মিখাইল গর্বাচেভ

শান্তিতে নোবেল পুরষ্কার বিজয়ী

মিখাইল সের্গেইভিচ গর্বাচেভ (রুশ ভাষা : Михаил Сергеевич Горбачёв –[১] মিখাইল্‌ সিরর্গেয়েভিচ্‌ গর্বাচফ্‌ –[mʲɪxɐˈil sʲɪrˈɡʲeɪəvʲɪtɕ ɡərbɐˈtɕof] (); ২ মার্চ, ১৯৩১৩০ আগস্ট, ২০২২ খ্রি.)[২][৩] ছিলেন একজন সোভিয়েত রাজনীতিবিদ এবং সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সর্বশেষ প্রেসিডেন্ট। পূর্ববর্তী কনস্তান্তিন চেরনেনকোর মৃত্যুর পর ১৯৮৫ সালে তিনি ক্ষমতায় আসেন। তিনি ১৯৮৫ সাল থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক, ১৯৮৮ সাল থেকে রাষ্ট্রপ্রধান, ১৯৮৮ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত সুপ্রিম সোভিয়েতের প্রেসিডিয়ামের চেয়ারম্যান, ১৯৮৯ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত সুপ্রিম সোভিয়েতের চেয়ারম্যান হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। আদর্শগত ভাবে গর্বাচেভ প্রথমে মার্কসবাদ–লেনিনবাদকে মেনে চললেও ১৯৯০-এর দশকের গোড়ার দিকে সামাজিক গণতন্ত্রের দিকে অগ্রসর হন।[৪] ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দের ২৫ ডিসেম্বর তিনি সোভিয়েতের ইউনিয়নের আনুষ্ঠানিক বিলুপ্তির দিন পদত্যাগ করেন। গর্বাচেভের পদত্যাগের মধ্য দিয়েই বিশ্বে চার দশক ধরে চলা স্নায়ুদ্ধের সমাপ্তি হয়। তিনি পেরেস্ত্রোইকাগ্লাসনস্ত নীতির প্রবর্তক।

মিখাইল গর্বাচেভ
Михаил Горбачёв
১৯৮৭ সালে গর্বাচেভ
সোভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্রপতি
কাজের মেয়াদ
১১ মার্চ ১৯৮৫ – ২৪ আগষ্ট ১৯৯১
উপরাষ্ট্রপতিগেনাদি ইয়ানায়েভ
পূর্বসূরীপদটি প্রতিষ্ঠিত হয়
উত্তরসূরীপদটি বিলুপ্ত করা হয়েছে
সুপ্রিম সোভিয়েতের চেয়ারম্যান
কাজের মেয়াদ
২৫ মে ১৯৮৯ – ১৫ মার্চ ১৯৯০
ডেপুটিআনাতোলি লুকিয়ানোভ
পূর্বসূরীপদটি প্রতিষ্ঠিত হয়
উত্তরসূরীআনাতোলি লুকিয়ানোভ (কার্যনির্বাহী ভূমিকা রাষ্ট্রপতির কাছে হস্তান্তর)
সুপ্রিম সোভিয়েতের প্রেসিডিয়ামের চেয়ারম্যান
কাজের মেয়াদ
১ অক্টোবর ১৯৮৮ – ২৫ মে ১৯৮৯
পূর্বসূরীআন্দ্রেই গ্রোমিকো
উত্তরসূরীপদটি বিলুপ্ত করা হয়েছে
সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক
কাজের মেয়াদ
১১ মার্চ ১৯৮৫ – ২৪ অগাস্ট ১৯৯১
ডেপুটিয়েগোর লিগাচেভ
ভ্লাদিমির ইবাশকো (১৯৯০-১৯৯১)
পূর্বসূরীকনস্তান্তিন চেরনেনকো
উত্তরসূরীপদটি বিলুপ্ত করা হয়েছে
সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির পলিটব্যুরোর সদস্য
কাজের মেয়াদ
২৭ নভেম্বর ১৯৭৯ – ২৪ অগাস্ট ১৯৯১
সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সচিবালয়ের সদস্য
কাজের মেয়াদ
২৭ নভেম্বর ১৯৭৮ – ২৪ অগাস্ট ১৯৯১
ব্যক্তিগত বিবরণ
জন্ম(১৯৩১-০৩-০২)২ মার্চ ১৯৩১
প্রিবলনোয়ে, স্তাভরোপোল ক্রাই, রুশ সোভিয়েত যুক্তরাষ্ট্রীয় সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন
মৃত্যু৩০ আগস্ট ২০২২(2022-08-30) (বয়স ৯১)
জাতীয়তারাশিয়া
রাজনৈতিক দলরাশিয়ার স্বাধীন গণতান্ত্রিক পার্টি (২০০৮-২০২২)
সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটদের ইউনিয়ন (২০০৭-২০২২)
অন্যান্য
রাজনৈতিক দল
রাশিয়ার সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি (২০০১-২০০৪)
সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টি (১৯৫০-১৯৯১)
দাম্পত্য সঙ্গীরাইসা গর্বাচেভা (১৯৫৩-১৯৯৯; রাইসা গর্বাচেভার মৃত্যু)
সন্তানইরিনা বির্গানস্কায়া
প্রাক্তন শিক্ষার্থীমস্কো স্টেট ইউনিভার্সিটি
জীবিকাআইনজীবী
ধর্মধর্মহীন
স্বাক্ষর
ওয়েবসাইটদ্যা গর্বাচেভ ফাউন্ডেশন
১৯৮৮ সালে পোল্যান্ড ভ্রমণে গর্বাচেভ এবং তার স্ত্রী রাইসা

গর্বাচেভ প্রিভোলনোয়ে, স্তাভরোপোল ক্রাই, রাশিয়ান এবং ইউক্রেনীয় বংশোদ্ভুত একটি দরিদ্র কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহন করেন। জোসেফ স্ট্যালিন এর শাসনামলে তিনি বেড়ে ওঠেন। তার যৌবনে তিনি কম্বাইন হারভেস্টার সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদানের আগে সমষ্টিগত কৃষিখামার পরিচালনা করেছিলেন।

