বিক্ষেপণ

যে ভৌত প্রক্রিয়ায় সরল পথে চলমান তরঙ্গ মাধ্যমের স্থানিক অসমরূপতাগুলোর দরুন বিচ্যুত হয়

পদার্থবিজ্ঞানের বহু-সংখ্যক ভৌত প্রক্রিয়াকে বিক্ষেপণ নামে অভিহিত করা হয়। বিক্ষেপণে মূলত কোন মাধ্যমে গতিশীল কণাকে অথবা আলো বা শব্দের মতো কয়েক ধরনের বিকিরণকে অসমরূপতাসমূহের (non-uniformities) দ্বারা এদের সঞ্চারপথ থেকে বিচ্যুত হতে বাধ্য করা হয়। যেসব অসমরূপতা বিক্ষেপণ ঘটায় তাদের সংখ্যা অগণিত যার মধ্যে কণা এবং বিকিরণও অন্তর্ভুক্ত। কোন বিকিরণের প্রতিফলনের ক্ষেত্রে প্রতিফলনের সূত্র অনুসারে এর যে কোণে প্রতিফলিত হওয়া উচিৎ সেখান থেকে এর বিচ্যুতি ঘটলে এরূপ প্রতিফলন বা বিচ্যুতিকেও সাধারণত বিক্ষেপণের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। যেসব বিকিরণের প্রতিফলনের ক্ষেত্রে বিক্ষেপণ ঘটে অর্থাৎ যেসব প্রতিফলিত বিকিরণের বিক্ষেপণ ঘটে তাদেরকে সচরাচর অপসারী প্রতিফলন এবং অবিক্ষিপ্ত প্রতিফলনকে নিয়মিত প্রতিফলন বলা হয়। (অন্ততপক্ষে ১৭ শতকের আইজাক নিউটনের সময়ে[১]) বিক্ষেপণ শব্দটি দ্বারা মূলত আলোর বিক্ষেপণকেই বোঝানো হত। "রশ্মি"-সদৃশ ঘটনাসমূহ আবিষ্কৃত হলে বিক্ষেপণের ধারণা এসব বিষয়ের ক্ষেত্রেও সম্প্রসারিত হয় যার ফলে ১৮০০ সালের দিকে উইলিয়াম হার্শেল "তাপ রশ্মি"র বিক্ষেপণের প্রসঙ্গটি তুলে ধরতে পারতেন (প্রকৃতিতে তাপ যে তড়িচ্চুম্বকীয় সেটা তখনও স্বীকৃতি পায়নি)।[২] জন টিন্ডাল যিনি আলোর বিক্ষেপণ সংক্রান্ত গবেষণার একজন অগ্রদূত তিনি ১৮৭০ এর দশকে আলো এবং শব্দের বিক্ষেপণের মধ্যে যে সম্পর্ক রয়েছে তা লক্ষ্য করেন।[৩] ১৯ শতকের শেষের দিকে ক্যাথোড রশ্মি (ইলেকট্রন রশ্মি)[৪] এবং এক্স-রে[৫] এর বিক্ষেপণ পর্যবেক্ষণ এবং সেসব নিয়ে আলোচনা করা হত। অতিপারমাণবিক কণার আবিষ্কার (যেমন: ১৯১১ সালে আর্নেস্ট রাদারফোর্ডের আবিষ্কার[৬]) এবং ২০ শতকে কোয়ান্টাম তত্ত্বের বিকাশের সাথে সাথে, উপরন্তু আলোর বিক্ষেপণের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত গাণিতিক কাঠামো অন্যান্য অনেক ভৌত ঘটনাবলীর ক্ষেত্রেও যে প্রয়োগ করা সম্ভবপর সেটা স্বীকার করে নেওয়ার ফলে বিক্ষেপণের ধারণাটির অনেক সম্প্রসারণ ঘটে।

উপরের আলোচনা অনুসারে অণু, পরমাণু, ইলেকট্রন, ফোটন এবং অন্যান্য কণার মধ্যে যে কণা-কণা সংঘর্ষ (কণা পদার্থবিজ্ঞানের ভাষায় যা বিশেষ একটি ঘটনা) তাকে বিক্ষেপণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়। এর উদাহরণ হিসেবে রয়েছে: পৃথিবীর ঊর্ধ্ব বায়ুমণ্ডলে মহাজাগতিক রশ্মির বিক্ষেপণ, কণা ত্বরক যন্ত্রের ভিতর কণার সংঘর্ষ, ফ্লুরোসেন্ট বাতির ভিতরে গ্যাস পরমাণুর ইলেকট্রন বিক্ষেপণ এবং পারমাণবিক চুল্লীর ভিতরে নিউট্রন বিক্ষেপণ।[৭]

