স্বাদ

স্বাদ হল মুখগহ্বরে স্থাপিত কোনও পদার্থের (মূলত খাদ্যের) সেই উপলব্ধ ধর্ম, যা দ্বারা পদার্থটিকে অম্ল (টক), মিষ্টি, লবণাক্ত (নোনতা), তিক্ত (তিতা বা তেতো), ইত্যাদি বিশেষণে চরিত্রায়িত করা যায়। যে ক্ষমতাবলে স্বাদ অনুভূত বা উপলব্ধ হয়, তাকে স্বাদেন্দ্রিয় বা স্বাদ উপলব্ধির ক্ষমতা বলে।[১] যে অঙ্গটি স্বাদ গ্রহণের সাথে জড়িত, তাকে স্বাদগ্রাহক অঙ্গ বা রাসনাঙ্গ (Taste organ) বলে; মানুষের ক্ষেত্রে জিহ্বা প্রধান স্বাদগ্রাহক অঙ্গ। যে জটিল প্রক্রিয়ায় মুখগহ্বর থেকে স্বাদের স্নায়বিক সংকেতগুলি মস্তিষ্কে গিয়ে স্বাদের উপলব্ধি হয়, তাকে আস্বাদন (Gustation) বা স্বাদ প্রত্যক্ষণ (Taste perception) বলে। যখন কোনও পদার্থ মুখগহ্বরে, মূলত জিহ্বার উপরিতলে অবস্থিত স্বাদকোরকগুলির স্বাদগ্রাহক কোষগুলির সাথে রাসায়নিক বিক্রিয়া করে, তখন সেগুলি উদ্দীপ্ত হয়ে মস্তিষ্কে বা মনে স্বাদ উপলব্ধির ঘটনাটি সংঘটিত হয়। স্বাদ কোনও খাদ্য বা পদার্থের স্বাদ ও গন্ধের মিশ্র অনুভূতির তথা স্বাদগন্ধের (flavour) একটি অংশ হিসেবে অনুভূত হয়। স্বাদ সংবেদন, ঘ্রাণ সংবেদন ও ত্রিজ স্নায়ুর উদ্দীপন (যে স্নায়ুটি খাদ্যের বুনট, ব্যথা-উদ্রেককারী ক্ষমতা ও তাপমাত্রা সম্পর্কিত উপাত্ত বহন করে), এই তিনটি মিলে খাদ্য ও অন্যান্য পদার্থের সামগ্রিক স্বাদগন্ধ নির্ধারিত হয়। মানুষের জিহ্বা, উপজিহ্বা (আলজিহ্বা) ও অন্যান্য অংশেও স্বাদকোরক ও অন্যান্য ধরনের স্বাদ সংবেদী কোষ থাকে।[২][৩] মস্তিষ্কের বহিঃস্তরে অবস্থিত স্বাদসংক্রান্ত কেন্দ্রে (gustatory cortex) স্বাদের প্রত্যক্ষণ বা উপলব্ধি সম্পাদিত হয়।

জিহ্বার চার ধরনের পিড়কা; ১) সূত্রাকার পিড়কা, যেগুলি কোন স্বাদ গ্রহণ করে না, ২) ছত্রাকাকার পিড়কা, ৩) পর্ণাকার পিড়কা এবং ৪) বলয়িত পিড়কা; শেষোক্ত তিন ধরনের পিড়কা রাসায়নিকভাবে উদ্দীপ্ত হয়ে পাঁচ ধরনের মৌলিক স্বাদের স্নায়বিক সংকেত মস্তিষ্কে প্রেরণ করে
একটি স্বাদকোরকের দৈর্ঘ্যচ্ছেদ

