নাটক

সাহিত্যের একটি বিশেষ ধরন

নাটক সাহিত্যের একটি বিশেষ ধরন। সাধারণত একটি লিখিত পাণ্ডুলিপি অনুসরণ করে অভিনয় করে নাটক পরিবেশিত হয়ে থাকে। নাটক লেখা হয় অভিনয় করার জন্য। তাই নাটক লেখার আগেই তার অভিনয় করার যোগ্য হতে হয়। নাটকে স্থান, সময় ও পরিবেশের বর্ণনা ছাড়াও সংলাপ লেখা থাকে। সংলাপ বলেই একজন অভিনেতা নাটকের বিভিন্ন বিষয়ে বলে থাকেন। তবে সংলাপই শেষ কথা নয়। সংলাপবিহীন অভিনয়ও নাটকের অংশ।

ভারতীয় নাটকের একটি দৃশ্য

প্রেক্ষাপট

সংস্কৃত আলঙ্কারিকগণ নাট্যসাহিত্যকে কাব্য সাহিত্যের মধ্যে স্থান দিয়েছেন। তাদের মতে কাব্য দুই প্রকার - দৃশ্য কাব্য ও শ্রব্য কাব্য। নাটক প্রধানত দৃশ্য কাব্য এবং এটি সকল প্রকার কাব্য সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ -

নাটক দৃশ্য ও শ্রব্যকাব্যের সমন্বয়ে রঙ্গমঞ্চের সাহায্যে গতিমান মানবজীবনের প্রতিচ্ছবি আমাদের সম্মুখে মূর্ত্ত করে তোলে। রঙ্গমঞ্চের সাহায্য ব্যতীত নাটকীয় বিষয় পরিস্ফুট হয় না। নাট্যোল্লিখিত কুশীলবগণ তাদের অভিনয়-নৈপুণ্যে নাটকের কঙ্কালদেহে প্রাণসঞ্চার করেন, তাকে বাস্তব রূপৈশ্বর্য্য দান করেন। নাটকে অনেক সময় পাত্র-পাত্রীদের কথায় নাট্যকার নিজের ধ্যান-ধারণার কথাও সংযোগ করে দেন। এইজন্য এটি সম্পূর্ণরূপে বস্তুনিষ্ঠ বা তন্ময় বা অবজেকটিভস্‌ না-ও হতে পারে। কিন্তু শ্রেষ্ঠ নাট্যকার নিজেকে যথাসাধ্য গোপনে রাখেন এবং তার চরিত্র-সৃষ্টির মধ্যে বিশেষ একটি নির্লিপ্ততা বর্তমান থাকে।[১]

সংস্কৃত নাটক

সংস্কৃত নাটকে দেখা যায় যে, প্রথমত পূর্বরঙ্গ বা মঙ্গলাচরণ, দ্বিতীয়তঃ সভাপূজা (সামাজিকগণের), তৃতীয়তঃ কবিসংজ্ঞা বা নাটকীয় বিষয়-কথন এবং তারপর প্রস্তাবনা। 'মঙ্গলাচরণে' সূত্রধর (তিনি জাতিতে ব্রাহ্মণ, সংস্কৃতজ্ঞ ও অভিনয়-পটু) রঙ্গভূমিতে উপস্থিত থেকে অভিনয়-কার্য্যের বিঘ্নপরিসমাপ্তির জন্য যে মঙ্গলাচরণ করেন তার নাম 'নান্দী'।

প্রস্তাবনার পর সাধারণতঃ প্রথম অঙ্ক আরম্ভ হয়। নাটকীয় কুশীলবগণ 'সূচিত' না হয়ে রঙ্গমঞ্চে প্রবেশ করতে পারে না। শুধু নায়ক বা আর্ত্ত যে-কোন চরিত্রের প্রবেশের জন্য সূচনার প্রয়োজন নেই। নাটকের ভাষায় গদ্যপদ্য উভয়ই ব্যবহৃত হয়। তবে, সংস্কৃত নাটকে বিদ্বানপুরুষ সাধারণতঃ সংস্কৃত, বিদুষী মহিলাগণ শৌরসেনী, রাজপুত্র ও শ্রেষ্ঠিগণ অর্দ্ধমাগধী, বিদূষক প্রাচ্যা এবং ধূর্ত্ত অবন্তিক ভাষা ব্যবহার করতেন।[১]

