আতশবাজি

আতশবাজি (ইংরেজি: Fireworks) হচ্ছে নিম্নমাত্রার বিস্ফোরক (pyrotechnics) নান্দনিক এবং বিনোদনমূলক উদ্দেশ্যে বহুল ব্যবহৃত এক ধরনের বাজি।

সিডনি শহরে খ্রিস্টীয় নববর্ষের আতসবাজী

মূলত চারটি প্রাথমিক রূপ আছে আতশবাজি্র, যথা: শব্দ, আলো, ধোঁয়া এবং ভাসমান উপকরণ। এগুলি রঙিন শিখা যেমন লাল, কমলা, হলুদ, সবুজ, নীল, বেগুনি এবং সিলভার সহ নানান রঙের ঝলক (বৈদ্যুতিক স্পার্কের ন্যায়) সৃষ্টি করতে সক্ষম। বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন প্রদর্শনী, খেলা এবং বহু সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠানে আতশবাজির ব্যবহার হয়। আতশবাজি সাধারনতঃ ফ্ল্যাস পাউডার (সোর- চার ভাগ, গন্ধক- এক ভাগ, এলুমিনিয়াম পাউডার - এক ভাগ ) এর দ্বারা তৈরি হয়। এ ছাড়া রঙিন আলোর জন্য স্ট্রনশিয়াম, বেরিয়াম প্রভৃতি ধাতুর নাইট্রেট, ক্লোরেট লবণ ব্যবহৃত হয়। তবে রঙিন আলোর জন্য ক্লোরিন অবশ্যম্ভাবী। ক্লোরেট লবণ থেকে এই ক্লোরিন পাওয়া যায়। কিন্তু নাইট্রেটলবন ব্যবহার করলে আলাদা ভাবে ক্লোরিন নিস্কাশক দ্রব্য [যথা পি-ভি-সি (পলি-ভিনাইল ক্লোরাইড)] মেশাতে হয়। এ ছাড়া নীল রঙের জন্য তুঁতে ও ক্লোরিন নিস্কাশক ব্যবহার করা যায়।বাজীর পলতের জন্য কালো মশলা (সোরা- আট ভাগ, গন্ধক- এক ভাগ, কাঠকয়লা - দুই ভাগ ) ব্যবহার হয়।এ ছাড়াও সোরার জায়গায় ব্যারাইটা ব্যবহার করলে হাল্কা সবুজাভ সাদা আলো পাওয়া যায়। এর সঙ্গে পিভিসি মেশালে সবুজ রঙ বেশি দেখা যায়। এজন্য রং মশালে ব্যারাইটা ব্যবহার করা হয়।

তুবড়ীর ভাগ

সোরা- ষোলো ভাগ, লোহাচূর - দশ ভাগ, গন্ধক- তিন ভাগ, কাঠকয়লা - চার ভাগ

আতশবাজি
২০০৫ সালে আয়োজিত হয় তাইওয়ানের তাইপে ১০১ এর সুউচ্চু দালানে এক বিশাল আতশবাজি প্রদর্শনী। যা ছিল পৃথিবীর প্রথম আকাশচুম্বী অট্টালিকা থেকে আতশবাজি প্রদর্শনী।
2013 ফ্রান্সের প্যারিসে Bastille Day এর আতশবাজি প্রদর্শনী।

আতশবাজিগুলোর সাধারণ বৈশিষ্ট্য হ'ল একটি কাগজ বা কার্ডের নির্মিত টিউব যার ভেতরে থাকে দহনযোগ্য উপাদান, প্রায়শই ব্যবহৃত হয় পাইরোটেকনিক স্টার, যা বর্নিল আলোয়ে বিস্ফোরিত হয় ।স্কাইরকেট ফায়ারওয়ার্কের একটি সাধারণ রূপ, যদিও প্রথমে তা যুদ্ধে ব্যবহৃত হয়েছিল। যদিও বর্তমানে এটিকে আতশবাজির মূল উপাদান হিসাবে ধরা হয়।

