পার্ল হারবার আক্রমণ

পার্ল হারবার আক্রমণ ছিল ইতিহাসের একটি অপ্রত্যাশিত সামরিক অভিযান যা জাপান সাম্রাজ্যের নৌবাহিনী কর্তৃক ৭ ডিসেম্বর, ১৯৪১ সালের ভোরে (জাপানের সময়: ৮ ডিসেম্বর, ১৯৪১) হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের পার্ল হারবারে অবস্থিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিমান ও নৌ-ঘাঁটিতে আক্রমণ পরিচালিত হয়। এ আক্রমণটি জাপান সাম্রাজ্যের জেনারেল হেডকোয়ার্টারের অপারেশন জেড-এর পরিকল্পনায় হাওয়াই অপারেশন বা অপারেশন এআই নামে সমধিক পরিচিত।[৬][৭][৮][৯] হাওয়াই দ্বীপে ঐ দিনটি ছিল ছুটির দিন। সেখানে আমেরিকান নৌবাহিনীর প্যাসিফিক ফ্লিটকে জাপানী নৌবাহিনীর বিরুদ্ধে আকাশসীমা অবরোধের জন্য ঘাঁটিতে নিয়ে আসা হয়েছিল।

পার্ল হারবার আক্রমণ
মূল যুদ্ধ: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল

একটি জাপানী প্লেন থেকে যুদ্ধ জাহাজের সারি আলোকচিত্রটি আক্রমণের শুরুতে তোলা হয়েছে। বিস্ফোরণটির কেন্দ্র ছিল টর্পেডো স্ট্রাইক ইউএসএস ওকলাহামাতে (বিবি-৩৭)। দু'টি জাপানী প্লেনের আক্রমণ দেখা গিয়েছিল: একটি ইউএসএস নিওশোর (এও-২৩) ওপর এবং একটি নৌবাহিনী প্রাঙ্গণের ওপর।
তারিখ৭ই ডিসেম্বর, ১৯৪১
অবস্থান
প্রধানত পার্ল হারবার, হাওয়াই দ্বীপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
ফলাফল

জাপানী প্রধানের যুদ্ধ-কৌশলে জয়লাভ

বিবাদমান পক্ষ
 মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রটেমপ্লেট:দেশের উপাত্ত জাপানের সাম্রাজ্য
সেনাধিপতি ও নেতৃত্ব প্রদানকারী
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হাজব্যাণ্ড কিমেল
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ওয়াল্টার শর্ট
জাপান চুইচি নাগুমো
জাপান ঈসোরোকু ইয়ামোতো
শক্তি
সামরিক শক্তি:
৮টি যুদ্ধের জাহাজ
৮টি ক্রুইজার
৩০টি ডেস্ট্রয়ার
৪টি ডুবোজাহাজ
৪৯টি অন্যান্য জাহাজ[১]
~৩৯০ উড়োজাহাজ
সামরিক শক্তি:
৬টি উড়োজাহাজ বাহক
২টি যুদ্ধের জাহাজ
২টি হেভি ক্রুইজার
১টি লাইট ক্রুইজার
৯টি ডেস্ট্রয়ার
৮টি ট্যাংকার
২৩টি নৌবহর ডুবোজাহাজ
৫টি ছোট ডুবোজাহাজ
৪১৪টি উড়োজাহাজ
হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতি
৪টি যুদ্ধের জাহাজ ডুবে গিয়েছিল
৩টি যুদ্ধের জাহাজ ক্ষতিগ্রস্ত
১টি যুদ্ধের জাহাজ ভূপৃষ্ঠ ছিল
২টি ডেস্ট্রয়ার ডুবে গিয়েছিল
১টি অন্যান্য জাহাজ ডুবে গিয়েছিল
৩টি ক্রুইজার ক্ষতিগ্রস্ত[nb ১]
১টি ডেস্ট্রয়ার ক্ষতিগ্রস্ত
৩টি অন্যান্য জাহাজ ক্ষতিগ্রস্ত
১৮৮টি উড়োজাহাজ ধ্বংস
১৫৫টি উড়োজাহাজ ক্ষতিগ্রস্ত
২,৪০২ জন নিহত
১,২৪৭ জন আহত[৩][৪]
৪টি ছোট ডুবোজাহাজ ডুবে গিয়েছিল
১টি ছোট ডুবোজাহাজ ভূপৃষ্ঠ ছিল
২৯টি উড়োজাহাজ ধ্বংস
৬৪ জন নিহত
১ জন বন্দি[৫]
বেসামরিক দুর্ঘটনা:
৫৭ জন নিহত
৩৫ জন আহত[৩]

৬টি বিমানবাহী জাহাজ থেকে ৩৫৩টি জাপানি যুদ্ধ বিমান, বোমারু বিমান এবং টর্পেডো বিমান নৌ-ঘাঁটিটিতে একযোগে আক্রমণ করে।[১০] চারটি মার্কিন যুদ্ধজাহাজ তাৎক্ষণিকভাবে ডুবে যায়। এছাড়াও অন্য চারটি যুদ্ধজাহাজ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ডুবে যাওয়া যুদ্ধজাহাজগুলোর মধ্যে দুটিকে উদ্ধার করে পরবর্তীতে বিশ্বযুদ্ধের কাজে লাগানো হয়। জাপান পরিচালিত এ বিমান আক্রমণে ১৮৮টি মার্কিন বিমান ধ্বংস হয়। নিহত হয় ২,৪০২ জন এবং আহত বা ঘায়েল হয় ১,২৮২ জন।[১১] কিন্তু বিমান আক্রমণে বিদ্যুৎ কেন্দ্র, জাহাজ নির্মাণ কেন্দ্র, রক্ষণাবেক্ষণ কেন্দ্র, জ্বালানি ও টর্পেডো সংরক্ষণাগার বিশেষ করে সাবমেরিন জেটি এবং গোয়েন্দা বিভাগের সদর দপ্তর আক্রান্ত হয়নি।

অন্যদিকে, আক্রান্তকারী জাপান সৈন্যদলের সামরিক সরঞ্জাম লোকসান ও জানমালের ক্ষয়ক্ষতি ছিল খুবই হালকা প্রকৃতির। তাদের ২৯টি যুদ্ধ বিমান ভূ-পাতিত হয় এবং ৫টি খর্বাকৃতি সাবমেরিন বা ডুবোজাহাজ তলিয়ে যায়। হামলাকারীদের মধ্য থেকে ৬৫ জন নিহত কিংবা আহত হয়। 'কাজু সাকামাকি' নামীয় এক জাপানি নাবিককে আটক করা হয়।

আক্রমণের ফলে প্রতিটি আমেরিকানের মনে গভীর রেখাপাত করেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রশান্ত এবং ইউরোপীয় দেশগুলোর - উভয় অংশেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি প্রবেশের অধিকার জন্মে ও নেতৃত্বের সুযোগ পায়। পরের দিন অর্থাৎ ৮ ডিসেম্বর, ১৯৪১ তারিখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাপানের বিরুদ্ধে তাদের আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধ ঘোষণা করে। অপ্রত্যাশিতভাবে অভ্যন্তরীণ ও জাতীয় সমর্থনের মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যেকার সম্পর্ক শীতলীকরণ পর্যায়ে যায়, যা পূর্বে খুবই শক্তিশালী ছিল। গ্রেট ব্রিটেন বা যুক্তরাজ্য গোপনে যুক্তরাষ্ট্রকে সহায়তা করে সক্রীয় মৈত্রীশক্তির দেশ হিসেবে আবির্ভূত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় জার্মানি এবং ইতালি যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ১১ ডিসেম্বর যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও পরবর্তীকালে ঐ একই দিন পাল্টা যুদ্ধের ঘোষণা প্রদান করে সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে।

অনেক ঐতিহাসিক ঘটনাকে আড়াল করে জাপান পার্ল হারবারে সামরিক আক্রমণ পরিচালনা করেছিল। কোনরূপ আনুষ্ঠানিক সতর্কবাণীর অভাব, দৃশ্যত ও বিশেষত চলমান আলাপ-আলোচনা দ্বারা সমস্যার সমাধান থাকা সত্ত্বেও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্রাংকলিন ডি. রুজভেল্ট ৭ ডিসেম্বর, ১৯৪১ তারিখে ঘোষণা দেন যা কুখ্যাত দিন হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবে বা কলঙ্কজনক বক্তব্য মর্মে বিশ্ববাসীর কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছে।

সংঘর্ষের প্রেক্ষাপট

ওয়াহো দ্বীপের পার্ল হারবারে ১৯০৮ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নৌ-ঘাঁটি স্থাপন করে। তখন থেকেই এটি জাপান সাম্রাজ্যের নৌবাহিনীর চোখে ভীতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। পার্ল হারবার নৌ-ঘাঁটি অত্যন্ত সুরক্ষিতভাবে ছিল যা ওয়াহো'র দুর্গ হিসেবে পরিচিত। দুর্গের অভ্যন্তরে যুদ্ধজাহাজের বন্দুকের গুলি, বোমাবর্ষণ ৪০ সে.মি প্রস্থের স্থাপনকৃত দেয়াল ভেদ ভিতরে প্রবেশ করা ছিল অসম্ভব। সেখানে কোন পতিত জমি না রাখায় প্রতিপক্ষের নৌবাহিনীর গোলাবর্ষণ ও অবতরণ করে সাফল্য লাভ করা সম্ভব নয়। কৌশল প্রয়োগ করে জাপানের সামরিক বাহিনী ঐ ঘাঁটিতে অনেক নির্মাণ শ্রমিককে গুপ্তচর হিসেবে প্রেরণ করে। ফলে, জাপান কর্তৃপক্ষ তাদের মাধ্যমে নৌ-ঘাঁটির বিস্তারিত বিবরণ জানতে সক্ষম হয়।

