পরাশক্তি
পরাশক্তি (ইংরেজি: Superpower) নির্দিষ্ট কোন দেশ হিসেবে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্র যা অন্যান্য দেশের উপর প্রভাব বিস্তার, বিভিন্ন বৈশ্বিক ঘটনায় সংশ্লিষ্টতা, শক্তিমত্তার সক্ষমতা বৈশ্বিক মানদণ্ডে প্রণীত হয় ও নিজেদের স্বার্থকে রক্ষা করতে সচেষ্ট হয়। ঐতিহ্যগতভাবে পরাশক্তিকে প্রধান শক্তির তুলনায় বড় হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে।
শব্দগুচ্ছের প্রথম সার্থক প্রয়োগ ঘটে ১৯৪৪ সালে। মূলতঃ ব্রিটিশ সাম্রাজ্য, সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যায় প্রতাপশালী দেশের ক্ষেত্রে পরাশক্তি শব্দগুচ্ছ প্রয়োগ করা হয়। ২য় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভূক্ত দেশসমূহ কমনওয়েলথভূক্ত দেশে এবং উপনিবেশগুলো স্বাধীন দেশে পরিণত হতে থাকে। ফলশ্রুতিতে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র - এ দু'টি দেশই কেবল পরাশক্তিরূপে বিশ্ব দরবারে পরিচিতি পায়। ঠাণ্ডা যুদ্ধে উভয় দেশ একে-অপরের বিরুদ্ধে অবতীর্ণ হয় ও বিশ্ববাসী পারমাণবিক অস্ত্র প্রয়োগের সমূহ আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন চিত্তে দিনযাপন করতে থাকে।
উৎপত্তি
এলাইস লাইম্যান মিলার নামীয় ন্যাভাল পোস্টগ্র্যাজুয়েট স্কুলের অধ্যাপক পরাশক্তির সংজ্ঞা নিরূপণে প্রয়াস চালিয়েছেন।[১] তিনি বলেন,
একটি দেশের যখন শক্তিমত্তার মাধ্যমে রাজত্ব বা প্রভুত্ব অর্জনে এবং বহিঃর্বিশ্বের সর্বত্র প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষমতা রয়েছে এবং কখনো কখনো একই সময়ে বিশ্বের যে-কোন এলাকায় আপাতঃদৃষ্টিতে যুক্তিসঙ্গত বলে বৈশ্বিকভাবে নেতৃত্ব প্রদানের গুণাবলী অর্জন করার যোগ্যতা রয়েছে, তখনই দেশটি পরাশক্তিরূপে সকলের মনোযোগ আকর্ষণ করে ও পরিচিতি পায়।
১৯৪৪ সালের শুরুতে পরাশক্তি শব্দগুচ্ছের ব্যবহার শুরু হলেও ২য় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটিশ সাম্রাজ্য এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্ষেত্রেই শব্দগুচ্ছের বিশেষ প্রয়োগ ঘটে। কেননা, যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন বৈশ্বিক রাজনীতি ও সামরিক বাহিনীর মাধ্যমে প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে নিজেদের সক্ষমতা প্রমাণ করতে পেরেছে।
পরাশক্তি শব্দগুচ্ছটি ইতিহাসের আলোকে এবং কখনোবা খুবই হাল্কাভাবে বিভিন্ন দেশের মধ্যেও প্রচলন ঘটানো হয়ে থাকে। তন্মধ্যে - প্রাচীন মিশর, প্রাচীন গ্রীস, চীন[২] ভারত,[২] পারস্য সাম্রাজ্য, অটোম্যান সাম্রাজ্য, রোমান সাম্রাজ্য,[৩][৪] মোঙ্গল সাম্রাজ্য, পর্তুগীজ সাম্রাজ্য, স্পেনীয় সাম্রাজ্য,[৫][৬] ফ্রান্স,[৭][৮] এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্য অন্যতম।
একসময় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের স্বর্ণশিখরে থাকাকালীন সময়ে বিশ্বের প্রতি চারজনের একজনই এ সাম্রাজ্যের পতাকাতলে অবস্থান করতেন।
ডাচ-আমেরিকান ভূ-সমরবিদ নিকোলাস স্পাইকম্যান ১৯৪৩ সালে যুদ্ধ-পরবর্তী নতুন বিশ্বের রূপরেখা তার দ্য জিওগ্র্যাফী অব দ্য পীস শিরোনামের বইয়ে বর্তমানে ব্যবহৃত রাজনৈতিক পরিভাষা হিসেবে শব্দগুচ্ছ প্রথম প্রবর্তন করেন।
এর এক বছর পর আমেরিকান বৈদেশিক নীতিবিষয়ক অধ্যাপক উইলিয়াম টি.আর. ফক্স ১৯৪৪ সালে দ্য সুপারপাওয়ার্স: দি ইউনাইটেড স্ট্যাটস, ব্রিটেন এন্ড দ্য সোভিয়েত ইউনিয়ন - দিয়ার রেসপনসিবিলিটি ফর পীস শীর্ষক গ্রন্থে বিশ্বের পরাশক্তিসম দেশের কথা বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেন।[৯]
বৈশিষ্ট্যাবলী