আতশবাজি ছিল মূলত চীনের উদ্ভাবন। আতশবাজি করার একটি সাংস্কৃতিক অনুশীলন হ'ল অশুভ আত্মা কে ভয় দেখানো। চীনা নববর্ষ এবং মধ্য-শরৎ চাঁদ উৎসব এর মতো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বিপুল পরিমাণে আতশবাজি ব্যবহৃত হয়। এমন দৃষ্টিনন্দন দৃশ্য দেখার জন্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে অজস্র পর্যটক দর্শনীয় স্থানগুলিতে ভিড় করেন। চীন বিশ্বের বৃহত্তম আতশবাজি প্রস্তুতকারক এবং রফতানিকারক দেশ।

ইতিহাস

মিং রাজবংশ উপন্যাসের ১৬২৮-১৬৪৩ সংস্করণ থেকে একটি আতশবাজি প্রদর্শনের উদাহরণ।[১]
১৭৪৯ সালে ইংল্যান্ডের লন্ডন, টেম্‌স নদী-এর পাড়ে রাজকীয় আতশবাজি প্রদর্শনীর একটি নকশাকাটা কাপড়ের চিত্র
মুহাম্মদ শাহের জন্য একটি আতশবাজি প্রদর্শনী
সায়ান ক্যাসেল, জার্মানীতে আতশবাজি তৈরি করা হচ্ছে

আতশবাজীর শুরুটা চীন থেকেই।.[২] নানান অনুষ্ঠানে চীনাদের আতসবাজির ব্যবহার করার প্রমাণ রয়েছে।[৩] ধীরে ধীরে আতশবাজি কেন্দ্রিক শিল্প গুলো স্বাধীন পেশায় পরিনত হতে থাকে এবং এই পেশায় সংশ্লিষ্টদের সম্মানের চোখে দেখা হতো।[৪] চীনা জনগণ বিশ্বাস করতে শুরু করে যে আতশবাজি মন্দ আত্মা কে তাড়িয়ে দিতে এবং ভাগ্য এবং সুখ আনতে সক্ষম।[৫]

হান রাজবংশ চলাকালীন (২০২ খ্রিস্টপূর্বাব্দ - ২২০ খ্রিস্টাব্দ), লোকেরা উচ্চ শব্দ সহ একটি বিস্ফোরণ তৈরি করতে বাঁশের কান্ডকে আগুনের মধ্যে ছুঁড়ে মারত।[৬] পরবর্তী সময়ে, বারুদ ব্যবহার করা হতো এসব শব্দ তৈরি করার জন্য।[৬] এই বিস্ফোরিত বাঁশের ডাল "বাওঝু" (爆竹) বা or বোগান (爆竿)নামে পরিচিত ছিল এবং যা বিনিময়যোগ্য ছিল। [৬] সম্ভবত দ্বাদশ এবং সম্ভবত একাদশ শতাব্দীর মধ্যে বাওঝাং (爆 仗) শব্দটি বিশেষত আতশবাজী দেখাতেন যারা তাদের বোঝাতে ব্যবহৃত হতো।[৬]

সং রাজবংশীয় আমলে (৯৬০-১২৭৯) ক্রেতা সাধারণ আতশবাজি বাজার থেকেই কিনতে পারতেন বলে নিদর্শন পাওয়া গেছে।.[৭] ১১১০ সনে সং সম্রাট “সম্রাট হুইজং” তার রাজদরবারে বিশাল এক আতশবাজির প্রদর্শনির আয়োজন করেছিলেন বলে ইতিহাসবিদেরা বর্ণনা করেন।[৮] ১২৬৪ সালের এক নথি প্রমাণ করে যে “সম্রাজ্ঞী দোয়াগের” –এর সম্মান স্বরূপ তার পুত্র সং সম্রাট লিজং এক ভোজনের দাওয়াতে রকেটের আদলে বানানো একটি আতশবাজির প্রদর্শন করেন, যা সম্রাজ্ঞী দোয়াগের কে চমকে দেয়। [৯] যুদ্ধের ক্ষেত্রে রকেট হিসাবে ব্যবহার সাধারণ ছিল, যেমনটি হিউলংজিং লিউ বোয়েন (১৩১১–১৩৭৫) এবং জিয়াও ইউ দ্বারা সংকলিত (ফ্লা.সি. ১৩৫০–১৪১২) দ্বারা প্রমাণিত।[১০] ১২৪০ সালে আরবরা চীন থেকে বন্দুক এবং তার ব্যবহার সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করেছিল। হাসান আল-রম্মাহ নামে একজন সিরিয়ান রকেট, আতশবাজি এবং ইত্যাদি সম্পর্কিত ঘটনা নিয়ে লিখেছিলেন। তিনি আতশাবজিকে “চীনা ফুল” হিসাবে প্রকাশ করেন।[৩][১১]