যেসব অসমরূপতা (non-uniformities) বিক্ষেপণ ঘটায় তাদেরকে সাধারণত বিক্ষেপক (scatterer) বা বিক্ষেপণ কেন্দ্র (scattering center) বলা হয়। তালিকায় এদের সংখ্যা অত্যধিক যাদের কয়েকটি হলো: কণা, বুদবুদ, ফোঁটা বা ড্রপলেট, পলিক্রিস্টালাইন কঠিন পদার্থে বিদ্যমান ক্রিস্টালাইট (স্ফটিক বিশেষ), মনোক্রিস্টালাইন কঠিন পদার্থের ত্রুটি , পৃষ্ঠতলের রুক্ষতা, জীবদেহের কোষ, এবং কাপড়ে থাকা (সুতার) তন্তু; এমনকি তরল বা প্রবাহী বস্তুতে ঘনত্বের তারতম্যও বিক্ষেপণ ঘটাতে সক্ষম। যেসব চলমান তরঙ্গ বা গতিশীল কণার চলার পথে এই ধরনের ঘটনার লক্ষণ বা প্রভাব দেখা যায় তাদের প্রায় সবগুলোকেই বিক্ষেপণ তত্ত্বের কাঠামোতে ব্যাখ্যা করা সম্ভব।

যেসব বিষয়ের ক্ষেত্রে বিক্ষেপণ আর বিক্ষেপণ তত্ত্ব খুবই তাৎপর্যপূর্ণ তাদের মধ্যে মধ্যে রয়েছে রাডারের মাধ্যমে দূর অনুধাবণ, চিকিৎসায় ব্যবহৃত শব্দোত্তর তরঙ্গ বা আল্ট্রাসনোগ্রাফি, অর্ধপরিবাহী ওয়েফারের পরীক্ষণ, পলিমারকরণ প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ-নিয়ন্ত্রণ, শব্দ নিরোধক দিয়ে আচ্ছাদনের প্রক্রিয়া (acoustic tiling), শূন্যস্থান দিয়ে যোগাযোগ, এবং কম্পিউটার জেনেরেটেড ইমেজারি বা কম্পিউটার গ্রাফিক্সের মাধ্যমে ছবি তৈরিকরণ।[৮] কণা পদার্থবিজ্ঞান, পারমাণবিক, আণবিক ও আলোকীয় পদার্থবিজ্ঞান, নিউক্লীয় পদার্থবিজ্ঞান এবং জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানের মতো বিষয়ের ক্ষেত্রে কণা-কণা বিক্ষেপণ তত্ত্ব খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কণা পদার্থবিজ্ঞানে কোয়ান্টাম মিথস্ক্রিয়া এবং মৌলিক কণার বিক্ষেপণকে বিক্ষেপণ ম্যাট্রিক্স বা S-ম্যাট্রিক্সের দ্বারা ব্যাখ্যা করা হয়। S-ম্যাট্রিক্সের প্রবর্তন এবং বিকাশ হয়েছে জন আর্চিবল্ড হুইলার এবং ভের্নার কার্ল হাইজেনবের্গ এর হাত ধরে।[৯]

বিভিন্ন ধারণার আলোকে বিক্ষেপণের পরিমাণ নির্ণয় করা যায়, যাদের মধ্যে রয়েছে: বিক্ষেপণ ক্রস সেকশন (σ), ক্ষয় সহগসমূহ, দ্বিমুখী বিক্ষেপণ বণ্টন ফাংশন (BSDF), S-ম্যাট্রিক্সসমূহ এবং গড় মুক্ত পথ।

একক এবং বহুমুখী বিক্ষেপণ

রাতের আকাশে ক্ষীণ ও পরিব্যাপ্ত দ্যুতির যে কক্ষপথীয় আলো (Zodiacl light) বা নকল ভোর দেখতে পাওয়া যায় তা আসলে সৌরজগতের ধ্রুব সমতল ব্যাপি ছড়িয়ে থাকা আন্তঃগ্রহীয় ধূলার দ্বারা সূর্যালোকের বিক্ষেপণ থেকে উদ্ভূত হয়।[১০]

