নিকারাগুয়া

মধ্য আমেরিকার একটি দেশ

নিকারাগুয়া (স্পেনীয় ভাষায় Nicaragua নিকারাউয়া) মধ্য আমেরিকার একটি প্রজাতন্ত্র। এর সরকারি নাম নিকারাগুয়া প্রজাতন্ত্র (República de Nicaragua রেপুব্লিকা দে নিকারাউয়া). যদিও নিকারাগুয়া মধ্য আমেরিকার বৃহত্তম রাষ্ট্র, এর জনসঙ্খ্যা কম। এর উত্তরদিকে রয়েছে হন্ডুরাস, দক্ষিণদিকে কোস্তা রিকা। নিকারাগুয়ার পশ্চিমদিকে রয়েছে প্রশান্ত মহাসাগর, পূর্বদিকে ক্যারিবীয় সাগর। হন্ডুরাসের সাথে এ'দেশের সীমান্ত দৈর্ঘ্য ৯২২ কিমি ও কোস্তা রিকার সাথে ৩০৯ কিমি। অর্থাৎ প্রতিবেশী দুই দেশের সাথে দেশটির মোট সীমান্ত দৈর্ঘ্য ১২৩১ কিমি। দু'টি বৃহৎ মিষ্ট জলের হ্রদ - মানাগুয়া হ্রদনিকারাগুয়া হ্রদ, অনেকগুলি সুপ্ত ও জীবন্ত আগ্নেয়গিরি ও বিস্তীর্ণ রেনফরেস্ট এই দেশের সবচেয়ে বড় ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য। দেশের জীববৈচিত্রের প্রাচুর্য এ' দেশকে মেসোআমেরিকার এক অন্যতম জৈবসম্পদে পূর্ণ দেশে পরিণত করেছে।

Republic of Nicaragua

República de Nicaragua
Nicaragua জাতীয় পতাকা
পতাকা
Nicaragua জাতীয় মর্যাদাবাহী নকশা
জাতীয় মর্যাদাবাহী নকশা
জাতীয় সঙ্গীত: Salve a ti, Nicaragua
Nicaragua অবস্থান
রাজধানী
ও বৃহত্তম নগরী বা বসতি
মানাগুয়া
সরকারি ভাষাস্পেনীয়1
জাতীয়তাসূচক বিশেষণনিকারাগুয়ান
সরকারপ্রজাতন্ত্র
• রাষ্ট্রপতি
দানিয়েল ওর্তেগা (FSLN)
• উপ-রাষ্ট্রপতি
হাইমে মোরালেস কারাথো
স্বাধীন 
স্পেনের হাত থেকে
• ঘোষিত
১৫ সেপ্টেম্বর, ১৮২১
• স্বীকৃত
২৫ জুলাই, ১৮৫০
আয়তন
• মোট
১২৯.৪৯৪ কিমি (৪৯.৯৯৮ মা) (৯৭তম)
• পানি (%)
7.14
জনসংখ্যা
• জুলাই ২০০৬ আনুমানিক
৫,৬০৩,০০০ (১০৭তম)
• ২০০৫ আদমশুমারি
৫,১৪২,০৯৮
• ঘনত্ব
৪২/কিমি (১০৮.৮/বর্গমাইল) (১৩২তম)
জিডিপি (পিপিপি)২০০৬ আনুমানিক
• মোট
$২০,১৮৯ বিলিয়ন (১০৩তম)
• মাথাপিছু
$৩,১০০ (১২৮তম)
জিনি (২০০৫)40.5 [১]
ত্রুটি: জিনি সহগের মান অকার্যকর
মানব উন্নয়ন সূচক (২০০৬)বৃদ্ধি ০.৬৯৮
ত্রুটি: মানব উন্নয়ন সূচক-এর মান অকার্যকর · ১১২তম
মুদ্রাকর্ডোবা (NIO)
সময় অঞ্চলইউটিসি-6
কলিং কোড৫০৫
ইন্টারনেট টিএলডি.ni
  1. ইংরেজি এবং আরও কিছু স্থানীয় ভাষা ক্যারিবীয় উপকূল অঞ্চলে ব্যবহৃত হয়।

নিকারাগুয়া নামের উদ্ভব

নিকারাগুয়া নামের উদ্ভব নিয়ে একাধিক কাহিনী প্রচলিত আছে। তার মধ্যে তিনটি সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য। অনেকের মতে এই নামটি এসেছে স্থানীয় এক উপজাতিপ্রধানের নাম থেকে।[২] জনশ্রুতি অনুযায়ী স্পেনীয় কঙ্কুইস্তাদোর গিল গঞ্জালেস দাভিলা এই অঞ্চলে আজকের সান হোর্খে বা রিভাসে এসে উপজাতিপ্রধান নিকারাও Nicarao'এর দেখা পান। দিনটি ছিল ১৫ অক্টোবর, ১৫২৩। তার নাম থেকেই দেশটির নাম হয় নিকারাগুয়া। অন্যদের মতে নিকান শব্দের অর্থ স্থানীয় নাহুতল Nahuatl ভাষায় 'এখানে', আরাহুয়াক মানে 'মানুষ'। এই দুটি শব্দ থেকেই এসেছে নিকারাগুয়া শব্দটি। [৩] আরেকটি মত হল, এই অঞ্চলে স্পেনীয়দের আগমনকালে যে আমেরিন্ডিয়ান উপজাতি বাস করতো তাদেরই নাম ছিল নিকারাও। গিল গঞ্জালেস দাভিলা এই নিকারাও শব্দের সাথে স্পেনীয় শব্দ আকুয়া অর্থাৎ জল যুক্ত করে নিকারাগুয়া শব্দটি তৈরি করেন। এই অঞ্চলে দুটি বৃহৎ অন্তর্দেশীয় হ্রদ মানাগুয়া হ্রদনিকারাগুয়া হ্রদের অবস্থানই হয়তো তার এমন নামকরণের কারণ। [৪]

ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য

নিকারাগুয়া মধ্য আমেরিকা যোজকে অবস্থিত সবচেয়ে বড় দেশ। উত্তর গোলার্ধে অবস্থিত এই দেশটির অবস্থান ১১ ডিগ্রি উত্তর থেকে ১৪ ডিগ্রি উত্তর অক্ষরেখা ও ৭৯ ডিগ্রি পশ্চিম থেকে ৮৮ ডিগ্রি পশ্চিম দ্রাঘিমারেখার মধ্যে। অর্থাৎ দেশটি ক্রান্তীয় অঞ্চলের মধ্যে পড়ে। দেশটির আয়তন ১,২৯,৪৯৪ বর্গ কিলোমিটার বা ৫০,১৯৩ বর্গমাইল। অর্থাৎ আয়তনের বিচারে নিকারাগুয়া পৃথিবীর ৯৭তম দেশ। এর উত্তরে হন্ডুরাস, পশ্চিমে প্রশান্ত মহাসাগর, দক্ষিণে কোস্তা রিকা ও পূর্বে ক্যারিবীয় সাগর। ভূতাত্ত্বিকভাবে দেশটির অবস্থান দু'টি মহাসাগরীয় টেকটনিক প্লেটের সংযোগস্থলের খুব কাছে - ক্যারিবীয় প্লেট ও কোকোস প্লেট।[৫] ফলে ভূতাত্ত্বিকভাবে অঞ্চলটি যথেষ্ট অস্থির। তাই এই অঞ্চলে প্রচূর আগ্নেয়গিরি দেখতে পাওয়া যায়। প্রশান্ত মহাসাগরের তীরের সাথে সমান্তরালে যে আগ্নেয়গিরি শৃঙ্খলটি দক্ষিণপূর্বে কোস্তা রিকা থেকে উত্তর-পশ্চিমে হন্ডুরাস হয়ে আরও উত্তরে বিস্তৃত, তার একেবারে কেন্দ্রস্থলে অবস্থানের ফলে নিকারাগুয়ায় আগ্নেয়গিরির সংখ্যা মধ্য আমেরিকার মধ্যে সবচেয়ে বেশি। আরও উল্লেখযোগ্য, এইসব আগ্নেয়গিরির মধ্যে অনেকগুলিই সুপ্ত বা জীবন্ত। প্রাকৃতিকভাবে দেশটিকে তিনটি অঞ্চলে ভাগ করা যায় - পশ্চিমে প্রশান্ত মহাসাগরীয় নিম্নভূমি, মধ্যভাগের আর্দ্র ও ঠাণ্ডা উচ্চভূমি ও পূর্বদিকের ক্যারিবীয় নিম্নভূমি।

নিকারাগুয়ার প্রাকৃতিক মানচিত্র

প্রশান্ত মহাসাগরীয় নিম্নভূমি

পশ্চিমে প্রশান্ত মহাসাগরীয় নিম্নভূমি অঞ্চলটি মুলত চওড়া ও উর্বর সমভূমি নিয়ে গঠিত। এই অঞ্চলটিতেই দেশের বেশিরভাগ জনবসতি অবস্থিত। কিন্তু কর্ডিলেরা লস মারিবিওস পর্বতশ্রেণীর বিভিন্ন আগ্নেয় পর্বত এই সমভূমিতে প্রবেশ করে একে মাঝেমাঝেই পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন কয়েকটি উর্বর সমভূমি অঞ্চলে পরিণত করেছে। এই নিম্ন-সমভূমি অঞ্চলটি উত্তরে ফনসেকা উপসাগর'এর তীর থেকে শুরু হয়ে প্রশান্ত মহাসাগরের তীর বরাবর দক্ষিণে লেক নিকারাগুয়া পেরিয়ে কোস্তা রিকা পর্যন্ত বিস্তৃত। এই অঞ্চলের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য হল মধ্য আমেরিকার সবচেয়ে বড় দুটি অন্তর্দেশীয় হ্রদের উপস্থিতি - নিকারাগুয়া হ্রদ (লাগো কোকিবোলকা) ও মানাগুয়া হ্রদ। এর মধ্যে নিকারাগুয়া হ্রদটি দেশটির দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত ও আয়তনে অপেক্ষাকৃত বড়। এটি মধ্য আমেরিকার সবচেয়ে বড় মিষ্ট জলের হ্রদ (আয়তন ৮০০১ বর্গ কিমি, সর্বাধিক দৈর্ঘ্য ১৭৭ কিমি, সর্বাধিক গভীরতা ৭০ মিটার বা ২৩০ ফুট। আয়তনের বিচারে বিশ্বে ১৯তম।)। [৬] এই হ্রদটি থেকেই দেশের প্রধান নদী রিও সান হুয়ান নদীর উৎপত্তি, যা দেশটির দক্ষিণ সীমান্ত বরাবর পূর্বমুখে প্রবাহিত হয়ে অবশেষে ক্যারিবীয় উপসাগরে পড়েছে।

মধ্যভাগের উচ্চভূমি

মধ্যভাগের উচ্চভূমির সর্বোচ্চ শিখর হল পিকো মোগোটোন। দেশের উত্তরসীমায় অবস্থিত এই শিখরের উচ্চতা ২৪৩৮ মিটার। উত্তর থেকে দক্ষিণে বিস্তৃত এই সমগ্র অঞ্চলটির গড় উচ্চতা ৬১০ - ১৫২৪ মিটার। মধ্যভাগের এই উচ্চভূমিতে পশ্চিমের সমভূমি অঞ্চলের তুলনায় জনবসতি বেশ কম। কিন্তু এই উচ্চভূমির উত্তর-পশ্চিমের উপত্যকা অঞ্চলটি যথেষ্ট উর্বর। দেশের মোট কৃষিকার্যের এক চতুর্থাংশই এই অঞ্চলে হয়ে থাকে। পাহাড়ের উঁচু ঢালু অংশে কফি চাষ হয়। এই অঞ্চলের অরণ্যে ওক, পাইন, নানারকমের মস, ফার্ন আর অর্কিড প্রচূর পরিমানে দেখতে পাওয়া যায়।

