ছিন রাজবংশ

ছিন সাম্রাজ্য (চীনা: ; ফিনিন: Qín Cháo; ওয়েড-জাইলস: Ch'in2 Ch'ao2; আইপিএ: [tɕʰǐn tʂʰɑ̌ʊ̯]) সাম্রাজ্যবাদী চীনের প্রথম সাম্রাজ্য, যা খ্রিস্টপূর্ব ২২১ অব্দ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ২০৬ অব্দ পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। ছিন রাজ্যের নামে এই সাম্রাজ্যের নামকরণ করা হয়, যা বর্তমানে গানসুশানসি নামে পরিচিত। কিন সাম্রাজ্যের প্রথম সম্রাট ছিন শি হুয়াং সাত যুদ্ধরত রাজ্য থেকে কিন রাজ্য জয় করে এই সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে যুদ্ধরত রাজ্য কালে শাং ইয়াং আইনসর্বস্বতা ধারণার প্রবর্তন করার ফলে কিন সাম্রাজ্যের ক্ষমতা আরও বেড়ে যায়। খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীর মাঝামাঝি ও শেষের দিকে, ছিন কয়েকটি বিজয় লাভ করে সারা চীনের উপর নিয়ন্ত্রণ লাভ করে, যার মধ্যে ছিল দুর্বল চৌ সাম্রাজ্য ও সাত যুদ্ধরত রাজ্যের বাকি ছয় রাজ্যের বিরুদ্ধে বিজয়। এই সময়ে কিন তার রাজনৈতিক ক্ষমতা ও দৃঢ় অর্থনীতি দিয়ে সমগ্র চীনকে একত্রিত করে বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তুলে।[১]

ছিন সাম্রাজ্য

秦朝
খ্রিস্টপূর্ব ২২১ অব্দ–খ্রিস্টপূর্ব ২০৬ অব্দ
কিন সাম্রাজ্য, আনু. খ্রিস্টপূর্ব ২১০ অব্দ
কিন সাম্রাজ্য, আনু. খ্রিস্টপূর্ব ২১০ অব্দ
অবস্থাসাম্রাজ্য
রাজধানীজিয়ানইয়াং
প্রচলিত ভাষাপ্রাচীন চীনা ভাষা
ধর্ম
চীনা লোকজ ধর্ম
সরকাররাজতন্ত্র
সম্রাট 
• খ্রিস্টপূর্ব ২২১ - ২১০ অব্দ
ছিন শি হুয়াং
• খ্রিস্টপূর্ব ২১০ - ২০৭ অব্দ
ছিন আর শি
চ্যান্সেলর 
• খ্রিস্টপূর্ব ২২১ - ২০৮ অব্দ
লি সি
• খ্রিস্টপূর্ব ২০৮ - ২০৭ অব্দ
চৌ গাও
ঐতিহাসিক যুগসাম্রাজ্য
• সমগ্র চীনকে একত্রীকরণ
খ্রিস্টপূর্ব ২২১ অব্দ
খ্রিস্টপূর্ব ২১০ অব্দ
• লিউ বাংয়ের আত্মসমর্পণ
খ্রিস্টপূর্ব ২০৬ অব্দ
জনসংখ্যা
• খ্রিস্টপূর্ব ২১০ অব্দ
২০,০০০,০০০
মুদ্রাপ্রাচীন চীনা মুদ্রা
পূর্বসূরী
উত্তরসূরী
চৌ সাম্রাজ্য
ছিন রাজ্য
আট সাম্রাজ্য
হান সাম্রাজ্য
নানইয়ুয়ে
ছিন রাজবংশ
শিলালিপিতে (উপরে) ও আধুনিক লিপিতে (নিচে)"ছিন সাম্রাজ্য" <r> চীনা অক্ষর
চীনা 秦朝

