মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস

ইতিহাসের বিভিন্ন দিক

আনুমানিক ১৫০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে স্থানীয় আদিবাসী আমেরিকানদের উত্তর আমেরিকার ভূখন্ডে আগমনের মধ্য দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস শুরু হয়। সেখানে অনেক স্থানীয় কৃষ্টি ও সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল যার অধিকাংশ ষোলশতকের মধ্যে বিলুপ্ত হয়ে যায়। ১৪৯২ সালে ক্রিস্টোফার কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে সেখানে ইউরোপিয় ঔপনিবেশিক যুগের শুরু হয়। আমেরিকা মহাদেশের বেশীরভাগ উপনিবেশ ১৬০০ সালের পরে গড়ে উঠেছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীর ইতিহাসে একমাত্র উপনিবেশ যাদের উৎপত্তির বিস্তারিত বিবরণ সংরক্ষণ করা হয়েছে। [ক] ১৭৬০ সালে উত্তর আমেরিকার পূর্ব উপকূলে ২.৫ মিলিয়ন জনসংখ্যা নিয়ে তেরটি বৃটিশ কলোনি স্থাপিত হয়েছিল। ফ্রান্স ইন্ডিয়ান যুদ্ধে জয়লাভের পর বৃটিশ সরকার উপনিবেশের উপর বেশ কিছু কর ধার্য করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে সেখানে প্রতিবাদ শুরু হয়। ১৭৭৩ সালে বোষ্টন টি পার্টির প্রতিবাদের কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আন্দোলন দমনের জন্য বৃটিশ পার্লামেন্ট বিশেষ আইন পাশ করে। পরবর্তিতে ১৭৭৫ সালে এই আন্দোলন এক রক্তক্ষয়ি সংঘর্ষে রূপ নেয়। তবে সেখানের জনসংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে এবং তার চেয়েও বেশি হারে বৃদ্ধি পায় সেখানের অর্থনীতির আকার। ১৯৪০ সালের পূর্ব পর্যন্ত শান্তিকালিন সময়ে যুক্তরাষ্ট্র তখনো কোন উল্লেখযোগ্য সামরিক শক্তি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেনি।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভৌগোলিকভাবে বিস্তার

১৭৭৬ সালে ফিলাডেলফিয়ায় দ্বিতীয় মহাদেশীয় কংগ্রেস (Second Continental Congress) জেনারেল জর্জ ওয়াশিংটনের নেতৃত্বে উপনিবেশগুলোর স্বাধীনতা ঘোষণা দিয়ে নিজেদেরকে একত্রে “যুক্তরাষ্ট্র” হিসাবে ঘোষণা করে। বিপ্লবী যুদ্ধে তারা জয়লাভ করে। ১৭৮৩ সালে একটি শান্তিচুক্তির মাধ্যমে নতুন রাষ্ট্রগুলোর সীমানা নির্ধারণ করা হয়। কনফেডারেশনের শাসনপন্থা প্রণয়ন করা হয়।[২] সেই সাথে কেন্দ্রে প্রশাসনিক ক্ষমতা ও কর গ্রহণের সক্ষম নয় এমন একটি সীমিত ক্ষমতাসম্পন্ন সরকার গঠন করা হয়। ১৭৮৯ সালে একটি কনভেনশনের মাধ্যমে নতুন শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করা হয়। ১৭৯১ সালে তাতে ‘নাগরিক অধিকার’ সংযোজন করা হয়। একই সাথে জর্জ ওয়াশিংটনকে প্রেসিডেন্ট এবং জর্জ হ্যামিলটনকে তার প্রধান পরামর্শদাতা নির্বাচিত করে কেন্দ্রে একটি শক্তিশালী সরকার গঠন করা হয়। ১৮০৩ সালে ফ্রান্সের কাছ থেকে লুজিয়ানা টেরিটরি ক্রয় করার পর যুক্তরাষ্ট্রের আকার দ্বিগুন বৃদ্ধি পায়।

ভাগ্য প্রকাশের (manifest destiny) ধারনায় অনুপ্রাণিত হয়ে যুক্তরাষ্ট্র আরো পশ্চিমে প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূলের তার ভূখন্ড বিস্তৃত করতে থাকে। ১৭৯০ সালে সুবিশাল ভৌগোলিক এলাকার জনসংখ্যা ছিল মাত্র ৪ মিলিয়ন। দাস মালিক ও ইয়োমান কৃষকদের জন্য পশ্চিমের শস্তা জমি দেশটির পশ্চিমমূখি সম্প্রসারণের মূল চালিকা শক্তি ছিল। বিতর্কিত দাস প্রথার ব্যাপক বিস্তার ক্রমে অষোন্তস জন্ম দিতে থাকে। এক পর্য়ায়ে রাজনৈতিক ও শাসনতান্ত্রিক যুদ্ধ শুরু হয়। ১৮০৪ সালের মধ্যে মেসন -ডিক্সন লাইনের উত্তরে সমস্ত রাজ্যে দাস প্রথা বিলুপ্ত করা হয়। কিন্তু দক্ষিণে কৃষিকাজে বিশেষ করে তুলা উৎপাদনের জন্য এই প্রথা তখনো চালু ছিল।

১৮৬০ সালে আব্রাহাম লিংকন দাস প্রথার বিস্তাররোধ সমর্থিক একটি প্লাটফর্ম থেকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। দাসশ্রমের উপর নির্ভরশীল দক্ষিণের সাতটি রাষ্ট্র তখন বিদ্রোহ করে এবং কনফেডারেসির ভিত্তি প্রস্তুত করে। ১৮৬১ সালে একটি ফেডারেল দুর্গে আক্রমণের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। ১৮৬৫ সালে কনফেডারেটসের পরাজয়ের পর দাস প্রথার অবসান ঘটে। যুদ্ধ পরবর্তি পুনর্গঠনের সময়, মুক্ত দাসদের আইনগত অধিকার এবং ভোটাধিকার প্রদান করা হয়। কেন্দ্রে একটি শক্তিশালী জাতীয় সরকার গঠন করা হয়। সেই সরকারের মূল দায়িত্ব ছিল সকল নাগরিকের ব্যক্তি স্বাধীনতা রক্ষা করা। তবে এরপরে ১৮৭৭ সালে শ্বেতাঙ্গরা যখন দক্ষিণে তাদের ক্ষমতা ফিরে পাবার পর, আধাসামরিক ক্ষমতা প্রয়োগ করে নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখতে ‘জিম ক্রো’ আইন পাস করে, একই সাথে নতুন রাষ্ট্রীয় সংবিধানের মাধ্যমে বেশিরভাগ আফ্রিকান আমেরিকান এবং অনেক দরিদ্র শ্বেতাঙ্গদের ভোটাধিকারে বাধা প্রদান করা হয়।

উদ্যোক্তা, শিল্পায়ন এবং লক্ষ লক্ষ অভিবাসী শ্রমিক এবং কৃষকের আগমনের কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ শতকের শেষের দিকে বিশ্বের শীর্ষ শিল্প শক্তিতে পরিনত হয়। দেশজুড়ে একটি জাতীয় রেলপথ নেটওয়ার্ক নির্মিত হয় এবং বৃহৎ খনি এবং কারখানা প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৯০ থেকে ১৯২০ এর দশক পর্যন্ত দুর্নীতি, অদক্ষতা এবং পুরাতন ধারার রাজনীতির বিরুদ্ধে ব্যাপক অসন্তোষ ও প্রগতিশীল আন্দোলন শুরু হয়। যার ফলে ফেডারেল আয়কর, সিনেটরদের সরাসরি নির্বাচন, মদ নিষিদ্ধকরণ এবং মহিলাদের ভোটাধিকারসহ বেশ কিছু সংস্কার করা হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রথম দিকে নিরপেক্ষ থাকলেও, ১৯১৭ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং পরের বছর মিত্র বাহিনীর যুদ্ধে অর্থায়ন করে। ‘সমৃদ্ধ গর্জনশীল বিশ’ (Roaring Twenties) এর পর, ১৯২৯ সালের ওয়াল স্ট্রিট শেয়ার বাজারের ব্যাপক ধ্বস এক দশক যাবত বিশ্বব্যাপী মহামন্দার সূচনা করেছিল। প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট `নিউ ডিল' নামের একটি নতুন কর্মসূচি গ্রহণ করেন। এই কর্মসূচির মধ্যে ছিল, বেকার ও কৃষকদের সহায়তা দান, সামাজিক নিরাপত্তা বা সোসাল সিকিউরিটি এবং সর্বনিম্ন বেতন নির্ধারণ। এই কর্মসূচি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আধুনিক উদারবাদ (Modern liberalism) প্রতিষ্ঠা করেছিল। [৩] মার্কিন রণঘাঁটি পার্ল হারবার আক্রান্ত হবার পর ১৯৪১ দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে অংশ নিয়ে মিত্র শক্তিকে অর্থ সহায়তা প্রদান করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই ভূমিকা নাৎসী জার্মান ও ইটালির ফ্যাসিস্ট শক্তিকে পরাস্ত করতে বিশেষ ভূমিকা রাখে। যুদ্ধে মার্কিনদের অংশগ্রহণ চূড়ান্ত রূপ পায় যখন তারা জাপান সাম্রাজ্যের হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরে তাদের নতুন আবিষ্কৃত ‘আনবিক বোমা’ নিক্ষেপ করে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলাফল হিসাবে সোভিয়েত ইউনিয়ন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্ধী শক্তি হিসাবে আবির্ভূত হল। স্নায়ু যুদ্ধের সময় এই দুই পরাশক্তি, অস্ত্র প্রতিযোগিতা, মাহাকাশ, প্রচার প্রচারণা এবং কমিউনিস্ট সম্প্রসারণের বিরুদ্ধে স্থানীয় যু্দ্ধের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে পরস্পরের বিরুদ্ধে ঠান্ডা যুদ্ধে লিপ্ত হয়। ১৯৬০ এর দশকে, প্রবল নাগরিক অধিকার আন্দোলনের প্রভাবে, সামাজিক সংস্কারের আরেকটি দিক, আফ্রিকান আমেরিকান এবং অন্যান্য জাতিগত সংখ্যালঘুদের ভোটাধিকার এবং চলাচলের স্বাধীনতার সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত করেছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর শীতল যুদ্ধের অবসান হয় এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বে একমাত্র পরাশক্তি হিসাবে পরিগনিত হতে থাকে। শীতল যুদ্ধের অবসানের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতি মূলতঃ মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাব অক্ষুন্ন রাখার বিষয়টি অধিক প্রাধান্য পায়। বিশেষ করে ১১ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্ক হামলা এবং ইসলামিক স্টেটের মোকাবেলাই তাদের পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা বিষয়ক নীতিমালার মূল বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। ২১ শতকের শুরুতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি মন্দার কবলে পরে। পরবর্তীতে বিশ্বব্যাপী কোভিড-১৯ অতিমারীর কারনে এদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি অনেক মন্থর হয়ে পরে।

প্রাগৈতিহাসিক যুগ

এই মানচিত্রটিতে বরফমুক্ত করিডোর এবং নির্দিষ্ট প্যালিওইনডিয়ান সাইটগুলির আনুমানিক অবস্থান দেখা যাচ্ছে (ক্লোভিস তত্ব অনুসারে)।

ঠিক কবে আমেরিকার আদিবাসীরা সেখান প্রথম বসতি স্থাপন করেছিল সে ব্যাপারে নিশ্চিত করে কিছু বলা শক্ত। প্রচলিত তত্ব অনুসারে আদি ইউরেশিয়ার বাসিন্দারা শীকারের উদ্দেশ্যে বন্য জন্তুর পালকে অনুসরন করে আমেরিকা মহাদেশে এসে পৌছায়। সে সময় পৃথিবীতে বরফ যুগ চলতে থাকায় বেরিং প্রণালী সাইবেরিয়া এবং বর্তমান আলাস্কাকে সংযুক্ত করে রেখেছিল। যার ফলে মানুষ এশিয়া থেকে আমেরিকায় পায়ে হেঁটে চলে আসতে পেরেছিল, পরবর্তিতে তারা আরো দক্ষিনে চলে আসে। এই অভিবাসন ৩০,০০০ বছর থেকে ১০,০০০ বছর পূর্ব পর্যন্ত চলেছিল।[৪] বেরিং প্রণালীর স্থল সংযোগটি সমুদ্রে তলিয়ে যাওয়ার পর এই অভিবাসন বন্ধ হয়ে যায়।[৫][পূর্ণ তথ্যসূত্র প্রয়োজন] নতুন অভিবাসীরা খুব দ্রুত ভিন্ন ভিন্ন জাতি ও গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে যায়।

প্রাক কলম্বিয়ান যুগে আমেরিকার সাংস্কৃতি, কৃষ্টি এবং স্থাপনায় নিজস্ব ধরন পরিলক্ষিত হয়। ইউরোপিয় উপনিবেশকদের আগমনের পর সে সব প্রভাব ধীরে ধীরে কমতে থাকে। প্রাক কলম্বিয়ান যুগ বলতে ১৪৯২ সালের ক্রিষ্টোফার কলোম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের পূর্বের যুগকে বুঝালেও প্রকৃতপক্ষে শব্দটি দ্বারা আমেরিকার আদিবাসী সংস্কৃতিকে বোঝানো হয়। যে সংস্কৃতি কলোম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের অনেক দশক পরও, ইউরোপিয়দের দ্বারা সম্পুর্ণরূপে দখল হবার আগ পর্যন্ত টিকে ছিল।

প্রাক কলম্বিয়ান যুগ

একটি প্রোজেক্টাইল ক্লোভিস পয়েন্ট।

১০,০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে, আমেরিকার আদিবাসীরা সমগ্র উত্তর আমেরিকায় ছড়িয়ে পরে। প্যালিও-ইন্ডিয়ান জনগোষ্ঠী বরফ যুগে মূলত, বিশালাকায় প্রাণী ম্যামথ শীকার করতো। কিন্তু যখন ম্যামথ বিলুপ্ত হতে শুরু করল, তখন মানুষ খাদ্য উৎস হিসেবে বাইসনকে বেছে নিল। সময়ের সাথে সাথে, বেরি এবং খাদ্য বীজ সংগ্রহ শিকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিকল্প হয়ে ওঠে। প্রায় ৮,০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মধ্য মেক্সিকোতে প্যালিও-ইন্ডিয়ানরা আমেরিকার প্রথম কৃষি খামার তৈরী করেছিল। সেখানে তারা ভুট্টা, মটরশুটি এবং স্কোয়াশ রোপণ শুরু করেছিল। অবশেষে, কৃষি সম্পর্কে তাদের এই জ্ঞান, উত্তর দিকে ছড়িয়ে পড়ে। ৩০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে, হোহোকাম নগরীর প্রাচীন সেচ ব্যবস্থার পর, অ্যারিজোনা এবং নিউ মেক্সিকো উপত্যকায় ভুট্টা চাষ শুরু হয়। [৬][৭]

আমেরিকার প্রাচীন সংস্কৃতির মধ্যে অন্যতম হল ক্লোভিস সংস্কৃতি। প্রাথমিক ভাবে ছুঁচালো বল্লমের অগ্রভাগ থেকে এই সংস্কৃতিকে আবিষ্কার করা হয়। ৯,১০০ থেকে ৮,৮৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত, এই সংস্কৃতি উত্তর আমেরিকার বেশিরভাগ অঞ্চলে জনপ্রিয় ছিল এবং দক্ষিণ আমেরিকায়ও এর উপস্থিতি ছিল। ১৯৩২ সালে নিউ মক্সিকোর ক্লোভিস এলাকায় একটি প্রত্নতাত্মিক খননের পর এই সংস্কৃতির বেশ কিছু পুরাতাত্মিক নিদর্শন পাওয়া গিয়েছিল।

ভাষাবিদ, নৃতত্ববিদ ও প্রত্নতাত্বিকদের মতে আমেরিকায় পরবর্তি অভিবাসন ঘটে ৮,০০০ খ্রীস্টপূর্বে। এদের মধ্যে অন্যতম ছিল না-দেনে ভাষাভাষি জনগোষ্ঠী, যারা ৫০০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে আমেরিকার ভূখন্ডে প্রবেশ করেছিল।[৮] এই জনগোষ্ঠী উত্তর পশ্চিম আমেরিকার প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূল পর্য়ন্ত বাস করত। তারা বৃহদাকায় বাসস্থানে কয়েকটি পরিবার একত্রে বসবাস করত। তবে এসব বসবাসের স্থান তারা সব ঋতুতে ব্যবহার করত না। মূলত গ্রীষ্মে পশু শীকার ও মাছ ধরার ক্ষেত্রে এবং শীতকালে খাদ্য সংরক্ষণ করতে ব্যবহার করত।[৯] ওসারা নামের আরো একটি জনগোষ্ঠীর সন্ধান পাওয়া যায় যারা খ্রষ্টিপূর্ব ৫,৫০০ থেকে ৬০০ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত এই এলাকায় বসবাস করত।

স্তুপ এবং পোয়েবলো

ওয়েষ্ট ভার্জিনিয়ায় প্রাপ্ত এ্যাডেনা গোষ্ঠী কর্তৃক নির্মিত একটি স্তুপ।
মঙ্ক মাউন্ড, ইউনেসকো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্যের আর একটি স্তুপ।

এ্যাডেনা সংস্কৃতি নামের একটি প্রাক কলম্বিয়ান সংস্কৃতির জনগোষ্ঠী খ্রীষ্টপূর্ব ৬০০ সাল থেকে মাটির তৈরী বৃহদাকার স্তুপ নির্মান করত। এরাই আমেরিকার সবেচেয়ে প্রাচীন স্তুপ বা মাউন্ড নির্মানকারী জনগোষ্ঠী। ওয়াটসন ব্রেক এমনি একটি মাউন্ড কমপ্লেক্স যার বয়স ৩,৫০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ। Poverty Point নামের আরও একটি মৃৎনির্মিত কমপ্লেক্সের সন্ধান পাওয়া। এর আনুমানিক নির্মান সাল ১৭০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ।

হোপওয়েল নামের আর একটি সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর সাথে এ্যাডেনা গোষ্ঠীর জনগন মিশে এক হয়ে যায়। হোওয়েলরা অপেক্ষাকৃত অধিক ক্ষমতাবান ছিল এবং মহাদেশের বিশাল এলাকাজুড়ে ব্যবসায় বাণিজ্য করত।

উত্তর -পশ্চিম এবং উত্তর -পূর্ব

প্রশান্ত মহাসাগরীয় উত্তর -পশ্চিমের আদিবাসীরা সম্ভবত সবচেয়ে ধনী আদিবাসী আমেরিকান ছিল। অনেকগুলি স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্যের জাতিস্বত্তা সেখানে গড়ে উঠেছে, কিন্তু তারা সবার মধ্যে কিছু বিশ্বাস ও এৗতিহ্যগত মিল ছিল। খ্রিস্টপূর্ব ১,০০০ সালের আগে থেকেই এই অঞ্চলের স্থায়ী গ্রামগুলি গড়ে উঠতে শুরু করে। এসব সম্প্রদায় পটল্যাচের মতো বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠান পালন করত। এই সমাবেশগুলি সাধারণত বিশেষ কোন উপলক্ষ্যে আয়োজন করা হতো। যেমন, ‘টোটেম মেরু’ বা নতুন প্রধানকে বরণ করার উৎসব। ১৫ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ইরোকুইসরা বর্তমান নিউইয়র্কে, ওয়ানিদা, মোহাওক, ওননডাগা, কায়ুগা এবং সেনেকা নিয়ে উপজাতীয় জাতির একটি কনফেডারেসি গঠন করেছিল। তারা এমন একটি শাসন ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল যা ইউরোপের কঠিন রাজতন্ত্র থেকে অনেক আলাদা ছিল।[১০][১১][১২] ৫০ সদস্যের একটি কেন্দ্রীয় কমিটিতে প্রতিটি গোত্র থেকে একজন করে প্রতিনিধী থাকতো। ধারণা করা হয় যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের গঠনের সময় আদিবাসীদের এই রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে স্মরণ রেখেছিলেন। ইরোকুইস ছিল শক্তিশালী, প্রতিবেশী অনেক উপজাতি এবং পরবর্তীকালে ইউরোপীয়দের সাথে তারা যুদ্ধ করছিল। তাদের নিয়ন্ত্রিত অঞ্চল প্রসারিত হওয়ার সাথে সাথে ওসেজ, কাও, পোনকা এবং ওমাহা জনগোষ্ঠী সহ ছোট আরো অনেক উপজাতি আমেরিকার আরও পশ্চিমে চলে যেতে বাধ্যহয়।[১২][১৩]

স্থানীয় হাওয়াইয়ানরা

১ম থেকে ১০ম শতকের মধ্যে পলিনেশিয়ানরা হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে বসতি স্থাপন করতে শুরু করে। প্রায় ১২০০ খ্রিস্টাব্দে, তাহিতিয়ান অভিযাত্রীরা এই দ্বীপটি আবিষ্কারের পর এখানে বসতি স্থাপন করতে শুরু করেছিলেন। ৬০০ বছর পর সেখানে পরে ব্রিটিশদের আগমনের আগ পর্যন্ত দ্বীপটি বিশ্বের অন্যান্য অংশ থেকে একরকম বিচ্ছিন্ন ছিল। ব্রিটিশ অভিযাত্রী ক্যাপ্টেন জেমস কুকের অধীনে ইউরোপীয়রা ১৭৭৮ সালে হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে এসেছিলেন। এবং যোগাযোগের পাঁচ বছরের মধ্যে, ইউরোপীয় সামরিক প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে হাইতের রাজা প্রথম কামাহেমাহা প্রথমবার দ্বীপগুলিকে একত্রিত করে হাওয়াই রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেন।

