ইসলামি শিল্প

ইসলামি শিল্প হল সেই সকল মানুষ দ্বারা সৃষ্ট দৃশ্যমান শিল্প যারা খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতাব্দী হতে কোন মুসলিম মুসলিম বসবাস করছে অথবা মুসলিম শাসক দ্বারা শাসিত কোন বসতিতে বসবাস করেছে।[১] এটা খুবই জটিল শিল্প কারণ কারণ এই শিল্পের বিস্তৃতি অনেক বেশি ছড়ানো এবং নানান দেশের মুসলিম ১৪০০ বছর ধরে এই শিল্পের চর্চা করছে; এটা শুধু একটা বিশেষ গোষ্ঠীর শিল্প নয়, এটা কোন বিশেষ সময়ের শিল্প নয়, অথবা কোন জায়গা বা আঁকা আঁকির মতো নির্দিষ্ট গন্ডির শিল্প নয়।[২] এই শিল্পের প্রতিটি ক্ষেত্রই অনেক বিস্তৃত। ইসলামি স্থাপত্য যেমন অনেক বেশি বিস্তৃত ঠিক তেমনি ইসলামি ক্যালিওগ্রাফি, আঁকা আঁকি, গ্লাসে তৈরি কারুকাজ, ইসলামি মৃৃৎশিল্প, টেক্সটাইল শিল্পে কারুকাজ, ইসলামি এমব্রয়ডারি ইত্যাদি ক্ষেত্রের পরিসরও কম নয়।

স্পেনের আলহাম্বারায় আরবীয় নকশা
ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝিতে তৈরি, এখন পর্যন্ত অক্ষত সবচেয়ে সুন্দর পার্সিয়ান এরাবিল কার্পেট
ঝর্ণার কাছে শিকারীরা - রিজা আব্বাসি, ১৬২৫ খ্রিস্টাব্দ, ব্রুকলিন জাদুঘর

ইসলামি শিল্প শুধু একটা ধর্মীয় শিল্প নয়, এটা ধনী এবং সব ধরনের মুসলিম সমাজের একটি শিল্প। ধারাবাহিকভাবে অনেক পুরনো উপাদানকে এই শিল্প নিজের অন্তর্ভুক্ত করেছে, বিশেষ করে ইসলামি মৌলভিদের দ্বারা যা নিষিদ্ধ হয় নি।[৩] এখন পর্যন্ত যত ইসলামি শিল্পে যত ক্যালিওগ্রাফি পাওয়া গেছে সেসবে ধর্মীয় দিকটি খুব বেশি গুরুত্ব পায়নি। বরং প্রাধান্য পেয়েছে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির শিল্প। কিন্তু স্থাপত্য ক্ষেত্রে দেখা যায়, ধর্মীয় দিকটি স্থাপত্যে খুব বেশি প্রাধান্য পেয়েছে। নানারকম মসজিদ এবং এর সমতুল্য অন্যান্য বস্তুগুলো যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। বিশেষ কিছুর গঠন সম্পর্কিত ছবি কিছুটা ইসলামি ভাবধারা ফুটিয়ে তুললেও, প্রাসাদের দেয়াল, কবিতার বইয়ে ইসলামি ভাবধারা ততটা ফুটে উঠে না। পবিত্র কুরআনের আয়াত এবং ইসলামি ক্যালিগ্রাফি এই শিল্পের প্রধান উপজীব্য বিষয় হলেও, এই শিল্পের অন্যান্য ক্ষেত্রগুলো যেমন মসজিদের বাতির কাঁচে, কাঠের কারুকাজে, মসজিদের টাইলস, কার্পেটে এসব বিষয়গুলো স্থান পেয়েছে সমসাময়িক ভাবধারার সাথে মিশ্রিত হয়ে যেখানে ইসলামি মুদ্রিত অংশ বা ভাবধারা বেশি প্রাধান্য পায়।