ইতিহাস

উৎপত্তি ও প্রাথমিক সময়

খ্রিস্টপূর্ব নবম শতাব্দীতে সিয়া সাম্রাজ্য সময়কালের রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ গাও ইয়াওয়ের উত্তরসূরী ফেইজিকে কিন শহরের শাসনভার প্রদান করা হয়। শহরটি বর্তমান সময়ের তিয়ানশুই শহরে অবস্থিত ছিল। চৌ সাম্রাজ্যের অষ্টম রাজা সিয়াওয়ের রাজত্বকালে এই শহর কিন রাজ্য নামে পরিচিতি লাভ করে। খ্রিস্টপূর্ব ৮৯৭ অব্দে গংহে রাজপ্রতিনিধির সময়কালে এলাকাটি ঘোড়ার বংশবিস্তার ও প্রতিপালনের জন্য নির্ভরশীল হয়ে ওঠে।[২] ফেইজির এক উত্তরসূরী ডিউক ঝুয়াং ত্রয়োদশ চৌ রাজা পিংয়ের প্রিয়পাত্র হয়ে উঠে এবং রাজা পুরস্কারস্বরূপ তার পুত্র ডিউক সিয়াংকে এক অভিযানের প্রধান করে পূর্বে পাঠান। সেখানে তিনি কিন রাজ্য গড়ে তুলেন।[৩]

ক্ষমতা লাভ

যুদ্ধরত রাজ্যগুলোর মানচিত্র, ছিন রাজ্য (গোলাপী)

শাং ইয়াং, ছিন রাজ্যের একজন আইনপ্রণয়নকারী, যুদ্ধরত রাজ্য কালে আইনসর্বস্বতা ধারণার প্রবর্তন করেন, এবং খ্রিস্টপূর্ব ৩৬১ অব্দ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৩৩৮ অব্দ পর্যন্ত সামরিক বাহিনীতে বেশ কিছু সংস্কার কাজ করেন। এছাড়া তিনি খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীর মাঝামাঝিতে জিয়ানইয়াংয়ে ছিন রাজ্যের রাজধানী গড়ে তুলতে অবদান রাখেন।[৪] আইনসর্বস্বতার প্রসার লাভ করলে চীনে যুদ্ধ শুরু হয়। শরৎ বসন্ত যুগে বলা হত যুদ্ধ হল ভদ্রলোকদের কাজ এবং যুদ্ধে সেনাপতিদের স্বর্গীয় আইনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে যুদ্ধ করতে হত।[৫] ছিন যুদ্ধের এই মতবাদকে অস্বীকার করে এবং শত্রুর দুর্বলতার সুযোগ নিতে থাকে। ওয়েই রাজ্যের একজন অভিজাত অভিযোগ করেন যে ছিনরা ছিল খুবই অর্থলোভী, জেদী, মুনাফা প্রত্যাশী ও আন্তরিকতাহীন এবং শিষ্টাচার, সুসম্পর্ক, নৈতিক কার্যাবলী সম্পর্কে অজ্ঞ।[৬][৭]

ছিনদের আরেকটি বড় শক্তি ছিল তাদের দক্ষ সামরিক বাহিনী ও যোগ্য সেনাপ্রধান। তারা নতুন যুদ্ধসরঞ্জাম ও যোগাযোগ ব্যবস্থার সদ্ব্যবহার করে, যা তাদের শত্রুবাহিনীর ছিল না।[৮] ছিন সাম্রাজ্যের আরেকটি প্রধান সুবিধা ছিল ভৌগোলিক অবস্থান। পর্বতবেষ্টিত রাজ্যটি প্রাকৃতিকভাবে একটি শক্ত অবস্থান লাভ করে। গুয়ানঝং এলাকার প্রাণকেন্দ্র রাজ্যটি ইয়াংজি নদীর বিপরীতে গুয়ানডং নামে পরিচিত ছিল। খাদ্য উৎপাদন ও প্রাকৃতিক সম্পদে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ায় কিনরা বড় ও শক্তিশালী সামরিক বাহিনী গড়ে তুলে। এছাড়া খ্রিস্টপূর্ব ২৪৬ অব্দে ওয়েই নদীতে খাল খননও তাদের রাজ্য বিস্তারে সহায়ক হয়।[৭][৯]

যুদ্ধরত রাজ্য বিজয়

চীন সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পূর্বে যুদ্ধরত রাজ্য কালে প্রধান সাত যুদ্ধরত রাজ্য ছিল ইয়ান রাজ্য, চৌ রাজ্য, চী রাজ্য, চু রাজ্য, হান রাজ্য, ওয়েই রাজ্য ও ছিন রাজ্য। সবগুলো রাজ্যের শাসকরা তাদের অভিজাত থেকে রাজা দাবী করে। তবে তারা চৌ সম্রাটদের মত স্বর্গীয় আদেশ প্রাপ্তির দাবী করে না এবং বিভিন্ন উপসনা ও আনুষ্ঠানিকতা তারা চৌ সম্রাটদের উপর ছেড়ে দেয়।[১০]

খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ ও তৃতীয় শতাব্দীতে যুদ্ধরত রাজ্য বিজয়ের পূর্বে চীনদের কিছু সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। খ্রিস্টপূর্ব ৩৩৮ অব্দে রাজা হুইওয়েন শাং ইয়াংকে তার ব্যক্তিগত অসন্তোষের কারণে হত্যা করে। খ্রিস্টপূর্ব ৩০৭ অব্দে কিনরা উত্তরাধিকার নিয়ে আন্তঃদ্বন্দ্বে জড়িয়ে পরে। চৌ রাজ্যের কাছে পরাজিত হওয়ার পর তারা কি রাজ্যের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার সময়ে খ্রিস্টপূর্ব ২৯৫ অব্দে তাদের এক মিত্রপক্ষের কাছে পরাজিত হয়। রাজনীতিজ্ঞ ফান সুই (范雎) প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পাওয়ার পর উত্তরাধিকার নিয়ে সমস্যার সমাধান হয় এবং তিনি জিন রাজ্য ও চী রাজ্যের মত রাজ্য সম্প্রসারণ নীতি প্রয়োগ করেন।[১১]

চীনরা শীঘ্রই অন্য রাজ্যগুলোতে আক্রমণ শুরু করে। প্রথমেই তারা পূর্বে হান রাজ্যে আক্রমণ করে এবং খ্রিস্টপূর্ব ২৩০ অব্দে সিনঝেং শহর দখল করে। পরে তারা উত্তরে আক্রমণ করলে খ্রিস্টপূর্ব ২২৮ অব্দে চৌ রাজ্য আত্মসমর্পণ করে এবং খ্রিস্টপূর্ব ২২৬ অব্দে আরও উত্তরের ইয়ান রাজ্য দখল করে। পরবর্তীতে কিন সেনাবাহিনী পূর্বে ও পরে দক্ষিণে আক্রমণ করে খ্রিস্টপূর্ব ২২৫ অব্দে কাইফেংয়ের ওয়েই শহর দখল করে এবং খ্রিস্টপূর্ব ২২৩ অব্দে চু রাজ্যকে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করে। শেষে তারা লুওইয়াংয়ে চৌ সাম্রাজ্যের ছোট্ট অংশের শাসককে পদচ্যুত করে এবং খ্রিস্টপূর্ব ২২১ অব্দে লিনজি শহর দখল করার মাধ্যমে কি রাজ্য জয় করে।[১২]

খ্রিস্টপূর্ব ২২১ অব্দে সবকয়টি রাজ্য বিজয়ের পর রাজা ঝেং চীনের দক্ষ শাসক হয়ে উঠে। তিনি প্রধানমন্ত্রীত্ব ত্যাগ করে একজন শাসক হিসেবে তার অবস্থান দৃঢ় করেন। পরে তিনি ত্রিলোক ও পাঁচ সম্রাটদের নাম একত্র করে তার নতুন নামকরণ করে শি হুয়াংডি বা প্রথম সম্রাট[১৩][note ১] তিনি সম্রাট হিসেবে নিজেকে ঘোষণা দিয়ে যুদ্ধে ব্যবহৃত যেসব অস্ত্রে ছিনদের অধিগ্রস্ত নয় তা বাজেয়াপ্ত করে গলিয়ে ফেলার আদেশ দেন। ফলে ছিনের নতুন রাজধানী সিয়ানইয়াংয়ে বারোটি বড় ধাতব মূর্তি তৈরির মত গলিত ধাতু পাওয়া যায়।[১৪]