ক্যারিবীয় নিম্নভূমি

অপরদিকে পূর্ব ও দক্ষিণদিকের ক্যারিবীয় উপকূলীয় নিম্নভূমি বেশ চওড়া। প্রচূর বৃষ্টিপাতযুক্ত ও বড় নদী সংবলিত এই অঞ্চলটি প্রায় পুরোটাই ক্রান্তীয় রেনফরস্টে ঢাকা। মেস্কিটো উপজাতির নামানুসারে এই অঞ্চলকে অনেকসময় মেস্কিটো উপকূলও বলা হয়ে থাকে। মধ্য আমেরিকার সবচেয়ে বড় নদী রিও কোকো এই অঞ্চলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত। নিকারাগুয়া ও হন্ডুরাসের সীমা অনেকাংশে এই নদীর গতিপথ বরাবরই চিহ্নিত হয়েছে। অপেক্ষাকৃত সরলরৈখিক প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূল রেখার তুলনায় ক্যারিবীয় উপকূল রেখা অত্যন্ত ভগ্ন। এই অঞ্চলে প্রচূর ব-দ্বীপ ও লেগুনের দেখা পাওয়া যায়।
এই অঞ্চলে স্বভাবতই জনবসতিও যথেষ্টই কম। কিন্তু এর আয়তন দেশের প্রায় ৫৭ শতাংশ। এই অঞ্চলটি দেশের খনিজ সম্পদেরও মূল ভাণ্ডার। এই অঞ্চলের সিউনা, রোসিটা ও বোনানজা 'খনি ত্রিভূজ' নামে পরিচিত। এর মধ্যে বোনানজায় একটি চালু স্বর্ণ খনি খুব বিখ্যাত। সিউনা ও রোসিটায় অবশ্য এখন আর কোনো খনি চালু অবস্থায় নেই। তবে বোনানজার খনিকে কেন্দ্র করে এই দুই জায়গাতেও সোনার পাত তৈরির শিল্প যথেষ্ট বিকাশ লাভ করেছে।

নদনদী

নিকারাগুয়ার প্রধান নদী রিও সান হুয়ান। নিকারাগুয়া হ্রদ থেকে এই নদী উৎপন্ন হয়ে প্রথমে দক্ষিণবাহী ও তারপরে পুবমুখে প্রবাহিত হয়ে ক্যারিবীয় সাগরে পতিত হয়েছে। নিকারাগুয়া হ্রদ এই নদীটির দ্বারাই ক্যারিবীয় সাগরের সাথে যুক্ত হওয়ায় ১৯২ কিলোমিটার লম্বা এই নদীটি অনেকসময় এল দেসাহুয়াদেরো (নর্দমা) নামেও অভিহিত হয়ে থাকে। সম্পূর্ণ নাব্য এই নদীটির এক বড় অংশ নিকারাগুয়া ও কোস্তা রিকার সীমানা দিয়ে প্রবাহিত। তথাকথিত নিকারাগুয়া হাঙর বা মিষ্ট জলের ষাঁড় হাঙ্গর ও অন্যান্য বহু জলজ প্রাণীর আবাসস্থল এই নদী।[৭][৮] হ্রদ থেকে রিও সান হুয়ান নদী যেখানে বেরিয়েছে, সেখানে এক জায়গায় নদী থেকে প্রশান্ত মহাসাগরের দূরত্ব মাত্র ২৪ কিলোমিটার। তাই এই নদীকে ঘিরে পানামা খালের বিকল্প একটি আন্তর্মহাসাগরীয় খাল খননের পরিকল্পনা বারে বারে আলোচনায় উঠে এসেছে, যদিও নানা কারণে তা এখনও বাস্তবায়িত হয়ে ওঠেনি। মানাগুয়া হ্রদ অপরদিকে রিও তিপিতাপা নদী দ্বারা নিকারাগুয়া হ্রদের সাথে যুক্ত। এই নদীটি উত্তরে মানাগুয়া হ্রদ থেকে উৎপন্ন হয়ে দক্ষিণবাহী হয়ে নিকারাগুয়া হ্রদে পড়েছে।
দেশের পূর্বদিকে ক্যারিবীয় নিম্নভূমি অঞ্চলটি অনেকগুলি নদী অধ্যুষিত। পূর্ববাহী এই নদীগুলির মধ্যে সবচেয়ে বড় রিও কোকো। দেশের উত্তর সীমা ধরে প্রবাহিত এই নদী মধ্য আমেরিকার বৃহত্তম নদী। এছাড়াও এই অঞ্চলের অন্য নদীগুলির মধ্যে এসকনদিদো, রিও গ্রান্দে দ্য মাতাহালপা, প্রিনসাপোলকা, প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।

