রুশ–জাপান যুদ্ধ

বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে রাশিয়া ও জাপানের মধ্যকার যুদ্ধ

রুশ–জাপান যুদ্ধ (রুশ: Русско-японская война, রুস্কো-ইয়াপোনস্কায়া ভয়না; জাপানি: 日露戦争, নিচিরোসেনসো; ১৯০৪–১৯০৫) বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে রাশিয়া এবং জাপানের মধ্যে সংঘটিত হয়েছিল। এই যুদ্ধের প্রধান কারণ ছিল মাঞ্চুরিয়াকোরিয়ায় দেশ দুইটির বিপরীতমুখী সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ। যুদ্ধটি মূলত দক্ষিণ মাঞ্চুরিয়ার লিয়াওদং উপদ্বীপ ও মুকদেনে, কোরিয়া ও জাপানের সীমান্তবর্তী সাগরসমূহে এবং পীত সাগরে সংঘটিত হয়েছিল।

রুশ–জাপান যুদ্ধ

ঘড়ির কাঁটার দিক অনুযায়ী ওপর থেকে নিচে: পোর্ট আর্থার অবরোধের সময় রুশ ক্রুজার পাল্লাদা; মুকদেনের যুদ্ধের সময় রুশ অশ্বারোহী সৈন্যবাহিনী; চেমুলপো উপসাগরের যুদ্ধের সময় রুশ ক্রুজার ভারিয়াগ এবং রুশ গানবোট কোরিয়েৎজ; পোর্ট আর্থারে মৃত জাপানি সৈন্য; ইয়ালু নদীর যুদ্ধের সময় জাপানি পদাতিক সৈন্যবাহিনী
তারিখ৮ ফেব্রুয়ারি ১৯০৪ – ৫ সেপ্টেম্বর ১৯০৫
অবস্থান
ফলাফল

জাপানি বিজয়

অধিকৃত
এলাকার
পরিবর্তন
রাশিয়া কোয়ান্টাং ইজারা অঞ্চল ও দক্ষিণ শাখালিন জাপানের নিকট হস্তান্তর করে
বিবাদমান পক্ষ
জাপানের সাম্রাজ্য জাপান

রুশ সাম্রাজ্য রাশিয়া

মন্টিনেগ্রোর হ্মুদ্র রাজ্য মন্টেনিগ্রো[১]
সেনাধিপতি ও নেতৃত্ব প্রদানকারী
  • জাপানের সাম্রাজ্য সম্রাট মেইজি
  • জাপানের সাম্রাজ্য ওইয়ামা ইওয়াও
  • জাপানের সাম্রাজ্য কোদামা জেনতারো
  • জাপানের সাম্রাজ্য নোগি মারেসুকে
  • জাপানের সাম্রাজ্য কুরোকি তামেমোতো
  • জাপানের সাম্রাজ্য তোগো হেইহাচিরো
 আত্মসমর্পণকারী
শক্তি

জাপানের সাম্রাজ্য ১২,০০,০০০ সৈন্য (সর্বমোট)[২]

  • ৬,৫০,০০০ সৈন্য (মোতায়েনকৃত সর্বোচ্চ)

রুশ সাম্রাজ্য ১৩,৬৫,০০০ সৈন্য (সর্বমোট)[৩]

  • ৭,০০,০০০ সৈন্য (মোতায়েনকৃত সর্বোচ্চ)
হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতি
জাপানের সাম্রাজ্য
  • ৪৭,১৫২–৪৭,৪০০ সৈন্য নিহত
  • ১১,৪২৪–১১,৫০০ সৈন্য আঘাতপ্রাপ্তির ফলে মৃত
  • ২১,৮০২–২৭,৩০০ সৈন্য রোগের কারণে মৃত[৪][৫]
রুশ সাম্রাজ্য
  • ৩৪,০০০–৫২,৬২৩ সৈন্য নিহত অথবা আঘাতপ্রাপ্তির ফলে মৃত
  • ৯,৩০০–১৮,৮৩০ সৈন্য রোগের কারণে মৃত
  • ১,৪৬,০৩২ সৈন্য আহত
  • ৭৪,৩৬৯ সৈন্য যুদ্ধবন্দি[৪][৫]

নৌবাহিনী এবং সামুদ্রিক বাণিজ্যের জন্য রাশিয়ার প্রশান্ত মহাসাগরে একটি উষ্ণ-জলীয় বন্দর প্রয়োজন ছিল। ভ্লাদিভোস্তক কেবল গ্রীষ্মকালে কার্যোপযোগী থাকত, কিন্তু পোর্ট আর্থার (চীনের লিয়াওদং প্রদেশের একটি নৌঘাঁটি, যেটি রাশিয়াকে ইজারা দেয়া হয়েছিল) সারা বছরই কার্যোপযোগী থাকত। এদিকে ১৮৯৫ সালে প্রথম চীন-জাপান যুদ্ধের অবসানের পর থেকেই জাপান তার নিজস্ব 'প্রভাবক্ষেত্রে' রুশ হস্তক্ষেপের আশঙ্কা করে আসছিল। কারণ, রাশিয়া ষোড়শ শতাব্দীতে জার চতুর্থ ইভানের শাসনকাল থেকেই সাইবেরিয়ার দূর প্রাচ্যে সম্প্রসারণবাদী নীতি অনুসরণ করে আসছিল[৬]। রুশ সম্প্রসারণের ভয়ে জাপান মাঞ্চুরিয়ায় রুশ আধিপত্য স্বীকার করে নেয়ার বিনিময়ে কোরিয়ায় জাপানি আধিপত্য স্বীকার করে নেয়ার জন্য রাশিয়াকে প্রস্তাব দেয়। কিন্তু রাশিয়া এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে এবং ৩৯তম অক্ষরেখার উত্তরে কোরিয়ার যে অংশ অবস্থিত সেই অংশটিকে রাশিয়া ও জাপানের মধ্যে 'নিরপেক্ষ এলাকা' বা 'বাফার জোন' হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের দাবি জানায়। জাপানি সরকার রাশিয়াকে নিজেদের কৌশলগত স্বার্থের প্রতি হুমকি হিসেবে বিবেচনা করতে থাকে এবং যুদ্ধ শুরু করার জন্য প্রস্তুত হয়। ১৯০৪ সালে রাশিয়া ও জাপানের মধ্যে আলোচনা ব্যর্থ হওয়ার পর জাপানি নৌবাহিনী অতর্কিতভাবে পোর্ট আর্থারে রুশ পূর্বাঞ্চলীয় নৌবহরের ওপর আক্রমণ চালায়।

রাশিয়া একের পর এক যুদ্ধে জাপানের কাছে পরাজিত হতে থাকে, কিন্তু রাশিয়ার জার দ্বিতীয় নিকোলাসের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, শেষ পর্যন্ত রাশিয়াই যুদ্ধে বিজয়ী হবে। এজন্য তিনি রাশিয়াকে যুদ্ধে লিপ্ত রাখেন, প্রথমে কয়েকটি নৌযুদ্ধের ফলাফল দেখার জন্য এবং পরে একটি 'অসম্মানজনক সন্ধি' এড়িয়ে রাশিয়ার সম্মান বাঁচানোর জন্য। শেষ পর্যন্ত মার্কিন রাষ্ট্রপতি থিওডোর রুজভেল্টের মধ্যস্থতায় পোর্টসমাথের চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে এই যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে।

এই যুদ্ধে জাপানি সামরিক বাহিনীর পরিপূর্ণ বিজয় পর্যবেক্ষকদের হতবাক করে দেয়। এই যুদ্ধের ফলাফল পূর্ব এশিয়ায় ক্ষমতার ভারসাম্য বদলে দেয়, এবং বিশ্ব রাজনীতির মঞ্চে জাপানের সাম্প্রতিক প্রবেশের পুনর্মূল্যায়ন ঘটায়। এটি ছিল আধুনিক যুগে কোনো ইউরোপীয় শক্তির বিরুদ্ধে একটি এশীয় শক্তির প্রথম বড় ধরনের সামরিক বিজয়। পণ্ডিতরা এখনো এই যুদ্ধের ঐতিহাসিক তাৎপর্য নিয়ে বিতর্ক করে যাচ্ছেন।

ঐতিহাসিক পটভূমি

রুশ–জাপান যুদ্ধের সময়ে কেইও বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন জাপানি ছাত্রের তৈরি একটি রুশ-বিরোধী হাস্যরসাত্মক মানচিত্র

