মানব জিনোম প্রকল্প

মানব বংশাণুসমগ্র প্রকল্প বা মূল ইংরেজিতে হিউম্যান জিনোম প্রজেক্ট (এইচজিপি) একটি আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক গবেষণা প্রকল্প। এই প্রকল্পে মানুষের ডিএনএর নিউক্লিওটাইড ভিত্তি জোড় অনুক্রমের (বেস পেয়ার সিকোয়েন্স) বের করার জন্য শুরু করা হয়। একই সাথে দৈহিক এবং কাজের দিক থেকে সকল বংশাণুর মানচিত্রণ এবং তা শনাক্ত করা এই প্রকল্পের অন্যতম লক্ষ্য ছিল। [১] এখন অব্দি বিশ্বের সবচেয়ে বড় একসাথে দলগতভাবে করা জীববৈজ্ঞানিক প্রকল্প এটি।[২] ১৯৮৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকার এই ধারণা প্রথম নিয়ে আসলেও প্রকল্পটি সত্যিকার অর্থে শুরু হয় ১৯৯০ সালে এবং শেষ হয় ২০০০ সালে। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব হেলথ (এনআইএইচ)-এর মাধ্যমে প্রকল্পটির অর্থায়ন করা হয়। এছাড়াও বিশ্বজুড়ে একাধিক গবেষক দল এই কাজে সম্পৃক্ত ছিল। একই সময়ে সেলেরা কর্পোরেশন, বর্তমানে সেলেরা জেনেটিক্স একই ধরনের প্রকল্পে হাত লাগায়, যা ১৯৯৮ সালে শুরু হয়। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও জাপান, ফ্রান্স, জার্মানি, চীন ও কানাডার মোট ২০টি বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা কেন্দ্রে এই প্রকল্পেজেকাজ চলে।[৩][তথ্যসূত্র প্রয়োজন]

লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চির ভিটুরিভীয় মানব, এইহজিপির লোগো

বর্ণনা

ইতিহাস

মানব বংশাণুসমগ্র প্রকল্প একটি ১৫ বছরব্যাপী সরকারি অর্থায়নে সম্পাদিত প্রকল্প। এই প্রকল্পের মূল লক্ষ্য ছিল ১৫ বছরের মধ্যে মানুষের সম্পূর্ণ ডিএনএ অনুক্রম বের করা।[৪] ১৯৮৫ সালের মে মাসে, রবার্ট সিনশাইমার একটি কর্মশালায় মানব বংশাণুসমগ্রের অনুক্রম নির্ণয় করার আলোচনা করেন।[৫] তবে একাধিক কারণে ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব হেলথ এই প্রকল্পে আগ্রহী ছিল না। একই বছরের মার্চে, স্যান্টা ফে কর্মশালায় চার্লস ডেলিসি এবং ডেভিড স্মিথ এই ধারণাটি নিয়ে আলোচনা করেন।[৬] একই সময় একটি বিজ্ঞান রচনায় রেনাটো ডুলবেকো সম্পূর্ণ বংশাণুসমগ্রের অনুক্রম নির্ণয়ের কথা উল্লেখ করেন।[৭] দুই মাস পরে জেমস ওয়াটসন কোল্ড স্প্রিং হারবর ল্যাবরেটরিতে এই ব্যাপারে একটি কর্মশালা পরিচালনা করেন। 

ফলাফল

২০০১ সালের খসড়া ও ২০০৪ সালের পূর্ণাঙ্গ ওনুক্রম থেকে নিম্নোক্ত তথ্যের ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায়:

  1. অন্যান্য স্তন্যপায়ীর সাথে মানুষের প্রোটিন-সংকেতায়ন সংখ্যা মিলে যায়। প্রায় ২২ হাজার ৩০০টি প্রোটিন সংকেতায়নকারী বংশাণু মানুষের রয়েছে।[৮]
  2. মানব বংশাণু পূর্বের করা ধারণার চেয়েও বেশি একে অপরের সাথে মিলে বা আইডেন্টিকাল।[৯][১০][১১]
  3. খসড়া প্রকাশিত হওয়ার সময়কাল পর্যন্ত মেরুদন্ডী প্রাণীর জন্য নির্দিষ্ট ৭ শতাংশের চেয়েও কম প্রোটিন ফ্যামিলি এতে পাওয়া গেছে।[১২]

অর্জন

লন্ডনের ওয়েলকাম কালেকশনে প্রদর্শনরত প্রথম গ্রন্থ আকারে প্রকাশিত মানব বংশাণুসমগ্রের মুদ্রিত রূপ