ইউরোপীয় উপনিবেশ

প্রধান প্রধান ইউরোপীয় জাতিগুলো আমেরিকায় বসতি স্থাপনের বেশ কয়েকটি ব্যর্থ চেষ্টার পর ইংরেজরা ১৬০৭ সালে সেখানে বসতি স্থাপনে সক্ষম হয়। ইউরোপীয়রা আমেরিকাতে ঘোড়া, গবাদি পশু এবং হগ নিয়ে এসেছিল এবং পরিবর্তে ভুট্টা, টার্কি, টমেটো, আলু, তামাক, মটরশুটি এবং স্কোয়াশকে ইউরোপে নিয়ে গিয়েছিল। আমেরিকায় নতুন রোগের সংস্পর্শে আসার পর অনেক অভিযাত্রী এবং প্রাথমিক বসতি স্থাপনকারীরা মারা যান। গুটি বসন্ত ও হাম আদিবাসী জনগনের জন্য বেশি মারাত্মক ছিল। কারন রোগটি সম্পূর্ণ অপরিচত হওয়ায় তাদের শরীর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরী হবার কোন সুযোগ পায়নি। ইতিহাসে এই ঘটনা ‘কলম্বিয়ান এক্সচেঞ্জ’ নামে পরিচিত। বড় আকারের ইউরোপীয় বসতি শুরু হওয়ার আগেই ব্যাপক মহামারীরতে প্রচুর আদিবাসী আমেরিকান মারা গিয়েছিল। জনসংখ্যার একটি বড় অংশের আকস্মিক মৃত্যুতে তাদের সমাজব্যবস্থা ভেঙে পড়েছিল।[১৪][১৫]

প্রথম বসতি

স্প্যানিশ যোগাযোগ

আমেরিকা আবিষ্কারের কথা জানিয়ে রাজা ফারনান্ডেজ ও রানী ইসাবেলাকে লেখা ক্রিস্টোফার কলম্বাসের চিঠি।

প্রথম ইউরোপীয় হিসাবে স্প্যানিশ অভিযাত্রীরা বর্তমান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পৌছাঁন। ক্রিস্টোফার কলম্বাসের অভিযানের পর (১৪৯২ থেকে শুরু করে) ক্যারিবিয়ানে আধুনিক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পুয়ের্তো রিকো অঞ্চল এবং (আংশিকভাবে) ইউএস ভার্জিন দ্বীপপুঞ্জে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছিল। হুয়ান পন্স ডি লিওন ১৫১৩ সালে ফ্লোরিডায় অবতরণ করেন।[১৬] স্প্যানিশ অভিযানগুলি দ্রুত অ্যাপাল্যাচিয়ান পর্বত, মিসিসিপি নদীতে পৌঁছে।[১৭]

১৫৩৯ সালে হার্নাডো ডি সটো আমেরিকার পূর্ব দক্ষিণ অঞ্চলে ব্যাপক অভিযান চালান, [১৮] এক বছর পর ফ্রানসিসকো কর্নাডো স্বর্ণের খনির খোঁজে আরিজোনা থেকে মধ্য কেনসাস পর্য়ন্ত ব্যাপক অনুসন্ধান চালান।[১৮] [৬] এসব এলাকায় ছোট ছোট স্প্যানিশ বসতি গড়ে উঠেছিল। ক্রমে এসকল বসতি গুরুত্বপূর্ণ শহরে পরিনত হয়েছিল। যেমন, সান মেরিনো, নিউ মেক্সিকো, টাকশন, লজ এন্জেলস্ এবং সান ফ্রানসিসকো।[১৯]

ডাচ মধ্য আটলান্টিক

১৭৫০ সালের ম্যাপে উত্তর আমেরিকার ভূমির উপর ইউরোপীয় বসতিস্থাপনকারীদের দাবি
  ফ্রান্স
  গ্রেট ব্রিটেন
  স্পেন

ডাচ ওয়েস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি অভিযাত্রী হেনরি হাডসনকে ১৬০৯ সালে এশিয়া যাওয়ার উত্তর -পশ্চিম জলপথ আবিষ্কারের দায়িত্ব দেয়। কোম্পানিটি ১৬২১ সালে উত্তর আমেরিকার পশম বাণিজ্যকে পুঁজি করে নিউ নেদারল্যান্ড প্রতিষ্ঠা করে। ডাচ এবং আদিবাসী আমেরিকানদের মধ্যকার দ্বন্দ্বের নিরোসনে নেয়া অব্যবস্থাপনার কারণে প্রথম দিকে বসতি স্থাপনের গতি খুব মন্থর ছিল। ডাচরা স্থানীয় আদিবাসী আমেরিকানদের কাছ থেকে ২৪ মার্কিন ডলারের বিনিময়ে ম্যানহাটান দ্বীপ কিনে নিয়ে তার নতুন নামকরণ করে নিউ আমস্টারডাম। এই শহরকে নিউ নেদারল্যান্ডের রাজধানী হিসাবেও ঘোষণা করে। এই শহর খুব দ্রুত সম্প্রসারিত হয় এবং ১৬০০ সালের মাঝামাঝিতে এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য কেন্দ্র এবং বন্দর গড়ে ওঠে। ডাচরা ক্যালভিনিস্ট (ব্যাপটিস্ট বা প্রটেস্ট্যান্ট মতবাদের বিশ্বাসী) হলেও, ওলন্দাজরা অন্যান্য ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রতি সহনশীল ছিল এবং উত্তরের ইরোকুইসদের সাথে তাদের ব্যবসায়িক সম্পর্ক বজায় রেখেছিল।[২০] উপনিবেশটি নিউ ইংল্যান্ড থেকে ব্রিটিশ উপনিবেশ সম্প্রসারণের অন্তরায় ছিল। ফলস্বরূপ ডাচ ও ইংজেদের মধ্যে একের পর এক যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ১৬৬৪ সালে ব্রিটেন উপনিবেশটি দখল করে নেয় এবং এর রাজধানীর নতুন নামকরণ করা হয় নিউ ইয়র্ক সিটি। নিউ নেদারল্যান্ড আমেরিকান সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক জীবনে ধর্মীয় সহনশীলতা এবং শহুরে এলাকায় সংবেদনশীল বাণিজ্য এবং গ্রামাঞ্চলে গ্রামীণ ঐতিহ্যে (রিপ ভ্যান উইঙ্কলের গল্পে বর্ণিত) একটি স্থায়ী ছাপ রেখে যায়। উল্লেখযোগ্য ডাচ আমেরিকানদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন, মার্টিন ভ্যান ব্যুরেন, থিওডোর রুজভেল্ট এবং ফেরিনগ্লোসেন পরিবার।[২০]

সুইডিশ বসতি

সুইডিশ সাম্রাজ্যের প্রথম বছরগুলিতে, সুইডিশ, ডাচ এবং জার্মান স্টকহোল্ডাররা উত্তর আমেরিকায় পশম এবং তামাক ব্যবসার জন্য নিউ সুইডেন কোম্পানি গঠন করে। কোম্পানির প্রথম অভিযানের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন পিটার মিনুইট, যিনি ১৬২৬ থেকে ১৬৩১ পর্যন্ত নিউ নেদারল্যান্ডের গভর্নর ছিলেন কিন্তু ডাচ সরকারের সাথে বিরোধের পর সেখান থেকে চলে যান। ১৬৩৮ সালের মার্চ মাসে ডেলাওয়্যার উপসাগরে অবতরণ করেন। বসতি স্থাপনকারীরা এখনকার ডেলাওয়্যারের উইলমিংটনে ‘ফোর্ট ক্রিস্টিনা’ নামকে একটি কেল্লা প্রতিষ্ঠা করেন। ডেলাওয়্যার নদীর উভয় তীরে স্থানীয় আদিবাসীদের সাথে একটি চুক্তি করেন। পরবর্তী সতেরো বছরে, আরও ১২ টি অভিযান সুইডিশ সাম্রাজ্য থেকে (যার মধ্যে সমসাময়িক ফিনল্যান্ড, এস্তোনিয়া, এবং লাটভিয়া, নরওয়ে, রাশিয়া, পোল্যান্ড এবং জার্মানির অংশও ছিল) নতুন সুইডেনে এসেছিল। উপনিবেশটি বহু খামারের সাথে ১৯ টি স্থায়ী বসতি স্থাপন করে, যা আধুনিক মেরিল্যান্ড, পেনসিলভানিয়া এবং নিউ জার্সির বিভিন্ন জায়গায় অবস্থিত ছিল। ১৫৫৫ সালে প্রতিবেশী নিউ নেদারল্যান্ড উপনিবেশ কর্তৃক আক্রান্ত হবার পর ১৫৫৫ সালে এটি নিউ নেদারল্যান্ড এর অন্তর্ভুক্ত হয়।[২১][২২]

ফরাসি এবং স্প্যানিশ দ্বন্দ্ব

ব্রিটিশ উপনিবেশ

১৬১৬ সালে প্রকাশিত ইংলিশ পরর্য়টক জন স্মিথ এর নিউ ইংল্যান্ডের বর্ণনা এর উদ্ধৃতি
মে ফ্লাওয়ার যাত্রীদের নিয়ে নতুন দুনিয়ার পলিমাউথের পিলগ্রিমসের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছে। প্রথম শীতে জাহাজের অর্ধেক আরোহীর মৃত্যু হয়।[২৩]

ওয়াল্টার রালেইগ ১৫৮৫ সালে উত্তর আমেরিকার প্রথম ব্রিটিশ উপনিবেশ স্থাপন করার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু তার এই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল। এর বিশ বছর পর উপনিবেশ প্রতিষ্ঠার পরিবর্তি প্রচেষ্টা অবশ্য সফল হয়েছিল।[৬]

প্রথমদিকে ব্রিটিশ উপনিবেশগুলি বেসরকারী উদ্যোক্তারা শুধু মুনাফার উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এসব উপনিবেশে অনাহার, রোগ এবং স্থানীয় আমেরিকানদের আক্রমণের শীকার হয়েছিল। অনেক অভিবাসী ধর্মীয় স্বাধীনতা পাবার জন্য বা রাজনৈতিক নিপীড়ন থেকে মুক্তি পাওয়া জন্য সেখানে এসেছিল। শিল্প বিপ্লবের কারণে বাস্তুচ্যুত কৃষক, অথবা শুধুমাত্র দুঃসাহসিক অভিযানের সুযোগ পাবার জন্য সেখানে গিয়েছিল।

কিছু এলাকায়, স্থানীয় আমেরিকানরা বসতিস্থাপনকারীদের শিখিয়েছিল কীভাবে দেশীয় ফসল রোপণ এবং ফসল কাটতে হয়। অনেক জায়গায় তারা স্থানীয়দের হিংস্র আক্রমনের শীকার হয়। অন্যদের মধ্যে, তারা বসতি স্থাপনকারীদের আক্রমণ করে। অব্যবহৃত বনাঞ্চল থেকে প্রচুর নির্মাণ সামগ্রী এবং জ্বালানি কাঠের পর্যাপ্ত সরবরাহ ছিল। মহাসাগরের প্রাকৃতিক প্রবেশদ্বার, বিশাল সমুদ্র উপকূল ইউরোপের সাথে বাণিজ্যিক যোগাযোগ রক্ষায় পোতাস্রয় নির্মানের জন্য আদর্শ ছিল। [৬]

জেমসটাউনে প্রথম বসতি

১৬০৭ সালে জেমস নদীর তীরে অবস্থিত জেমসটাউনে ভার্জিনিয়া কোম্পানি প্রথম সফল ইংরেজ উপনিবেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এই বসতিস্থাপনকারীরা স্বর্ণের সন্ধানে ব্যস্ত ছিল এবং একটি নতুন এলাকায় টিকে থাকার জন্য প্রয়োজনিয় প্রস্তুতি তাদের ছিল না। ক্যাপ্টেন জন স্মিথ প্রথম বছর এই উপনিবেশকে আপ্রাণ চেষ্টা করে টিকিয়ে রেখেছিলেন। পরে অরাজাগতা ও বিশৃঙ্খলার কারনে সে চেষ্টা ব্যর্থ হলে দুই বছর পরে তিনি ইংল্যান্ডে ফিরে আসেন। জন রলফ ১৬১২ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজে তামাক নিয়ে পরীক্ষামূলক ব্যবসা শুরু করেন। ১৬১৪ সালে সেখান থেকে তামাকের প্রথম চালান লন্ডনে আসে। পরবর্তী এক দশকের মধ্যে তামাক, ভার্জিনিয়ার প্রধান আয়ের উৎস হয়ে ওঠে।

১৬২৪ সালে, বছরের পর বছর ধরে রোগের পাদুর্ভাব, স্থানীয়দের আক্রমণ, ১৬২২ সালের পোহাটান আক্রমণর পর রাজা প্রথম জেমস ভার্জিনিয়া কোম্পানির সনদ প্রত্যাহার করে ভার্জিনিয়াকে একটি রাজকীয় উপনিবেশে পরিণত করেন।

নিউ ইংল্যান্ড

মে ফ্লাওয়ারের পুরুষ যাত্রীরা ‘কম্প্যাক্ট’ স্বাক্ষর করছেন।

প্রাথমিকভাবে ধর্মীয় সংস্কারপন্থী পিউরিটানরা রাজা প্রথম জেমসের ধর্মীয় নিপীড়ন থেকে বাঁচতে নিউ ইংল্যান্ডে বসতি স্থাপন করেছিল। এই পিউরিটানরা ১৬২০ সালে মে ফ্লাওয়ার নামের একটি জাহাজে করে ভার্জিনিয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিলেন। জাগাজটি ঝড়ের কবলে পড়ে প্লাইমাউথে অবতরণ করে। যেখানে তারা ‘মেফ্লাওয়ার কম্প্যাক্টে’ নামে স্থানী জনগনের সাথে একটি সামাজিক চুক্তি করে। জেমসটাউনের মতো, প্লাইমাউথের এই উপনিবেশেও রোগ ও অনাহার হানা দেয়। স্থানীয় ওয়্যাম্পানোগ ইন্ডিয়ানরা বসতিস্থপনকারীদের ভূট্টা চাষের কৌশল শিখিয়েছিল। পিউরিটানদের কলোনির মতো ১৬৩০ সালে ম্যাসাচুসেটস বে কলোনি প্রতিষ্ঠা করা হয়। তারা ইংল্যান্ড থেকে পৃথক স্বশাসনের জন্য সনদের ভিত্তিতে এই কলোনি স্থাপন করেছিল। প্রতিষ্ঠার প্রথম বছরের বেশিরভাগ সময় উইনথ্রপকে তারা গভর্নর হিসেবে নির্বাচিত করে। রজার উইলিয়ামস উইনথ্রপের আদিবাসী আমেরিকানদের চিকিৎসা এবং ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার বিরোধিতা করেন এবং ধর্মীয় স্বাধীনতার ভিত্তিতে প্রভিডেন্স প্ল্যান্টেশন, পরে রোড আইল্যান্ড নতুন উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা করেন। অন্যান্য উপনিবেশবাদীরা কানেকটিকাট নদী উপত্যকায় এবং বর্তমান নিউ হ্যাম্পশায়ার এবং মেইনের উপকূলে বসতি স্থাপন করে। এসব এলাকায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক স্থানীয় আমেরিকানদের আক্রমণ অব্যাহত ছিল। এর মধ্যে ১৬৩৭ সালের পেকোট যুদ্ধ এবং ১৬৭৫ সারের রাজা ফিলিপের যুদ্ধ উল্লেখ্যযোগ্য।

অসমতল, কঠিন ও পাথুরে মাটির কারণে নিউ ইংল্যান্ডের জমি কৃষির জন্য উপযোগী ছিল না। তাই এখানে বাণিজ্য ও শিল্পের কেন্দ্র গড়ে উঠেছিল। নদীর স্রোতকে কাজে লাগিয়ে শস্য মাড়াইয়ের কল এবং করাত কল স্থাপন করা হয়েছিল। সেই সাথে অসংখ্য বন্দর স্থাপন করে বাণিজ্যকে সহজ করে তুলেছিল। এই শিল্প কেন্দ্রগুলির চারপাশে ঘনবসতি সম্পন্ন গ্রাম গড়ে ওঠে। এবং একমসয় বোস্টন আমেরিকার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বন্দর হিসাবে পরিচতি পায়।

দক্ষিণের উপনিবেশ

দক্ষিণের গ্রামাঞ্চল অধ্যুসিত উপনিবেশগুলির চিত্র উত্তরের বিপরীত ছিল। ভার্জিনিয়ার বাইরে, নিউ ইংল্যান্ডের দক্ষিণে প্রথম ব্রিটিশ উপনিবেশ ছিল মেরিল্যান্ড, যা ১৬৩২ সালে ক্যাথলিকদের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিতি পায়। কৃষকরা ভার্জিনিয়ার টাইডওয়াটার অঞ্চলে দাসশ্রমের ভিত্তিতে ব্যাপক আবাদি জমি গড়ে তোলে। তখন ক্ষুদ্র কৃষকরা রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত হতে শুরু করে।

১৬৭০ সালে, ক্যারোলিনা প্রদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়। চার্লসটন ছিল এই অঞ্চলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও বড় বাণিজ্যিক বন্দর। যদিও ভার্জিনিয়ার অর্থনীতির ভিত্তি ছিল তামাক। সেখান থেকে চাল, নীল এবং কাঠও রপ্তানি করা হতো। ১৭১২ সালে উপনিবেশটি দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে উত্তর এবং দক্ষিণ ক্যারোলিনা প্রদেশ তৈরি করে।[২৪]

ধর্ম

John Gadsby Chapman, Baptism of Pocahontas (1840), on display in the Rotunda of the U.S. Capitol.

প্রথম মহান জাগরণের পরে আমরি ধর্মীয়তা ব্যাপক প্রসার লাভ করে। জোনাথন এডওয়ার্ডস এবং জর্জ হোয়াইটফিল্ডের মত ধর্ম প্রচারকরা ১৭৪০ এর দশকে একটি ধর্মীয় পুনর্জাগরণের নেতৃত্বে ছিলেন।

সরকার

তেরোটি আমেরিকান উপনিবেশের প্রত্যেকটির সরকারি কাঠামো ভিন্ন ছিল। লন্ডন থেকে নিযুক্ত একজন গভর্নর সাধারণত, একটি উপনিবেশ শাসন করত। গভর্ণর নির্বাহী প্রশাসনকে নিয়ন্ত্রণ করতেন। ভোটের মাধ্যমে নতুন আইন প্রণয়ন ও কর আরোপের ক্ষমতা ছিল স্থানীয়ভাবে নির্বাচিত আইনসভার উপর।

১৮ শতাব্দীর মধ্যে আমেরিকান উপনিবেশগুলিতে, জমি এবং খাদ্যের সরবরাহ বৃদ্ধির সাথে সাথে মৃত্যুর হার কমে আসছিল। ফলে এসব উপনেবিশের দ্রুত প্রবৃদ্ধি হতে থাকে। উপনিবেশগুলি ব্রিটেনের বেশিরভাগ অংশের চেয়ে ধনী ছিল এবং আরো অভিবাসী ইচ্ছুক জনগোষ্ঠীকে আকৃষ্ট করেছিল, বিশেষ করে কিশোর -কিশোরীরা যারা শিক্ষানবিশ চুক্তিভিত্তিক কাজের জন্য সেখানে এসেছিল। [২৫]

ক্রীতদাস ও চুক্তিভিত্তিক দাসত্ব

ইউরোপ থেকে আগত অভিবাসীদের অর্ধেকের বেশি ছিল চুক্তিভিত্তিক মেয়াদী দাস।[২৬] তখন দূর দেশ আমেরিকা ভ্রমণের খরচ ছিল খুব বেশী। এত খরচ কম মানুষই বহন করতে পারে। তাই চুক্তিভিত্তিক, মেয়াদী দাসত্ব গ্রহণ, অভিবাসী প্রত্যাশিতদের জন্য ছিল একটি সুযোগ। সাধারণত, অভিবাসন ইচ্ছুক মানুষ বিনা মজুরীতে একটি নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য শ্রম দান করতে চুক্তিবদ্ধ হতো। চুক্তির মেয়াদ সাধারণত চার থেকে সাত বছর হতো। বিনিময়ে তারা আমেরিকায় যাবার পথ খরচ এবং তাদের মেয়াদ শেষে এক টুকরো জমি পেত। কিছু ক্ষেত্রে, জাহাজের ক্যাপ্টেনরা দরিদ্র শ্রমিক-অভিবাসীদের সরবরাহের জন্য পুরস্কার পেত। তাই মিথ্যা প্রতিশ্রুতি এবং অপহরণের মতো ঘটনাও প্রায়ই ঘটত। ভার্জিনিয়া কোম্পানি এবং ম্যাসাচুসেটস বে কোম্পানি মেয়াদী দাসও ব্যবহার করত। [৬]

১৬১৯ সালে ভার্জিনিয়াতে জেমসটাউনের প্রতিষ্ঠার ঠিক বারো বছর পরে, মার্কিন ভূমিতে প্রথম আফ্রিকান কৃতদাস আনা হয়। [২৭][২৮] প্রথম দিকে এসব দাস তাদের নিজেদের স্বাধীনতা ক্রয় করে নেয়ার সুযোগ থাকলেও ধীরে ধীরে দাসত্বের ধারণাটি কঠোর হতে শুরু করে এবং ১৬৬০ -এর দশকে তামাক ও ধানের আবাদে শ্রমের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় অনিচ্ছাকৃত দাসত্ব আজীবন দাসত্বে পরিণত হয়।[২৮] [তথ্যসূত্র প্রয়োজন] ধীরে ধীরে দাসত্ব আর চামড়ার কালো রং সমার্থক হয়ে যায়। একজন দাস পিতা মাতার সন্তানরা দাস হয়েই জন্ম গ্রহণ করে।[২৮] ১৭৭০ সালের মধ্যে আমেরিকার এক-পঞ্চমাংশ জনসংখ্যা ছিল কৃষ্ণাঙ্গ দাস।

যতদিন উপনিবেশগুলোকে ফরাসি এবং স্প্যানিশ শক্তির বিরুদ্ধে ব্রিটিশ সামরিক সহায়তা প্রয়োজন ছিল ততদিন ব্রিটেন থেকে স্বাধীন হবার প্রশ্নটি উত্থাপিত হয়নি। ১৭৬৫ সালের পর সামরিক হুমকি মুক্ত হয়ে আমেরিকায় ব্রিটিশ কলোনিগুলো স্বাধীনতার পথে পা বাড়ায়।[২৫]

স্বাধীনতার পথ

আমেরিকার ব্রিটিশ উপনিবেশের মানচিত্র। ফরাসি এবং ভারতীয় যুদ্ধের পূর্বে ১৭৫০ সালে উত্তর আমেরিকায় ব্রিটিশ এবং নতুন ফরাসি বসতির মানতচিত্র।

