অতিবৃষ্টি অরণ্য
অতিবৃষ্টি অরণ্য বা ঘনবর্ষণ বনাঞ্চল হচ্ছে পৃথিবীর সেইসব বনাঞ্চল যেখানে সারা বছর প্রচণ্ড বৃষ্টিপাত হয়। এই বৃষ্টিপাতের বাৎসরিক পরিমাণ কমপক্ষে ১৭৫০ মিলিমিটার হতে ২০০০ মিলিমিটার পর্যন্ত হতে পারে। সারা বছর প্রচণ্ড বৃষ্টিপাত হয় বলে গাছের পাতা সবসময় সবুজ থাকে।ভূপৃষ্ঠের মূলত নিরক্ষীয় হতে ক্রান্তীয় অঞ্চলেই এই অরণ্যগুলি দেখা যায়। অতিবৃষ্টি অরণ্যের মধ্যে বৃহত্তমটি হচ্ছে দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের ক্রান্তীয় অঞ্চলের আমাজন নদীর অববাহিকাতে অবস্থিত আমাজন অরণ্য। নিকারাগুয়া ও বেলিজসহ মধ্য আমেরিকায় এই আমাজন অতিবৃষ্টি অরণ্য বিস্তৃত। এছাড়াও ক্যামেরুন হতে কঙ্গো প্রজাতন্ত্র পর্যন্ত বিস্তৃত নিরক্ষীয় আফ্রিকায়, মায়ানমার হতে ইন্দোনেশিয়া ও পাপুয়া নিউ গিনি পর্যন্ত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, অস্ট্রেলিয়ার পূর্ব কুইন্সল্যান্ড এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কিছু অংশে এই অরণ্য দেখা যায়।
ক্রান্তীয় অতিবৃষ্টি অরণ্য
সাধারণত নিরক্ষরেখা থেকে ১০ ডিগ্রী উত্তর দিকে বা দক্ষিণ দিকে যে অতিবৃষ্টি অরণ্যগুলির দেখা মেলে, সেগুলিকে ক্রান্তীয় অতিবৃষ্টি অরণ্য বলে। এগুলিতে জলবায়ু উষ্ণ ও আর্দ্র এবং কোন বিশেষ শুষ্ক মৌসুম থাকে না। এগুলিতে গড় মাসিক তাপমাত্রা বছরের প্রায় সকল মাসেই ১৮ °সে (৬৪ °ফা) অতিক্রম করে।[১] গড় বার্ষিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ১৬৮ সেমি (৬৬ ইঞ্চি)-এর নিচে হয় না এবং বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ১,০০০ সেমি (৩৯০ ইঞ্চি)ও অতিক্রম করতে পারে। তবে সাধারণত বার্ষিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ হয়ে থাকে ১৭৫ সেমি (৬৯ ইঞ্চি) থেকে ২০০ সেমি (৭৯ ইঞ্চি) পর্যন্ত।[২]
বিশ্বের অনেকগুলো ক্রান্তীয় অরণ্য সরাসরি মৌসুমি নিম্নচাপ অঞ্চলের (monsoon trough) সাথে সম্পর্কিত, যা আন্তঃক্রান্তীয় অভিসৃতি অঞ্চল (ইন্টারট্রপিকাল কনভারজেন্স জোন) নামেও পরিচিত।[৩] নিরক্ষীয় অঞ্চলে মূলত কর্কটক্রান্তি রেখা ও মকরক্রান্তি রেখার মাঝামাঝি পূর্ণাঙ্গ বৈশিষ্ট্যবিশিষ্ট ক্রান্তীয় আর্দ্র অরণ্য লক্ষ্য করা যায় । দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ক্রান্তীয় অতিবৃষ্টি অরণ্যগুলি অবস্থিত (মায়ানমার (বার্মা) থেকে ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, পাপুয়া নিউগিনি, শ্রীলঙ্কা, সাহারা-নিম্ন আফ্রিকা এবং ক্যামেরুন থেকে কঙ্গোর (কঙ্গো অতিবৃষ্টি অরণ্য), দক্ষিণ আমেরিকায় (যেমন: আমাজন অরণ্য), মধ্য আমেরিকায় (যেমন: বোসাস, দক্ষিণ ইউকাটান পেনিনসুলা (Yucatán Peninsula)-এল পেটেন-বেলিজ-ক্যালাকমুল), অস্ট্রেলিয়া, এবং আরো রয়েছে প্যাসিফিক দ্বীপপুঞ্জে (যেমন হাওয়াই)। ক্রান্তীয় অরণ্যগুলিকে "পৃথিবীর ফুসফুস" নামেও ডাকা হয়; তবে সম্প্রতি জানা গেছে যে, অতিবৃষ্টি অরণ্যগুলি সালোকসংশ্লেষ প্রক্রিয়ায় পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে মোট অক্সিজেন সংযোজনে যথেষ্ট পরিমাণ প্রভাব রাখে না।[৪][৫]
অতিবৃষ্টি অরণ্যের বৈশিষ্ট্যসমূহ
ক্রান্তীয় অঞ্চলের অতিবৃষ্টি অরণ্য সাধারণত ক্রান্তীয় আর্দ্র অরণ্যের পর্যায়ে পড়ে, যার অনেক রকম বিভাজন আছে। বন গবেষকগণ অতিবৃষ্টি অরণ্যকে অন্যান্য অরণ্য থেকে আলাদা করেন কিছু বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে, যেমন: তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত, শুকনো মৌসুমের ব্যাপ্তি, এবং উচ্চতা।[৬]
তাপমাত্রা
অতিবৃষ্টি অরণ্য সাধারণত উষ্ণ এবং আর্দ্র- বার্ষিক গড় তাপমাত্রা হলো ২৫° সেলসিয়াস (৭৭° ফারেনহাইট)। বিষুবরেখার কাছাকাছি তাপমাত্রায় কিছুটা পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়, তবে বর্ষাবনে তাপমাত্রা বছরের প্রায় সব সময়ই প্রায় একই রকম থাকে- গড় সর্বনিম্ন মাসিক তাপমাত্রা হলো আরামদায়ক ১৮° সেলসিয়াস (৬৪° ফারেনহাইট)। যেখানকার তাপমাত্রা ০° সেলসিয়াসের (৩২° ফারেনহাইট) কাছাকাছি চলে আসে সেখানে সাধারণত অতিবৃষ্টি অরণ্য গড়ে উঠে না কারণ বর্ষাবনের উদ্ভিদ ও জীবপ্রজাতি এতো কম তাপমাত্রা সহ্য করতে পারে না। অতিবৃষ্টি অরণ্যের তাপমাত্রা বিষুবরেখা থেকে এর দূরত্বের ভিত্তিতে শুধু নির্ধারিত হয় না, বরং উচ্চতার উপরও নির্ভর করে। যত উচ্চতা বেশি হয়, রাতের তাপমাত্রা আনুপাতিক হারে তত কমতে থাকে। দৈনিক তাপমাত্রার এরকম উঠা-নামা অরণ্যের প্রাকৃতিক পরিবেশকে প্রভাবিত করে। আর তাই সাধারণত সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৩,২৮০ ফুট (১,০০০ মিটার) উচ্চতার ঊর্ধ্বে অতিবৃষ্টি অরণ্য দেখা যায় না।[৬]
বৃষ্টিপাত
মূলত বৃষ্টিপাতের সাথেই অতিবৃষ্টি অরণ্যের সম্পর্ক। অতিবৃষ্টি অরণ্যে বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত ১৮০০ মিলিমিটার (৬ ফুট) থেকে ৯০০০ মিলিমিটার (৩০ ফুট) পর্যন্ত হয়ে থাকে। প্রতি মাসে সাধারণত ১০০ মিলিলিটারেরও (৪ ইঞ্চি) বেশি বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে। বলতে গেলে কোন অতিবৃষ্টি অরণ্যে শুকনো মৌসুম থাকেই না। যদি কখনও শুকনো সময় দেখা যায়, তবে সেটা সাধারণত হয় সংক্ষিপ্ত এবং আগে থেকে জানা যায় না।[৬]