দক্ষিণে বিস্তার লাভ

খ্রিস্টপূর্ব ২১৪ অব্দে ছিন শি হুয়াং যখন উত্তরে তার সাম্রাজ্যের নিরাপত্তা জোরদার করতে সক্ষম হল, সে তার সামরিক বাহিনীকে (১০০,০০০ সেনা) দুই ভাগে ভাগ করল এবং এক ভাগকে (৫০,০০০ সেনা) দক্ষিণে ছোট ছোট সম্প্রদায়ের তার অধিগত করার জন্য পাঠালেন। তার আগে তিনি দক্ষিণে সিচুয়ান এলাকা দখল করে সমগ্র চীনে তার কর্তৃত্ব স্থাপন করলেন। ছিন সেনারা দক্ষিণের জঙ্গল পরিপূর্ণ এলাকা সম্পর্কে অবগত না থাকার কারণে দক্ষিণের সম্প্রদায়ের সাথে গেরিলা যুদ্ধ-এ পরাজিত হয় এবং প্রায় ১০০,০০০ সেনা মারা যায়। পরাজিত হলেও তার সেনাদের খাবার ও সেনা মোতায়নের লক্ষ্যে দক্ষিণে খাল খনন করেছিল যা তাদের দ্বিতীয়বার আক্রমণ করার সহায়ক হয়। এই খাল ব্যবহার করে ছিন সেনারা উপকূলবর্তী গুয়াংচৌ এবং পরে ফুচৌ ও গুইলিন প্রদেশ দখল করে,[note ২] তারা আরও দক্ষিণে হ্যানয়-এ আক্রমণ করে এবং জয়লাভ করে। দক্ষিণ বিজয়ের পর ছিন শি হুয়াং নতুন এলাকায় বসতি স্থাপনের ১০০,০০০ এর অধিক বন্দীকে মুক্তি দেয়।[১৪]

সিওংনূর বিরুদ্ধে যুদ্ধ

ছিন সাম্রাজ্য উত্তরে বিস্তার লাভ করার পর, কিনরা তাদের রাজ্যের উপর নিয়ন্ত্রণ হারাতে থাকে। উত্তরের কিছু সম্প্রদায়, যাদের ছিনরা হু নামে ছিনত, মুক্ত ছিল।[১৫] অরডোর মরুভূমিতে বসবাসকারী সিওংনু সম্প্রদায় কিন কৃষকদের সাথে ব্যবসা নিষিদ্ধ করে দেয় এবং প্রায়ই হামলা করে তাদের পিছু হটতে বাধ্য করে। সেনাপ্রধান মেং তিয়ানের নেতৃত্বে এক সামরিক অভিযানে খ্রিস্টপূর্ব ২১৫ অব্দে তারা সে অঞ্চল বিজয় করে। কৃষকরা সেখানে কৃষিকাজ শুরু করে এবং বিপ্লব করে আলাদা হয়ে যায়। পরবর্তীতে হানরাও তাদের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকলে অরডোসের দিকে বিস্তার লাভ করতে থাকে।[১৬]

ক্ষমতাচ্যুতি

ছিন শি হুয়াংকে হত্যার চেষ্টা, ব্যবহৃত ছোরা পিলারে আটকে রয়েছে

ছিন শি হুয়াং অমরত্ব লাভের জন্য মরিয়া হয়ে উঠলে তাকে হত্যা করার তিনটি চেষ্টা চালানো হয়েছিল। তিনি খ্রিস্টপূর্ব ২১০ অব্দে অমরত্ব লাভের জন্য তার রাজ্যের পূর্বে তাও ধর্মের এক জাদুকরের কাছ থেকে অমৃত আনতে গিয়ে মারা যান। প্রধানমন্ত্রী লি সি ও প্রধান খোঁজা চৌ গাও এই খবর তাদের ফিরে আসা পর্যন্ত গোপন রাখেন যাতে ফিরে এসে তারা সম্রাটের উইল পরিবর্তন করে তার সবচেয়ে সহজ সরল ও নমনীয় পুত্র হুহাইকে উত্তরাধিকার করতে পারেন।[১৭] তারা ভেবেছিল যযে তারা তাকে সহজে প্রভাবিত করতে পারবে এবং পুরো সাম্রাজ্য তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে। হুহাই ছিন আর শি নামে সিংহাসনে বসেন এবং তিনি আদপে অদক্ষ ও নমনীয় ছিলেন। তিনি অনেক মন্ত্রী ও যুবরাজকে হত্যা করেন, বড় বড় স্থাপনার কাজ শুরু করেন, সেনা সংখ্যা বৃদ্ধি করেন এবং যেসব দূত খারাপ খবর নিয়ে আসত তাদের হত্যা করত। ফলে চীনের বিভিন্ন স্থানে বিপ্লব দেখা দেয়, পদস্থ কর্মচারীদের উপর আক্রমণ শুরু হয় এবং এলাকায় কোন কোন পদস্থ কর্মচারী তাদের রাজা বলে দাবী করে।[১৮]