পরাশক্তির বৈশিষ্ট্যাবলীর ধারণাটি সুষ্পষ্ট নয়[১০] এবং ধারাবাহিকতাপূর্ণ উৎসের মধ্যেকার পার্থক্যও দেখা দিতে পারে। লাইম্যান মিলারের মতে পরাশক্তির মর্যাদা পাবার লক্ষ্যে প্রাথমিকভাবে চারটি অক্ষ শক্তির প্রয়োজন - সমরসজ্জা, মজবুত অর্থনীতি, দক্ষ রাজনীতিবিদ এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জোসেফ নাই পরাশক্তিকে কোমল শক্তি নামে আখ্যায়িত করেছেন।[১]
অধ্যাপক পল ডিউকের মতে, পরাশক্তিকে বৈশ্বিকভাবে যুদ্ধ পরিচালনায় সক্ষমতা অর্জনসহ প্রয়োজনে পৃথিবীকে ধ্বংস করার মতো সম্ভাব্য অস্ত্র থাকতে হবে; বিস্তৃত ও ব্যাপক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা ও প্রভাব বিস্তারের ক্ষমতা থাকতে হবে এবং বৈশ্বিকভাবে চিন্তাধারাকে তুলে ধরতে হবে। তদুপরি এ মৌলিক সংজ্ঞাটি সময়ের প্রেক্ষাপটে পরিবর্তিত হতে পারে।[১১]
অন্যদিকে অধ্যাপক জুন টিউফেল ড্রেয়ার মনে করেন, পরাশক্তিধর দেশকে অবশ্যই তার শক্তিকে নমনীয় এবং শক্তভাবে সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণের মাধ্যমে বহিঃর্বিশ্বে প্রভাব বিস্তার করতে হবে।[১২]
স্নায়ু যুদ্ধ
২৯ অক্টোবর থেকে ৭ নভেম্বর, ১৯৫৬ সালে সুয়েজ খাল নিয়ে সৃষ্ট সুয়েজ সমস্যায় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিত নড়বড়ে হয়ে উঠে। পরপর দুইটি বিশ্বযুদ্ধের কবলে পড়ে দেশটি অর্থনৈতিকভাবে দূর্বল হয়ে যায়। তাদের বৈদেশিক নীতি নতুন পরাশক্তির সাথে তাল মেলাতে ব্যর্থ হয় ও সংরক্ষিত মুদ্রা সঙ্কটের কারণে বাঁধাগ্রস্ত হয়ে দাঁড়ায়।[১৩] ২য় বিশ্বযুদ্ধের কারণে এর প্রভাব জাতীয় সীমানা পেরিয়ে বৈশ্বিকভাবে বিরাট প্রভাব পড়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ইউরোপ কিংবা এশিয়ার ন্যায় শিল্পোৎপাদন বা গুরুতরভাবে বেসামরিক ক্ষয়-ক্ষতির সম্মুখীন হয়নি।
যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের বৈশ্বিক অবস্থানকে বিশ্ব মানচিত্রে বৃহত্তম ও দীর্ঘস্থায়ীত্বের প্রতীক হিসেবে নিজেদেরকে তুলে ধরে।[১৪] দেশটি মালামাল সরবরাহে প্রধান ভূমিকা পালন করে। এছাড়াও, শিল্পের সাহায্যে শক্তিশালী অর্থনৈতিক বুনিয়াদ ও প্রযুক্তিগত অবকাঠামোয় সামরিক শক্তিমত্তায় দেশটি বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে চালকের আসনে উপবিষ্ট হয়।
তথ্যসূত্র
গ্রন্থপঞ্জি
- Belt, Don (২০০৪)। "Europe's Big Gamble"। National Geographic। পৃষ্ঠা 54–65।
- Brzezinski, Zbigniew (১৯৯৭)। The Grand Chessboard: American Primacy and Its Geostrategic Imperatives। New York: Basic Books। আইএসবিএন 0-465-02726-1।
- Fox, William (১৯৪৪)। The Super-powers: the United States, Britain, and the Soviet union—their responsibility for peace। Harcourt, Brace a. Co।
- Kamen, Henry (২০০৩)। Spain's Road To Empire: The Making Of A World Power, 1492–1763। Penguin। পৃষ্ঠা 640p.।
- Kennedy, Paul (১৯৮৮)। The Rise and Fall of the Great Powers। আইএসবিএন 0-679-72019-7।
- McCormick, John, John (২০০৭)। The European Superpower। Palgrave Macmillan।
- Todd, Emanuel (২০০X)। After the Empire – The Breakdown of the American Order।
- Rosefielde, Steven (২০০৫)। Russia in the 21st Century: The Prodigal Superpower (PDF)। Cambridge, UK: Cambridge University Press। আইএসবিএন 0-521-83678-6। সংগ্রহের তারিখ ২০০৭-১০-০৭।
- Erik Ringmar, "The Recognition Game: Soviet Russia Against the West," Cooperation & Conflict, 37:2, 2002. pp. 115–36. – an explanation of the relations between the superpowers in the 20th century based on the notion of recognition.