ঐক্যনীতি

সনাতনপন্থী নাট্যকারগণ নাটকে তিনটি ঐক্যনীতি মেনে চলতেন। সেগুলো হলোঃ-

  1. সময়ের ঐক্যঃ নাটকীয় আখ্যানভাগ রঙ্গমঞ্চে দেখাতে যতক্ষণ সময় লাগে, বাস্তব জীবনে সংঘটিত হতে যেন ঠিক ততক্ষণ লাগে, এদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। এরিস্টটল এই কাল-নির্দেশ করতে গিয়ে একে 'সিঙ্গেল রিভোলিউশন অব দ্য সান' অর্থাৎ ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সীমাবদ্ধ করেছেন।
  2. স্থানের ঐক্যঃ নাটকে এমন কোন স্থানের উল্লেখ থাকতে পারবে না, যেখানে নাট্য-নির্দেশিত সময়ের মধ্যে নাটকের কুশীলবগণ যাতায়াত করতে পারে না।
  3. ঘটনার ঐক্যঃ নাটকে এমন কোন দৃশ্য বা চরিত্র সমাবেশ থাকবে না, যাতে নাটকের মূল সুর ব্যাহত হতে পারে। সমস্ত চরিত্র ও দৃশ্যই নাটকের মূল বিষয় ও সুরের পরিপোষকরূপে প্রদর্শিত হওয়া চাই এবং নাটকটি যেন আদি, মধ্য ও অন্ত-সমন্বিত একটি অখণ্ডরূপে পরিস্ফুট হয়।

ইংরেজি সাহিত্যে বেন জনসন ঐক্যনীতি মেনে চলেছেন এবং শেক্সপিয়ার মাত্র দ্য টেম্পেস্ট এবং দ্য কমেডি অব এরর'স-এ এই নিয়ম মেনে চলেছেন। এইখানে উল্লেখযোগ্য যে, প্রাচীন সংস্কৃত নাটকে কাল, স্থান ও ঘটনার ঐক্য অনুঃসৃত হয়নি। ভবভূতির 'মহাবীর চরিত্রে' দ্বাদশবর্ষের ঘটনা নাট্যাকারে পরিবেশিত হয়েছে। চরিত্রে দ্বাদশবর্ষের ঘটনা নাট্যাকারে পরিবেশিত হয়েছে।[১]

নাটকের উপাদান

  • মূল ভাবনা বা প্রেমিজ: একটা নাটক তার দর্শককে কিছু বলতে চায়। নাট্যকার একটি ধারণাকে অবলম্বন করে একটি কাহিনি তৈরি করেন। কাহিনির মাধ্যমে তিনি তার ধারণাটিকে বলেন। তার এই মূল বক্তব্যটিই হল মূল ধারণা বা প্রেমিজ।
  • কাহিনি বা প্লট: নাটকে সাধারণত একটি ঘটনা থাকে। কাহিনির শুরু, মধ্য ও শেষ থাকে। এক বা একাধিক মানুষের বা চরিত্রের কাহিনি বর্ণিত হতে থাকে। প্রধান কাহিনির পাশাপাশি নাটকে উপ-কাহিনি বা সাব-প্লট থাকতে পারে। তবে উপ-কাহিনি প্রধান কাহিনিকে সহায়তা করে।
  • চরিত্র: নাটক যেই ব্যক্তিগুলোর কাহিনি বর্ণনা করে সেই ব্যক্তিগুলোই নাটকের চরিত্র। মূলত একটি নাটকে একজন প্রধান চরিত্র হয়। চরিত্রটি নাটকের শুরুতে যে রকম থাকে, নাটকের শেষে সে রকম থাকে না। ঘটনাপ্রবাহের প্রবাহে তার মধ্যে নানা রকম পরিবর্তন ঘটে।
  • সংলাপ: নাটকের চরিত্র বা পাত্রপাত্রী কথোপকথন আকারে যা বলে সেটাই সংলাপ। সোজা কথায়, নাটকের চরিত্রের মুখের কথাগুলোকেই সংলাপ বলে।