প্রত্যাশিত যুদ্ধ

জাপান কর্তৃক মালয় এবং ডাচ ইস্ট ইণ্ডিজে আগ্রাসী ভূমিকা পালন ও দখলের স্বার্থে পার্ল হারবার আক্রমণটি নিরপেক্ষ এলাকায় অবস্থিত ইউ.এস প্যাসিফিক রণতরীতে পরিচালিত হয়। এতে জাপান প্রাকৃতিক সম্পদ হিসেবে খনিজ তৈল এবং রাবারের দখলস্বত্ত্ব লাভের বিপুল সম্ভাবনা দেখে। জাপান এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে যুদ্ধের সম্ভাবনাটি তেমন ছিল না। ১৯২০-এর দশক থেকে পারস্পরিক সহযোগিতা ও উন্নয়নের আওতায় উভয় দেশই এ বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন ছিল। কিন্তু, ১৯৩১ সালে এশিয়ার প্রবল পরাশক্তি হিসেবে জাপানের আগ্রাসী মনোভাবের প্রেক্ষাপটে মঞ্চুরিয়া অধিগ্রহণের ফলে পরিবেশ খুব দ্রুত উত্তপ্ত হয়ে উঠে ও উত্তেজনা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। পরবর্তী দশকে ভৌগোলিক সীমারেখা পেরিয়ে জাপান চীনের ভূমি দখল করার পাশাপাশি দেশটির সামরিক শক্তি খর্ব করার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা চালাতে থাকে। অবশেষে নিরন্তর প্রয়াসে পর্যাপ্ত সম্পদ লাভের জন্যে চীনের মূলভূমি দখলের যোগ্যতা লাভে সক্ষম হয় দেশটি। মুরে'র নেতৃত্বে সাউদার্ন অপারেশনের কৌশল হিসেবে ২য় বিশ্বযুদ্ধের ("মহান পূর্ব এশিয়ার যুদ্ধ") সূচনা পর্ব হিসেবে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। বিশ্বের ইতিহাসে মুরে এবং তার কৌশলগত পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ২য় বিশ্বযুদ্ধের বিস্তৃতি ঘটে। বৈশ্বিক যুদ্ধ হিসেবে ইউরোপ, উত্তর আমেরিকাই শুধু নয়; এশিয়া এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোও এ যুদ্ধে সরাসরি জড়িয়ে পড়ে।

১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বর থেকে জাপান কর্তৃক সংঘটিত বিভিন্ন ঘটনা যেমন: ইউএসএস প্যানে'র উপর আক্রমণ এবং নানকিং গণহত্যার (২ লক্ষাধিক বাছবিচারহীন হত্যাকাণ্ড) ঘটনায় পশ্চিমের দেশগুলোয় প্রকাশ্যে জনমতের ফলে সৃষ্ট জাপান বিরোধী আন্দোলন প্রকটভাবে দানা বেঁধে ওঠে। জাপানের অন্য রাজ্য গ্রাস ও অধিগ্রহণে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রসমূহের অভ্যন্তরে ব্যাপক আতঙ্ক সৃষ্টির প্রেক্ষাপটে চীনের অনুরোধক্রমে ও যুদ্ধের জন্য ঋণ সহায়তা সরবরাহ চুক্তির আওতায় যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং ফ্রান্স একত্রিত হয়।[১২]

১৯৪০ সালে জাপান ফরাসি ইন্দোচীন জোরপূর্বক ও অন্যায়ভাবে সামরিক শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে অধিগ্রহণ করে। এর ফলে তারা চীনে সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা চালায়। জাপানের এই অবন্ধুত্বসূলভ আচরণের প্রেক্ষাপটে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উড়োজাহাজ ও মেশিনের যন্ত্রাংশ, পেট্রোলিয়ামজাতীয় তরল পদার্থ ইত্যাদি জাপানে প্রেরণের উদ্দেশ্যে জাহাজ বোঝাই করার উপর স্থগিতাদেশ প্রদান করে। সেপ্টেম্বরে লোহা ও স্টীলের পাত রপ্তানীর উপর নিষেধাজ্ঞা জারী করার ঘোষণা দেয়া হলে জাপানের রাষ্ট্রদূত হোরিনাউচি ৮ অক্টোবর, ১৯৪০ সালে সেক্রেটারী হালের কাছে তীব্রভাবে প্রতিবাদ ব্যক্ত করেন এবং হুশিয়ার বাণী উচ্চারণ করেন যে, এর ফলে তা হবে অবন্ধুত্বসূলভ আচরণ।[১৩] মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাপানে তৈল রপ্তানী বন্ধ করতে পারেনি। ঐ সময়ে ওয়াশিংটন মানবীয় দৃষ্টিকোণ ও ভাব-আবেগ নিয়ন্ত্রণের প্রশ্নে তৈল রপ্তানী বন্ধ করার মতো চরম পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়। এছাড়াও মার্কিন তেল আমদানীর উপর বহুলাংশেই জাপানের নির্ভরশীলতা ছিল।[১৪][১৫]

১৯৪১ সালের প্রথমদিকে প্রেসিডেন্ট ফ্রাংকলিন ডি. রুজভেল্ট স্যান ডিয়েগো থেকে হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে প্রশান্ত মহাসাগরীয় রণতরী স্থানান্তর করেন। এছাড়াও তিনি দূরপ্রাচ্যে জাপানী আগ্রসনকে নিরুৎসাহিত ও দমিয়ে রাখতে ফিলিপাইনে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি তৈরি করার নির্দেশ দেন। কারণ জাপানের হাই কমান্ড ভুলক্রমে যদি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ব্রিটিশ উপনিবেশগুলোতে আক্রমণ করে ফেলে, তাহলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধের দিকে অগ্রসর হবে। একটি ব্যাপক বিধ্বংসী আক্রমণ মোকাবিলা করার একমাত্র উপায়ই হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর মাধ্যমে সরাসরি হস্তক্ষেপ করা।[১৬] ফিলিপাইনে আক্রমণ করাও ছিল জাপানীদের যুদ্ধ পরিকল্পনা অংশের অন্যতম বিবেচ্য বিষয়। মার্কিন যুদ্ধ পরিকল্পনা অরেঞ্জ ফিলিপাইনের প্রতিরক্ষাকল্পে চল্লিশ হাজার দক্ষ ও অভিজাত বাহিনীর সদস্য নিয়োগ করে। এ পরিকল্পনার বিপক্ষ মতামত ব্যক্ত করেন ফিলিপাইনের ফিল্ড মার্শাল ডগলাস ম্যাকআর্থার। তিনি মত প্রকাশ করেছিলেন যে, মোতায়েনকৃত সদস্যদের পরিবর্তে ১০গুণ বেশি সদস্য প্রয়োজন এবং কাজটি বাস্তবায়ন করা সহজসাধ্য হবে না।[১৭] ১৯৪১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বিশ্লেষক ও পরিকল্পনাকারীগণ ফিলিপাইনে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়া শীর্ষক অধ্যাদেশ জারি করেন। এছাড়াও ১৯৪১ সালের শেষ দিকে এশিয়াটিক রণতরীর কমান্ডোর এ্যাডমিরাল থমাসের উপর এবিষয়ে দায়িত্বভার অর্পণ করা হয়।[১৮]

ফ্রান্স পতনের প্রেক্ষাপটে ফরাসি ইন্দোচীনে জাপানীরা আক্রমণ করে। এ আগ্রাসনের প্রতিবাদে ১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দের জুলাইতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাপানে জ্বালানী তৈল রপ্তানি স্থগিত রাখে। এছাড়াও নতুন অভ্যন্তরীণ জ্বালানী তৈল বণ্টন নীতিও এজন্যে দায়ী।[১৯] ফলশ্রুতিতে জাপানীরা নিজেদেরকে টিকিয়ে রাখতে তৈলসমৃদ্ধ ডাচ উপনিবেশ হিসেবে ইস্ট ইণ্ডিজ দখলের পরিকল্পনা করে।[২০] তারা চীন থেকে নিজ সৈন্যবাহিনী প্রত্যাহার করে এবং ইউরোপীয় দেশগুলোর নিয়ন্ত্রণাধীন প্রাকৃতিক সম্পদসমৃদ্ধ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় উপনিবেশ দখলে ব্যাপক মনোনিবেশ ঘটায়।

১৯৪১ সালের শুরুতে এ্যাডমিরাল ইসোরোকু ইয়ামামোতো'র (পরবর্তীতে জাপানের সম্মিলিত যুদ্ধ জাহাজের প্রধান) নেতৃত্বে পার্ল হারবারের উপর আক্রমণের মাধ্যমে দক্ষিণাঞ্চলের প্রাকৃতিক সম্পদভুক্ত এলাকা (সাধারণভাবে জাপানীদের অভিমতে ডাচ ইস্ট ইন্ডিজ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া) রক্ষা করার জন্য প্রাথমিকভাবে পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়।[২১] এ সংক্রান্ত বিষয়ে তিনি প্রথাগত পরিকল্পনা গ্রহণ ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। কিন্তু জাপান সাম্রাজ্যের নৌবাহিনীর জেনারেল স্টাফের তরফ থেকে হুমকি, নৌ সদরদপ্তর থেকে অনেক তর্ক-বিতর্কসহ তার পদত্যাগের ব্যাপারেও আলোচনা হয়।[২২] প্রাথমিকভাবে ক্যাপ্টেন মিনোরু গেন্ডার তত্ত্বাবধানে ১৯৪১ সালের বসন্তের শুরুতে আক্রমণের বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজ চলতে থাকে। জাপানী আক্রমণের পরিকল্পনাবিদ ১৯৪০ সালে ব্রিটিশ বিমানবাহিনী কর্তৃক ইতালীয় নৌবহরের উপর বিমান আক্রমণের ঘটনাসমূহ নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেন। এর ফলে তারা পার্ল হারবারে মার্কিন নৌবহরের উপর খুবই সফল ও ব্যাপক আক্রমণ পরিচালনা করে পরিকল্পনাটির বাস্তবায়ন করতে পেরেছিল।

পরবর্তী কয়েক মাস ধরে বিমানের পাইলটদের জন্য প্রশিক্ষণ, যন্ত্রপাতি সংগ্রহ এবং বুদ্ধিমত্তা নিরূপণ করা হয়েছিল। সমুদয় প্রস্তুতি-পর্ব সম্পন্ন হওয়াসত্ত্বেও সম্রাট হিরোহিতো আক্রমণ পরিকল্পনার ব্যাপারে সম্মতিদানের জন্য ৫ নভেম্বর পর্যন্ত অপেক্ষা করেন যেখানে ইম্পেরিয়াল কনফারেন্সের তিন-চতুর্থাংশ বিষয়াদি সম্পাদনের পর এসমস্যার বিষয়ে আলোকপাত করা হয়।[২৩] চূড়ান্ত অনুমোদন প্রদানের জন্য সম্রাট ১ ডিসেম্বর পর্যন্ত অপেক্ষা করেন। জাপানের অধিকাংশ নেতৃবৃন্দ তাকে পরামর্শ দিলেন যে, চীনের ঘটনা, বিপদজনক হয়ে ওঠা মানচুকু এবং কোরিয়ার উপর নিয়ন্ত্রণকে আরো পাকাপোক্ত করার জন্যই আক্রমণ প্রয়োজন।[২৪] যাইহোক, ১৯৪১ সালের শেষ দিকে অনেক সামরিক বিশ্লেষকেরই ধারণা ছিল যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের মধ্যে যুদ্ধবিগ্রহ অনিবার্য হয়ে পড়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রশান্ত মহাসাগরীয় সামরিক ঘাঁটিগুলোকে একাধিক বিষয়ের উপর সতর্কিত করা হয়। কিন্তু মার্কিন কর্মকর্তারা সন্দিহান ছিলেন যে, পার্ল হারবারই হবে জাপানের প্রথম লক্ষ্য। তারা প্রত্যাশা করেছিলেন যে, ফিলিপাইনই হয়তো জাপান কর্তৃক প্রথম আক্রান্ত হতে পারে। যুদ্ধ ঘাঁটি তৈরি, ম্যানিলায় নৌ-ঘাঁটির কারণে সমুদ্রপথ বন্ধ, বিশেষত দক্ষিণের অঞ্চলগুলোয় সরবরাহ বন্ধ রাখা হয়, যা ছিল জাপানের প্রধান উদ্দেশ্য।[২৫][২৬] এছাড়াও তারা আরো ভুলের মধ্যে ছিল যে, জাপান ঐ সময়ে একাধিক প্রধান নৌ-যুদ্ধ পরিচালনা করার মতো সামরিক শক্তিমত্তায় সক্ষম ছিল না।[২৭]