স্বাদেন্দ্রিয় বা স্বাদসংক্রান্ত তন্ত্রটি অসংখ্য স্বাদগ্রাহক কোষ (taste receptor cell) নিয়ে গঠিত, যেগুলি স্বাদকোরক (taste bud) নামক কাঠামোর ভেতরে অবস্থান করে। মানুষের জিহ্বাতে ২ হাজার থেকে ৫ হাজার স্বাদকোরক থাকে,[৪] যা সমস্ত স্বাদকোরকের তিন-চতুর্থাংশ। এছাড়া মুখগহ্বরের তালু, পার্শ্ব ও পশ্চাৎ অংশে এবং গলার ভেতরে স্বরযন্ত্র, গলবিল ও অন্ননালীর উপরের প্রান্তেও কিছু (প্রায় এক-চতুর্থাংশ) স্বাদকোরক থাকে। জিহ্বার স্বাদকোরকগুলি আবার জিহ্বাপিড়কা (lingual papillae) নামক কাঠামোর ভেতরে অবস্থান করে; জিহ্বাপিড়কাগুলি খালি চোখে দৃশ্যমান ও জিহ্বাকে আচ্ছাদনকারী বহুসংখ্যক ক্ষুদ্র বৃন্তসদৃশ কাঠামো।[২] চার ধরনের জিহ্বাপিড়কা আছে, এগুলি হল জিহ্বার সমুখ দুই-তৃতীয়াংশে অবস্থিত ২ শত থেকে ৩ শত ছত্রাকাকার পিড়কা (fungiform papillae), জিহ্বার পশ্চাৎভাগে দুই পাশে ২০টি ভাঁজবিশিষ্ট ২টি পর্ণাকার পিড়কা (foliate papillae) এবং জিহ্বার পশ্চাৎভাগে মাঝামাঝি ৯টি বলয়িত পিড়কা (circumvallate papillae)। ছত্রাকার পিড়কাগুলির প্রতিটির অগ্রপৃষ্ঠে ৩ থেকে ৫টি করে স্বাদকোরক থাকে। প্রতিটি পর্ণাকার পিড়কাতে ৬০০টি স্বাদকোরক থাকে। অন্যদিকে প্রতিটি বলয়িত পিড়কাতে ২৫০টি স্বাদকোরক থাকে।[১][৫] ছত্রাকাকার, পর্ণাকার ও বলয়িত পিড়কাগুলিতে সব মিলিয়ে যথাক্রমে ২৫%, ২৫% ও ৫০% স্বাদকোরক থাকে। উপরের তিন ধরনের পিড়কা ছাড়াও জিহ্বার উপরে অসংখ্য সূত্রাকৃতি পিড়কা (filiform papillae) আছে, কিন্তু এগুলিতে কোনও স্বাদকোরক থাকে না। প্রতিটি স্বাদকোরক প্রায় ৫০ মিলিমিটার প্রশস্ত এবং প্রতিটিতে ৩০ থেকে ১০০টি স্বাদগ্রাহক কোষ ও কিছু ভিত্তিকোষ থাকে।

মুখগহ্বরের স্বাদগ্রাহক কোষগুলি পাঁচ ধরনের স্বাদের প্রতি সাড়া দেয়। এগুলি হল মিষ্টতা, অম্লতা, লবণাক্ততা, তিক্ততা ও মাংসলতা (জাপানি ভাষায় "উমামি")।[১][২][৬][৭] বৈজ্ঞানিক পরীক্ষণে প্রমাণিত হয়েছে এই পাঁচ ধরনের স্বাদের অস্তিত্ব আছে এবং এগুলি একে অপরের থেকে স্বতন্ত্র। খাদ্য বা পদার্থের স্বাদ-উদ্দীপক (tastant) অণু বা আয়ন স্বাদকোরকের উন্মুক্ত রন্ধ্রের মাধ্যমে এর ভেতরে প্রবেশ করে স্বাদগ্রাহক কোষগুলির সাথে রাসায়নিক ক্রিয়ার লিপ্ত হয়ে ভিন্ন ভিন্ন স্বাদের স্বতন্ত্র সংকেত উৎপাদন করে। যখন এই স্বাদ-উদ্দীপক অণুগুলি স্বাদকোরকগুলির জি প্রোটিন-যুগ্মায়িত গ্রাহকগুলির সাথে সংযুক্ত হয়, তখন মিষ্টতা, মাংসলতা ও তিক্ততা - এই তিনটি স্বাদবাহী সংকেত উৎপন্ন হয়। অন্যদিকে যখন কোনও ক্ষার ধাতুর আয়ন (ধনায়ন বা ক্যাটায়ন) এবং হাইড্রোজেন আয়ন স্বাদকোরকের মধ্যে প্রবেশ করে, তখন যথাক্রমে লবণাক্ততা ও অম্লতাবাহক (টক স্বাদ) সংকেত উৎপন্ন হয়।[৮]

