সাওর বিপ্লব

সাওর বিপ্লব (দারি: إنقلاب ثور পশতু: د ثور انقلاب) ১৯৭৮ সালের ২৭-২৮ এপ্রিল পিপল'স ডেমোক্রেটিক পার্টি অব আফগানিস্তান (পিডিপিএ) কর্তৃক রাষ্ট্রপতি মুহাম্মদ দাউদ খানের বিরুদ্ধে সংঘটিত হয়। দাউদ খান ইতিপূর্বে ১৯৭৩ সালে তার চাচাত ভাই ও বাদশাহ মুহাম্মদ জহির শাহকে ক্ষমতাচ্যুত করেছিলেন। দারি ভাষায় ফার্সি বর্ষপঞ্জির দ্বিতীয় মাসকে 'সাওর' বলা হয়। এই মাসে বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল।[২] এই বিপ্লবের ধারাবাহিকতায় ১৯৭৯ সালে আফগানিস্তানে সোভিয়েত হস্তক্ষেপ এবং ১৯৭৯-১৯৮৯ সালে সোভিয়েত-আফগান যুদ্ধ সংঘটিত হয়।

সাওর বিপ্লব
মূল যুদ্ধ: সোভিয়েত-আফগান যুদ্ধের পূর্বাবস্থা এবং স্নায়ু যুদ্ধ

কাবুলে রাষ্ট্রপতির প্রাসাদের বাইরে, ২৮ এপ্রিল ১৯৭৮
তারিখ২৭-২৮ এপ্রিল ১৯৭৮
অবস্থান
ফলাফল

পিডিপির বিজয়

বিবাদমান পক্ষ

আফগানিস্তান আফগানিস্তান প্রজাতন্ত্র

  • প্রেসিডেন্সিয়াল গার্ড
পিডিপিএ
সেনাধিপতি ও নেতৃত্ব প্রদানকারী
আফগানিস্তান মুহাম্মদ দাউদ খান  
আফগানিস্তান আবদুল কাদির নুরিস্তানি
মুহাম্মদ আসলাম ওয়াতানজার[১])
আবদুল কাদির
নূর মুহাম্মদ তারাকি [১])
হাফিজউল্লাহ আমিন
বাবরাক কারমাল[১]

পটভূমি

কেজিবির সংশ্লিষ্টতা

অভ্যুত্থানের অধিকাংশ সংগঠক সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রশিক্ষণ লাভ করেছিলেন। দাপ্তরিকভাবে সোভিয়েত ইউনিয়ন কোনো পূর্বশর্ত ছাড়া ব্যাপক উন্নয়ন সহায়তা পাঠিয়েছিল। পিডিপিএ গঠনে সোভিয়েত ইউনিয়নরা আর্থিকভাবে সহায়তা করে।

আফগানিস্তানকে প্রজাতন্ত্র ঘোষণা সাওর বিপ্লবে ভূমিকা রেখেছে। রাষ্ট্রপতি দাউদ খানের ধারণা ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে শক্তিশালী সম্পর্ক থাকলে পাকিস্তানের সাথে সীমান্ত সমস্যা নিরসন করা সম্ভব হবে। তবে পরে তিনি সরকারে সোভিয়েতদের ব্যাপক সংশ্লিষ্টতার কারণে শঙ্কিত হন। তার ধারণা হয় যে সোভিয়েতরা আফগানিস্তান দখলের পরিকল্পনা করছে। এর ফলে তার সরকার ও সোভিয়েত ইউনিয়নের সম্পর্ক শীতল হতে থাকে। আফগানিস্তানে রুশ প্রভাব পুনপ্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে সাওর বিপ্লব সংঘটিত হয়।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]