আক্রমণের উদ্দেশ্যসমূহ

ফোর্ড আইল্যান্ডের হ্যাঙ্গারটি বিমানসহ পুড়ছে।

পার্ল হারবার আক্রমণটিতে অনেকগুলো প্রধান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে জড়িত করেছিল জাপান।

  • প্রথমত, আক্রমণের ফলে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আমেরিকান যুদ্ধ জাহাজগুলো ধ্বংস হয়। এতে জাপানের দখলকৃত ডাচ ইস্ট ইণ্ডিজ এবং মালয়ে প্যাসিফিক ফ্লিটের হস্তক্ষেপ থেকে দূরে রাখা হয়।
  • দ্বিতীয়ত, আশা করা হয়েছিল যে, আক্রমণের ফলে জাপান তার সামরিক অবস্থানকে আরো মজবুত ও নৌ-শক্তি বৃদ্ধি করার জন্য পর্যাপ্ত সময় পাবে। এর ফলে ১৯৪০ সালে স্বাক্ষরিত উইনসন-ওয়ালশ্‌ চুক্তি বাতিল হয়ে যাবে যদি কোনো কারণে জাপান যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বিজয় অর্জন করতে পারে।[২৮][২৯]
  • সবশেষে, ঐক্যবদ্ধ আমেরিকানদের নৈতিক মনোবল বহুলাংশে হ্রাস পাবে। ফলে মার্কিন সৈন্যরা পশ্চিমের প্রশান্ত মহাসাগর ও ডাচ ইস্ট ইণ্ডিজে অগ্রসর না হয়ে যুদ্ধের চিন্তাধারা থেকে নিজেদেরকে বিচ্যূত করবে।

নীতিগত অবস্থানে থেকে যুদ্ধজাহাজ ধ্বংস করাকেই প্রধান লক্ষ্যবস্তু হিসেবে গ্রহণ করে জাপান। ঐ সময়ে বিশ্বের যেকোনো দেশের নৌবাহিনীর তুলনায় মার্কিনীদের আভিজাত্য ও গর্বের প্রতীক ছিল যুদ্ধজাহাজগুলো। এছাড়াও সামগ্রিকভাবে জাপান দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রবল পরাশক্তি রাষ্ট্র হিসেবে আসীন ছিল।[২৮]

প্রশান্ত মহাসাগরীয় নৌবহর পার্ল হারবারে নোঙর করার ফলে নির্দিষ্ট দুটি অসুবিধাকে মোকাবেলা করতে সক্ষম হয়:

  • শত্রুপক্ষের লক্ষ্যবস্তু হিসেবে আক্রান্ত জাহাজগুলো অগভীর জলে অবস্থান করবে। এতে তুলনামূলকভাবে সহজপন্থায় উদ্ধারকার্যে দ্রুত অংশগ্রহণ করাসহ প্রয়োজনে জাহাজগুলোকে মেরামত করে পুনরায় ব্যবহারোপযোগী করা যাবে। অধিকাংশ নাবিকই আক্রমণকালীন সময়ে নিজেদের প্রাণ রক্ষা করতে পারবেন। অনেকেই হয়তো উপকূল ত্যাগ করবে অথবা হারবার থেকে তাদেরকে উদ্ধার করা হবে।
  • দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ অসুবিধা হলো সময়জনিত কারণ। জাপানিরা জানতো যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রশান্ত মহাসাগরীয় নৌবহরের অধীনে তিনটি বিমান বহনকারী যুদ্ধ জাহাজ (ইউএসএস এন্টারপ্রাইজ, ইউএসএস লেসিংটন এবং ইউএসএস সারাতোগা) তখনো পার্ল হারবারে প্রবেশ করেনি। অ্যাডমিরাল মাহানের চূড়ান্ত যুদ্ধের মতবাদ - বিশেষ করে সর্বোচ্চসংখ্যক যুদ্ধজাহাজ ধ্বংস করার ঘোষণায় আইজেএন-এর শীর্ষ স্থানীয় কর্মকর্তা ইমামোতো যুদ্ধে যাবার লক্ষ্যে এগিয়ে যান।

জাপানীদের আস্থা ও বিশ্বাস ছিল যে, তাদের সামরিক ক্ষমতা প্রয়োগের ফলে একটি ছোট ও যুদ্ধে সহজভাবে বিজয় অর্জনসহ অন্যান্য লক্ষ্যমাত্রা বিশেষত নৌ জেটি, তেল সংরক্ষণাগার, ডুবোজাহাজ ঘাঁটি নিরাপদে দখল করা যাবে। তাদের সামরিক চিন্তাধারায় উক্ত সমস্ত সম্পদ বৃহৎ যুদ্ধের আগে দখল করা হলে দখলকৃত স্থাপনায় ফেলে যাওয়া সকলপ্রকার সুযোগ-সুবিধার ব্যাপক প্রভাব অনুভূত হবে।

অগ্রসরতা ও আক্রমণ

২৬ নভেম্বর ১৯৪১ তারিখে জাপানী টাস্ক ফোর্স (কিডো বুতাই স্ট্রাইকিং ফোর্স) ৬টি বিমানবাহী যুদ্ধ জাহাজ - আকাগি, কাগা, সোরিয়া, হিরুও, শোকাকু এবং জুইকাকু নিয়ে উত্তর জাপানের উপকূল থেকে উত্তর-পশ্চিম হাওয়াইয়ের দিকে অগ্রসর হয়। পার্ল হারবার আক্রমণে এ বিমান পরিবাহী রণপোতগুলো ব্যবহারের পরিকল্পনা নেয় তারা। সর্বমোট ৪০৮টি এয়ারক্রাফট বা যুদ্ধবিমান পার্ল হারবার আক্রমণে ব্যবহৃত হয়। তন্মধ্যে ৩৬০টি বিমান দুই স্তরবিশিষ্ট এবং বাকি ৪৮টি বিমান প্রতিরক্ষামূলক কমব্যাট এয়ার প্যাট্রোলের (সিএপি) যা পরবর্তীতে প্রথম স্তর থেকে ৯টি যুদ্ধ বিমান যুক্ত হবে।

প্রথম স্তরের বিমানের মাধ্যমে প্রাথমিক আক্রমণ হবার পর দ্বিতীয় স্তরের বিমানগুলো আক্রমণ করে অবশিষ্ট কাজগুলো সম্পন্ন করবে। প্রথম স্তরের বিমানগুলো থেকে মূলত প্রধান যুদ্ধ জাহাজগুলোতে আক্রমণ শানানো হবে। অগভীর জলে রাডার সংযোগ ও উত্তাল তরঙ্গবিরোধী প্রযুক্তিতে গড়া, বিশেষভাবে উপযোগী টাইপ ৯১ এ্যারিয়্যাল টর্পেডোর সাহায্যে এ আক্রমণ প্রক্রিয়া পরিচালিত হবে।[৩০]

  • বিমান চালকদের প্রতি নির্দেশ ছিল যে, তারা যেন সবচেয়ে মূল্যবান লক্ষ্যস্থলে বিশেষত যুদ্ধজাহাজ এবং বিমানবাহী জাহাজে আঘাত হেনে ধ্বংস করতে পারে। যদি কোন কারণে যুদ্ধজাহাজ এবং বিমানবাহী জাহাজে আঘাত হানতে না পারে তবে অন্যান্য উচ্চস্তরের জাহাজ হিসেবে ক্রুইজার এবং ডেস্ট্রয়ারকে লক্ষ্য হিসেবে চিহ্নিত করে আঘাত করে।
  • বোমারু বিমানের সৈনিকদেরকে স্থল এলাকা লক্ষ্য করে বোমা নিক্ষেপ করার নির্দেশ দেয়া হয়।
  • যুদ্ধ বিমানগুলোকে নির্দেশ দেয়া হয় তারা যেন গোলাবর্ষণ ও আক্রমণের সাহায্যে যতোটা সম্ভব নিশ্চিতভাবে স্থলে অবস্থানরত বিমানগুলো ধ্বংস করার চেষ্টা করে। এর ফলে প্রতিপক্ষের বিমানগুলো বোমারু বিমানগুলোকে বিশেষ করে প্রথম স্তরের বিমানগুলোকে আক্রমণ ও তাড়া করতে পারবে না। যখন যুদ্ধবিমানগুলোর জ্বালানী কমে যাবে তখন সেগুলো বিমানবাহী যুদ্ধ জাহাজে ফিরে গিয়ে জ্বালানী সংগ্রহ করে পুনরায় যুদ্ধক্ষেত্রে ফিরে যাবে। যুদ্ধে নিয়োজিত আকাশে টহলধারী যুদ্ধ বিমানগুলো যেখানে প্রয়োজন, সেখানেই তাদের দায়িত্ব পালন করে চলছিল, বিশেষ করে মার্কিনীদের বিমানঘাঁটিগুলোতে।

আক্রমণ ঘোষণার আগে ক্রুইজার থেকে দুইটি পরিদর্শনকারী বিমান ওয়াহু এলাকা পর্যবেক্ষণ করে এবং শত্রুর নৌবহরের অবস্থান ও বিন্যাসের উপর প্রতিবেদন দাখিল করে। এছাড়াও অন্য চারটি পরিদর্শনকারী বিমান জাপানের রণপোতবাহী জাহাজ কিডো বুতাই এবং নিহাউয়ের উপর চক্কর দিতে থাকে যাতে আকস্মিক পাল্টা আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে পারে।[৩১]