নাটকের শ্রেণিবিভাগ

নাটকের শ্রেণিবিভাগ কোনো বিশেষ বিষয়কে ভিত্তি করে করা হয়নি। নানারকম বিষয়বস্তু অনুসারে নাটককে নানাভাবে শ্রেণিবিভাগ করা হয়েছে। নাটকের শ্রেণিবিভাগগুলো এরকম:ক) ভাব সংবেদনা রীতি অনুসারে (০১) ট্রাজেডি (০২) কমেডি (০৩) ট্রাজি-কমেডি (০৪) মেলোড্রামা ও (০৫) ফার্স।
খ) বিষয়বস্তুর উৎসরীতি অনুসারে (০১) পৌরাণিক (০২) ঐতিহাসিক (০৩) ঐতিহাসিককল্প চরিত্রমূলক (০৪) সামাজিক (০৫) পারিবারিক (০৬) উপকথাশ্রয়ী ও (০৭) কাল্পনিক
গ) বিষয়বস্তুর প্রকৃতি অনুসারে (০১) ধর্মমূলক (০২) নীতিমূলক (০৩) আধ্যাত্মিক (০৪) রাজনৈতিক (০৫) অর্থনৈতিক (০৬) প্রেমমূলক (০৭) দেশপ্রেমমূলক (০৮) সমাজরীতিমূলক (০৯) ষড়যন্ত্রমূলক (১০) রোমাঞ্চকর দুঃস্বাহসমূলক ও (১১) অপরাধ আবিষ্কারমূলক প্রভৃতি
ঘ) উপাদানযোজনা বৈশিষ্ট্য অনুসারে (০১) গীতিনাট্য বা অপেরা (০২) যাত্রা (০৩) নৃত্যনাট্য (০৪) নাটক বা ড্রামা
ঙ) আয়তন বা অঙ্কসংখ্যা অনুসারে (০১) মহানাটক (০২) নাটক (০৩) নাটিকা (০৪) একাঙ্কিকা
চ) গঠন রীতি অনুসারে (০১) ক্লাসিক্যাল (০২) রোমান্টিক (০৩) দৃশ্যাবলী
ছ) রচনারীতি অনুসারে (০১) পদ্যনাটক (০২) গদ্যনাটক (০৩) গদ্য-পদ্যময় নাটক
জ) উপস্থাপনারীতি অনুসারে (০১) বাস্তবিক নাটক (০২) ভাবতান্ত্রিক নাটক (০৩) রূপক নাটক (০৪) সাংকেতিক নাটক (০৫) এক্সপ্রেশানিস্টিক নাটক
ঝ) উদ্দেশ্য অনুসারে (০১) ঘটনামূখ্য (মোলোড্রামা) (০২) চরিত্রমূখ্য (চরিত্রনাট্য) (০৩) রসমূখ্য (রসনাট্য) ও (০৪) তত্ত্বমূখ্য (তত্ত্বনাটক)

লোকনাট্য

সাধারণ মানুষের মধ্যে গল্পে গল্পে যে নাটক গড়ে ওঠে, সাধারণ মানুষের গল্প অবলম্বন করে যার কাহিনি আবর্তিত এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে কথ্যরীতিতে যে নাটক বেঁচে থাকে তাই লোকনাট্য।

তথ্যসূত্র

গ্রন্থপঞ্জি

বহিঃসংযোগ

🔥 Top keywords: রাম নবমীমুজিবনগর দিবসপ্রধান পাতামুজিবনগর সরকারবিশেষ:অনুসন্ধানইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগএক্স এক্স এক্স এক্স (অ্যালবাম)বাংলাদেশবাংলা ভাষামিয়া খলিফারাজকুমার (২০২৪-এর চলচ্চিত্র)আনন্দবাজার পত্রিকাআবহাওয়ারামপহেলা বৈশাখউয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগইসরায়েলইরানরবীন্দ্রনাথ ঠাকুরমুজিবনগরইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউনরিয়াল মাদ্রিদ ফুটবল ক্লাব২০২৪ ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগক্লিওপেট্রাচর্যাপদভূমি পরিমাপশেখ মুজিবুর রহমানজনি সিন্সকাজী নজরুল ইসলামঈদুল আযহাফিলিস্তিনইউটিউবভারতবিকাশআসসালামু আলাইকুমসৌদি আরববাংলা প্রবাদ-প্রবচনের তালিকামুহাম্মাদ