দক্ষিণ ক্যারোলিনা এবং ভার্জিনিয়ায় উচ্চ ধনী শ্রেণীর উত্থান ঘটে, যদের সম্পদের মূল উৎস ছিল দাস শ্রমিক দ্বারা পরিচালিত বৃহৎ বাগানের আয়। নিউইয়র্কের উপকূলে আরো একটি সামাজিক শ্রেণীর উদ্ভব হয়, যেখানে ডাচ ভাড়াটে কৃষকরা ভ্যান রেনসেলিয়ার পরিবারের মতো খুব ধনী ডাচ মালিকদের কাছ থেকে জমি ভাড়া নিয়ে চাষাবাদ করতেন। পেনসিলভেনিয়ার মতো অন্যান্য উপনিবেশগুলি অবশ্য অনেক সমতাবাদী ছিল। আঠারো শতকের মাঝামাঝি পেনসিলভানিয়া মূলত একটি মধ্যবিত্ত উপনিবেশ ছিল যারা উচ্চ-শ্রেণীর প্রতি খুব একটা সমীহ প্রকাশ করত না। ১৯৫৬ সালে পেনসেলভেনিয়া জার্নালে একজন সাংবাদিক লিখেছিলেন,

এই প্রদেশের লোকেরা সাধারণত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর, এবং বর্তমানে তারা বেশ ভাল একটি স্তরে অবস্থান করে। তারা প্রধানত পরিশ্রমী কৃষক, শিল্পী বা ব্যবসায়ী পুরুষ; তারা স্বাধীনতার ভোগ করে, এবং তাদের মধ্যে মধ্যবিত্তরা মনে করে যে নাগরিকত্বে তার অধিকার আছে।[২৯]

রাজনৈতিক সংহতি এবং স্বায়ত্তশাসন

বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনের "যোগ দাও, অথবা মর" ধারণাটি নিয়ে ১৭৫৬ সালের একটি রাজনৈতিক কার্টুন

ফরাসি এবং ইন্ডিয়ান যুদ্ধ (১৭৫৪-১৭৬৩) ছিল সাত বছরব্যাপী যুদ্ধের একটি অংশ। উপনিবেশগুলির রাজনৈতিক উন্নয়নে জলবিভাজকের মতো ঘটনা ছিল। কানাডা এবং আমেরিকার কলোনিগুলোতে ব্রিটিশ রাজশক্তির প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ফরাসি এবং নেটিভ আমেরিকানদের প্রভাব, উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছিল এবং তেরোটি উপনিবেশের অঞ্চল কানাডা এবং লুইজিয়ানা উভয় এলাকা নিউ ফ্রান্স পর্য়ন্ত বিস্তার লাভ করেছিল। যুদ্ধের প্রচেষ্টার ফলে উপনিবেশগুলির মধ্যে বৃহত্তর রাজনৈতিক একীকরণ ঘটেছিল, উদহরণ হিসাবে। বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনের "যোগ দাও, অথবা মর" ধারণাটির বাস্তবায়ন দেখতে পাওয়া যায় আলবেনি কংগ্রেসে। ফ্রাঙ্কলিনের অনেক আবিষ্কারের মধ্যে একটি হল - মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ধারণা। ধারনাটির জন্ম হয় ১৭৬৫ সালের পরে, এক দশক পরে উপলব্ধি করা যায়। [৩০]

প্রতিনিধিত্ববিহীন কর

উত্তর আমেরিকায় ব্রিটেন কর্তৃক ফরাসি ভূখণ্ড অধিগ্রহণের পর, ১৭৬৩ সালে রাজা তৃতীয় জর্জের জারিকৃত একটি রাজকীয় ঘোষণাপত্রের মূল লক্ষ্য ছিল নতুন উত্তর আমেরিকান সাম্রাজ্য সংগঠিত করা এবং অ্যাপাল্যাচিয়ান পর্বতমালার পশ্চিমাঞ্চলে উপনিবেশিক বিস্তার থেকে স্থানীয় আমেরিকানদের রক্ষা করা। পরবর্তী বছরগুলিতে, উপনিবেশবাদী এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মধ্যে সম্পর্কে টানাপোড়েন শুরু হয়। ১৭৬৫ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট স্ট্যাম্প অ্যাক্ট পাস করে। এই নতুন আইন অনুসারে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট উপনিবেশিক আইনসভাকে পাশ কাটিয়ে উপনিবেশগুলিতে কর আরোপ করে। তখন বিতর্কের জন্ম হয়: যে পার্লামেন্টে ট্যাক্স দাতাদের কোন প্রতিনিধি নেই সেই পার্লামেন্টের কর আরোপ করার নৈতিক কোন অধিকার আছে কিনা। চারিদিকে আওয়াজ ওঠে, “প্রতিনিধিত্ব ছাড়া কোন কর নয়” উত্তেজনার পারদ বাড়তে থাকে, ১৭৭০ সালে তা চূড়ান্ত রূপ নেয়।[৩১]

১৭৭৩ সালে বস্টন টি পার্টি বোস্টন শহরে কর্মীরা চায়ের উপর নতুন করের বিরুদ্ধে সরাসরি ও দৃশ্যমান প্রতিবাদে নামে। পার্লামেন্ট দ্রুত এর জবাব দেয়। পরের বছর অসহনীয় আইন (Intolerable Acts) পাশ করে। এই আইন অনুসারে ম্যাসাচুসেটসকে তার স্ব-শাসনের ঐতিহাসিক অধিকার থেকে সরিয়ে সামরিক শাসনের অধীনে রাখা হয়। ফলে বাকি তেরোটি উপনিবেশে ক্ষোভের সঞ্চার হয়। প্রতিটি উপনিবেশের নেতারা অসহনীয় আইনের প্রতি তাদের প্রতিরোধ কর্মসূচীর সমন্বয় সাধনের জন্য প্রথম মহাদেশীয় কংগ্রেস আহ্বান করেন। কংগ্রেস ব্রিটিশ বাণিজ্য বর্জনের আহ্বান জানায়, জনগনের অধিকার ও অভিযোগের একটি তালিকা প্রকাশ করে এবং সেই অভিযোগগুলোর প্রতিকার চেয়ে ব্রিটিশ রাজার কাছে আবেদন করে।[৩২] এই আবদনে কোন কাজ না হওয়ায়, ১৭৭৫ সালে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে উপনিবেশগুলির প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য ১৭৭৫ সালে দ্বিতীয় মহাদেশীয় কংগ্রেস আহ্বান করা হয়। সাধারণ মানুষও ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিচ্ছন্নবাদী হয়ে উঠেছিল। যদিও বিদ্রোহের আদর্শিক ব্যাপারগুলো সম্পর্কে পরিচিত ছিল না। তারা তাদের ব্যক্তিগদ "অধিকারের" বিষয়টিকে খুব দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করত। সাধারণ জনগন মনে করত, ব্রিটিশরা ইচ্ছাকৃতভাবে সেই অধিকার লঙ্ঘন করছে। তারা বোস্টনবাসীদের উপর নানা দমন পিড়নের ব্যাপারে ক্ষুব্ধ হয়েছিল। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর বোস্টনে আগমনে তা তাদের কাছে আরো প্রকট হয়। [৩৩] সাধারণ মানুষের ধারণা ছিল ঈশ্বর তাদের সাথে আছেন।[৩৪]

বিপ্লব এবং স্বাধীনতা

১৭৭৫ সালের এপ্রিল মাসে ব্রিটিশরা গোলাবারুদ বাজেয়াপ্ত করে বিপ্লবী নেতাদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা করলে ম্যাসাচুসেটসের লেক্সিংটন এবং কনকর্ডে আমেরিকার বিপ্লবী যুদ্ধ শুরু হয়। রাজনৈতিক মূল্যবোধের ক্ষেত্রে, আমেরিকানরা মূলত রিপাবলিকানিজম নামক একটি ধারণার উপর একতাবদ্ধ হয়েছিল। এই ধারণা আভিজাততন্ত্রকে প্রত্যাখ্যান করে নাগরিক কর্তব্য এবং দুর্নীতির ভয়কে প্রাধান্য দিয়েছিল। ঐতিহাসিকদের একটি দলের মতে, "জাতির প্রতিষ্ঠাতা পিতাদের জন্য, রিপাবলিকানিজম বিষয়টি শুধুই একটি সরকার ব্যবস্থা নয়, তার চেয়ে বেশীকিছু। এটি একটি জীবনধারা, একটি মূল মতাদর্শ, স্বাধীনতার প্রতি আপোষহীন প্রতিশ্রুতি এবং আভিজাততন্ত্রকে সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যান করা।"[৩৫]

১৭৭৫ সালে তেরোটি উপনিবেশ ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করে এবং ১৭৭৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হিসাবে তাদের স্বাধীনতা ঘোষণা করে। ১৭৭৫ থেকে ১৭৮৩ সালের মধ্যে আমেরিকানরা সারাতোগার যুদ্ধে ব্রিটিশ হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে, উত্তর -পূর্বাঞ্চলকে সুরক্ষিত করে এবং ফরাসিদের যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সামরিক জোটবদ্ধ হতে উৎসাহিত করে । ফ্রান্স এই জোটে স্পেন এবং নেদারল্যান্ডস নিয়ে আসে। অন্যদিকে ব্রিটেনের কোন মিত্র না থাকায় উভয় পক্ষের সামরিক ও নৌবাহিনীতে একটি ভারসাম্য বজায় থাকে।[৩৬]

জর্জ ওয়াশিংটন

জেনারেল জর্জ ওয়াশিংটন একজন দক্ষ সংগঠক এবং প্রশাসক ছিলেন। তিনি কংগ্রেস এবং রাজ্য গভর্নরদের সাথে সফলভাবে কাজ করেছেন। তার অধীনের সৈন্যদের সমর্থন ও প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। এবং একটি আদর্শবাদী রিপাবলিকান সেনাবাহিনী গড়ে তুলেছিলেন। তার সবচেয়ে বড় কঠিন কাজটি ছিল রসদ সরবরাহ নিশ্চিত করা, কারণ কংগ্রেস বা রাজ্যগুলির কাছে তহবিল, অস্ত্রশস্ত্র, পোশাক, বেতন বা এমনকি সৈন্যদের খাদ্য সরবরাহের জন্য পর্যাপ্ত তহবিল ছিল না। যুদ্ধক্ষেত্রের সামরিক কৌশলী বিবেচনায়, ওয়াশিংটন প্রায়ই তার ব্রিটিশ সমকক্ষদের দ্বারা কৌশলগত দিক দিয়ে পরাস্ত হতেন। তবে একজন দক্ষ সমরবিদ হিসেবে, তারা যুদ্ধে কী কৌশল অবলম্বন করতে পারেন সে সম্পর্কে তার একটি ভাল ধারণা ছিল। ব্রিটিশরা চারটি হানাদর সেনাবাহিনী পাঠায়। ওয়াশিংটনের কৌশল ১৭৭৬ সালে প্রথম সেনাবাহিনীকে বোস্টন ত্যাগে বাধ্য করে। সারাতোগা (১৭৭৭) এবং ইয়র্কটাউন (১৭৮১) সালে এ দ্বিতীয় এবং তৃতীয় সেনাবাহিনীকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করে। তিনি ব্রিটিশদের নিয়ন্ত্রিত নিউ ইয়র্ক সিটি এবং কয়েকটি স্থানে সীমাবদ্ধ রেখে প্যাট্রিয়টকে বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসংখ্যাকে নিয়ন্ত্রণে রাখেন।”[৩৭]

অনুগত এবং ব্রিটেন

জন ট্রাম্বুলের স্বাধীনতার ঘোষণা (১৮১৯)

অনুগতরা, যাদের উপর ব্রিটিশরা ব্যাপকভাবে নির্ভর করেছিল তারা জনসংখ্যার প্রায় ২০% ছিল। কিন্তু সাংগঠনিকভাবে তারা ছিল খুবই দুর্বল। যুদ্ধ শেষ হওয়ার সাথে সাথে, ব্রিটিশ সেনাবাহিনী ১৭৮৩ সালের নভেম্বরে নিউইয়র্ক সিটি ত্যাগ করে। অনুগত গোষ্ঠীর নেতাদের তারা সাথে নিয়েছিল। ক্ষমতাগ্রহণের পরিবর্তে ওয়াশিংটন অপ্রত্যাশিতভাবে ভার্জিনিয়ায় তার খামারে অবসর গ্রহণ করেন।[৩৭] রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সেমুর মার্টিন লিপসেটের মতে, "মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছিল প্রথম উপনিবেশ যা উপনেবিশক শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে সফলভাবে করেছিল। এই অর্থে, আমেরিকানরা ছিল প্রথম 'নতুন জাতি'”।[৩৮]

স্বাধীনতার ঘোষণা

১৭৭৬ সালের ২ জুলাই, ফিলাডেলফিয়ায় দ্বিতীয় মহাদেশীয় কংগ্রেস, রিচার্ড হেনরি লি -এর প্রস্তাব গ্রহণ করে উপনিবেশগুলির স্বাধীনতার ঘোষণা করে, এই ঘোষণায় যা বলা হয়েছিল:

এই সংযুক্ত উপনিবেশগুলি স্বাধীন এবং স্বাধীন রাষ্ট্র হওয়া উচিত, এবং তারা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রতি সমস্ত আনুগত্য থেকে অব্যাহতিপ্রাপ্ত, এবং সেই সাথে তাদের এবং গ্রেট ব্রিটেন রাজ্যের মধ্যে যে সমস্ত রাজনৈতিক সংযোগ রয়েছে সেসবও অকার্যকর হওয়া উচিত। বিদেশী শক্তির সহায়তা সংগ্রহের জন্য অবিলম্বে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত এবং উপনিবেশগুলিকে আরও ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত করার জন্য একটি কনফেডারেশন গঠন করা উচিত।

১৭৭৬ সালের ৪ জুলাই, তারা স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র গ্রহণ করে এবং এই তারিখটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্মদিন হিসাবে পালিত হয়। এর কিছুদিন পরেই কংগ্রেস আনুষ্ঠানিকভাবে জাতির নাম "ইউনাইটেড কলোনি অফ আমেরিকা" থেকে পরিবর্তন করে "ইউনাইটেড স্টেটস অফ আমেরিকা" রাখে।[৩৯]

প্রজাতন্ত্রের শুরুর সময়

কনফেডারেশন এবং সংবিধান

প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটন

জর্জ ওয়াশিংটন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠদের মধ্যে একজন। তিনি কন্টিনেন্টাল আর্মির সর্বাধিনায়ক, বিপ্লবের নায়ক এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম রাষ্ট্রপতি। (গিলবার্ট চার্লস স্টুয়ার্ট দ্বারা অংকিত)
প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটনের বিদায়ী ভাষণ, 1796

জর্জ ওয়াশিংটন, আমেরিকার বিপ্লবী যুদ্ধের একজন নায়ক, মহাদেশীয় সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক এবং সাংবিধানিক সম্মেলনের সভাপতি, ১৭৮৯ সালে নতুন সংবিধানের অধীনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন। ১৭৯০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় রাজধানীকে নিউ ইয়র্ক থেকে ফিলাডেলফিয়াতে সরিয়ে নেয়া হয়। অবশেষে ১৮০০ সারে রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসি তে স্থায়ী করা হয়। ওয়াশিংটন প্রশাসনের প্রধান কৃতিত্ব ছিল একটি শক্তিশালী জাতীয় সরকার গঠন করা যা সব আমেরিকান বিনা প্রশ্নে মেনে নিয়েছিল।[৪০]

দ্বি-দলীয় ব্যবস্থা

টমাস জেফারসন এবং জেমস ম্যাডিসন একটি বিরোধী রিপাবলিকান পার্টি গঠন করেন (সাধারণত রাজনৈতিক বিজ্ঞানীরা যাদের ডেমোক্রেটিক-রিপাবলিকান পার্টি বলে)। হ্যামিল্টন এবং ওয়াশিংটন ১৭৯৪ সালে জে চুক্তির মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের মধ্যে পুনরায় সুসম্পর্ক স্থাপন করেন। জেফারসনিয়ানের সমর্থকরা এর তীব্র প্রতিবাদ করেছিলেন। ভোটাররা দুই দলের একটিকে ভোট প্রদান করে। এইভাবে প্রথম দল বা ‘ফার্স্ট পার্টি’ ব্যাবস্থা চালু হয়। ফেডারেলিস্টরা ব্যবসা, আর্থিক এবং বাণিজ্যিক স্বার্থকে বেশি গুরত্ব দিত। তারা ব্রিটেনের সাথে বাণিজ্য বৃদ্ধি করতে চাইতো। রিপাবলিকানরা তাদের বিরুদ্ধে, রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, ধনীদের শাসক শ্রেণীতে পরিণত করার এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ব্রিটিশদের পয়সা বানানোর গুঁটি বানানোর পরিকল্পনায় মদদ দেয়ার অভিযুক্ত করে। [৪১] চুক্তি সম্পাদিত হবার পর রাজনীতির মাঠ তীব্র উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল।[৪২]

ফেডারেল সরকারের চ্যালেঞ্জ

নতুন ফেডারেল সরকারের জন্য গুরুতর চ্যালেঞ্জগুলির মধ্যে রয়েছে উত্তর -পশ্চিম ইন্ডিয়ান যুদ্ধ, চলমান চেরোকি -আমেরিকান যুদ্ধ এবং ১৭৯৪ হুইস্কি বিদ্রোহ, যেখানে পশ্চিমা অধিবাসীরা মদের উপর আরোপিত একটি ফেডারেল করের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিল। প্রেসিডেন্ট ওয়াশিংটন সেখানে স্টেট মিলিশিয়া মেতায়েন করেছিলেন এবং নিজে বিদ্রোহ দমন করার জন্য একটি সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। বিদ্রোহ দমন করার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জাতীয় সরকারের ক্ষমতা আরো সুদৃঢ় হয়।[৩৭]

প্রেসিডেন্ট ওয়াশিংটন, দুই মেয়াদের বেশি সময় ক্ষমতায় থাকতে অস্বীকার করে একটি নজীর স্থাপন করেছিলেন। তার বিদায়ী ভাষনে তিনি বিদেশী শক্তির সাথে জোটবদ্ধ হবার সময় সমতর্কতা অবলম্বনের কথা বলেন। এবং রাজনৈতিক দল গঠন নিয়েও কথা বলেন। তার ভাষনে তিনি ফেডারেল সরকারের সুবিধা এবং নৈতিকতা ও নৈতিকতার গুরুত্বের প্রশংসা করেছিলেন।[৪৩]

জন অ্যাডামস নামের একজন ফেডারেলিস্ট, ১৭৯৬ সালের নির্বাচনে জেফারসনকে পরাজিত করেন। এস সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ফ্রান্সের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পরে।ফেডারেলিস্টরা এলিয়েন এবং সিডিশন অ্যাক্টের মাধ্যমে রিপাবলিকানদের মুখ বন্ধ করার চেষ্টা করেছিল। হ্যামিল্টনকে প্রধান করে যুক্তরাষ্ট্র একটি বিশাল সেনাবাহিনী গড়ে তুলে ফরাসি আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য প্রস্তুত হয়। ফ্রান্সে একটি সফল শান্তি মিশন পাঠানর বিতর্ককে কেন্দ্র করে ফেডারেলিস্টরা বিভক্ত হয়ে পরে। ১৭৯৮ সালে এই অঘোষিত যুদ্ধের অবসান হয়।[৪১][৪৪]

ক্রীতদাস শ্রমের চাহিদা বৃদ্ধি

ক্রীতদাস বিক্রির জন্য অপেক্ষা করছে: রিচমন্ড, ভার্জিনিয়া (আইরে ক্রো এর আঁকা

বিপ্লবী যুদ্ধের পরবর্তী দুই দশকের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দাসত্বের মর্যাদার নাটকীয় পরিবর্তন ঘটে। এ সময় মুক্ত কৃষ্ণাঙ্গদের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। অভেদ মানবজাতির ধারণা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে উত্তরের রাজ্যগুলো দাসপ্রথা বিলুপ্ত ঘোষণা করে। উত্তর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি শ্রম নির্ভর না থাকার কারনে এই সিদ্ধান্ত ত্বরান্বিত হয়। তবে দক্ষিণ যুক্তরাষ্ট্রের চিত্র ছিল তার বিপরীত।

উচ্চ দক্ষিণের রাজ্যগুলিতে দাসমুক্তির বিষয়টি অনেক সহজ ছিল। যার ফলে উচ্চ দক্ষিণে স্বাধীন কৃষ্ণাঙ্গদের অনুপাত (মোট অ-শ্বেতাঙ্গ জনসংখ্যার শতাংশ হিসাবে) ১৭৯২ সালে এক শতাংশের কম থেকে ১৮১০ সালের মধ্যে ১০ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। সে সময় পর্য়ন্ত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১৩.৫ শতাংশ কৃষ্ণাঙ্গ মুক্ত ছিল।[৪৫]

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিনােঞ্চলের গভীরে ক্রমবর্ধমান তুলা চাষের কারণে ক্রীতদাসের চাহিদা বাড়তে থাকে। ফলে দাস মুক্ত করনের হারও দ্রুত কমতে থাকে; এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ক্রীতদাস বাণিজ্য অনেক কৃষক ও ব্যবসায়ীদের আয়ের একটি বড় উৎস হয়ে ওঠে।. ১৮০৭ সালে, কংগ্রেস আটলান্টিক ক্রীতদাস বাণিজ্য এর সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পৃক্ততা চ্ছিন্ন করে। [৪৬]

লুইসিয়ানা এবং জেফারসনিয়ান প্রজাতন্ত্রবাদ

বিপ্লবী যুদ্ধের পর প্রথম দুই দশকে, রাজ্যগুলির মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দাস ব্যবস্থায় নাটকীয় পরিবর্তন ঘটে এবং মুক্ত কৃষ্ণাঙ্গদের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। মানুষের সমতার বৈপ্লবিক আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে এবং দাসত্বের প্রতি তাদের কম অর্থনৈতিক নির্ভরতার কারনে উত্তরের রাজ্যগুলো দাসব্যবস্থা বিলুপ্ত করে।

টমাস জেফারসন ১৮০০ সালের নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট পদে অ্যাডামসকে পরাজিত করেন।