"ইসলামি শিল্প বিভিন্ন উৎস থেকে উন্নতি লাভ করেছে: রোমান, সাম্প্রতিক খ্রিষ্টীয় শিল্প, বাইজানটাইন শিল্পগুলো ইসলামি শিল্পে সম্প্রতি প্রভাব বিস্তার করেছে; ইসলামি পারস্যের আগে যে সাসানিয়ান শিল্প ছিল, সেই শিল্পের প্রভাবও ইসলামি শিল্পে কম নয়; এছাড়া মধ্য এশিয়ার শিল্পের প্রভাবগুলো হটাৎ করেই এলোপাথারি ভাবে ইসলামি শিল্পে প্রভাব বিস্তার করেছে। এছাড়া আঁকাআঁকি, পটারি বা টেক্সটাইলে চায়নিজ শিল্পের প্রভাব কম নয়।"[৪]এতো বৈচিত্র‍্যের পরেও "ইসলামি শিল্প"কে এখনকার ঐতিহাসিকরা বলেন[৫] "কল্পিত উদ্ভাবন"[৬] বা শুধু "দৃষ্টিভ্রমকারী" ইউরোপকেন্দ্রিক চিন্তা,[৭] বিশেষ করে ইসলামি স্বর্ণযুগে, বিভিন্ন সময় এবং বিভিন্ন জায়গায় যত ইসলামি শিল্পের সৃষ্টি হয়েছে, সেসব শিল্পগুলোই "মরীচিকা" শব্দটি ব্যবহারের জন্য যথেষ্ট।[৮]

ইসলামি শিল্পে একই নকশা বারবার ব্যবহৃত হতে পারে। যেমন জ্যামিতিক ফুল বা লতাপাতার নকশা বার বার ব্যবহৃত হয় যেগুলোকে বলা হয় অ্যারাবিস্ক। এটি ঈশ্বরের অদ্বিতীয়তা, অসীমতাকে নির্দেশ করে।[৯] অনেক সময় এ নকশাগুলোর বার বার ব্যবহার বাঁধাগ্রস্ত হয়। অনেক শিল্পী ইচ্ছে করেই এই বাঁধা সৃষ্টি করেন। কারণ তারা বিশ্বাস করেন একমাত্র ঈশ্বরই সূক্ষতা সৃষ্টি করতে পারেন, যদিও এই বিষয়ে মতভেদ রয়েছে।[১০][১১][১২]

পুরোপুরি ভাবে না হলেও ইসলামি শিল্পে মূলত জ্যামিতিক নকশা, লতাপাতার নকশা এবং আরবীয় ক্যালিওগ্রাফি বেশি প্রতিফলিত হয়। কারণ অনেক মুসলিমই মনে করেন মানব শরীরের আকার আকৃতির নকশা একটি খারাপ কাজ।[১৩] কারণ এটি একটি পাপ, যেহেতু, পবিত্র কোরআনে এ সম্পর্কে নিষেধ রয়েছে। অবশ্য ইসলামি শিল্পের প্রায় প্রতিটা যুগেই মানুষের ছবি খুঁজে পাওয়া যায়। বিশেষ করে ছোট খাট ক্ষেত্রগুলোতে। পূজার ক্ষেত্রে মানব আকৃতির ব্যবহার ইসলামি আইনে এটি সম্পূর্ণ ভাবে নিষিদ্ধ যা "শরীয়া" নামে পরিচিত।[১৪][১৫][১৬] ইসলামি শিল্পে, অনেক আগে থেকেই ছোট প্রাণী এবং মানুষ খুঁজে পাওয়া যায়, বিশেষ করে শিকারের ছবি। তবে পোট্রেইট এর নিদর্শন খুব বেশি তৈরি হয়নি।

শিল্প

সেলিমিয়া মসজিদের গম্বুজের ভিতরের অংশ; এদির্নে, তুরস্ক। (ইসলামী শিল্পকলায় আলংকারিক শিল্পের ক্ষেত্রে এর গুরুত্বপূর্ণ স্থান রয়েছে।)