১৮৬৮ সালে 'মেইজি পুনর্গঠন'-এর পর জাপানি সরকার পশ্চিমা আদর্শ, প্রযুক্তিগত উন্নতি এবং যুদ্ধকৌশল আত্মীকরণের প্রচেষ্টা চালায়। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে জাপান একটি আধুনিক শিল্পোন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হয়। জাপানিরা পশ্চিমা শক্তিগুলোর সঙ্গে সমতা অর্জনে আগ্রহী ছিল। মেইজি সরকার সবসময়ই জাপানকে একটি আধুনিক রাষ্ট্রে পরিণত করতে চাইত, কিন্তু পাশ্চাত্য ভাবধারার অনুসারী করতে চায় নি। আর জাপান সবসময়ই একটি সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ছিল এবয সাগর পেরিয়ে সাম্রাজ্য বিস্তার করতে বিশেষভাবে আগ্রহী ছিল[৭]। ১৮৬৯ থেকে ১৮৭৩ সালে জাপানি অভিজাত সম্প্রদায় সেইকান রোন বা কোরিয়া অধিকার বিতর্ক নিয়ে দারুণভাবে বিভক্ত ছিল। তাদের একাংশ তাৎক্ষণিকভাবে কোরিয়া জয় করতে চাইছিল, এবং অপর অংশ জাপান আরো উন্নত হওয়ার আগ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে চাইছিল। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো, জাপানি অভিজাতদের কেউই কোরীয়দের স্বাধীন থাকার অধিকার স্বীকার করতে রাজি ছিল না। তাদের মধ্যে বিভেদের একমাত্র কারণ ছিল কোরিয়া দখলের সময়সূচি[৮]। ইউরোপীয়রা যেমন আফ্রিকাএশিয়ার পশ্চাৎপদতাকে আফ্রিকা ও এশিয়ায় তাদের সাম্রাজ্য বিস্তারের কারণ হিসেবে দেখিয়েছিল, ঠিক তেমনিভাবে জাপানি অভিজাতদেরও বিশ্বাস ছিল, কোরিয়া ও চীনের পশ্চাৎপদতা প্রমাণ করে যে তারা 'নিচু জাত' এবং এটি জাপানিদেরকে এসব ভূখণ্ড দখল করার 'অধিকার' দেয়[৯]। ১৮৮৭ সালে জাপানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইনোউয়ে কাওরু একটি ভাষণে বলেন যে, "আমাদের অবশ্য কর্তব্য হলো আমাদের সাম্রাজ্য এবং আমাদের জনগণকে পরিবর্তন করা, সাম্রাজ্যকে ইউরোপের দেশগুলোর মতো এবং জনগণকে ইউরোপের জনগণের মতো করে তোলা"। তিনি এমনকি এও বলেন যে চীনা এবং কোরীয়রা আধুনিকায়ন না করে নিজেদের স্বাধীন থাকার অধিকার হারিয়ে ফেলেছে[৯]। আধুনিকায়নের অংশ হিসেবে 'যোগ্যতমের জয়' সংক্রান্ত ডারউইনিয়ান মতবাদ ১৮৮০-এর দশকে জাপানে জনপ্রিয়তা অর্জন করে। এছাড়া অনেক সাধারণ জাপানি আধুনিকায়নের জন্য সরকার কর্তৃক চাপিয়ে দেয়া করের বোঝা নিয়ে ক্ষুদ্ধ ছিল এবং তাদের ত্যাগের বিনিময়ে 'সমুদ্রের ওপারে উপনিবেশ' জাতীয় প্রতিদানের দাবি জানায়[১০]। ১৮৮৪ সালে জাপান কোরিয়ায় একটি জাপানপন্থী সংস্কারবাদী দলকে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলে উৎসাহিত করে এবং এর ফলে কোরিয়ার রক্ষণশীল সরকার চীনের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করে। ফলশ্রুতিতে সিউলে চীনা ও জাপানি সৈন্যদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়[১১]। এসময় টোকিও চীনের সঙ্গে যুদ্ধে জড়ানোর জন্য নিজেকে প্রস্তুত মনে করছিল না, ফলে সঙ্কটটি তিন্তসিনের চুক্তির মাধ্যমে সমাপ্ত হয়। এই চুক্তির ফলে কোরিয়ায় চীনা আধিপত্য আরো বিস্তৃত হয়, যদিও এটি জাপানিদেরও কোরিয়ায় হস্তক্ষেপ করার অধিকার দেয়[১১]। ১৮৮০-এর দশকে এবং ১৮৯০-এর দশকের প্রথম দিকে জাপানি সরকার কোরিয়ায় 'যথেষ্ট আক্রমণাত্মক না হওয়া'র জন্য জাপানিদের দ্বারা তীব্রভাবে সমালোচিত হয়[১১]

তখনকার একটি বৃহৎ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি জারশাসিত রাশিয়ার প্রাচ্যে সাম্রাজ্য বিস্তারের উচ্চাভিলাষ ছিল। ১৮৯০-এর মধ্যে রাশিয়ার প্রভাব মধ্য এশিয়ার মধ্য দিয়ে আফগানিস্তান পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল এবং এ প্রক্রিয়ায় স্থানীয় রাষ্ট্রগুলো রাশিয়ায় অঙ্গীভূত হয়ে যায়। রুশ সাম্রাজ্য পশ্চিমে পোল্যান্ড থেকে পূর্বে কামচাতকা উপদ্বীপ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল[১২]। ভ্লাদিভোস্তক পর্যন্ত ট্রান্স-সাইবেরীয় রেলপথ নির্মাণের মাধ্যমে রাশিয়া এ অঞ্চলে তার প্রভাব এবং উপস্থিতির বিস্তৃতি ঘটানোর ইচ্ছা পোষণ করছিল। ১৮৬১ সালের 'শুশিমা ঘটনা'য় রাশিয়া সরাসরি জাপানি ভূখণ্ডে আগ্রাসন চালিয়েছিল।

চীন–জাপান যুদ্ধ (১৮৯৪–১৮৯৫)

১৮৯৪ সালের অক্টোবরে পিয়ংইয়ং-এ জাপানিদের কাছে চীনা জেনারেলদের আত্মসমর্পণ

'মেইজি পুনর্গঠন' এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণের মধ্যবর্তী সময়ে জাপান দুইটি গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধে অংশ নেয়। এদের মধ্যে প্রথমটি হলো ১৮৯৪ থেকে ১৮৯৫ সালে সংঘটিত প্রথম চীন–জাপান যুদ্ধ। যুদ্ধটি জোসেওন রাজবংশের শাসনাধীন কোরিয়ার ওপর নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্যের বিষয় নিয়ে সংঘটিত হয়। ১৮৮০-এর দশক থেকে কোরিয়ায় প্রভাব বিস্তারের জন্য চীন ও জাপানের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা চলতে থাকে[১৩]। কোরীয় রাজদরবার ছিল দলাদলিতে জর্জরিত, এবং এটি একটি জাপানপন্থী সংস্কারবাদী দল ও একটি চীনপন্থী তুলনামূলক রক্ষণশীল দলের মধ্যে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল[১৪]। ১৮৮৪ সালে চীনা সৈন্যরা কোরিয়ায় একটি জাপানপন্থী অভ্যুত্থান দমন করে, এবং সিউলে জেনারেল ইউয়ান শিকাই-এর অধীনে একটি 'রেসিডেন্সি' প্রতিষ্ঠিত হয়[১৩]। এরপর দংহাক ধর্মীয় আন্দোলনের নেতৃত্বাধীন একটি কৃষক বিদ্রোহ দমনের জন্য কোরীয় সরকার চীনকে সৈন্য প্রেরণের অনুরোধ জানায়[১৫]। প্রত্যুত্তরে জাপান বিদ্রোহ দমনের জন্য কোরিয়ায় নিজেদের একটি সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করে এবং সিউলে একটি পুতুল সরকার প্রতিষ্ঠা করে। চীন এর প্রতিবাদ জানায় এবং যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। যুদ্ধটি সংক্ষিপ্ত হয়, কারণ জাপানি স্থলবাহিনী দ্রুত লিয়াওদং উপদ্বীপে চীনা সৈন্যদেরকে পরাজিত করে এবং ইয়ালু নদীর যুদ্ধে জাপানি নৌবাহিনী চীনা নৌবহরকে প্রায় সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দেয়। যুদ্ধ শেষে চীন ও জাপানের মধ্যে শিমোনোসেকি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এবং এর ফলে চীন জাপানের কাছে লিয়াওদং উপদ্বীপ ও তাইওয়ান দ্বীপ সমর্পণ করে। শান্তি চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর রাশিয়া, জার্মানি এবং ফ্রান্স জাপানকে লিয়াওদং উপদ্বীপ থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করতে বাধ্য করে। জাপানি নেতাদের ধারণা ছিল যে, রাশিয়া, জার্মানি ও ফ্রান্সের সম্মিলিত শক্তির মোকাবেলা করার মতো সামর্থ্য তাঁদের নেই এবং তাই তাঁরা চরমপত্রের কাছে নতি স্বীকার করেন। একই সময়ে জাপানিরা কোরিয়ায় তাদের প্রভাব বিস্তারের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখে। ১৮৯৫ সালের ৮ অক্টোবর কোরিয়ার রানী মিয়েয়ংসেয়ং (যিনি ছিলেন কোরীয় রাজদরবারে জাপান-বিরোধী ও চীনপন্থী দলের নেত্রী) জিয়েওংবোকগাং প্রাসাদের অভ্যন্তরে জাপানি গুপ্তচরদের হাতে খুন হন। এ ঘটনাটি জাপানের জন্য লাভজনক না হয়ে উল্টো ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়, কারণ এ ঘটনার ফলে কোরীয় জনমত জাপানের বিরুদ্ধে চলে যায়[১৬]। ১৮৯৬ সালের প্রথমদিকে কোরিয়ার রাজা গোজোং জাপানি গুপ্তচরদের হাত থেকে প্রাণরক্ষার জন্য সিউলে রুশ দূতাবাসে আশ্রয় নেন এবং এসময় থেকে কোরিয়ায় রুশ প্রভাব বাড়তে থাকে[১৬]। রাজার পালিয়ে যাওয়ার পর কোরিয়ার জনগণ বিদ্রোহ করে এবং জাপানপন্থী সরকারের পতন ঘটে। বেশ কয়েকজন মন্ত্রীকে রাস্তায় প্রকাশ্যে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়[১৬]

১৮৯৭ সালে রাশিয়া লিয়াওদং উপদ্বীপ দখল করে, পোর্ট আর্থার নৌঘাঁটি নির্মাণ করে এবং বন্দরটিতে রুশ প্রশান্ত মহাসাগরীয় নৌবহরকে স্থাপন করে। রাশিয়া কর্তৃক পোর্ট আর্থার দখল ছিল প্রকৃতপক্ষে একটি ব্রিটিশ-বিরোধী চাল, কারণ ওয়েইহাই-এ ব্রিটিশ জবরদখল প্রতিহত করার জন্যই রাশিয়া এই পদক্ষেপ নিয়েছিল। কিন্তু জাপানে এই পদক্ষেপকে জাপান-বিরোধী পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হতে থাকে[১৭]। জার্মানি জিয়াওঝোও উপসাগর দখল করে নেয়, তিসিংতাও দুর্গ নির্মাণ করে এবং বন্দরটিতে জার্মান পূর্ব এশিয়া স্কোয়াড্রন স্থাপন করে। ১৮৯৭ থেকে ১৯০৩ সালের মধ্যে রাশিয়া মাঞ্চুরিয়ায় চীনা পূর্বাঞ্চলীয় রেলপথ নির্মাণ করে[১৮]। চীনা পূর্বাঞ্চলীয় রেলপথ রাশিয়া ও চীনের যৌথ মালিকানাধীনে ছিল, কিন্তু কোম্পানির ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে ছিল কেবল রুশরাই, রেলপথটি তৈরি করা হয়েছিল রুশ গেইজের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এবং রেলপথটিতে চলাচলকারী রেলগাড়িগুলোকে ডাকাতদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য মাঞ্চুরিয়ায় রুশ সৈন্য মোতায়েন করা হয়[১৮]। চীনা পূর্বাঞ্চলীয় রেলপথ কোম্পানির সদর দপ্তর ছিল রুশদের দ্বারা নবনির্মিত শহর হারবিনে, যেটিকে 'প্রাচ্যের মস্কো' নামে অভিহিত করা হতো[১৮]। ১৮৯৭ সাল থেকে মাঞ্চুরিয়া ক্রমেই একটি রুশ প্রদেশের রূপ ধারণ করতে থাকে, যদিও কাগজে-কলমে সেটি তখনও চীন সাম্রাজ্যের অন্তর্গত ছিল[১৮]