আগ্নেয়গিরি শৃঙ্খল

মোমোতোম্বো আগ্নেয়গিরি

নিকারাগুয়াকে বলা হয়ে থাকে আগ্নেয়গিরির দেশ। দেশের পশ্চিম তট বরাবর একটি আগ্নেয়গিরি শৃঙ্খল দেশের উত্তর থেকে দক্ষিণে বিস্তৃত। বস্তুত এই আগ্নেয়গিরি শৃঙ্খলটি মধ্য আমেরিকার আগ্নেয়গিরি শৃঙ্খলেরই অংশ বিশেষ। দেশের পশ্চিম তটে প্রশান্ত মহাসাগরের তলদেশে উপকূল থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার অভ্যন্তরে দুই টেকটনিক প্লেট, ক্যারিবিয় প্লেট ও কোকোস প্লেটের সংযোগস্থল। বিজ্ঞানীদের পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, কোকোস প্লেটটি প্রতিবছর ক্যারিবীয় প্লেট অভিমুখে ৭০-৮৫ মিলিমিটার সরে আসছে। অন্যদিকে উত্তর আমেরিকা প্লেটটিকে স্থির ধরে নিলে, ক্যারিবীয় প্লেটটির গতি পূর্ব অভিমুখে প্রতিবছর ১৮-২০ মিলিমিটার। এই দুই প্লেটের অসম গতির কারণে সৃষ্ট সংঘর্ষের ফলে এই অঞ্চল ভূতাত্ত্বিকভাবে এখনও যথেষ্ট অস্থির।[৯] সেই কারণেই এই অঞ্চলে প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূল রেখা বরাবর একটি আগ্নেয়গিরি শৃঙ্খল দেখতে পাওয়া যায় যেটি দক্ষিণে কোস্তা রিকা থেকে শুরু হয়ে উত্তরে নিকারাগুয়া, হন্ডুরাস, এল সালভাদোরগুয়াতেমালার মধ্য দিয়ে বিস্তৃত।[৫][৯] এই মধ্য আমেরিকার আগ্নেয় মেখলার একেবারে মধ্যস্থলে নিকারাগুয়ার অবস্থানের ফলে আগ্নেয়গিরির সংখ্যা এ'দেশে এত বেশি। এগুলির মধ্যে অনেকগুলিই সুপ্ত বা জীবন্ত। মাঝেমাঝেই অগ্ন্যুৎপাত তাই এ'দেশে নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। এ'দেশের সক্রিয় আগ্নেয়গিরিগুলির মধ্যে সেরো নেগ্রো, কনসেপসিওন, লাস পিলাস, মাথায়া, সান ক্রিস্তোবাল, তেলিসা প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এদের মধ্যে কনসেপসিওন থেকে শেষ অগ্ন্যুৎপাত ঘটেছে ২০০৯ সালে, সান ক্রিস্তোবালে ২০১২ সালে, তেলিসায় ২০০৭ সালে ও সেরো নেগ্রো শেষবার জেগে উঠেছিল ১৯৯৯ সালে। অপরদিকে মোম্বাচো, মোমোতোম্বো, কসিথুইনা প্রভৃতি আগ্নেয়গিরিগুলি থেকে গত ১০০ বছরে কোনো অগ্ন্যুৎপাত না ঘটলেও যে কোনও মুহূর্তেই সেগুলি আবার জেগে উঠতে পারে। আবার জাপাতেরা, মাদেরাস, আপোইয়েক প্রভৃতি আগ্নেয়গিরিগুলি থেকে বিগত কয়েক হাজার বছরের মধ্যেও কোনও অগ্ন্যুতপাতের ঘটনা ঘটতে দেখা যায়নি।

জলবায়ু

নিকারাগুয়ার প্রাকৃতিক মানচিত্র (উচ্চতা)
নিকারাগুয়ার কোপেন জলবায়ু শ্রেণিবিভাগের মানচিত্র