ইসলামী শিল্পসমূহ ইসলামী সংস্কৃতির একটি বড় অংশ গঠন করে।[১৭] ইসলামী শিল্প(সমূহ) শব্দটি একটি অপেক্ষাকৃত নতুন শব্দ। এই শব্দটি প্রথম আধুনিক যুগে ব্যবহৃত হয়েছিল।[১৭] এর আগে, ইসলামী শিল্পকর্মগুলোকে সাধারণত তাদের নির্দিষ্ট ধরন বা শৈলীর দ্বারা উল্লেখ করা হত। তাই, সাধারণভাবে এটিকে একটি আধুনিক ধারণা হিসাবে বিবেচনা করা যেতে পারে। এই শব্দের দ্বারা বোঝানো হয় ইসলামী ভূখণ্ডে উৎপাদিত, ইসলামী সংস্কৃতির ছাপ বহনকারী শিল্পকর্মকে। ইসলামী শিল্পের মধ্যে রয়েছে স্থাপত্য, ভাস্কর্য, চিত্রকলা, অলংকার, কারুশিল্প, এবং অন্যান্য শিল্পকলার বিভিন্ন শাখা। ইসলামী শিল্পসমূহ ইসলামী বিশ্বাস, ঐতিহ্য, এবং সংস্কৃতির প্রতিফলন ঘটায়। এসব শিল্পকর্ম অবশ্যই মুসলমানদের জন্য বা মুসলমানদের দ্বারা তৈরি হওয়ার প্রয়োজন নেই। ইসলামী শিল্প বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধর্মীয় এবং জাতিগত গোষ্ঠীর মানুষের দ্বারা তৈরি হয়েছে।[১৭] ঐতিহাসিক মুসলিম শিল্পীদের দ্বারা আধুনিক যুগে ইসলামী শিল্পকে ধর্মীয় নয় বরং জাতীয় শিল্পের দিক থেকে মূল্যায়ন করা হয়েছে। কিছু লোক বিশ্বাস করে যে, ইসলামী শিল্পকে তার ধর্মীয় প্রেক্ষাপটে বোঝা উচিত, অন্যরা বিশ্বাস করে যে, এটিকে তার জাতিগত বা সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে বোঝা উচিত।[১৭] এই ধারণাটি সাধারণত ভুল বলে মনে করা হয়। কেননা, ইসলামিক শিল্প সাধারণত ইসলামী বিশ্বাসের প্রতিফলন ঘটায়।[১৭] শিল্পগুলো অনেক জাতিগত গোষ্ঠীর অবদানের ফলাফল হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে। ইসলামী শিল্পের বিকাশে বিভিন্ন জাতিগত গোষ্ঠীর অবদান রয়েছে। সেই সময়গুলোতে ইসলামী ভূখণ্ডে বসবাসকারী নাগরিকদের আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। এই কারণে, আজ অনেক ঐতিহাসিক ইসলামী শিল্পীর বাসস্থান ও অঞ্চল দেখে তাদের জাতিগত উৎপত্তি জানা খুব কঠিন।[১৭]