মস্কো স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত অবস্থা ১৯৫৩ সালে তিনি তাঁর সহপাঠী, রাইসা তিত্রেঙ্কোকে বিয়ে করেন। ১৯৫৫ সালে তিনি আইন বিষয়ে ডিগ্রি লাভ করেন। [৫] স্ট্যালিনের মৃত্যুর পর, সোভিয়েত নেতা নিকিতা ক্রুশ্চেভ এর ডি-স্ট্যালিনাইজেশন সংস্কারের একজন প্রবক্তা হিসাবে আবির্ভূত হন। তিনি ১৯৭০ সালে স্ট্যাভ্রোপোল আঞ্চলিক কমিটির প্রথম পার্টি সেক্রেটারি নিযুক্ত হন। এ সময়ে তিনি স্ট্যাভ্রোপোল খাল নির্মাণের তত্ত্বাবধান করেন।

সোভিয়েত নেতা লিওনিদ ব্রেজনেভ এবং ইউরি অ্যান্ড্রোপোভ এবং কনস্টান্টিন চেরনেঙ্কো এর সংক্ষিপ্ত মেয়াদের পরে ১৯৮৫ সালে পলিটব্যুরো গর্বাচেভকে সাধারণ সম্পাদক হিসাবে নির্বাচিত করে। যদিও গর্ভাচেভ সোভিয়েত রাষ্ট্র এবং সমাজতান্ত্রিক আদর্শ সংরক্ষণের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন তথাপি গর্বাচেভ বিশ্বাস করতেন যে সেদেশে উল্লেখযোগ্য সংস্কার প্রয়োজন, বিশেষ করে ১৯৮৬ সালে চেরনোবিল বিপর্যয় এর পর সেটা আরো প্রকট হয়।তিনি আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত সেনা প্রত্যাহার করেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি রোনাল্ড রিগ্যান এর সাথে পারমাণবিক অস্ত্র সীমাবদ্ধ করার জন্য এবং শীতল যুদ্ধ সমাপ্ত করার জন্য শীর্ষ সম্মেলন শুরু করেন। রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে তিনি গ্লাসনোস্ট বা "উন্মুক্ততা" নীতি বাক স্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে অনুমতি দেন। তার "পেরেস্ত্রোইকা" বা "পুনর্গঠন" নীতি দক্ষতা আনায়নের নিমিত্ত অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিকেন্দ্রীকরণের চেষ্টা করেন। তাঁর গণতন্ত্রীকরণের পদক্ষেপ এবং জনগনের ভোটে নির্বাচিত পিপলস ডেপুটিদের নিয়ে কংগ্রেস গঠন একদলীয় রাষ্ট্রকে দুর্বল করে দেয়। ১৯৮৯-১৯৯০ সালে ইস্টার্ন ব্লকের বিভিন্ন দেশ মার্কসবাদী-লেনিনবাদী শাসন ত্যাগ করলে গর্বাচেভ সেসব দেশে সামরিক হস্তক্ষেপ করতে অস্বীকৃতি জানান। অভ্যন্তরীণভাবে, ক্রমবর্ধমান জাতীয়তাবাদী চেতনা সোভিয়েত ইউনিয়নকে ভেঙে ফেলার হুমকি দিতে শুরু করে। মার্কসবাদী-লেনিনবাদী কট্টরপন্থীরা ১৯৯১ সালে গর্বাচেভের বিরুদ্ধে আগস্ট অভ্যুত্থান ঘটায়। অভ্যুত্থান সফল না হলেও, পরবর্তিতে সোভিয়েত ইউনিয়ন গর্বাচেভের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ভেঙে যায়। সোভিয়েত রাষ্ট্রপতিপদ থেকে পদত্যাগ করার পর, তিনি গর্বাচেভ ফাউন্ডেশন চালু করেন, রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি বরিস ইয়েলৎসিন এবং ভ্লাদিমির পুতিনের কট্টর সমালোচক হয়ে ওঠেন এবং রাশিয়ার সামাজিক-গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পক্ষে প্রচারণা করেন। দীর্ঘ অসুস্থতার পর ২০২২ সালে গর্বাচেভ মারা যান।

জন্ম ও শিক্ষাজীবন

শৈশব: ১৯৩১-১৯৫০

গর্বাচেভ ১৯৩১ সালের ২ রা মার্চ প্রিভোলনোই গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। গ্রামটি ভূতপূর্ব সোভিয়েত ইউনিয়নের উত্তর ককেশাস ক্রাইতে অবস্থিত।[৬] সেই সময়, প্রিভোলনোয়ির অধিবাসিরা জাতিগত রাশিয়ান এবং জাতিগত ইউক্রেনীয়দের মধ্যে প্রায় সমানভাবে বিভক্ত ছিল।[৭] গর্বাচেভের পিতার পরিবার ছিল রাশিয়ান। তারা বেশ কয়েক প্রজন্ম আগে ভোরোনেজ থেকে এই অঞ্চলে আসেন। তার মাতার পরিবার ছিল জাতিগতভাবে ইউক্রেনীয়। তারা এসেছিলেন চেরনিহিভ থেকে। [৮] তার বাবা-মা জন্মের সময় তার নাম রেখেছিলেন ভিক্টর, কিন্তু তার মায়ের অনুরোধে - তাকে গোপরে ব্যাপটাইজ্ড করা হয়। সে সময়ে তার পিতামহ তার নাম রাখেন মিখাইল।[৯] তার বাবা সের্গেই আন্দ্রেয়েভিচের সাথে গর্বাচেভের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ ছিল; তার মা, মারিয়া প্যান্টেলেভনার সাথে (née Gopkalo), শতীল সম্পর্ক ছিল। [১০] তারা দরিদ্র কৃষক ছিলেন।[১১][১২]

সোভিয়েত ইউনিয়ন কমিউনিস্ট পার্টি দ্বারা পরিচালিত একটি একদলীয় রাষ্ট্র ছিল। গর্বাচেভের শৈশবে নেতৃত্বে জোসেফ স্ট্যালিন। গর্বাচেভের মাতামহ কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন এবং ১৯২৯ সালে গ্রামের প্রথম কোলখোজ (সমষ্টিগত খামার) গঠনে সহায়তা করেন এবং এর চেয়ারম্যান ছিলেন।[১৩] তিন বছর বয়সে, গর্বাচেভ তার পিতামাতার বাড়ি ছেড়ে তার পিতামহের বাড়ি কোলখোজে চলে যান। [১৪]