রুশ সম্প্রসারণ

১৮৯৭ সালে পোর্ট আর্থারে একটি রুশ নৌবহর স্থাপিত হয়। তিন মাস পরে ১৮৯৮ সালে চীন ও রাশিয়ার মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তি অনুযায়ী চীন রাশিয়ার কাছে পোর্ট আর্থার, তালিয়েনওয়ান এবং পার্শ্ববর্তী জণাভূমিসমূহ ইজারা দেয়। পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে চুক্তিটির মেয়াদ সম্প্রসারণের বিষয়েও দুই পক্ষ একমত হয়। রুশরা পরিষ্কারভাবে এরকম সম্প্রসারণ প্রত্যাশা করছিল, কারণ তারা কোনো সময় নষ্ট না করে অঞ্চলটি দখল করে নেয় এবং পোর্ট আর্থারে দুর্গ নির্মাণ আরম্ভ করে দেয়। পোর্ট আর্থার ছিল প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূলে রাশিয়ার একমাত্র উষ্ণ-জলীয় বন্দর, যার ফলে এর কৌশলগত গুরুত্ব ছিল অনেক বেশি। এক বছর পর রুশরা তাদের অবস্থান সুদৃঢ় করার জন্য হারবিন থেকে মুকদেনের মধ্য দিয়ে পোর্ট আর্থার পর্যন্ত একটি নতুন রেলপথ নির্মাণ আরম্ভ করে, যেটি দক্ষিণ মাঞ্চুরীয় রেলপথ নামে পরিচিত হয়[১৮]। রেলপথটির উন্নতি ঘটনাচক্রে বক্সার বিদ্রোহের একটি অন্তর্নিহিত কারণ হয়ে দাঁড়ায়, এবং বিদ্রোহের সময় বক্সার বাহিনী রেলপথটির কয়েকটি স্টেশন জ্বালিয়ে দেয়[১৯]

রুশরা কোরিয়াতেও হস্তক্ষেপ করতে শুরু করে। ১৮৯৮ সালের মধ্যে তারা ইয়ালু ও তুমেন নদীর নিকটবর্তী অঞ্চলে খনি ও বন সম্পর্কিত অধিকার লাভ করে, যা জাপানিদের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়[২০]। ফলে ট্রান্স-সাইবেরিয়ান রেলপথ সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই জাপানিরা রুশদের আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেয়।

বক্সার বিদ্রোহ

১৯০০ সালে আট-জাতির মিত্রজোটের সৈন্যরা। বাম থেকে ডানে: ব্রিটেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি, ব্রিটিশ ভারত, জার্মানি, ফ্রান্স, রাশিয়া, ইতালি ও জাপান

বক্সার বিদ্রোহ দমন এবং চীনা রাজধানী বেইজিং-এ বিদেশি দূতাবাসগুলোকে অবরোধ থেকে মুক্ত করার জন্য ১৯০০ সালে যে আট-জাতির আন্তর্জাতিক বাহিনী প্রেরণ করা হয়েছিল তাতে জাপান ও রাশিয়া উভয়েই সৈন্য প্রেরণ করে। রাশিয়া ইতোমধ্যেই মাঞ্চুরিয়ায় তার নির্মীয়মাণ রেলপথগুলো রক্ষা করার জন্য ১,৭৭,০০০ সৈন্য প্রেরণ করেছিল। চীনা সৈন্যরা এবং বক্সার বিদ্রোহীরা এত বিশাল সৈন্যবাহিনীর বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারে নি, এবং রুশ সৈন্যরা তাদেরকে মাঞ্চুরিয়া থেকে বহিষ্কার করে। বক্সার বিদ্রোহের পর রাশিয়া মাঞ্চুরিয়ায় ১,০০,০০০ সৈন্য মোতায়েন করে[২১]। রুশ সৈন্যরা সেখানে স্থায়ীভাবে অবস্থান করতে থাকে[২২] এবং সঙ্কট কেটে যাওয়ার পর অঞ্চলটি থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের প্রতিশ্রুতি দিলেও ১৯০৩ সালের মধ্যে রুশরা সৈন্য প্রত্যাহারের কোনো সময়সীমা নির্ধারণ করে দেয় নি[২৩]। বরং তারা মাঞ্চুরিয়ায় তাদের অবস্থান আরো শক্তিশালী করে তোলে।

যুদ্ধ-পূর্ব আলোচনা

জাপানি রাষ্ট্রনায়ক ইতো হিরোবুমি রুশদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেন। তিনি মনে করতেন, জাপান রাশিয়াকে সামরিকভাবে পরাজিত করতে পারবে না। এজন্য তিনি কোরিয়ার উত্তরাঞ্চলে জাপানি আধিপত্যের বিনিময়ে মাঞ্চুরিয়ায় রুশ আধিপত্য স্বীকার করে নেয়ার প্রস্তাব করেন। ইতোমধ্যে ১৯০২ সালে জাপান ও ব্রিটেনের মধ্যে ইঙ্গ–জাপানি মৈত্রীজোট স্থাপিত হয়। ব্রিটেন রাশিয়ার সঙ্গে নৌ প্রতিযোগিতা হ্রাস করতে চাইছিল এবং রাশিয়ার প্রশান্ত মহাসাগরীয় সমুদ্রবন্দর ভ্লাদিভোস্তক ও পোর্ট আর্থার যেন রুশরা পূর্ণরূপে ব্যবহার করতে না পারে সেজন্য ব্রিটেন জাপানের সঙ্গে মৈত্রীর বন্ধনে আবদ্ধ হয়। এই চুক্তি অনুসারে যদি রাশিয়া ও জাপানের মধ্যে যুদ্ধে কোনো দেশ রাশিয়ার পক্ষে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতো, সেক্ষেত্রে ব্রিটেন জাপানের পক্ষে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতো। এর ফলে রাশিয়া আর জার্মানি কিংবা ফ্রান্সের সাহায্য লাভ করতে পারে নি, কারণ এদের কেউই ব্রিটেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে রাজি ছিল না। এরকম একটি চুক্তির ফলে জাপান প্রয়োজনে যে কোনো মুহূর্তে যুদ্ধ শুরু করার জন্য প্রস্তুত হয়।

এদিকে ১৮৯০ এবং ১৯০০-এর দশকে জার্মান সরকারের 'পীত আতঙ্ক' প্রচারণা চরমে ওঠে। জার্মান সম্রাট দ্বিতীয় উইলহেলম প্রায়ই তাঁর চাচাতো ভাই রাশিয়ার জার দ্বিতীয় নিকোলাসকে 'শ্বেতাঙ্গ জাতির রক্ষাকর্তা' হিসেবে প্রশংসা করে তাঁর কাছে চিঠি লিখতেন এবং রাশিয়াকে এশিয়ায় সাম্রাজ্য বিস্তারে উৎসাহ দিতেন[২৪][২৫]। ১৮৯৪ সালের নভেম্বর থেকে উইলহেলম নিকোলাসকে 'পীত আতঙ্ক' থেকে ইউরোপের রক্ষাকর্তা হিসেবে প্রশংসা করে তাঁর কাছে চিঠি লিখতেন এবং জারকে আশ্বাস দিততেন যে, ঈশ্বর স্বয়ং তথাকথিত এশীয় হুমকি থেকে ইউরোপকে রক্ষা করার জন্য রাশিয়াকে 'বেছে নিয়েছেন'[২৬]। ১৯০২ সালের ১ নভেম্বর উইলহেলম নিকোলাসের কাছে লেখেন যে, 'প্রাচ্যের বেশকিছু সুনির্দিষ্ট লক্ষণ প্রদর্শন করে যে, জাপান ক্রমেই একটি অস্থির গ্রাহকে পরিণত হচ্ছে' এবং 'প্রতিটি নিরপেক্ষ ব্যক্তির কাছেই এটি সুস্পষ্ট যে কোরিয়া অবশ্যই রাশিয়ার'[২৪]। উইলহেলম তাঁর চিঠির শেষে চীন ও জাপান শীঘ্রই ইউরোপের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হবে বলে সতর্ক করেন; তিনি লেখেন: সুযোগ্য জাপানি অফিসারদের নেতৃত্বাধীন খ্রিস্টধর্মের প্রতি ঘৃণায় পরিপূর্ণ বিশ থেকে ত্রিশ লক্ষ চীনা সৈন্য এবং আধডজন জাপানি ডিভিশন - ভবিষ্যতের এরকম চিত্র উদ্বেগজনক এবং সেটা অসম্ভবও নয়। বরং এটি পীত আতঙ্কের বাস্তব রূপ, যেটি আমি কয়েক বছর আগে বর্ণনা করেছিলাম এবং যে কারণে অধিকাংশ লোক আমার সমালোচনা করেছিল...তোমার অনুগত বন্ধু এবং ভাই, উইলি, আটলান্টিকের অ্যাডমিরাল[২৭]। ১৮৯৪ সাল থেকে রাশিয়ার মিত্ররাষ্ট্র ফ্রান্স এশিয়ায় রাশিয়ার সম্প্রসারণবাদের পক্ষে ছিল না, এজন্য উইলহেলম এশিয়ায় রাশিয়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে আক্রমণাত্মকভাবে উৎসাহিত করেন। বার্লিনের কর্তাব্যক্তিরা বিশ্বাস করতেন যে, রাশিয়ার প্রতি জার্মান সমর্থনের ফলে রাশিয়া রুশ-ফরাসি মৈত্রীজোট ভেঙে নতুন একটি রুশ-জার্মান মৈত্রীজোট গঠন করতে পারে[২৪]। ফ্রান্স (১৮৯৪ সাল থেকে রাশিয়ার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র) এটি পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছিল যে, তারা এশিয়ায় নিকোলাসের সম্প্রসারণ নীতি সমর্থন করে না, এবং ফরাসি প্রধানমন্ত্রী মরিস রভিয়ের জনসম্মুখে ঘোষণা করেন যে, রুশ-ফরাসি মৈত্রীজোট কেবল ইউরোপের জন্য, এশিয়ার জন্য নয়, এবং জাপান রাশিয়া আক্রমণ করলে ফ্রান্স নিরপেক্ষ থাকবে[২৮]। মার্কিন প্রেসিডেন্ট থিওডোর রুজভেল্ট রুশ-জাপান বিতর্কের সমাধানে মধ্যস্থতা করার চেষ্টা করছিলেন। তিনি অভিযোগ করেন, উইলহেলমের 'পীত আতঙ্ক' প্রচারণা ইঙ্গিত দেয় যে জার্মানি রাশিয়ার সমর্থনে জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যেতে পারে এবং এটি রুশদের হঠকারী মনোভাবকে উৎসাহিত করছে[২৯]। ১৯০৫ সালের ২৪ জুলাই ব্রিটিশ কূটনীতিক সিসিল স্প্রিং-রাইসের কাছে লেখা এক চিঠিতে উল্লেখ করেন যে, উইলহেলম এই যুদ্ধের জন্য আংশিকভাবে দায়ী কারণ "তিনি এটি ঘটানোর জন্য যা কিছু করা সম্ভব সবই করেছিলেন"। তিনি অভিযোগ করেন যে, 'পীত আতঙ্ক' সম্বন্ধে উইলহেলমের নিয়মিত সতর্কবাণী রুশদেরকে সমঝোতায় নিরুৎসাহী করে তুলেছিল, কারণ নিকোলাস ধারণা করেছিলেন জাপান রাশিয়া আক্রমণ করলে জার্মানি হস্তক্ষেপ করবে[৩০]। উইলহেলমের 'পীত আতঙ্ক' সম্পর্কিত বক্তৃতাগুলোতে এবং জার নিকোলাসের কাছে লেখা চিঠিগুলোতে জার্মান সমর্থনের প্রচ্ছন্ন আশ্বাস সেন্ট পিটার্সবার্গের অনেক কর্তাব্যক্তিকে বিশ্বাস করিয়েছিল যে দূর প্রাচ্যে রাশিয়ার সামরিক দুর্বলতা (যেমন- ট্রান্স-সাইবেরীয় রেলপথ অসম্পূর্ণ থাকা) কোনো বিষয় নয় কারণ যুদ্ধ শুরু হলে জার্মানি রাশিয়াকে সাহায্য করবে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে উইলহেলম কিংবা তাঁর চ্যান্সেলর প্রিন্স বার্নহার্ড ভন বুলোভ কারোরই পূর্ব এশিয়া নিয়ে তেমন উৎসাহ ছিল না এবং নিকোলাসের কাছে লেখা উইলহেলমের চিঠিগুলোর মূল উদ্দেশ্য ছিল ইউরোপে ক্ষমতার ভারসাম্যের পরিবর্তন ঘটানো। উইলহেলম বিশ্বাস করতেন, রাশিয়া জাপানের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে পড়লে রুশ-ফরাসি মৈত্রীজোট ভেঙে পড়বে এবং রাশিয়া জার্মানির সঙ্গে নতুন জোট গঠন করবে[২৫]। জার্মানির ধারণা ছিল, যেহেতু জার্মানির প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ব্রিটেন জাপানের মিত্রশক্তি, তাই রাশিয়া আর জাপানকে একে অপরের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত করাতে পারলে রাশিয়া জার্মানির দিকে ঝুঁকে পড়বে[৩১]। তদুপরি উইলহেলমের ধারণা ছিল, যদি একটি নতুন রুশ-জার্মান জোট গঠিত হয়, তাহলে ফ্রান্স সেই জোটে যোগ দিতে বাধ্য হবে এবং রাশিয়া এশিয়ায় সম্প্রসারণবাদী নীতি বাস্তবায়নে লিপ্ত থাকলে বলকান থেকে দূরে থাকবে, ফলে রাশিয়া এবং জার্মানির প্রধান মিত্রশক্তি অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির মধ্য দ্বন্দ্বের প্রধান কারণ দূর হবে[২৪]। যুদ্ধের সময় জার নিকোলাস জার্মান হস্তক্ষেপ নিয়ে আশাবাদী ছিলেন এবং রাশিয়া বারবার পরাজিত হওয়া সত্ত্বেও কাইজার তাঁকে সহযোগিতা করবেন এই বিশ্বাসে যুদ্ধ চালিয়ে গিয়েছিলেন[৩২]