আলহামরা প্রাসাদ (গ্রানাডা, স্পেন) যা কর্দোবা খিলাফতের সময়ে নির্মিত হয়।

ইসলাম ধর্মে, আল্লাহকে মানুষের মতো কল্পনা করা নিষিদ্ধ। ইসলামে আল্লাহকে "লা শারিকা লাহু" বলা হয়, যার অর্থ "তার কোনো শরিক নেই"। অর্থাৎ, আল্লাহ এক এবং অদ্বিতীয়। তিনি মানুষের মতো নন। তাই তাঁর কোনো রূপ বা ছবি বা মূর্তি বা প্রতিকৃতি তৈরি করাও নিষিদ্ধ (হারাম)। এই কারণে ইসলাম ধর্মে খ্রিস্টধর্মের মতো কোনো ধর্মীয় চিত্রকলার ঐতিহ্য গড়ে ওঠেনি।[১৭] খ্রিস্টধর্মে, যীশুখ্রিস্টকে মানুষের মতো কল্পনা করা হয়। তাই খ্রিস্টধর্মে, যীশুখ্রিস্টের ছবি এবং মূর্তি তৈরি করা হয়। ইসলাম ধর্মে নবী-রাসূলদের দেবত্ব দেওয়া নিষিদ্ধ[১৭] তাই নবী-রাসূলদের ছবিও ধর্মীয় দিক থেকে অপ্রয়োজনীয়। ইসলামি বিশ্বাসানুসারে, নবী-রাসূলরা হলেন আল্লাহর প্রেরিত মানুষ। তারা মানুষ ছিলেন, দেবতা নয়। তাই তাদের ছবি তৈরি করার কোনো প্রয়োজন নেই। ইসলাম ধর্মে পৌত্তলিকতাকে ঘৃণার চোখে দেখা হয়। পৌত্তলিকতায় মানুষের তৈরি মূর্তি বা ছবিকে পূজা করা হয়। তাই ইসলাম ধর্মে, বিশেষ করে ৭ম শতাব্দীর প্রথম দিকে, শিল্পের প্রতি মুসলমানদের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল নেতিবাচক।[১৮] এই সময়ে, ইসলাম ধর্ম খুবই নতুন ছিল। মুসলমানরা পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে লড়াই করছিল। তাই তারা শিল্পকে পৌত্তলিকতার সাথে যুক্ত করত। তবে, কুরআনে শিল্পের বিরুদ্ধে কোনো সরাসরি নিষেধাজ্ঞা নেই। তাই পরবর্তী শতাব্দীতে, বিশেষ করে নতুন করে জয় করা অঞ্চলে, ইসলামিক ধারণা এবং প্রতীকগুলোর সাথে স্থানীয় শিল্প ঐতিহ্যগুলো সংমিশ্রণের ফলে, বিশেষ করে ইরানের অঞ্চলে, মুহাম্মাদসহ অন্যান্য নবী-রাসূলদের ছবি তৈরি করা হয়েছে।[১৭][১৯] তবে, এই ছবিগুলো ধর্মীয় উদ্দেশ্যে নয়, বরং ঐতিহাসিক উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়েছে। অর্থাৎ, এই ছবিগুলো মুহাম্মাদ এবং অন্যান্য নবী-রাসূলদের জীবন এবং কর্ম সম্পর্কে তথ্য প্রদান করার জন্য তৈরি করা হয়েছে।[১৭]

১৫০৭ সালের একটি চিত্রকর্ম যা লায়লী-মজনুর গল্পকে চিত্রিত করে।

পশ্চিমা বিশ্বে, চিত্রকলা এবং ভাস্কর্য, শিল্পের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রূপগুলোর মধ্যে রয়েছে। তবে ইসলামে, এই রূপগুলোকে প্রায়ই শিরক বা ঈশ্বরের প্রতিনিধিত্ব করার মতো বিবেচনা করা হয়। এই কারণে, ইসলামি শিল্পে এই রূপগুলোর পরিবর্তে অন্যান্য রূপগুলোর উপর জোর দেওয়া হয়েছে।[১৭] উদাহরণস্বরূপ, ইসলামি শিল্পে কাঠ, ধাতবশিল্প, আলংকারিক শিল্প, পোড়ামাটির শিল্প এবং কাচের শিল্প খুব জনপ্রিয়। এই শিল্পগুলো প্রায়শই জ্যামিতিক এবং প্রতিসম নকশাগুলো ব্যবহার করে তৈরি করা হয়। এই নকশাগুলো আল্লাহর সৃষ্টির জটিলতা এবং সৌন্দর্যকে প্রতিফলিত করে। ইসলামি শিল্পে ক্যালিগ্রাফিও একটি গুরুত্বপূর্ণ রূপ। কুরআন এবং অন্যান্য ইসলামিক পাঠ্যগুলো প্রায়শই ক্যালিগ্রাফিতে লেখা হয়।[১৭] ক্যালিগ্রাফি শিল্পীরা কুরআনের শব্দগুলোকে সুন্দর এবং বর্ণময় উপায়ে লিখতে এসব ব্যবহার করে।[১৮] এই লাইনগুলো ইসলামি শিল্পের বৈচিত্র্য এবং সৌন্দর্যের উপর জোর দেয়। ইসলামি শিল্প শুধুমাত্র চিত্রকলা এবং ভাস্কর্য থেকে বিরত নয়, এটি একটি অনন্য শৈলী যা বিশ্বের অন্য কোথাও পাওয়া যায় না।[১৭][২০]