সাবমেরিন সংক্রান্ত বিবরণ

জাপানের সাবমেরিনবাহিত আই-১৬, আই-১৮, আই-২০, আই-২২ এবং আই-২৪ রণতরীগুলোর প্রত্যেকটিই খুব ছোট আকৃতির কো-হাইওটেকি ঘরানার সাবমেরিন নিয়ে ওয়াহো নদীতে চলতে শুরু করে।[৩২] ২৫ নভেম্বর ১৯৪১ তারিখে কুরে নেভাল ডিস্ট্রিক্ট থেকে ঐ সাবমেরিনগুলো ১০ নটিক্যাল মাইল বেগে পার্ল হারবারের মুখে এসে ৭ ডিসেম্বর ১টায় তাদের টহল কার্যক্রম শুরু করে। হাওয়াইয়ের স্থানীয় সময় রাত ৩টা ৪২ মিনিটে মাইন ধ্বংসকারী ইউএসএস কনডোর দক্ষিণ-পশ্চিম পার্ল হারবার এলাকায় একটি ছোট সাবমেরিনের উপস্থিতি টের পেয়ে ক্ষেপণাস্ত্রবাহী ইউএসএস ওয়ার্ডকে সতর্ক সঙ্কেত প্রেরণ করে।[৩৩] খুব ছোট আকৃতির কো-হাইওটেকি ক্লাস সাবমেরিনটি পার্ল হারবার এলাকায় হয়তোবা প্রবেশও করেছিল। এছাড়াও ইউএসএস ওয়ার্ড ভোর ৬টা ৩৭ মিনিটে অন্য আরেকটি কো-হাইওটেকি ঘরানার সাবমেরিনকে ডুবিয়ে দেয় যা ছিল ২য় বিশ্বযুদ্ধে প্রথম মার্কিন গুলিবর্ষণ।[৩৩][৩৪] সকাল ৮টা ৪৩মিনিটে ইউএসএস মোনঘান আরেকটি মিডগেট সাবমেরিন ধ্বংস করে।[৩৩]

তৃতীয় একটি ছোট আকৃতির ডুবোজাহাজ আক্রমণে নিয়োজিত থাকা অবস্থায় দুইবার চরায় আটকে যায়। একবার পোতাশ্রয়ে প্রবেশের সময় বাইরের দিকে এবং আরেকবার ওয়াহু'র পূর্ব দিকে। চড়ায় আটকে থাকা অবস্থায় ৮ ডিসেম্বর এই ডুবোজাহাজটিকে আটক করা হয়।[৩৫] নিদর্শন চিহ্ন হিসেবে কাজু সাকামাকি সাঁতরে তীরে উঠার চেষ্টা করার সময় ধৃত হন এবং যুদ্ধে ১ম জাপানী বন্দী হিসেবে আখ্যায়িত হন।

চতুর্থ একটি ডুবোজাহাজ সমুদ্রের গভীরে যাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং টর্পেডোতে আগুন ধরার পূর্ব মুহুর্তে নাবিকেরা এটিকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করে।[৩৬] ১৯৯৯ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর একটি প্রতিষ্ঠান ঐ সময়ের প্রাপ্ত স্থিরচিত্র পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ করে মত পোষণ করে যে, ছোট ডুবোজাহাজগুলো সফলভাবে টর্পেডোর সাহায্যে ইউএসএস ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ায় আক্রমণ পরিচালনা করতে পেরেছিল। জাপানী বাহিনী একটি ছোট সাবমেরিনের কাছ থেকে ৮ ডিসেম্বর ০০:৪১-এ পার্ল হারবারের অভ্যন্তরে এক বা একাধিক বৃহদাকার যুদ্ধ জাহাজ ধ্বংসের একটি রেডিও বার্তা পেয়েছিল।[৩৭] ছোট ডুবোজাহাজটির চূড়ান্ত পরিণতি অজানাই থেকে যায় অর্থাৎ এটি মূল ডুবোজাহাজের কাছে আর ফিরে আসেনি।[৩৮][৩৯] ৭ ডিসেম্বর ২০০৯ সালে লস এ্যাঞ্জেলেস টাইমস্‌ তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করে যে, পার্ল হারবারের দক্ষিণে ৩ মাইল দূরে একটি সাবমেরিনের তিনটি টুকরো ১৯৯৪ থেকে ২০০১ সালের মধ্যে আবিষ্কৃত হয় যা হয়তোবা ঐ সময়ে হারিয়ে যাওয়া সাবমেরিনেরই হতে পারে। প্রচার সংস্থাটি তাদের প্রতিবেদনে আরো জানায়, এর স্বপক্ষে পরোক্ষ প্রমাণাদি রয়েছে যে, সাবমেরিনটি দুইটি টর্পেডোর সাহায্যে রণতরীতে আগুন দিয়েছিল।[৪০]

জাপানের যুদ্ধ ঘোষণা

পার্ল হারবার আক্রমণে কৌশলগত কারণে যুদ্ধের কোনরূপ আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করেনি জাপান। কিন্তু এ আক্রমণ এডমিরাল ইয়ামামোতো'র ইচ্ছা অনুযায়ী ছিল না। প্রকৃতপক্ষে তিনি জাপান-যুক্তরাস্ট্রের মধ্যেকার শান্তি প্রক্রিয়া আলোচনা বাতিলের ঘটনাটি আধা ঘণ্টা পর জানতে পারেন।[৪১][৪২] জাপানীরা যুদ্ধ সংক্রান্ত আলোচনার চেষ্টা চালিয়েছিল কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে তারা আনুষ্ঠানিক ঘোষণা প্রদানের পূর্বেই আক্রমণ শুরু করে দেয়। টোকিও থেকে পাঁচ হাজার শব্দের একটি দুই খণ্ডের বার্তা যা ১৪-খণ্ডের বার্তা নামে পরিচিত, ওয়াশিংটনে অবস্থিত জাপান দূতাবাসে প্রেরণ করে। বার্তাটি প্রক্রিয়াজাতকরণে অনেক সময় ব্যয়ের প্রেক্ষাপটে জাপানী রাষ্ট্রদূতের কাছে দেরীতে পৌঁছে। ইতোমধ্যে আমেরিকান কোড সংগ্রাহকরা জাপানের প্রেরিত বার্তাটি ঘণ্টাখানেকের মধ্যে নিজেদের অনুকূলে নিয়ে নেয়।[৪৩] ১৪-খণ্ডের বার্তায় যুদ্ধের ঘোষণা লিখিত আকারে ছিল কিন্তু রাষ্ট্রদূত না করেছেন যুদ্ধের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা, না করেছেন কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার[৪৪] যুদ্ধের ঘোষণাটি মুদ্রিত আকারে জাপানের দৈনিকগুলোর সান্ধ্যকালীন সংস্করণে প্রকাশিত হয়। কিন্তু আমেরিকান সরকারকে অবগত করানো হয় আক্রমণের পরদিন।[৪৫]

প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী জাপান কোন মাত্র সরকারীভাবে সতর্কবার্তা প্রেরণ ছাড়াই দু'দেশের সম্পর্ক ভেঙ্গে আক্রমণ পরিচালনা করবে এটি বিশ্বাসযোগ্য নয়। শুধুমাত্র ওয়াশিংটনকে যুদ্ধের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা সংবলিত নথি বিতরণে বিলম্বই এজন্যে দায়ী। তবে, ১৯৯৯ সালে টোকিওতে অবস্থিত ইন্টারন্যাশনাল ক্রিশ্চিয়ান ইউনিভার্সিটির আইন ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তাকিও ইগুচি পার্ল হারবার সম্পর্কীয় প্রামাণ্য দলিলাদি ঘেঁটে চমকপ্রদ তথ্য উপস্থাপন করেছেন। এতে তিনি কীভাবে সরকারের অভ্যন্তরে তীব্র বিতর্কের ঝড় উঠেছিল, প্রকৃতপক্ষে আক্রমণ করা উচিত হবে কি-না, হলে কোথায় হবে, আলোচনা বন্ধ করতে জাপানের ইচ্ছা, ওয়াশিংটনকে এ বিষয়ে জানানো এবং যুদ্ধ শুরু করার বিষয় ইত্যাদি তথ্য তুলে ধরেন। ৭ ডিসেম্বর সম্পর্কে যুদ্ধের দিনলিপিতে উল্লেখ করা হয় যে, "আমাদের কূটনীতি অগ্রসরমান ও সফলভাবে অগ্রসর হচ্ছে।" এ বিষয়ে ইগুচি আরো বলেন, "দিনলিপির মাধ্যমে দেখা যায় যে, সামরিক ও নৌবাহিনী থেকে যুদ্ধের কোন সঠিক দিনক্ষণ ঘোষণা করা হয়নি অথবা আলোচনা স্থগিতের জন্যেও পূর্ব থেকে কোন তথ্য প্রদান করা হয়নি।"[৪৬]

বিমান আক্রমণের ধারা

দুই স্তরের যুদ্ধ বিমানের মাধ্যমে জাপান পার্ল হারবারে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের নৌ ঘাঁটিতে আক্রমণ শুরু হয়।প্রথম স্তরের বিমানগুলো ১৩৬ নটিক্যাল মাইল দূরে থাকাকালীন সময়ে আমেরিকান সেনাবাহিনীর রাডারে দৃশ্যমান হলেও ভুলক্রমে ধারণা করা হয় যে ঐগুলো আমেরিকান বোমারু বিমান।

আক্রান্ত লক্ষ্যবস্তুসমূহ: ইউএসএস ক্যালিফোর্নিয়া (বিবি-৪৪), ইউএসএস মেরিল্যান্ড (বিবি-৪৬), ইউএসএস ওকলেহোমা (বিবি-৩৭), ইউএসএস টেনিসি (বিবি-৪৩), ইউএসএস ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া (বিবি-৪৮), ইউএসএস অ্যারিজোনা (বিবি-৩৯), ইউএসএস নেভাডা (বিবি-৩৬), ইউএসএস পেনসিলভানিয়া (বিবি-৩৮), ফোর্ড আইল্যান্ড এনএএস, হিকাম বিমান ঘাঁটি।

এড়িয়ে যাওয়া স্থাপনাসমূহ: তৈল সংগ্রহের ট্যাংক; সিনপ্যাক হেডকোয়ার্টার ভবন, সাবমেরিন ঘাঁটি, নৌ ঘাঁটি।