যখন কোন বিকিরণ কেবল একটি স্থানীয় বিক্ষেপণ কেন্দ্র দ্বারা বিক্ষিপ্ত হয় তখন একে একক বিক্ষেপণ বলা হয়। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিক্ষেপণ কেন্দ্রগুলো একসাথে দলবদ্ধভাবে থাকে। এই ধরনের গুচ্ছ কেন্দ্রের সাথে সংঘর্ষের ফলে একটি বিকিরণের বহু বার বিক্ষেপণ ঘটে যাকে বহুমুখী বিক্ষেপণ (multiple scattering) বলা হয়।[১১] একক এবং বহুমুখী বিক্ষেপণ প্রতিক্রিয়ার মধ্যে প্রধান পার্থক্য হল এই যে, একক বিক্ষেপণকে সাধারণত একটি এলোমেলো বা লক্ষ্যহীন ঘটনা হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে, পক্ষান্তরে কিছুটা এর বিপরীতে, বহুমুখী বিক্ষেপণকে আরও সুনির্ধারিত একটি প্রক্রিয়া হিসেবে ধারণা করা যেতে পারে; কারণ বিক্ষেপণ সংশ্লিষ্ট বহুসংখ্যক ঘটনার সমন্বিত ফল নির্ভর করে এর গড় ফলাফলে যা পাওয়া যায় তার উপর। এভাবে ব্যাপন তত্ত্বের আলোকে বহুমুখী বিক্ষেপণের সচরাচর ভাল একটি ধারণা পাওয়া সম্ভব।[১২]

ঠিক কোন পথে বিকিরণ আসছে তার উপর একক বিক্ষেপণের কেন্দ্রের অবস্থান প্রবলভাবে নির্ভর করার ঝোঁক বিদ্যমান। কিন্তু একক বিক্ষেপণের কেন্দ্রের অবস্থান সাধারণত বিকিরণের পথের সাপেক্ষে ভালভাবে জানা যায় না। ফলস্বরূপ এটি পর্যবেক্ষকের নিকট এলোমেলো মনে হয়। পারমাণবিক নিউক্লিয়াসের মধ্য নিক্ষিপ্ত ইলেকট্রন এই ধরনের বিক্ষেপণের একটি উদাহরণ। এক্ষেত্রে ইলেকট্রনের সঞ্চার পথের সাপেক্ষে পরমাণুটির সঠিক অবস্থান জানা না থাকায় এবং তা অপরিমাপযোগ্য হওয়ায় সংঘর্ষের পরে ইলেকট্রনটির প্রকৃত সঞ্চার পথ কি হবে তা অনুমান করা সম্ভব নয়। একারণে একক বিক্ষেপণকে সম্ভাব্যতার বণ্টনের দ্বারা ব্যাখ্যা করা হয়।

বহুমুখী বিক্ষেপণের ক্ষেত্রে মিথস্ক্রিয়ার যদৃচ্ছতা বা এলোপাতাড়ি অবস্থা বহুসংখ্যক বিক্ষেপণের গড় ফলাফলের (আউটকাম) প্রতি এমন ঝোঁক প্রবণতা দেখায় যে, এতে করে বিকিরণের চূড়ান্ত সঞ্চার পথ তীব্রতার একটি সুনির্ধারিত বণ্টন বলে মনে হয়। ঘন কুয়াশার মধ্য দিয়ে অতিক্রান্ত একটি স্বল্প আলোর বীমের মাধ্যমে এই বিক্ষেপণের উদাহরণ দেওয়া হয়। বহুমুখী বিক্ষেপণ ব্যাপনের (diffusion) একেবারেই অনুরূপ এবং অনেক ক্ষেত্রেই বহুমুখী বিক্ষেপণব্যাপন শব্দ দুটি পরস্পর বিনিময়যোগ্য। বহুমুখী বিক্ষেপণ উৎপাদনের নিমিত্তে নকশাকৃত আলোকীয় যন্ত্রকে ডিফিউজার বলা হয় যেগুলো সচরাচর আলোকচিত্রশিল্পে মৃদু আলো তৈরির জন্য ব্যবহার করা হয়।[১৩] কোন অনিয়মিত (random) মাধ্যমের দ্বারা বিক্ষিপ্ত সুসঙ্গত পশ্চাৎবিক্ষেপণ হলো পশ্চাৎবিক্ষেপণের সমৃদ্ধ একটি রূপ যা সুসঙ্গত বিকিরণকে বিবর্ধন করার সময় ঘটে এবং এটি মূলত দুর্বল স্থানিক বিন্যাসের দরুন হয়ে থাকে।