আতশবাজি ১৪’শ শতকে ইউরোপে প্রস্তুত শুরু হলেও তা জনপ্রিয় হয়ে উঠে ১৭’হ শতকে।[১২][১৩][১৪] পিটার দ্য গ্রেট এর রাষ্ট্রদূত লেভ ইজমেলভ একবার চীন থেকে রিপোর্ট করেছিলেন যে, "তারা এমন আতশবাজি তৈরি করতে সক্ষম যা ইউরোপের কেউ কখনও দেখেনি।"[১৪] 1758 সালে, জেসুইট ধর্মপ্রচারক পিয়ের নিকোলাস লে চেরন ডি'আইঙ্কারভিলি যিনি সেই সময়ে বেইজিং এ বসবাস করতেন, তিনি প্যারিস অফ সায়েন্সেস বইটিতে লিখেছেন কীভাবে বিভিন্ন ধরনের চাইনিজ আতশবাজি তৈরি করা হত ঐ সময়ে, যা লেখার পাঁচ বছর পরে প্রকাশিত হয়।[১৫][১৫] অ্যামাডি-ফ্রেঞ্চোইস ফ্রেজিয়ার তার সংশোধিত রচনা Traité des feux d'artice pour le spectacle (ফায়ার ফায়ারসে ট্রিটসিস) ১৭৪৭ সালে প্রকাশ করেছিলেন,[১৬] যাতে আতশবাজিকে তাদের সামরিক ব্যবহারের চেয়ে বিনোদনমূলক এবং আনুষ্ঠানিক কাজে বেশি ব্যবহারের প্রমাণ মেলে। আইস-লা-চ্যাপেলের শান্তি চুক্তি উদযাপনের জন্য ১৭৪৯ সালে, জর্জ ফ্রিডেরিক হ্যান্ডেল রচনা করেন মিউজিক ফর রয়েল ফায়ারওয়ার্ক্স, যা আগের বছর, ১৭৪৮ এ বছর ঘোষণা করা হয়েছিল।উনিশ শতক এবং আধুনিক রসায়ন আবিষ্কারের পূর্বে আতশবাজি ছিল তুলনামূলক নিস্তেজ এবং মৃদু।১৭৮৬ সালে বার্থোলেট আবিষ্কার করে যে পটাশিয়াম ক্লোরেটের সাথে জারণের ফলে বেগুনী রঙ তৈরি করা সম্ভব। পরবর্তীতে আবিষ্কৃত হয় যে বেরিয়াম, স্ট্রন্টিয়াম, তামা এবং সোডিয়ামের ক্লোরেটের সাথে জারণগুলির ফলেও উজ্জ্বল বর্ণ বিশিষ্ট ফুলকি সৃষ্টি হয়। ধাতব ম্যাগনেসিয়াম এবং অ্যালুমিনিয়ামের [আইসুলেশন] আরও একটি যুগান্তকারী আবিষ্কার হিসাবে চিহ্নিত হয় কারণ এই ধাতুগুলিো তীব্র রৌপ্য আলো উৎপন্ন করতে পারত।

আতশবাজিতে ব্যবহৃত উপাদান

আতশবাজির গুলিতে রঙগুলি সাধারণত 'পাইরোটেকনিক স্টার' দ্বারা উৎপন্ন হয় – বলে এদের 'স্টার (তারা)' বলে ডাকা হয় - যা জ্বললে তীব্র আলো তৈরি করে। তারার মধ্যে পাঁচটি মৌলিক ধরনের উপাদান রয়েছে.

