জেরেমি বেন্থাম
জেরেমি বেন্থাম (১৫ ফেব্রুয়ারি ১৭৪৮, কারো কারো মতে ৪ ফেব্রুয়ারি ১৭৪৭[১] - ৬ জুন ১৮৩২) ছিলেন একজন ইংরেজ দার্শনিক, আইনতত্ত্ববিদ এবং সমাজ সংস্কারক। তাকে আধুনিক উপযোগবাদের জনক ধরা হয়।[২][৩]
জেরেমি বেন্থাম | |
---|---|
জন্ম | লন্ডন, ইংল্যান্ড | ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৭৪৮
মৃত্যু | ৬ জুন ১৮৩২ লন্ডন, ইংল্যান্ড | (বয়স ৮৪)
মাতৃশিক্ষায়তন | দ্য কুইন্স কলেজ, অক্সফোর্ড (বিএ ১৭৬৩; এমএ ১৭৬৬) |
যুগ | আঠারোো শতকের দর্শন উনিশ শতকের দর্শন |
ধারা | উপযোগবাদ, বৈধ ধনাত্মকতাবাদ, উদারনীতিবাদ |
প্রধান আগ্রহ | রাজনৈতিক দর্শন, আইনের দর্শন, নীতিশাস্ত্র, অর্থনীতি |
উল্লেখযোগ্য অবদান | মহা সুখ নীতি |
ভাবগুরু
| |
ভাবশিষ্য
| |
স্বাক্ষর | |
বেন্থাম তার দর্শনের "মৌলিক স্বতঃসিদ্ধ সত্য" কে সংজ্ঞায়িত করেন যে "এটা হচ্ছে সর্বোৎকৃষ্ট সংখ্যার সর্বোৎকৃষ্ট সুখ যেটা হচ্ছে সঠিক অথবা ভুলের পরিমাপদণ্ড"।[৪][৫] তিনি ইংরেজ-মার্কিন আইনের দর্শনের একজন বড় তত্ত্ববাদী, এবং একজন উগ্র রাজনীতিবিদ যার ধারণাগুলো কল্যাণবাদের উন্নয়নে প্রভাবিত হয়। তিনি ব্যক্তি স্বাধীনতা এবং অর্থনৈতিক স্বাধীনতাকে সমর্থন করতেন। রাষ্ট্র থেকে ধর্ম আলাদা করার পক্ষে, বাক-স্বাধীনতার পক্ষে, নারীদের জন্য পুরুষদের মতই অধিকারের পক্ষে, তালাক দেওয়ার অধিকারের পক্ষে এবং সমকামীতাকে অপরাধের তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার পক্ষে কথা বলতেন।[৬] তিনি দাসপ্রথা, মৃত্যুদণ্ড প্রথা এবং শারীরিক শাস্তি (বাচ্চাদের ক্ষেত্রেও) উঠিয়ে দিতে বলেন।[৭] তিনি 'প্রাণী অধিকার' এরও অগ্র সমর্থক।[৮] যদিও তিনি খুব শক্তভাবেই ব্যক্তি স্বাধীনতা বাড়ানোর পক্ষে কথা বলতেন কিন্তু তিনি 'প্রকৃতি আইন' এবং 'প্রকৃতি অধিকার' এর বিরোধিতা করতেন, তিনি এগুলোকে বোকামি বলেন।[৯]
বেন্থামের ছাত্রগুলোর মধ্যে রয়েছে তার সচিব এবং সহকর্মী জেমস মিল, জেমসের ছেলে জন স্টুয়ার্ট মিল, আইন দার্শনিক জন অস্টিন এবং রবার্ট ওয়েন (কল্পলৌকিক সমাজতন্ত্রের অন্যতম জনক)।
১৮৩২ সালে বেন্থাম মারা যান। তিনি আগেই বলেছিলেন মৃত্যুর পর তার যেন শব ব্যবচ্ছেদ করা হয় এবং পরে স্থায়ীভাবে প্রতিমূর্তি হিসেবে সংরক্ষণ করে রাখা হয়, যেটা হবে তার স্মারক। এটা করা হয় এবং তার প্রতিমূর্তি এখন জনপ্রদর্শনীর জন্য 'ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন' (ইউসিএল) এ আছে। শিক্ষার সহজপ্রাপ্ততার পক্ষে তর্ক করার জন্য তাকে 'ইউসিএল' এর আত্মিক প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়। যদিও তিনি প্রতিষ্ঠানটি বানানোর কাজে সরাসরি ছোটো ভূমিকা রেখেছিলেন।[১০]
জীবন