তথাপি সকল একক বিক্ষেপণ কিন্তু অনিয়মিত (random) নয়। উদাহরণ স্বরূপ, একটি সুনির্ধারিত ফলাফলের উদ্দেশ্যে কোন সূক্ষ্ম (মাইক্রোস্কোপিক) কণার বিক্ষেপণ ঘটাতে একটি সুনিয়ন্ত্রিত লেজার রশ্মিকে নির্দিষ্ট দিকে তাক করা যেতে পারে। যেমন: এই ধরনের পরিস্থিতি রাডারের বিক্ষেপণেও দেখা যায়, যেখানে লক্ষ্যবস্তু হয়ে থাকে মানুষ কিংবা বিমানের মতো স্থুল (ম্যাক্রোস্কোপিক) কোন কিছু।

একইভাবে বহুমুখী বিক্ষেপণের ক্ষেত্রে বিশেষ করে সুসঙ্গত বিকিরণের বেলায় কখনো কখনো কিছুটা অনিয়মিত (random) ফলাফল পাওয়া যায়। সুসঙ্গত বিকিরণের বহুমুখী বিক্ষিপ্ত তীব্রতার এলোমেলো ওঠানামাকে স্পেকলবলা হয়। এছাড়া বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে কোন সুসঙ্গত তরঙ্গের একাধিক অংশের বিক্ষেপণ ঘটলেও স্পেকলের দেখা মেলে। নির্দিষ্ট কিছু বিরল পরিস্থিতিতে বহুমুখী বিক্ষেপণ কেবল অল্প সংখ্যক মিথস্ক্রিয়ার সাথে এমনভাবে জড়িত থাকতে পারে যেন মিথস্ক্রিয়ার যদৃচ্ছতা বা এলোপাতাড়ি অবস্থা পুরোপুরিভাবে গড় ফলাফল (আউটকাম) নয়। সঠিকভাবে কল্পনার (modeling) ক্ষেত্রে সবচেয়ে কঠিন যে সিস্টেমগুলো, আলোচিত সিস্টেমগুলো তাদেরই কয়েকটি বলে বিবেচনা করা হয়।

বিক্ষেপণের ব্যাখ্যা সেই সাথে একক ও বহুমুখী বিক্ষেপণের মধ্যকার স্বাতন্ত্র্য তরঙ্গ-কণা দ্বৈততার সাথে গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত।

বিক্ষেপণ তত্ত্ব

তরঙ্গ এবং কণার বিক্ষেপণ সংক্রান্ত পড়াশোনার ক্ষেত্রে এবং এটি বোঝার ক্ষেত্রে বিক্ষেপণ তত্ত্ব হলো একটি কাঠামো বিশেষ। তরঙ্গ বিক্ষেপণকে সোজাসাপ্টাভাবে সংঘর্ষের এবং কিছু বস্তুগত উপাদান সহযোগে কোন তরঙ্গের বিক্ষেপণের অনুরূপ বলা যায়, [স্পষ্টকরণ প্রয়োজন] উদাহরণস্বরূপ রংধনু গঠনের সময় বৃষ্টির ফোঁটা দ্বারা বিক্ষিপ্ত সূর্যালোক। (বিঃদ্রঃ রংধনু গঠনে মুখ্য ভূমিকা পালন করে প্রতিফলন, প্রতিসরণ এবং বিচ্ছুরণ)। এছাড়াও কোন টেবিলে থাকা বিলিয়ার্ড বলসমূহের পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া, স্বর্ণ নিউক্লিয়াসের দ্বারা আলফা কণার রাদারফোর্ড বিক্ষেপণ (অর্থাৎ কোণের পরিবর্তন), এক গুচ্ছ পরমাণুর দ্বারা ইলেকট্রন এবং রঞ্জন রশ্মির ব্র্যাগ বিক্ষেপণ (বা অপবর্তন) এবং পাতলা ধাতব পাত দিয়ে অতিক্রম করার সময় কোন ফিশন ফ্রাগমেন্টের অস্থিতিস্থাপক বিক্ষেপণও এই ভৌত প্রক্রিয়াটির অন্তর্ভুক্ত। ফিশন ফ্রাগমেন্ট হলো নিউক্লীয় বিভাজন বিক্রিয়ায় সৃষ্ট উৎপাদ বিশেষ। More precisely, scattering consists of the study of how solutions of partial differential equations, propagating freely "in the distant past", come together and interact with one another or with a boundary condition, and then propagate away "to the distant future". [বঙ্গানুবাদ প্রয়োজন]