প্রেসিডেন্ট হিসেবে জেফারসনের প্রধান কৃতিত্ব ছিল ১৮০৩ সালে লুইসিয়ানা ক্রয় এর ফলে মিসিসিপি নদীর পশ্চিমে মার্কিন বসতি সম্প্রসারণের দ্বার খুলে যায়।[৪৭] জেফারসন পেশায় একজন স্থপতি এবং আইনজ্ঞ ছিলেন। নতুন এলাকা খুঁজে বের করে তারে ভূচিত্র তৈরী করার অভিযান সমর্থন করতেন। বিশেষ করে লুইস এবং ক্লার্ক অভিযানের পিছনে তাঁর পৃষ্ঠপোষকতা ছিল।[৪৭] [৪৮] জেফারসন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রিপাবলিকানিজমে গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন। এবং আশা করতেন যে কৃষকরেই এই রিপাবিলকের ভিত্তি। শহর, কারখানা এবং ব্যাংকের উপর তার আস্থা ছিল না। এমনকি ফেডারেল সরকার এবং বিচারকদের উপরও তার তেমন আস্থা ছিল না। তিনি বিচার বিভাগকে ক্ষমতার দিক দিয়ে দুর্বল করার চেষ্টা করেছিলেন। জন মার্শাল নামের ভার্জিনিয়ার একজন ফেডারেলিস্ট এর সাথে তার দৃষ্টিভাঙ্গির অনেক মিল ছিল। সংবিধানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্র কাঠামোতে একটি সুপ্রীম কোর্টের উল্লেখ থাকলেও, তার দায়িত্ব ও কর্মকান্ডের কোন পরিষ্কার ধারণা সেখানে ছিল না। ১৮০১ - ১৮৩৫ সালে প্রধান বিচারপতি জন মার্শাল তার একটি পরিষ্কার ধারণা দেন।[৪৯]

১৮১২ এর যুদ্ধ

"দি স্টার-স্প্যাঙ্গল্ড ব্যানার"
"দি স্টার-স্প্যাঙ্গল্ড ব্যানার"-এর এর সবচেয়ে পুরানো প্রতিলিপি, সাল ১৮১৪

 মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-এর জাতীয় সঙ্গীত
কথাফ্রান্সিস স্কট কী, ১৮১৪
সুরজন স্ট্যাফোর্ড স্মিথ, ১৭৭৩
গ্রহণের তারিখ৩ মার্চ ১৯৩১ (1931-03-03)[৫০]
সঙ্গীতের নমুনা
noicon

মার্কিনীরা কিছু কর্মকান্ডের জন্য ব্রিটিশদের উপর ক্ষুব্ধ ছিল। সেগুলো হল, মার্কিন নৌবাহিনীর জাহাজের ফ্রান্সের নৌঘাঁটি আক্রমনের নিরপেক্ষ অধিকার উপেক্ষা করা, নেপোলিয়ন বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করার জন্য ১০,০০০ নৌ সেনাকে বলপূর্বক হরণ করা এবং মধ্য-পূর্ব এলাকায় আমেরিকার স্থানীয় আদিবাসীদেরকে সামরিক মদদ দিয়ে আমিরিকার পশ্বিমাঞ্চলে বসতি স্থাপনে বাধা দেয়া। উত্তরের ব্রিটিশ উপনেবিশগুলোকে সংযুক্ত করার একটি অভিপ্রায়ও সম্ভবত ব্রিটিশদের ছিল। [৫১][৫২][৫৩][৫৪][৫৫] উত্তর -পূর্ব আমেরিকার জনগনের, বিশেষ করে ফেডারেলিস্টদের প্রবল বিরোধিতা সত্ত্বেও কংগ্রেস ১৪ জুন, ১৮১২ তারিখে যুক্তরাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে।[৫৬]

উভয় পক্ষই যুদ্ধ নিয়ে হতাশ ছিল। আমেরিকান হাইকমান্ড অনেক ক্ষেত্রে অক্ষমতার পরিচয় দেয়। উভয় পক্ষই একে অপরকে পরাস্ত করার চেষ্টা করেও সফল হতে পারেনি। আমেরিকান মিলিশিয়া সৈন্যরা যুদ্ধের জন্য বাড়ি ছাড়তে চাইছিল না। তাদের কানাডা আক্রমণের চেষ্টা বারবার ব্যর্থ হয়েছিল। ব্রিটিশ অবরোধে আমেরিকান বাণিজ্যকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়। মার্কিন ট্রেজারি দেউলিয়া হয়ে যায়। এসব নিউ ইংল্যান্ডবাসীদের আরও ক্ষুব্ধ করে, যারা ব্রিটেনে চোরাকারবীর মাধ্যমে দ্রব্য পাচার করা শুরু করে। আন্ডার জেনারেল উইলিয়াম হেনরি হ্যারিসনের অধীনে আমেরিকানরা অবশেষে এরি লেকের নৌ নিয়ন্ত্রণ লাভ করে এবং কানাডাযর টেকুমসেহে রেড ইন্ডিয়ানদের পরাজিত করে।[৫৭]

ব্রিটিশরা ওয়াশিংটন আক্রমণ করে তা পুড়িয়ে দেয়। ১৮৪১ সালে বাল্টিমোরে ব্রিটিশদের প্রতিহত করা হয়।- আমেরিকার এই সাফল্য উপলখ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় সংগীত "স্টার স্প্যাংল্ড ব্যানার" লেখা হয়। প্ল্যাটসবার্গের যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি বড় ব্রিটিশ আক্রমণ প্রতিহত করে। অবশেষে ১৮১৫ সালের প্রথম দিকে অ্যান্ড্রু জ্যাকসন নিউ অরলিন্সের যুদ্ধ এ ব্রিটিশদের একটি বড় আক্রমণকে নিশ্চিতভাবে পরাজিত করার পর, জ্যাকসন একজন সফর সমর নায়ক হিসাবে পরিচিতি পান।[৫৮]

১৮১৫ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি আমেরিকানরা যুদ্ধে তাদেেই জয় হয়েছে বলে দাবি করে। নেপোলিয়নের পতনের পর, উভয় পক্ষের সামনে যুদ্ধ চালিয়ে যাবার আর কোন দৃশ্যমান কারণ ছিল না। উভয় পক্ষই একটি শান্তিচুক্তি করে। এই চুক্তিতে যুদ্ধ পূর্ব সীমানা অক্ষত থাকে। মার্কিন নাগরিকনা তাদের "দ্বিতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধের" সাফল্যে গর্বিত হয়। এই ঘটনা যুদ্ধবিরোধী ফেডারেলিস্ট পার্টির নেতারাদের রাজনৈতিক লজ্জায় ফেলে দিয়েছিল। যুদ্ধে পরাজিত ব্রিটিশরা আমেরিকান বসতির বিস্তার রোধে ইন্ডিয়ান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত হয়নি। কোন রকম বৃহৎ হুমকি ছাড়াই মধ্য-পশ্চিত অঞ্চলে মার্কিন বসতি স্থাপন চলতে থাকে।[৫৮] ১৮১২ সালের যুদ্ধ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একটি স্থায়ী সেনাবাহিনীর প্রয়োজনিয়তা নিয়ে যে নেতিবাচক ধারণায় পরিবর্তন আসে। একটি নিয়মিত সামরিক বাহিনী, অধুনা সমাপ্ত যুদ্ধে অ-সজ্জিত এবং দুর্বল প্রশিক্ষিত মিলিশিয়াদের চেয়ে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে অনেক কার্যকরি ছিল। সামরিক বিভাগের কর্মকর্তারা পরে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে দেশের প্রধান প্রতিরক্ষা হিসেবে একটি নিয়মিত সামিরক বাহিনীর প্রয়োজন।[৫৯]

দ্বিতীয় মহা জাগরণ

একটি প্রোটেস্ট্যান্ট ক্যাম্প মিটিং এর ছবি (by H. Bridport, c. 1829)

দ্বিতীয় মহা জাগরণ ছিল একটি প্রোটেস্ট্যান্ট পুনরুজ্জীবন আন্দোলন যা ১৯ শতকের গোড়ার দিকে সমগ্র জাতিকে প্রভাবিত করেছিল এবং সমাজে দ্রুত গির্জার প্রাধান্য বৃদ্ধি পাচ্ছিল। আন্দোলনটি ১৭৯০ সালের দিকে শুরু হয়, ১৮০০ সালের দিকে গতি লাভ করে এবং ১৮২০ সালের পরে ব্যাপটিস্ট এবং মেথোডিস্ট মণ্ডলীর সদস্যপদ দ্রুত বৃদ্ধি পায়। এই দুই খ্রিস্টিয় সম্প্রদায়ের ধর্মপ্রচারকরা এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয়। এই আন্দোলন ১৮৪০ এর দশকে চূড়ান্ত গতি পায়।[৬০] এ দুটি ধর্মীয় গোষ্ঠীতে লক্ষ লক্ষ নতুন সদস্য তালিকাভুক্ত হয়। জনগনের মধ্যে একটি নতুন মূল্যবোধ গঠনের সূচনা হয়। দ্বিতীয় মহা জাগরণ বেশ কিছু সংস্কার আন্দোলনের জন্ম দেয়। যীশু খ্রীষ্টের দ্বিতীয়বার আগমনের পূর্বে কলূষ দূর করার উদ্দেশ্যে, ‘বিলোপবাদ’ (দাসপ্রথার বিলোপ) এবং ‘সহনশীলতা আন্দোলন’ (মদ জাতীয় পানিয় বর্জন) এর সূত্রপাত হয়।[৬১]

উত্তম অনুভূতির যুগ

যুদ্ধের প্রবল বিরোধী হিসেবে, ফেডারেলিস্টরা ১৮১৪ সালে হার্টফোর্ড কনভেনশনের আয়োজন করে। যাতে বিচ্ছিন্নতার প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত ছিল। নিউ অরলিন্সে বিজয়ের পর ফেডারেলিস্টদের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয় এবং তারা আর রাজনৈতিক দল হিসেবে উল্লেখযোগ্য কোন ভূমিকা পালন করেনি।[৬২] রাষ্ট্রপতি ম্যাডিসন এবং অন্যান্য রিপাবলিকান বুঝতে পেরেছিলেন যে তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংক বন্ধ করে দেয়া একটি অতি বড় ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। তাই বিদেশী ব্যাংকারদের সহায়তায়, তারা ১৮১৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয় ব্যাংকের চার্টার্ড করেছিল।[৬৩][৬৪]

ব্রিটেনের অবরোধ চলাকালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কিছু শিল্প কারখানা গড়ে উঠেছিল। রিপাবলিকানরা এই সব শিশু শিল্পকে রক্ষা করার জন্য শুল্ক আরোপ করে। রাজনৈতিক দল হিসেবে ফেডারেলিস্টদের পতন, রিপাবলিকানদের দ্বারা অনেক ফেডারেলিস্ট নীতি গ্রহণ এবং রাষ্ট্রপতি জেমস মনরোর তার দুই মেয়াদে (১৮১৭-১৮২৫) পার্টিজাননীতি বর্জন এবং ফার্ষ্ট পার্টি নীতির অবলুপ্তি ইত্যাদির প্রভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উত্তম অনুভূতির যুগে প্রবেশ করে।[৬৩][৬৪]

১৮৩২ সালে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম রাষ্ট্রপতি, এ্যান্ড্রু জ্যাকসন, "জ্যাকসন এবং নো ব্যাংক" স্লোগান তুলে দ্বিতীয় মেয়াদে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। তিনি নির্বাচিত হয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয় ব্যাংকের সনদ আর নবায়ন করেননি। ১৮৩৬ সালে ব্যাংকটি বন্ধ হয়ে যায়। জ্যাকসন সবাইকে বুঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক থেকে অধিকাংশ অভিজাতরা আমেরিকানরা সুবিধা নেয়ার জন্য ব্যবহার করে। বিকল্প হিসাবে তিনি স্টেট ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন যাকে ঠাট্টার ছলে অনেকের কাছে "পোষা ব্যাংক" নামে পরিচিতি পায়। [৬৫]

পশ্চিম দিকে সম্প্রসারণ

ইন্ডিয়ানদের অপসারণ

ইন্ডিয়ান রিমুভাল অ্যাক্টের বলে বেশ কিছু স্থানীয় আমেরিকানদের প্রতিস্থাপন করা হয়েছিল।

১৮৩০ সালে, কংগ্রেস ইন্ডিয়ান রিমুভাল অ্যাক্ট পাস করে। এই আইন প্রেসিডেন্টকে মিসিসিপি নদীর পশ্চিমের জমির সাথে পূর্ব তীরের রাজ্যগুলিতে আমেরিকান আদিবাসী জমি বিনিময় করার অনুমতি দেয়।[৬৬] এর লক্ষ্য ছিল মূলত আমেরিকান দক্ষিণ -পূর্ব এলাকা থেকে পাঁচটি সভ্য উপজাতি সহ সকল স্থানীয় আমেরিকানদের সরিয়ে দেওয়া; বসতি স্থাপনকারীরা তাদের জমি দখল করতে চেয়েছিল। রাষ্ট্রীয় আইন না মেনে স্থানীয় জনগোষ্ঠী তাদের জমি ছেড়ে দিতে অস্বীকার করলে জ্যাকসোনিয়ান ডেমোক্র্যাটরা তাদেরকে জোরপূর্বক অপসারণের দাবি করেছিল; হিগস এবং ধর্মীয় নেতারা এই পদক্ষেপকে অমানবিক বলে বিরোধিতা করেছিলেন। চেরোকি ‘ট্রেইল অফ টিয়ার্স’ এ দেখা যায় এই স্থানান্তরের কারনে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছিল।[৬৭] ট্রেইল অফ টিয়ার্সের ফলে ১৬,৫৪৩ জনের মধ্যে পথেই প্রায় ৮,০০০ জনের করুন পরিনতি হয়েছিল।[৬৮][পূর্ণ তথ্যসূত্র প্রয়োজন][৬৯] ফ্লোরিডার সেমিনোল ইন্ডিয়ানরা অনেকেই পশ্চিমে যেতে অস্বীকার করেছিলেন; সেমিনোল যুদ্ধে তারা বহু বছর ধরে সেনাবাহিনীর সাথে লড়াই চালিয়ে যায়।

দ্বি-দলীয় ব্যবস্থা

হেনরী ক্লে

১৮২০ সালে ফেডারেলিস্ট এবং রিপাবলিকানদের ফার্স্ট পার্টি সিস্টেম বিলুপ্ত হওয়ার পর, সুসংগঠিত স্থানীয় দলগুলি একটি নতুন পার্টি সিস্টেমের উত্থানের জন্য চেষ্টা চালায়। এব্যাপারে তারা প্রায় সকল স্বেতাঙ্গ পুরুষদের ভোটের আবেদন করেছিল। প্রাক্তন জেফারসোনিয়ান (গণতান্ত্রিক-রিপাবলিকান) দলটি বিভক্ত হয়ে পরে। প্রেসিডেন্ট জেমস মনরোর উত্তরাধিকারী বেছে নেওয়া এবং এ্যান্ডু জ্যাকসন ও মার্টিন ভ্যান বুরেনের আমলের জেফারসনিয়ান নীতি সমর্থনকারী ইস্যুতে তারা বিভক্ত হয়ে পরেছিল। অন্য অংশে ছিল হেনরি ক্লে এর নেতৃত্বাধীন বিরোধী দলগুলি যারা পরে হুইগ পার্টি গঠনে সাহায্য করেছিল। ১৮৫০ এর দশকে দাসপ্রথার ইস্যুতে হুইগ পার্টি ভেঙে যায়। আব্রাহাম লিংকন এবং ওয়াল্টার্স ও তাদের অসংখ্য সমর্থকরা উইলিয়াম লয়েড গ্যারিসনের ধর্মতত্ত্ব প্রত্যাখ্যান করে এবং দাসপ্রথাকে একটি পাপ হিসাবে না দেখে একটি দুর্ভাগ্যজনক সামাজিক অনাচার বলে মনে করে।[৭০][৭১]

বিভক্তিগত দ্বন্দ্ব এবং গৃহযুদ্ধ

উত্তর এবং দক্ষিণের মধ্যে বিভাজন

১৯৪৮ সালের পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মূল আলোচনায় ছিল দাসত্বের বিস্তার, উত্তরে দাসত্ব-বিরোধী জনগোষ্ঠী এবং দক্ষিণের দাসত্ব-বিরোধী জনগনের মধ্য বিরোধীতা আর সংঘাত। কিছু সক্রিয় উত্তরপন্থী বিশ্বাস করতেন দাসপ্রথা অবিলম্বে বিলুপ্ত হওয়া উচিত কারন, ক্রীতদাস্ত প্রথা একটি পাপ (প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মতত্ত্বের পরিপ্রেক্ষিতে)। উত্তরে দাসত্ব বিস্তার বিরোধীদের সংখ্যা অনেক বেশি ছিল। তাঁরা দাস প্রথা বিলোপ, সকল আমেরিকানদের জন্য মুক্ত ভূমি (কম দামে ভূমি, যেন ছোট পরিবারগুলো তাদের জমি নিজেরাই চাষ করতে পারে।) ও মুক্তবাকের নিশ্চয়তা দাবী জানাচ্ছিল। দক্ষিনে এসব ধারণা ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। দক্ষিণ শ্বেতাঙ্গ ডেমোক্র্যাটরা মনে করতেন দাসপ্রথা সমস্ত স্বোতঙ্গদের জন্য (এমনকি ‍কৃষ্ণাঙ্গ দাসদের নিজেদের জন্যও) অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক সব দিক বিবেচনায় হিতকর। তারা দাসত্ব বিরোধী সকল মুখপাত্রকে "বিলোপবাদী" বলে নিন্দা করেছিল।[৭২] দাসপ্রথার পক্ষে যুক্তি ছিল যে দাস অর্থনীতির আকস্মিক সমাপ্তি দক্ষিণে গভীর এবং মারাত্মক অর্থনৈতিক প্রভাব ফেলবে যেখানের অর্থনীতির ভিত্তি মূলত দাস শ্রমের উপর নির্ভরশীল। তারা আরও যুক্তি দিয়েছিল যে সমস্ত ক্রীতদাসকে মুক্ত করা হলে ব্যাপক বেকারত্ব ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে।[৭৩] দাসপ্রতার প্রশ্নে ধর্ম ভিত্তিক বিভাজন তৈরী হয়। মেথডিস্ট এবং ব্যাপ্টিস্টরা উত্তর এবং দক্ষিণ এই দুই সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে। উত্তরে, মেথডিস্ট, কংগ্রেগ্যানালিস্ট এবং কোয়েকাররা অনেক বিলুপ্তিবাদীদের অন্তর্ভুক্ত ছিল। বিশেষ করে তাদের নারী কর্মীরা যথেষ্ট সোচ্চার ছিলেন। ক্যাথলিক, এপিস্কোপাল এবং লুথেরান সম্প্রদায়গুলি এ ব্যাপারে নির্বিকার ছিল।[৭৪]

১৮৫০ সালের সমঝোতা এবং জনপ্রিয় সার্বভৌমত্ব

হুইগ হেনরি ক্লে এবং ডেমোক্র্যাট স্টিফেন ডগলাসের মধ্যস্থাতায়, নতুন অঞ্চলে দাসত্বের বিষয়টি আপাতদৃষ্টিতে ১৮৫০ সালের সমঝোতার মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা হয়েছিল। এই সমঝোতায় উটাহ বা নিউ মেক্সিকোতে দাসত্বের উপর ফেডারেল বিধিনিষেধের আরোপ করা হয়। পক্ষান্তরে, ক্যালিফোর্নিয়াকে একটি মুক্ত স্টেট হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।[৭৫] এরপর বিতর্কের বিষয় হয়ে দাঁড়ায় ‘পলাতক ক্রীতদাস আইন’ (Fugitive Slave Act), এই আইন অনুসারে, স্বাধীন রাজ্যগুলিকে তাদের মালিকদের কাছে পলাতক ক্রীতদাসদের ফিরিয়ে দিতে সহযোগিতা করতে হয়।[৭৬] হ্যারিয়েট বীচার স্টো-এর বিখ্যাত উপন্যাস আঙ্কল টমস্‌ কেবিন-এ যেমনটা তুলে ধরা হয়েছিল, দাসব্যবস্থার বিরোধীরা এই আইনকে প্রতিহত করার চেষ্টা করছিল।[৭৬]

১৮২০-এর আপস আইন ১৮৫৪ সালে সেনেটর ডগলাস দ্বারা প্রচারিত "জনপ্রিয় সার্বভৌমত্ব এবং গণতন্ত্রের নামে পরিচিত ‘কানসাস-নেব্রাস্কা আইন’ দ্বারা বাতিল করা হয়েছিল। এই আইন দ্বারা তাদের ভোটাধিকারের মাধ্যমে জনগন তাদের নিজ নিজ অঞ্চলে দাসব্যাবস্থা থাকবে না থাকবে না সেই ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার সুযোগ করে দেয়া হয়। ফলে দাসত্বের প্রশ্নে ডগলাস নিরপেক্ষতা অবলম্বন করার সুযোগ পান। ক্রীতদাসপ্রথার বিরোধী শক্তিগুলি ক্ষুব্ধ ও শঙ্কিত হয়ে নতুন রিপাবলিকান পার্টি গঠন করে। ১৮৫০ সালের মধ্যে নতুন রিপাবলিকান পার্টি প্রায় সমস্ত উত্তরাঞ্চলীয় রাজ্য এবং একইভাবে ইলেক্টোরাল কলেজে আধিপত্য বিস্তার করে। প্রকাশপায় যে দাসপ্রথাকে কখনই প্রসারিত হতে দেওয়া হবে না (এবং এইভাবে ধীরে ধীরে লুপ্ত হয়ে যাবে)।[৭৭]