বিভিন্ন জলবায়ুতে বৃষ্টিপাতের জন্য জলীয়বাষ্প দূর থেকে এলেও অতিবৃষ্টি অরণ্যে যে বৃষ্টিপাত হয়, তার জলীয়বাষ্পের ৫০ শতাংশই হয় ঐ অতিবৃষ্টি অরণ্যের জলীয়বাষ্প। অতিবৃষ্টি অরণ্যকে ঘিরে থাকা গরম, ভ্যাপসা, আর্দ্রতাপূর্ণ যে বাতাস বিরাজ করে, তা জলীয়বাষ্পের খুব অল্প অংশই বেরিয়ে যেতে দেয়। অতিবৃষ্টি অরণ্যে যতটুকু বৃষ্টিপাত হয় তার অধিকাংশই গাছগুলো তার শাখা প্রশাখায় শুষে নেয়। কিছু পরিমাণ পাতার ফাঁক গলে নিচে পড়ে, যদিও অধিকাংশই নিচে পড়ার আগেই বাষ্প হয়ে যায় এবং আর্দ্র বাতাসে ভেসে থাকে। মৃদু, সদা চলাচলরত বাতাস তখন বাতাসের এই জলীয় অংশকে ঊর্ধ্বাকাশে তুলে নেয় এবং সেখানে ঠান্ডা বাতাসের সংস্পর্শে এসে মেঘে পরিণত হয়। যখন পর্যাপ্ত পরিমাণে ঠান্ডা জলীয় বাষ্প তৈরি হয়, তখন তা বৃষ্টির আকারে ঝরে পড়ে, আবারো বৃষ্টির চক্রকে চালু রাখে।[৬]
মৃত্তিকার রূপ
অধিকাংশ অতিবৃষ্টি অরণ্যেই শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বিপুল বৃষ্টিপাত আর প্রচন্ড গরমের কারণে মাটির পুষ্টি গুণাগুণ হারিয়ে যায়। পুষ্টি চাহিদার এই করুণ অবস্থার কারণে অধিকাংশ ক্রান্তীয় বৃক্ষ যতটুকু পুষ্টি পাওয়া যায়, তা তাদের জীবন্ত কোষে জমা করে রাখে। যখন এসব ক্রান্তীয় গাছগুলো মারা যায় তখন তাদের জমা করে রাখা পুষ্টি গুণাগুণ পচনের মাধ্যমে মাটিতে আবার ফিরে আসে। কিন্তু মাটিতে জমা থাকার চেয়ে অন্যান্য জীব বা উদ্ভিদ সাথে সাথেই সেসকল পুষ্টি গুণাগুণ শুষে নেয়।[৬]
অতিবৃষ্টি অরণ্যের গঠন
অতিবৃষ্টি অরণ্যের গঠন অন্যান্য সকল বনের চেয়ে আলাদা হয়ে থাকে এর বিভিন্ন স্তরভিত্তিক উদ্ভিদরাজির সমাবেশের কারণে, যাকে বলা হয় স্ট্রাটা (strata), একবচনে স্ট্র্যাটাম (stratum)।[৬]
উদ্ভিদ ও জীববৈচিত্র্য
অতিবৃষ্টি অরণ্যের উদ্ভিদ এবং জীবজন্তুর যে পরিমাণ, আদতে তা যেকোনো বাসস্থানের চেয়ে সমৃদ্ধ। যদিও বিগত কয়েক লক্ষ কোটি বছরের জলবায়ুগত পরিবর্তনে তাদের পরিমাণ কখনও বেড়েছে কখনও কমেছে, তবুও বর্ষাবন হলো পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন একটি বাস্তুসংস্থান। এই ধারাবাহিকতার কারণেই অতিবৃষ্টি অরণ্যে বেড়ে উঠেছে লক্ষ কোটি প্রজাতি, যার অনেকগুলো এনডেমিক (endemic), বা একমাত্র।[৬]
তথ্যসূত্র
বহিঃসংযোগ
- Animals in a rainforest
- Rainforest Action Network
- The Sabah Biodiversity Experiment on rainforest restoration ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২০ জানুয়ারি ২০১৯ তারিখে
- Rainforest Portal
- The Coalition for Rainforest Nations
- The Prince's Rainforests Project
- United Nations Forum on Forests
- Dave Kimble's Rainforest Photo Catalog (Wet Tropics, Australia)
- Rainforest Plants[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]