ইস্তাম্বুলের সুলায়মানি মসজিদের আঙিনায় কিছু ক্যালিগ্রাফি

ইসলামী শিল্পে বাস্তবধর্মী চিত্রকর্মকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, তাই শিল্পীরা কল্পনাপ্রসূত শৈলীর মিনিয়েচার শিল্পকে বিকশিত করেছিলেন। মিনিয়েচার শিল্প হলো ছোট ছোট ছবির শিল্প, যা প্রায়ই পাতায় আঁকা হয়। ইসলামী মিনিয়েচার শিল্পে প্রায়ই উদ্ভিদ, প্রাণী এবং মানুষের চিত্রকর্ম দেখা যায়।[১৯] হস্তলিপি (চারুলিপি) ইসলামী শিল্পের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। হস্তলিপিতে সুন্দর করে লেখা হয় এবং এটি প্রায়ই ধর্মীয় পাঠ্য বা কবিতার জন্য ব্যবহার করা হয়। ইসলামী সমাজে, চিত্রকর্ম নিষিদ্ধ ছিল, তাই হস্তলিপি আরও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।[২১] তৈজস শিল্প হলো হস্তলিপির সাথে সম্পর্কিত একটি আলংকারিক শিল্প। তৈজস শিল্পে প্রায়ই সোনা, রূপা এবং অন্যান্য মূল্যবান পাথরের ব্যবহার করা হয়। তৈজস শিল্প প্রায়ই কুরআনের নুসখাগুলোকে সজ্জিত করতে ব্যবহৃত হয়।[১৭][১৮]

ত্রয়োদশ শতাব্দীর একটি সিরীয় এবং মিশরীয় মার্জিত বীকার যাকে ইডেনহলের সম্ভাবনা বলা হয়। বিকারটি মধ্যযুগ থেকে ইংল্যান্ডে রয়েছে।

ইসলামিক শিল্পের মধ্যে স্থাপত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান রয়েছে। ইসলামের শুরুর দিকে, মক্কা এবং মদিনা, যেখানে ইসলামের বিকাশ ঘটেছিল, সেখানকার স্থাপত্য খুব উন্নয়নশীল ছিল না। ইসলামী রাষ্ট্রের শাসন সালতানাতের রূপ নেওয়ার পর স্থাপত্যের বিকাশ ঘটে।[২২] বিশেষ করে, এই সময়ের মধ্যে মসজিদ, মাদ্রাসা, প্রাসাদ, সেতুক্যারাভানসরাই নির্মাণের মাধ্যমে স্থাপত্যের বিকাশ ঘটে। ইসলামের নিজস্ব উপাসনালয় মসজিদের স্থাপত্য, বিশেষ করে ইসলামী স্থাপত্যের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। প্রথম বিজিত ভূখণ্ডে, বিশেষ করে সিরিয়ার মতো জায়গায়, গির্জাগুলোকে মসজিদে রূপান্তরিত করা হয়েছিল।[২২] তবে, পরে নতুন বিজিত ভূখণ্ডে এবং নতুন প্রতিষ্ঠিত শহরগুলোকে মুসলমানরা মসজিদ নির্মাণ শুরু করে। বিভিন্ন জলবায়ু এবং জাতিগত সংস্কৃতির প্রভাবের কারণে মসজিদের স্থাপত্য অঞ্চল থেকে অঞ্চলে ভিন্ন হয়।[১৮] এই ধরনের ধর্মীয় স্থানের স্থাপত্যতে চিত্র বর্ণনায় খুব একটা স্থান দেওয়া হয় না। এর পরিবর্তে, সেখানে আলংকারিক, প্রায়ই জ্যামিতিক ও আরবিস্ক ধরনের সজ্জা রয়েছে। ধর্মীয় নয় এমন স্থানের স্থাপত্যতে চিত্র বর্ণনায় স্থান দেওয়া হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, বিশেষ করে পুরানো হামামে এবং প্রাসাদে এটি দেখা যায়। তবে, ধর্মীয় স্থানের তুলনায় ধর্মীয় নয় এমন স্থানগুলো সময়ের সাথে সাথে ততটা ভালভাবে সংরক্ষণ করা হয়নি।[২৩] ইসলামী স্থাপত্যে জ্যামিতিক সজ্জা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই সজ্জাটি প্রায়ই মসজিদের দেয়ালে, মেঝেতে এবং ছাদে দেখা যায়। জ্যামিতিক সজ্জা প্রায়ই ইসলামিক ধর্মীয় বিশ্বাসের সাথে যুক্ত। উদাহরণস্বরূপ, অনেক মুসলমান বিশ্বাস করেন যে মহাবিশ্ব একটি সুন্দর এবং পরিকল্পিত ব্যবস্থা এবং জ্যামিতিক সজ্জা এই ধারণাকে প্রতিফলিত করে। আরবিস্ক হলো একটি জটিল সজ্জামূলক শৈলী যা আরবি লিপির উপর ভিত্তি করে। আরবিস্ক ইসলামী স্থাপত্যে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়।[১৮] আরবিস্ক প্রায়ই মসজিদের দেয়ালে, মেঝেতে এবং ছাদে দেখা যায়। এটি প্রায়ই অন্যান্য সজ্জা উপাদানের সাথে একত্রিত হয়। ইসলামী স্থাপত্যে আরেকটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো এর মিনারমিনার হলো ইসলামী স্থাপত্যের একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য। মিনারগুলো মসজিদের একটি উঁচু কাঠামো যা মুয়াজ্জিনরা নামাজের জন্য আহ্বান জানানোর জন্য ব্যবহার করেন। মিনারগুলো প্রায়ই মসজিদের মিহরাব বা নামাজের দিকে নির্দেশ করে নির্মিত হয়। গম্বুজ, কলাম এবং গেটওয়ে হল ইসলামী স্থাপত্যে ব্যবহৃত অন্যান্য সাধারণ উপাদান। গম্বুজগুলো প্রায়ই মসজিদের ছাদে দেখা যায়। কলামগুলো প্রায়ই মসজিদের ভিতরে এবং বাইরে পাওয়া যায়। গেটওয়েগুলো প্রায়ই মসজিদ এবং অন্যান্য ইসলামী ভবনগুলোতে দেখা যায়। ইসলামী স্থাপত্য বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে এবং বিভিন্ন সংস্কৃতির উপর প্রভাব ফেলেছে। ইসলামী স্থাপত্য আফ্রিকা, এশিয়া, ইউরোপ এবং আমেরিকা জুড়ে পাওয়া যায়। ইসলামী স্থাপত্য অন্যান্য সংস্কৃতির স্থাপত্যের উপরও প্রভাব ফেলেছে। উদাহরণস্বরূপ, ইসলামী স্থাপত্যের জ্যামিতিক সজ্জা এবং আরবিস্ক পশ্চিমা স্থাপত্যে প্রভাব ফেলেছে।[১৭]