১৯০৩ সালের ২৮ জুলাই সেন্ট পিটার্সবার্গে জাপানি রাষ্ট্রদূত কুরিনো শিনিচিরোকে মাঞ্চুরিয়ায় রুশ আধিপত্য বিস্তারের প্রতি তাঁর দেশের নেতিবাচক মনোভাব জানানোর জন্য নির্দেশ দেয়া হয়। ১২ আগস্ট জাপানি রাষ্ট্রদূত আরো আলোচনার জন্য জাপানি প্রস্তাবনা রুশদের কাছে হস্তান্তর করেন। প্রস্তাবনাটিতে কোরিয়ায় জাপানের এবং মাঞ্চুরিয়ায় রাশিয়ার 'বিশেষ অধিকার'কে পারস্পরিক স্বীকৃতি দেয়ার প্রস্তাব করা হয়[৩৩]

৩ অক্টোবর জাপানে রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত রোমান রোজেন জাপানি সরকারের কাছে আলোচনার জন্য পাল্টা রুশ প্রস্তাব উপস্থাপন করেন। এতে রাশিয়া মাঞ্চুরিয়ায় রুশ আধিপত্যকে স্বীকার করে নেয়া এবং কোরিয়ার উত্তরাঞ্চলকে জাপান ও রাশিয়ার মধ্যে 'বাফার জোন' হিসেবে রাখার প্রস্তাব করে এবং বিনিময়ে কোরিয়ায় জাপানের 'বিশেষ অর্থনৈতিক অধিকার' স্বীকার করে নিতে রাজি হয়[৩৪]

রুশ-জাপান আলোচনা চলতে থাকে, বিন্তু ১৯০৪ সালের জানুয়ারিতে জাপানি সরকার বুঝতে পারে যে মাঞ্চুরীয় বা কোরীয় সমস্যা সমাধানে রাশিয়া আগ্রহী নয়, বরং রাশিয়ার উদ্দেশ্য সামরিক প্রস্তুতির প্রয়োজনীয় সময় অর্জনের জন্য কূটনীতির মাধ্যমে কালক্ষেপন করা[৩৫]। ১৯০৩ সালের ডিসেম্বরে উইলহেলম রুশ-জাপান সম্পর্ক শীতলীকরণে তাঁর ভূমিকা সম্পর্কে একটি কূটনৈতিক নোটে লিখেছিলেন: ১৮৯৭ সাল থেকে আমার কখনো রাশিয়াকে এ বিষয়ে সন্দেহে রাখিনি যে যদি রাশিয়া দূরপ্রাচ্যে বড় ধরনের নীতি অনুসরণের সিদ্ধান্ত নেয় এবং এর ফলে যদি সামরিক জটিলতার সৃষ্টি হয়, তাহলে আমরা ইউরোপে তাকে রক্ষা করব (আমাদের পূর্ব সীমান্ত থেকে বিশাল রুশ সেনাবাহিনীর চাপ ও ভীতি দূর করার জন্য!)। এরপর রাশিয়া যখন পোর্ট আর্থার দখল করে নিল এবং আমাদেরকে 'বিশ্বাস করে' বাল্টিক থেকে তার নৌবহর সরিয়ে নিল এবং এর মাধ্যমে নিজেকে সাগরপথে 'আমাদের কাছে অরক্ষিত' করে ফেলল। দানজিগ ০১ এবং রেভাল ০২-তে একই আশ্বাস দেয়া হয়েছিল যার ফলে তারা পোল্যান্ড ও ইউরোপীয় রাশিয়া থেকে বহু ডিভিশন সৈন্য দূরপ্রাচ্যে পাঠাতে পেরেছিল এবং এখনো পাঠাচ্ছে। আমাদের সরকার সম্মত না থাকলে এটা কখনোই হতো না![৩৬] নিকোলাসের কাছে প্রেরিত উইলহেলমের চিঠিগুলোর মূল বক্তব্য ছিল যে, ঈশ্বর 'সমগ্র শ্বেতাঙ্গ জাতি'কে 'পীত আতঙ্ক' থেকে রক্ষা করার জন্য 'পবিত্র রাশিয়া'কে 'বাছাই' করেছেন এবং সম্পূর্ণ কোরিয়া, মাঞ্চুরিয়া ও বেইজিং পর্যন্ত উত্তর চীন দখল করে নেয়া রাশিয়ার 'অধিকার'[৩৭]। উইলহেলম নিকোলাসকে এ পর্যন্ত আশ্বাস দিয়েছিলেন যে, রাশিয়া জাপানকে পরাজিত করতে পারলে সেটা ব্রিটিশ কূটনীতির প্রতি মারাত্মক আঘাত হবে, এবং দুই সম্রাট (স্বঘোষিত 'আটলান্টিকের অ্যাডমিরাল' এবং 'প্রশান্ত মহাসাগরের অ্যাডমিরাল') যৌথভাবে ইউরেশিয়া শাসন করবেন। এটি তাঁদেরকে ব্রিটিশ নৌশক্তির মুখোমুখি হতে সক্ষম করবে, কারণ ইউরেশিয়ার বিপুল সম্পদের কারণে ব্রিটিশ অবরোধ তাঁদের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না এবং এরপর জার্মানি ও রাশিয়া এশিয়ায় ব্রিটেনের 'সর্বোত্তম উপনিবেশগুলো' ভাগাভাগি করে নেবে[৩৭]। নিকোলাস জাপানের সঙ্গে সমঝোতা করতে প্রস্তুত হয়েছিলেন, কিন্তু উইলহেলমের কাছে থেকে একটি চিঠি পাওয়ার পর (চিঠিটিতে জাপানিদের সঙ্গে সমঝোতা করতে চাওয়ার জন্য উইলহেলম নিকোলাসকে 'ভীরু' বলে অভিহিত করেছিলেন) তিনি আরো হঠকারী হয়ে ওঠেন[৩৮]

১৯০৪ সালের ১৩ জানুয়ারি জাপান প্রস্তাব করে যে, মাঞ্চুরিয়া জাপানি প্রভাবের বাইরে থাকবে এবং কোরিয়া রুশ প্রভাবের বাইরে থাকবে। কিন্তু ১৯০৪ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত জাপান কোনো আনুষ্ঠানিক উত্তর পায় নি, ফলে ৬ ফেব্রুয়ারি রাশিয়ায় জাপানি রাষ্ট্রদূত কুরিনো শিনিচিরোকে জাপানে ডেকে পাঠানো হয়[৩৯] এবং জাপান রাশিয়ার সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে[৩৫]