সাধারণভাবে নিকারাগুয়ায় তাপমাত্রা সারাবছরই প্রায় একরকম থাকে। ঋতুভেদে তাপমাত্রার পার্থক্য ঘটে কম। তবু অঞ্চলভেদে নিকারাগুয়ার জলবায়ুর মধ্যে যথেষ্ট প্রভেদ পরিলক্ষিত হয়। পশ্চিমে প্রশান্ত মহাসাগরীয় নিম্নভূমি অঞ্চল ও পূর্বে আতলান্তিক উপকূলে ক্যারিবীয় নিম্নভূমি অঞ্চল সারাবছরই বেশ উষ্ণ। এই অঞ্চলের জলবায়ুর বৈশিষ্ট্য ক্রান্তীয় অঞ্চলের মতো। কিন্তু দেশের মধ্যভাগে আগ্নেয়গিরি শৃঙ্খল ও তৎসন্নিহিত উচ্চভূমি অঞ্চলে ঋতুভেদে তাপমাত্রা যথেষ্ট ওঠানামা করে থাকে। শীতকালে এই অঞ্চলে ঠাণ্ডা পড়ে, তবে বৃষ্টিপাত ও জীবন্ত আগ্নেয়গিরিগুলি থেকে মাঝেমাঝেই অগ্ন্যুৎপাতের ফলে তাপমাত্রার স্থিরতা সময়ে সময়ে বিঘ্নিত হতে দেখা যায়।
প্রশান্ত মহাসাগরীয় নিম্নভূমি অঞ্চলটি জলবায়ুর দিক থেকে তিয়েরা কালিয়েন্তে বা উষ্ণ মণ্ডল হিসেবে পরিচিত। সারা বছরই এখানে তাপমাত্রা মোটামুটি একই রকম থাকে, ২৯.৪ এবং ৩২.২ °সে (৮৫ এবং ৯০ °ফা)'এর মধ্যে ঘোরাফেরা করে। নভেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত আবহাওয়া এই অঞ্চলে মোটামুটি শুকনো থাকে। কিন্তু মে মাস থেকে বর্ষা শুরু হয়ে অক্টোবর পর্যন্ত চলতে থাকে। সারা বছরে গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ৪০ - ৬০ মিলিমিটার। পূর্বে ক্যারিবীয় সাগর থেকে বয়ে আসা জলীয় বাস্প পূর্ণ বায়ু মধ্যভাগের উঁচু পর্বতমালায় বাধা পাওয়ার ফলে ঐ উচ্চভূমির পূর্ব ঢালের তুলনায় পশ্চিম ঢালে স্বভাবতই বৃষ্টির পরিমাণ কম। তবুও ভালো বৃষ্টিপাত, উর্বর জমি এবং অনুকূল জলবায়ুর কারণে দেশের এই পশ্চিম অঞ্চল আজ দেশের অর্থনৈতিক কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়েছে। দেশের অর্ধেকেরও বেশি মানুষ এই অঞ্চলেই বাস করেন।
মধ্যভাগের উচ্চভূমি অঞ্চলটি দেশের তিয়েরা তেমপ্লাদা বা নাতিশীতোষ্ণ মণ্ডল হিসেবে পরিচিত। এই অঞ্চলের জলবায়ু প্রশান্ত মহাসাগরীয় নিম্নভূমি অঞ্চলের তুলনায় শীতল। এখানকার গড় উষ্ণতা ২৩.৯ থেকে ২৬.৭ °সে (৭৫ থেকে ৮০ °ফা)। বর্ষাকাল এখানে আরও দীর্ঘস্থায়ী, বৃষ্টিপাতের পরিমাণও বেশি। বৃষ্টিপাতের ফলে পাহাড়ী অঞ্চলে মাঝেমাঝেই ধ্স নামে। সাধারণভাবে এই অঞ্চলে ভূমি রুক্ষ, জনঘনত্বও কম। তবে এই অঞ্চলের উত্তর-পশ্চিমের ঢালে যে উপত্যকাটি দেখতে পাওয়া যায়, সেটি যথেষ্ট উর্বর। ফলে এই অঞ্চলে জনঘনত্বও অপেক্ষাকৃত বেশি।
দেশের পূর্ব উপকূলের ক্যারিবীয় নিম্নভূমির জলবায়ুও সম্পূর্ণ ক্রান্তীয় অঞ্চলের উষ্ণ মণ্ডলীয় জলবায়ু। এই অঞ্চলের তাপমাত্রা অপেক্ষাকৃত বেশি, বাতাসে আপেক্ষিক আর্দ্রতাও যথেষ্ট বেশি। এই অঞ্চলে প্রচূর বৃষ্টিপাত হয়। বস্তুত এই অঞ্চল সমগ্র মধ্য আমেরিকার মধ্যে সবচেয়ে বৃষ্টিবহুল অঞ্চল। বছরে এর মোট পরিমাণ ২৫০০-৬৫০০ মিলিমিটার। অপেক্ষাকৃত কম জনবসতিপূর্ণ এই অঞ্চলের এক বড় অংশ জুড়ে ক্রান্তীয় রেনফরেস্ট দেখতে পাওয়া যায়।বর্ষাকালে পূর্বদিকের ক্যরিবীয় নিম্নভূমি অঞ্চলের উপর দিয়ে বয়া বিভিন্ন নদীগুলির নিম্ন, মধ্য ও এমনকী কিছু কিছু ক্ষেত্রে উচ্চপ্রবাহ অঞ্চলেও বন্যার প্রকোপ দেখা যায়। প্রতিবছর এই বন্যার ফলে চাষবাস ও নদী অববাহিকাগুলি ঘিরে থাকা বনাঞ্চলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ঘটে। এছাড়া মূলত জুলাই থেকে অক্টোবরের মধ্যে পূর্ব উপকূলীয় অঞ্চলে মাঝেমাঝেই প্রবল সামুদ্রিক ঝড় বা হ্যারিকেনের প্রভাব দেখতে পাওয়া যায়। এই সব ঝড়েও ক্যারিবীয় উপকূলীয় অঞ্চলের জীবনযাত্রা বহুসময়েই ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে থাকে।

জনপরিসংখ্যান

২০০৫ সাল পর্যন্ত হিসেব অনুযায়ী নিকারাগুয়ার মোট অধিবাসীর সংখ্যা ৫১,৪২,০৯৮ জন (২০১৪ সালের জুলাই মাসে ৫৮,৪৮,৬৪১[১০])। এঁদের মধ্যে মেস্তিজো, অর্থাৎ শ্বেতকায় ও স্থানীয় আমেরিন্ডিয়ানদের মিশ্রিত জনসংখ্যা মোট জনসংখ্যার ৬৯.৭ শতাংশ, ১৭.৬ শতাংশ শ্বেতকায় (মূলত স্পেনীয় বংশোদ্ভূত) ও ৯.২ শতাংশ আফ্রিকান বংশোদ্ভূত। মোট জনসংখ্যার ৯০ শতাংশই প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল ও মানাগুয়া অঞ্চলের বাসিন্দা। ২০০৫ সালের হিসেব অনুযায়ী ক্যারিবীয় উপকূলের মোট বাসিন্দা মাত্র ৭ লক্ষ।[১১] আবার কৃষ্ণাঙ্গ জনসংখ্যার ৯৫ শতাংশই বাস করেন ক্যারিবীয় উপকূল অঞ্চলে। এর ফলে গোটা দেশের সাপেক্ষে সংখ্যা কম হওয়া সত্ত্বেও ক্যারিবীয় উপকূল অঞ্চলে কৃষ্ণাঙ্গরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ (৫৯ শতাংশ)। স্থানীয় আমেরিন্ডিয়ানদের সংখ্যা দেশে উল্লেখযোগ্যভাবেই কম, মোট জনসংখ্যার মাত্র ৩.২ শতাংশ। এঁদের মধ্যে মেস্কিটো উপজাতি সংখ্যায় সর্বাধিক। এছাড়াও ছোট ছোট কতগুলি জনগোষ্ঠী রয়েছে, যেমন রামা, সুমো, প্রভৃতি। এঁদের বেশীরভাগেরই বসবাস অতলান্তিক উপকূলেই।
মোট জনসংখ্যার ৫৭.৫ শতাংশই শহরের বাসিন্দা (হিসেব ২০১১ সালের)। দেশে মানুষের বেঁচে থাকার গড় বয়স ৭২.৭ বছর। প্রতি ১০০ জন মহিলা পিছু পুরুষ সংখ্যা ৯৬। শিশুমৃত্যুর হার প্রতি হাজারে ২০.৩৬। জন্মহার প্রতি হাজারে ১৮.৪১ ও মৃত্যুহার ৫.০৭।[১০] ফলে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১.৮ (২০০৮ সালের হিসেব অনুযায়ী), যা পশ্চিম গোলার্ধের মধ্যে সবচেয়ে বেশি জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের মধ্যে একটি। ২০০৫ সালের হিসেব অনুযায়ী দেশে জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ৪২.৭ জন।[১২]