মাত্র নব্বুই মিনিটব্যাপী জাপানের পূর্বপরিকল্পিত বিমান আক্রমণে শান্ত ও সম্পূর্ণ পার্ল হারবার দ্বীপটি ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। আকস্মিক এ আক্রমণে ২,৩৮৬জন আমেরিকান নিহত হয়। নৌবাহিনীর ২,১১৭ জন ঘটনাস্থলেই কিংবা গুরুতররূপে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন এবং ৭৭৯জন আহত হন। সেনাবাহিনীর ২১৫ জন আক্রমণের সময় কিংবা আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন এবং ৩৬০জন আহত হন। তন্মধ্যে ৫৫জন ব্যক্তি ছিলেন বেসামরিক; যাদের অধিকাংশই মার্কিন বিমান বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রের নিক্ষেপের সময় জনবসতিপূর্ণ এলাকায় অবস্থান করছিলেন। এছাড়াও, আরো ১,১৩৯ জন ব্যক্তি গুরুতরভাবে আহত হন। আঠারোটি জাহাজের সলিল সমাধি ঘটে অথবা চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পরে। তন্মধ্যে পাঁচটি রণতরী বা যুদ্ধজাহাজও ছিল।[৩][৪]

পঞ্চান্ন জন জাপানি বিমান সৈনিক এবং নয়জন ডুবোজাহাজের নাবিক আক্রমণ পরিচালনার সময় নিহত হন। একজনকে বন্দী করা হয়। জাপানের ৪১৪টি বিমানের মধ্যে ২৯টি আক্রমণকালীন সময়ে হারিয়ে যায়।[৪৭][৪৮] তন্মধ্যে নয়টি ছিল প্রথম স্তরের ও বাকী ২০টি ছিল দ্বিতীয় স্তরের বিমান থেকে। এছাড়াও, অন্য ৭৪টি যুদ্ধ বিমান ভূমি থেকে নিক্ষেপণকারী ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে ভূপাতিত হয়ে ধ্বংস হয়।

১ম স্তরের বিন্যাসক্রম

প্রথম স্তরে ১৮৩টি বিমান ক্যাপ্টেন মিতসু ফুচিদা'র নির্দেশনায় উত্তর ওয়াহো থেকে রওয়ানা দেয়। এই স্তরে -

  • ১ম দল (লক্ষ্যস্থল: যুদ্ধ জাহাজ এবং বিমান পরিবাহী জাহাজ[৪৯]):
৫০টি নাকাজিমা বি৫এন (মিত্রপক্ষীয় নাম: ক্যাট) বোমারু বিমান ৮০০ কেজি (১৭৬৯ পাউণ্ড) বর্ম্মছেদকারী বোমা নিয়ে চারদিকে আক্রমণ করে।
৪০টি বি৫এন বোমারু বিমান টাইপ ৯১ টর্পেডো নিয়ে সজ্জ্বিত হয়ে চারদিক থেকে আক্রমণ করে।
  • ২য় দল (লক্ষ্যস্থল: মধ্য পার্ল হারবারের ফোর্ড আইল্যান্ড এবং সামরিক বিমানঘাঁটি হুইলার ফিল্ড):
৫৪টি আইচি ডি৩এ (মিত্রপক্ষীয় নাম: ভ্যাল) খাড়াভাবে নেমে বোমা ফেলার লক্ষ্যে তৈরী বিমানগুলো ২৪৯ কেজি (৫৫০ পাউণ্ড) সাধারণ উদ্দেশ্যে ব্যবহার্থে বোমা নিয়ে আক্রমণ করে।
  • ৩য় দল (লক্ষ্যস্থল: ফোর্ড আইল্যান্ড, হিকাম ফিল্ড, সামরিক বিমানঘাঁটি হুইলার ফিল্ড, বারবার'স পয়েন্ট, ক্যানিওহি)
৪৫টি মিতসুবিশি এ৬এমজিরো (মিত্রপক্ষীয় নাম: জিকি) যুদ্ধবিমানগুলো আকাশ পথ নিয়ন্ত্রণ এবং গোলাবর্ষণ করে।[৪৭]

এছাড়াও, ৬টি বিমান কারিগরী ত্রুটির জন্য আকাশে উড্ডয়নে ব্যর্থ হয়।[৩১]

প্রথম স্তরের অগ্রসরমান বিমানগুলো ওপানা পয়েন্টের কাছাকাছি উত্তরাংশে এসসিআর-২৭০ রাডারে দৃশ্যমান হয় ও প্রয়োজনীয় সতর্কবার্তা প্রেরণ করা হয়। দু'জন অপারেটর - প্রাইভেটস্‌ জর্জ এলিয়ন জুনিয়র এবং জোসেফ লকার্ড তাদের প্রতিবেদনে লক্ষ্যবস্তু হিসেবে নির্দেশ করেন।[৫০] কিন্তু সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত ল্যাফটেন্যান্ট কার্মিট এ. টাইলার উক্ত লক্ষ্যবস্তু হিসেবে পূর্বনির্ধারিত ৬টি বি-১৭ বোমারু বিমানের অবতরণ ঘটবে হিসেবে উল্লেখ করেন। বিমানগুলো খুব কাছাকাছি চলে আসার পর টের পাওয়া যায় যে রাডারে দৃশ্যমানের তুলনায় এগুলোতে মিল ছিল না।[৫১][৫২] বিমানের আকার-আকৃতির বিষয়ে তারা টাইলারকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি তাদের বক্তব্যকে উপেক্ষা করেন ও নিরাপত্তাজনিত কারণে বি-১৭ বিমান অবতরণের প্রসঙ্গ এড়িয়ে যান।[৫৩][৫৩]

প্রথম স্তরের আক্রমণ ও গোলাবর্ষণে বহু মার্কিন বিমান ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় এবং রাডারে কিছুটা অসংলগ্ন সতর্কবাণী শোনা যাচ্ছিল। যখন বিমান আক্রমণ ও বোমাবর্ষণ শুরু হয়, তখন জাহাজগুলো অন্যান্য সতর্কবার্তার জন্য প্রক্রিয়া চলছিল অথবা নিশ্চিতকরণের জন্য অপেক্ষা করছিল। যাইহোক এটা স্পষ্ট নয় যে কোনপ্রকার সতর্কবার্তা আক্রমণের বিপরীতে প্রভাব পড়েছিল কি-না, তা যদি সঠিকভাবে তরঙ্গায়িত হয় এবং অবিলম্বে সম্পাদিতও হয় তা-ও।ফলাফল হিসেবে পার্ল হারবারের মতো ফিলিপাইনও জাপানি আক্রমণে পর্যদুস্ত হয়। আক্রমণের ৯ ঘণ্টা পূর্বেই ডগলাস ম্যাকআর্থার পার্ল হারবারে সম্ভাব্য জাপানী আক্রমণের বিষয়ে সতর্কিত করেছিলেন। সুনির্দিষ্ট আদেশ ঘোষণার পূর্বেই জাপানী আক্রমণের ফলে তার নেতৃত্বের বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ হয়।

পার্ল হারবারের আকাশসীমায় প্রবেশ করে ক্যানিওহিতে প্রথম আক্রমণ শুরু হয় হাওয়াইয়ান সময় সকাল ৭টা ৪৮মিনিটে যা জাপানের কিডো বুতাই জাহাজে রক্ষিত স্থানীয় সময় ৮ ডিসেম্বর ভোর ৩টা ১৮মিনিটে।[১০][৫৪] সর্বমোট ৩৫৩টি জাপানী বিমান দুইটি স্তরে বিভক্ত হয়ে ওয়াহো এলাকায় পৌঁছে। ধীর গতির অথচ নির্দিষ্ট লক্ষ্যে নির্ভুলভাবে আক্রমণ করা যায় এমন টর্পেডোগুলো প্রথম স্তরের বোমারু বিমানগুলোর সাহায্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধজাহাজগুলোয় আকস্মিকভাবে আক্রমণ চালিয়ে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। ওয়াহুতে অবস্থানরত যুক্তরাস্ট্রের সবচেয়ে বড় হিকাম ফিল্ড এবং হুইলার ফিল্ডে অবস্থিত প্রধান মার্কিনসেনা বিমানঘাঁটিতে নিচু দিকে খাড়াভাবে নেমে আসা জাপানী যুদ্ধবিমানগুলো একযোগে আক্রমণ করে। দ্বিতীয় স্তরের ১৭১টি বিমান ক্যানিওহের কাছাকাছি বিলোজ ফিল্ড ও ফোর্ড আইল্যান্ড আক্রমণে অংশ নেয়। শুধুমাত্র ইউএসএস এন্টারপ্রাইজ থেকে পি-৩৭ হকস্‌, পি-৪০ ওয়ারহকস্‌ এবং কিছু এসবিডি ডন্টলেস ডাইভ বোমারু বিমানগুলো শত্রু বিমান প্রতিরোধে অংশগ্রহণ করে।

মার্কিন জাহাজগুলোয় অবস্থানরত ব্যক্তিরা সতর্ক সঙ্কেত, বোমা বিস্ফোরণ এবং গুলির আওয়াজে জেগে উঠেন। তারা ঘুমন্ত চোখে দ্রুত পোশাক পড়ে জেনারেল কোয়ার্টার স্টেশনের দিকে দৌঁড়ে যেতে থাকেন। (বিখ্যাত বার্তা ছিল, "পার্ল হারবার বিমান অবরুদ্ধ হয়েছে। এটি কুচকাওয়াজ নয়।" - প্যাট্রোল উইং-২, প্রথম সিনিয়র হাওয়াইয়ান কমান্ডের আওতায় বার্তাটি প্রেরণ করা হয়েছিল।) প্রতিরক্ষা কার্যে নিয়োজিত ব্যক্তিরা তখন ছিলেন সম্পূর্ণরূপে অপ্রস্তুত। অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদের মালখানা কঠোর নিরাপত্তাজনিত কারণে তালাবদ্ধ অবস্থায় ছিল। কিন্তু বিমান অবরোধের কারণে তা দ্রুত খোলার ব্যবস্থা করা হয়।[৫৫] অস্ত্রাগার খুলে দেয়া হয়। নৌবাহিনীর সদস্যদের কেউই ৫‘‘/৩৮ ক্যালিবার বন্দুক পাননি। শুধুমাত্র মেশিনগানের এক-চতুর্থাংশ এবং ৩১ সেনা ব্যাটারীর চারটি হামলা মোকাবেলায় ব্যবহৃত হয়েছিল।[৫৫] এরূপ দূর্বল মানের সতর্ক অবস্থা জারী করা সত্বেও অনেক মার্কিন সামরিক ব্যক্তি যুদ্ধকালীন সময়ে বেশ কার্যকরীভাবে সাড়া দিয়েছিলেন। ইউএসএস নেভাদা জাহাজে কর্মরত জো তাওসিগ, জুনিয়র আক্রমণ সময় প্রতিরক্ষায় অংশ নিয়ে দূরে নিয়ে গেলেও তিনি একটি পা হারান। পরবর্তীতে ঐ জাহাজটি সিনিয়র কোয়ার্টার মাস্টারের মাধ্যমে উপকূলে নিয়ে যান।[৫৬] ডেস্ট্রয়ারের মধ্যে একটি - ইউএসএস আইলউইন চারজন অফিসার, সকল শিক্ষানবীশ নাবিক যারা গত এক বছরের মধ্যে সমুদ্রে দায়িত্ব পালন করেননি, তাদেরকে নিয়ে নিরাপদ দূরত্বে চলে যায়। এটিতে মাত্র ৩৬ ঘণ্টা পূর্বে কমান্ডিং অফিসার নিয়োগ করা হয়েছিল।[৫৭] ক্যাপ্টেন মারভিন বেনিয়ন ইউএসএস ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ার (বিবি-৪৮) (কিমেল'স ফ্ল্যাগশীপ) দায়িত্বে থেকে তার লোকদেরকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু ইউএসএস টেনেসি জাহাজে নিক্ষেপিত একটি বোমার আঘাতে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে তার দেহ তীরে পড়ে থাকে।