১৯৯০ সালে মানুষের বংশাণুর তিন বিলিয়নের বেশি রাসায়নিক সাংগঠনিক উপাদানের বিন্যাস ও সনাক্তকরণের পদক্ষেপ হিসেবে মানব বংশাণুসমগ্র প্রকল্প শুরু করা হয়। এতে করে বিভিন্ন রোগের বংশগত উৎস এবং এসব রোগের চিকিৎসা খুঁজে বের করার প্রয়াস চালানো যাওয়ার সুযোগ থাকে। মানুষের বংশাণুসমগ্রে প্রায় ৩৩০ কোটি ভিত্তিজোড় আছে, এটা বিবেচনায় নিয়ে এই প্রকল্পকে একটি মহাপ্রকল্প হিসেবে হাতে নেয়া হয়েছিল। বংশাণুসমগ্র বিন্যাস হাতে আসার সাথে পরবর্তী ধাপ ছিল ঠিক কোন সব বিন্যাস সাধারণভাবে বহুল প্রচলিত রোগ যেমন বহুমূত্র বা ক্যান্সার হয় এবং এসবে চিকিৎসাপদ্ধতি বের করা।[১৩][১৪]

সেই আমলে প্রতিটি রোগীর আলাদা আলাদাভাবে বংশাণু বিন্যাস করা অনেক খরচের ব্যাপার ছিল। তাও ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব হেলথ একটি সহজ রাস্তা খুঁজে বের করে। তারা শুধুমাত্র সেসমস্ত অংশ খুঁজে বের করে যে অংশগুলোতে বেশিরভাগ ভিন্নতা রয়েছে। যেহেতু বেশিরভাগ প্রচলিত রোগই সাধারণ, তাই মনে করা হয়েছিল, বংশাণুর সাধারণ অংশটুকুতেই এর এসব রোগের কারণ খুঁজে পাওয়া যাবে। ২০০২ সালে ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব হেলথ ইউরোপীয়ান, পশ্চিম এশিয়ান এবং আফ্রিকান মানুষের সাধারণ ভিন্নতা খুঁজে পেতে হ্যাপম্যাপ প্রজেক্ট হাতে নিয়েছে।[১৫]

সম্পূর্ণ মানব বংশাণুসমগ্র প্রায় ১৫০,০০০ ভিত্তিজোড় দৈর্ঘ্যে ছোট ছোট অংশে ভাঙ্গা হয়।[১৪] এই টুকরগুলো ব্যাক্টেরিয়াল কৃত্রিম ক্রোমোজোম ভেক্টর দ্বারা জোড়া লাগানো হয়। এই ব্যাক্টেরিয়াল কৃত্রিম ক্রোমজোম বংশাণু প্রকৌশল পদ্ধতির মাধ্যমে নকশা করা হয়। এই ভেক্টর বহন করা ক্রোমোজমকে ব্যাক্টেরিয়ার প্রবেশ করা হয়। এতে ডিএনএ রেপ্লিকেশন পদ্ধতিতে ব্যাক্টেরিয়া বংশাণুগুলির কপি প্রস্তুত করে। এই সমস্ত ছোট ছোট টুকরোগুলো "শটগান" প্রজেক্টের মাধ্যমে আলাদা আলাদাভাবে সিকুএন্সিং করা হয় এবং সারিবদ্ধ করা হয়।[১৬][১৭]

সম্পূর্ণ প্রকল্পের খরচ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকার, মার্কিন যুক্তরাজ্যের একটি দাতব্য সংস্থা- দি ওয়েলকাম ট্রাস্ট এবং সারাবিশ্বের একাধিক সংস্থা বহন করে।[১৮][১৯]

জাতিসংঘের ইউনেস্কো বিভিন্ন দেশের অংশগ্রহণে মানব বংশাণুসমগ্র প্রকল্প সম্পন্ন করতে বিস্তর ভূমিকা রাখে।[২০]

উন্নতি

প্রাপ্ত বংশাণুসমগ্র উপাত্তের ব্যাখ্যা এবং গবেষণা এখনো প্রাথমিক পর্যায়েই আছে। তবে একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য চিকিৎসা ও জীবপ্রকৌশলীতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম। মানব বংশাণুসমগ্র প্রকল্প সম্পূর্ণভাবে শেষ হওয়ার আগেই এরকম ধারণার স্বপক্ষে যুক্তি পাওয়া গেছে। মিরিয়াড জিনেটিক্সের মতো একটি কোম্পানি ইতিমধ্যেই বংশাণু পরীক্ষা ব্যক্তিগত পর্যায়ে শূরু করেছে। এর মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের রোগ যেমন স্তন ক্যান্সার, যকৃতের অসুখ, তঞ্চন জটিলতা ইত্যাদির ঝুঁকি আগে থেকেই সনাক্ত করা যায়। এছাড়াও ক্যান্সার, আলঝেইমারের মতো রোগের কারণ খুঁজে পাওয়া সুযোগ অনেক উঁচু মাত্রায় বেড়ে গেছে।[১৫][২১][২২]