রোপণের অর্থনীতি

দক্ষিণের দাসত্ব-ভিত্তিক সমাজগুলি তাদের তুলা এবং অন্যান্য কৃষিপণ্য উৎপাদনের উপর ভিত্তি করে বেশ সম্পদশালী হয়ে উঠেছিল এবং কিছু জনগন অভ্যন্তরীণ দাস ব্যবসা থেকেও সম্পদ গড়ে তুলেছিল। বোস্টন এবং নিউইয়র্কের মতো উত্তরের শহরে গড়ে ওঠা আঞ্চলিক শিল্প যেমন, টেক্সটাইল মিল সহ ব্যাংকিং, শিপিং ইত্যাদি অর্থনৈতিকভাবে দাসপ্রতার সাথে সম্পৃক্ত ছিল। ১৮৬০ সালের মধ্যে, দক্ষিণে চার মিলিয়ন ক্রীতদাস জনসংখ্যা ছিল, যা ১৭৯০ সালে সমগ্র মার্কিন দেশের চেয়ে প্রায় আট গুণ বেশি। ইউরোপে কাঁচা তুলার জন্য প্রচুর চাহিদার কারণে এই তুলার চাষ অত্যন্ত লাভজনক ছিল। বেশির ভাগ লাভের অর্থ নতুন জমিতে এবং আরও ক্রীতদাস কেনার জন্য বিনিয়োগ করা হয়েছিল (বেশিরভাগই ছিল ক্রমহ্রাসমান তামাক চাষ অঞ্চল থেকে পাওয়া)।

গৃহযুদ্ধের অব্যবহিত পূর্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। মিসিসিপি নদীর পূর্বে, বা সীমান্তবর্তী সমস্ত ভূমি ইউনিয়নে রাজ্য থাকলেও পশ্চিম তীরে তখনও স্থানীয় আমেরিকানরা বাস করত।

মার্কিন জাতির প্রথম ৭২ বছরের ইতিহাসের ৫০ বছরই, ক্রীতদাসের মালিক এমন ব্যাক্তিরাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি ছিলেন। সে সময, শুধুমাত্র দাসধারী রাষ্ট্রপতিরাই দ্বিতীয় মেয়াদে পুনরায় নির্বাচিত হিয়েছিলেন।[৭৮] এছাড়াও, দক্ষিণের রাজ্যগুলি তাদের জনসংখ্যায় ক্রীতদাসদের আংশিক গণনার কারণে কংগ্রেসে তাদের বর্ধিত অংশিদার দ্বারা উপকৃত হয়েছিল।

দাস বিদ্রোহ

গ্যাব্রিয়েল প্রসার (১৮০০), ডেনমার্ক ভেসি (১৮২২), ন্যাট টার্নার (১৮৩১) এবং জন ব্রাউন (১৮৫৯) এর মতো বিখ্যাত দাস বিদ্রোহীরা দক্ষিণে স্বেতাঙ্গদের ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ক্রীতদাসদের উপর কঠোর নজরদারি আরোপ করা হয় ও তাদের অধিকার হ্রাস করা হয়। ১৮৫০ সালের পলাতক ক্রীতদাস আইনের অধীনে পালিয়ে যাওয়া দাসদের পুনরায় তাদের মালিকদের নিকট হস্তান্তরে সহযোগিতা স্টেটগুলো বাধ্য ছিল। এই আইনের ব্যাপারে উত্তরবাসীদের ক্ষুব্ধ ছিল। পূর্বে, একটি পালিয়ে যাওয়া একজন ক্রীতদাস কোন দাসপ্রথার অস্তিত্ব নেই এমন কোন স্টেটে পৌঁছালে মিসৌরি সমঝোতার অধীনে সে স্বাধীনতা অর্জন করেছে বলে ধরে নেয়া যেত। ১৮৫৭ সালের ড্রেড স্কট বনাম স্যান্ডফোর্ড মামলায় মার্কিন সুপ্রিম কোর্ট মিসৌরি আপোষকে অসাংবিধানিক বলে রায় দেয়।

প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন এবং বিচ্ছিন্নতা

১৮৬০ সালের নির্বাচনে আব্রাহাম লিংকন জয়ের পর, ৭ টি দক্ষিণাঞ্চলীয় স্টেট ইউনিয়ন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ১৮৬১ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি একটি নতুন রাষ্ট্র, কনফেডারেট স্টেটস অফ আমেরিকা (কনফেডারেসি) প্রতিষ্ঠা করে। কনফেডারেসি সমর্থিত সেনারা দক্ষিণ ক্যারোলিনার একটি মার্কিন সেনা দুর্গ ফোর্ট সামটার আক্রমণ করে। সেই সাথে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। লিংকন যখন ১৮৬১ সালের এপ্রিলে কনফেডারেসিকে দমন করার জন্য সৈন্যদের আহ্বান করেছিলেন, তখন আরও চারটি স্টেট আলাদা হয়ে যায় এবং কনফেডারেসিতে যোগ দেয়। কয়েকটি (উত্তরাঞ্চলীয়) "দাস রাজ্য" যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয়নি এবং সীমান্ত রাজ্য হিসেবে পরিচিতি লাভ করে; এগুলো ছিল ডেলাওয়্যার, মেরিল্যান্ড, কেনটাকি এবং মিসৌরি। যুদ্ধের সময়, ভার্জিনিয়ার উত্তর-পশ্চিম অংশ কনফেডারেসি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।[৭৯] এবং পশ্চিম ভার্জিনিয়ার নতুন ইউনিয়ন স্টেটের জন্ম হয়। পশ্চিম ভার্জিনিয়া সীমান্ত রাজ্যের সাথে যুক্ত ছিল।

গৃহযুদ্ধ

গেটিসবার্গে নিহত ইউনিয়ন সৈন্য, টিমোথি এইচ ও'সুলিভানের ছবি, ৫ ও ৬ জুলাই, ১৮৬৩
আব্রাহান লিংকনের গেটিসবার্গ এ্যাড্রেস

গৃহযুদ্ধ শুরু হয় ১২ এপ্রিল, ১৮৬১, যখন কনফেডারেট বাহিনী দক্ষিণ ক্যারোলিনার ফোর্ট সামটারে একটি মার্কিন সামরিক স্থাপনায় আক্রমণ করে। জবাবে, লিঙ্কন রাজ্যগুলিকে দুর্গ পুনরুদ্ধার, রাজধানী রক্ষা এবং ইউনিয়নের অখন্ডতা রক্ষার জন্য সৈন্য পাঠানোর আহ্বান জানান। বুল রানের প্রথম যুদ্ধে দুই সেনাবাহিনীর প্রথম বড় সংঘর্ষ হয়েছিল। এই সংঘর্ষের পর উভয় পক্ষই বুঝতে পেরেছিল যে, যুদ্ধটি যা ভাবা হয়েছিল তার থেকে অনেক বেশি দীর্ঘ এবং রক্তাক্ত হবে। [৮০]

অ্যান্টিটামের যুদ্ধে অ্যালান পিঙ্কারটন এবং মেজর জেনারেল জন আলেকজান্ডার ম্যাকক্লারনান্ডের সাথে লিঙ্কন।

ওয়েষ্টার্ণ থিয়েটারে, ইউনিয়ন বাহিনী তুলনামূলকভাবে সফল ছিল। পেরিভিলের যুদ্ধ এবং শিলোর যুদ্ধের মতো বড় যুদ্ধের সাথে ইউনিয়ন বাহিনীর গানবোটগুলো বড় কনফেডারেট অপারেশন ধ্বংস করে ইউনিয়নের জন্য কৌশলগত বিজয় নিয়ে আসে।[৮১] ওয়েস্টার্ণ থিয়েটারে যুদে ইউনিয়নের জন্য খারাপভাবে শুরু হয়েছিল। মার্কিন জেনারেল জর্জ বি ম্যাকক্লেলান তার উপদ্বীপ অভিযানে ভার্জিনিয়ার রিচমন্ডের কনফেডারেট রাজধানী দখল করতে ব্যর্থ হন এবং কনফেডারেট জেনারেল রবার্ট ই লি -এর আক্রমণে পিছু হটতে বাধ্য হন।[৮১] ইতিমধ্যে, উভয় পক্ষ ১৮৬১-১৮৬২সালে নতুন সেনাবাহিনী আকার বৃদ্ধি করতে এবং তাদের প্রশিক্ষণে মনোনিবেশ করেছিল। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সামরিক সাফল্যের মধ্যে ছিল সীমান্ত রাজ্যগুলি নিয়ন্ত্রণে ইউনিয়নের সাফল্য। কনফেডারেটগুলিকে মূলত সীমান্ত স্টেটগুলো ছেড়ে যেতে বাধ্য করা হয়েছিল। অ্যান্টিটামের যুদ্ধে ১৮৬২ সালের শরৎকালে কনফেডারেট বাহিনী পশ্চাদপসরণ করলে লিংকন তাদের সতর্ক করে দেন যে যদি রাজ্যগুলি ফিরে না আসে তবে তিনি ১৮৬৩ সালের জানুয়ারিতে একটি দাসত্ব বা বন্ধন-মোচন মুক্তির ঘোষণা দেবেন।

Four score and seven years ago our fathers brought forth upon this continent, a new nation, conceived in Liberty, and dedicated to the proposition that all men are created equal.

Now we are engaged in a great civil war, testing whether that nation, or any nation so conceived and so dedicated, can long endure. We are met on a great battle-field of that war. We have come to dedicate a portion of that field, as a final resting place for those who here gave their lives that that nation might live. It is altogether fitting and proper that we should do this.

But, in a larger sense, we can not dedicate—we can not consecrate—we can not hallow—this ground. The brave men, living and dead, who struggled here, have consecrated it, far above our poor power to add or detract. The world will little note, nor long remember what we say here, but it can never forget what they did here. It is for us the living, rather, to be dedicated here to the unfinished work which they who fought here have thus far so nobly advanced. It is rather for us to be here dedicated to the great task remaining before us—that from these honored dead we take increased devotion to that cause for which they gave the last full measure of devotion—that we here highly resolve that these dead shall not have died in vain—that this nation, under God, shall have a new birth of freedom—and that government of the people, by the people, for the people, shall not perish from the earth.

Abraham Lincoln

জেনারেল লি এর ছোট সেনাবাহিনী ১৮৬২ সালের শেষের দিকে এবং ১৮৬৩ সালের বসন্তে যুদ্ধে জয়লাভ করে। যুদ্ধে তিনি খুব আগ্রাসি ছিলেন। কিন্তু তিনি পশ্চিমে ইউনিয়নের হুমকি উপেক্ষা করেছিলেন। রসদ সরবরাহের উৎস সন্ধানে এবং উত্তরে যুদ্ধ-অবসাদ সৃষ্টি করার জন্য লি পেনসিলভেনিয়া আক্রমণ করেছিলেন। সম্ভবত এটাই যুদ্ধের টার্নিং পয়েন্টে ছিল। ১৮৬৩ সালের গেটিসবার্গের যুদ্ধে লি এর সেনাবাহিনী খুব খারাপভাবে পরাজিত হয়েছিল এবং কোনক্রমে ভার্জিনিয়াতে ফিরে এসেছিল।[৮২] ১৮৬৩ সালের জুলাই মাসে, জেনারেল ইউলিসিস এস. গ্রান্টের অধীনে ইউনিয়ন বাহিনী ভিকসবার্গের যুদ্ধে মিসিসিপি নদীর নিয়ন্ত্রণ লাভ করে, যার ফলে ভৌগলিকভাবে কনফেডারেসি বিভক্ত হয়। ১৮৬৪ সালে, ইউনিয়ন জেনারেল উইলিয়াম টেকুমসেহ শেরম্যান আটলান্টা দখল করার জন্য টেনেসির চ্যাটানুগা থেকে দক্ষিণে যাত্রা করেন। এই যুদ্ধের বিজয়ের পর উত্তরে রিপাবলিকানদের মধ্যে যুদ্ধের ডামাডোল শেষ হয়। এবং লিঙ্কনকে পুনরায় নির্বাচনে জিততে সাহায্য করেছিল।

হোমফ্রন্টে, উত্তরের শিল্প নাটকীয়ভাবে সম্প্রসারিত হতে শুরু করে। ব্যাপক রেলপথ পরিষেবা ব্যবহার করে এবং শিল্প শ্রমিকদের অস্ত্র কারখানায় নিযুক্ত করা হয়। বৈদেশিক বাণিজ্য প্রচুর বৃদ্ধি পেয়েছিল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ব্রিটেনে খাদ্য ও তুলা রপ্তানি করত।এবং ব্রিটেন ইউনিয়ন সেনাবাহিনীর জন্য তৈরি পণ্য এবং হাজার হাজার স্বেচ্ছাসেবক পাঠাচত (কিছু সংখ্যক স্বেচ্ছাসেবক অবশ্য কনফেডারেটদের কাছেও পাঠন হতো)। বেসামরিক কারখানা, খনি, শিপইয়ার্ড, ব্যাংক, পরিবহন এবং খাদ্য দ্রব্যের ব্যাপক সরবরাহ সবই প্রথম বিশ্বযুদ্ধে শিল্পায়নের প্রভাবকে পূর্বাভাস দেয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গৃহযুদ্ধ ইতিহাসের সবচেয়ে মারাত্মক যুদ্ধ হিসাবে বর্ণিত হয়েছে। এই যুদ্ধে প্রায় ৭৫০,০০০ সৈন্য নিহত হয়েছে এবং অনির্ধারিত সংখ্যক বেসামরিক হতাহতের হয়েছিল।

আমেরিকান গৃহযুদ্ধ ছিল বিশ্বের প্রথম দিকের শিল্প যুদ্ধ। এ যুদ্ধের ফলে রেলপথ, টেলিগ্রাফ, স্টিমশিপ এবং ব্যাপকহারে উৎপাদিত অস্ত্র সস্ত্র এ যুদ্ধে ব্যবহুত হয়েছিল।[খ]উত্তরাঞ্চলের মোট জনসংখ্যার ২০ থেকে ৪৫ বছর বয়সী সমস্ত পুরুষদের প্রায় দশ শতাংশ এবং দক্ষিনাঞ্চেলের ১৮ তেকে ৪০ শতাংশ পুরুষের ৩০ শতাংশ মারা যায়।[৮৫] এই যুদ্ধের প্রধানতম ফলাফলের মধ্যে ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দাসত্বের অবসান, ইউনিয়ন পুনরুদ্ধার এবং ফেডারেল সরকারের শক্তিবৃদ্ধি।

দাসত্ব-মোচনের ঘোষণা

Modern reading of President Abraham Lincoln's Emancipation Proclamation of 1863 giving freedom to all African Americans who resided within the Confederacy but not those within the Union.

দাসত্ব-মোচন ঘোষণা বা The Emancipation Proclamation ছিল ১৮৬৩ সালের ১ জানুয়ারি প্রেসিডেন্ট রাষ্ট্রপতি আব্রাহাম লিংকন কর্তৃক জারি করা একটি নির্বাহী আদেশ যেখানে দাসদের মুক্তির কথা ঘোষণা করা হয়েছিল। এক কথায় এই নির্বাহী আদেশ মার্কিন সরকার কর্তৃক স্বীকৃত আইনগত অবস্থা পরিবর্তন করেছিল।, কনফেডারেসির নির্ধারিত এলাকায় ৩ মিলিয়ন দাসকে "দাস" থেকে "মুক্ত" করে দিয়েছিল। কাযর্ত, একজন ক্রীতদাস কনফেডারেট সরকারের নিয়ন্ত্রণ থেকে পালিয়ে যায় বা ফেডারেল সৈন্যদের দখলে থাকা অঞ্চলে প্রবেশ করে, আইনত এবং প্রকৃতপক্ষে সে স্বাধীন হয়ে ওঠে। এসব ক্ষেত্রে মালিকরা কোন ক্ষতিপূরণ পাবার যোগ্য নয়। কৃষিজমির মালিকরা উপলব্ধি করে যে দাস-মুক্তি তাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দেবে, অনেকে তাদের ক্রীতদাসদের যতটা সম্ভব কেন্দ্রীয় সেনাবাহিনীর নাগালের বাইরে নিয়ে যায়। ১৮৬৫ সালের জুনের মধ্যে, ইউনিয়ন সেনাবাহিনী সমস্ত কনফেডারেসি তাদের নিয়ন্ত্রণে নেয় এবং সমস্ত দাসদের মুক্ত করে।[৮৬] অনেক সদ্যমুক্ত হওয়া দাস ফ্রিডম্যানস ব্যুরো দ্বারা পরিচালিত শিবিরে চলে যায়। সেখানে তাদের খাদ্য, আশ্রয়, চিকিৎসা সেবা এবং তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয়েছিল।

যুদ্ধ এবং পুনর্গঠনের বিলাম পরিবর্তনের ফলে বিপুল সংখ্যক কৃষ্ণাঙ্গ জনসংখ্যার উপর একটি বড় নেতিবাচক প্রভাব পরে। অনেক কৃষ্ণাঙ্গ দাস অসুস্থতা হয়ে মরা যায়।[৮৭]

পুনর্গঠন

পুনর্গঠন ১ জানুয়ারী, ১৮৬৩ সারের লিঙ্কনের দাস-মুক্তির ঘোষণা থেকে ১৮৭৭ সালের সমঝোতা পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিল।[৮৮][৮৯] লিংকনের সামনে তখন অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ছিল, প্রাক্তন দাস ("ফ্রিডম্যান"), প্রাক্তন বিদ্রোহীদের আনুগত্য এবং নাগরিক অধিকার, ফেডারেল রাষ্ট্রে ১১টি প্রাক্তন কনফেডারেট রাজ্যের অবস্থা, ভবিষ্যত কোন গৃহযুদ্ধ প্রতিরোধের জন্য ফেডারেল সরকারের ক্ষমতা বৃদ্ধি। এবং এসব সিদ্ধান্ত কে নেবে, প্রসিডেন্ট না কংগ্রেস? বেকার ফ্রিডম্যানদের অনাহার এবং বাস্তুচ্যুত হওয়ার মারাত্মক পরিস্থিতি সামাল দিতে সামরিক বাহিনী দ্বারা পরিচালিত প্রধান ফেডারেল ত্রাণ সংস্থা, ফ্রিডম্যানস ব্যুরো দ্বারা পূরণ করা হয়েছিল।[৯০]

আমূল পুনর্গঠন

প্রাক্তন কনফেডারেটস দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে বেশিরভাগ দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্যের নিয়ন্ত্রণে ছিল, কিন্তু ১৮৬৬ সালের নির্বাচনে কট্টরপন্থী রিপাবলিকানরা কংগ্রেসের নিয়ন্ত্রণ লাভ করলে অবস্থার পরিবর্তিত হয়। প্রেসিডেন্ট অ্যান্ড্রু জনসন, যিনি প্রাক্তন বিদ্রোহীদের সাথে পুনর্মিলনের জন্য সহজ শর্ত চেয়েছিলেন, কট্টর রিপাবলিকান কংগ্রেসের মুখে কার্যত ক্ষমতাহীন ছিলেন। তাকে অভিশংসিত করা হলেও, সিনেটে মাত্র এক ভোটের ব্যবধানে তাকে প্রেসিডেন্ট পদ থেকে সরানো যায়নি। কংগ্রেস কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষদের ভোটাধিকার প্রদান করে। অস্থায়ীভাবে অনেক প্রাক্তন কনফেডারেট নেতাদের নির্বাচন করার অধিকার স্থগিত করে। নতুন রিপাবলিকান সরকার ‘কার্পেট ব্যাগার’ (উত্তর থেকে নতুন আগত), এবং স্কেলওয়াগস (স্থানীয় স্বেতাঙ্গ দক্ষিনবাসী) নিয়ে গঠিত ফ্রিডম্যানদের জোটের সমর্থনে ক্ষমতায় এসেছিল। মার্কিন সেনাবাহিনী তাদের সমর্থন করেছিল। বিরোধীরা তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির ও শ্বেতাঙ্গদের অধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ করে।[৯১]

প্রবৃদ্ধি ও শিল্পায়ন

সীমান্ত এবং রেলপথ

ট্রান্সকন্টিনেন্টাল রেলপথের সমাপ্তি (১৮৬৯)

ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে আমেরিকার পশ্চিম তীর পর্যন্ত বসতি স্থাপিত হয়। এসব এলাকার সাথে প্রথমে ওয়াগন ট্রেন এবং পরে নৌকাযোগে যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু হয়। এরপর ট্রান্সকন্টিনেন্টাল রেলপথ স্থাপিত হয়। জার্মানি এবং স্ক্যান্ডিনেভিয়া থেকে আগত বিপুল সংখ্যক ইউরোপীয় অভিবাসী প্রেরি রাজ্যে কম খরচে বা বিনামূল্যে চাষাবাদের জমি গ্রহণ করেছিলেন। এলাকায় রৌপ্য এবং তামার খনির জন্য মাউন্টেন ওয়েস্ট স্থাপিত হয়।

ইন্ডিয়ানদের সাথে যুদ্ধ

তাদের ভূমি দখল করায় স্থানীয় আদিবাসী আমেরিকানরা প্রায়ই মার্কিন সেনাবাহিনী নেটিভ আমেরিকানদের সাথে ঘন ঘন ছোট ছোট যুদ্ধে লিপ্ত হতো। ধীরে ধীরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নেটিভ আমেরিকান উপজাতীয়দের জমিগুলি ক্রয় করে জমির উপর তাদের দাবি নিষ্প্রভ হয়ে পরে।

সোনালী কাল

স্কটিশ অভিবাসী অ্যান্ড্রু কার্নেগি, আমেরিকান ইস্পাত শিল্পের ব্যাপক প্রসারের নেতৃত্ব দেন।

"গিল্ডড এজ" বা সোনালী কাল শব্দটি মার্ক টোয়েন উনিশ শতকের শেষের দিকে আমেরিকান সম্পদ এবং সমৃদ্ধির নাটকীয় সম্প্রসারণের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি এই শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। শব্দটি সরকারের ব্যাপক দুর্নীতিকে বিশেষভাবে নির্দশ করে। এ সময়ের ‍গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারে মধ্যে ছিল ‘সিভিল সার্ভিস আইন’। এই আইন অনুসারে সরকারি চাকরির জন্য আবেদনকারীদের জন্য একটি প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল। অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ আইনগুলির মধ্যে ছিল, আন্তঃরাজ্য বাণিজ্য আইন, যা ছোট জাহাজ ও রেলপথের মধ্যে বৈষম্যের অবসান ঘটাযত। এছাড়াও শেরম্যান অ্যান্টিট্রাস্ট অ্যাক্ট, যা একচেটিয়া ব্যবসাকে নিষিদ্ধ করে। টোয়েন বিশ্বাস করতেন যে এই সময় জমির ফটকা কারবারি, অসৎ রাজনীতি এবং অনৈতিক ব্যবসার দ্বারা কলুষিত হয়েছিল।[৯২] চার্লস এ বিয়ার্ড এবং ম্যাথিউ জোসেফসনের সময় থেকে, কিছু ঐতিহাসিক মনে করেন যে গিল্ডড এজ এবং প্রগতিশীল যুগের অন্তত কিছু সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কার্যকরভাবে ধনিকতান্ত্রিক (Plutocracy) রাষ্ট্র ছিল। [৯২] [৯৩][৯৪][৯৫][৯৬][৯৭][৯৮]