এই সময়ে লি সি ও চৌ গাওয়ের পরিকল্পনা ভেস্তে যায় এবং লি সিকে হত্যা করা হয়। চৌ গাও ছিন আর শিকে তার অযোগ্যতার জন্য আত্মহত্যা করতে বাধ্য করার সিদান্ত নেয়। এতে ছিন আর শির ভাইপো জিয়িং সিংহাসনে আরোহণ করে এবং চৌ গাওকে হত্যা করে।[১৮] জিয়িং রাজনৈতিক অস্থিরতা ও স্থানীয় যারা নিজেদের রাজা দাবী করছে, এই অবস্থায় নিজেকে সকল রাজার রাজা হিসেবে ঘোষণা দিল।[৯] তার অদক্ষতার কারণে ধীরে ধীরে সাম্রাজ্য ধ্বংস হতে লাগলো এবং খ্রিস্টপূর্ব ২০৯ অব্দে বড় রকমের বিদ্রোহ দেখা দিল। যখন লিউ বাংয়ের নেতৃত্বে চুয়ের বিদ্রোহীরা আক্রমণ করল তখন বিধ্বস্ত রাজ্য আর বেশিদিন ঠিকে থাকতে পারে নি। খ্রিস্টপূর্ব ২০৭ অব্দে জিয়িং ওয়েই নদীর তীরে পরাজিত হয় এবং আত্মসমর্পণ করে। চু দলপতি সিয়াং ইয়ু তাকে হত্যা করে। পরের বছর কিনের রাজধানী ধ্বংস করা হয় এবং ইতিহাসবেত্তারা মনে করেন এর মাধ্যমেই কিন সাম্রাজ্যের পতন হয়।[১৯][note ৩] লিউ বাং সিয়াং ইয়ুর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে এবং তাকে পরাজিত করে নিজেকে সম্রাট গাওজু হিসেবে ঘোষণা দেয়।[note ৪][২০]

সমাজ ও সংস্কৃতি

স্থাপত্য

ডুজিয়াংইয়ান, খ্রিস্টপূর্ব ২৫৬ অব্দের একটি জলসেচ প্রকল্প

যুদ্ধরত রাজ্য কালে স্থাপত্যকলার কয়েকটি ব্যাপ্তি পরিলক্ষিত হয়। শহর রক্ষার জন্য আরও দীর্ঘ প্রাচীর এবং প্রত্যেকটি জেলাকে আলাদা করার জন্য ছোট ছোট প্রাচীর নির্মিত হয়। তাদের শক্তি ও ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশের জন্য তারা তাদের স্থাপনের বিভিন্ন রকমের পরিবর্তন নিয়ে আসে। বিভিন্ন স্থাপনা যেমন সুউচ্চ মিনার, পিলার ফটক, উঁচু মঞ্চ ও অট্টালিকা তাদের স্থাপত্যশৈলীর প্রকাশ ঘটে।[২১]

দর্শন ও সাহিত্য

১২ অক্ষরবিশিষ্ট পাথরের ফলক, ছিন সাম্রাজ্য (খ্রিস্টপূর্ব ২২১ - ২০৬ অব্দ)। অক্ষরগুলো হল "海内皆臣,歲登成熟,道毋飢人".

ছিনরা চৌদের মত লিখিত রূপ হিসেবে লোগোগ্রাম ব্যবহার করত।[২২] লিখিত রূপকে সারাদেশে একই মানদন্ডে ও আকারে নিয়ে আসা ছিল প্রধানমন্ত্রী লি সির জীবনের সেরা অর্জন। চীনা সংস্কৃতিতে এই একত্রীকরণ ব্যাপক প্রভাব ফেলে। তিনি লিপিবিদ্যায় লেজার লিপির (Chinese: 小篆, Pinyin: xiǎozhuàn) প্রবর্তন করেন, যা এখনো তাস, পোস্টার ও বিজ্ঞাপনে ব্যবহৃত হয়।[২৩]