অভিবাসী

অভিবাসীদের সংখ্যা নিকারাগুয়ায় সে'দেশের জনসংখ্যার তুলনায় যথেষ্টই বেশি। তবে তা কখনই ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত জনসংখ্যার ১ শতাংশকে খুব বেশি অতিক্রম করেনি। ২০০৫ সালের আদমশুমারি রিপোর্ট অনুযায়ী বিদেশে জন্মেছে এ'রকম জনসংখ্যা নিকারাগুয়ার মোট জনসংখ্যার ১.২ শতাংশ।[১১]
ঊনবিংশ শতাব্দীতে ইঊরোপের নানা দেশ, যেমন জার্মানি, ইতালি, স্পেন, ফ্রান্স, বেলজিয়াম থেকে বহু পরিবার নিকারাগুয়ায় এসে বসবাস শুরু করে। মূলত প্রশান্ত মহাসাগরীয় নিম্নভূমি ও মধ্যভাগের উচ্চভূমি অঞ্চলেই এরা বসতি স্থাপন করে। পরবর্তীকালে মধ্যপ্রাচ্যআরব উপদ্বীপ থেকেও বহু মানুষ নিকারাগুয়ায় এসে বসবাস শুরু করে। এরা মূলত সিরিয়া, আর্মেনিয়া, প্যালেস্তাইন ও লেবানন থেকে আসা মানুষ। সংখ্যায় এরা আজ প্রায় ৩০ হাজার। এছাড়াও ২০০৫ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী নিকারাগুয়ায় চীনা অভিবাসীর সংখ্যাও প্রায় ১২ হাজার।[১১] এদের মধ্যে এক মানাগুয়া শহরেই প্রায় ৮০০০ জনের বাস। ঊনবিংশ শতাব্দীতেই এই চীনারা এ'দেশে আসতে শুরু করে। কিন্তু ১৯২০ সালের আগে স্থায়ীভাবে কোনও চীনা বসতির উল্লেখ পাওয়া যায় না।

ভাষা

নিকারাগুয়ার সরকারি ভাষা স্পেনীয়। দেশের মানুষের ৯৭ শতাংশই মাতৃভাষা হিসেবে এই ভাষায় কথা বলে থাকেন।[১২] সারা দেশেই এই ভাষা চলে। তবে অঞ্চলভেদে এই ভাষার নানা উপভাষাগত প্রভেদ দেখা যায়। ক্যারিবীয় উপকূলে কৃষ্ণাঙ্গ নিকারাগুয়ানদের মধ্যে ক্রেওল বা ক্যারিবীয় ইংরেজিরও প্রচলন দেখা যায়। মূলত ব্লুমসফিল্ড শহর ও তার আশেপাশে এই ভাষার প্রচলন বেশি। তবে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে এরা প্রত্যেকেই সাধারণত স্পেনীয় ভাষায় যথেষ্টই সচ্ছন্দ। এছাড়াও ক্যারিবীয় উপকূলে বসবাসকারী বিভিন্ন আমেরিন্ডিয়ান উপজাতির মানুষ তাদের নিজস্ব ভাষাতেও কথা বলে থাকেন। এই ভাষাগুলোর মধ্যে মেস্কিটো, মাতাগালপা, মায়াংনা, রামা, সুমো, গারিফুনা, প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।[১৩] এদের মধ্যে কয়েকটি ভাষায় বর্তমানে এত কম মানুষ কথা বলেন যে সেগুলিকে আশঙ্কাজনক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। যেমন উলুওয়া ভাষা (২০০৯ সালের হিসেব অনুযায়ী এই ভাষায় মাত্র ৩৫০ জন মানুষ কথা বলেন।)। এছাড়া কয়েকটি ভাষা বিলুপ্তও হয়ে গেছে। যেমন সুবতিয়াবা ভাষা। ১৯৮১ সালের হিসেব অনুযায়ী যদিও এই ভাষা গোষ্ঠীর প্রায় ৫০০০ মানুষের খোঁজ পাওয়া যায়, তাদের কেউই আর নিজেদের প্রথম ভাষা হিসেবে এই ভাষাটি ব্যবহার করতেন না। মাঙ্গুয়ে ভাষার ক্ষেত্রেও বিষয়টি একইরকম।[১৩]
ভাষাবিদদের কাছে বর্তমানে নিকারাগুয়া প্রতীক ভাষা(ইডিওমা দে সেনিয়াস দে নিকারাগুয়া) একটি অত্যন্ত আগ্রহোদ্দীপক বিষয়। ১৯৭০'এর পরবর্তী সময়ে পশ্চিম নিকারাগুয়ার একদল বধির স্কুলছাত্রের নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে জন্ম নেওয়া এই ভাষাটি বর্তমানে অনেকের মতেই পৃথিবীর নবীনতম ভাষা। মূলত মানাগুয়া শহর সংলগ্ন এলাকায় বধির মানুষদের মধ্যে দ্রুত ছড়িয়ে পড়া এই ভাষায় ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত হিসেব অনুযায়ী প্রায় ৩০০০ মানুষ কথা বলেন। বধিরদের জন্য নির্মিত প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলিতেও বর্তমানে এই ভাষা শেখানো হয়ে থাকে।[১৪]

ধর্ম

মানাগুয়ার পুরনো গির্জা
বহু পুরনো লেওন ক্যাথিড্রাল দেশের একটি অন্যতম ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্য, ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট বলেও স্বীকৃত