১৯৩২-১৯৩৩ সালের সোভিয়েত ইউনিয়ন একটি দুর্ভিক্ষের কবলে পরে। সেই দুর্ভিক্ষে গর্বাচেভের দুই চাচা এবং একজন খালা মারা গিয়েছিলেন। [১৫] এর পরে শুরু হয় গ্রেট পার্জ। যেখানে মার্কসবাদ এর বিরুদ্ধ মতবাদের প্রতি সহানুভূমিশীলদের "জনগণের শত্রু" বলে অভিযুক্ত করে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। বিচারে তাদের মৃত্যুদন্ড না হলে, শ্রম শিবিরগুলিতে কাজ করতে হত। গর্বাচেভের পিতামহ ও মাতামহ উভয়কেই গ্রেপ্তার করা হয়েছিল (১৯৩৪ সালে তার মাতামহ এবং ১৯৩৭ সালে তার পিতামহকে) এবং মুক্তি পাওয়ার আগে গুলাগ শ্রম শিবিরে তারা বন্দী ছিলেন। [১৬] ১৯৩৮ সালের ডিসেম্বরে মুক্তি পাওয়ার পর, গর্বাচেভের মাতামহ জয়েন্ট স্টেট পলিটিক্যাল ডাইরেক্টরেট বা সোভিয়েত গোপন পুলিশ দ্বারা নির্যাতিত হওয়ার বিষয়টি প্রকাশ করেন। তার এই বিবরন ছো্ট্ গর্ভাচেভকে প্রভাবিত করেছিল। [১৭]

১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর, ১৯৪১ সালের জুন মাসে জার্মান সেনাবাহিনী সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করে। ১৯৪২ সালে সাড়ে চার মাসের জন্য প্রিভোলনোই জার্মান বাহিনীর দখলে থাকে। [১৮] গর্বাচেভের বাবা লাল ফৌজ যোগ দিয়েছিলেন এবং ফ্রন্টলাইনে লড়াই করেছিলেন; যুদ্ধের এক পর্য়ায়ে তাকে ভুলকরে মৃত ঘোষণা করা হয়েছিল। পরে কুরস্কের যুদ্ধে আহত হয়েছিলেন। [১৯] যুদ্ধে জার্মানি পরাজিত হওয়ার পর, ১৯৪৭ সালে গর্বাচেভের একটি ভাইয়ের জন্ম হয়। [২০] গ্রামের স্কুলটি যুদ্ধের সময় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ১৯৪৪ সালের শরৎকালে পুনরায় খোলার পর গর্ভাচেভ প্রথমে সেখানে ফিরে যেতে চাইছিলেন না।[২১] কিন্তু শেষ পর্য়ন্ত স্কুলে ফিরে যান, এবং পড়াশুনায় খুব ভাল করতে থাকেন।[২২] এ সময়ে তিনি থমাস মেইন রিড এর পাশ্চাত্য উপন্যাস থেকে শুরু করে বিখ্যাত রুশ লেখকদের লেখা পাঠ করেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল, Vissarion Belinsky, আলেকজান্ডার পুশকিন, নিকোলাই গোগোল এবং মিখাইল লারমন্টভ।[২৩]

১৯৪৬ সালে, তিনি সোভিয়েত রাজনৈতিক যুব সংগঠন কমসোমোলে যোগদান করেন। পরে সংগঠনটির স্থানীয় দলের নেতা এবং তারপরে জেলার কমসোমোল কমিটিতে নির্বাচিত হন। [২৪] ১৯৪৬ সাল থেকে টানা পাঁচ বছর গ্রীষ্মকালে তিনি তার বাবাকে একটি কম্বাইন হারভেস্টার পরিচালনা করতে সহায়তা করার জন্য বাড়িতে ফিরে আসেন। এ সময়ে মাঝে মাঝে তিনি দিনে ২০ ঘন্টা কাজ করতেন। [২৫] ১৯৪৮ সালে, তারা ৮,০০০ এরও বেশি কুইন্টাল শস্য সংগ্রহ করেছিল। এই কৃতিত্ব যার জন্য সের্গেইকে অর্ডার অফ লেনিন এবং তার পুত্র অর্ডার অফ দ্য রেড ব্যানার অফ লেবার পুরস্কার প্রদান করা হয়েছিল। [২৬]

বিশ্ববিদ্যালয়: ১৯৫০-১৯৫৫

I would consider it a high honour to be a member of the highly advanced, genuinely revolutionary Communist Party of Bolsheviks. I promise to be faithful to the great cause of Lenin and Stalin, to devote my entire life to the party's struggle for Communism. বলশেভিকদের অত্যন্ত উন্নত, সত্যিকারের বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হতে পেরে আমি নিজেকে অত্যন্ত সম্মানিত বোধ করি। আমি প্রতিজ্ঞা করছি লেনিন ও স্তালিনের মহান উদ্দেশ্যের প্রতি বিশ্বস্ত থাকব, কমিউনিজমের জন্য পার্টির সংগ্রামে আমার পুরো জীবন উৎসর্গ করব।

— Gorbachev's letter requesting membership of the Communist Party, 1950[২৭]

মস্কো স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়

১৯৫০ সালের জুন মাসে গর্বাচেভ কমিউনিস্ট পার্টির প্রার্থী হন। [২৭] মস্কো স্টেট ইউনিভার্সিটি (এমএসইউ) এর আইন স্কুলে অধ্যয়নের জন্যে তিনি আবেদন করেছিলেন। এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি তখন দেশের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁর কোনরকম পরীক্ষা না নিয়েই তাকে ভর্তী করে নেন। সম্ভবত, তার শ্রমিক-কৃষক ইতিহাস এবং তার স্বীকৃতি স্বরূপ [[অর্ডার অফ দ্য রেড ব্যানার অফ লেবার] প্রাপ্তি এর পিছনে একটি কারন হিসাবে কাজ করেছিল। [২৮] সে সময়ে আইন বিষয়ে পড়াশুনা খুব জনপ্রিয় ছিল না।[২৯] গর্ভাচেভ ১৯ বছর বয়সে প্রথম মস্কো ভ্রমণ করেছিলেন। সেবারিই প্রথম তিনি নিজ গ্রাম ছেড়ে শহরে আসেন।[৩০] মস্কোতে, গর্বাচেভ সহ শিক্ষার্থীদের সাথে সোকোলনিকি জেলার একটি ডরমিটরিতে বসবাস করতেন। [৩১] তিনি এবং অন্যান্য গ্রাম থেকে আসা শিক্ষার্থীরা বেশ কুন্ঠা বোধ করতেন। কিন্তু গর্ভাচেভ শীঘ্রই নতুন পরিবেশে মানিয়ে নিয়েছিলেন। [৩২] প্রায়শই গভীর রাত পর্যন্ত পড়াশুনা করার কথা গর্ভাচেভের সহপাঠীরা স্মরণ করে। [৩৩] যে কোন বিরোধে মধ্যস্থতাকারী হিসাবে তার খ্যাতি ছিল, [৩৪] গর্ভাচেভের ছাত্র অবস্থায়, একটি ইহুদি-বিরোধী প্রচারাভিযান সমগ্র সোভিয়েত ইউনিয়নে ছড়িয়ে পড়ে। গর্বাচেভ প্রকাশ্যে ভোলোদিয়া লিবারম্যান নামক এক ইহুদি ছাত্রকে সমর্থন করেছিলেন। লিবারম্যানের বিরুদ্ধে দেশের প্রতি অবিশ্বস্ততার অভিযোগ ছিল। [৩৫]