সুলতান আহমেদ মসজিদ (ইস্তাম্বুল, তুরস্ক), এর আঙ্গিনা এবং মিনার সহ, ১৬০৯-১৭ সালের মধ্যে উসমানীয় সুলতান প্রথম আহমেদ দ্বারা নির্মিত।

ইসলামি শিল্পকলার ক্ষেত্রে বস্ত্র-ভিত্তিক শিল্পগুলোও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।[১৭][১৮] ইসলামী শিল্পকলায়, বস্ত্র শিল্পের মধ্যে রয়েছে কার্পেট, কাপড়, রুমাল এবং অন্যান্য বস্ত্র পণ্য। এই দ্রব্যগুলো বিভিন্ন ধরনের নকশা এবং কৌশল দ্বারা তৈরি করা হয়েছিল, যা ইসলামী শিল্পের বৈচিত্র্য এবং সৌন্দর্যের একটি অনন্য উদাহরণ প্রদর্শন করে। বস্ত্র উৎপাদন বাণিজ্যিকভাবেও একটি বড় আয়ের উৎস ছিল।[১৭][১৮] ইসলামী বিশ্বে, বস্ত্র একটি গুরুত্বপূর্ণ রপ্তানি পণ্য ছিল। বিভিন্ন ধরনের কাঁচামাল ব্যবহার করে বস্ত্র উৎপাদন করা হত, যার মধ্যে ছিল তুলা, রেশম, এবং উল। ইসলামী বিশ্বে বিভিন্ন ধরনের বস্ত্র পণ্য তৈরি করা হত। এই পণ্যগুলো বিভিন্ন শৈলী এবং কৌশল দ্বারা তৈরি করা হত, যার মধ্যে রয়েছে বুনন, সেলাই এবং খোদাই[১৮] মধ্যযুগে গির্জায় পোপদের হাড় রাখার জন্য ব্যবহৃত বেশিরভাগ খোদাই করা কাপড়গুলো ইসলামী অঞ্চল থেকে এসেছিল। এই কাপড়গুলো তাদের সুন্দর নকশা এবং উচ্চমানের জন্য বিখ্যাত ছিল। আজও মধ্যযুগীয় ইসলামী কাপড়গুলো তাদের সৌন্দর্য এবং শিল্পমানের জন্য প্রশংসিত হয়।[১৭]