  • একটি জ্বালানী
  • একটি অক্সাইড—এমন একটি যৌগ যা জ্বালানীর সাথে যুক্ত হয়ে উচ্চ মাত্রায় তাপ উৎপাদন করতে পারে
  • রঙ- প্রডাক্টিং সল্ট (যেহেতু জ্বালানীর নিজিস্ব রঙ নেই)
  • একটি মোড়ক যা সব গুলো উপাদানকে একসাথে ধরে রাখতে সক্ষম।

আরও কিছু সাধারণ পাইরোটেকনিক কলারেন্ট (রঙ-উত্পাদনকারী যৌগ) এখানে সারণীযুক্ত রয়েছে। ফায়ারওয়ার্কে ব্যবহৃত যৌগের রঙ, একই রঙের শিখা পরীক্ষা এর বর্ণের মতো হবে। রঙিন শিখা তৈরি করে এমন যৌগই কিন্তু আতশবাজির রঙ করার ক্ষেত্রে উপযুক্ত নয়। তবে আইডিয়াল কালারান্টগুলি খাঁটি, তীব্র বর্ণের সৃষ্টি করতে সক্ষম।স্পার্ক (অগ্নিস্ফুলিঙ্গ) এর রঙ লাল / কমলা, হলুদ / সোনালি এবং সাদা / রূপাতে সীমাবদ্ধ। দ্যুতিময় যেকোনো যৌগের আলোক নির্গমন পরিক্ষার মাধ্যমে যা বর্ণনা করা সম্ভব।[১৭] ধতব যৌগ থেকে নির্গত আলোককে কৃষ্ণ বিকিরণ বলে। এছাড়া নিম্ন স্ফুটনাংক বিশিষ্ট ধাতু সমূহ ঘন-সন্নিবেশিত আলো উৎপন্ন করতে পারে।[১৮] এটি ধাতুর দহন সংক্রান্ত বৈশিষ্ট্যের দরুন হয়ে থাকে।

রঙধাতুযৌগের উদাহরণ
লালস্ট্রন্টিয়াম (তীব্র লাল)

লিথিয়াম (মাঝারি লাল)

SrCO3 (স্ট্রোটিয়াম কার্বনেট)

Li2CO3 (লিথিয়াম কার্বনেট)LiCl (লিথিয়াম ক্লোরাইড)

কমলাক্যালশিয়ামCaCl2 (ক্যালসিয়াম ক্লোরাইড)
হলুদসোডিয়ামNaNO3 (সোডিয়াম নাইট্রেট)
সবুজবেরিয়ামBaCl2 (বেরিয়াম ক্লোরাইড)
নীলতামা হ্যালিড সমূহCuCl2 (কপার ক্লোরাইড), নিম্নতাপে
বেগুনী নীলবর্ণসিজিয়ামCsNO3 (সিজিয়াম নাইট্রেট)
বেগুনীপটাশিয়াম

রুবিডিয়াম (ভায়োলেট-লাল)

KNO3 (পটাশিয়াম নাইট্রেট)

RbNO3 (রুবিডিয়াম নাইট্রেট)

সোনালীকাঠকয়লা, লোহা, বা ল্যাম্পব্ল্যাক
সাদাটাইটানিয়াম, অ্যালুমিনিয়াম, বেরিলিয়াম, বা ম্যাগনেসিয়াম গুঁড়ো

তথ্যসূত্র

🔥 Top keywords: রাম নবমীমুজিবনগর দিবসপ্রধান পাতামুজিবনগর সরকারবিশেষ:অনুসন্ধানইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগএক্স এক্স এক্স এক্স (অ্যালবাম)বাংলাদেশবাংলা ভাষামিয়া খলিফারাজকুমার (২০২৪-এর চলচ্চিত্র)আনন্দবাজার পত্রিকাআবহাওয়ারামপহেলা বৈশাখউয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগইসরায়েলইরানরবীন্দ্রনাথ ঠাকুরমুজিবনগরইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউনরিয়াল মাদ্রিদ ফুটবল ক্লাব২০২৪ ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগক্লিওপেট্রাচর্যাপদভূমি পরিমাপশেখ মুজিবুর রহমানজনি সিন্সকাজী নজরুল ইসলামঈদুল আযহাফিলিস্তিনইউটিউবভারতবিকাশআসসালামু আলাইকুমসৌদি আরববাংলা প্রবাদ-প্রবচনের তালিকামুহাম্মাদ