বিশ্ববিদ্যালয়ে, গর্বাচেভ তার ক্লাসের কমসোমোল প্রধান ছিলেন, এবং তারপরে আইন স্কুলে আন্দোলন ও প্রচার বিষয়ক উপ-সচিব হয়েছিলেন। [৩৬] ১৯৫২ সালে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির পূর্ণ সদস্য নিযুক্ত হন। [৩৭] ২৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৫৩ তিনি সপাঠী রাইসা তিতারেঙ্কোকে বিয়ে করেন।[৩৮] ১৯৫৫ সালের জুন মাসে গর্বাচেভ ভাল ফলাফল করে স্নাতক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন; [৩৯]

কমিউনিস্ট পার্টিতে উত্থান

স্ট্যাভ্রোপল কমসোমল: ১৯৫৫-১৯৬৯

সোভিয়েত নেতা নিকিতা ক্রুশ্চেভ, যাঁর স্টালিনিস্ট-বিরোধী সংস্কার গর্বাচেভ সমর্থন করেছিলেন

আগস্ট ১৯৫৫ সালে, গর্বাচেভ স্ট্যাভ্রোপল আঞ্চলিক প্রকিউরেটরের অফিসে কাজ শুরু করেন, কিন্তু কাজটি তার ভাল লাগেনি।[৪০] এরপর তিনি কমসোমলের আন্দোলন এবং প্রচার বিভাগের উপ-পরিচালক হিসাবে কাজ শুরু করেন। তিনি এলাকার গ্রাম পরিদর্শন করেন এবং সেখানকার বাসিন্দাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের জন্য কাজ শুরু করেন। গর্বাচেভ এবং তার স্ত্রী প্রথমে স্ট্যাভ্রপোলে একটি ছোট ঘর ভাড়া নিয়েছিলেন, [৪১] প্রতিদিন সন্ধ্যায় শহরের চারপাশে তাঁরা হেঁটে বেড়াতেন।[৪২] ১৯৬১ সালে, গর্বাচেভ কৃষি উৎপাদনে দ্বিতীয় ডিগ্রি অর্জন করেন; তিনি স্থানীয় স্ট্যাভ্রপল এগ্রিকালচারাল ইনস্টিটিউট থেকে ১৯৬৭ সালে দূরশীক্ষনে তার ডিপ্লোমা লাভ করেন।

নিকিতা ক্রুশ্চেভ স্তালিনের স্থলাভিষিক্ত হন। যিনি ১৯৫৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে দেওয়া একটি ভাষণে, স্ট্যালিন এবং তার ব্যাক্তিপূজার বিরোধীতা করেছিলেন। এর পরে তিনি সোভিয়েত সমাজ জুড়ে ডি-স্টালিনাইজেশন প্রক্রিয়া চালু করেন৷[৪৩] গর্বাচেভ সোভিয়েত ইউনিয়নের এমন দুইজন নেতাদের মধ্যে একজন, যারা নিজেদেরকে "প্রকৃত মার্কসবাদী" বা "অকৃত্রিম লেনিনবাদী" হিসেবে প্রমাণ করেছেন যা যারা স্ট্যালিনের কর্মকান্ডকে একটি বিকৃতি হিসাবে বিবেচনা করেছিলেন।[৪৪] গর্ভাচেভ স্টাভরপোলে ক্রুশ্চেভের স্ট্যালিনিস্ট-বিরোধী বার্তা ছড়িয়ে দিতে সাহায্য করেছিলেন। তবে তিনি এমন অনেকের মুখোমুখি হয়েছিলেন যারা তখনো স্ট্যালিনকে একনিষ্ঠভাবে সমর্থন করত।[৪৫]

গর্বাচেভ স্থানীয় প্রশাসনের পদমর্যাদার দিকে দিয়ে ধীরে ধীরে উপরে ওঠেন। [৪৬] কর্তৃপক্ষ তাকে রাজনৈতিকভাবে নির্ভরযোগ্য হিসাবে বিবেচনা করতে শুরু করে। [৪৭] ১৯৫৬ সালের সেপ্টেম্বরে, তিনি স্ট্যাভ্রোপল শহরের কমসোমলের প্রথম সচিব পদে উন্নীত হন। সরকার গর্বাচেভকে এতটাই নির্ভরযোগ্য বলে মনে করেছিল যে তাকে পশ্চিম ইউরোপে সোভিয়েত প্রতিনিধী দলের সদস্য করে পাঠানো হয়েছিল; তিনি ১৯৭০ থেকে ১৯৭৭ সালের মধ্যে পাঁচবার সেখানে সফর করেছিলেন। [৪৮][৪৯]