বিপ্লবের পর সোভিয়েত ইউনিয়নের উপর পিডিপিএর নির্ভ‌রশীলতা শীঘ্রই প্রকাশ হয়ে পড়ে। কাবুলের মার্কিন দূতাবাস থেকে ওয়াশিংটনে প্রেরিত টেলিগ্রামে বলা হয় "প্রথম ব্রিটিশ, এবং পরে মার্কিনরা শত বছর ধরে যা প্রতিহত করার চেষ্টা করে এসেছে তা সংঘটিত হয়েছে: রুশ ভালুক হিন্দু কুশের দক্ষিণে এসে পড়েছে।"[৩]

১৯৭৩ আফগানিস্তান অভ্যুত্থান

মুহাম্মদ জহির শাহ ১৯৩৩ সালে সিংহাসনে বসেন। তার চাচাত ভাই মুহাম্মদ দাউদ খান ১৯৫৩ সাল থেকে ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তিনি বাদশাহর সমর্থক ছিলেন না।[৪] ১৯৭০ এর দশকে দাউদ তাকে ক্ষমতাচ্যুত করার পরিকল্পনা করেন। ১৯৭৩ সালে বাদশাহ চিকিৎসার জন্য ইতালি যান। এসময় দাউদের নেতৃত্বে সংঘটিত অভ্যুত্থানে জহির শাহ ক্ষমতাচ্যুত হন এবং রাজতন্ত্র বিলুপ্ত হয়। দাউদ খান নতুন সরকার গঠন করে নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেন। এরপর থেকে জহির শাহ ইতালিতে নির্বাসিত জীবনযাপন করতে থাকেন।[৫]

দাউদ খানের শাসন

দাউদ খানের শাসনামলে ক্ষমতাসীন পিডিপিএ দলের মধ্য কোন্দল দেখা দেয়। এর ফলে পারচাম ও খালক নামক দুইটি উপদল তৈরি হয়। ১৯৭৮ সালে অন্যতম প্রধান পারচাম সদস্য মীর আকবর খাইবার খুন হন। সরকারের তরফ থেকে এ ঘটনায় শোক প্রকাশ করা হলেও নূর মুহাম্মদ তারাকি এজন্য সরকারকে দায়ী করেন। এছাড়াও কাবুলের বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর অনেকে এমনটা বিশ্বাস করত। পিডিপিএ নেতৃবৃন্দের মধ্যে ধারণা জন্মায় যে দাউদ সবাইকে নিশ্চিহ্ন করার পরিকল্পনা করছেন।

খাইবারের জানাজার সময় সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ অনুষ্ঠিত হয়। এরপর বাবরাক কারমালসহ অন্যান্য পিডিপিএ নেতৃবৃন্দ গ্রেপ্তার হন। তবে হাফিজউল্লাহ আমিন গৃহবন্দি হন। এর ফলে তিনি অভ্যুত্থান সংগঠিত করার সুযোগ পান।[৬] তিনি খালকপন্থি সেনা অফিসারদেরকে সরকার উৎখাতের নির্দেশনা দেন।

অভ্যুত্থান

১৯৭৮ সালের ২৭ এপ্রিল বৃহষ্পতিবার সামরিক বাহিনীতে পিডিপিএর খালকপন্থিদের অনুগতরা কাবুলে রাষ্ট্রপতি প্রাসাদে হামলা চালায়। পরেরদিন শুক্রবার হওয়ায় এবং অধিকাংশ সামরিক ও সরকারি কর্মীরা ছুটিতে থাকার কারণে কৌশলগতভাবে এই দিনটি বেছে নেয়া হয়েছিল। বিমানবাহিনীর কয়েকটি প্লেনের সহায়তায় বিদ্রোহীরা রাষ্ট্রপতির রক্ষীদের প্রতিরোধ ভেঙে ফেলে এবং দাউদ খান ও তার পরিবারের অধিকাংশ সদস্য নিহত হন।