তড়িচ্চুম্বকত্ব

একটি অবস্তুগত (virtual) ফোটনের নিঃসরণের মাধ্যমে দুটি ইলেক্ট্রনের মধ্যকার বিক্ষেপণের ফাইনম্যান চিত্র

প্রতিদিন আমরা যেসব তরঙ্গের সম্মুখীন তাদের মধ্যে তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গসমূহ সবচেয়ে পরিচিত যারা বিক্ষেপণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যায়।[১৪] আলো এবং বেতার তরঙ্গের (বিশেষকরে রাডারের বেলায়) বিক্ষেপণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পরস্পর থেকে পৃথক এমন বেশ কয়েকটি তড়িচ্চুম্বকীয় বিক্ষেপণ নামের দিক থেকে যথেষ্ট স্বতন্ত্র। (উপেক্ষণীয় পরিমাণ শক্তির স্থানান্তর সংশ্লিষ্ট) আলোর স্থিতিস্থাপক বিক্ষেপণের মধ্যে প্রধান যেগুলো রয়েছে তাদের মধ্যে আছে রেইলি বিক্ষেপণ এবং মি বিক্ষেপণ। অস্থিতিস্থাপক বিক্ষেপণের মধ্যে রয়েছে ব্রিলুইন বিক্ষেপণ, রমন বিক্ষেপণ, রঞ্জন রশ্মির অস্থিতিস্থাপক বিক্ষেপণ এবং কম্পটন বিক্ষেপণ।

দুটি প্রধান ভৌত প্রক্রিয়ার মধ্যে আলোর বিক্ষেপণ একটি, অপর প্রক্রিয়াটি হলো আলোর শোষণ। কোন বস্তুর যে দৃশ্যমানতা অর্থাৎ বস্তুর যে দর্শনযোগ্য উপস্থিতি অধিকাংশ বস্তুর ক্ষেত্রেই এই অবদান আলোর বিক্ষেপণের। কোন পৃষ্ঠতলকে আমরা সাদা বা অন্য কোন বর্ণের বলে যে অ্যাখ্যা দিই এদের এরূপ দৃশ্যমানতা আদতে বস্তুর অভ্যন্তরীণ বা পৃষ্ঠতলীয় অসামঞ্জস্যতার দ্বারা উদ্ভূত আলোর বহুমুখী বিক্ষেপণের উপর নির্ভরশীল। এধরনের অসামঞ্জস্যতার উদাহরণ হিসেবে পাথর গঠনকারী সূক্ষ্ম স্ফটিকসমূহের সীমানাতলের অথবা কাগজে থাকা সূক্ষ্ম তন্তুর কথা বলা যায়। আরো সাধারণভাবে বলা যায়, কোন পৃষ্ঠের দীপ্তি বা ঔজ্জ্বল্য নির্ধারক গ্লস বা লাস্টা বা শীন ধর্মগুলো বিক্ষেপণের উপর নির্ভর করে। যেসব পৃষ্ঠতলে উচ্চমাত্রায় বিক্ষেপণ ঘটে সেগুলোকে নিষ্প্রভ বা ম্যাট (matte) হিসাবে বর্ণনা করা হয়। অপরদিকে পৃষ্ঠতলে আলোর বিক্ষেপণের অনুপস্থিতি একে পালিশ করা ধাতু বা পাথরের মতো চকচকে চেহারা দেয়।

