লাগ্রঁজ বিন্দু

লাগ্রঁজ বিন্দু বলতে দুটি বিশাল কক্ষীয় বস্তুর মহাকর্ষীয় প্রভাবের অধীনে কম-ভরের বস্তুদের সাম্যাবস্থা বিন্দুদের বোঝায়। গাণিতিকভাবে এটি সীমাবদ্ধ তিন-বস্তু সমস্যার সমাধানের সঙ্গে জড়িত।[১]

সূর্য–পৃথিবী ব্যবস্থার লাগ্রঁজ বিন্দুসমূহ (স্কেল অনুযায়ী নয়)। এখানে পৃথিবীর কক্ষপথ বামাবর্তী।
সূর্য–পৃথিবী L2 বিন্দুতে এক মহাকাশযানের উদাহরণ
      উইলকিনসন মাইক্রোওয়েভ অ্যানিসোট্রপি প্রোব ·       পৃথিবী

সাধারণভাবে বিশাল বস্তুদুটি যেকোনো একটি বিন্দুতে অসম মহাকর্ষীয় বল প্রয়োগ করে, এবং ঐ বিন্দুতে যেকোনো বস্তুর কক্ষপথকে পরিবর্তিত করে। লাগ্রঁজ বিন্দুতে বিশাল বস্তুদুটির মহাকর্ষীয় বল ও কেন্দ্রবিমুখী বল পরস্পরকে প্রশমিত করে।[২]

যেকোনো দুটি কক্ষীয় বস্তুর ব্যবস্থার জন্য L1 থেকে L5 পর্যন্ত পাঁচটি লাগ্রঁজ বিন্দু আছে, এবং সমস্ত লাগ্রঁজ বিন্দুই বস্তুদুটির কক্ষীয় তলে আছে। সূর্য–পৃথিবী ব্যবস্থার জন্য পাঁচটি লাগ্রঁজ বিন্দু আছে, এবং পৃথিবী–চাঁদ ব্যবস্থার জন্য পাঁচটি আলাদা লাগ্রঁজ বিন্দু আছে। L1, L2, ও L3 বিশাল বস্তুদুটির কেন্দ্রগামী সরলরেখার উপর আছে। অন্যদিকে L4 ও L5 প্রত্যেকে বিশাল বস্তুদুটির কেন্দ্র দ্বারা গঠিত সমবাহু ত্রিভুজের তৃতীয় শীর্ষ হিসেবে কাজ করে।

বস্তুদুটির ভোরের অনুপাত যথেষ্ট বড় হলে L4 ও L5 বিন্দুদুটি স্থায়ী বিন্দু যার চারিদিকে ছোট বস্তু আবর্তন করতে পারে, এবং তাদের নিজের দিকে টেনে নেওয়ার প্রবণতা থাকে। সূর্যের সাপেক্ষে বিভিন্ন গ্রহের L4 ও L5 বিন্দুর নিকটে ট্রোজান গ্রহাণু থাকে; বৃহস্পতি গ্রহের এরকম দশ লক্ষের বেশি ট্রোজান আছে।

কিছু লাগ্রঁজ বিন্দু মহাকাশ অনুসন্ধানের জন্য ব্যবহৃত হয়। সূর্য–পৃথিবী ব্যবস্থার দুটি গুরুত্বপূর্ণ লাগ্রঁজ বিন্দু হলো L1 (সূর্য ও পৃথিবীর মাঝে) ও L2 (পৃথিবীর বিপরীতে একই সরলরেখায়); উভয়ই চাঁদের কক্ষপথ থেকে যথেষ্ট দূরে। ২০২১-এর হিসাব অনুযায়ী, ডিপ স্পেস ক্লাইমেট অবজারভেটরি (ডিসকভার) L1 বিন্দুতে অবস্থিত, এবং চিত্র তোলার মাধ্যমে এটি সূর্য থেকে আগত সৌরঝড়ের গবেষণা ও পৃথিবীর জলবায়ু পর্যবেক্ষণ করে।[৩] শক্তিশালী জেমস ওয়েব মহাকাশ দূরবীক্ষণ যন্ত্র L2 বিন্দুতে অবস্থিত।[৪]

ইতিহাস

প্রায় ১৭৫০ খ্রিস্টাব্দে সুইস গণিতবিদ লেওনার্ড অয়লার সরলরৈখিক লাগ্রঁজ বিন্দু তিনটি (L1, L2, L3) আবিষ্কার করেছিলেন। এক দশক পরে ইতালীয় বংশোদ্ভূত জোসেফ-লুই লাগ্রঁজ বাকি বিন্দু দুটি (L4, L5) আবিষ্কার করেছিলেন।[৫][৬]