নতুন শহরের (শারি নাও) স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে প্রথম গুলির শব্দ শোনা যায়। এখানে থেকে শহরের অন্যত্র লড়াই ছড়িয়ে পড়ে। বিকেলে জঙ্গিবিমান থেকে শহরের কেন্দ্রে অবস্থিত প্রাসাদে হামলা চালানো হয়। সন্ধ্যার দিকে সরকারি বেতার কেন্দ্র থেকে ঘোষণা করা হয় যে খালকপন্থিরা দাউদের সরকার উৎখাত করেছে। ঘোষণায় খালক শব্দের ব্যবহারের কারণে একথা স্পষ্ট হয়ে যায় যে পিডিপিএ অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দিচ্ছে এবং বেতার কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে।[৭]

মধ্যরাতে প্রাসাদের উপর বিমান হামলা বৃদ্ধি পায়। পরের দিন ২৮ এপ্রিল সকালে কাবুল শান্ত ছিল। তবে শহরের দক্ষিণ থেকে বন্দুক যুদ্ধের আওয়াজ শোনা যায়। একদল সৈনিক প্রাসাদ ঘিরে ফেলে রাষ্ট্রপতি দাউদ ও তার ভাই নাইমের আত্মসমর্পণ দাবি করে। কিন্তু তারা অস্ত্র নিয়ে সৈনিকদের উপর হামলা চালানোর পর সৈনিকদের গুলিতে নিহত হন।[৮]

সাওর বিপ্লবের পরের দিন কাবুলের দৃশ্য।

কম্যুনিস্ট শাসন

দাউদ খানের পতনের পর পিডিপিএ ক্ষমতাসীন হয়। খালকপন্থি নূর মুহাম্মদ তারাকির নেতৃত্বে নতুন সরকার স্থাপিত হয়। মন্ত্রীসভায় খালক ও পারচাম উভয় গ্রুপ থেকে নেতা বাছাই করা হয়েছিল। খালকপন্থি তারাকি প্রধানমন্ত্রী, পারচামপন্থি কারমাল সিনিয়র ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী এবং খালকপন্থি আমিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হন। তবে এই মিত্রতা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। জুলাইয়ের শুরুর দিকে তারাকি ও আমিন সরকার থেকে পারচামপন্থিদের অপসারণ করেন। কারমালকে চেকোস্লোভাকিয়ায় রাষ্ট্রদূত হিসেবে পাঠিয়ে দেয়া হয়। ১৯৭৮ সালের আগস্টে তারাকি ও আমিন একটি ষড়যন্ত্র জানতে পারেন এবং মন্ত্রীসভার কয়েকজন বন্দী সদস্যকে মৃত্যুদন্ড প্রদান ও বন্দী করেন। বন্দীদের মধ্যে বিপ্লবের সামরিক নেতা জেনারেল আবদুল কাদিরও ছিলেন। ১৯৭৯ সালের সেপ্টেম্বরে তারাকিও আক্রান্ত হন। এসময় আমিন তাকে ক্ষমতাচ্যুত ও হত্যা করেন।ted him.[৯]

ক্ষমতাসীন হওয়ার পর পিডিপিএ সমাজতান্ত্রিক কর্মসূচি চালু করেন। ঐতিহ্যবাহী সবুজ ইসলামি পতাকার বদলে সোভিয়েত ইউনিয়নের আদলে লাল রঙের পতাকার ব্যবহার শুরু হয়। এর ফলে জনগণ অসন্তুষ্ট হয়।[১০] নতুন ব্যবস্থা না নিয়ে প্রথাগত ঋণ ব্যবস্থা বিলুপ্ত করায় কৃষিক্ষেত্রে সংকট দেখা দেয়।[১১][১২] ভূমি সংস্কার কার্যক্রমও সমালোচিত হয়েছিল। এক সাংবাদিক সমালোচনা করে বলেন "অগোছালো পন্থায় ভূমি অধিগ্রহণের ফলে সবাই ক্ষিপ্ত হয়, এতে কেউই লাভবান হয়নি, এবং খাদ্য উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে," এবং "আফগানিস্তানের আধুনিক ইতিহাসে প্রথমবারের মত সংগঠিত, জাতিপর্যায়ের নিষ্পেষণ।"[১৩]

