রাজস্ব নীতি

রাজস্ব নীতি বলতে একটি দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক কার্যকলাপের উপর প্রভাব বিস্তারকারী উপাদনসমূহ নিয়ন্ত্রণের কৌশলকে বুঝায়। অন্যভাবে বলা যায়, একটি দেশের সরকারের আয় এবং ব্যয় ব্যবস্থাপনার কলা-কৌশলকে রাজস্ব নীতি বলে। সামষ্টিক অর্থনৈতিক কার্যকলাপ পরিচলনা ও নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকার রাজস্ব নীতি প্রণয়ন করে। সরকার নির্দিষ্ট অর্থবছরের নির্ধারিত ব্যয় সমন্বয় করার উদ্দেশে রাজস্ব বা আয় নিরূপণ করে।[১] অর্থাৎ, সরকার প্রথমে ব্যয় নির্ধারণ করে এবং নির্ধারিত ব্যয়ের সাথে সমন্বয় করে রাজস্ব বা আয় নির্ধারণ করে। সাধারণত জাতীয় বাজেটে সরকারের রাজস্ব নীতির প্রয়োগ ঘটে থাকে। জাতীয় বাজেট হচ্ছে দেশের সরকার প্রণীত রাষ্ট্রের বাৎসরিক আয়-ব্যয়ের পরিকল্পনা যেটি প্রতিবেদন বা দলিল আকারে প্রকাশ করা হয়। মূলত, সরকারি রাজস্ব বা আয় এবং ব্যয় নিরূপণ ও বাজেট প্রণয়ন সম্পর্কিত নীতিই রাজস্ব নীতি হিসেবে পরিচিত। রাজস্ব নীতির মূল লক্ষ্য জনকল্যাণ।[২][৩][৪]

যেহেতু রাজস্ব নীতি বলতে একটি দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক কার্যকলাপ এর উপর প্রভাব বিস্তারকারী উপাদান সমূহ নিয়ন্ত্রণের কৌশলকে বুঝায়

রাজস্ব নীতির লক্ষ্য

দেশ বা সরকারভেদে রাজস্ব নীতির ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। তবে দেশ-সরকার নির্বিশেষে সকল রাজস্ব নীতির মূল লক্ষ্য বা উদ্দেশ্যই জনকল্যাণ। আর এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার উন্নয়ন, জাতীয় আয়ের সঠিক ব্যবহার এবং নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি নিশ্চিত করা অপরিহার্য। ফলে উক্ত সামষ্টিক অর্থনৈতিক উপাদানসমূহের সঠিক ব্যবস্থাপনাই রাজস্ব নীতির লক্ষ্য হিসেবে বিবেচ্য।[৫][৬]

রাজস্ব নীতির ধরন

রাজস্ব নীতি কেমন হবে সেটি নির্ভর করে দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক অবস্থার উপর। পরিস্থিতি বিবেচনায় সরকার রাজস্ব নীতি নির্ধারণ করে থাকে অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় ব্যয় ও রাজস্ব নির্ধারণ করে থাকে। রাজস্ব নীতি সাধারণত নিম্নোক্ত ধরনের হয়ে থাকে-[৭][৮]

  • নিরপেক্ষ রাজস্ব নীতি: সাধারণত অর্থনৈতিক অবস্থা যখন স্থিতিশীল থাকে তখন নিরপেক্ষ রাজস্ব নীতি অবলম্বন করা হয় অর্থাৎ যখন অর্থনৈতিক প্রসার বা অর্থনৈতিক মন্দা কোনটাই ঘটে না। এক্ষেত্রে সরকারের রাজস্ব এবং ব্যয় প্রায় সমান থাকে এবং অর্থনৈতিক কার্যকলাপের উপর রাজস্ব নীতির আলাদা কোন প্রভাব থাকে না বরং নিরপেক্ষ থাকে।
  • সম্প্রসারণমূলক রাজস্ব নীতি: সাধারণত অর্থনৈতিক মন্দা চলাকালে সরকার অর্থনৈতিক চক্র সংকোচন মোকাবেলায় এই নীতি অনুসরণ করে থাকে। এক্ষেত্রে সরকার রাজস্ব আয়ের থেকে ব্যয় বেশি করে। বিশেষ করে জনসাধারণের সুবিধায় ব্যবহার্য অবকাঠামো নির্মাণ ও উন্নয়ন এবং ক্ষেত্রবিশেষ প্রণোদনা দিয়ে থাকে। সেই সাথে কর হার কমিয়ে দেয় যাতে জনসাধারণের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। রাজস্ব নীতির জাতীয় বাজেটভিত্তিক প্রয়োগ বিবেচনায় এক্ষেত্রে ঘাটতি বাজেট প্রণয়ন করা হয়।
  • সংকোচনমূলক রাজস্ব নীতি: এই ধরনের রাজস্ব নীতি সরকার সাধারণত মুদ্রাস্ফীতির চাপ সামাল দিতে গ্রহণ করে থাকে। এক্ষেত্রে সরকার হয় কর হার বাড়িয়ে দেয় অথবা সামগ্রিক সরকারী ব্যয় কমাতে চায় অথবা উভয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে। কর হার বৃদ্ধি পেলে জনসাধারণের তথা ব্যবসায়ীদের খরচযোগ্য আয় কমে যায়। অন্যদিকে সরকারের ব্যয় কমে গেলে সেটা মোট দেশজ উৎপাদনে সরাসরি প্রভাব ফেলে অর্থাৎ মোট দেশজ উৎপাদনে কমে যায়। এতে মুদ্রাস্ফীতির উপর চাপ কমে কিন্তু সেই সাথে বেকারত্ব বেড়ে যায়।

