স্কার্ভি

ভিটামিন - সি এর অভাবজনিত রোগ

স্কার্ভি (ইংরেজি: scurvy) হলো ভিটামিন সি বা অ্যাসকরবিক অ্যাসিডের অভাবজনিত একটি রোগ।[১] এ রোগের প্রাথমিক উপসর্গগুলো হলো দুর্বলতা, ক্লান্তিবোধ ও হাত-পায়ে ব্যথা।[১][২]চিকিৎসা না করলে রক্তশূন্যতা, মাড়ির রোগ, চুলের পরিবর্তন ও ত্বক থেকে রক্তপাত ঘটতে পারে।[১][৩] রোগের অবস্থা খারাপ হতে থাকলে আরও কিছু লক্ষণ প্রকাশ পায় যেমন ক্ষত নিরাময়ে দেরি হওয়া, ব্যক্তিত্বের পরিবর্তন ও সর্বশেষে সংক্রমণ বা রক্তপাতজনিত কারণে মৃত্যুও হতে পারে।[২]

স্কার্ভি
প্রতিশব্দমোলারের রোগ, চিয়েডলের রোগ,স্কোরবিউটাস[১] বারলোর রোগ, হাইপোঅ্যাসকোরবেমিয়া[১] ভিটামিন সি ঘাটতি জনিত রোগ
স্কার্ভি রোগাক্রান্ত মাড়ি যা এই রোগের একটি উপসর্গ। দাঁতগুলোর মধ্যবর্তী ত্রিভুজাকৃতির অঞ্চলটি মাড়ির রক্তিমতা প্রদর্শন করে।
বিশেষত্বএন্ডোক্রাইনোলজি
লক্ষণদুর্বলতা, ক্লান্তিবোধ, চুলের পরিবর্তন, বাহু ও পায়ে ব্যথা, মাড়ির রোগ, অল্পতেই রক্তপাত।[১][২]
কারণভিটামিন সি-এর অভাব [১]
ঝুঁকির কারণমানসিক অসুস্থতা, অস্বাভাবিক খাদ্যাভ্যাস, মদ্যাসক্তি, প্রবীণ ব্যক্তি যারা একা বসবাস করেন, অন্ত্রীয় অপশোষণ, ডায়ালাইসিস[২]
রোগনির্ণয়ের পদ্ধতিউপসর্গের ওপর ভিত্তি করে।[২]
চিকিৎসাভিটামিন সি। [১], লেবু জাতীয় ফল।
সংঘটনের হারবিরল[২]

কমপক্ষে একমাস খুব কম বা ভিটামিন সি বিহীন খাবার খেলে এই রোগের উপসর্গ দেখা দেয়। [১][২] আধুনিক সময়ে স্কার্ভি হয় মূলত যাদের মানসিক অসুস্থতা, অস্বাভাবিক খাদ্যাভ্যাস, মদ্যাসক্তি রয়েছে ও যে-সকল প্রবীণ ব্যক্তি একাকী বসবাস করে।[২] অন্যান্য ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে অন্ত্রীয় অপশোষণ ও ডায়ালাইসিস[২] যদিও অনেক প্রাণী তাদের নিজস্ব ভিটামিন সি উৎপাদন করতে পারে, তবে মানুষ ও অন্যান্য অল্প কিছু প্রাণী পারে না।[২] কোলাজেন সংশ্লেষণের জন্য ভিটামিন সি প্রয়োজন।[২] শারীরিক লক্ষণ, এক্স-রে ও চিকিৎসার পরে উন্নতি এগুলো দেখেই রোগ নির্ণয় করা হয়।[২]

ভিটামিন সি দিয়ে চিকিৎসা শুরু করতে হয়।[১]কয়েকদিনের মধ্যেই উন্নতি লক্ষ করা যায় এবং কয়েক সপ্তাহের মধ্যে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যায়।[২]ভিটামিন সি এর উৎসের মধ্যে অন্যতম হলো লেবু জাতীয় ফল, কমলা, পেয়ারা, পেপে, স্ট্রবেরি, বরই, জাম্বুরা ও কিছু সবজি (যেমন লাল গোলমরিচ, কাঁচা মরিচ, বেল মরিচ, ব্রকলি ও টমেটো)[২]উচ্চতাপে রান্না ভিটামিন সি নষ্ট করে দেয়।[২]

পুষ্টির অভাবজনিত অন্যান্য রোগের তুলনায় স্কার্ভি একটি বিরল রোগ।[২] উন্নয়নশীল দেশগুলোতে অপুষ্টিজনিত কারণে এটা দেখা যায়।[২]শরণার্থীদের মধ্যে এই রোগের হার ৫-৪৫%[৪]প্রাচীন মিশরের সময়েও স্কার্ভি রোগের বর্ণনা পাওয়া যায়।[২]অধিক দূরত্বের সমুদ্র যাত্রায় এটা দেখা যেত যা অনেক মানুষের মৃত্যুর কারণ ছিল।[৫] পালের যুগে মনে করা হতো যে, ভ্রমণের সময় প্রায় ৫০ শতাংশ নাবিক স্কার্ভি রোগে মারা যাবে।[৬] ১৭৫৩ সালে রয়েল নেভির জেমস লিন্ড নামক একজন স্কটল্যান্ডীয় চিকিৎসক প্রমাণ করেন যে লেবু জাতীয় ফল দিয়ে সফলভাবে স্কার্ভির চিকিৎসা করা সম্ভব।[৭]১৭৯৫ সালের দিকে গিলবার্ট ব্লেন নামক স্বাস্থ্য সংস্কারক রয়েল নেভির প্রশাসকদেরকে নাবিকদের নিয়মিতভাবে লেবুর রস দেওয়ার জন্য প্ররোচিত করতে সমর্থ হন।[৬][৭]