বিবর্তনের গবেষণায় বিভিন্ন প্রাণীর ডিএনএ অনুক্রম নির্ণয় নতুন সম্ভাবনার দিগন্ত খুলে দিয়েছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে, বিবর্তন সংক্রান্ত প্রশ্নে আণবিক জীববিজ্ঞান ফ্রেমে অনেক প্রশ্নেরই উত্তর দেয়া সম্ভব। রাইবোসম, বিভিন্ন অঙ্গাণুর উন্নতি, ভ্রুণের উন্নয়ন এবং মেরুদণ্ডী প্রাণীর রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ইত্যাদির বিবর্তনীয় দিক নিয়ে বিশদ আলোচনার সুযোগ করে দেয়।[১৫][২৩]

উদাহরণস্বরূপ, ট্রিটিয়াম এস্টিভিয়ামের বংশাণুগত গঠনের উপর করা গবেষণা থেকে গাছের বিবর্তনে গৃহস্থালীর প্রভাব নিয়ে গভীর জ্ঞান অর্জিত হয়েছে।[২৪] এরকম বিবর্তনের জন্য ঠিক কোন লোসাই সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছে, এসব যাচাই বাছাইয়ের ক্ষেত্রে বংশাণুগত অনুক্রম নির্ণয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

নীতি, আইনগত এবং সামাজিক ইস্যু

মানব বংশাণুসমগ্র প্রকল্প নিয়ে একাধিক নীতিগত, আইনত এবং সামাজিক দুশ্চিন্তা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিল। বিশেষ করে, বংশাণুগ সংকেতের ভিত্তিতে মানুষের মাঝে বৈষম্য সৃষ্টির একটি সম্ভাবনা তৈরি হয়। সবচেয়ে বেশি রকমের আশঙ্ককা করা হয় স্বাস্থ্য বীমা নিয়ে। মানুষের মাঝে এই আশঙ্কা জন্মে যে, বংশাণুগত সংকেতের মাধ্যমে কোন নির্দিষ্ট রোগের সম্ভাবনা থাকলে ব্যক্তিকে স্বাস্থ্য বীমার সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা বা এই সেবা থেকে বৈষম্য করার হার বেড়ে যাবে।[২৫] ১৯৯৬ সালে এই কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কোন ব্যক্তির নিজস্ব অনুমতি ছাড়া তাকে সনাক্ত করা যায় এরকম বংশাণূগত তথ্য চিকিৎসার্থে বা চিকিৎসাসেবা সংক্রান্ত কাজে ব্যবহারের নিমিত্ত হস্তান্তর বা প্রচার নিষিদ্ধ করা হয়।[২৬] বৈজ্ঞানিক গবেষণায় এই প্রকল্প বিশাল অবদান রাখলেও কিছু লেখকের মতে, এই অনুক্রম নির্ণয় সামাজিকভাবে যে চাপ তৈরি করেছে তার প্রতি আলোকপাত করেছেন। তাদের মতে, "রোগের আণবিক দিক তুলে ধরে চিকিৎসা সম্পন্ন করার প্রক্রিয়ার যে নতুন ধারণা তৈরি হয়েছে তা নতুন প্রজন্মের ডাক্তারদের প্রতি রোগীদের উচ্চাকাঙ্ক্ষার তৈরি করে।[২৭]

তথ্যসূত্র

🔥 Top keywords: রাম নবমীমুজিবনগর দিবসপ্রধান পাতামুজিবনগর সরকারবিশেষ:অনুসন্ধানইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগএক্স এক্স এক্স এক্স (অ্যালবাম)বাংলাদেশবাংলা ভাষামিয়া খলিফারাজকুমার (২০২৪-এর চলচ্চিত্র)আনন্দবাজার পত্রিকাআবহাওয়ারামপহেলা বৈশাখউয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগইসরায়েলইরানরবীন্দ্রনাথ ঠাকুরমুজিবনগরইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউনরিয়াল মাদ্রিদ ফুটবল ক্লাব২০২৪ ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগক্লিওপেট্রাচর্যাপদভূমি পরিমাপশেখ মুজিবুর রহমানজনি সিন্সকাজী নজরুল ইসলামঈদুল আযহাফিলিস্তিনইউটিউবভারতবিকাশআসসালামু আলাইকুমসৌদি আরববাংলা প্রবাদ-প্রবচনের তালিকামুহাম্মাদ