কিছু পণ্ডিত মনে করেন যে, জার দ্বিতীয় নিকোলাস রুশ জাতীয়তাবাদের পুনর্জাগরণ ঘটানোর জন্য এই যুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি করেছিলেন, যদিও এই ধারণার কোনো ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই[৪০]। জারের উপদেষ্টারা যুদ্ধের পক্ষে ছিলেন না, কারণ ইউরোপীয় রাশিয়া থেকে প্রাচ্যে সৈন্য ও রসদপত্র পরিবহনের সমস্যা তাঁরা উপলব্ধি করেছিলেন[৪১]। কিন্তু নিকোলাস বিশ্বাস করতেন যে, রাশিয়ার বিশাল শক্তির সামনে জাপান আত্মসমর্পণ করবে, এবং তাঁর এই ভ্রান্ত বিশ্বাস যুদ্ধকে ত্বরান্বিত করেছিল।

যুদ্ধ ঘোষণা

বৃহত্তর মাঞ্চুরিয়া; রুশ (বাহির) মাঞ্চুরিয়াকে উপরে ডানদিকে হালকা লাল রঙে দেখানো হয়েছে

জাপান ১৯০৪ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে[৪২]। কিন্তু, রুশ সরকারের কাছে জাপানের যুদ্ধ ঘোষণা পৌঁছানোর তিন ঘণ্টা আগেই জাপানি নৌবাহিনী পোর্ট আর্থারে রুশ প্রশান্ত মহাসাগরীয় নৌবহরকে আক্রমণ করে। জার দ্বিতীয় নিকোলাস এই আক্রমণের সংবাদ পেয়ে হতবাক হয়ে যান। তিনি বিশ্বাসই করতে পারেন নি যে, জাপান আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধ ঘোষণা দেয়া ছাড়াই আক্রমণ করবে এবং তাঁর মন্ত্রীরা তাঁকে আশ্বস্ত করেছিলেন যে, জাপানিরা যুদ্ধ করবে না। ফলে যখন আক্রমণ শুরু হলো, ব্রিটিশ দূতাবাসের প্রথম সচিব সিসিল স্প্রিং রাইসের মতে, তখন জার সংবাদটি প্রায় 'বিশ্বাসই করেন নি'[৪৩]। রাশিয়া আট দিন পর জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে[৪৪]। জাপান প্রত্যুত্তরে ১৮০৯ সালে যুদ্ধ ঘোষণা ব্যতীত সুইডেনের ওপর রাশিয়ার আক্রমণের ঘটনা তুলে ধরে এবং ১৯০৭ সালের অক্টোবরে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় হেগ শান্তি সম্মেলনের আগে যুদ্ধ শুরুর আগে যুদ্ধ ঘোষণা করার নিয়ম আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ছিল না[৪৫]

এই যুদ্ধে চীন জাপানকে সমর্থন করে, এমনকি জাপানকে সামরিক সাহায্য দেয়ারও প্রস্তাব দেয়, কিন্তু জাপান সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। তবুও ইউয়ান শিকাই বেশ কয়েকবার জাপানি জেনারেলদের জন্য খাদ্য এবং অ্যালকোহলজাত পানীয় প্রেরণ করেন। স্থানীয় মাঞ্চুরীয়রা ভাড়াটে সৈন্য হিসেবে উভয় পক্ষেই যোগদান করে[৪৬]

১৯০৪ সালের অভিযান

পোর্ট আর্থার মাঞ্চুরিয়ার দক্ষিণে লিয়াওদং উপদ্বীপে অবস্থিত ছিল, এবং রুশ সেনাবাহিনী এটিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ নৌঘাঁটিতে রূপান্তরিত করেছিল। এশিয়ার মূল ভূখণ্ডে যুদ্ধ করার জন্য জাপানের সমুদ্র নিয়ন্ত্রণে রাখা প্রয়োজন ছিল। এজন্য পোর্ট আর্থারে অবস্থানরত রুশ নৌবহরকে ধ্বংস করাই ছিল জাপানের প্রথম সামরিক লক্ষ্য।

পোর্ট আর্থারের যুদ্ধ

১৯০৪ সালে কোরিয়ার সিউলে জাপানি দখলদার পদাতিক বাহিনী

১৯০৪ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি রাতে অ্যাডমিরাল তোজো হেইহাচিরোর নেতৃত্বে জাপানি নৌবহর পোর্ট আর্থারে রুশ জাহাজগুলোর ওপর অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটায়[৪৭]। আক্রমণে রুশ দূর প্রাচ্যীয় নৌবহরের সবচেয়ে ভারী দুইটি যুদ্ধজাহাজ সেজারেভিচরেতভিজান এবং ৬,৬০০-টনী ক্রুজার পাল্লাদা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়[৪৮]। এই আক্রমণের ফলে পরবর্তী দিন সকালে শুরু হয় পোর্ট আর্থারের যুদ্ধ। খণ্ড খণ্ড পরিণামহীন নৌযুদ্ধ চলতে থাকে, কিন্তু রুশ নৌবহর সাগরতীরে অবস্থানরত উপকূলরক্ষী বাহিনীর দ্বারা সুরক্ষিত থাকায় এবং ১৯০৪ সালের ১৩ এপ্রিল অ্যাডমিরাল স্তেপান মাকারভ নিহত হওয়ার পর রুশদের সাগরতীর ছেড়ে খোলা সাগরে আসার অনীহার কারণে অ্যাডমিরাল তোজো রুশ নৌবহরকে আক্রমণ করতে পারছিলেন না। যদিও পোর্ট আর্থারের যুদ্ধ ছিল প্রকৃতপক্ষে পরিণামহীন, কিন্তু জাপানিদের প্রাথমিক আক্রমণ যুদ্ধ সম্পর্কে আত্মবিশ্বাসী রাশিয়ার ওপর বিধ্বংসী মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব ফেলে। উদ্যোগ চলে যায় জাপানিদের হাতে, আর রুশরা বন্দরে অপেক্ষা করতে থাকে[৪৯]

এইসব খণ্ডযুদ্ধের আড়ালে কোরিয়ার ইন্‌ছনের কাছে জাপানি সৈন্য অবতরণ করে। ইন্‌ছন থেকে জাপানিরা প্রথমে সিউল এবং পরবর্তীতে সমগ্র কোরিয়া দখল করে নেয়। এপ্রিলের শেষদিকে কুরোকি ইতেইয়ের নেতৃত্বে জাপানি সেনাবাহিনী ইয়ালু নদী অতিক্রম করে রুশ-অধিকৃত মাঞ্চুরিয়ায় প্রবেশের জন্য প্রস্তুত হয়।

নৌপথে পোর্ট আর্থার অবরোধ

রুশ-জাপান যুদ্ধের যুদ্ধক্ষেত্রসমূহ

জাপানিরা রুশদেরকে পোর্ট আর্থার ব্যবহার করা থেকে বিরত রাখার প্রচেষ্টা চালায়। ১৩–১৪ ফেব্রুয়ারি রাতে জাপানিরা বন্দরটির গভীর পানির প্রণালীতে বেশ কয়েকটি কংক্রিট-বোঝাই স্টিমার ডুবিয়ে পোর্ট আর্থারের প্রবেশপথ বন্ধ করার প্রচেষ্টা চালায়, কিন্তু এগুলো এত গভীরে ডুবে গিয়েছিল যে তাদের উদ্দেশ্য পূরণ হয় নি[৫০]। ৩–৪ মে রাতে সাগরতীরে প্রবেশের পথ বন্ধ করার আরেকটি জাপানি প্রচেষ্টাও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। মার্চে পোর্ট আর্থারের অবরোধ ভাঙার জন্য সুদক্ষ ভাইস অ্যাডমিরাল স্তেপান মাকারভকে রুশ প্রথম প্রশান্ত মহাসাগরীয় স্কোয়াড্রনের কমান্ডার নিযুক্ত করা হয়।

১৯০৪ সালের ১২ এপ্রিল দুইটি রুশ যুদ্ধজাহাজ পেত্রোপাভলোভস্ক এবং পোবেদা পোর্ট আর্থারের বাইরে যেতে সক্ষম হয়, কিন্তু জাপানিদের পুঁতে রাখা মাইনে আঘাত করে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই পেত্রোপাভলোভস্ক ডুবে যায়, আর পোবেদা কোনোক্রমে তীরে পৌঁছতে সক্ষম হলেও সেটি ব্যাপকভাবে মেরামত করার প্রয়োজন হয়। অ্যাডমিরাল মাকারভ ছিলেন এই যুদ্ধের সবচেয়ে কর্মক্ষম নৌ-কৌশলবিদ, কিন্তু পেত্রোপাভলোভস্কের সঙ্গে তাঁরও সলিলসমাধি ঘটে।

১৯০৪ সালের ১৫ এপ্রিলে রুশ সরকার ব্রিটিশ যুদ্ধ সংবাদদাতাদের গ্রেপ্তার করার হুমকি দেয়। এই সাংবাদিকেরা লন্ডনভিত্তিক টাইমস পত্রিকার জন্য খবর সংগ্রহ করতে 'হাইমুন' নামের একটি জাহাজে করে যুদ্ধের এলাকায় পৌঁছেছিল, এবং এরা রুশদের অবস্থান জাপানিদের জানিয়ে দিতে পারে বলে রুশ সরকার আশঙ্কা করছিল।

রুশরা জাপানিদের আক্রমণাত্মকভাবে মাইন স্থাপনের পদ্ধতি দ্রুত শিখে নেয় এবং কাজে লাগায়। ১৯০৪ সালের ১৫ মে রুশরা দুইটি জাপানি যুদ্ধজাহাজ ইয়াশিমা এবং হাতসুসেকে প্রলুব্ধ করে পোর্ট আর্থার থেকে দূরে সম্প্রতি স্থাপিত রুশ মাইনক্ষেত্রে নিয়ে আসে। প্রতিটি জাহাজই কমপক্ষে দুইটি করে মাইনে আঘাত করে। হাতসুসে জাহাজটি ৪৫০ জন নাবিকসহ কয়েক মিনিটের মধ্যে ডুবে যায়, আর ইয়াশিমা জাহাজটি মেরামতের জন্য কোরিয়ার দিকে 'টো' করে নিয়ে যাওয়ার সময় ডুবে যায়। ১৯০৪ সালের ২৩ জুন নতুন রুশ কমান্ডার অ্যাডমিরাল উইলহেলম ভিৎজেফতের নেতৃত্বে রুশ স্কোয়াড্রনের অবরোধ ভাঙার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। মাসের শেষের দিকে জাপানি গোলন্দাজ বাহিনী সাগরতীরে গোলাবর্ষণ শুরু করে।