বেশিরভাগ বস্তুতে রঙের উদ্ভব নির্দিষ্ট একটি রঙের নির্বাচিত শোষণ তথা বর্ণালীর শোষণের ফলে হয়ে থাকে যেখানে স্থিতিস্থাপক বিক্ষেপণের মাধ্যমেও বেশ কিছু পরিবর্তন ঘটে। বর্ণায়নের ক্ষেত্রে বর্ণালীর শোষণ এবং বিক্ষেপণ উভয়েরই গুরুত্বপূর্ণ ও জটিল ভূমিকা রয়েছে এমন একটি সাধারণ উদাহরণ হিসেবে আমরা ত্বকের নিচে থাকা শিরার দৃশ্যমান নীল রঙের কথা বলতে পারি। অধিকন্তু বর্ণালীর শোষণ না ঘটলেও শুধু আলোর বিক্ষেপণের মাধ্যমেই প্রায় নীলাভ (ঈষৎ নীল) বর্ণের তৈরি হতে পারে; যেমন: আকাশের নীল রং (রেইলি বিক্ষেপণ), মানব চক্ষুর নীল আইরিশ এবং কিছু কিছু পাখির নীলচে পালক (রিচার্ড প্রাম এবং অন্যান্যদের গবেষণা, ১৯৯৮)। সে যাইহোক, ন্যানোকণিকাগুলোর ক্ষেত্রে অনুরণিত আলোর বিক্ষেপণ বহু ধরনের অত্যন্ত সম্পৃক্ত এবং প্রাণবন্ত রঙ তৈরি করতে পারে, বিশেষত যখন পৃষ্ঠতলীয় প্লাজমন অনুরণনের ব্যাপারটি এতে জড়িত থাকে (রোকি এবং অন্যান্য, ২০০৬)।[১৫][১৬]

আলোর বিক্ষেপণের মডেলগুলোকে মাত্রাহীন আকৃতি-প্যারামিটার α এর ভিত্তিতে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। আকৃতি-প্যারামিটার α কে নিম্নোক্তভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়:

এখানে πDp হলো কণার পরিধি এবং λ হলো কণাটি যে মাধ্যমে গতিশীল সেই মাধ্যমে তাৎক্ষণিক বিকিরণের তরঙ্গদৈর্ঘ্য। α এর মান ভিত্তিক আলোর তিন প্রকার বিকিরণ হলো:

α ≪ 1: রেইলি বিক্ষেপণ (কণাগুলো আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের তুলনায় ক্ষুদ্র);
α ≈ 1: মি বিক্ষেপণ (কণাগুলো প্রায় আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের সমান, শুধু গোলাকার অবস্থার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য) এবং
α ≫ 1: জ্যামিতিক বিক্ষেপণ (কণাগুলো আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের তুলনায় অনেক বৃহৎ)।