বেন্থাম জন্মগ্রহণ করেন হোউন্ডসডিচ, লন্ডনে একটি ধনী পরিবারে যে পরিবার 'টরি পার্টি' নামের একটি রাজনৈতিক দলকে সমর্থন করত। তিনি ছিলেন একজন বিশেষ গুণসম্পন্ন বাচ্চা। বাচ্চা থাকা অবস্থায় তাকে পাওয়া যেত তার পিতার টেবিলে ইংল্যান্ডের বহু-সংখ্যা বিশিষ্ট ইতিহাস পড়া অবস্থায় এবং তিনি মাত্র তিন বছর বয়সে ল্যাটিন ভাষা পড়া শুরু করেন।[১১] তিনি তার ভাই স্যামুয়েল বেন্থাম এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ছিলেন।
জেরেমি ওয়েস্টমিন্সটার স্কুলে যান, এবং ১৭৬০ সালে ১২ বছর বয়সে তিনি তার পিতার দ্বারা 'দ্য কুইন্স কলেজ, অক্সফোর্ড' এ পাঠিত হন, যেখান থেকে তিনি ১৭৬৩ সালে স্নাতক, এবং ১৭৬৬ সালে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। তিনি আইনজীবী হিসেবে প্রশিক্ষিত হয়েছিলেন, যদিও তিনি কখনো আইন চর্চা করেননি। তাকে ১৭৬৯ সালে উকিল-সংঘ এ ডাকা হয়। তিনি 'ইংরেজ আইন বিধি' এর উপরে নিরাশ ছিলেন এবং এটাকে তিনি "দানবের ছলচাতুরি" বলে আখ্যা দেন।
যখন মার্কিন উপনিবেশগুলো ১৭৭৬ সালে তাদের স্বাধীনতা ঘোষণা করে তখন ব্রিটিশ সরকার সরাসরি কোন সাড়া না দিলেও লন্ডনের আইনজীবী এবং ছোট পুস্তিকা লেখক জন লিন্ডকে একটি খণ্ডন করার নির্দেশ দেয়।[১২] তার ১২০ পৃষ্ঠার নিবন্ধটি উপনিবেশগুলোতে সরবরাহ করা হয়েছিল এবং একটি অনুচ্ছেদ ছিলো যার শিরোনাম ছিলো "ঘোষণার ছোটো সমীক্ষা" বেন্থামের দ্বারা লিখিত, লিন্ডের বন্ধু, যেটা মার্কিন রাজনৈতিক দর্শনকে আক্রমণ এবং উপহাস করেছিলো।[১৩][১৪]
তার বহু আইনি ও সমাজ সংস্কার প্রস্তাবগুলোর মধ্যে একটি ছিলো জেলখানার দালানের নকশার পরিবর্তন করা। এক্ষেত্রে তিনি 'প্যানোপটিকন' নামে একটি ধারণা বানান।[১৫] তিনি এই প্যানোপটিকন দালান তৈরীর ধারণার ক্ষেত্রে তার জীবনের প্রায় ১৬ বছর অতিবাহিত করেন এবং আশা করেন যে সরকার তার পরিকল্পনাকে গ্রহণ করবে জেলখানা বানানোর জন্য এবং তাকে ঠিকাদার-পরিচালক নিয়োগ দিবে। যদিও তার পরিকল্পনা অনুযায়ী জেলখানা কখনোই বানানো হয়নি, তার ধারণাটি পরবর্তী প্রজন্মের চিন্তাবিদদের উপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে। বিংশ শতাব্দীর ফরাসী দার্শনিক মিশেল ফুকো যুক্তি দেখান যে প্যানোপটিকন ছিল উনবিংশ শতকের বিভিন্ন অনুশাসনাত্মক প্রতিষ্ঠাপনের মধ্যে নিদর্শনাত্মক জিনিস।[১৬]
বেন্থাম বুঝতে পেরে যান যে তার জেলভবন বানানোর পরিকল্পনা ইংল্যান্ডের রাজা দ্বারা বাতিলকৃত হয়েছে এবং একটি অভিজাততান্ত্রিক সম্প্রদায় তাদের নিজের ইচ্ছানুযায়ী কাজ করে যাচ্ছেন। সমাজের বহু বছর ধরে চলে আসা প্রথা যে হুট করে পালটানো যায়না তা তিনি সহজেই বুঝে যান।[১৭]
তার আরো সফল কাজের মধ্যে আছে প্যাট্রিক কলকুহোউনের সঙ্গে 'পুল অব লন্ডন' এর দূর্নীতির মোকাবেলা করা। বেন্থামের প্রচেষ্টায় 'টেমস পুলিশ বিল (১৭৯৮)' ১৮০০ সালে পাশ হয়।[১৮] আইনটি 'টেমস নদী পুলিশ' তৈরী করে, যেটি ছিলো দেশটির প্রথম নিরোধাত্তক পুলিশ এবং ৩০ বছর পর করা রবার্ট পিলের সংস্কারের পূর্বসুরী আইন।[১৯]
