পতাকা এক খণ্ড বস্ত্র বিশেষ যা কোন গোষ্ঠী, দল, জাতি, দেশ বা সংগঠনের, এমনকী বিশেষ অনুষ্ঠানের প্রতীক তথা পরিচায়ক হিসাবে ব্যবহৃত হয়। সচরাচর চারকোনা একটুকরো সাদা বা রঙিন কাপড় পতাকা হিসাবে ব্যবহৃত হয়। ব্যবহারকালে পতাকার এক প্রান্ত একটি দণ্ডে বাঁধা হয়। পতাকার বস্ত্রখণ্ডে বিশেষ কোনও রঙ, নকশা, প্রতিকৃতি এবং চিহ্নের দ্বারা কোনও আদর্শ কিংবা বার্তা উৎকীর্ণ থাকতে পারে। আধুনিক বিশ্বের প্রায় প্রতিটি রাষ্ট্রের একটি করে স্বতন্ত্র পতাকা আছে যা জাতীয় পতাকা হিসাবে বিবেচিত। অনেক পতাকার নকশা একইরকম হলে তাদের একত্রে পতাকা পরিবার বলে।[১] পতাকা বিষয়ক বিদ্যাকে নিশানতত্ত্ব বা ভেক্সিলোলজি বলে। "ভেক্সিলোলজি" কথাটি লাতিনvexillum (ধ্রুপদী উচ্চারণ: ৱেক্সিলুম্) থেকে আগত এবং এর অর্থ "পতাকা" বা "ব্যানার"।
ব্যুৎপত্তি
বাংলা "পতাকা" একটি সংস্কৃতজাত শব্দ। সংস্কৃত √পত্ ধাতু থেকে এর উৎপত্তি, যার অর্থ "গমন করা"। যথা: √পত্ + অক + আ = পতাকা। এটি স্ত্রী-বাচক শব্দ।[২] ধ্বন্যাত্মক সম্পর্কও রয়েছে; কারণ পতাকা বাতাসে উড়লে 'পত্ পত্' শব্দ হয়।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]
ইতিহাস
পতাকার উৎপত্তি অজানা[৩] এবং কখন প্রথম পতাকা উত্তোলন করা হয়েছিল তার সময়কালও অজানা।[৪] আনু. খ্রিস্টপূর্ব ৩৫০০-এর প্রাক-রাজবংশীয় মিশরীয় মৃৎশিল্পে পতাকা-জাতীয় ভেক্সিলয়েড-সহ জাহাজের উপস্থাপনা লক্ষ করা যায়।[৪] প্রাচীন ইতিহাসে যুদ্ধক্ষেত্রে ভেক্সিলয়েড ব্যবহার করা হতো, যার উৎপত্তিস্থল মিশর বা আসিরিয়া।[৫]
পতাকার উৎপত্তি রহস্যজনক হলেও ইরানের শাহদাদে ব্রোঞ্জনির্মিত প্রাচীনতম পতাকা পাওয়া গিয়েছিল, যার সময়কাল আনু. খ্রিস্টপূর্ব ২৪০০। এই পতাকায় বসে থাকা একজন পুরুষ এবং তার মুখোমুখি নতজানু হয়ে থাকা একজন নারী ছিল। এই দুজনের মাঝখানে একটি তারা ছিল। এইধরনের নকশা অন্যান্য ইরানি ব্রোঞ্জযুগীয় শিল্পকর্মে পাওয়া যায়।[৬][৭][৮][৯]
খ্রিস্টপূর্ব ৫৫০ থেকে ৩৩০ অব্দে পারস্যে এক ধরনের পতাকার প্রচলন ছিল। যুদ্ধক্ষেত্রে সেনাদল সমন্বয়ের কাজে প্রথম পতাকা ব্যবহার হয়েছিল। মধ্যযুগে পতাকার ব্যাপক প্রচলন শুরু হয়। শুধু রাষ্ট্রীয় প্রতীক হিসেবেই নয়, বিভিন্ন কাজের সমন্বয়ের জন্য নানা আয়তন, রঙ ও নকশায় এটা তৈরি করা হতো। ১৩ শতকে ডেনমার্কে রাষ্ট্রীয় পতাকার প্রচলন ঘটে। এটাকেই সবচেয়ে পুরনো রাষ্ট্রীয় পতাকা হিসেবে ধরা হয়। ১৬৩০ খ্রিস্টাব্দের পর এ ধরনের পতাকা তৈরিতে লাল, নীল ও সাদা রঙয়ের ব্যবহারই বেশি দেখা যায়। ১৭৭৭ খ্রিস্টাব্দের ১৪ জুন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় পতাকা আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি লাভ করে। ১৭৯৪ খ্রিস্টাব্দের ফ্রান্সে জাতীয় পতাকার উদ্ভব ঘটে। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ২ মার্চ বাংলাদেশের পতাকা প্রথম উত্তোলন করা হয়। ভারতে এই পতাকাটিকে সাধারণত "তেরঙা" বা "ত্রিবর্ণরঞ্জিত পতাকা" বলা হয়। পিঙ্গালি ভেঙ্কাইয়া কৃত ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের "স্বরাজ" পতাকার ভিত্তিতে এই পতাকাটির নকশা প্রস্তুত করা হয়েছিল।
জাতীয় পতাকা
বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা।
ভারতের জাতীয় পতাকা।
ইউনিয়ন জ্যাক, যুক্তরাজ্যের জাতীয় পতাকা।
স্টার অ্যান্ড স্ট্রাইপস, যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় পতাকা।
কোনো দেশ, জাতি বা রাষ্ট্রের প্রতীক হিসাবে পতাকার ব্যবহার অত্যন্ত জনপ্রিয়। কিছু জাতীয় পতাকা অন্যান্য দেশ বা রাষ্ট্রের নিজস্ব পতাকা নির্মাণে প্রভাব ফেলে। নিচে কিছু গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ দেওয়া হয়েছে:
বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা বাঙালি জাতি বা রাষ্ট্রের জাতীয় পরিচয়ের প্রতীক। গাঢ় সবুজ বর্ণের আয়তক্ষেত্রের মাঝখানে একটা ভরাট রক্তিম বৃত্ত নিয়ে এটা তৈরি। এর দৈর্ঘ্য ও প্রস্থের অনুপাত ১০:৬। পতাকার মাঝখানের লাল বৃত্তটির ব্যাসার্ধ হবে পতাকার দৈর্ঘ্যের ৫ ভাগের একভাগ।
ভারতের জাতীয় পতাকা কেন্দ্রে চব্বিশটি দণ্ডযুক্ত নীল "অশোকচক্র" সহ গেরুয়া, সাদা ও সবুজ আনুভূমিক আয়তাকার ত্রিবর্ণরঞ্জিত পতাকা। ১৯৪৭ সালের ২২ জুলাই গণপরিষদের একটি অধিবেশনে ভারতের পতাকার এই বর্তমান রূপটি ভারত অধিরাজ্যের সরকারি পতাকা হিসেবে গৃহীত হয়। পরবর্তীকালে এটি ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের জাতীয় পতাকার মর্যাদা লাভ করে। ভারতে এই পতাকাটিকে সাধারণত "তেরঙা" বা "ত্রিবর্ণরঞ্জিত পতাকা" বলা হয়। পিঙ্গালি ভেঙ্কাইয়া কৃত ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের "স্বরাজ" পতাকার ভিত্তিতে এই পতাকাটির নকশা প্রস্তুত করা হয়েছিল।