রেইলি বিক্ষেপণ এমনই একটি প্রক্রিয়া যেখানে কণা, বুদবুদ বা ফোঁটার মতো বিভিন্ন প্রতিসরাঙ্কের ক্ষুদ্র গোলীয় আয়তনের দ্বারা আলো সহ অন্যান্য তড়িচ্চুম্বকীয় বিকিরণের বিক্ষেপণ ঘটে। এমনকি ঘনত্বের পরিবর্তনও রেইলির বিক্ষেপণের কারণ হতে পারে। সর্ব প্রথম লর্ড রেইলি এই বিক্ষেপণের সফল একটি মডেল প্রদান করেন যার দরুন এর এরূপ নাম। রেইলির মডেল প্রয়োগ করতে হলে বিক্ষেপণ সৃষ্টিকারী কণার ব্যাসকে বিক্ষিপ্ত তরঙ্গের তরঙ্গদৈর্ঘ্যের (λ) তুলনায় অবশ্যই অনেক ক্ষুদ্র হতে হবে; এই ঊর্ধ্ব সীমা সাধারণত বিক্ষিপ্ত তরঙ্গদৈর্ঘ্যের প্রায় 1/10 ধরা হয়। এই আকারের কণার ক্ষেত্রে বিক্ষেপণ কেন্দ্রের সঠিক আকৃতি সাধারণত অতটা তাৎপর্যপূর্ণ নয় আর এক্ষেত্রে বিক্ষেপণ কেন্দ্রের আকৃতি যাই হোক না কেন একে সচরাচর সম আয়তনের গোলক হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। গ্যাসের অণুগুলো চারদিকে ছোটাছুটি করায় এর মধ্যে অতি ক্ষুদ্র পরিমাণে ঘনত্বের উঠানামা হয়। বিশুদ্ধ গ্যাসের মধ্য দিয়ে বিকিরণ গমনের সময় যে সহজাত বিক্ষেপণ হয় তা ঘনত্বের এই অতি ক্ষুদ্র পরিবর্তনের কারণে ঘটে। সাধারণত রেইলির মডেলে প্রয়োগের ক্ষেত্রে এমন বিক্ষেপণ যথেষ্টই ক্ষুদ্র। একটি পরিষ্কার দিনে পৃথিবীর আকাশ নীল দেখার মূল কারণ হলো এই রেইলি বিক্ষেপণ। কারণ রেইলির বিখ্যাত 1/λ4 সূত্র অনুসারে বায়ুস্তর অতিক্রম করে সূর্য থেকে যে আলো আসে তাতে বিদ্যমান অপেক্ষাকৃত বৃহৎ তরঙ্গদৈর্ঘ্যের লাল আলোর তুলনায় ক্ষুদ্র তরঙ্গদৈর্ঘ্যের নীল আলোর বিক্ষেপণ অনেক জোরালোভাবে ঘটে। বায়ুমণ্ডলে বিকিরণের শোষণের পাশাপাশি এই ধরনের বিক্ষিপণও বিকিরণের অপচয়ের একটি প্রধান কারণ।[১৭] বিক্ষেপণের মাত্রা কণার ব্যাস ও বিকিরণের তরঙ্গদৈর্ঘ্যের অনুপাতের ফাংশনরূপে পরিবর্তিত হয়। উপরন্তু এর মাত্রার পরিবর্তন নির্ভর করে সমবর্তন, কোণ এবং সুসঙ্গতাসহ অন্যান্য অনেক কার্যকারণের উপর।[১৮]

অপেক্ষাকৃত বৃহত্তর ব্যাসের গোলকার কণার দ্বারা তড়িচ্চুম্বকীয় বিক্ষেপণ সমস্যাটির প্রথম সমাধান দেন জার্মান পদার্থবিদ গুস্তাভ মি। একারণে রেইলি পাল্লার চেয়ে বৃহত্তর পাল্লার গোলীয় কণার দ্বারা সৃষ্ট বিক্ষেপণগুলো সচরাচর মি বিক্ষেপণ নামে পরিচিত। মি অঞ্চলের ক্ষেত্রে বিক্ষেপণ কেন্দ্রের আকৃতি অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে আর এক্ষেত্রে কণার আকৃতি কেবল গোলাকার হলেই বিক্ষেপণ তত্ত্ব ভালভাবে কাজ করে এবং তত্ত্বের কিছুটা পরিমার্জন করলে তা স্ফেরয়েড ও এলিপ্সয়েডগুলোর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হয়। অন্যান্য নির্দিষ্ট কিছু সরল আকৃতির কণার দ্বারা বিক্ষেপণের ক্ষেত্রে বদ্ধ-সমাধান থাকলেও ইচ্ছামত যেকোন আকৃতির কণার দ্বারা বিক্ষেপণের ক্ষেত্রে সাধারণ কোন বদ্ধ-সমাধানের কথা এখনও জানা যায়নি।

আলোর স্থিতিস্থাপক বিক্ষেপণে শক্তির এবং একইভাবে তরঙ্গদৈর্ঘ্য ও কম্পাঙ্কের খুবই সামান্য পরিমাণে পরিবর্তন হয়ে থাকে। মি এবং রেইলি বিক্ষেপণের প্রতিটিই স্থিতিস্থাপক বিক্ষেপণ প্রক্রিয়া হিসেবে গণ্য করা হয়। সে যাইহোক, গতিশীল বিক্ষেপণ কেন্দ্রের দ্বারা তড়িচ্চুম্বকীয় বিকিরণের বিক্ষেপণ ঘটলে এটি ডপলার ক্রিয়া বা সরণ প্রদর্শন করে যা শনাক্তযোগ্য এবং পরিমাপযোগ্য। একারণে লিডার ও রাডারের মতো প্রযুক্তিগুলোতে বিক্ষিপ্ত তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গের দ্বারা সৃষ্ট ডপলার ক্রিয়াকে বিক্ষেপণ কেন্দ্রের (অর্থাৎ গতিশীল বস্তুর) অবস্থান ও গতি পরিমাপে প্রয়োগ করা হয়। ডপলার সরণে শক্তির সামান্যই পরিবর্তন ঘটে।