২য় স্তরের বিন্যাসক্রম

দ্বিতীয় স্তরে ১৭১টি বিমান ল্যাফটেন্যান্ট-কমাণ্ডার শিজেকাজু শিমাজাকি'র দিক-নির্দেশনায় পরিচালিত হয়।[৪৭] ৪টি বিমান কারিগরী ত্রুটির জন্য উড্ডয়নে ব্যর্থ হয়।[৩১]

দ্বিতীয় স্তরের আক্রমণে নিয়োজিত বিমানগুলো তিনটি দলে বিভক্ত হয়েছিল। একটি দল কানিওহে এবং আরেকটি দল মূল পার্ল হারবারের বাকী এলাকা আক্রমণের সাথে জড়িত হয়। এছাড়াও, অন্য আরেকটি দল পার্ল হারবারের অনেকগুলো দিক থেকে একই সময়ে এসে আক্রমণ করে। এ স্তরে নিম্নলিখিত লক্ষ্যমাত্রা স্থির করা হয়েছিল:[৪৭]

  • ১ম দল : ৫৪টি বি৫এন ২৪৯ কেজি (৫৫০ পাউণ্ড) বর্ম্মছেদকারী গোলাবারুদ এবং ৬০ কেজি (১৩২ পাউণ্ড) সাধারণ উদ্দেশ্যে বোমাবর্ষণের জন্য আক্রমণ করে।।
২৭টি বি৫এন যুদ্ধবিমান ক্যানিওহি, ফোর্ড আইল্যান্ড এবং বারবার'স পয়েন্টে অবস্থিত সকল প্রকার বিমান এবং বিমান রক্ষিত স্থানে আক্রমণ করে।
২৭টি বি৫এন যুদ্ধবিমান হিকাম ফিল্ডে অবস্থিত সকল প্রকার বিমান এবং বিমান মেরামতের জন্য রক্ষিত স্থানে আক্রমণ করে।
  • ২য় দল : (লক্ষ্যস্থল : বিমান পরিবহনে নিয়োজিত জাহাজ এবং ক্রুইজার)
৮১টি ডি৩এ যুদ্ধবিমান ২৪৯ কেজি (৫৫০ পাউণ্ড) গোলাবারুদ নিয়ে চারটি ভাগে বিভক্ত হয়ে সাধারণ উদ্দেশ্যে বোমাবর্ষণ করে।
  • ৩য় দল : (লক্ষ্যস্থল : ফোর্ড আইল্যান্ড, হিকাম ফিল্ড, হুইলার ফিল্ড, বারবার'স পয়েন্ট এবং ক্যানিওহিতে সকল প্রকার বিমানের উপর বোমাবর্ষণ)
৩৬টি এ৬এম বিমান প্রতিরক্ষা ও গোলাবর্ষণের কাজে নিয়োজিত থাকে।

একটি টর্পেডোর আক্রমণে ইতোমধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত ইউএসএস নেভাদা হারবার থেকে বের হবার চেষ্টা চালায়। এটি অনেকগুলো বোমারু বিমানের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয় ও ১১৩ কেজি (২২০ পাউণ্ড) বোমায় আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ায় ব্যাপক দাবানলের সৃষ্টি করে। হারবারে অনুপ্রবেশের সময় রোধ এড়ানোর লক্ষ্যে ইউএসএস নেভাদা উদ্দেশ্যমূলক ও ইচ্ছাকৃতভাবে তীরে নোঙ্গর করা অবস্থায় ছিল।

ইউএসএস ক্যালিফোর্নিয়া (বিবি ৪৪) দুটি বোমা এবং দুটি টর্পেডোর ধাক্কা খায়। কর্মরত নাবিকেরা জাহাজটিকে রক্ষা করার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা চালায়। কিন্তু পানি নিষ্কাষণকালীন সময়ে জাহাজটিকে পরিত্যাক্ত ঘোষণা করা হয়। ইউএসএস আরিজোনা এবং ইউএসএস ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া থেকে জ্বলন্ত তেল প্রচণ্ড বেগে প্রবেশ করে এবং পরিস্থিতি আগের তুলনায় যথেষ্ট ঘোলাটে হয়ে উঠে। অস্ত্রবিহীন অবস্থায় প্রশিক্ষণ জাহাজ ইউএসএস উটাহ দুইবার টর্পেডোর আঘাতে গর্তের সৃষ্টি হয়। ইউএসএস ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ায় (বিবি-৪৮) সাতটি টর্পেডো আঘাত হানে। ইউএসএস ওকলাহোমায় চারটি টর্পেডো আঘাত হানে। তন্মধ্যে শেষ দুইটি টর্পেডো জাহাজটির বেল্ট আর্মারে আঘাত করায় এটি উল্টে যায়। ইউএসএস মেরিল্যান্ড ৪০ সেন্টিমিটারের শেল নিক্ষেপ করা হলে কোনটিই গুরুতর ক্ষতি করতে পারেনি।

জাপানিরা যুদ্ধ জাহাজগুলোয় আক্রমণের জন্য মনোনিবেশ করলেও তারা অন্যান্য লক্ষ্যবস্তুগুলোকে বিন্দুমাত্র উপেক্ষা করেনি। হালকা ক্রুজার হিসেবে ইউএসএস হেলেনায় টর্পেডো নিক্ষেপ করা হয় এবং বিস্ফোরণে পার্শ্ববর্তী মাইন পোঁতায় নিয়োজিত ইউএসএস ওগালা উল্টে যায়। ড্রাই ডকে রক্ষিত দুটি ডেস্ট্রয়ার - ইউএসএস ক্যাসিন এবং ইউএসএস ডাউনেস ধ্বংস হয় যখন বোমা তাদের জ্বালানি সংরক্ষণাগারে নিক্ষিপ্ত হয়। জ্বালানিতে ছিদ্র হয়ে আগুন ধরে যায়; ড্রাই ডকে ভেসে যাওয়া তৈলের লেলিহান শিখায় ঐ দুটো ডেস্ট্রয়ার পুড়ে যায়। হালকা ক্রুজার ইউএসএস র‌্যালেই একটি টর্পেডোয় ছিদ্র হয়। হালকা ক্রুজার ইউএসএস হনুনুলু ক্ষতিগ্রস্ত হলেও পরবর্তীকালে মেরামতের মাধ্যমে ব্যবহার উপযোগী করে তোলা হয়। অত্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত ইউএসএস ভেসটালকে মেরামত করে ইউএসএস আরিজোনার পাশাপাশি নোঙর করে রাখা হয়। ভাসমান বিমান পরিবাহী ইউএসএস কার্টিসও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ইউএসএস শ ডেস্ট্রয়ারটি অত্যন্ত খারাপভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় যখন দুটি বোমা সামনের দিকে পড়ে।[৫৮]

হাওয়াইয়ে ৪০২টি আমেরিকান বিমানের মধ্যে ১৮৮টি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় এবং ১৫৯টি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।[১০] বিমানবন্দরে বাকী ১৫৫টি বিমান অবতরণ করা ছিল। আসলে ঘাঁটিতে অবতরণকৃত বিমানগুলোর কোনটিই আত্মরক্ষা কিংবা উড্ডয়নের জন্য পূর্ব-প্রস্তুত ছিল না। আটজন সামরিক বিমানবাহিনীর পাইলট আকাশ যুদ্ধে শত্রুর মোকাবিলা করার জন্য বিমান আক্রমণে অংশ নেন।[৫৯] এ আক্রমণে ছয়জন পাইলট কমপক্ষে একটি জাপানী যুদ্ধ বিমান ভূপাতিত করেছিলেন। তারা হলেন - ফার্স্ট লেফটেন্যান্ট লুইস এম। স্যাণ্ডারস্‌, সেকেণ্ড লেফটেন্যান্ট ফিলিপ এম. রাসমুসেন, সেকেণ্ড লেফটেন্যান্ট কেনেথ এম. টেলর, সেকেণ্ড লেফটেন্যান্ট জর্জ এস. ওয়েলচ, সেকেণ্ড লেফটেন্যান্ট হ্যারী ডব্লিউ. ওয়েলচ্‌ এবং গর্ডন এইচ. স্টার্লিং জুনিয়র। তন্মধ্যে স্টার্লিং যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফেরার পথে সহযোদ্ধার গুলিতে মারা যান।[৬০]জাপানি আক্রমণে ব্যারাকে অবস্থানকারী অতিরিক্ত একজন কর্মকর্তা নিহত হন।

সার্বিক ক্ষয়-ক্ষতির চালচিত্র

যুদ্ধজাহাজ

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রণতরী ইউএসএস ক্যালিফোর্নিয়া (বিবি-৪৪) ডুবে যাচ্ছে।
  • ইউএসএস অ্যারিজোনা : বিস্ফোরিত হয়। সবটুকুই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১,১৭৭ জন নিহত।
  • ইউএসএস ওকলাহোমা : উল্টে যায়। সবটুকুই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ৪২৯ জন নিহত।
  • ইউএসএস ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া : দুটি বোমা ও সাতটি টর্পেডোর আঘাতে ডুবে যায়। পরবর্তীতে পুনরায় চলাচলের উপযোগী করা হয় জুলাই, ১৯৪৪ সালে। ১০৬ জন নিহত।
  • ইউএসএস ক্যালিফোর্নিয়া : দুটি বোমা ও দুইটি টর্পেডোর আঘাতে ডুবে যায়। পরবর্তীতে পুনরায় চলাচলের উপযোগী করে তোলা হয় জানুয়ারি, ১৯৪৪ সালে। ১০০ জন নিহত।
  • ইউএসএস নেভাদা : তীরে অবস্থানকালীন ছয়টি বোমা ও একটি টর্পেডোর আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরবর্তীতে পুনরায় চলাচলের উপযোগী করা হয় অক্টোবর, ১৯৪২ সালে। ৬০ জন নিহত।
  • ইউএসএস টেনেসি : দুটি বোমায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরবর্তীতে পুনরায় চলাচলের উপযোগী করা হয় ফেব্রুয়ারি, ১৯৪২ সালে। ৫ জন নিহত।
  • ইউএসএস মেরিল্যান্ড : দুটি বোমায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরবর্তীতে পুনরায় চলাচলের উপযোগী করা হয় ফেব্রুয়ারি, ১৯৪২ সালে। ৪ জন নিহত (তন্মধ্যে জলের উপর নামার জন্য ভাসমান বিমানের পাইলটও ছিলেন)।
  • ইউএসএস পেনসিলভানিয়া : একটি বোমায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ইউএসএস ক্যাসিনের ভগ্নস্তুপে পড়েছিল। পরবর্তীতে পুনরায় নৌ-চলাচলের উপযোগী করা হয়। ৯ জন নিহত।