যুক্তরাজ্যেরইউনিয়ন জ্যাক সবচেয়ে জনপ্রিয় জাতীয় পতাকার মধ্যে অন্যতম। এই পতাকার উপর ভিত্তি করে যুক্তরাজ্যের উপনিবেশগুলোর পতাকা তৈরি করা হয়েছিল, এবং একাধিক প্রাক্তন উপনিবেশ তাদের সাংস্কৃতিক ইতিহাসের প্রতীক হিসাবে নিজেদের জাতীয় পতাকায় ইউনিয়ন জ্যাক রেখে দিয়েছে, যেমন অস্ট্রেলিয়া, টুভালু ও নিউজিল্যান্ড রাষ্ট্র, কানাডার অন্টারিও, ব্রিটিশ কলম্বিয়া ও মানিটোবা প্রদেশ এবং যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই রাজ্য। উইকিমিডিয়া কমন্সে দেখুন: ব্রিটিশ পতাকার উপর ভিত্তি করে নির্মিত পতাকা।
আন্তর্জাতিক পতাকার মধ্যে জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, অলিম্পিক, প্যারালিম্পিক ইত্যাদির পতাকা উল্লেখযোগ্য।
সাদা পতাকা
সাদা পতাকা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত আত্মরক্ষামূলক প্রতীকিচিহ্ন যা সাময়িক যুদ্ধবিরতী কিংবা স্থায়ী যুদ্ধবিরতীর জন্যে প্রদর্শন করা হয়। বিবাদমান উভয় পক্ষের মধ্যেকার আলাপ-আলোচনার জন্যে প্রাথমিক অনুরোধ বার্তা হিসেবেও এর ব্যবহার রয়েছে। এছাড়াও এটি আত্মসমর্পণের প্রতীকিরূপ যা কোন দেশের দূর্বল সামরিক বাহিনীর পক্ষ থেকে আলোচনার জন্যে অনুরোধ বার্তা প্রেরণের মাধ্যম। ইতিহাসগত কিংবা স্থানীয়ভাবে সাদা রঙযুক্ত পতাকা বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছে। তবে, এর বহুল ব্যবহার ঘটে থাকে মূলতঃ যুদ্ধকালীন সময়ে। রোমান সাম্রাজ্যে ইতিহাসবেত্তা কর্নেলিয়াস টেসিতাস উল্লেখ করেছেন যে, ১০৯ খ্রিস্টাব্দে আত্মসমর্পণের জন্যে সাদা রঙের পতাকা ব্যবহার করা হয়েছিল। ঐ সময়ের পূর্বে রোমের সেনাবাহিনী তাদের আত্মসমর্পণের জন্যে মাথার উপর বর্ম্ম রাখতো।[১২]
কালো পতাকা
কালো কাপড় কেটে কালো পতাকা তৈরী করা হয়। সাধারণভাবে কালো পতাকা শোকের প্রতীক। জাহাজে মৃত দেহ থাকলে কালো পতাকা উড়িয়ে দেয়া হয়। আবার জলদস্যুরাও তাদের নৌযানে কালো পতাকা ব্যবহার করতো।
আকার ও নকশা
পতাকাগুলো সাধারণত আয়তাকার (২:৩, ১:২ কিংবা ৩:৫ অনুপাতে) হয়, যদিও উড্ডয়নের পক্ষে উপযুক্ত এমন যেকোনো আকার-আকৃতির পতাকা রয়েছে, যেমন বর্গাকার, ত্রিভুজাকার ইত্যাদি। নেপালের জাতীয় পতাকা আয়তাকার নয় এমন একটি জাতীয় পতাকার উদাহরণ, যা আকৃতিতে পরপর বসানো দুটি সমকোণী ত্রিভূজ।
পতাকার অংশ
পতাকার সাধারণ অংশ হচ্ছে: ক্যান্টন (পতাকার উত্তর-পশ্চিমের অংশ), ফিল্ড বা গ্রাউন্ড (ক্যান্টন ব্যতীত পতাকার বাকি অংশ), হয়েস্ট (যে অংশের মাধ্যমে পতাকাকে খুঁটির সঙ্গে যোগ করা হয়) ও ফ্লাই (হয়েস্ট থেকে সবচেয়ে দূরবর্তী অংশ)।[১৩]