স্বাদের মৌলিক প্রকারগুলি আংশিকভাবে মুখে খাদ্যের সংবেদন ও স্বাদগন্ধের জন্য দায়ী। অন্যান্য নিয়ামকগুলির মধ্যে আছে গন্ধ,[১] যা কিনা নাকের গন্ধসংক্রান্ত উপঝিল্লি (olfactory epithelium) দ্বারা গৃহীত হয়;[৯] বুনট,[১০] যা বিভিন্ন প্রকারের যান্ত্রিক গ্রাহক (mechanoreceptor), পেশী স্নায়ু, ইত্যাদি দ্বারা গৃহীত হয়;[১১] তাপমাত্রা, যা তাপগ্রাহকগুলি (thermoreceptor) দ্বারা গৃহীত হয়; "শীতলতা" (coolness), যেমন মেন্থলের শীতল অনুভূতি ও "ঝাল" বা "কড়া" অনুভূতি (hotness বা pungency), যেমন মরিচের ঝাল অনুভূতি, কিংবা অঙ্গারায়িত (কার্বন ডাই-অক্সাইড বুদবুদবিশিষ্ট) পানীয় পানের সময় সৃষ্ট "শিরশির" অনুভূতি মুখগহ্বরের শ্লৈষ্মিক ঝিল্লির পৃষ্ঠে সংঘটিত এক ধরনের রাসায়নিক সংবেদনের (chemesthesis) মাধ্যমে সংঘটিত হয়। সুতরাং ঝাল বৈজ্ঞানিকভাবে স্বীকৃত কোনও মৌলিক স্বাদ নয়, কেননা ঝালের উপলব্ধি জিহ্বার স্বাদকোরকগুলি থেকে আসে না। বরং এক্ষেত্রে খাদ্যের কিছু অণু (যেমন মরিচের ক্যাপসেসিন অণু) মুখের শ্লৈষ্মিক ঝিল্লির ত্রিজস্নায়ুকে উদ্দীপ্ত করে ও সেই স্নায়বিক উদ্দীপনা মুখমণ্ডলীয় স্নায়ু, জিহ্বাগলবিলীয় স্নায়ু ও ভবঘুরে স্নায়ু (ভেগাস স্নায়ু) দ্বারা বাহিত হয়ে মস্তিষ্কে পৌঁছায় ও "ঝাল" হিসেবে উপলব্ধ হয়।

স্বাদতন্ত্রটি একই সাথে ক্ষতিকর ও উপকারী পদার্থের প্রতি সংবেদনশীল, তাই সব মৌলিক স্বাদ-প্রকারগুলিকে হয় অনীহামূলক কিংবা রুচিবর্ধক হিসেবে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়, যা মানবদেহের উপরে এগুলির প্রভাবের উপর নির্ভর করে।[১২] মিষ্টতা শক্তিসমৃদ্ধ খাদ্য শনাক্ত করতে সাহায্য করে, অন্যদিকে তিক্ততা বা তিতা স্বাদ বিষের সতর্কসংকেত হিসেবে কাজ করে।[১৩]

বৃদ্ধ বয়সে জিহ্বাপিড়কাগুলি হ্রাস পেতে শুরু করলে ও লালারসের পরিমাণ কমতে শুরু করলে স্বাদের উপলব্ধি ধীরে ধীরে ফিকে হতে শুরু করে।[১৪] স্বাদ উপলব্ধিতে বিকারও ঘটতে পারে, যাকে স্বাদবিকার (dysgeusia) বলে। সমস্ত স্তন্যপায়ী প্রাণী একই ধরনের মৌলিক স্বাদ গ্রহণের অধিকারী হয় না। কিছু কিছু তীক্ষ্ণদন্তী প্রাণী শ্বেতসারের স্বাদ উপলব্ধি করতে, কিন্তু মানুষেরা তা পারে না। বিড়ালরা মিষ্টতা উপলব্ধি করতে পারে না। বেশ কিছু মাংসাশী প্রাণী যেমন হায়েনা, শুশুক বা ডলফিন ও সমুদ্রসিংহের পাঁচটি মৌলিক স্বাদের মধ্যেই চারটির জন্যই স্বাদগ্রহণ ক্ষমতা বিলুপ্ত হয়ে গেছে; তারা কেবল লবণাক্ততা শনাক্ত করতে পারে। [১৫]