১৮৯০ সাল নাগাদ আমেরিকান শিল্প উৎপাদন এবং মাথাপিছু আয় বিশ্বের অন্যান্য দেশের আয়কে ছাড়িয়ে যায়। ভারী ঋণ এবং খামারের দাম হ্রাসের প্রতিক্রিয়ায়, গম এবং তুলা চাষিরা পপুলিস্ট পার্টিতে যোগ দেয়।[৯৯] ইউরোপ থেকে প্রচুর অভিবাসী জনগন আমেরিকায় এসে আমেরিকান শিল্পের জন্য শ্রম সরবরাহ করে। এসব অভিবাসী মানুষ পূর্বের অনুন্নত এলাকাগুলোতে বসবাস করতে শুরু করে। ১৮৮০ থেকে ১৯১৪ পর্যন্ত সর্বোচ্চ সংখ্যক অভিবাসী জনগন, ২২ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করেছিল।[১০০] বেশিরভাগই ছিল অদক্ষ শ্রমিক যারা দ্রুত খনি, কল এবং কারখানায় চাকরি পেয়ে গিয়েছিল। দারিদ্র্য, ক্রমবর্ধমান বৈষম্য এবং বিপজ্জনক কাজের অবস্থা, ইউরোপীয় অভিবাসীদের থেকে ভিন্ন সমাজতান্ত্রিক এবং নৈরাজ্যবাদী ধারণার সাথে শ্রমিক আন্দোলনকে উস্কে দেয়। প্রায়ই সহিংস ধর্মঘট হতে থাকে।[১০১][১০২]

ইউনিয়ন এবং ধর্মঘট

দক্ষ শ্রমিকরা তাদের কর্ম নিয়ন্ত্রণ করে উত্তর -পূর্বের শিল্প এলাকায় শ্রমিক ইউনিয়ন গঠন করে নিজেদের মজুরি বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে একজোট হয়। ১৯৩০ এর আগে কিছু কারখানার শ্রমিক, শ্রমিক ইউনিয়নগুলিতে যোগদান করেছিল। স্যামুয়েল গম্পার্স আমেরিকান ফেডারেশন অফ লেবার (১৮৮৬-১৯২৪) এর নেতৃত্ব দেন। তিনি একাধিক ইউনিয়নের মধ্যে সমন্বয়সাধনের কাজটি করেন। জ্বালানি তেল শিল্পে জন ডি. রকফেলার এবং ইস্পাত শেল্পে অ্যান্ড্রু কার্নেগির নেতৃত্বে প্রভূত প্রবৃদ্ধি ঘটে। এই দুই মহান শিল্পপতি পরে বিখ্যাত সমাজসেবক উভয়েই জনহিতকর কর্মকান্ডের নেতা (গসপেল অফ ওয়েলথ) হিসাবে আবির্ভূত হন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাসপাতাল, বিশ্ববিদ্যালয়, লাইব্রেরি এবং সকল আধুনিক প্রতিষ্ঠানেগুলোর ভিত্তি তৈরী করতে ব্যাপক ভূমিকা পালন করেছিলেন।

১৮৯৩ সালে দেশজুড়ে মন্দার আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। কৃষিপণ্যের দাম, শ্রমের মজুরি এবং লাভ হ্রাস পেতে থাকে।[১০৩] অনেক রেল কোম্পানি দেউলিয়া হয়ে গেল। এসবের রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া হল খুব খারাপ। শাসক দল ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রতি অসন্তোষ বাড়তে থাকে। পার্টির নেতা রাষ্ট্রপতি গ্রোভার ক্লিভল্যান্ড নিজের কাঁধে এসব দায়ভার নিয়ে নেন। শ্রমিকরা এই সময়ে অসংখ্য ধর্মঘটের ডাক দেয়। বিশেষ করে ১৯৮৯৪ সালের সহিংস পুলম্যান স্ট্রাইক। ক্লিভল্যান্ডের নির্দেশে ফেডারেল সৈন্যরা এই ধর্মঘট দমন করেছিল।

সাম্রাজ্যবাদ

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১৮৯০ সালের পর বিশ্বের অন্যতম অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। মূল পর্বটি ছিল স্প্যানিশ-আমেরিকান যুদ্ধ। কিউবায় স্পেনের দমনমূলক নীতি সংস্কারের জন্য আমেরিকার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় এই যুদ্ধ শুরু হয়েছিল।[১০৪] এক মার্কিন কর্মকর্তা এই যুদ্ধের নাম দিয়েছিলেন, "চমৎকার ছোট যুদ্ধ" ("splendid little war")। এই যুদ্ধে স্থল এবং সমুদ্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পর পর বেশ কয়েকটি ছোট ছোট যুদ্ধে জয়লাভ করে। প্যারিস শান্তি সম্মেলনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ফিলিপাইন, পুয়ের্তো রিকো এবং গুয়াম অধিগ্রহণ করে।[১০৫] মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ তত্ত্বাবধানে কিউবা স্বাধীনতা লাভ করে। এই শান্তিচুক্তির শর্তগুলো বিতর্কের জন্ম দেয়। ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতা উইলিয়াম জেনিংস ব্রায়ান ফিলিপাইনের নিয়ন্ত্রণের বিরোধিতা করেছিলেন। এই পদক্ষেপ মার্কিন গণতন্ত্রের জন্য সাম্রাজ্যবাদমূলক ও অশোভন বলে সমালোচনা করেছিলেন।[১০৫] প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম ম্যাককিনলে সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। জাতি সমৃদ্ধির সাথে সাথে যুদ্ধে বিজয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গর্বের বিষয় বলে উল্লেখ করেন। ম্যাককিনলে ১৯০০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ব্রায়ানকে সহজেই পরাজিত করেছিলেন।[১০৬]

১৯০৮ সাল নাগাদ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সাম্রাজ্যে বিস্তারের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। এবং তাদের আন্তর্জাতিক মনোযোগ ক্যারিবিয়ান অঞ্চলের উপর সীমাবদ্ধ হয়, বিশেষ করে পানামা খাল নির্মাণের দিকেই তাদের সকল মনযোগ ছিল। ১৯১৪ সালে পানামা খাল চালু করা হয়। ফলস্বরূপ, জাপান এবং দূর প্রাচ্যের বাকি অংশের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য বৃদ্ধি পায়। [১০৭]

অসন্তোষ এবং সংস্কার

প্রগতিশীল যুগ

মধ্যবিত্ত শ্রেণীর রাজনীতির দুর্নীতি ও অদক্ষতা নিয়ে ক্রমবর্ধমান অসন্তোষ এবং শহারাঞ্চলের শিল্প সমস্যা মোকাবেলায় ব্যর্থতার প্রতিবাদে ১৮৯০-এর দশকে প্রগতিশীল প্রগতিশীল আন্দোলন শুরু হয়। প্রতিটি বড় শহর ও রাজ্যে এবং জাতীয় স্তরে, শিক্ষা, চিকিৎসা ও শিল্পে, প্রগতিশীলরা জরাজীর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলির আধুনিকীকরণ ও রাজনীতি থেকে দুর্নীতি দূরীকরণের জোড় দাবি জানাতে থাকে। উভয় দলের নেতৃস্থানীয় রাজনীতিবিদ, বিশেষ করে থিওডোর রুজভেল্ট, চার্লস ইভান্স হিউজ এবং রিপাবলিকান পক্ষে রবার্ট লা ফোলেট এবং ডেমোক্র্যাটিক পক্ষের উইলিয়াম জেনিংস ব্রায়ান এবং উড্রো উইলসন প্রগতিশীল সংস্কারের ধারণাটি গ্রহণ করেছিলেন। নারীরা তাদের ভোটাধিকার, বিভিন্ন অযৌক্তিক সামাজিক নিষেধাজ্ঞা এবং উন্নত বিদ্যালয়ের জন্য দাবি জানান। শিকাগোর জেন অ্যাডামস তাদের অন্যতম নেতা ছিলেন।

নারী ভোটাধিকার

মৌণ প্রহরা (Silent Sentinels), নারী বিক্ষোপকারীরা হোয়াইট হাউজের সামনে পিকেটিং করছে।

১৮৪৮ সালের জুন মাসে লিবার্টি পার্টির জাতীয় সম্মেলনের মাধ্যমে নারীদের ভোটাধিকার আন্দোলন শুরু হয়। প্রেসিডেন্ট প্রার্থী গেরিট স্মিথ বিষয়টিকে তার নির্বাচনী অঙ্গিকার হিসাবে গ্রহণ করে মহিলাদের ভোটাধিকারের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। এক মাস পরে, তার জ্ঞাতি বোন এলিজাবেথ ক্যাডি স্ট্যান্টন, লুক্রেটিয়া মট ও অন্যান্য মহিলাদের সাথে সেনেকা ফলস কনভেনশন গঠন করেন। সেখানে মহিলাদের জন্য সমান অধিকার এবং ভোটের অধিকারের দাবি ঘোষণা করা হয়।[গ] বিলুপ্তি আন্দোলনের সময় এই কর্মীদের অনেকেই রাজনৈতিকভাবে সচেতন হয়ে ওঠেন। "ফার্স্ট-ওয়েভ ফেমিনিজম"-এর সময় নারী অধিকারের প্রচারণার নেতৃত্বে ছিলেন স্ট্যান্টন, লুসি স্টোন এবং সুসান বি. অ্যান্টনিসহ আরও অনেক। স্টোন এবং পলিনা রাইট ডেভিস ১৮৫০ সালের বিখ্যাত ‘জাতীয় মহিলা অধিকার কনভেনশনের’ আয়োজন করেছিলেন। উনিশ শতকের শেষের দিকে কয়েকটি পশ্চিমা স্টেট নারীদের ভোটাধিকার প্রদান করে।[১০৯] ১৯১২ সালের দিকে নারীবাদী আন্দোলন পুনরায় শুরু হয়। তারা নারী ও পুরুষ উভয়ের সম অধিকারের দাবি জোরদার করে। তারা এও বলে যে মার্কিন রাজনীতির দুর্নীতি শুদ্ধিকরণের কাজটি পুরুষরা আর করতে পারছেন না বিধায় কাজিটি নারীদেরকেই করতে হবে।[১১০] অ্যালিস পলের নেতৃত্বে নারীদের আন্দোলন দানা বাধতে থাকে। রাজধানী এবং প্রধান শহরগুলিতে তারা বিক্ষোভ প্রদর্শণ করে। হোয়াইট হাউজের সম্মুখে ‘মৌণ প্রহরা’ (Silent Sentinels) এর সময়ে রাস্তার যান চলাচল বিঘ্নিত করায় অনেককে আটক করা হয়।[১১১]

নারী ভোটাধিকার বিরোধীদের যুক্তি ছিল এমন, যেহেতু শুধু পুরুষরাই যুদ্ধ করতে পারে, সেহেতু, শুধুমাত্র পুরুষরাই ভোটের অধিকার পাবার যোগ্য। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে হোম ফ্রন্টে কয়েক হাজার আমেরিকান মহিলার স্বেচ্ছা অংশগ্রহণ সেই যুক্তি খণ্ডন করে। ততদিনে সারা বিশ্বের বহু দেশে নারীদের ভোটাধিকার দেয়া হয়েছিল। এমনকি খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিমের অনেক স্টেটে নারীরা জাতীয় আঞ্চলিক নির্বাচনগুলোতে ভোট দিতে পারত। মার্কিন কংগ্রেস ১৯১৯ সালে সংবিধানের ঊনবিংশ সংশোধনী পাস করে এবং নারীরা ১৯২০ সালের নির্বাচনে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করে।[১১২]

যুদ্ধ, সমৃদ্ধি এবং হতাশা

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ

Romagne-sous-Montfaucon-এ আমেরিকান কবরস্থান

১৯১৪ সাল থেকে ইউরোপে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে, রাষ্ট্রপতি উড্রো উইলসন নিরপেক্ষ পররাষ্ট্র নীতি ঘোষণা করেন। কিন্তু একই সাথে জার্মানিকে তিনি সতর্ক করেছিলেন যে মিত্র দেশগুলিতে পণ্য সরবরাহকারী আমেরিকান জাহাজের বিরুদ্ধে সাবমেরিন আক্রমণ পুনরায় শুরু করার অর্থ হবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। জার্মানি সেই সতর্কতা অগ্রাহ্য করার ঝুঁকি নেয়। আরএমএস লুসিটানিয়ার মতো জাহাজ ডুবিয়ে দিয়ে ব্রিটেনে রসদ সরবরাহ বন্ধ করে যুদ্ধে জেতার চেষ্টা করে; মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১৯১৭ সালের এপ্রিলে যুদ্ধ ঘোষণা।[১১৪] আমেরিকান অর্থ, খাদ্য, এবং যুদ্ধাস্ত্র দ্রুত পৌঁছেছিল, কিন্তু প্রথমদিকে সৈন্যদের নিয়োগ এবং প্রশিক্ষণে সময় লাগছিল। ১৯১৮ সালের গ্রীষ্মে জেনারেল জন জে. পার্শিং-এর অধীনে প্রতিদিন প্রায় ১০,০০০ জন আমরিকান সৈন্য মোতায়েন হতে শুরু করে।[১১৫] যুদ্ধের বিরুদ্ধে ভিন্নমতকে ১৯১৮ সালের রাষ্ট্রদ্রোহ আইন এবং ১৯১৭ সালের গুপ্তচরবৃত্তি আইন দ্বারা দমন করা হয়। জার্মান ভাষা, বামপন্থী এবং শান্তিবাদী পত্রপত্রিকাগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়। যুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালানোর জন্য ২,০০০ জনেরও বেশি মানুষকে বন্দী করা হয়েছিল। পরে মার্কিন রাষ্ট্রপতি ওয়ারেন জি হার্ডিং সকল রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি দিয়েছিলেন।[১১৬]

১৯১৮ সালের নভেম্বরে মিত্রশক্তি জয় লাভ করে। প্রেসিডেন্ট উইলসন তাঁর বিখ্যাত চৌদ্দ দফা বক্তব্যের মাধ্যমে জার্মানির কাছে কাইজারকে পদচ্যুত করার দাবি জানান।

মহামন্দা

ডরোথিয়া ল্যাঞ্জ এর আলোকচিত্র, “মাইগ্রেন্ট মাদার”, ৩২ বছর বয়সী একজন সাত সন্তানের জননী, মার্চ ১৯৩৬

১৯২০ এর দশকে, জাতি ব্যাপক সমৃদ্ধি উপভোগ করেছিল, যদিও মার্কিন কৃষি অর্থনীতি দুর্বলতা ছিল। প্রাথমিক স্ফীতির পর ২৯ অক্টোবর, ১৯২৯ সালে স্টক মার্কেটের ব্যাপক পতন শুরু হয়।[১১৭][পূর্ণ তথ্যসূত্র প্রয়োজন] শেয়ার বাজারে ব্যাপক দরপতনের সাথে সাথে আরো কিছু অর্থনৈতিক কারনে বিশ্বব্যাপী মহামন্দা দেখা দেয়। মার্কিন বাজারে মুদ্রাসংকোচন দেখা দেয়। দ্রব্যমূল্য হ্রাস পায়, বেকারত্ব ১৯২৯ সালে ৩% থেকে ১৯৩৩ সালে ২৫%-এ উন্নীত হয়। চাষাবাদ ও খামারের দাম অর্ধেকে নেমে আসে এবং পণ্য উৎপাদন এক-তৃতীয়াংশ কমে যায়।[১১৮] এই মহামন্দার পিছনে বেশ কিছু কারণ ছিল, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল, উচ্চ ভোক্তা-ঋণ, ব্যাঙ্ক এবং বিনিয়োগকারীদের অতিরিক্ত অনুরোধের কারণে দেয়া ঋণের কারনে অনিয়ন্ত্রিত বাজার।[১১৯] এছাড়াও ভোক্তার অভাবে, অটোমোবাইল এবং যন্ত্রপাতিগুলির মতো ভারী পণ্যের উৎপাদন হ্রাস পায়। ১৯৩০ সালের অক্টোবরে কৃষকরা ব্যাপকভাকে ঋণ খেলাপি হতে থাকে ফলে অনেক ব্যাংক ব্যর্থ হয়ে যায়। সেই সময়ে কোনো ফেডারেল ডিপোজিট ইন্সুরেন্স ছিল না। ব্যাঙ্কের ব্যর্থতা একটি স্বাভাবিক অংশ হিসেবে বিবেচিত হত। উদ্বিগ্ন আমানতকারীরা তখন সঞ্চয় তুলে নিতে শুরু করে। ব্যাঙ্কগুলিকে তখন বাধ্য হয়ে নতুন ঋণ তৈরির পরিবর্তে পুরাতন ঋণের অবসানে বেশি মনযোগি হয়।[১২০] এর ফলে বাজারে অর্থ সরবরাহ কমে যায়। ফলে অর্থনীতি সংকুচিত হয়ে যায়। যার ফলে সামগ্রিক বিনিয়োগে উল্লেখযোগ্য পতন ঘটে। ইতোমধ্যেই ধূঁকতে থাকা শিল্প ও কারবারের উপর আরও চাপ সৃষ্টি করে। এই মহামন্দা প্রায় চার বছর স্থায়ী হয়েছিল।[১২১]

ডিপ্রেশনের ফলে মার্কিন ইতিহাসে প্রথমবারের মতো দেশত্যাগের সংখ্যা বেড়ে যায়। কিছু অভিবাসী তাদের নিজ দেশে ফিরে যায়, এবং কিছু স্থানীয় মার্কিন নাগরিক কানাডা, অস্ট্রেলিয়া এবং দক্ষিণ আফ্রিকায় চলে যায়। গ্রেট প্লেইনস (ওকিস) এবং দক্ষিণের অতিরিক্ত ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা থেকে বিপুল সংখ্যক জনগন ক্যালিফোর্নিয়া এবং উত্তরের শহরে চলে যায়। ইতিহাসে যাকে মহা অভিবাসন বা কৃষ্ণাঙ্গ অভিবাসন বা ‘গ্রেট মাইগ্রেশন’ বলে।[১২২][১২৩] এ সময় জাতিগত উত্তেজনাও বেড়ে যায়। ১৯৪০ সাল নাগাদ, অভিবাসন স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে এবং দেশত্যাগ হ্রাস পায়। ফ্র্যাঙ্ক ম্যাককোর্ট এর ‘অ্যাঞ্জেলার অ্যাশেজ’ বইয়ে দেশত্যাগের বর্ণনা পাওযা যায়।[১২৪]

শিকাগোতে একটি স্যুপের দোকানের বাইরে বেকার পুরুষের দল, ১৯৩১

মহামন্দা আধুনিক মার্কিন সাহিত্যে অনেক কিছু সংযোজন করেছে। জন স্টেইনবেকের রচিত ‘দ্য গ্রেপস অফ রাথ’ এবং ‘অফ মাইস অ্যান্ড মেন’ মহামন্দার পটভূমিতে দুইটি বিখ্যাত উপন্যাস।

১৯৩২ সালে, ডেমোক্র্যাটিক মনোনীত প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ফ্র্যাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্ট "আমেরিকান জনগণের জন্য একটি নতুন চুক্তি" বা নিউ ডিল এর প্রতিশ্রুতি দেন। স্টেট সরকারগুলিও পরিস্থিতি মোকাবেলায় নতুন কর্মপরিকল্পনা যুক্ত করে। এসব কর্মপরিকল্পনার জন্য অর্থ যোগানের জন্য বিক্রয় কর চালু করে। এই অবস্থায় আদর্শগতভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আধুনিক উদারনীতি প্রতিষ্ঠিত হয়। শ্বেতাঙ্গ, কৃষ্ণাঙ্গ, শ্রমিক, শ্রমিক ইউনিয়ন এবং দক্ষিণী শেতাঙ্গদের এই ‘নিউ ডিল’ এর কারনে সরকারের প্রতি কৃতঙ্গ ছিল এবং তারাই প্রায় তিন দশক ধরে ওয়াশিংটনে ডেমোক্র্যাটদের ক্ষমতায় রাখে।

দ্বিতীয় নিউ ডিলটি ১৯৩৫-১৯৩৬ সালে ঘোষিত হয়। এ সময় ওয়াগনার অ্যাক্টের মাধ্যমে শ্রমিক ইউনিয়ন গড়ে তোলা হয়েছিল। এই সব ইউনিয়ন ‘নিউ ডিল কোয়ালিশন’ এর মাধ্যমে ১৯৩৬, ১৯৪০ এবং ১৯৪৪ এর নির্বাচনে একটি বড় ভূমিকা রাখে। ১৯৪০ সালে যখন রক্ষণশীলরা ‘কনজারভেটিভ কোয়ালিশন’ এর মাধ্যমে কংগ্রেসে ক্ষমতায় ফিরে আসলে, বেশিরভাগ কর্মসূচি বন্ধ করে দেওয়া হয়। মার্কিন অর্থনীতি মূলত ১৯৩৬ সালের মধ্যে পূর্বাবস্থায় চলে আসলেও ১৯৩৭-১৯৩৮ সালে একটি তীক্ষ্ণ, সংক্ষিপ্ত মন্দা দেখা দেয়। যুদ্ধকালীন ব্যয়ের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদী বেকারত্ব হ্রাস পায়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ

পার্ল হারবার আক্রমণ করে জাপানিরা আমেরিকান নৌ শক্তিকে পঙ্গু করে দেয়, বহু মার্কিন যুদ্ধজাহাজ ধ্বংস হয়।