১৯৬৬ সালে পূর্ব জার্মানি সফরে গর্বাচেভ

১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বরে তিনি একটি প্রতিনিধিদলের সাথে ইতালি ভ্রমণ করেছিলেন, যেখানে তারা ইতালির কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিনিধিদের সাথে দেখা করেছিরেন; গর্বাচেভ ইতালীয় সংস্কৃতি পছন্দ করলেও সেদেশের দারিদ্র্য ও বৈষম্য দেখে হতবাক হয়েছিলেন।[৫০] ১৯৭২ সালে তিনি বেলজিয়াম ও নেদারল্যান্ডস এবং ১৯৭৩ সালে পশ্চিম জার্মানি সফর করেন। [৫১] গর্বাচেভ এবং তার স্ত্রী ১৯৭৬ এবং ১৯৭৭ সালে ফ্রান্স সফর করেন। [৫২] তিনি বিস্মিত হয়েছিলেন যে পশ্চিম ইউরোপীয়রা কীভাবে খোলাখুলিভাবে তাদের মত প্রকাশ করছে এবং তাদের রাজনৈতিক নেতাদের সমালোচনা করে, যা সোভিয়েত ইউনিয়নে কল্পনা করাও যেত না।[৫৩] ১৯৭৪ সালে তার বাবা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ার পর, গর্বাচেভ তার মৃত্যুর কিছুদিন আগে প্রিভোলনোতে যান।[৫৪]

কেন্দ্রীয় কমিটির সম্পাদক: ১৯৭৮-১৯৮৪

গর্বাচেভ আফগানিস্তানে সোভিয়েত সেনা মোতায়েনের বিষয়ে সন্দিহান ছিলেন (১৯৮৬ সালের ছবি)

১৯৭৮ সালের নভেম্বরে গর্বাচেভকে কেন্দ্রীয় কমিটির সেক্রেটারি নিযুক্ত করা হয়। [৫৫] তার নিয়োগ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যরা সর্বসম্মতিক্রমে অনুমোদন করেছিলেন। [৫৬] মস্কোর রাজনৈতিক অভিজাতদের অংশ হিসাবে, গর্বাচেভ এবং তার স্ত্রীর জন্য আরও ভাল চিকিৎসা সেবা এবং বিশেষায়িত দোকানগুলিতে যাতায়াতের অনুমোতি পেয়েছিলেন; তাদের রাঁধুনি, চাকর, দেহরক্ষী এবং সচিবও দেওয়া হয়েছিল, যদিও তাদের মধ্যে অনেকেই [[কেজিবি]-র গুপ্তচর ছিলেন। [৫৭] তার নতুন পদে, গর্বাচেভ প্রায়শই বারো থেকে ষোল ঘন্টা কাজ করতেন। [৫৭] তিনি এবং তার স্ত্রী সামাজিক মেলামেশার সুযোগ খুব কম পেতেন, তবে তাঁরা মস্কোর থিয়েটার এবং যাদুঘরগুলি পরিদর্শন করতে পছন্দ করতেন। [৫৮]

১৯৭৮ সালে, গর্বাচেভকে কেন্দ্রীয় কমিটির কৃষি বিষয়ক সচিবালয়ে নিযুক্ত করা হয়, এই পদে পূর্বে তার পুরানো বন্ধু কুলাকভের কাজ করতেন, যিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। [৫৯] ১৯৭৯ সালের ডিসেম্বরে সোভিয়েতরা আফগান মুজাহিদিনদের বিরুদ্ধে অভিযানের জন্য সেনাবাহিনী প্রেরণ করে; এই পদক্ষেপকে প্রকাশ্যে সমর্থন দিলেও, গর্বাচেভ ব্যক্তিগতভাবে এটিকে একটি ভুল বলে মনে করেছিলেন। [৬০] ১৯৮০ সালের অক্টোবরে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারক পরিষদ, পলিটব্যুরোর পূর্ণ সদস্যপদ লাভ করেন। সে সময় তিনি পলিটব্যুরোর সর্বকনিষ্ঠ সদস্য ছিলেন। [৬১] ১৯৮২ সালের নভেম্বরে ব্রেজনেভের মৃত্যুর পর, আন্দ্রেপভ সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক হন। ১৯৮৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে অ্যান্ড্রোপভ মারা যান। তার মৃত্যুশয্যায় তিনি তার আকাঙ্ক্ষা পোষন করেন যেন গর্বাচেভ তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন।[৬২] তখন কেন্দ্রীয় কমিটির অনেকেই মনে করেন, ৫৩ বছর বয়সী গর্বাচেভ এ পদের জন্য অনভিজ্ঞ। [৬৩] পরিবর্তে, ব্রেজনেভের একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু, বর্ষিয়ান কমিউনিষ্ট কনস্ট্যান্টিন চেরনেনকো জেনারেল সেক্রেটারি নিযুক্ত হন। কিন্তু তার স্বাস্থ্য খুব খারাপ ছিল।[৬৪] চেরনেঙ্কো প্রায়ই অসুস্থতার কারনে পলিটব্যুরোর বৈঠকে সভাপতিত্ব করতে পারতেন না। তখন, গর্বাচেভ শেষ মুহূর্তে তার হয়ে সভা পরিচালনা করতেন। [৬৫]

১৯৮৫ সালের নভেম্বরে গর্বাচেভ (জেনেভা, সুইজারল্যান্ড)

১০ মার্চ ১০৮৫ তারিখে, চেরনেঙ্কো মারা যান।[৬৬]

গ্রোমিকো গর্বাচেভকে পরবর্তী সাধারণ সম্পাদক হিসেবে প্রস্তাব করেছিলেন; সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ দলীয় সদস্য হিসেবে, কেন্দ্রীয় কমিটিতে গ্রোমাইকোর এই সুপারিশ যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ছিল।[৬৭] গর্বাচেভি আশংকা করছিলেন যে দলের ভিতরে তার এই নিয়োগের বিরোধীতা হবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পলিটব্যুরোর বাকি অংশ তাকে সমর্থন করেছিল। এমনকি একজন বয়োজেষ্ঠ্য নেতাকে বঞ্চিত করে তাকে এই পদ দেয়া হয়।[৬৮] এভাবে গর্ভাচেভ, সোভিয়েত ইউনিয়নের অষ্টম নেতা হন।[১২] সরকারে ভিতরে খুব কম লোকই কল্পনা করেছিলেন যে তিনি এতটা কট্টরবাদী সংস্কারপন্থী নেতা হিসাবে আবির্ভূত হবেন।[৬৯] গর্ভাচেভ সোভিয়েত জনসাধারণের কাছে খুব সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব ছিলেন না। তখাপি, জনমনে স্বস্তি ছিল যে নতুন নেতা খুব বেশী বয়স্ক বা অসুস্থ নন।[৭০] ১৪ মার্চ তারিখে রেড স্কয়ারে অনুষ্ঠিত চেরনেঙ্কোর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াতে, নেতা হিসেবে গর্বাচেভ প্রথম জনসাধারণের সামনে উপস্থিত হন।[৭১]