ক্যালিওগ্রাফি

১৫'শ শতকের সমরকন্দের অ্যারাবিস্ক সিরামিক প্যানেলের একটি অংশ

ক্যালিওগ্রাফিক নকশা ইসলামি শিল্পে প্রায় সর্বক্ষেত্রেই দৃশ্যমান। বিশেষ করে মধ্যযুগের ইউরোপে, নানারকম মুদ্রায়, টাইলস, ধাতব শিল্পে এবং ছোট খাট চিত্রে যেখানে পবিত্র কুরআনের আয়াত রয়েছে বা কোন স্থাপত্যে, সেসব ক্ষেত্রগুলোতে এই ক্যালিওগ্রাফির ব্যবহার অনেক বেশি। ইসলামি ক্যালিওগ্রাফির ব্যবহার ইসলামি দিক থেকে সরে এসে আরো নানান ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন পবিত্র কুরআনের চায়নিজ ক্যালিওগ্রাফির ব্যবহার গ্রেট মস্কিউ অব জিয়ানে খুব ভালোভাবে ফুটে উঠেছে।[২৪] এছাড়াও কবিতার চরণের ক্ষেত্রে, অথবা রেকর্ডিং বা ডোনেশনের ক্ষেত্রেও এই ক্যালিওগ্রাফির ব্যবহার রয়েছে। ক্যালিওগ্রাফির ব্যবহার অনেক রকম ভাবে ঘটেছে এর মধ্যে দুটি প্রধান ক্ষেত্র হল "কুফিক" এবং "নাস্ক", যেগুলো নানারকম দেয়াল এবং ধাতব জিনিসপত্র বা মিনারসমূহতে দেখা যায়।[৯] আঁকা আঁকি কিংবা স্থাপত্যে ব্যবহৃত ইসলামি ক্যালিওগ্রাফিকে মাঝে মাঝে কুরআনিক শিল্প বলে অবহিত করা হয়।[২৫]

৯ম থেকে ১১তম শতাব্দীতে তৈরি পূর্ব পারস্যের তৈরি কিছু সিরামিক পাত্র দেখা যায় যেগুলোতে খুব বেশি পরিমাণে ক্যালিওগ্রাফি ফুটে উঠেছে। এগুলোকে বলা হয় মুদ্রিত পাত্র। এগুলোকে বলা হয়, "এই পাত্রগুলোই সম্ভবত পারস্যের তৈরি সবচেয়ে বেশি স্পর্শকাতর সিরামিক পাত্র"।[২৬] টাইলসে তৈরি বড় রকমের ক্যালিওগ্রাফি, মাঝে মুদ্রিত অক্ষরগুলো সামনের দিকে বেরিয়ে আসে, অথবা পেছনের অংশ কেটে ফেলা হয়, এই ধরনের ক্যালিওগ্রাফি সমূহ নানারকম বিখ্যাত ভবনের দরজা বা বের হওয়ার দরজায় দেখতে পাওয়া যায়। এছাড়া জটিল ভাবে মুদ্রিত ক্যালিওগ্রাফিও ভবন সাজানোর কাজে ব্যবহৃত হয়। বেশিরভাগ ইসলামি সময়ে, বিভিন্ন ইসলামি মুদ্রায় শুধুমাত্র অক্ষরই মুদ্রিত থাকত যদিও তাদের আকৃতি ছিল খুবই ছোট। অটোমান সুলতানদের মনোগ্রাম বা নিজস্ব চিহ্ন ব্যবহারের ক্ষেত্রেও ইসলামি ক্যালিগ্রাফির ব্যবহার দেখা যায়। একজন অটোমান সুলতান তার মনোগ্রামে এই ইসলামি ইসলামি ক্যালিওগ্রাফির ব্যবহার করেছিলেন যা অফিসিয়াল কাগজপত্রে বা অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কাগজে ব্যবহৃত হত। এছাড়াও নানাকরম অ্যালবাম, ছোট কবিতা অথবা কুরআনিক আয়াতে এই এর ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়।