যুদ্ধরত রাজ্য কালে চীনা পন্ডিতরা ছিন্তার শত শাখার আওতায় বিভিন্ন দর্শনের প্রবর্তন করেন। খ্রিস্টপূর্ব ২২১ অব্দে ছিন শি হুয়াং সব রাজ্য জয় করে আইনসবস্বতার ভিত্তিতে রাজ্য পরিচালনা শুরু করে। শুধুমাত্র মহীবাদকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হয়েছিল যদিও এর কারণ জানা যায়নি। ছিন রাজ্যনীতি ও মহীবাদ কিছু ক্ষেত্রে এক হওয়া স্বত্তেও মহীবাদীদের খুঁজে বের করে হত্যা করা হয়।[২৪]

কনফুসিয়াস-এর কনফুসীয় ধর্মও যুদ্ধরত রাজ্য কালে প্রভাব বিস্তার করে।[note ৫] কনফুসীয় সাহিত্যে ছয়টি বিষয় প্রাধান্য লাভ করে: গীতিকবিতা, দলিলপত্র, ধর্মীয় রীতিনীতি, সঙ্গীত, শরৎ বসন্ত ইতিহাস, ও পরিবর্তন, যা সে সময়ে সাহিত্যের অংশ ছিল।[২৫]

ছিন সাম্রাজ্য সময়ে প্রথম সম্রাট ছিন শি হুয়াং আইনসর্বস্বতা ছাড়া কনফুসীয় ধর্মসহ বাকি দর্শনগুলোকে গোপন করার চেষ্টা চালায়। আইনসর্বস্বতাকে আমলাতান্ত্রিক উপায় হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং সম্রাটকে অমান্যকারীকে কঠোর শাস্তির বিধান দেওয়া হয়। ব্যবসায়ী ও বিদ্বানরা মূল্যহীন বলে গণ্য হয়।[২৬] আরও কঠোর পদক্ষেপ ছিল বই পুড়িয়ে ফেলা এবং পন্ডিতদের জীবন্ত কবর দেওয়া।[১৪] ছিন শি হুয়াং তার ক্ষমতা সুদৃঢ় করার লক্ষ্যে যেসব বই আইনসর্বস্বতার পরিপন্থি সেগুলো পুড়িয়ে ফেলার আদেশ দেন।[২৭] খ্রিস্টপূর্ব ২১৩ অব্দে এক ডিক্রি পাস হয় যাতে নির্ধারণ করে দেওয়া হয় যেসকল পন্ডিতরা তাদের বই জমা না দিবে তাদের জীবন্ত কবর দেওয়া হবে।[১৪] শুধু আইনসর্বস্বতার সাথে গ্রহণযোগ্য রাষ্ট্রশাসন সম্পর্কিত এবং জ্যোতিষ, কৃষি ও চিকিৎসা শাস্ত্র সম্পর্কিত বইসমূহ সংরক্ষিত হয়।[২৭]

সরকার ও সামরিক বাহিনী

টেরাকাটা সেনাবাহিনী, ছিন শি হুয়াংয়ের কবরস্থ জাদুঘর
Qin warriors of the Terracotta Army, Bowers Museum in Santa Ana, California.
ছিন সাম্রাজ্যের যৌগিক তির (উপরে) ও আড় ধনুকের বোলট (bottom)
Credit: Liang Jieming

ছিন সরকার ছিল আমলাতান্ত্রিক এবং পদক্রম অনুসারে কর্মকর্তাদের দ্বারা পরিচালিত হত। ছিনরা রাজ্যপরিচালনার জন্য হান ফেইজি কৌশল অবলম্বন করত। এই কৌশল অনুসারে প্রথম সম্রাট শি হুয়াং সকল অঞ্চলের সমন্বয় ও নিয়ন্ত্রণ করত। ভাষা থেকে শুরু করে রথের চাকার দৈর্ঘ্য পর্যন্ত সকল ক্ষেত্রেই একটি নির্দিষ্ট মান নির্ধারিত ছিল।[১৩] ঝেং ও তার উপদেষ্টারা মিলে একটি নতুন আইন প্রনয়ন করে যা জায়গীর প্রথার বিলোপ সাধন করে। তারা চীনে কেন্দ্রীয় আমলাতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার প্রচলন করেন। নতুন এই ব্যবস্থার ফলে চীনের সরকারব্যাবস্থা ও সেনাবাহিনী আরও শক্তিশালী হয়ে উঠে।[২৮]