পোর্ট আর্থার অবরোধ

পোর্ট আর্থার অবরোধকালে গোলাবর্ষণ

১৯০৪ সালের এপ্রিলে পোর্ট আর্থার অবরোধ শুরু হয়। জাপানি সৈন্যরা সাগরতীরের নিকটে অবস্থিত সুরক্ষিত পাহাড়ের চূড়াগুলোতে বহুবার আক্রমণ চালায়, কিন্তু সবগুলো আক্রমণই ব্যর্থ হয় এবং এর ফলে হাজার হাজার জাপানি সৈন্য হতাহত হয়। অবশেষে ১৯০৪ সালের ডিসেম্বরে বেশ কয়েক ব্যাটারি ১১-ইঞ্চি 'ক্রুপ' ক্ষুদ্র কামানের সাহায্যে জাপানিরা প্রধান পাহাড়চূড়াটি দখল করে নিতে সক্ষম হয়। এই জায়গা থেকে জাপানি দূরপাল্লার কামান রুশ নৌবহরের ওপর গোলাবর্ষণ করতে সক্ষম হয়। রুশ নৌবহর ভূমি-ভিত্তিক গোলন্দাজ বাহিনীর বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম ছিল না এবং অবরোধকারী জাপানি নৌবহরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতেও আগ্রহী ছিল না। এর ফলে ক্রমান্বয়ে চারটি রুশ যুদ্ধজাহাজ ও দুইটি ক্রুজার ডুবে যায়, এবং আরো দুইটি যুদ্ধজাহাজ কয়েক সপ্তাহ পর অকার্যকর হয়ে পড়ে। এভাবে প্রশান্ত মহাসাগরে অবস্থানরত রাশিয়ার সবগুলো বড় যুদ্ধজাহাজই ডুবিয়ে দেয়া হয়। সম্ভবত এটিই পৃথিবীর সামরিক ইতিহাসে একমাত্র উদাহরণ যেক্ষেত্রে বড় যুদ্ধজাহাজের বিরুদ্ধে ভূমি-ভিত্তিক গোলন্দাজ বাহিনী এতটা সাফল্য অর্জন করতে পেরেছিল।

১৯০৪ সালে পরিখায় অবস্থানরত রুশ সৈন্যদের ওপর জাপানি আক্রমণ

এদিকে স্থলপথে অবরুদ্ধ শহরটিকে মুক্ত করার প্রচেষ্টাও ব্যর্থ হয়, এবং আগস্টের শেষদিকে লিয়াওইয়াং-এর যুদ্ধের পর উত্তরাঞ্চলীয় রুশ বাহিনী (যেটি পোর্ট আর্থারকে মুক্ত করতে পারত) মুকদেনে পশ্চাৎপসরণ করে।

পোর্ট আর্থার সেনানিবাসের কমান্ডার মেজর জেনারেল আনাতোলি স্তোশেল বিশ্বাস করতেন যে, রুশ নৌবহর ধ্বংস হওয়ার পর শহর রক্ষার আর কোনো দরকার নেই। সাধারণত জাপানিদের প্রতিটি আক্রমণের সময় রুশ প্রতিরোধকারী সৈন্যদের মধ্যে হতাহতের হার ছিল জাপানিদের তুলনায় অনেক বেশি। বিশেষত ডিসেম্বরের শেষদিকে বেশ কয়েকটি বৃহৎ ভূগর্ভস্থ মাইন বিস্ফোরিত হয় এবং এর ফলে প্রতিরক্ষা রেখার আরো কিছু অংশ জাপানিদের দখলে চলে যায়।

এজন্য স্তোশেল ১৯০৫ সালের ২ জানুয়ারি বিস্মিত জাপানি জেনারেলদের কাছে আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নেন। তিনি উপস্থিত অন্যান্য সামরিক কর্মকর্তা কিংবা জার বা সামরিক কমান্ডের কারো সঙ্গে কোনোরকম আলোচনা না করে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এঁদের সবাই ছিলেন এই সিদ্ধান্তের বিরোধী। ১৯০৮ সালে স্তোশেল কোর্ট-মার্শালের মুখোমুখি হন, এবং প্রতিরক্ষায় ব্যর্থতা ও নির্দেশ অমান্য করার দায়ে তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। অবশ্য পরে তাঁকে ক্ষমা করা হয়।

ব্রিটিশ-জাপানি গোয়েন্দা সহযোগিতা

যুদ্ধ শুরুর আগে থেকেই ব্রিটিশ এবং জাপানি গোয়েন্দা সংস্থা রাশিয়ার বিরুদ্ধে একে অপরকে সহায়তা করে আসছিল[৫১]। যুদ্ধের সময় ব্রিটিশ মালয় ও চীনে অবস্থিত ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীর স্টেশনগুলো প্রায়ই যুদ্ধ সম্পর্কিত বেতারবার্তা এবং টেলিগ্রাফ কেবল মাঝপথে রোধ করত এবং পাঠ করে জাপানিদের জানিয়ে দিতো[৫২]। অপরদিকে জাপানিরা রাশিয়া সম্পর্কিত তথ্য ব্রিটিশদেরকে সরবরাহ করত। একজন ব্রিটিশ কর্মকর্তা জাপানি গোয়েন্দা সংস্থার 'আদর্শ মান' সম্পর্কে লিখেছিলেন[৫৩]। বিশেষত ব্রিটিশ এবং জাপানি গোয়েন্দা সংস্থা এ বিষয়ে প্রচুর প্রমাণ পায় যে, জার্মানি রাশিয়াকে এই যুদ্ধে সহযোগিতা করছে[৫৪]

ইয়ালু নদীর যুদ্ধ

জাপানিরা দ্রুতগতিতে মাঞ্চুরিয়া দখল করার কৌশল অবলম্বন করেছিল, অপরদিকে রুশরা সময় পাওয়ার জন্য কালক্ষেপণের কৌশল অবলম্বন করেছিল। সুদীর্ঘ ট্রান্স-সাইবেরীয় রেলপথ (যেটি সেসময় ইর্কুতস্কের কাছে অসমাপ্ত ছিল) দিয়ে অতিরিক্ত রুশ সৈন্যদের পৌঁছানোর জন্যই রুশদের সময়ের প্রয়োজন ছিল। ১৯০৪ সালের ১ মে সংঘটিত ইয়ালু নদীর যুদ্ধ ছিল এই যুদ্ধের প্রথম বৃহৎ স্থলযুদ্ধ। যুদ্ধের সময় জাপানি সৈন্যরা নদী অতিক্রম করে রুশ সৈন্যদের অবস্থানের ওপর আক্রমণ চালায়। 'জাপানিরা সহজ শত্রু হবে, যুদ্ধ সংক্ষিপ্ত হবে, এবং রাশিয়া বিপুলভাবে বিজয়ী হবে' - রুশ পূর্বাঞ্চলীয় সৈন‍্যবাহিনীর পরাজয় এরকম সকল ধারণা দূর করে দেয়[৫৫]। বহু দশক পরে এটিই ছিল প্রথম যুদ্ধ যেটিতে কোনো ইউরোপীয় শক্তির বিরুদ্ধে এশীয় কোনো শক্তি জয়ী হয়েছিল। এই যুদ্ধে জাপানের সামরিক সক্ষমতার সঙ্গে যে রাশিয়া তাল মিলিয়ে চলতে পারেনি সেটা প্রকাশ হয়ে পড়ে[৫৬]। জাপানি সৈন্যরা মাঞ্চুরীয় উপকূলের বেশ কয়েক জায়গায় অবতরণ করে এবং বেশ কয়েকটি খণ্ডযুদ্ধের পর রুশদেরকে পোর্ট আর্থারের দিকে বিতাড়িত করে। অবশ‍্য ১৯০৪ সালের ২৫ মে সংঘটিত নানশানের যুদ্ধসহ পরবর্তী খণ্ডযুদ্ধসমূহে পরিখায় অবস্থানরত রুশদেরকে আক্রমণ করে জাপানিরা প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়।

পীত সাগরের যুদ্ধ

১৯০৪ সালের এপ্রিলে পোর্ট আর্থার অবরোধের সময় অ্যাডমিরাল স্তেপান মাকারভের মৃত্যু হলে অ্যাডমিরাল উইলহেলম ভিৎজেফত নৌবহরের নতুন কমান্ডার নিযুক্ত হন, এবং তাঁকে পোর্ট আর্থার থেকে বেরিয়ে ভ্লাদিভোস্তকে তাঁর বাহিনীকে মোতায়েন করতে নির্দেশ দেয়া হয়। ১৯০৪ সালের ১০ আগস্ট সকালে ফরাসি-নির্মিত রুশ যুদ্ধজাহাজ সেজারেভিচে পতাকা উড়িয়ে ভিৎজেফত ৬টি যুদ্ধজাহাজ, ৪টি ক্রুজার এবং ১৪টি টর্পেডো বোট ডেস্ট্রয়ার নিয়ে যাত্রা শুরু করেন। তাঁর জন্য অপেক্ষা করছিলেন জাপানি অ্যাডমিরাল তোজো, ৪টি যুদ্ধজাহাজ, ১০টি ক্রুজার এবং ১৮টি টর্পেডো বোট ডেস্ট্রয়ার-সহ।

১২:১৫ সময়ে যুদ্ধজাহাজ বহরদ্বয় একে অপরকে দেখতে পায়, এবং ১৩:০০ সময়ে তোজো ভিৎজেফতের 'টি' অতিক্রম করে আট মাইল দূরে থেকে গোলাবর্ষণ শুরু করেন। সেসময় পর্যন্ত আর কোনো নৌযুদ্ধে কোনো নৌবহর শত্রুপক্ষকে এত দূর থেকে আক্রমণ করেনি[৫৭]। প্রায় ত্রিশ মিনিট ধরে যুদ্ধজাহাজগুলো একে অপরের ওপর আঘাত করতে থাকে, এবং একে অপরের থেকে ৪ মাইলের দূরত্বে আসার পর দ্বিতীয়বারের মতো গোলাবর্ষণ শুরু করে। ১৮:৩০ সময়ে তোজোর যুদ্ধজাহাজগুলো ভিৎজেফতের জাহাজের ব্রিজে আঘাত করে এবং ভিৎজেফত তৎক্ষণাৎ নিহত হন।