কণার ব্যাস এবং তরঙ্গদৈর্ঘ্যের অনুপাতের মান প্রায় 10 এর বেশি হলে জ্যামিতিক আলোকবিজ্ঞানের সূত্রগুলো কণার ও আলোর মধ্যকার মিথস্ক্রিয়ার ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে অনেকটাই যথাযথভাবে কাজ করে। তথাপি এইসব বড় বড় গোলাকার কণার ক্ষেত্রেও মি তত্ত্ব ব্যবহার করা যেতে পারে, তাতে কিন্তু সমাধানটি সাংখ্যিকভাবে প্রায়ই জবড়জং বা অযৌক্তিক হয়ে ওঠে।

বৃহৎ এবং অনিয়মিত আকৃতির কণার মতো বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে অর্থাৎ রেইলি এবং মির বিক্ষেপণ মডেল কাজ করে না এমন ঘটনাগুলোর বেলায় বিক্ষেপণের মডেলিংয়ের জন্য ব্যবহারযোগ্য অনেক সাংখ্যিক পদ্ধতি রয়েছে। এগুলোর মধ্যে সসীম উপাদান বিধিসমূহ সর্বাধিক প্রচলিত যেখানে বিক্ষিপ্ত তড়িচ্চুম্বকীয় ক্ষেত্রের বণ্টন বের করার জন্য ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণগুলোর সমাধান করা হয়। অত্যাধুনিক এবং জটিল (Sophisticated) কিছু সফটওয়্যার প্যাকেজ রয়েছে যেগুলো কাঠামোটির দ্বিমাত্রিক এবং কখনো কখনো ত্রিমাত্রিক মডেল তৈরির মাধ্যমে শূন্যস্থানে বিক্ষেপণের ক্ষেত্রে প্রতিসরাঙ্ক বা প্রতিসরাঙ্কগুলোকে বিশেষায়িত করার সুযোগ দেয়। অপেক্ষাকৃত বড় এবং জটিল কাঠামোর বেলায় কম্পিউটারে সম্পাদনের ক্ষেত্রে এই মডেলগুলোর সাধারণত যথেষ্ট পরিমাণ সময় প্রয়োজন হয়।

আধান বা আহিত কণার সঞ্চালকে সাধারণভাবে ইলেকট্রোফোরেসিস বলা যায় যেখানে একটি তড়িৎ ক্ষেত্রের প্রভাবে বৃহদাণুগুলোর স্থানান্তর ঘটে। ইলেক্ট্রোফোরেটিক আলোক বিক্ষেপণ কণার স্থানান্তর ঘটায় এমন একটি তরলের মধ্য দিয়ে বৈদ্যুতিক ক্ষেত্রের অতিক্রমণের সাথে সম্পর্কযুক্ত। কণারগুলোর চার্জ যত বাড়তে থাকে এরা তত দ্রুত স্থানান্তরের সক্ষম হয়ে ওঠে।

তথ্যসূত্র

বহিঃসংযোগ

🔥 Top keywords: রাম নবমীমুজিবনগর দিবসপ্রধান পাতামুজিবনগর সরকারবিশেষ:অনুসন্ধানইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগএক্স এক্স এক্স এক্স (অ্যালবাম)বাংলাদেশবাংলা ভাষামিয়া খলিফারাজকুমার (২০২৪-এর চলচ্চিত্র)আনন্দবাজার পত্রিকাআবহাওয়ারামপহেলা বৈশাখউয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগইসরায়েলইরানরবীন্দ্রনাথ ঠাকুরমুজিবনগরইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউনরিয়াল মাদ্রিদ ফুটবল ক্লাব২০২৪ ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগক্লিওপেট্রাচর্যাপদভূমি পরিমাপশেখ মুজিবুর রহমানজনি সিন্সকাজী নজরুল ইসলামঈদুল আযহাফিলিস্তিনইউটিউবভারতবিকাশআসসালামু আলাইকুমসৌদি আরববাংলা প্রবাদ-প্রবচনের তালিকামুহাম্মাদ