সোভিয়েত নেতা হিসাবে প্রাথমিক সময়: ১৯৮৫-১৯৮৬

গর্বাচেভের নেতৃত্বের ধরন তার পূর্বসূরিদের থেকে আলাদা ছিল। তিনি বেসামরিক লোকদের সাথে আলাপ করার জন্য রাস্তায় দাঁড়িয়ে যেতেন। ১৯৮৫ সালের রেড স্কয়ারের অনুষ্ঠানে তার প্রতিকৃতি প্রদর্শন নিষিদ্ধ করেছিলেন। তিনি পলিটব্যুরো মিটিংয়ে খোলামেলা আলোচনা উৎসাহিত করতেন।[৭২] গর্বাচেভ জানতেন যে পলিটব্যুরো তাকে পদ থেকে অপসারণ করার ক্ষমতা রাখে। তাছাড়া পলিটব্যুরোর সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থক ছাড়া তিনি তার আমূল সংস্কার কর্মসূচী চালিয়ে যেতে পারবেন না।[৭৩] তিনি পলিটব্যুরো থেকে বেশ কিছু বয়স্ক সদস্যকে, গ্রিগরি রোমানভ, নিকোলাই টিখোনভ, ভিক্টর গ্রিসিনকে অপসারণের নিমিত্তে অবসর গ্রহণে উৎসাহিত করেছিলেন।[৭৪] দলের মধ্যে তার মতাদর্শে বিশ্বাসী এমন অনেক নতুন নেতাদের তিনি গুরুত্বপূর্ণ পদ দান করেন। এই নিয়োগপ্রাপ্তদের বেশিরভাগই ছিল নতুন প্রজন্মের সুশিক্ষিত কর্মকর্তা যারা ব্রেজনেভ যুগে পদবঞ্চিত হয়ে হতাশ হয়ে পড়েছিলেন।[৭৫] তার শাসনের প্রথম বছরে সচিবালয়ে ২৩ জন বিভাগীয় প্রধানের মধ্যে ১৪ জনকে বদলি করা হয়।[৭৬] ফলে, গর্বাচেভ পলিটব্যুরোতে এক বছরের মধ্যে তার আধিপত্য অর্জন করেন, যা স্ট্যালিন, ক্রুশ্চেভ বা ব্রেজনেভের চেয়েও দ্রুত।[৭৭]

অভ্যন্তরীন রাজনীতি

৯ মে ২০১৯ মস্কোতে গর্বাচেভ অন্যের সাহায্য নিয়ে হাঁটছেন

গর্বাচেভ বারবার "পেরেস্ট্রোইকা" শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন, প্রথমবার ১০৮৪ সালের মার্চ মাসে শব্দটি সর্বজনীনভাবে ব্যবহৃত হয়।[৭৮] সার্বিক পুনর্গঠনের কর্মসূচীকে বোঝানোর জন্য শব্দটি ব্যবহৃত হয়। সংস্কারের উদ্দেশ্য ছিল কেন্দ্রীয় পরিকল্পিত অর্থনীতিকে চাঙ্গা করা—বাজার সমাজতন্ত্রে রূপান্তর করা নয়। ১৯৮৬ সালের গোড়ার দিকে, পলিটব্যুরো মিটিংয়ে গর্বাচেভের বিরুদ্ধে বোরিস ইয়েলৎসিনের অবস্থান প্রকট হতে শুরু করে।[৭৯] ফেব্রুয়ারী মাসে সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির ২৭তম কংগ্রেসে, ইয়েলৎসিন গর্বাচেভের সূচিত সংস্কারের চাইতেও অনেক বেশি সুদূরপ্রসারী সংস্কারের আহ্বান জানান এবং পার্টি নেতৃত্বের সমালোচনা করেন, যদিও তিনি গর্বাচেভকে উদ্ধৃত করেননি। তারপরে গর্বাচেভ তার বক্তব্যের সময়ে পরবর্তি কয়েক ঘন্টা ধরে প্রকাশ্যে ইয়েলৎসিনের সমালোচনা করেছিলেন।[৮০] এর পরেও, গর্বাচেভও ইয়েলতসিনের সমালোচনা করেছিলেন, তিনি দাবি করেছিলেন যে ইয়েলতসিন কেবল নিজের ব্যাপারেই যত্নশীল এবং "রাজনৈতিকভাবে নিরক্ষর" ছিলেন।[৮১] এরপর ইয়েলৎসিন মস্কো পার্টির সেক্রেটারি এবং পলিটব্যুরোর সদস্য পদ থেকে পদত্যাগ করেন।[৮১]

১৯৮৬ সালের এপ্রিল মাসে চেরনোবিল বিপর্যয় ঘটে।[৮২] অবিলম্বে, ঘটনাটি ছোট করার জন্য এর সাথে জড়িত কর্মকর্তারা গর্বাচেভকে ভুল তথ্য দিয়েছিলেন। বিপর্যয়ের মাত্রা প্রকট হওয়ার সাথে সাথে চেরনোবিলের আশেপাশের এলাকা থেকে ৩৩৬,০০০ মানুষকে সরিয়ে নেওয়া হয়।[৮৩] এই দুর্যোগকে সোভিয়েত সমাজে ব্যাপক সমস্যার একটি নজিরের এর পাশাপাশি সমাজে অপ্রতুল কারিগরি এবং কর্মক্ষেত্রে অপটুতা ও জড়তার প্রমাণ হিসেবে গণ্য করা হয়েছিল।[৮৪]এপ্রিল থেকে বছরের শেষ পর্যন্ত, গর্বাচেভ খাদ্য উৎপাদন, রাষ্ট্রীয় আমলাতন্ত্র, সামরিক খসড়া এবং কারাগারের বিশাল বন্দী জনসংখ্যার সহ সোভিয়েত ব্যবস্থার খোলামেলা সমালোচনা শুরু করেন।[৮৫]