সেজারেভিচের হাল নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর এবং অ্যাডমিরাল নিহত হওয়ার পর জাহাজটি যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সরে পড়ে, ফলে রুশ নৌবহরে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। কিন্তু তোজো জাহাজটিকে ডুবিয়ে দেয়ার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন, এবং জাহাজটির ওপর আক্রমণ অব্যাহত রাখেন। এসময় মার্কিন-নির্মিত রুশ যুদ্ধজাহাজ রেৎভিজান বীরত্বের সঙ্গে তোজোর জাহাজকে আক্রমণ করে সেজারেভিচকে রক্ষা করে[৫৮]। রাশিয়া থেকে আগমনরত বাল্টিক নৌবহরের যুদ্ধজাহাজগুলোর সঙ্গে ভবিষ্যৎ যুদ্ধের কথা ভেবে নিজের যুদ্ধজাহাজ হারানোর ঝুঁকি না নিয়ে তিনি পোর্ট আর্থারের দিকে পশ্চাৎপসরণরত রুশ জাহাজগুলোর পশ্চাদ্ধাবন করা থেকে বিরত থাকেন। এর ফলে সমাপ্তি ঘটে তখন পর্যন্ত নৌযুদ্ধের ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি দূরত্বের দ্বন্দ্বযুদ্ধের। এটিই ছিল ইস্পাতের তৈরি আধুনিক যুদ্ধজাহাজগুলোর মধ্যে প্রথম যুদ্ধ।

বাল্টিক নৌবহরের আগমন

বাল্টিক নৌবহরের গতিপথ

ইতোমধ্যে রুশরা তাদের দূর প্রাচ্য নৌবহরকে সহায়তা করার জন্য অ্যাডমিরাল জিনোভি রোঝেস্তভেনস্কির অধীনে বাল্টিক নৌবহরকে প্রেরণের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল। ইঞ্জিনে সমস্যা এবং আরো কয়েকটি ছোটোখাট দুর্ঘটনার পর ১৯০৪ সালের ১৫ অক্টোবর অবশেষে স্কোয়াড্রনটি যাত্রা শুরু করে, এবং অর্ধেক পৃথিবী ঘুরে বাল্টিক সাগর থেকে কেপ অফ গুড হোপের মধ্য দিয়ে প্রশান্ত মহাসাগরে পৌঁছায়। তাদের এই সাত মাসব্যাপী দীর্ঘ অভিযান সমগ্র বিশ্বের মনোযোগ কেড়ে নিয়েছিল। ১৯০৪ সালের ২১ অক্টোবর ডগার ব্যাঙ্ক ঘটনার পর (যে ঘটনায় রুশ নৌবহর ব্রিটিশ জেলেনৌকাকে শত্রুর টর্পেডো বোট ভেবে গুলি চালিয়েছিল) রুশরা এই দীর্ঘ পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়েছিল। এই ঘটনার ফলে ব্রিটিশরা তাদেরকে সুয়েজ খাল ব্যবহার করতে দিতে অস্বীকৃতি জানায়, এবং এর ফলে ব্রিটেনের সঙ্গে রাশিয়ার প্রায় যুদ্ধ বেধে যাওয়ার উপক্রম হয়।

বেসামরিক জনগণের ভাগ্য

মাঞ্চুরিয়ায় যুদ্ধের সময় রুশ সৈন্যরা বহু চীনা গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়, নারীদের ধর্ষণ করে এবং বাধাদানকারীদের মেরে ফেলে[৫৯]। রুশদের ধারণা ছিল, যেহেতু চীনারা এশীয়, তারা নিশ্চয়ই রাশিয়াকে পরাজিত করার জন্য এশীয় জাপানিদের সহযোগিতা করছে, কাজেই তাদের শাস্তি পাওয়া উচিত[৫৯]। রুশ সৈন্যরা পীত আতঙ্কে ভুগছিল, এবং কেবল জাপানিদের নয়, সকল এশীয়কেই শত্রু হিসেবে দেখছিল[৫৯]। মাঞ্চুরিয়ায় বসবাসকারী চীনারা সব রুশ সৈন্যকেই ভয় পেত, তবে নিষ্ঠুরতা এবং অপরিসীম লুটতরাজের আকাঙ্ক্ষার জন্য কসাকদের তারা সবচেয়ে বেশি ভয় করত[৫৯]। জাপানিদের তুলনামূলক সুশৃঙ্খল আচরণের জন্য মাঞ্চুরিয়ায় বসবাসকারী হান ও মাঞ্চু জাতির লোকেদের অনেকেই জাপানপন্থী হয়ে পড়েছিল[৫৯]। অবশ্য জাপানিরাও লুটতরাজে পিছিয়ে ছিল না, যদিও তাদের পদ্ধতি ছিল রুশদের চেয়ে কম হিংস্র। এছাড়া কোনো চীনা বা মাঞ্চুকে রুশ গুপ্তচর হিসেবে সন্দেহ হলেই তারা তৎক্ষণাৎ তাকে মেরে ফেলত[৫৯]। লিয়াওইয়াং শহরের ভাগ্য ছিল সবচেয়ে খারাপ, এটিকে প্রথমদিন রুশরা জ্বালিয়ে দেয়, পরের দিন চীনা পুলিশরা এটি জ্বালিয়ে দেয় এবং তার পরের দিন জাপানিরাও শহরটি জ্বালিয়ে দেয়[৫৯]। জাপানিরা রুশ রসদপত্র সরবরাহকারী কলামগুলোর ওপর আক্রমণ করার জন্য চীনা দস্যুদের ভাড়া করে[৪৬]। কেবল একবার এই দস্যুরা জাপানি সৈন্যদের আক্রমণ করেছিল। সম্ভবত জাপানি সৈন্যদেরকে রুশ বলে ভুল করে তারা এই হামলা চালিয়েছিল[৬০]। দস্যু সর্দার ঝাং জাউলিন (যিনি ১৯১৬ থেকে ১৯২৮ সাল পর্যন্ত একজন যুদ্ধবাজ নেতা হিসেবে মাঞ্চুরিয়া শাসন করেছিলেন) জাপানিদের জন্য ভাড়াটে যোদ্ধা হিসেবে কাজ করেন। আইনত মাঞ্চুরিয়া তখনও চীনা সাম্রাজ্যের অংশ ছিল, এবং চীনা সরকারি কর্মকর্তারা রাশিয়া ও জাপানের মধ্যেকার এই যুদ্ধে যথাসম্ভব নিরপেক্ষ থাকার চেষ্টা করেন[৬০]। মাঞ্চুরিয়ায় জাপানি দখলকৃত অংশে জাপানি সরকার 'বেসামরিক প্রাদেশিক শাসনকর্তা' নিযুক্ত করে, যাঁরা স্বাস্থ্য, পয়:প্রণালী এবং রাস্তাঘাটের অবস্থার উন্নয়নের জন্য কাজ করেন[৬০]। জাপানিদের এসব কর্মকাণ্ড স্ব-স্বার্থপ্রণোদিত ছিল, কারণ উন্নত যাতায়াত ব্যবস্থা জাপানিদের রসদপত্র সরবরাহের সমস্যা হ্রাস করে এবং চীনাদের স্বাস্থ্যের উন্নতির ফলে জাপানি সৈন্যদের সংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা হ্রাস পায়[৬০]। অপরপক্ষে, রুশরা তাদের শাসনাধীন চীনাদের স্বাস্থ্য বা পয়:প্রণালীর কোনো উন্নতি সাধন করে নি, বরং পশ্চাৎপসরণের সময় সবকিছু ধ্বংস করে দিয়ে যায়[৬০]। অনেক চীনা জাপানিদেরকে 'দুই শয়তানের মধ্যে কম শয়তান' হিসেবে বিবেচনা করত[৬০]

১৯০৫ সালের অভিযান

মুকদেনের যুদ্ধের পর রুশ সৈন্যদের পশ্চাৎপসরণ

পোর্ট আর্থারের পতনের পর জাপানি তৃতীয় সেনাবাহিনী রুশ-নিয়ন্ত্রিত মুকদেনের দক্ষিণে নতুন সৈন্য মোতায়েন করতে সক্ষম হয়। মাঞ্চুরিয়ায় তীব্র শীতকাল শুরু হওয়ার পর থেকে বিগত বছরে শাহোর যুদ্ধের পর আর কোনো বড়ো ধরনের স্থলযুদ্ধ হয়নি। দুই পক্ষ একে অপরের বিপরীত দিকে মুকদেনের দক্ষিণে ঘাঁটি গেড়ে বসে।

শান্দেপুর যুদ্ধ

২৫ থেকে ২৯ জানুয়ারির মধ্যে রুশ দ্বিতীয় সেনাবাহিনী জেনারেল অস্কার গ্রিপেনবুর্গের নেতৃত্বে শান্দেপু শহরের কাছে জাপানি বাহিনীর বাম বাহুকে আক্রমণ করে। এই আক্রমণে জাপানিরা হতভম্ব হয়ে পড়ে। রুশরা জাপানিদেরকে প্রায় পরাজিত করে ফেলেছিল, কিন্তু অন্যান্য রুশ সৈন্যদলের সাহায্য না পাওয়ায় আক্রমণটি স্থগিত করা হয় এবং যুদ্ধটি অমীমাংসিতভাবে শেষ হয়। জাপানিরা জানত যে ট্রান্স-সাইবেরীয় রেলপথ দিয়ে সাহায্য পৌঁছানোর আগেই রুশ বাহিনীকে ধ্বংস করে ফেলতে হবে।

মুকদেনের যুদ্ধ

১৯০৫ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি মুকদেনের যুদ্ধ শুরু হয়। পরবর্তী দিনগুলোতে জাপানি বাহিনী রুশ বাহিনীর ডান ও বাম বহুর ওপর আক্রমণ চালাতে থাকে। প্রায় পাঁচ লক্ষ সৈন্য এই যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। দুই পক্ষই ভালোভাবে পরিখা খনন করে সেখানে অবস্থান করছিল এবং তাদেরকে সহযোগিতা করার জন্য শত শত কামানও ছিল। বেশ কয়েকদিন তীব্র যুদ্ধের পর রুশরা পিছু হটে যেতে বাধ্য হয়। জাপানিরা তাদের ঘেরাও করে ফেলতে পারে এই আশঙ্কায় রুশরা পশ্চাৎপসরণ আরম্ভ করে, এবং জাপানি সৈন্যদের সঙ্গে রুশ বাহিনীর পশ্চাদভাগের সৈন্যদের তীব্র সংঘর্ষ হতে থাকে, যার ফলে রুশ বাহিনী ভেঙে পড়ে। তিন সপ্তাহব্যাপী যুদ্ধের পর ১৯০৫ সালের ১০ মার্চ জেনারেল কুরোপাতকিন মুকদেনের উত্তরে পশ্চাৎপসরণ করার সিদ্ধান্ত নেন। এই যুদ্ধে রাশিয়া ৯০,০০০ সৈন্য হারায়।