১৭৭২ সালে লাগ্রঁজ "তিন-বস্তু সমস্যার উপর একটি প্রবন্ধ" প্রকাশিত করেছিলেন। এর প্রথম অধ্যায়ে তিনি সাধারণ তিন-বস্তু সমস্যার কথা বিবেচনা করেছিলেন। সেখান থেকে দ্বিতীয় অধ্যায়ে তিনি বৃত্তাকার কক্ষপথ যুক্ত যেকোনো তিনটি ভরের সরলরৈখিক ও সমবাহু, এই দুটি বিশেষ নির্দিষ্ট প্যাটার্নের সমাধান প্রদর্শন করেছিলেন।[৭]

লাগ্রঁজ বিন্দুসমূহ

এক আবর্ত নির্দেশতন্ত্রে এক দুই-বস্তু ব্যবস্থার মহাকর্ষকেন্দ্রবিমুখী বলের কার্যকরী বিভবের এক সমোন্নতি রেখাচিত্র। তিরগুলি পাঁচটি লাগ্রঁজ বিন্দুর চারিদিকে বিভবের নিম্নমুখী গ্রেডিয়েন্টকে বোঝায়। বিন্দুর দিকে বিভবকে লাল এবং বিন্দু থেকে বিভবকে নীল রঙে দেখানো হয়েছে। আবার, L4 ও L5 বিন্দুদুটি বিভবের সর্বোচ্চ মান। এই বিন্দুগুলিতে বলগুলি প্রশমিত হয়।

L1 বিন্দু

L1 বিন্দুটি M1 ও M2 ভরদুটির কেন্দ্রগামী সরলরেখার উপর অবস্থিত। এই বিন্দুতে M1 ও M2 ভরদুটির মহাকর্ষীয় বল পরস্পর মিলিত হয়ে এক সাম্যাবস্থার সৃষ্টি করে। কোনো এক বস্তু সূর্যের চারিদিকে পৃথিবীর থেকে নিকটবর্তী কক্ষপথে আবর্তন করলে তার কক্ষীয় পর্যায়কাল পৃথিবীর থেকে সাধারণত কম হওয়ার কথা, তবে এখানে পৃথিবীর মহাকর্ষীয় বলকে অগ্রাহ্য করা হয়েছে। পৃথিবী ও সূর্যের মাঝে বস্তুটি থাকলে পৃথিবীর অভিকর্ষজ বল বস্তুর উপর সূর্যের মহাকর্ষীয় বলকে কিছুমাত্রায় প্রশমিত করে, যার ফলে বস্তুটির কক্ষীয় পর্যায়কাল বৃদ্ধি পায়। বস্তুটি পৃথিবীর যত কাছে হবে, এই প্রভাবটি তত বেশি হবে। L1 বিন্দুতে বস্তুটির কক্ষীয় পর্যায়কাল পৃথিবীর কক্ষীয় পর্যায়কালের ঠিক সমান হয়। L1 বিন্দুটি পৃথিবী থেকে সূর্যের দিকে প্রায় ১৫ লক্ষ কিলোমিটার অথবা ০.০১০ জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক একক দূরত্বে অবস্থিত।[১]

L2 বিন্দু

L2 বিন্দুটি M1 ও M2 ভরদুটির কেন্দ্রগামী সরলরেখার উপর ছোট ভর থেকে দূরে অবস্থিত। এখানে ভরদুটির মিলিত মহাকর্ষীয় বল L2 বিন্দুতে কোনো বস্তুর উপর কেন্দ্রবিমুখী প্রভাবকে প্রশমিত করে। সূর্য থেকে পৃথিবীর বিপরীত দিকে কোনো বস্তুর কক্ষীয় পর্যায়কাল পৃথিবীর থেকে সাধারণত কম হওয়ার কথা। পৃথিবীর অতিরিক্ত অভিকর্ষজ বলের জন্য বস্তুটির কক্ষীয় পর্যায়কাল কমে যায়, এবং L2 বিন্দুতে কক্ষীয় পর্যায়কাল পৃথিবীর সমান হয়। L1 বিন্দুর মতো L2 বিন্দুটি পৃথিবী থেকে সূর্যের বিপরীত দিকে প্রায় ১৫ লক্ষ কিলোমিটার অথবা ০.০১০ জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক একক দূরত্বে অবস্থিত। L2 বিন্দুতে অবস্থিত এক মহাকাশযানের উদাহরণ হলো জেমস ওয়েব মহাকাশ দূরবীক্ষণ যন্ত্র, যা সূর্য–পৃথিবী L2 বিন্দুর নিকটে পরিচালনার জন্য তৈরি করা হয়েছে।[৮] আগেকার উদাহরণ হলো উইলকিনসন মাইক্রোওয়েভ অ্যানিসোট্রপি প্রোব