জেরেমি অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তির সাথে তৎনুরুপুতা বজায় রাখতেন। উদাহরণস্বরূপ ১৭৮০ এর দশকে বয়স্ক এ্যাডাম স্মিথের সঙ্গে সমতা বজায় চলছিলেন, স্মিথকে একটি তত্ত্ব বোঝানোর ব্যর্থ চেষ্টা করেছিলেন যে সুদের হারকে স্বাধীনভাবে প্রবাহিত হতে দেওয়া উচিত।[২০] তার অনোর মিরাবিউ সহ ফরাসী বিপ্লবের অন্যান্য নেতাদের সঙ্গে অনুরূপতা রাখার জন্য তাকে ফ্রান্সের সম্মানিত নাগরিকে ভূষিত করা হয়।[২১] তিনি 'প্রকৃতি অধিকার'-এর বৈপ্লবিক প্রবচনের স্পষ্টভাষী বিরোধী ছিলেন এবং হিংসার বিরুদ্ধে যেটা উদ্ভব হয় জ্যাকোবিনরা ক্ষমতা গ্রহণ করার পর (১৭৯২)। ১৮০৮ থেকে ১৮১০ সাল পর্যন্ত তিনি ল্যাটিন আমেরিকার স্বাধীনতার প্রণেতা ফ্র্যাঙ্ককিসকো দ্য মিরান্ডার সঙ্গে ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব রেখেছিলেন এবং মিরান্ডার লন্ডনের গ্র্যাফটোন ওয়ে হাউসেও যাতায়াত ছিলো তার।
১৮২৩ সালে তিনি জেমস মিলের সঙ্গে ওয়েস্টমিন্সটার রিভিউ নামের একটি পাক্ষিক ম্যাগাজিন বের করেন, এই ম্যাগাজিনটি "দার্শনিক উগ্র"দের জন্য বের করা হয়, এই দার্শনিক উগ্ররা ছিলেন বেন্থামের ছাত্রগণ যাদেরকে তিনি সমাজ পরিবর্তনের কাজে নিয়োজিত করতেন।[২২] দার্শনিক উগ্রদের মধ্যে একজন ছিলেন জন বৌরিং, যাকে বেন্থাম পছন্দ করতেন, তাদের সম্পর্ককে তিনি পিতা-পুত্রের মত আখ্যা দেন, তিনি বৌরিংকে ওয়েস্টমিন্সটার রিভিউের রাজনৈতিক বিষয়ক সম্পাদক নিযুক্ত করেন এবং এর সাথে তার নিজের সাহিত্যিক প্রধান নিয়োগ দেন।[২৩] আরেকজন এরকম ছিলেন এডউইন চ্যাডউইক যিনি পরিচ্ছন্নতা, পয়ঃনিষ্কাশন এবং পুলিশ সেবার বিষয় নিয়ে লিখতেন এবং 'পুওর ল এ্যামেন্ডমেন্ট' এর একজন মুখ্য অবদানকারী, বেন্থাম ইনাকে তার সচিব নিয়োগ দেন এবং আরো অনেক দায়িত্ব দেন।[২৪]
তার জীবন সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পাওয়া যায় মাইকেল সেন্ট জন প্যাকের জন স্টুয়ার্ট মিলের জীবনকাহিনীতেঃ"জেরেমি যখন তরুণ ছিলেন তখন তিনি 'বোউড হাউস' ভবনে যেতেন যেখানে তার পৃষ্ঠপোষক লর্ড ল্যান্সডাউন থাকতেন, ঐ বাড়ীটির নারীদের সঙ্গে ব্যর্থ সখ্যতা চলত জেরেমির, তিনি নারীদের সঙ্গে দাবা খেলতেন এবং তাদের তোষামোদ করতেন, অথবা বাদ্যযন্ত্র বাজানো শিখাতেন। আশি বছর বয়সে বেন্থাম এগুলো মনে করা শুরু করেন যে একজন নারী তাকে ফুল উপহার দিয়েছিলো। তার জীবনের শেষের দিকে এই বোউড হাউসের কথা মনে উঠলে তিনি অশ্রুসজল হয়ে উঠতেন এবং তিনি বলতেন তিনি অতীতে যেতে চাননা, সামনে এগুতে চান।"[২৫]
ফিলিপ লুকাস এবং এ্যানি শিরান তার জীবন নিয়ে একটি মনস্তাত্ত্বিক গ্রন্থ বের করেছিলেন যেখানে তারা দাবী করেন যে জেরেমির 'এ্যাসপার্জার্স সিনড্রোম' নামক রোগ ছিলো।[২৬]