যদিও নিকারাগুয়ার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ (প্রায় ৮০ শতাংশ) ক্যাথলিক ধর্মের অনুসারী এবং ক্যাথলিক বিশপদের দেশের সাধারণ মানুষের উপর বিশেষ প্রভাব পরিলক্ষিত হয়, সরকারিভাবে ১৯৩৯ সাল থেকে নিকারাগুয়া একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশ। দেশের সংবিধানেও দেশের মানুষের ধর্মীয় স্বাধীনতার কথার উল্লেখ আছে।
স্পেনীয় কঙ্কিস্তাদোরদের নিকারাগুয়ায় আগমণ ও সেদেশ দখলের অল্পদিনের মধ্যেই ১৫৩০ সাল নাগাদ খ্রিষ্টান মিশনারিরা এদেশে আসতে শুরু করেন। সামান্য কিছু ব্যতিক্রম বাদে সে' সময়ই স্পেনীয়দের মদতে এখানকার বেশিরভাগ স্থানীয় মানুষও এই মূলত ক্যাথলিক ধর্ম প্রচারকদের প্রচেষ্টায় খ্রিষ্ট ধর্মে ধর্মান্তরিত হন। অবশ্য এক্ষেত্রে বিদ্রোহের ইতিহাসও আছে। কিন্তু মূলত স্পেনীয় শাসকদের বিরুদ্ধে সে বিদ্রোহ সে' সময় কঠোর হাতে দমন করা হয় ও অসংখ্য স্থানীয় অধিবাসীকে শাস্তি হিসেবে পেরুতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে অস্বাস্থ্যকর ও অমানবিক পরিস্থিতিতে পাহাড় ও খনিতে কাজ করতে তাদের বাধ্য করা হলে তাদের অধিকাংশেরই মৃত্যু ঘটে। ফলে নিকারাগুয়ায় সে' সময় থেকেই রোমান ক্যাথলিক ধর্ম সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্মে রূপান্তরিত হয়। ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত এই ধর্মই দেশে সরকারি ধর্ম হিসেবে স্বীকৃত ছিল।
বর্তমানে ক্যাথলিক চার্চ সমগ্র দেশকে ৮টি ডায়াসেশনে ভাগ করেছে। দেশের মোট প্রায় ৪৩.৫ লক্ষ মানুষ তাদের অনুসরণ করেন। মোট ৩৬৭ জন ক্যাথলিক প্যারিস প্রিস্টের অধীনে এই অনুগামীরা বিন্যস্ত। একেকজন প্রিস্টের অধীন এলাকা প্রায় ৩২৬ বর্গ কিলোমিটার ও গড়ে ১১,৮০০ অধিবাসী তাদের অনুসরণ করেন।
ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে খ্রিষ্ট ধর্মের অন্য শাখাগুলিও নিকারাগুয়ায় প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে। এদের মধ্যে প্রোটেস্টান্ট চার্চ, মোরাভীয় চার্চ, দ্য চার্চ অফ নাজারিন, দ্য অ্যাসেম্বলিজ অফ গড, প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। মূলত দেশের পশ্চিম অংশে এদের প্রভাব বেশি দেখা যায়। এদের মধ্যে মোরাভীয় চার্চের কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ঊনবিংশ শতাব্দীতে জার্মানি থেকে এই ধর্ম প্রচারকরা নিকারাগুয়ায় আসেন। বিশেষ করে অস্পেনীয় স্থানীয় বিভিন্ন উপজাতি, যেমন মেস্কিটো, সুমু, রামা ও ক্রেওল জনসাধারণের কাছে এই চার্চ ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ১৯৯০ এর দশক থেকে দেখা যাচ্ছে, প্রোটেস্টান্ট ধর্মের অনুরাগীর সংখ্যা দেশে দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে।[১৫]
নিকারাগুয়ার মানুষ সাধারণভাবে ধর্মভীরু। প্রতি রবিবার নিয়ম করে গির্জার প্রার্থনায় যোগ দেওয়ার অভ্যাসে তাদের ঘাটতি থাকলেও, জনজীবনে ও এমনকী রাজনীতিতেও ক্যাথলিক বিশপদের বিশেষ প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। বিশেষ করে ১৯৭০ ও ৮০'র দশকে সোমোথা সরকারের বিরুদ্ধে দেশ জুড়ে আন্দোলনে এঁদের প্রভাব ব্যাপকভাবে মানুষকে সংগঠিত করে। পরবর্তীকালে সান্দানিস্তা আন্দোলনের জনভিত্তি তৈরির ক্ষেত্রেও ক্যাথলিক গির্জার যথেষ্ট ভূমিকা ছিল। বিশেষ করে শহরাঞ্চলের গরিব মানুষকে এই আন্দোলনের পিছনে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে এরা অত্যন্ত সদর্থক ভূমিকা পালন করে।
ধর্মাচরণের দিক থেকে দেখলে নিকারাগুয়ায় পালিত সংখ্যাগরিষ্ঠ ক্যাথলিক জনগোষ্ঠীর কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। লাতিন আমেরিকার অন্য অনেক দেশের মতো এদেশে চালু ধর্মাচরণ বাস্তবে খ্রিষ্ট ধর্মের সাথে স্থানীয় আদিবাসী মানুষের প্রাচীন ধর্মাচরণের একটি মিশ্রণ নয়। এদেশে ষোড়শ শতকেই স্থানীয় অধিবাসীদের খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তকরণ একরকম সম্পূর্ণ হওয়া ও বাকিদের অনেককেই দেশ থেকে নির্বাসনের ফলে স্থানীয় মানুষের প্রাচীন ধর্মগুলির প্রভাব এদেশের মানুষের উপর পরবর্তীকালে আর তেমন পরিলক্ষিত হয় না। কিন্তু এদেশে খ্রিষ্টীয় সন্তদের জনপ্রিয়তা অত্যন্ত বেশি। সাধারণ মানুষের ধর্মাচরণ মূলত এঁদের ঘিরেই আবর্তিত হয়। সন্তদের ছবি, কুয়াদ্রোস, এদেশে প্রায় ঘরে ঘরে দেখতে পাওয়া যায়। সমাজের বিভিন্ন অংশ এঁদের মধ্যে বিশেষ কাউকে তাদের প্যাট্রন সেন্ট বলেও মনে করে থাকে। ফলে এইসব সন্তদের নামে উৎসর্গীকৃত দিবসগুলি এদেশে অত্যন্ত আড়ম্বর ও উৎসাহের সাথে পালিত হয়। যেমন রাজধানী মানাগুয়ায় সন্ত দমিনিক'এর সম্মানে আগস্ট মাসে দুইদিন ব্যাপী অত্যন্ত আড়ম্বরপূর্ণ মিছিলের আয়োজন করা হয়। দেশের নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষ বিশেষ করে এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে থাকে।[১৫]
তবে বর্তমানে নিকারাগুয়ায় সরকারিভাবে ধর্মনিরপেক্ষ নীতি অনুসরণের ফলে, ও অন্যদেশ থেকে অভিবাসীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে অন্যান্য ধর্মেরও প্রচলন ঘটেছে এবং তাদের প্রভাবও বৃদ্ধি পেয়েছে। এদের মধ্যে বৌদ্ধদের কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।[১৬]