প্রথম সম্রাট শি হুয়াং যাযাবরদের আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য উত্তরে প্রাচীর গড়ে তোলার পরিকল্পনা করেন। ফলে তিনি চীনের মহাপ্রাচীর নির্মাণের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন অভিজাত ও পরবর্তী সাম্রাজ্যের সময়ে তা পুনঃনির্মাণের ফলে তা বিশাল আকৃতি লাভ করে। শি হুয়াংয়ের আরেকটি প্রকল্প ছিল টেরাকাটা সেনাবাহিনী, যা তিনি তার প্রতিরক্ষার জন্য নির্মাণ করেন। টেরাকাটা সেনাবাহিনী মাটির নিচে অবস্থিত হওয়ায় ১৯৭৪ সালে আবিস্কৃত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তেমনভাবে লক্ষণীয় ছিল না।[২৯]

ধর্ম

Floating on high in every direction,
Music fills the hall and court.
The incense sticks are a forest of feathers,
The cloudy scene an obscure darkness.
Metal stalks with elegant blossoms,
A host of flags and kingfisher banners.
The music of the "Seven Origins" and "Blossoming Origins"
Are intoned as harmonious sounds.
Thus one can almost hear
The spirits coming to feast and frolic.
The spirits are seen off to the zhu zhu of the musics,
Which purifies and refines human feelings.
Suddenly the spirits ride off on the darkness,
And the brilliant event finishes.
Purified thoughts grow hidden and still,
And the warp and weft of the world fall dark.

Han shu, p. 1046

ছিন সাম্রাজ্য সময়ে চীনারা শেন ("আত্মা" বা ছায়া) ও মৃত্যুর পর আরেক লোকে বিশ্বাস করত। চীনারা সেই পরলোকের সাথে যোগসূত্র স্থাপনের লক্ষ্যে পশু বলি দিত। তার মনে করত পরলোক পৃথিবীর মত আরেকটি স্থান এবং মৃত্যুর পর মানুষ সেখানে স্থানান্তরিত হয়। তাদের উপাসনার দুটি প্রধান উদ্দেশ্য ছিল মৃতরা ঠিকভাবে পরলোকে পৌঁছেছে ও সেখানে বসবাস করছে কিনা তা অবগত হওয়া এবং আত্মালোক থেকে আশীর্বাদ লাভ করা।[note ৬][৩০][৩১]

ধর্মীয় রীতিনীতিগুলো সাধারনত স্থানীয় ছোট উপাসনা স্থল ও পবিত্র স্থানে করা হত। সকলের অংশগ্রহণে পশু বলি ও অন্য রীতি পালনের সময়ে ধূপ ও ধোঁয়া দেওয়া হত এবং গান-বাজনার আয়োজন হত। প্রধান বলিদানকারী উপবাস করত এবং বলিদানের পূর্বে ধ্যান করত। অন্য অংশগ্রহণকারীরাও প্রস্তুত হয়ে আসত তবে প্রধান যাজকের মত নয়। ধ্যানমগ্ন প্রধান যাজকরা পরলোকের আত্মাদের সাথে যোগাযোগ করত এবং অতিপ্রাকৃতিক কাজ করতে পারত। তারা লুয়ান ডা কৌশলের সাহায্যে তাদের ক্ষমতা বাড়াতে পারত। ইতিহাসবেত্তা সিমা চিয়েন এ ধরনের কাজকে অবজ্ঞা করতেন এবং এগুলোকে ধোঁকা বলে অভিহিত করেন।[৩২]

আরেকটি ধর্মীয় রীতি ছিল জ্যোতিষবিদ্যা যার মাধ্যমে ভবিষ্যদ্বাণী করা হত এবং ভবিষ্যতকে প্রভাবিত করা হত। ভবিষ্যৎ জানার জন্য হাড় বা কচ্ছপের খোলস ভাঙ্গা ছিল একটি প্রচলিত রীতি। কিন সাম্রাজ্য সময়ে জ্যোতিষবিদ্যা বিভিন্নরূপে বিস্তৃতি লাভ করে, যদিও প্রকৃতিকে পর্যবেক্ষণই ছিল সবচেয়ে জনপ্রিয় উপায়। ধুমকেতু, চন্দ্রগ্রহণসূর্যগ্রহণ এবং খরাকে খারাপ কিছুর পূর্বাভাস হিসেবে বিবেচনা করা হত।[৩৩]