মহামন্দার বছরগুলিতে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন অভ্যন্তরীণ সমস্যার দিকে মনোনিবেশ করেছিল তখন বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্রের অবনতি ঘটে এবং অনেক দেশ স্বৈরশাসকদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। জাপান সাম্রাজ্য পূর্ব এশিয়া এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তার করে। নাৎসি জার্মানি এবং ফ্যাসিবাদী ইতালি সমন্বিতভাবে আক্রমনের হুমকি দেয়, অন্যদিকে ব্রিটেন এবং ফ্রান্স ইউরোপে আরেকটি যুদ্ধ এড়ানর চেষ্টা করে। নিরপেক্ষতা আইন অনুসারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিদেশী সংঘাত এড়াতে চেয়েছিল। ১৯১৩৯ সালের সেপ্টেম্বরে পোল্যান্ডে জার্মান আক্রমণের পর ক্রমবর্ধমান নাৎসি-বিরোধী অনুভূতির সাথে সংঘর্ষ শুরু হয় এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। প্রথমে, রুজভেল্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে "গণতন্ত্রের অস্ত্রাগার" হিসাবে বর্ণনা করে কোনও সৈনিক মোতায়েন ব্যাতিত মিত্রশক্তিকে সম্পূর্ণ আর্থিক এবং যুদ্ধাস্ত্র সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।[১২৫] জাপান ১৯৪১ সালে পার্ল হারবারে আক্রমণ দ্বারা প্রশান্ত মহাসাগরে আমেরিকার শক্তিকে প্রতিহত করার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু তার পরিবর্তে এই ঘটনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহনে অনুঘটক হিসাবে কাজ করেছিল।[১২৬]

মিত্রবাহিনীর এই যুদ্ধ প্রচেষ্টায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবদানের মধ্যে ছিল অর্থ, খাদ্য, পেট্রোলিয়াম, প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন এবং (বিশেষ করে ১৯৪৪-১৯৪৫) সৈন্যবাহিনী প্রদান করা। মার্কিন সরকারের মূল উদ্দেশ্য ছিল জাতীয় অর্থনৈতিক উৎপাদন সর্বাধিক করা, মিত্রশক্তি এবং বিদেশে মার্কিন বাহিনীর ব্যবহারের জন্য প্রচুর পরিমাণে সরবরাহের রপ্তানি করা ও বেকারত্বের অবসান করা। এর ফলে তাদের জিডিপি নাটকীয় ভাবে বৃদ্ধি পায়। পাশাপাশি যুদ্ধের প্রয়োজনে বেসামরিক খাতের চাহিদা ও ভোগও বৃদ্ধি পায়। লক্ষ লক্ষ কর্মী নিম্ন-উৎপাদনশীল পেশা থেকে উচ্চতর ও দক্ষ চাকরিতে উন্নিত হয়। উন্নত প্রযুক্তি এবং ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে উৎপাদনশীলতা বেড়ে যায় এবং ছাত্র, অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তি, গৃহিণী এবং বেকাররা সক্রিয় শ্রমশক্তিতে রূপান্তরিত হয়। অর্থনৈতিক গতিশীলতা ব্যবস্থাপনায় ‘ওয়ার বোর্ড’ কাজ করে। যুদ্ধকালীন উৎপাদন বৃদ্ধির ফলে পূর্ণ কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়, যা মহামন্দার চিহ্নকে মুছে দেয়। প্রকৃতপক্ষে, শ্রমের ঘাটতির কারনে শিল্পগুলি শ্রমিকদের নতুন উৎস হিসাবে নারী ও কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করে। [১২৭] বেশিরভাগ ভারী ও টেকসই পণ্য দুষ্প্রাপ্য হয়ে পড়েছিল। মাংস, পোশাক এবং পেট্রল কঠোরভাবে রেশনিং করা হয়েছিল। শিল্পাঞ্চলে আবাসনের ব্যবস্থা অপ্রতুল ছিল কারণ মানুষের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছিল। অধিকাংশ শ্রমিক ক্ষুদ্র ও অপ্রসস্থ কোয়ার্টারে বসবাস করত। মূল্য এবং মজুরি নিয়ন্ত্রণ করা হতো। এ সময় আমেরিকানরা তাদের আয়ের একটি বড় অংশ সঞ্চয় করতো। এসব সঞ্চয় যুদ্ধের পরে মহামন্দা ফিরে আসার পরিবর্তে অর্থনীতিতে নতুন প্রবৃদ্ধি নিয়ে আসতে কাজে লেগেছিল।[১২৮][১২৯]

১৯৪৩ সালের নভেম্বরে তারাওয়া সমুদ্র সৈকতে মার্কিন সৈন্যদের মৃতদেহ।

মিত্র শক্তি - মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং অন্যান্য দেশগুলি - জার্মানিকে প্রধান হুমকি হিসাবে মনে করত এবং ইউরোপের যুদ্ধকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আধিপত্য বিস্তার করে এবং ১৯৪২ সালে প্রশান্ত মহাসাগরে জাপানি সামরিক তৎপরতা রুখে দেয়। পার্ল হারবার এবং ফিলিপাইন হারানোর পরে এবং প্রবাল সাগরের যুদ্ধ (মে ১৯৪২) অমিমাংশিত থাকার পর, মার্কিন নৌবাহিনী মিডওয়েতে (জুন ১৯৪২) একটি দৃঢ় আঘাত হানে।) আমেরিকান স্থল বাহিনী উত্তর আফ্রিকার অভিযানে সহায়তা করেছিল যা শেষ পর্যন্ত ১৯৪৩ সালে মুসোলিনীর ফ্যাসিবাদী সরকারের পতনের সাথে সমাপ্ত হয়। ইতালি মিত্রবাহিনীর পক্ষ নেয়। ডি-ডে, জুন ৬, ১৯৪৪ সালে আরও একটি উল্লেখযোগ্য ইউরোপীয় ফ্রন্ট খোলা হয়েছিল, যেখানে আমেরিকান এবং মিত্রবাহিনী ব্রিটেন থেকে নাৎসি-অধিকৃত ফ্রান্স আক্রমণ করে।

যুদ্ধের উন্মাদনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জাপান বিরোধী মনোভাবের জন্ম দেয়। যার ফলে জাপানি আমেরিকানদের বন্দী করা হয়। রুজভেল্টের ৯০৬৬ তম এক্সিকিউটিভ অর্ডার বলে জাপানি বংশোদ্ভূত ১২০,০০০ জন আমেরিকানকে তাদের বাড়িঘর থেকে অপসারণ কের বন্দিশিবিরে রাখা হয়েছিল। আটককৃতদের দুই-তৃতীয়াংশ আমেরিকান নাগরিক এবং তাদের অর্ধেক ছিল শিশু।[১৩০][১৩১][১৩২]

ম্যানহাটন প্রকল্পের ট্রিনিটি পরীক্ষাটি ছিল পারমাণবিক অস্ত্রের প্রথম বিস্ফোরণ।

সামরিক গবেষণা বৃদ্ধি পায়, যার ফলে পারমাণবিক বোমা তৈরি করার জন্য ম্যানহাটন প্রজেক্ট এর মতো সামরিক গোপন পরিকল্পনা করা হয়।[১৩৩] ১৬ জুলাই ১৯৪৫ সালে প্রথম পারমাণবিক পরীক্ষাটি করা হয়।[১৩৪]

মিত্রশক্তি জার্মানদের ফ্রান্স থেকে হটিয়ে দিলে পশ্চিমের রনাঙ্গনের যুদ্ধ শেষ হয়। বার্লিনকে সোভিয়েতদের কাছে ছেড়ে দিতে হয়। ১৯৪৫ সালের মে মাসে আনুষ্ঠানিকভাবে ইউরোপে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে।[১৩৫] প্রশান্ত মহাসাগরে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র টোকিওর দিকে একটি ‘আইল্যান্ড হপিং’ বা ‘দ্বীপ লম্ফন’ কৌশল অবলম্বন করে। জাপান এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইতিহাসের সবচেয়ে বড় নৌ যুদ্ধে "লেইতে উপসাগরের যুদ্ধ" এ এই দুই দেশের বাহিনী অবতীর্ণ হয়। যুদ্ধে ফিলিপাইন পুনরুদ্ধার করা হয়।[১৩৬] তবে, যুদ্ধের ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ফিলিপাইনে যে সমস্ত উন্নয়নকর্মে বিনিয়োগ করেছিল তা ব্যর্থ হয়ে যায়। কারণ, শহরগুলি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল।[১৩৭] মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তখন মারিয়ানা দ্বীপপুঞ্জ থেকে জাপানের মূল ভূখণ্ডে বোমা হামলা চালানোর জন্য এবং ১৯৪৫ সালে ইও জিমা এবং ওকিনাওয়াতে বিমানঘাঁটি স্থাপন করে।[১৩৮] মার্কিন বোমারু বিমান বোয়িং বি-২৯ জাপানের হিরোশিমা এবং নাগাসাকি শহর দু’টিতে পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ করলে, জাপান আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয় এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে।[১৩৯] মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাপান (এবং জার্মানির অংশ) দখল করে এবং আমেরিকার সীমান্ত ধরে জাপানকে পুনর্গঠন করে।[১৪০]

যুদ্ধের সময়, রুজভেল্ট দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের চারটি প্রধান মিত্র শক্তি হিসাবে চিহ্নিত করেছিলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং গনচীন। এই চারটি জাতি পরবর্তীতে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ভিত্তি হয়ে ওঠে। যদিও জাতিটি ৪০০,০০০ এরও বেশি সামরিক এবং বেসামরিক লোকবল হারিয়েছিল। তথাপি, এই মহাযুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে এর ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের কোন কিছুই স্পর্শ করতে পারেনি।[১৪১]

যুদ্ধোত্তর মার্কিন বৈদেশিক বিষয়ে বিচ্ছিন্নতা ও নিরপেক্ষতা (isolationism) নীতির পরিসমাপ্তি ঘটে। পারমাণবিক অস্ত্রের হুমকি ও আশাবাদ উভয়ই জাগিয়ে তোলে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর থেকে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করা হয়নি। বিশ্বশক্তিগুলোর মধ্যে একটি "দীর্ঘ শান্তি" শুরু হয়েছিল যা ‘শীতল যুদ্ধ’ নামে পরিচিত। ২২ মে, ১৯৪৭ সালে ট্রুম্যান মতবাদ এই বাস্তবতাকেই তুলে ধরেছিল। এরপর বিশ্বব্যাপী যুদ্ধের অনুপস্থিতি সত্ত্বেও, কোরিয়া এবং ভিয়েতনামে আঞ্চলিক যুদ্ধ সংগঠিত হয়।[১৪২]

শীতল যুদ্ধ, পাল্টা সংস্কৃতি এবং নাগরিক অধিকার

শীতল যুদ্ধ

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের দুইটি প্রভাবশালী পরাশক্তির একটি হিসাবে আবির্ভূত হয়। অন্যটি ইউএসএসআর বা সোভিয়েত ইউনিয়ন। মার্কিন সেনেট দ্বিদলীয় ভোটে জাতিসংঘে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অংশগ্রহণের অনুমোদন করে। এর ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঐতিহ্যগত বিচ্ছিন্নতাবাদ থেকে সরে আসা এবং আন্তর্জাতিক সম্পৃক্ততাকে নিশ্চিত করে।

মার্কিন সৈন্যরা ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় একটি গ্রামে সম্ভাব্য ভিয়েত কং সদস্যদের খোঁজে অনুসন্ধান চালাচ্ছে

১৯৪৫-১৯৪৮ সালের প্রাথমিক আমেরিকান লক্ষ্য ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ থেকে ইউরোপকে উদ্ধার করা এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের রাজনৈতিক মতাদর্শ কমিউনিজমের বিস্তার ঠেকানো। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কোরিয়া এবং ভিয়েতনামের যুদ্ধে যোগ দিয়েছিল। তৃতীয় বিশ্বের বামপন্থী সরকারগুলিকে এর বিস্তার বন্ধ করার চেষ্টা করেছিল।[১৪৩] বলকানে কমিউনিস্ট সম্প্রসারণের হুমকি মোকাবেলায় ১৯৪৭ সালের ট্রুম্যান মতবাদ অনুযায়ী গ্রিস ও তুরস্ককে সামরিক ও অর্থনৈতিক সহায়তা প্রদান করে। ১৯৪৮ সালে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মার্শাল প্ল্যানের আওতায় টুকরো টুকরো আর্থিক সাহায্য কর্মসূচির আওতায় পশ্চিম ইউরোপের অর্থনীতিতে অর্থ সরবরাহ করে এবং ব্যবসায় ও বাণিজ্য বাধা দূর করে।[১৪৪] ১৯৪৮ সালে এই পরিকল্পনার বাজেট ছিল ১৩ বিলিয়ন থেকে বৃদ্ধি করে ২৫৮ বিলিয়ন ডলারে উন্নিত করা হয়। এছাড়াও যুদ্ধের শেষ এবং মার্শাল প্ল্যানের শুরুর মধ্যে ইউরোপকে অতিরিক্ত ১৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সাহায্যের দেয়া হয়েছিল। সোভিয়েত রাষ্ট্রের প্রধান জোসেফ স্টালিন তার স্যাটেলাইট রাজ্যগুলিকে এই কের্মসূচিতে অংশগ্রহণ করতে বাধা দেন। সেই সময় থেকে, পূর্ব ইউরোপ, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির দিক থেকে পশ্চিম ইউরোপের চেয়ে আরও পিছিয়ে পড়ে। ১৯৪৯ সালে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, শান্তিকালীন সময়ে সামরিক জোট না করার দীর্ঘস্থায়ী নীতি পরিত্যাগ করে, উত্তর আটলান্টিক চুক্তি সংস্থা (NATO) জোট গঠন করে। এই ন্যাটো জোট ২১ শতকেও অব্যাহত রয়েছে। জবাবে সোভিয়েতরা কমিউনিস্ট রাষ্ট্রগুলিকে নিয়ে ওয়ারশ চুক্তি গঠন করে।[১৪৪]

বাজ অলড্রিন (ছবিতে দেখানো হয়েছে) এবং নীল আর্মস্ট্রং ১৯৬৯ সালের NASA-এর অ্যাপোলো ১১ মিশনের সময় চাঁদে পদার্পণ করা প্রথম ব্যক্তি।
এ্যাপোলো ১১ এর শব্দ এবং চাঁদে অবতরণ

১৯৪৯ সালের আগস্টে সোভিয়েতরা তাদের প্রথম পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষা করে। বিশ্বে পারমাণবিক যুদ্ধের ঝুঁকি বেড়ে যায়। তবে ‘পারস্পরিক নিশ্চিত ধ্বংসের হুমকি’ (mutually assured destruction-MAD) উভয় শক্তিকে পারমাণবিক যুদ্ধ থেকে বিরত রাখে। এর অধিনে সোভিয়েত বা যুক্তরাষ্ট্র কোন পক্ষই প্রথমে পারমাণবিক অস্ত্র দ্বারা আঘাত করবে না। কারণ, MAD এর ধারণা অনুসারে, আঘাত হলে প্রতিপক্ষ তখন তিনপ্রকার উপায়ে প্রত্যাঘাত করবে - আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপনাস্ত্র, কৌশলগত দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ও পারমাণবিক ডুবোজাহাজ থেকে উৎক্ষেপিত ক্ষেপণাস্ত্র। এই ত্রিমূখী আক্রমনের ফলে নিশ্চিতভাবে আক্রমনকারী দেশ সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। MAD এর ফলে সরাসরি যুদ্ধ বন্ধ হলেও প্রক্সি যুদ্ধ শুরু হয়, বিশেষ করে কোরিয়া এবং ভিয়েতনামের যুদ্ধে উভয় পক্ষ প্রত্যক্ষ একে অপরের মুখোমুখি না হয়ে পরোক্ষ যুদ্ধে লিপ্ত হয়।[১৪২]

নাগরিক অধিকার নেতা মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র (ডানে)

প্রেসিডেন্ট ডোয়াইট ডি. আইজেনহাওয়ার, ১৯৩২ সাল থেকে প্রথম রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট হিসেবে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হন। তার কর্মকান্ড আমেরিকাবাসীর জীবন ও রাজনীতিতে স্থায়ী প্রভাব ফেলেছিল। [১৪৫] তিনি কোরিয়ান যুদ্ধের অবসান ঘটান এবং বড় সংঘর্ষ এড়িয়ে যান। তিনি উচ্চ প্রযুক্তি নির্ভর প্রতিক্ষা ব্যবস্থা যেমন, পারমাণবিক অস্ত্র বহনে সক্ষম দূরপাল্লার বোমারু বিমান এবং আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র গড়ে তুলে সামরিক ব্যয় কমিয়ে আনেন। ১৯৫৩ সালে জোসেফ স্ট্যালিনের মৃত্যুর পর আইজেনহাওয়ার সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক অর্জনের জন্য কাজ করেছিলেন।

১৯৫৭ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন পৃথিবীর কক্ষপথে প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ স্পুটনিক প্রেরণ করলে দুই দেশের মধ্যে স্পেস রেস শুরু হয়। ১৯৬০ সালে, জন এফ কেনেডি রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। তার সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মহাকাশ গবেষণা ত্বরান্বিত হয়। ভিয়েতনাম যুদ্ধে মার্কিন ভূমিকার বৃদ্ধি পায়, বে অফ পিগস আক্রমণ, কিউবান ক্ষেপণাস্ত্র সংকট এবং মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রকে কারাগারে বন্দী করা হয়। ২২শে নভেম্বর, ১৯৬৩ সালে কেনেডি আততায়ীর গুলিতে নিহত হন।[১৪৬]

নাগরিক অধিকার আন্দোলন

১৯৫০ এর দশকের শেষের দিকে, বিশেষ করে দক্ষিণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রাতিষ্ঠানিক বর্ণবাদ শুরু হয়। এর প্রতিবাদে নাগরিক অধিকার আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল। আফ্রিকান-আমেরিকান নেতা রোজা পার্কস এবং মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের মন্টগোমারি বাস বয়কটের মাধ্যমে আন্দোলন শুরু করেছিল। প্রায় চার বছর বর্ণবাদের বিরুদ্ধে এই সহিংস আন্দোলন চলতে থাকে। শেষ পর্যন্ত, কিছু মামলায় সুপ্রীম কোর্টের সিদ্ধান্ত, ১৯৬৪ সালের নাগরিক অধিকার আইন, ১৯৬৫ সালের ভোটিং অধিকার আইন এবং ১৯৬৮ সালের ফেয়ার হাউজিং অ্যাক্ট এর মাধ্যমে জিম ক্রো আইনের সমাপ্তি ঘটায় যা শ্বেতাঙ্গ এবং কৃষ্ণাঙ্গদের মাধ্যে জাতিগত ভেদাভেদ দূর হয়ে যায়। [১৪৭]

মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র, ১৯৬৪ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছিলেন। ১৯৬৮ সালে এক শ্বেতাঙ্গ উগ্রপন্থী তাকে হত্যা করে। তার মৃত্যুর পর অন্যরা এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন, বিশেষ করে তার বিধবা স্ত্রী কোরেটা স্কট কিং, যিনি তার স্বামীর মতোই সক্রিয় ছিলেন। তিনি ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরোধী এবং নারীমুক্তি আন্দোলনেরও একজন সক্রিয় নেত্রী ছিলেন। ১৯৬৭ সালের প্রথম নয় মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ১২৮ টি শহরে মোট ১৬৪ টি দাঙ্গা সংগঠিত হয়েছিল।[১৪৮] এই দশকের শেষ পর্যন্ত সমঅধিকারের দিকে ইতিবাচক অগ্রগতি হয়। বিশেষ করে সরকারি পরিষেবা, খেলাধুলা এবং বিনোদনের ক্ষেত্রে নতুন পরিবর্তন আসে। নেটিভ আমেরিকানরা তাদের জমির অধিকারের জন্য লড়াই করার জন্য ফেডারেল আদালতের দারস্থ হয়। ফেডারেল সরকারের চুক্তি মানতে ব্যর্থতার অভিযোগে তারা বিক্ষোভ করে। সবচেয়ে স্পষ্টবাদী নেটিভ আমেরিকান গোষ্ঠীগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল আমেরিকান ইন্ডিয়ান মুভমেন্ট (AIM)। ১৯৬০-এর দশকে, সেজার শ্যাভেজ ক্যালিফোর্নিয়ায় স্বল্প বেতনের কাজ করে এমন মেক্সিকান-আমেরিকান কৃষিখামার কর্মীদের সংগঠিত করতে শুরু করেন। তার নেতৃত্বে আঙ্গুর আহরণকারী শ্রমিকরা পাঁচ বছর ধরে ধর্মঘট করে। তারপর শ্যাভেজ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম সফল কৃষিখামার শ্রমিকদের ইউনিয়ন গঠন করেন। তার ইউনাইটেড ফার্ম ওয়ার্কার্স অফ আমেরিকা (ইউএফডব্লিউ) কয়েক বছর পর টিকে ছিল। তথাপি ১৯৯৩ সালে শ্যাভেজ মারা যাওয়ার পর তিনি মেক্সিকান আমেরিকানদের মানসে একজন সাধুর মর্যাদা পেয়েছিলেন।[১৪৯]

নারী মুক্তি

এ সময় নারীদের অসমতা বিরোধী একটি নতুন চেতনা মার্কিন জাতিকে নাড়া দিতে শুরু করে। ১৯৬৩ সালে বেটি ফ্রিডানের বেস্ট-সেলার দ্য ফেমিনিন মিস্টিক- প্রকাশিত হবার পর নারীর জীবন শুধু সংসারের গৃহিণী হবার যোগ্য এই সামাজিক মনোভাবের বিরুদ্ধে তীব্র মতবাদ গড়ে ওঠে। আন্দোলনকারীরা বিশ্বাস করত যে, নারীরা শুধুমাত্র স্ত্রী, মা বা গৃহিনী নয়, নারীরা পুরুষদের মতোই সব ধরনের কাজ করতে সক্ষম। ১৯৬৬ সালে ফ্রিডান, অন্যান্যরা নারীদের সহায়তায় ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর উইমেন (NOW) প্রতিষ্ঠা করেছিল।[১৫০][১৫১] ধীরে ধীরে এই আন্দোলনের ব্যাপকাতা ও কলেবর বৃদ্ধি পেতে থাকে।