L3 বিন্দু

L3 বিন্দুটি M1 ও M2 ভরদুটির কেন্দ্রগামী সরলরেখার উপর বড় ভর থেকে দূরে অবস্থিত। সূর্য–পৃথিবী ব্যবস্থায় L3 বিন্দুটি সূর্যের বিপরীত দিকে অবস্থিত, পৃথিবীর কক্ষপথ থেকে কিছুটা বাইরে, এবং পৃথিবীর তুলনায় বিন্দুটি সূর্যের কেন্দ্র থেকে খানিকটা দূরে। এরকম অবস্থানের কারণ সূর্যও পৃথিবীর অভিকর্ষজ বল দ্বারা প্রভাবিত, এবং এটি সূর্য ও পৃথিবীর সাধারণ ভরকেন্দ্রের চারিদিকে আবর্তন করে, যা সূর্যের দেহের ভিতরেই অবস্থিত। সূর্য থেকে পৃথিবীর সমদূরত্বে অবস্থিত কোনো বস্তুর কক্ষীয় পর্যায়কাল এক বছর তখনই হবে যদি কেবল সূর্যের মহাকর্ষের কথা ধরা হয়। কিন্তু পৃথিবী থেকে সূর্যের বিপরীতে অবস্থিত এবং পৃথিবীর সঙ্গে সমরেখ কোনো বস্তু "অনুভব" করে যে পৃথিবীর অভিকর্ষ সূর্যের মহাকর্ষের সঙ্গে সামান্য পরিমাণে যুক্ত হচ্ছে এবং একইরকম এক বছর পর্যায়কালের জন্য একে সুতরাং পৃথিবী ও সূর্যের সাধারণ ভরকেন্দ্র থেকে সামান্য দূরে আবর্তন করা উচিত। L3 বিন্দুতেই পৃথিবী ও সূর্যের মিলিত মহাকর্ষের জন্য বস্তুটিকে পৃথিবীর মতো পর্যায়কালে আবর্তন করতে হয়, এবং এটি কার্যকরভাবে পৃথিবী ও সূর্যের মিলিত ভরের চারিদিকে আবর্তন করছে যেখানে বস্তুটির কক্ষপথের একটি নাভিতে সূর্য ও পৃথিবীর সাধারণ ভরকেন্দ্র আছে।

L4 ও L5 বিন্দু

L4 বিন্দুতে অভিকর্ষজ ত্বরণ।

L4 ও L5 বিন্দুদুটি কক্ষীয় তলে অবস্থিত দুটি সমবাহু ত্রিভুজের তৃতীয় শীর্ষে অবস্থিত যাদের সাধারণ ভূমি M1 ও M2 ভরদুটির কেন্দ্রগামী সরলরেখা, যাতে করে বিন্দুটি ছোট ভরটি থেকে ৬০° আগে (L4 বিন্দু) বা পিছে (L5 বিন্দু) অবস্থিত।

মহাকাশ যাত্রায় ব্যবহার

সূর্য–পৃথিবী

সূর্য–পৃথিবী L1 বিন্দুর চারিদিকে এক কক্ষপথে অ্যাডভান্সড কম্পোজিশন এক্সপ্লোরার মহাকাশযান।
সূর্য–পৃথিবী L2 বিন্দুর চারিদিকে কক্ষপথে গায়া (হলুদ) ও জেমস ওয়েব মহাকাশ দূরবীক্ষণ যন্ত্র (নীল)।

সূর্য–পৃথিবী ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য সূর্য–পৃথিবী L1 বিন্দু উপযুক্ত। এখানে বস্তুগুলি পৃথিবী বা চাঁদের ছায়া দ্বারা কখনোই আবৃত হয় না, এবং পৃথিবী পর্যবেক্ষণের সময় সর্বদা সূর্যালোকিত গোলার্ধকে পর্যবেক্ষণ করবে। এধরনের প্রথম মহাকাশ অভিযান হলো ১৯৭৮ ইন্টারন্যাশনাল সান আর্থ এক্সপ্লোরার ৩ (আইএসইই-৩), যা সৌর বিশৃঙ্খলার জন্য এক আন্তঃগ্রহ দ্রুত সতর্কতা পর্যবেক্ষক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল।[৯] ডিসকভার জুন ২০১৫ থেকে L1 বিন্দুর চারিদিকে আবর্তিত হয় এসেছে।

আরও দেখুন

তথ্যসূত্র

বহিঃসংযোগ

🔥 Top keywords: রাম নবমীমুজিবনগর দিবসপ্রধান পাতামুজিবনগর সরকারবিশেষ:অনুসন্ধানইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগএক্স এক্স এক্স এক্স (অ্যালবাম)বাংলাদেশবাংলা ভাষামিয়া খলিফারাজকুমার (২০২৪-এর চলচ্চিত্র)আনন্দবাজার পত্রিকাআবহাওয়ারামপহেলা বৈশাখউয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগইসরায়েলইরানরবীন্দ্রনাথ ঠাকুরমুজিবনগরইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউনরিয়াল মাদ্রিদ ফুটবল ক্লাব২০২৪ ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগক্লিওপেট্রাচর্যাপদভূমি পরিমাপশেখ মুজিবুর রহমানজনি সিন্সকাজী নজরুল ইসলামঈদুল আযহাফিলিস্তিনইউটিউবভারতবিকাশআসসালামু আলাইকুমসৌদি আরববাংলা প্রবাদ-প্রবচনের তালিকামুহাম্মাদ