পশ্চাৎপসরণকারী রুশ মাঞ্চুরীয় বাহিনী প্রায় বিধ্বস্ত হয়ে যায়, কিন্তু তা সত্ত্বেও জাপানিরা তাদেরকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করতে ব্যর্থ হয়। জাপানিদের নিজেদেরও প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল এবং রুশ সৈন্যদের পশ্চাদ্ধাবন করার মতো অবস্থা তাদের ছিল না। যদিও মুকদেনের যুদ্ধে রুশদের বড় ধরনের পরাজয় ঘটে এবং জাপানিদের সবচেয়ে বড় বিজয় সূচিত হয়, কিন্তু চূড়ান্ত বিজয় তখনও নৌবাহিনীর ওপর নির্ভর করছিল।

সুশিমার যুদ্ধ

জাপানি যুদ্ধজাহাজ মিকাসা (সুশিমার যুদ্ধের সময় অ্যাডমিরাল তোজো হেইহাচিরোর পতাকাবাহী জাহাজ)

বেশ কয়েক সপ্তাহ ফরাসি-অধিকৃত মাদাগাস্কারের একটি ক্ষুদ্র বন্দর নোসিবেতে থেমে থাকার পর (ফরাসিরা নিতান্ত অনিচ্ছাসত্ত্বেও রাশিয়ার সঙ্গে মিত্রতা বজায় রাখার জন্য এটির অনুমতি দিয়েছিল) ১৯০৫ সালের ৭ থেকে ১০ এপ্রিল রুশ বাল্টিক নৌবহর সিঙ্গাপুর প্রণালীর মধ্য দিয়ে ফরাসি ইন্দোচীনের ক্যাম রান উপসাগরে পৌঁছে[৬১][৬২]। অবশেষে ১৯০৫ সালের মে মাসে নৌবহরটি জাপান সাগরে পৌঁছায়। সেসময়ে এরকম একটি যাত্রার জন্য প্রয়োজনীয় রসদের পরিমাণ ছিল বিস্ময়কর। স্কোয়াড্রনটির এই যাত্রাকালে প্রায় ৫,০০,০০০ টন কয়লার প্রয়োজন হয়েছিল, অথচ আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে রাশিয়া নিরপেক্ষ বন্দরগুলো থেকে কয়লা সংগ্রহ করতে পারে নি। ফলে রুশ কর্তৃপক্ষ নৌবহরটিকে সমুদ্রপথে কয়লা সরবরাহ করার জন্য অনেকগুলো কয়লাবাহী জাহাজের একটি বহর যোগাড় করতে বাধ্য হয়েছিল। এরকম দীর্ঘ যাত্রার জন্য প্রয়োজনীয় রসদপত্র সংরক্ষণের ফলে জাহাজগুলোর ওজন অনেক বেড়ে যায় এবং সেটা আরেকটা সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়[৬৩]

রুশ দ্বিতীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় স্কোয়াড্রন (বাল্টিক নৌবহরের নতুন নাম) পোর্ট আর্থারকে মুক্ত করার জন্য ১৮,০০০ নটিক্যাল মাইল (৩৩,০০০ কি.মি.) অতিক্রম করেছিল। কিন্তু নৌবহরটি যখন মাদাগাস্কারে ছিল, তখনই সেখানে জাপানিদের কাছে পোর্ট আর্থারের আত্মসমর্পণের হতাশাজনক সংবাদ পৌঁছায়। এরপর অ্যাডমিরাল রোঝেস্তভেনস্কির একমাত্র আশা ছিল ভ্লাদিভোস্তক বন্দরে পৌঁছানো। ভ্লাদিভোস্তকে যাওয়ার তিনটি পথ ছিল। এদের মধ্যে সংক্ষিপ্ততম এবং সরাসরি পথটি ছিল কোরিয়া এবং জাপানের মধ্যবর্তী সুশিমা প্রণালীর মধ্য দিয়ে। কিন্তু তিনটি পথের মধ্যে এটিই ছিল সবচেয়ে বেশি বিপজ্জনক, কারণ এই পথটির অবস্থান ছিল জাপানের প্রধান দ্বীপসমূহ এবং কোরিয়ায় জাপানি নৌঘাঁটিগুলো মধ্যে।

অ্যাডমিরাল তোজো রুশ অগ্রগতি সম্পর্কে অবগত ছিলেন, এবং বুঝতে পেরেছিলেন যে, পোর্ট আর্থারের পতনের পর রুশ দ্বিতীয় এবং তৃতীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় নৌবহরদ্বয় দূর প্রাচ্যে রাশিয়ার অবশিষ্ট একমাত্র বন্দর ভ্লাদিভোস্তকে পৌঁছানোর চেষ্টা করবে। তিনি সেই মোতাবেক যুদ্ধের পরিকল্পনা করেন এবং রুশ জাহাজগুলোকে ঠেকানোর জন্য তাঁর জাহাজগুলোকে মেরামত করেন।

জাপানি সম্মিলিত নৌবহরে প্রথমে মোট ৬টি যুদ্ধজাহাজ ছিল, কিন্তু পোর্ট আর্থারের যুদ্ধে মাইন বিস্ফোরণে দুইটি জাহাজ ডুবে যাওয়ার পর ৪টি যুদ্ধজাহাজ অবশিষ্ট ছিল। তবে নৌবহরটিতে তখনও অনেকগুলো ক্রুজার, ডেস্ট্রয়ার এবং টর্পেডো বোট অবশিষ্ট ছিল। অন্যদিকে, রুশ দ্বিতীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় স্কোয়াড্রনে ছিল ৮টি যুদ্ধজাহাজ (এদের মধ্যে ৪টি নতুন বোরোদিনো শ্রেণির যুদ্ধজাহাজও ছিল), এবং অনেকগুলো ক্রুজার, ডেস্ট্রয়ার ও অন্যান্য সহায়তাকারী জাহাজ। রুশ নৌবহরে সর্বমোট ৩৮টি জাহাজ ছিল।

মে মাসের শেষের দিকে দ্বিতীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় স্কোয়াড্রন ভ্লাদিভোস্তকে পৌঁছানোর শেষ পর্যায়ে ছিল। তারা জাপান ও কোরিয়ার মধ্যে অবস্থিত সংক্ষিপ্ত ঝুঁকিপূর্ণ পথটিই বেছে নিয়েছিল এবং ধরা পড়ার ভয়ে রাতে যাত্রা করেছিল। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, রুশ নৌবহরের দুইটি হাসপাতাল-জাহাজ যুদ্ধের প্রচলিত নিয়ম অনুসারে তাদের বাতি জ্বালিয়ে রেখেছিল[৬৪], যার ফলে জাপানি সশস্ত্র বাণিজ্যিক ক্রুজার শিনানো মারু তাদেরকে দেখে ফেলে। বেতার মারফত তারা এ খবর তোজোর সদর দপ্তরে প্রেরণ করে এবং জাপানি সম্মিলিত নৌবহর সেখান থেকে তৎক্ষণাৎ রওনা হয়ে যায়[৬৫]। ১৯০৫ সালের ২৭–২৮ মে জাপানিরা সুশিমা প্রণালীতে রুশদেরকে আক্রমণ করে। রুশ নৌবহরটি প্রায় সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যায়, এবং তারা আটটি যুদ্ধজাহাজ, অনেকগুলো ছোট জাহাজ এবং ৫,০০০-এর বেশি লোক হারায়। অপরপক্ষে জাপানিরা মাত্র তিনটি টর্পেডো বোট এবং ১১৬ জন লোক হারায়। কেবল তিনটি রুশ জাহাজ ভ্লাদিভোস্তকে পৌঁছতে সক্ষম হয়।

শাখালিন আক্রমণ

শাখালিনে জাপানি সৈন্যদের অবতরণ

সুশিমার যুদ্ধে রাশিয়ার পরাজয়ের পর জার নিকোলাসকে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরে বাধ্য করার জন্য জাপানি সৈন্যরা ১৯০৫ সালের ৭ জুলাই শাখালিন দ্বীপে অবতরণ করে[৬৬]। শাখালিনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল খুবই দুর্বল এবং এখানে অবস্থিত রুশ সৈন্যদলের অধিকাংশ সৈন্যই ছিল রাজনৈতিক বন্দি, যাদের কোনোরকম সামরিক প্রশিক্ষণ ছিল না। ফলে জাপানিরা সহজেই শাখালিন দখল করে নিতে সক্ষম হয় এবং ১৯০৫ সালের ৩১ জুলাই শাখালিনের রুশ সৈন্যরা জাপানিদের কাছে আত্মসমর্পণ করে।

শান্তিচুক্তি ও ফলাফল

পোর্টসমাথের চুক্তি

মার্কিন রাষ্ট্রপতি থিওডোর রুজভেল্টের মধ্যস্থতায় জাপান ও রাশিয়ার মধ্যে পোর্টসমাউথের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, এবং এর মধ্য দিয়ে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। চুক্তি অনুযায়ী রাশিয়া কোরিয়ায় জাপানি আধিপত্য স্বীকার করে নেয়, পোর্ট আর্থারের ইজারা জাপানের কাছে হস্তান্তর করে, মাঞ্চুরিয়া থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয় এবং শাখালিন দ্বীপের দক্ষিণাংশ জাপানের কাছে হস্তান্তর করে। রুজভেল্ট শান্তি স্থাপনে তাঁর অবদানের জন্য ১৯০৬ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।

আরও দেখুন

তথ্যসূত্র

🔥 Top keywords: রাম নবমীমুজিবনগর দিবসপ্রধান পাতামুজিবনগর সরকারবিশেষ:অনুসন্ধানইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগএক্স এক্স এক্স এক্স (অ্যালবাম)বাংলাদেশবাংলা ভাষামিয়া খলিফারাজকুমার (২০২৪-এর চলচ্চিত্র)আনন্দবাজার পত্রিকাআবহাওয়ারামপহেলা বৈশাখউয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগইসরায়েলইরানরবীন্দ্রনাথ ঠাকুরমুজিবনগরইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউনরিয়াল মাদ্রিদ ফুটবল ক্লাব২০২৪ ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগক্লিওপেট্রাচর্যাপদভূমি পরিমাপশেখ মুজিবুর রহমানজনি সিন্সকাজী নজরুল ইসলামঈদুল আযহাফিলিস্তিনইউটিউবভারতবিকাশআসসালামু আলাইকুমসৌদি আরববাংলা প্রবাদ-প্রবচনের তালিকামুহাম্মাদ