পররাষ্ট্র নীতি

১৯৮৫ সালের মে মাসে গর্বাচেভ দেশটির বৈদেশিক নীতির "আমূল পুনর্গঠনের" পক্ষে ছিলেন।[৮৬] তার নেতৃত্বের সামনে একটি প্রধান সমস্যা ছিল আফগান গৃহযুদ্ধে সোভিয়েত অংশগ্রহণ। পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে সোভিয়েত সেনারা সেদেশে চলা গৃহযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল।[৮৭] যুদ্ধে , সোভিয়েত সেনাবাহিনী ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখিন হয়েছিল। বেসামরিক জনসাধারণ এবং সামরিক বাহিনীর মধ্যেও এই সদ্ধােন্তের বিরোধিতা ছিল।[৮৭] অক্টোবর ১৯৮৫ সালে, পলিটব্যুরো আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের গর্বাচেভের সিদ্ধান্তকে অনুমোদন করে, যদিও তারা পরিপূর্ণ বাস্তবায়িত হয়েছিল ১৯৮৯ সালে।[৮৮]

গর্বাচেভ শীতল যুদ্ধে উচ্চ উত্তেজনাকর সময় উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছিলেন।[৮৯] তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সোভিয়েত ইউনিয়নের সম্পর্ক উন্নয়ন করা প্রয়োজনে। গর্বাচেভ এবং রোনালান্ড রিগান, উভয়েই স্নায়ুযুদ্ধ নিয়ে আলোচনার জন্য একটি শীর্ষ সম্মেলন করতে ইচ্ছুক ছিলেন। কিন্তু দুজনেই তাদের নিজ নিজ সরকারের মধ্যে এর বিরোধিতার মুখোমুখি হয়েছিলেন।[৯০] তারা ১৯৮৫ সালের নভেম্বরে জেনেভা, সুইজারল্যান্ডে একটি শীর্ষ সম্মেলনে অংশ নেন।[৯১]

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন

১৯৯১ সালের আগষ্ট মাসে গর্ভাচেভ যখন অবকাশ যাবন করছিলেন, তখনকমিউনিস্ট পার্টির একদল সিনিয়র নেতা - "গ্যাং অফ এইট" - নিজেদেরকে জরুরী অবস্থার স্টেট কমিটি বলে দাবী করনে তারা সোভিয়েত ইউনিয়নের নিয়ন্ত্রণ দখল করার জন্য একটি অভ্যুত্থান ঘটায়।[৯২] অভ্যুত্থানের নেতারা গর্বাচেভকে সপরিবারে গৃহবন্দী করে এবং আনুষ্ঠানিকভাবে দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করার দাবি জানায়। কিন্তু গর্ভাচেভ তা প্রত্যাখ্যান করেন।[৯৩] রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ইয়েলৎসিন ও তাঁর সমর্থকরা সে সময়ে অভ্যুত্থানকারীদের বিরোধীতা করে। অভ্যুত্থানের নেতারা বুঝতে পেরেছিলেন যে তাদের যথেষ্ট সমর্থনের অভাব ছিল। অভ্যুত্থানের প্রচেষ্টা ব্যার্থ হয়। অভ্যুত্থানের বেশ কিছু সদস্য আত্মহত্যা করে; অন্যদের বরখাস্ত করা হয়।[৯৪] ২৩ আগস্ট রাশিয়ান সুপ্রিম সোভিয়েতের একটি অধিবেশনে ইয়েলৎসিন অভ্যুত্থান সদস্যদের অনেককে নিয়োগ ও পদোন্নতি দেওয়ার জন্য গর্বাচেভের তীব্র সমালোচনা করেন।[৯৫]

২৯ আগস্ট ১৯৯১-এ, সুপ্রিম সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির সমস্ত কার্যকলাপ অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করে। এরফলে কার্যত সোভিয়েত ইউনিয়নে কমিউনিস্ট শাসনের অবসান ঘটে। এর পূর্বে ৬ নভেম্বর, ইয়েলৎসিন রাশিয়ায় কমিউনিস্ট পার্টির সমস্ত কার্যকলাপ নিষিদ্ধ করে এক ডিক্রি জারি করেছিলেন।[৯৬][৯৭] দেশের অভ্যন্তরে ঐক্য বজায় রাখার জন্য, গর্বাচেভ শেষ চেষ্টা হিসাবে একটি নতুন ইউনিয়ন গঠনের চেষ্টা করেছিলেন।কিন্তু বিভিন্ন সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রের নেতারা ক্রমবর্ধমান জাতীয়তাবাদী চাপের কারণে ফেডারেল রাষ্ট্রের ধারণাটি ফলপ্রসু হয়নি।[৯৮] শুধুমাত্র কাজাখস্তান এবং কিরঘিজিয়ার নেতারা গর্বাচেভকে সমর্থন করেছিলেন।[৯৯] ১ ডিসেম্বর ইউক্রেনীয়রা 90% ভোটের মাধ্যমে স্বাধীনতার পক্ষে রায় দেয়। গর্বাচেভ আশা করেছিলেন অন্তত ইউক্রেন ইউনিয়নের পক্ষে থাকবে।[১০০] জর্জি ম্যালেনকভ এবং ক্রুশ্চেভের পরে গর্বাচেভ ছিলেন তৃতীয় সোভিয়েত নেতা, যিনি ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেননি।

সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাগ্যকে মেনে নিয়ে গর্বাচেভ ইয়েলতসিনের সাথে এই মর্মে একটি সমোঝতা করেন যে, ২৯ ডিসেম্বরের মধ্যে ক্রেমলিন ত্যাগ করার আগে ২৫ ডিসেম্বর গর্বাচেভক আনুষ্ঠানিকভাবে সোভিয়েত রাষ্ট্রপতি এবং কমান্ডার-ইন-চিফ হিসাবে তার পদত্যাগের ঘোষণা করবেন।[১০১] ইয়াকভলেভ, চেরনিয়াভ এবং শেভার্ডনাদজে গর্বাচেভকে তাঁর পদত্যাগের বক্তৃতা লিখতে সাহায্য করেন।[১০২] গর্বাচেভ ক্রেমলিন প্রাসাদে টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে বক্তৃতা দেন, আন্তর্জাতিক টেলিভিশন চ্যানেলগুলো সেটা সম্প্রচার করে।[১০৩] তিনি ঘোষণা করেন, "আমি এতদ্বারা সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট পদে আমার কার্যক্রম বন্ধ করে দিচ্ছি।" তিনি সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন কিন্তু তিনি তার প্রশাসনের বেশ কিছু অর্জনের দাবী করেছিলেন: রাজনৈতিক ও ধর্মীয় স্বাধীনতা, সর্বগ্রাসীবাদের অবসান, গণতন্ত্রের এবং বাজার অর্থনীতির প্রচলন, এবং অস্ত্র প্রতিযোগিতার ও শীতল যুদ্ধের অবসান।[১০৪] [১০৫][১০৬]