ব্যবহার অনুপযোগী যুদ্ধজাহাজ (প্রশিক্ষণ জাহাজ)

  • ইউএসএস উটাহ (বিবি-৩১/এজি-১৬) : উল্টে যায় ও সম্পূর্ণরূপে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ৫৮ জন নিহত।

টহল জাহাজ

  • ইউএসএস হেলেনা : ১টি টর্পেডোতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ব্যবহার উপযোগী করে তোলা হয় জানুয়ারি, ১৯৪২ সালে। ২০ জন নিহত।
  • ইউএসএস র‌্যালীহ : ১টি টর্পেডোতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরবর্তীতে পুনরায় ব্যবহার উপযোগী করে তোলা হয়।
  • ইউএসএস হনলুলু : লক্ষ্যচ্যুত হওয়ায় অল্প ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরবর্তীতে পুনরায় ব্যবহার উপযোগী করে তোলা হয়।

ধ্বংসকার্য্যে নিয়োজিত জাহাজ

  • ইউএসএস ক্যাসিন : একটি বোমার আঘাতে পুড়ে যায়। পুনরায় ব্যবহার উপযোগী করে নৌ-চলাচলের জন্যে ভাসানো হয় ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৪ সালে।
  • ইউএসএস ডাউনেস : পুড়ে যাওয়া ইউএসএস ক্যাসিনের আগুনে পুড়ে যায়। পুনরায় ব্যবহার উপযোগী করে নৌ-চলাচলের জন্যে ভাসানো হয় নভেম্বর, ১৯৪৩ সালে।
  • ইউএসএস শ্‌ : তিনটি বোমার আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জুন, ১৯৪২ সালে পুনরায় ব্যবহার উপযোগী করে নৌ-চলাচলের জন্যে ভাসানো হয়।

সহায়ক শক্তি

  • ইউএসএস ওগলালা : সমুদ্রে মাইন বসানোর কাজে নিয়োজিত জাহাজ এটি। টর্পেডোর আঘাতে নষ্ট হয়ে যাওয়া ইউএসএস হেলেনা'র কারণে এটি উল্টে যায়। পরবর্তীতে ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৪ সালে মেরামত করে ইঞ্জিন মেরামতকারী জাহাজ হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
  • ইউএসএস ভেস্টাল : মেরামতকারী জাহাজ হিসেবে সমুদ্র তটে অবস্থানের প্রেক্ষাপটে এটি দুটি বোমায় ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় ও পার্শ্ববর্তী ইউএসএস অ্যারিজোনা থেকে আগুন লেগে যায়। পরবর্তীতে আগস্ট, ১৯৪২ সালে মেরামত করে ব্যবহার উপযোগী করা হয়।
  • ইউএসএস কার্টিস : সাগরে নামার যোগ্য বিমানের বহরের জাহাজ। একটি বোমায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জাপানের একটি যুদ্ধ বিমান ধ্বংস করে। পরবর্তীতে জানুয়ারি, ১৯৪২ সালে মেরামত করে ব্যবহার উপযোগী করা হয়। ১৯ জন নিহত হয়।

প্রথম স্থিরচিত্র

একটি জাপানী মিতসুবিশি এ৬এম২ "জিরো" জঙ্গী বিমান আকাজি বিমানবাহী জাহাজ থেকে ৭ ডিসেম্বর, ১৯৪১ সালে উড্ডয়ন করছে।

লি এমব্রি নামীয় জনৈক বিমানচালক পার্ল হারবার আক্রমণের অব্যবহিত পরই প্রথম এরিয়্যাল স্থিরচিত্র ধারণ করেন।তিনি তখন ক্যালিফোর্নিয়ার হ্যামিলটন ফিল্ড থেকে বোয়িং বি-১৭ বিমান নিয়ে ফিলিপাইনের দিকে যাচ্ছিলেন।[৬১] আক্রমণের সময় হিকাম ফিল্ডে বিমানের জন্য পূর্বনির্ধারিত জ্বালানী সংগ্রহে তার যাত্রা বিরতির প্রয়োজন পড়েছিল।

উদ্ধার তৎপরতা

পদ্ধতিগতভাবে দুর্গতদের অনুসন্ধানের পর আনুষ্ঠানিকভাবে জাহাজ উদ্ধারকার্য শুরু হয়। ইউএস প্যাসিফিক রণতরীতে কর্মরত মেটেরিয়াল অফিসার ক্যাপ্টেন হোমার এন. ওয়ালিন খুব দ্রুত উদ্ধার তৎপরতায় সম্পৃক্ত হন।তিনি ১৯৪২ সালের শুরুতে ইউএসএস ক্যালিফোর্নিয়া উদ্ধারকার্য্যে নেতৃত্ব দেন।

পার্ল হারবারের চারপাশের এলাকাগুলোতে নৌবাহিনী, নৌ-জেটি এবং সাধারণ জনগণ চলাচলের যোগ্য জাহাজসমূহ চিহ্নিত করে মেরামতের জন্য কাজ শুরু করেন। তারা জাহাজের গর্তগুলো জোড়া দিয়ে, ভগ্নস্তুপ পরিষ্কার করাসহ জল নিষ্কাষণ করে চলাচল উপযোগী করেন। নৌ ডুবুরীরা ক্ষতিগ্রস্ত জাহাজের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে ক্ষতিগ্রস্ত জায়গাগুলো মেরামত করেন। ছয় মাসের মধ্যে পাঁচটি যুদ্ধ জাহাজ ও দুইটি ক্রুইজার (শত্রু জাহাজ খোঁজায় নিয়োজিত যুদ্ধ জাহাজ) জোড়া দিয়ে অথবা চলাচল উপযোগী করে পার্ল হারবারের নৌ জেটিতে প্রেরণ করা হয় এবং ব্যাপকভাবে মেরামত জন্য প্রধান জেটিতে পাঠানো হয়।

নিবিড় এ উদ্ধার অভিযান আরো একটি বছরের জন্য অব্যাহত থাকে। প্রায় বিশ হাজার লোককে জাহাজগুলোর উদ্ধার কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করা হয়।[৬২] কিন্তু, ইউএসএস ওকলাহোমাকে সাফল্যের সাথে উঠানো হলেও কখনো মেরামত করে ব্যবহার উপযোগী করা হয়নি। ইউএসএস অ্যারিজোনা এবং লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানায় নিয়োজিত জাহাজ ইউএসএস উটাহ প্রচন্ডভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় উদ্ধার কার্যক্রম পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়। অদ্যাবধি ঐ দুটি বিশাল আকৃতির জাহাজ যেখানে নিমজ্জ্বিত হয়েছিল সেখানেই রয়েছে এবং ইউএসএস অ্যারিজোনাকে নিয়ে যুদ্ধের স্মৃতি হিসেবে ঠাঁই করে নিয়েছে ইতিহাসের পর্দায়।[৬৩]

ফলাফল

কৌশলগত পরিণতি

জাপানী যুদ্ধ বিমানবাহী শোকাকু জাহাজ থেকে মিতসুবিশি এ৬এম২ "জিরো" জঙ্গী বিমানগুলো পার্ল হারবারের দিকে উড্ডয়নের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।

অ্যাডমিরাল হারা তাদাইচি জাপানি আক্রমণের ফলাফল হিসেবে বলেছিলেন, "আমরা মহান পার্ল হারবার আক্রমণে যুদ্ধকৌশল প্রয়োগ করে বিজয় অর্জন করি এবং সামগ্রিক ফলাফল হিসেবে যুদ্ধে হেরে যাই"।[৬৪] যথাযথভাবে সুনির্দিষ্ট ও প্রয়োজনীয় উদ্দেশ্যের উপর আক্রমণ সম্পন্ন হলেও এটি বৃহদাকার এবং অপ্রয়োজনীয়ভাবে ভিন্ন প্রেক্ষাপট ও পরিবেশ সৃষ্টি করে। মূল পরিকল্পনাটি গ্রহণ করেছিলেন ইমামোতো। ফলে, আমেরিকান নৌবাহিনী ১৯৩৫ সাল থেকে প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জ ফিলিপাইনে অগ্রসর হয়ে ব্যাপক বিধ্বংসী যুদ্ধ ছড়িয়ে দেয় যা ছিল প্লান অরেঞ্জের অংশবিশেষ।[১৬] তা সত্ত্বেও ১৯৪০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্লান ডগের আওতায় জোরপূর্বক আইজেএন (ইম্পেরিয়াল জাপানি নেভি)-কে প্রশান্ত মহাসাগরের পূর্বাঞ্চল থেকে বিতাড়িত করে এবং অস্ট্রেলিয়া থেকে জাহাজগুলোকে দূরে সরিয়ে রাখে। এভাবেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ধীরে ধীরে নাৎসীবাদী জার্মানীকে পরাজিত করতে বাধ্য করে।[৬৫]

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সৌভাগ্য ছিল যে, মার্কিন বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজগুলো জাপানি আক্রমণের সময় অক্ষত ছিল। অন্যথায়, প্যাসিফিক রণপোতবাহী জাহাজের পক্ষে আক্রমণের উদ্দেশ্যে অভিযানের ক্ষমতা এক বছর বা তারও বেশি সময় ব্যয় করতে হতো। আটটির মধ্যে ছয়টি যুদ্ধজাহাজ মেরামত করে পুনরায় কাজে লাগানোর উপযোগী করা হয়। কিন্তু তাদের ধীর গতির কারণে উপকূলের কাছাকাছি এলাকায় গোলাবর্ষণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখা হয়। যুদ্ধে জাপানিদের কৌশলগত চিন্তাধারায় মূল ত্রুটি ও বিশ্বাস ছিল যে, প্রশান্ত মহাসাগরীয় যুদ্ধে যুদ্ধজাহাজগুলো অংশ নিবে এবং ক্যাপ্টেন আলফ্রেড মাহানের মতবাদটি প্রতিপালিত হবে। ফলশ্রুতিতে ইমামোতো এবং তার উত্তরাধিকারী মজুতকৃত যুদ্ধজাহাজগুলোকে চূড়ান্ত যুদ্ধের জন্য প্রেরণ করতেন যা কখনো ভাবা যায়নি।