রাজস্ব নীতির হাতিয়ারসমূহ

যেহেতু জাতীয় বাজেটেই রাজস্ব নীতির প্রতিফলন ঘটে থাকে, সেহেতু রাজস্ব নীতির হাতিয়ার বা রাজস্ব নীতি অর্থায়নের মাধ্যম বলতে আসলে বাজেট অর্থায়নের হাতিয়ার বা মাধ্যমগুলোকে বুঝানো হয়। সাধারণত বাজেটের অর্থায়ন হয় নিম্নোক্ত উৎস থেকে-[৯]

সরকারি রাজস্ব

বাজেটের অর্থায়নের মূল উৎস হচ্ছে সরকারের বিভিন্ন রাজস্ব বা আয়। সরকারি রাজস্বকে সাধারণত দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যথা:

  • কর রাজস্ব: কর রাজস্বের মধ্যে আছে আয়কর, মূল্য সংযোজন কর, বাণিজ্য শুল্ক, আবগারী শুল্ক, সম্পূরক শুল্ক, ভুমি রাজস্ব, নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প এবং অন্যান্য করসমুহ। কর রাজস্বই সরকারের আয়ের অন্যতম উৎস। সরকারি আয়ের সিংহভাগই আসে বিভিন্ন রকমের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ কর থেকে।
  • কর-বহির্ভূত রাজস্ব: কর বহির্ভূত রাজস্বের মধ্যে আছে সরকারি প্রতিষ্ঠান হতে লভ্যাংশ ও মুনাফা, সরকার প্রদত্ত ঋণের থেকে প্রাপ্ত সুদ, সরকারি সেবা খাত থেকে প্রাপ্ত আয় এবং বিভিন্ন দণ্ড ও জরিমান থেকে প্রাপ্ত অর্থ। এছাড়াও আরও কিছু ক্ষেত্র থেকে সরকার রাজস্ব আদায় করে থাকে।

ঋণগ্রহণ

সরকার ঘাটতি বাজেট অর্থায়নের জন্য দেশ অথবা বিদেশ থেকে ঋণ গ্রহণ করে থাকে। দেশীয় উৎস থেকে সাধারণত ট্রেজারি বিল, সরকারি বিভিন্ন মেয়াদী সিকিউরিটিজ এবং বন্ডসমূহ বিক্রি করে ঋণ নেয় হয়। অন্যদিকে, বিদেশি ঋণ সাধারণত বিভিন্ন দাতাসংস্থা যেমন- বিশ্ব ব্যাংকইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স কর্পোরেশন অথবা বিদেশি সরকারের কাছ থেকে গ্রহণ করা হয়। দেশি-বিদেশি উভয়ক্ষেত্রেই সরকারকে উক্ত ঋণের বিপরীতে নির্দিষ্ট পরিমান সুদ দিতে হয়।

অনুদান

ক্ষেত্রবিশেষ সরকার ঘাটতি বাজেট অর্থায়নের জন্য বিদেশি অনুদান গ্রহণ করে থাকে। সাধারণত উন্নত দেশসমুহ অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশসমূহকে অনুদান দিয়ে থাকে। তবে, এই অনুদান শুধুমাত্র নগদ অর্থের মাধ্যমেই হয় না বরং অন্য অনেক উপায়ে হতে পারে।

পূর্ববর্তী উদ্বৃত্ত বাজেট থেকে অর্থায়ন

সরকার পূর্ববর্তী উদ্বৃত্ত বাজেটের অর্থ থেকে পরবর্তী বছরের বাজেট অর্থায়ন করতে পারে। অর্থাৎ পূর্ববর্তী কোন অর্থবছরের বাজেটের যে অর্থ উদ্বৃত্ত হিসেবে ছিল সেই অর্থ ঘাটতি বাজেটে ব্যবহার করে থাকে। যদিও এই ধরনের অর্থায়ন সাধারণত দেখা যায় না।[১০] কারণ সব দেশের সরকারই বাজেটের একটা ধারা অব্যাহত রাখতে চেষ্টা করে। যেমন কোন কোন দেশের সরকার ঘাটতি বাজেট দেয় বিদেশি অনুদানের ও অন্যান্য সুবিধা পাবার আশায় এবং এই ধারা অনেক বছর অব্যহত রাখে। আবার খুব কম দেশই উদ্বৃত্ত বাজেট নীতি অনুসরণ করে। যেহেতু সরকার কোন লাভজনক সংস্থা নয় তাই তার ব্যয় থেকে আয় বেশি হবার প্রয়োজন পরে না বরং প্রয়োজনে ভারসাম্যপূর্ণ বাজেট করে থাকে।