অন্যত্র অভিবাসন

দীর্ঘ গৃহযুদ্ধ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও দেশের মধ্যে কাজের অভাবের কারণে নিকারাগুয়ার বহু মানুষ বিভিন্ন সময়ে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। ১৯৯০'এর দশকে দেশজুড়ে অর্থনৈতিক মন্দার কারণেও এই প্রবণতা আরও বৃদ্ধি পায়। সাধারণভাবে কাজের খোঁজে দেশ ছাড়া এইসব মানুষ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পার্শ্ববর্তী দেশ কোস্তা রিকা ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী হন। কোস্তা রিকার আদমশুমারি দপ্তরের ২০০১ সালের হিসেব অনুযায়ী সেদেশে বর্তমানে ২,৩৬,০০০ নিকারাগুয়ান বাস করে। অন্যদিকে ১৯৯০ সালের মার্কিন সেনসাস রিপোর্টই জানাচ্ছে, সেদেশে তখন ১,৬৮,০০০ নিকারাগুয়ান বাস করে।[১৭] এই হিসেবের মধ্যে অবশ্যই বেআইনি অনুপ্রবেশের সংখ্যা ধরা হয়নি। অপেক্ষাকৃত কম সংখ্যায় হলেও এক উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ পার্শ্ববর্তী দেশ হন্ডুরাসেও অভিবাসী হন। এছাড়া অতি সাম্প্রতিক কালে এল সালভাদরে মূদ্রা হিসেবে ডলারের প্রচলন শুরু হবার পর থেকে সেখানেও অভিবাসনের একটি প্রক্রিয়া পরিলক্ষিত হচ্ছে। ২০০০ সালের পর থেকে শুরু হওয়া এল সালভাদরমুখী এই অভিবাসনের চরিত্র অবশ্য কিছুটা পরিযায়ী শ্রমিকের মতো। বছরের নির্দিষ্ট সময়ে কাজের খোঁজে এরা এই দেশে যায় ও সেই কাজ শেষে আবার নিজের দেশে ফিরে আসে।
২০০৮ সালে পরিচালিত নিকারাগুয়ার পারিবারিক সমীক্ষা থেকে উঠে আসা তথ্যে দেখা যাচ্ছে, সেদেশে প্রায় ১১ লক্ষ ৫৮ হাজার পরিবার বাস করে। এদের ৭৫ শতাংশের ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে পরিবারের কেউ না কেউ বিদেশে বাস করে। অর্থাৎ, সেই হিসেবে বিদেশে অভিবাসী নিকারাগুয়ানের মোট সংখ্যা প্রায় ৯ লক্ষ। এঁরা মূলত কেউ পরিচারিকা, কেউ বা খুচরো বিক্রেতা, মেশিনচালক বা কৃষি শ্রমিক। আবার এঁদের বড় একটি অংশ ছাত্র-ছাত্রী। এছাড়াও বিভিন্ন পেশার পেশাদার মানুষ, যেমন আইনজীবী, শিক্ষক, ইঞ্জিনিয়াররাও স্বল্প সংখ্যায় হলেও অভিবাসীদের মধ্যে আছেন।[১৭]
এছাড়াও পশ্চিম ইউরোপের বিভিন্ন দেশ, বিশেষ করে ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, স্পেন, নরওয়ে ও সুইডেনেও বর্তমানে ছোট আকৃতিতে হলেও একটি নিকারাগুয়ান অভিবাসী সমাজ গড়ে উঠেছে। এশিয়ায় জাপানেও নিকারাগুয়া থেকে বেশ কিছু মানুষ কাজের খোঁজে আশ্রয় নিয়েছেন।

আরও দেখুন

তথ্যসূত্র

🔥 Top keywords: রাম নবমীমুজিবনগর দিবসপ্রধান পাতামুজিবনগর সরকারবিশেষ:অনুসন্ধানইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগএক্স এক্স এক্স এক্স (অ্যালবাম)বাংলাদেশবাংলা ভাষামিয়া খলিফারাজকুমার (২০২৪-এর চলচ্চিত্র)আনন্দবাজার পত্রিকাআবহাওয়ারামপহেলা বৈশাখউয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগইসরায়েলইরানরবীন্দ্রনাথ ঠাকুরমুজিবনগরইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউনরিয়াল মাদ্রিদ ফুটবল ক্লাব২০২৪ ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগক্লিওপেট্রাচর্যাপদভূমি পরিমাপশেখ মুজিবুর রহমানজনি সিন্সকাজী নজরুল ইসলামঈদুল আযহাফিলিস্তিনইউটিউবভারতবিকাশআসসালামু আলাইকুমসৌদি আরববাংলা প্রবাদ-প্রবচনের তালিকামুহাম্মাদ