আক্রমণের ফলাফল

পার্ল হারবার আক্রমণের প্রেক্ষাপটে শত্রু প্রতিরোধে বীরত্বপূর্ণ ও যথাযথ অবদান রাখায় আমেরিকান সৈন্যদেরকে পুরস্কৃত করা হয়। তন্মধ্যে - সম্মান পদক : ১৫টি, নেভি ক্রস : ৫১টি, সিলভার ক্রস : ৫৩টি, নৌবাহিনী এবং নাবিক কোর পদক : ৪টি, বিশেষ উড়ন্ত দণ্ড : ১টি, বিশেষ সেবা দণ্ড : ৪টি, বিশেষ সেবা পদক : ১টি এবং ব্রোঞ্জের তারকাখচিত পদক : ৩টি দেয়া হয়। এছাড়াও, আক্রমণের সময় অবস্থানরত সকল প্রাক্তন সৈনিককে একটি বিশেষ সামরিক পুরস্কার হিসেবে পার্ল হারবার স্মারক পদক প্রদানের জন্য অনুমোদন করা হয়।[৬৬]

আক্রমণের পরদিন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট কংগ্রেসের যুক্ত অধিবেশনে জাপান সাম্রাজ্যের উপর যুদ্ধের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা প্রদানের জন্য আহ্বান জানান।তার এ ঘোষণাই পরবর্তীকালে ইতিহাসের কলঙ্কজনক বক্তৃতা হিসেবে বিশ্বের দরবারে পরিচিতি লাভ করে।কংগ্রেসের সদস্যগণ একযোগে এক ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে এ বিষয়ে অনুমোদন প্রদান করে।

পরবর্তীতে ইউরোপের অন্যতম প্রতাপশালী নাৎসী জার্মানি এবং ইতালীর রাজতন্ত্রীয় সরকার ১১ ডিসেম্বর, ১৯৪১ সালে অক্ষশক্তির সদস্য রাস্ট্র হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধ ঘোষণা করে।এর প্রত্যুত্তরে, মার্কিন যুক্তরাস্ট্রের কংগ্রেস ও এর সদস্যগণ একই দিনে জার্মানি ও ইতালি - উভয় দেশের বিরুদ্ধেও আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধ ঘোষণার প্রস্তাবে স্বাক্ষর করে।

পার্ল হারবার আক্রমণের ফলে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের সকল মিত্র পক্ষের দেশগুলো প্রাথমিকভাবে ধাক্কা খায়। আরো ক্ষয়-ক্ষতির মতো ভীতিকর অবস্থার পরিবেশ সৃষ্টি করে এবং সামগ্রীকভাবে পরিস্থিতির ভীষণ অবনতি ও ঘোলাটে হয়ে উঠে। জাপান কয়েক ঘণ্টা পরেই সময় পার্থক্যজনিত কারণে ৮ ডিসেম্বর ফিলিপাইনে আক্রমণ চালায়। পার্ল হারবার আক্রমণের মাত্র তিনদিন পর মালয়ের পূর্ব উপকূলে বৃটেনের রাজকীয় নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ এইচএমএস প্রিন্স অব ওয়ালস্‌ এবং ব্যাটল ক্রুইজার এইচএমএস রিপালস্‌ ডুবে যায়। এর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইন্সটন চার্চিল পরবর্তীতে বলেছিলেন,

যুদ্ধ চলাকালে পার্ল হারবার বিষয়ে প্রায়শঃই আমেরিকানরা সংঘবদ্ধভাবে প্রচারণা কার্যক্রম পরিচালনা করতো।[৬৮] পার্ল হারবারে আক্রমণ ও এর ভবিষ্যৎ ফলাফলের প্রেক্ষাপটে জাপানি বংশোদ্ভূত মার্কিন অধিবাসী ও নাগরিকদেরকে অন্তরীণ করে রাখা হয়। আক্রমণের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে জাপানি আমেরিকান নেতাদেরকে ঘিরে রাখা হয় এবং অতি উচ্চমাত্রায় নিরাপত্তা প্রদানে ক্যাম্পে নিয়ে আসা হয়।[৬৯] পরে, এক লক্ষ দশ হাজারেরও বেশি জাপানি মার্কিন নাগরিকসহ যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদেরকে তাদের বাসভবন থেকে নিয়ে আসা হয় এবং অন্তরায়ন ক্যাম্পে স্থানান্তর করা হয়।[৭০]

প্রচার মাধ্যমে

  • দ্য ফাইনাল কাউন্টডাউন : ছবিটি পার্ল হারবারকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে। এতে দেখা যায় যে, ১৯৮০ সালে পারমাণবিক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে যুদ্ধবিমান পরিবাহী ইউএসএস নিমিজ ৬ ডিসেম্বর, ১৯৪১ ইং তারিখে ঘাঁটি আক্রমণের পূর্বদিনকে ঘিরে স্মৃতি রোমন্থন করতে দেখা যায় চলচ্চিত্রটিতে।
  • ফ্রম হিয়ার টু ইটারনিটি : এ ছবিটি জেমস জোন্স কর্তৃক পরিচালিত। পার্ল হারবার আক্রমণের প্রেক্ষাপটে রবার্ট ই. লি প্রিউইটের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা চলচ্চিত্রায়ণের মাধ্যমে ফুঁটিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে।
  • ইন হার্ম'স ওয়ে : জেমস্‌ ব্যাসেটের উপন্যাস অবলম্বনে অটো প্রিমিনগার ১৯৬৫ সালে চলচ্চিত্রে রূপায়ণ করেন। ৬ ডিসেম্বর, ১৯৪১ সালে হাওয়াইয়ে আক্রমণ স্বত্ত্বেও জাহাজের এক ব্যক্তির হারবার ছেড়ে যাওয়ার সামর্থ্যই এর উপজীব্য বিষয়।
  • পার্ল হারবার : মাইকেল বে পরিচালিত ২০০১ সালের ছবি। ঐতিহাসিক সত্যতার মাপকাঠিতে রচিত প্রেমগাঁথাকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে ছবিটি।
  • এয়ার ফোর্স : ১৯৪৩ সালে তৈরী কুৎসা ও বিভ্রান্তি রটানো চলচ্চিত্রবিশেষ। হিকাম ফিল্ডে বি-১৭ বিমান বহনকারী বোমারু বিমানের জন্য ম্যারী এন জাহাজে কর্মরত নাবিকের নিয়তি সম্পর্কে চিত্রিত হয়েছে এ ছবিতে।
  • ডিসেম্বর সেভেনথ্‌ : জন ফোর্ডের পরিচালনায় ১৯৪৩ সালে আমোদ-প্রমোদে লিপ্ত যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীকে জাপানী আক্রমণকে ঘিরে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। অন্যান্য প্রতিবেদন বিশেষ করে প্রচারমাধ্যমে ভুলক্রমে ছবিটি থেকে সংগৃহীত স্থির চিত্রকেই গ্রহণ করেছে যা পরবর্তীতে পার্ল হারবার আক্রমণের প্রকৃত চিত্রকে বিকৃত করেছে।[৭১]
  • স্টর্ম ওভার দ্য প্যাসিফিক : ১৯৬০ সালে জাপানী স্টুডিও তোহো কোম্পানী লিমিটেডের প্রযোজনায় একজন জাপানী বিমানচালকের পার্ল হারবারে দায়িত্ব পালন ও মিডওয়ের যুদ্ধে অংশগ্রহণ সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে। পরবর্তীতে ছবিটি ১৯৬১ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আই বোম্বড্‌ পার্ল হারবার শিরোনামে ইংরেজিতে অনূদিত হয়ে মুক্তি পায়।
  • তোরা! তোরা! তোরা! : জাপানি আক্রমণের শিকার পার্ল হারবারকে ঘিরে ১৯৭০ সালে নির্মিত চলচ্চিত্র বিশেষ। আমেরিকান এবং জাপানিদের দৃষ্টিভঙ্গি, ঐতিহাসিক ঘটনাসহ আমেরিকানদের তথ্য কোডের ব্যবহারকে তুলে ধরা হয়।[৭২]
  • দি উইণ্ডস অব ওয়ার : ১৯৬৩ এবং ১৯৭১ সালে আমেরিকান লেখক হারমান ওক রচিত উপন্যাস। ডিসেম্বর ১৯৪১ সালে আক্রমণের ফলাফল হিসেবে উপন্যাসটির সমাপ্তি ঘটে। ১৯৮৪ সালে টেলিভিশনে মিনিসিরিজ আকারে প্রচার করা হয়। এতে অভিনয় করেন - রবার্ট মিচাম, আলী ম্যাকগ্রা এবং রালফ্‌ বেলামি (প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের ভূমিকায়)।
  • পার্ল হার্বার পেপারস্‌: ইনসাইড দ্য জাপানি প্লানস্‌ : ১৯৯৩ সালে প্রকাশিত বই। গোল্ডস্টেইন এবং ডিলন বইটির লেখক। প্রাঞ্জ লাইব্রেরি থেকে জাপানি দৃষ্টিকোণে আক্রমণসহ কিছু কর্মকর্তার ব্যক্তিগত ডায়রী এবং জাহাজের সময়কাল সম্পর্কীয় কথা লিপিবদ্ধ আছে।

আরও দেখুন

পাদটীকা

তথ্যসূত্র

বহিঃসংযোগ

অ্যাকাউন্ট
মিডিয়া
ঐতিহাসিক ডকুমেন্ট


🔥 Top keywords: রাম নবমীমুজিবনগর দিবসপ্রধান পাতামুজিবনগর সরকারবিশেষ:অনুসন্ধানইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগএক্স এক্স এক্স এক্স (অ্যালবাম)বাংলাদেশবাংলা ভাষামিয়া খলিফারাজকুমার (২০২৪-এর চলচ্চিত্র)আনন্দবাজার পত্রিকাআবহাওয়ারামপহেলা বৈশাখউয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগইসরায়েলইরানরবীন্দ্রনাথ ঠাকুরমুজিবনগরইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউনরিয়াল মাদ্রিদ ফুটবল ক্লাব২০২৪ ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগক্লিওপেট্রাচর্যাপদভূমি পরিমাপশেখ মুজিবুর রহমানজনি সিন্সকাজী নজরুল ইসলামঈদুল আযহাফিলিস্তিনইউটিউবভারতবিকাশআসসালামু আলাইকুমসৌদি আরববাংলা প্রবাদ-প্রবচনের তালিকামুহাম্মাদ