স্থায়ী সম্পদের বিক্রয়

বিশেষ ক্ষেত্রে সরকার ঘাটতি বাজেট অর্থায়নের জন্য সরকারি স্থায়ী সম্পদ বিক্রয় করতে পারে। যদিও এ ধরনের অর্থায়ন খুব একটা দেখা যায় না।

রাজস্ব নীতির অর্থনৈতিক প্রভাব

দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক কার্যকলাপের উপর প্রভাব বিস্তারের জন্য সরকার রাজস্ব নীতির ব্যবহার করে থাকে। ফলে অর্থনীতিতে রাজস্ব নীতির গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রয়েছে। সরকার বিশেষ করে সামগ্রিক চাহিদাকে প্রভাবিত করে নির্দিষ্ট কিছু অর্থনৈতিক লক্ষ্য অর্জন করতে চায়। এসব লক্ষ্যের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে-[১১][১২]

  • মূল্য স্থিতিশীলতা- একটি দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে মূল্য স্থিতিশীলতা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ নিয়ামক। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেলে দেশের জনগনের বিশেষ করে মধ্যবিত্ত ও নিন্ম আয়ের মানুষের জীবনযাত্রায় খরচ বেড়ে যায়। কিন্তু এই সময়ে তাদের আয়ের পরিবর্তন হয় না অর্থাৎ মানুষের হাতে খরচযোগ্য আয় একই থাকে। তখন হয় তাকে ভোগ কমাতে হবে না হয় তুলনামূলক কম মানের পণ্য ব্যবহার করতে হবে। এতে তার জীবনযাত্রায় মান কমে যাবে। এজন্য সব দেশের সরকারই চায় মূল্যস্তর স্থিতিশীলতা রাখতে। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য সরকার সাধারণত সংকোচনমূলক রাজস্ব নীতি গ্রহণ করে থাকে যাতে মুদ্রাস্ফীতির অতিমাত্রায় বেড়ে না যায় এবং মূল্যস্তরও স্থিতিশীল থাকে।[১৩]
  • সম্পূর্ণ কর্মসংস্থান- সরকার চায় তার দেশের সকল নাগরিকদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে যেটাকে অর্থনীতির ভাষায় সম্পূর্ণ বা পূর্ণ কর্মসংস্থান বলে। যদিও বাস্তবে সম্পূর্ণ কর্মসংস্থান বা ১০০ শতাংশ কর্মসংস্থান সম্ভব হয় না। তবুও প্রতিটা সরকার চায় সর্বোচ্চ সংখ্যক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করেতে এবং সে অনুযায়ী রাজস্ব নীতি গ্রহণ করে থাকে।
  • অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি- অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধারা বৃদ্ধি এবং অব্যাহত রাখাই সরকারের গৃহীত সকল অর্থনৈতিক নীতির মুখ্য উদ্দেশ্য। অর্থাৎ দেশের অর্থনীতিতে পণ্য ও সেবার উৎপাদন বৃদ্ধি করা।

সর্বোপরি, সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রণীত মুদ্রানীতির সাথে সমন্বয় করে রাজস্ব নীতি গ্রহণ করে যাতে সামষ্টিক অর্থনৈতিক উদ্দেশ্যগুলি অর্জন বিশেষকরে মোট দেশজ উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি মুদ্রানীতির উদ্দেশ্য যেমন মুদ্রাস্ফীতি ও সুদের হার নিয়ন্ত্রণে রেখে দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন সাধিত হয়।[১৪]

তথ্যসূত্র

বহিঃসংযোগ

🔥 Top keywords: রাম নবমীমুজিবনগর দিবসপ্রধান পাতামুজিবনগর সরকারবিশেষ:অনুসন্ধানইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগএক্স এক্স এক্স এক্স (অ্যালবাম)বাংলাদেশবাংলা ভাষামিয়া খলিফারাজকুমার (২০২৪-এর চলচ্চিত্র)আনন্দবাজার পত্রিকাআবহাওয়ারামপহেলা বৈশাখউয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগইসরায়েলইরানরবীন্দ্রনাথ ঠাকুরমুজিবনগরইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউনরিয়াল মাদ্রিদ ফুটবল ক্লাব২০২৪ ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগক্লিওপেট্রাচর্যাপদভূমি পরিমাপশেখ মুজিবুর রহমানজনি সিন্সকাজী নজরুল ইসলামঈদুল আযহাফিলিস্তিনইউটিউবভারতবিকাশআসসালামু আলাইকুমসৌদি আরববাংলা প্রবাদ-প্রবচনের তালিকামুহাম্মাদ