ক্যালিওগ্রাফি তৈরি হয় মূলত আরবীয় অক্ষর দ্বারাই। এছাড়াও পারসিয়ান অক্ষর, তুরস্কের অক্ষর এবং অনেক পরে উর্দু, এসকল ভাষা দ্বারাও বর্তমনানে ক্যালিওগ্রাফি তৈরি হয়। ক্যালিওগ্রাফির মর্যাদা অন্যান্য চিত্রশিল্পির তৈরি শিল্প থেকেও অনেক বেশি।

চিত্র

নিজামির খামসা এর একটি দৃশ্য, পারস্য, ১৫৩৯-৪৩

যদিও দেয়াল চিত্রের একটি সুন্দর অতীত রয়েছে, তবুও ইসলামি বিশ্বে সবচেয়ে উন্নত এবং সবচেয়ে বেশি অক্ষত অবস্থায় রয়েছে মুদ্রিত অক্ষরসমূহই, বিশেষ করে ক্ষুদ্র কোন মুদ্রা বা এমন কোন ছোট আকৃতির বস্তুতে করা ক্যালিওগ্রাফি বা মুদ্রিত কোন অক্ষর। সুদূর ১৩শ শতাব্দী থেকে পারস্যের প্রচ্ছদগুলোই অনেক বেশি বিখ্যাত। এসকল প্রচ্ছদ গুলো অটোমান প্রচ্ছদ গুলোকে ফুটিয়ে তোলে এবং ভারতের মুঘল সম্রাজ্যের প্রচ্ছদসমূহকে। তবে এইসকল প্রচ্ছদ গুলো মূলত অফিস আদালতেই বেশি ব্যবহৃত হয়, কারণ স্বাভাবিক জীবনে এসকল শিল্পের খুব বেশি দেখা যায় না। এছাড়া একটি বিষয় নিয়ে অনেক মতানৈক্য রয়েছে যে মানুষের আকার আকৃতি অনেকটাই বেশি প্রচলিত চিত্রের ক্ষেত্রে। যদিও ছোট আকৃতির শিল্পগুলোতেও অনেক মানব আকার আকৃতি রয়েছে। বিশেষ করে ১৬শ শতাব্দী থেকে এর ব্যবহার অনেক বেড়েছে। যদিও অনেক আগের ছোট আকৃতির চিত্রে মানব মানব আকার আকৃতির ব্যবহার অনেক বেশি দৃশ্যমান। বিশেষ করে উম্মাদ ডিজার্ট প্রাসাদ (৬৬০-৭৫০) এবং আব্বাসিদ খলিফার আমল (৭৪৯-১২৫৮) এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ।[২৭]ইসলামি শিল্পে চিত্রের ব্যবহার সবচেয়ে বেশি দেখা যায় পারস্যের কবিতার বইয়ে।

তথ্যসূত্র

বহিঃসংযোগ

🔥 Top keywords: রাম নবমীমুজিবনগর দিবসপ্রধান পাতামুজিবনগর সরকারবিশেষ:অনুসন্ধানইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগএক্স এক্স এক্স এক্স (অ্যালবাম)বাংলাদেশবাংলা ভাষামিয়া খলিফারাজকুমার (২০২৪-এর চলচ্চিত্র)আনন্দবাজার পত্রিকাআবহাওয়ারামপহেলা বৈশাখউয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগইসরায়েলইরানরবীন্দ্রনাথ ঠাকুরমুজিবনগরইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউনরিয়াল মাদ্রিদ ফুটবল ক্লাব২০২৪ ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগক্লিওপেট্রাচর্যাপদভূমি পরিমাপশেখ মুজিবুর রহমানজনি সিন্সকাজী নজরুল ইসলামঈদুল আযহাফিলিস্তিনইউটিউবভারতবিকাশআসসালামু আলাইকুমসৌদি আরববাংলা প্রবাদ-প্রবচনের তালিকামুহাম্মাদ