ভূমিকা

ইতিহাস

পশ্চিমা বিশ্বে এরিস্টটলই[১৬] প্রথম দাবি করেন যে সকল স্বাদই দুইটি মৌলিক স্বাদ মিষ্ট ও তিক্ত[১৭] দিয়ে তৈরি।[১৮]

প্রাচীন ভারতীয় আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা শাস্ত্র মতে স্বাদ হলো ৬টি: অম্ল, মধুর, তিক্ত, লবণ, কষায় এবং কটু।[১৯]

মৌলিক স্বাদ

বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে শরীর এবং মনো বৈজ্ঞানিকরা চারটি মৌলিক স্বাদ বিশ্বাস করতেন: মিষ্ট, টক, নোনতা এবং তিতা। তখনও পঞ্চম স্বাদ হিসেবে উমামি স্বীকৃত হয়নি,[২০] কিন্তু বর্তমানে অনেকেই এটিকে পঞ্চম স্বাদ হিসাবে স্বীকার করে।

মিষ্ট

মিষ্টকে সাধারণত একটি তৃপ্তিকর সংবেদন হিসাবে গণ্য করা হয়। এটি চিনি এবং অন্যান্য কয়েকটি পদার্থের উপস্থিতিতে উৎপাদিত হয়। মিষ্টত্ব প্রায়ই অ্যালডিহাইড এবং কিটোন সাথে সংযুক্ত থাকে যা কার্বনাইল গ্রুপ ধারণ করে।

টক

টক একটি স্বাদ যাতে অম্লত্ব অনুভূত হয়। কোন বস্তুর টক স্বাদকে পরিমাপ করা হয় লঘু হাইড্রক্লোরিক এসিডের সাপেক্ষে, অম্ল সূচকে যার অবস্থান ১।

নোনতা

সোডিয়াম আয়নের উপস্থিতি প্রাথমিকভাবে নোনতা স্বাদ উৎপাদিত স্বাদ হয়. ক্ষার ধাতুর অন্যান্য আয়নেও লবণ স্বাদ আছে, কিন্তু সোডিয়াম থেকে তা কম লবণাক্ত।

তিতা

তিক্ততা সবচেয়ে সংবেদনশীল স্বাদ এবং অনেকে এটাকে অনুপভোগ্য, উৎকট অথবা অসহনীয় উপলব্ধি করে। প্রচলিত তিক্ত খাবার এবং পানীয় হলো কফি, কুইনাইন, লেবুজাতীয় ফলের খোসা, চিরতা কাণ্ড, পাট শাক, বিয়ার ইত্যাদি।

উমামি

উমামি একটি ক্ষুধাবর্ধক স্বাদ এবং একে সুগন্ধী[২১][২২] বা মাংসবৎ গন্ধযুক্ত স্বাদ হিসাবে উল্লেখ করা হয়।[২২][২৩] এই স্বাদ পনির[২৪] এবং সয়া সসে পাওয়া যায়।

তথ্যসূত্র

বহিঃসংযোগ

🔥 Top keywords: রাম নবমীমুজিবনগর দিবসপ্রধান পাতামুজিবনগর সরকারবিশেষ:অনুসন্ধানইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগএক্স এক্স এক্স এক্স (অ্যালবাম)বাংলাদেশবাংলা ভাষামিয়া খলিফারাজকুমার (২০২৪-এর চলচ্চিত্র)আনন্দবাজার পত্রিকাআবহাওয়ারামপহেলা বৈশাখউয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগইসরায়েলইরানরবীন্দ্রনাথ ঠাকুরমুজিবনগরইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউনরিয়াল মাদ্রিদ ফুটবল ক্লাব২০২৪ ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগক্লিওপেট্রাচর্যাপদভূমি পরিমাপশেখ মুজিবুর রহমানজনি সিন্সকাজী নজরুল ইসলামঈদুল আযহাফিলিস্তিনইউটিউবভারতবিকাশআসসালামু আলাইকুমসৌদি আরববাংলা প্রবাদ-প্রবচনের তালিকামুহাম্মাদ