আন্দোলনের ফলাফর হিসাবে, অনেক ফেডারেল আইন (যেমন বেতন, কর্মসংস্থান, শিক্ষা, কর্মসংস্থানের সুযোগ এবং মর্যাদা সমান করে; গর্ভাবস্থার বৈষম্যের অবসান ঘটায়; এবং মহাকাশ গবেষণা - নাসা, মিলিটারি একাডেমি এবং অন্যান্য সংস্থাকে নারীদের ভর্তির সুযোগ প্রদান), রাষ্ট্রীয় আইন (অর্থাৎ, যারা স্বামী দ্বারা স্ত্রী নির্যাতন বন্ধ করা এবং বৈবাহিক ধর্ষণ), সুপ্রিম কোর্টের রায় (অর্থাৎ চতুর্দশ সংশোধনীর সমান সুরক্ষা ধারা নারীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য বলে রায়) প্রণীত হয়। ষ্ট্রীয় ERA আইনের অধীনে নারীর সমান মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেছে এবং সামাজিক প্রথা ও চেতনা পরিবর্তন হতে শুরু করে।[১৫২]

বৈরীতার অবসান

প্রেসিডেন্ট রেগান ২৩ মার্চ, ১৯৮৩ সালে এসডিআই শুরুর ঘোষণা দিচ্ছেন

স্নায়ুযুদ্ধের মধ্যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি ভিয়েতনাম যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। এই যুদ্ধ খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই অজনপ্রিয় ছিল। ১৯৬৯ সালে রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট জনসন রিচার্ড নিক্সনের স্থলাভিষিক্ত হন, যিনি ধীরে ধীরে যুদ্ধকে দক্ষিণ ভিয়েতনামী বাহিনীর হাতে তুলে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি ১৯৭৩ সালে শান্তি চুক্তি নিয়ে আলোচনা শুরু করেন। এই চুক্তি যুদ্ধবন্দিদের মুক্তি নিশ্চিত করে এবং মার্কিন সেনাদের প্রত্যাহারের পথ ‍সুগম করে। এই যুদ্ধে ৫৮,০০০ মার্কিন সৈন্য মারা যায়। নিক্সন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং চীনের মধ্যে তীব্র অবিশ্বাসকে জাগিয়ে তোলেন। চালিত করেছিলেন, উভয় পক্ষের সাথে বৈরিতার অবসান করেন।[১৫৩]

ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি, ওয়াটারগেট অফিস কমপ্লেক্সে ডেমোক্র্যাটিক ন্যাশনাল কমিটির সদর দফতরে নিক্সনের অপারেটিভদের আড়িপাতার সাথে জড়িত থাকার অভিযোগ প্রমাণিত হলে, তার রাজনৈতিক ভিত্তি ধ্বংস হয়ে যায়। প্রেসিডেন্টের অনেক সহযোগীকে কারাগারে পাঠান হয় এবং ৯ আগস্ট, ১৯৭৪ এ নিক্সন পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। তার স্থলাভিষিক্ত হন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফোর্ড। সাইগনের পতন ভিয়েতনাম যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। ফলাফল স্বরূপ উত্তর ও দক্ষিণ ভিয়েতনাম পুনরায় একত্রিত হয়। একই বছর, প্রতিবেশী কম্বোডিয়া এবং লাওসে কমিউনিস্টদের বিজয় হয়।[১৫৩]

জিমি কার্টার ছিলেন ওয়াশিংটনের রাজনৈতিক অঙ্গনের একদম বাইরের একজন। ১৯৭৬ সালে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন।[১৫৪] আন্তর্জাতিক রাজনীতির অঙ্গনে, কার্টার ইসরায়েল এবং মিশরের মধ্যে ক্যাম্প ডেভিড চুক্তির মধ্যস্থতা করেন। ১৯৭৯ সালে, ইরানি ছাত্ররা তেহরানে মার্কিন দূতাবাসে হামলা চালায় এবং ৬৬ মার্কিন নাগরিককে জিম্মি করে। শুরু হয় ইরান জিম্মি সংকট। জিম্মি সঙ্কট এবং ক্রমাগত মুদ্রাস্ফীতি কারণে কার্টার ১৯৮০ সালের নির্বাচনে রিপাবলিকান প্রার্থী রোনাল্ড রিগানের কাছে হেরে যান। [১৫৫] ২০ জানুয়ারী, ১৯৮১ সালে, কার্টারের মেয়াদ শেষ হওয়ার কয়েক মিনিট পরে, ইরানে মার্কিন দূতাবাসে আটক অবশিষ্ট মার্কিন বন্দীদের মুক্তি দেওয়া হয়, এভাবে ৪৪৪ দিনের জিম্মি সংকটের অবসান ঘটে।[১৫৬]

রক্ষণশীলতার উত্থান এবং শীতল যুদ্ধের সমাপ্তি

মিখাইল গর্বাচেভরোনাল্ড রিগ্যান, ‘মধ্যপাল্লার পারমাণবিক শক্তি চুক্তি’ স্বাক্ষর করছেন

রোনাল্ড রিগান তার ১৯৮০ এবং ১৯৮৪ সালের বিপুল ভোটে জয়লাভ করে একটি বড় রাজনৈতিক পুনর্বিন্যাস করেছিলেন। রেগানের অর্থনৈতিক নীতি ("রিগ্যানোমিক্স" নামে পরিচিত) এবং ১৯৮১ সালের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার কর আইনের বাস্তবায়ন সাত বছরের মধ্যে শীর্ষ প্রান্তিক করের হার ৭০% থেকে ২৮% এ নামিয়ে এনেছিলেন।[১৫৭] রিগান সরকারি কর এবং প্রবিধান কমিয়ে আনতে থাকেনে।[১৫৮] মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১৯৮২ সালে অর্থনৈতিক মন্দার সম্মুখীন হয়েছিল। ধীরে ধীরে সে অবস্থা উল্টে যায়, মুদ্রাস্ফীতির হার ১১% থেকে ২%-এ নেমে আসে, বেকারত্বের হার ১৯৮২ সালের ডিসেম্বরে ১০.৮% থেকে ১৯৮৪ সালের নভেম্বরে ৭.৫%-এ নেমে আসে।[১৫৯] এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ৪.৫% থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৭.২% পর্যন্ত হয়েছিল।[১৬০] রিগান একটি জটিল ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা চালু করেছিলেন যা স্ট্র্যাটেজিক ডিফেন্স ইনিশিয়েটিভ (এসডিআই) নামে পরিচিত (বিরোধীরা "স্টার ওয়ারস" নামে ডাকতো) এই প্রযুক্তিতে, মার্কিন মহাকাশে লেজার সিস্টেমের সাহায্যে ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করতে পারতো। ১৯৯০ এর দশকের গোড়ার দিকে, স্নায়ুযুদ্ধের অবসান হয় এবং পারমাণবিক অস্ত্রাগারের দ্রুত হ্রাসের সাথে সাথে, ক্লিনটন প্রশাসনের সময়ে SDI-এর জন্য রাজনৈতিক সমর্থন বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৯৩ সালে SDI কর্মসূচী আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হয়।

১৯৮৫ সালে সোভিয়েত রাশিয়ার ক্ষমতায় আসেন। রিগান সোভিয়েত নেতা মিখাইল গর্বাচেভের সাথে চারবার বৈঠক করেছিলেন। তাদের শীর্ষ সম্মেলন ‘মধ্যপাল্লার পারমাণবিক শক্তি চুক্তি’ স্বাক্ষরিত হয়। গর্বাচেভ প্রথমে আমেরিকার সাথে ব্যয়বহুল অস্ত্র প্রতিযোগিতার সমাপ্তি ঘটিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নে কমিউনিজমকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলেন। [১৬১] তারপর ১৯৮৯ সালে পূর্ব ইউরোপীয় সাম্রাজ্যকে কমিউনিজম বলয় থেকে ছেঁটে ফেলে। ১৯৯১ সালের বড় দিনে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটে, মার্কিন-সোভিয়েত স্নায়ুযুদ্ধের অবসান ঘটে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের একমাত্র অবশিষ্ট পরাশক্তি হিসাবে আবির্ভূত হয় এবং ১৯৯০ এর দশকে ইরাকের বিরুদ্ধে ১৯৯১ সালের উপসাগরীয় যুদ্ধ সহ আন্তর্জাতিক বিষয়ে হস্তক্ষেপ অব্যাহত রাখে।

২১ শতকের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র

১১ সেপ্টেম্বর ("9/11") হামলা ও তৎপরবর্তি ঘটনা

2001 সালে ১১ সেপ্টেম্বর হামলার পর লোয়ার ম্যানহাটনের সাবেক ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার

১১ সেপ্টেম্বর, ২০০১ ("9/11"), মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার শিকার হয়। আল-কায়েদার ১৯ জন ছিনতাইকারী চারটি বেসামরিক বিমানকে আত্মঘাতী হামলায় ব্যবহার করে নিউ ইয়র্কের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ও মার্কিন সামরিক সদর দফতর পেন্টগনে হামলা করে। হামলায় টুইন টাওয়ারে দুটি টাওয়ারই সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছিল। মোট ২,৯৩৭ জন এই হামলায় নিহত হয়। এদের মধ্যে, ২০৬ জন বিমান যাত্রী, ২,৬০৬ জন যারা ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে ও তার আশেপাশে ছিলন। এবং ১২৫ জন পেন্টাগনে ছিলেন।[১৬২] বিমানের যাত্রী এবং ক্রুরা মিলে চতুর্থ প্লেনটির নিয়ন্ত্র পুনরায় নিয়ে নেয়। তারা বিমানটিকে নিরাপদে অবতরণ করাতে না পারলেও, পেনসিলভানিয়ার একটি খোলা মাঠে সেটাকে বিধ্বস্ত করে। চার সন্ত্রাসী সহ ৪৪ জন মারা যায়, কিন্তু বিনিময়ে যারা সন্ত্রাসীদের লক্ষ্যবস্তু ছিল তাদের জীবন রক্ষা পায়। দুই ঘণ্টার মধ্যে, ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের টাওয়ার দুটি সম্পূর্ণভাবে ধসে পড়ে। ফলে আশেপাশের এলাকার ব্যাপক ক্ষতি হয় এবং লোয়ার ম্যানহাটান বিষাক্ত ধুলোর মেঘে ছেয়ে যায়। জবাবে, রাষ্ট্রপতি জর্জ ডব্লিউ বুশ ২০ সেপ্টেম্বর "সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ" ঘোষণা করেন। তালেবান শাসনকে উৎখাত করার জন্য, ৭ অক্টোবর, ২০০১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটো আফগানিস্তানে আক্রমণ করে। আফগানিস্তানের সরকার তখন আল-কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেনকে সেখানে আশ্রয় দিয়েছিল।[১৬৩]

ভবিষ্যত এমন আক্রমণ প্রতিরোধ করার জন্য ফেডারেল সরকার নতুন স্বরাষ্ট্র বিষয়ক প্রচেষ্টা প্রতিষ্ঠা করেছিল। ইউএসএ প্যাট্রিয়ট আইন প্রনয়ন করে যোগাযোগের উপর নজরদারী করার সরকারের ক্ষমতা বৃদ্ধি করেছিল। ফেডারেল আইন প্রয়োগকারী এবং গোয়েন্দা পরিষেবাগুলির মধ্যে তথ্য ভাগ করে নেওয়ার উপর আইনি বিধিনিষেধ তুলে নিয়া হয়েছিল। ফেডারেল কাউন্টার-টেররিজম কার্যক্রমের নেতৃত্ব ও সমন্বয়ের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হোমল্যান্ড সিকিউরিটি বিভাগ তৈরি করা হয়।[১৬৪] ২০০২ সাল থেকে, মার্কিন সরকার সন্দেহভাজন সন্ত্রাসবাদীদের কিউবার মার্কিন নৌ ঘাঁটি, গুয়ানতানামো বে এর বন্দীশালায় অনির্দিষ্টকালের জন্য আটকে রাখে। এর ফলে বিশ্বজুড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ ওঠে।[১৬৫][১৬৬][১৬৭]

২০০৩ সালে, ১৯ মার্চ থেকে ১ মে পর্যন্ত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরাকে আক্রমণ করে। ইরাক সরকারের পতন ঘটে এবং ইরাকি স্বৈরশাসক সাদ্দাম হোসেনকে বন্দী করা হয়। বুশ প্রশাসনের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইরাক আক্রমণের পিছনে কারণ ছিল গণবিধ্বংসী অস্ত্র নির্মূল করা। [১৬৮] (সেটা জাতিসংঘেরও মূল দাবি ছিল, যদিও পরে তদন্তে গোয়েন্দা প্রতিবেদনের অংশগুলি ভুল বলে প্রমাণিত হয়েছিল)[১৬৯], ইরাকের জনগনেকে মুক্ত করা। শুরুর দিকে কিছু প্রাথমিক সাফল্য সত্ত্বেও, অব্যাহত ইরাক যুদ্ধ আন্তর্জাতিক সমালোচনার সম্মুখিন হয়। এবং ধীরে ধীরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ সমর্থনও হ্রাস পেতে থাকে। অনেকেই এই আক্রমণের পেছনে ব্যায়িত অর্থের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করে।[১৭০][১৭১]

ওবামা কংগ্রেসে ভাষণ দিচ্ছেন। সাথে ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং হাউস স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি, ফেব্রুয়ারি ২৪, ২০০৯.

আর্থিক সঙ্কট এবং ইরাক যুদ্ধ এই দুই কারনে প্রেসিডেন্ট বুশের অজনপ্রিয়তা হ্রাস পেলে, ২০০৮ সালে, প্রথম আফ্রিকান-আমেরিকান বংশদ্ভুত বারাক হুসেন ওবামা, রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন।[১৭২][১৭৩] তার নির্বাচনের পর, ওবামা অনিচ্ছার সাথে ইরাকে যুদ্ধ ৩১ আগস্ট, ২০১০ পর্যন্ত অব্যাহত রেখে এর সমাপ্তি ঘোষণা করেন। ১৫ ডিসেম্বর, ২০১১ পর্যন্ত ৫০,০০০ জন সৈন্য এবং সামরিক কর্মীকে ইরাকি বাহিনীকে সহায়তা করার জন্য এবং বাহিনী প্রত্যাহার করতে সাহায্য করার জন্য ইরাকে রাখা হয়েছিল। আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধ শেষ হবার পর মার্কিন সৈন্যরা দেশ ছেড়ে চলে যায়।[১৭৪] একই সময়ে, ওবামা আফগানিস্তানে মার্কিন সামিরক শক্তি বৃ্দ্ধি করেন। সেখানে অতিরিক্ত ৩০,০০০ সৈন্য মোতায়েন করেন। ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে সেখান থেকে সৈন্য প্রত্যাহার শুরু করার প্রস্তাব করেন।[১৭৫][১৭৬] ২০১৬ সালে বারাক ওবামা, ১৩৪৯১ তম নির্বাহী আদশে স্বীকারক্তি আদায়ের জন্য নির্যাতনের ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন।[১৭৫][১৭৬] পরবর্তিতে এই আদেশ আইনে রূপান্তরিত হয়েছিল।[১৭৬] ওবামা বিদেশে সিআইএ-চালিত গোপন বন্দীশালাগুলো (ব্ল্যাক সাইট) বন্ধের নির্দেশ দেন। [১৭৭][১৭৮] ওবামা গুয়ানতানামো বে ডিটেনশন ক্যাম্প "যত তাড়াতাড়ি সম্ভব" বন্ধ করতে চেয়েছিলেন। তার মেয়াদে বন্দী শিবিরের জনসংখ্যা ২৪২ বন্দী থেকে ৪৫ এ নেমে এসেছিল। গুয়ানতানামো রিভিউ টাস্ক ফোর্স অনেক বন্দিকে মুক্তি দিয়ে এবং বিদেশে পুনর্বাসনের ব্যবস্থাও করেছিল।[১৭৯][১৮০] ওবামার ইচ্ছা ছিল কারাগারটি একেবারে বন্ধ করে দেয়া। কিন্তু কংগ্রেসের বাধার কারনে তা সম্ভব হয়নি।[১৭৯]

২০১১ সালের মে মাসে, প্রায় এক দশক আত্মগোপনে থাকার পর, আল কায়েদার প্রতিষ্ঠাতা ও নেতা ওসামা বিন লাদেন, প্রেসিডেন্ট ওবামার সরাসরি নির্দেশে মার্কিন নৌসেনাদের একটি বিশেষ বাহিনী দ্বারা পরিচালিত অভিযানে পাকিস্তানের এবটাবাদে নিহত হন। আল কায়েদা যখন আফগানিস্তানে পতনের দাঁড় প্রান্তে, তখন সহযোগী সংগঠনগুলি ইয়েমেন এবং অন্যান্য প্রত্যন্ত অঞ্চলে তাদের কর্মকান্ড অব্যাহত রাখে। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্তা সিআইএ তাদের নেতাদের খুঁজে বের করতে এবং হত্যা করতে অতি আধুনিক প্রযুক্তি, ড্রোন ইত্যাদি ব্যবহার করে।[১৮১][১৮২]

১৫ এপ্রিল ২০১৩ সালে বোস্টন ম্যারাথনে এক বোমা হামলার ঘটনা ঘটে। প্রেসার কুকারে রাখা দুইটি বোমা ম্যারাথনের সমাপ্তি লাইনের কাছে বিস্ফোরিত হয়। এরপর সেখানে গোলাগুলিও হয়। এই ঘটনায় ৩ জন নিহত এবং ২৬৪ জন আহত হয়েছিল।

২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে ‘ইসলামিক স্টেট অফ ইরাক অ্যান্ড দ্য লেভান্ট’ (আইএসআইএস) নামে একটি সসস্ত্র ইসলামক গোষ্ঠীর কর্মকান্ড শুরু হয়। পশ্চিম ইরাক এবং পূর্ব সিরিয়ার বেশিরভাগ অঞ্চল তারা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। এ সময়ে আইএসআইএস তিন সাংবাদিকের শিরশ্ছেদ করে তাদের মধ্যে দুইজন আমেরিকান এবং একজন ব্রিটিশ। এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্ররা সেখানে বড় সামরিক আক্রমণ পরিচালনা করে।

২৮ ডিসেম্বর ২০১৪-এ, ওবামা আনুষ্ঠানিকভাবে আফগানিস্তানে যুদ্ধ মিশন শেষ করেন। এবং দূতাবাসের রক্ষীরা ছাড়া ২০১৬ সালের শেষের দিকে অবশিষ্ট সমস্ত মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের প্রতিশ্রুতি দেন।[১৮৩] সেখানের মার্কিন সামরিক মিশন আনুষ্ঠানিকভাবে ৩০ আগস্ট ২০২১ এ শেষ হয়। [১৮৪]

সম্প্রতিক ঘটনাবলী

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন কংগ্রেসের একটি যৌথ অধিবেশনে ভাষণ দিচ্ছেন, প্রথম নারী মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস এবং হাউস স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি তাঁর পিছনে দন্ডায়মান ২৮ এপ্রিল, ২০২১।

২০১৯ সালে, একটি অভিযোগে আসে যে, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ছেলের ব্যবসায়িক লেনদেনের তদন্ত করার দাবিতে ট্রাম্প ইউক্রেনের কাছ থেকে বিদেশী সহায়তা আটকে রেখেছেন। ফলস্বরূপ, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং কংগ্রেসের কাজে বাধা দেওয়ার জন্য ট্রাম্প অভিশংসিত হন। [১৮৫] মার্কিন ইতিহাসে তিনি তৃতীয় রাষ্ট্রপতি যিনি অভিশংসিত হলেন। তবে সিনেটের ভোটাভুটিতে ট্রাম্প অভিযোগ থেকে অব্যহতি পান।[১৮৬]

২০২০ সালের জানুয়ারিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম কোভিড-১৯ মহামারীর পাদুর্ভাব ঘটে। এ পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬০৮,০০০ জন। জুলাই ২০২১-এর হিসাব অনুযায়ী যা অন্য যেকোনো দেশের চেয়ে বেশি। এমনকি কোরীয় যুদ্ধ এবং ভিয়েতনাম যুদ্ধেও এত মৃত্যু ঘটেনি।[১৮৭]

বারাক ওবামা প্রশাসনের প্রাক্তন ভাইস প্রেসিডেন্ট ডেমোক্র্যাট জো বাইডেন ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্পকে পরাজিত করেছিলেন। ১৯৯২ সালের পর রাষ্ট্রপতি থাকা অবস্থায় একজন প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থির প্রথম পরাজয়।[১৮৮]

বাইডেন নির্বাচিত হবার পর, আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সৈন্যদের প্রত্যাহারের তারিখটি পিছিয়ে ৩১ আগস্ট করা হয়। ১২০,০০০ জনেরও বেশি মার্কিন নাগরিক এবং তাদের স্থানীয় সহায়তাকরীরা বিমানের মাধ্যমে কাবুল ত্যাগ করার পর, ৩০ আগস্ট, ২০২১ তারিখে আফগানিস্তানে মার্কিন সামরিক মিশন আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হয়।

আরও দেখুন

তথ্যসূত্র

বহিঃসংযোগ


উদ্ধৃতি ত্রুটি: "lower-alpha" নামক গ্রুপের জন্য <ref> ট্যাগ রয়েছে, কিন্তু এর জন্য কোন সঙ্গতিপূর্ণ <references group="lower-alpha"/> ট্যাগ পাওয়া যায়নি

🔥 Top keywords: রাম নবমীমুজিবনগর দিবসপ্রধান পাতামুজিবনগর সরকারবিশেষ:অনুসন্ধানইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগএক্স এক্স এক্স এক্স (অ্যালবাম)বাংলাদেশবাংলা ভাষামিয়া খলিফারাজকুমার (২০২৪-এর চলচ্চিত্র)আনন্দবাজার পত্রিকাআবহাওয়ারামপহেলা বৈশাখউয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগইসরায়েলইরানরবীন্দ্রনাথ ঠাকুরমুজিবনগরইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউনরিয়াল মাদ্রিদ ফুটবল ক্লাব২০২৪ ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগক্লিওপেট্রাচর্যাপদভূমি পরিমাপশেখ মুজিবুর রহমানজনি সিন্সকাজী নজরুল ইসলামঈদুল আযহাফিলিস্তিনইউটিউবভারতবিকাশআসসালামু আলাইকুমসৌদি আরববাংলা প্রবাদ-প্রবচনের তালিকামুহাম্মাদ