পরের দিন, ২৬ ডিসেম্বর, সোভিয়েত ইউনিয়নের সর্বোচ্চ পরিষদ এর উচ্চকক্ষ, আনুষ্ঠানিকভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তি পক্ষে ভোট দেয়।[১০৭] ৩১ ডিসেম্বর ১৯৯১-এর মধ্যরাতে আনুষ্ঠানিকভাবে সোভিয়েত ইউনিয়ন বিলুপ্ত হয়।[১০৮] অদ্যবধি, রাশিয়ার দখলে না নেয়া সব সোভিয়েত প্রতিষ্ঠানগুলির কার্যক্রম বন্ধ আছে।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]

ব্যক্তি গর্বাচেভ

১৬ জুন ১৯৯২ সালে জেরুজালেমে ওয়েস্টার্ন ওয়াল এ গর্বাচেভ

তিনি দক্ষিণ রাশিয়ার আঞ্চলিক উচ্চারণে কথা বলতেন।[১০৯] শোনা যায়, গর্বাচেভ লোক সংগীত ও পপ গান গাইতে ভালবাসতেন।[১১০] তিনি ফ্যাশনেবল পোশাক পড়তেন।[১১১] কড়া মদের প্রতি তাঁর বিদ্বেষ ছিল।[১১২] ধূমপান করতেন না।[১১৩]পারিবারিক পরিমন্ডলে তিনি বাইরের লোকের সাথে মেলামশা করতেন না। লোকজনকে তার বাড়িতে আমন্ত্রণ করা এড়িয়ে যেতেন।[১১৪] স্ত্রীর প্রতি তাঁর প্রগাঢ় অনুরাগ ছিল। তিনি খুব সন্তান বৎসল ছিলেন।[১১৫][১১৬] তার একমাত্র কন্যাকে গর্ভাচেভ কোন অভিজাত স্কুলে না পাঠিয়ে স্ট্যাভ্রোপলের স্থানীয় স্কুলে পাঠিয়েছিলেন।[১১৭] সোভিয়েত প্রশাসনের সমসাময়িক অনেকের মত তাঁর কোন নারীপ্রীতি ছিল না। তবে নারীদের প্রতি তিনি অত্যন্ত সম্মানজনক আচরণ করতেন।[১১৮] গর্বাচেভ রাশিয়ান অর্থোডক্স চার্চ থেকে বাপ্তিস্ম নিয়েছিলেন। তাঁর পিতামহ ও পিতামহী ধর্মপরায়ন খ্রিস্টান ছিলেন।[১১৯] তাঁর প্রিয় লেখকদের মধ্যে ছিলেন আর্থার মিলার, ফিওদর দস্তয়েভস্কি, এবং চিংহিজ আইতমাটভ। তিনি গোয়েন্দা কাহিনী পড়তে ভালবাসতেন।[১২০] গর্ভাচেভ অত্যস্ত আত্মবিশ্বাসী [১২১], ও বিনম্র স্বভাবের, অধিকারী ছিলেন।[১১৩] তাঁর স্মৃতিশক্তি ছিল ভাল।[১২২] তিনি কাজপাগল ছিলেন। দলের জেনারেল সেক্রটারি থাকা অবস্থায় প্রতিদিন ৭ টা থেকে ৮ টার মধ্যে দিন শুরু করতেন এবং রাত ১ টা ২ টার আগে বিছানায় যেতেন না।[১২৩] টবম্যান তাকে "একজন অসাধারণ ভদ্রলোক" বলে বলেছেন।[১২৪] তার মতে গর্বাচেভ "উচ্চ নৈতিকতার” অধিকারী ছিলেন।

মৃত্যু

হাউস অফ দ্য ইউনিয়নসে রক্ষিত মিখাইল গর্বাচেভের মৃতদেহ

গর্বাচেভ ৩০ আগস্ট ২০২২-এ মস্কোর সেন্ট্রাল ক্লিনিকাল হাসপাতালে ৯১ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।[১২৫][১২৬] ২০২০ সাল থেকে "গুরুতর এবং দীর্ঘ অসুস্থতার পরে" তিনি মারা যান।[১২৭][১২৮][১২৯] তার উইল অনুসারে, গর্বাচেভকে মস্কোর নোভোদেভিচি কবরস্থানে তার স্ত্রী রাইসার পাশে তাঁকে সমাহিত করা হয়। তাঁর স্ত্রী ১৯৯৯ সালে মারা যান।[৯৭][১৩০] ৩ সেপ্টেম্বর ২০২২ সকাল ১০ টা থেকে ১২ টা পর্যন্ত হাউস অফ ইউনিয়নের কলাম হলে গর্বাচেভের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেখানে অনার গার্ড থাকলেও কোন রাষ্ট্রীয় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠিত হয়নি।[১৩১]

রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিন ১ সেপ্টেম্বর ২০২২-এ সেন্ট্রাল ক্লিনিকাল হাসপাতাল পরিদর্শনের সময় গর্বাচেভকে আনুষ্ঠানিক বিদায় জানান, যেখানে তিনি তার কফিনে পুস্প স্তবক দিয়ে সম্মান জানান।[১৩২][১৩৩]

তথ্যসূত্র

🔥 Top keywords: রাম নবমীমুজিবনগর দিবসপ্রধান পাতামুজিবনগর সরকারবিশেষ:অনুসন্ধানইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগএক্স এক্স এক্স এক্স (অ্যালবাম)বাংলাদেশবাংলা ভাষামিয়া খলিফারাজকুমার (২০২৪-এর চলচ্চিত্র)আনন্দবাজার পত্রিকাআবহাওয়ারামপহেলা বৈশাখউয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগইসরায়েলইরানরবীন্দ্রনাথ ঠাকুরমুজিবনগরইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউনরিয়াল মাদ্রিদ ফুটবল ক্লাব২০২৪ ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগক্লিওপেট্রাচর্যাপদভূমি পরিমাপশেখ মুজিবুর রহমানজনি সিন্সকাজী নজরুল ইসলামঈদুল আযহাফিলিস্তিনইউটিউবভারতবিকাশআসসালামু আলাইকুমসৌদি আরববাংলা প্রবাদ-প্রবচনের তালিকামুহাম্মাদ