নারী অধিকার

পিডিপিএ নারীদের সমতা ঘোষণা করে[১৪] এর ফলে রক্ষণশীল জনগণ ক্ষিপ্ত হয় এবং একে ইসলামের উপর আক্রমণ হিসেবে বিবেচনা করে।[১৫] নারী অধিকারের উপর পিডিপিএ কর্তৃক বেশ কয়েকটি বক্তব্য প্রচার করা হয় যাতে নারী সমতা এবং রাজনৈতিক জীবনে নারীদের অংশগ্রহণের কথা বলা হয়।

মানবাধিকার

বিপ্লবের পর দেশে কঠোর নির্যাতন শুরু হয়। সাংবাদিক রবার্ট কাপলানের বর্ণা‌নুযায়ী আফগানিস্তান ঐতিহাসিকভাবে দরিদ্র ও উন্নয়নবঞ্চিত হলেও ১৯৭৮ সাল নাগাদ এখানে রাজনৈতিক নির্যাতন কখনোই বেশি দেখা যায়নি।

মধ্যরাতে দরজায় সৈনিকদের করাঘাত অনেক আরব ও আফ্রিকান রাষ্ট্রে খুব স্বাভাবিক হলেও আফগানিস্তানে খুব কমই তা দেখা যেত, এখানে কেন্দ্রীয় সরকার কাবুলের বাইরে নিজ কর্তৃত্ব দেখাতে পারত না।তারাকির অভ্যুত্থান সব বদলে দেয়। ১৯৭৮ সালের এপ্রিল থেকে ১৯৭৯ সালের ডিসেম্বরে সোভিয়েত আগ্রাসনের মধ্যবর্তী সময়ে আফগান কম্যুনিস্টরা কাবুল থেকে ছয় মাইল পূর্বের পুল-ই-চারকি কারাগারে ২৭,০০০ রাজনৈতিক বন্দীকে হত্যা করে....অধিকাংশ ক্ষতিগ্রস্ত ছিল আফগানিস্তানের ধার্মিক গ্রামীণ সমাজের আধুনিকায়ন ও সেকুলারকরণের বিরোধী গ্রামের মোল্লা ও প্রধানরা। পাশ্চাত্যের মাপকাঠিতে এটা ফলপ্রসূ। কিন্তু এই কার্যক্রম এতটা সহিংসভাবে সম্পন্ন হচ্ছিল যে এমনকি সোভিয়েতরাও শঙ্কিত হয়ে উঠে...[১৬]

আরও দেখুন

তথ্যসূত্র

বহিঃসংযোগ

🔥 Top keywords: রাম নবমীমুজিবনগর দিবসপ্রধান পাতামুজিবনগর সরকারবিশেষ:অনুসন্ধানইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগএক্স এক্স এক্স এক্স (অ্যালবাম)বাংলাদেশবাংলা ভাষামিয়া খলিফারাজকুমার (২০২৪-এর চলচ্চিত্র)আনন্দবাজার পত্রিকাআবহাওয়ারামপহেলা বৈশাখউয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগইসরায়েলইরানরবীন্দ্রনাথ ঠাকুরমুজিবনগরইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউনরিয়াল মাদ্রিদ ফুটবল ক্লাব২০২৪ ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগক্লিওপেট্রাচর্যাপদভূমি পরিমাপশেখ মুজিবুর রহমানজনি সিন্সকাজী নজরুল ইসলামঈদুল আযহাফিলিস্তিনইউটিউবভারতবিকাশআসসালামু আলাইকুমসৌদি আরববাংলা প্রবাদ-প্রবচনের তালিকামুহাম্মাদ