ছিন সম্রাট

An edict in bronze from the reign of the Second Qin Emperor

ছিনরা চৌ সাম্রাজ্য ধ্বংস করার পূর্বে রাজা চৌজিয়াং ৫১ বছর কিনদের শাসন করেন, যদিও তখন অন্য যুদ্ধরত রাজ্যগুলো স্বাধীন ছিল। কয়েকজন চীনা ইতিহাসবিদ তাই পরবর্তী বছরকে (৫২তম বছর) চৌ সাম্রাজ্যের উত্তরসূরী হিসেবে উল্লেখ করেন।

ছিন শি হুয়াং প্রথম সার্বভৌম শাসক যিনি চীনকে একত্রিত করে খ্রিস্টপূর্ব ২২১ অব্দে নিজেকে চীনের সম্রাট হিসেবে ঘোষণা দেন। ফলে ঐ বছর থেকে কিন সাম্রাজ্য সময়কাল শুরু হয় যা ১৫ বছর স্থায়ী ছিল এবং খ্রিস্টপূর্ব ২৬ অব্দে গৃহযুদ্ধে লিপ্ত হয়ে বিলুপ্ত হয়।[৩৪]

নামপারিবারিক নামরাজত্বকাল
Convention: "Qin" + posthumous name
রাজা চৌজিয়াংয়িং জে (嬴則 yíng zé) or Ying Ji (嬴稷 yíng jì)খ্রিস্টপূর্ব ৩০৬ – ২৫০ অব্দ
রাজা সিয়াওওয়েনয়িং ঝু (嬴柱 yíng zhù)খ্রিস্টপূর্ব ২৫০ অব্দ
রাজা ঝুয়াংজিয়াংয়িং জিচু (嬴子楚 yíng zǐ chǔ)খ্রিস্টপূর্ব ২৪৯ – ২৪৭ অব্দ
কিন সাম্রাজ্য (খ্রিস্টপূর্ব ২২১ - ২০৬ অব্দ)
ছিন শি হুয়াং (始皇帝 Shǐ Huángdì)য়িং ঝেং (嬴政 yíng zhèng)খ্রিস্টপূর্ব ২৪৬ - ২১০
ছিন আর শি (二世皇帝 Èr Shì Huángdì)য়িং হুহাই (嬴胡亥 yíng hú hài)খ্রিস্টপূর্ব ২১০ - ২০৭ অব্দ
জিয়িংকে (秦王子嬰 qín wáng zi yīng) তার পারিবারিক নামেই ডাকা হত
ছিন সান শিয়িং জিয়িং (嬴子嬰 yíng zi yīng)খ্রিস্টপূর্ব ২০৬ অব্দ

ছিন পরিবার

আরও দেখুন

পাদটীকা

তথ্যসূত্র

গ্রন্থপঞ্জি

আরও পড়ুন

বহিঃসংযোগ

পূর্বসূরী
চৌ সাম্রাজ্য
চীনের সাম্রাজ্য
খ্রিস্টপূর্ব ২২১ – ২০৬ অব্দ
উত্তরসূরী
হান সাম্রাজ্য

টেমপ্লেট:কিন সাম্রাজ্য

🔥 Top keywords: রাম নবমীমুজিবনগর দিবসপ্রধান পাতামুজিবনগর সরকারবিশেষ:অনুসন্ধানইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগএক্স এক্স এক্স এক্স (অ্যালবাম)বাংলাদেশবাংলা ভাষামিয়া খলিফারাজকুমার (২০২৪-এর চলচ্চিত্র)আনন্দবাজার পত্রিকাআবহাওয়ারামপহেলা বৈশাখউয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগইসরায়েলইরানরবীন্দ্রনাথ ঠাকুরমুজিবনগরইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউনরিয়াল মাদ্রিদ ফুটবল ক্লাব২০২৪ ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগক্লিওপেট্রাচর্যাপদভূমি পরিমাপশেখ মুজিবুর রহমানজনি সিন্সকাজী নজরুল ইসলামঈদুল আযহাফিলিস্তিনইউটিউবভারতবিকাশআসসালামু আলাইকুমসৌদি আরববাংলা প্রবাদ-প্রবচনের তালিকামুহাম্মাদ