উপসর্গসমূহ

প্রাথমিক উপসর্গের মধ্যে রয়েছে অসুস্থতা বোধ ও তন্দ্রা। এক থেকে তিন মাস পরে রোগীর অস্থি ব্যথা ও ঘনঘন শ্বাস হয়। কারনিটিন উৎপাদন কমে যাওয়ার জন্য পেশিব্যথা হতে পারে। অন্যান্য লক্ষণের মধ্যে অন্যতম হলো ত্বকের পরিবর্তন যেমন, ত্বক খসখসে হয়ে যাওয়া, সহজে কালশিরা পড়া ও লাল বিন্দুর মতো ফুসকুড়ি (পিটেকি), মাড়ির রোগ, দাঁত ঢিলা হয়ে যাওয়া, ক্ষত নিরাময়ে বিলম্ব হওয়া ও আবেগীয় পরিবর্তন (যেটা কোনো শারীরিক পরিবর্তন ঘটার পূর্বেই দেখা দিতে পারে)। শৌগ্রেন সিনড্রোম এর মতো চোখ ও মুখ শুষ্ক হয়ে যেতে পারে। পরবর্তীতে জন্ডিস, সর্বশরীরের স্ফীতি, প্রস্রাব কমে যাওয়া (অলিগিউরিয়া), স্নায়ুরোগ, জ্বর, খিঁচুনি ও এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।[৮]

কারণ

মানুষ বিপাকীয়ভাবে ভিটামিন সি সংশ্লেষণে অক্ষম, তাই খাদ্যে ভিটামিন সি এর অভাব হলে স্কার্ভি হয়।আধুনিক পশ্চিমা সমাজে বয়স্কদের ক্ষেত্রে স্কার্ভি বিরল, যদিও শিশু ও বৃদ্ধরা আক্রান্ত হয়। [৯]কার্যত বাণিজ্যিকভাবে সহজলভ্য সকল শিশুখাদ্যে ভিটামিন সি যোগ করা থাকে যা শিশুদের স্কার্ভি প্রতিরোধে সহায়তা করে। যদি মা পর্যাপ্ত ভিটামিন সি খায়, তাহলে মানব স্তন দুগ্ধে পর্যাপ্ত পরিমাণ ভিটামিন সি থাকে। বাণিজ্যিক দুধ পাস্তুরিত করা হয়, ফলে উচ্চতাপে প্রাকৃতিক ভিটামিন সি নষ্ট হয়ে যায়।[৬]স্কার্ভি অপুষ্টিজনিত রোগগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি। এরকম অণুপুষ্টি ঘাটতির অন্যান্য রোগগুলো হলো বেরিবেরিপেলাগ্রা। পৃথিবীর যে দরিদ্র অঞ্চলগুলো এখনও বাহ্যিক খাদ্য সহায়তার ওপর নির্ভরশীল সেসব অঞ্চলে স্কার্ভি রোগ বিদ্যমান।[১০]যদিও বিরল, শিল্পোন্নত দেশগুলোতে যেসকল ব্যক্তি সুষম খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলে নি তাদের মধ্যে এখনও স্কার্ভি রোগ দেখা যায়।[১১][১২][১৩][১৪][১৫]

নিদানতত্ত্ব

জানুসন্ধির এক্স-রে (তীর চিহ্ন স্কার্ভি রেখা নির্দেশ করে)

সমগ্র দেহের চলমান প্রক্রিয়াতে জড়িত উৎসেচকসমূহের উৎপাদন ও ব্যবহারের জন্য ভিটামিন হচ্ছে অত্যাবশ্যক উপাদান।[৬] দেহের বিবিধ জৈবসংশ্লেষী প্রক্রিয়ার জন্য অ্যাসকরবিক অ্যাসিডের প্রয়োজন। এটি হাইড্রোক্সিলেশন ও অ্যামিডেশন বিক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে।কোলাজেন সংশ্লেষণের সময় অ্যাসকরবিক অ্যাসিড যথাক্রমে প্রোলিল হাইড্রোক্সিলেজ ও লাইসিল হাইড্রোক্সিলেজ উৎসেচকদ্বয়ের জন্য কোফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করে। এই দুই উৎসেচক কোলাজেনে যথাক্রমে প্রোলিনলাইসিন নামক দুটি অ্যামিনো অ্যাসিডের হাইড্রোক্সিলেশনের জন্য দায়ী। হাইড্রোক্সিপ্রোলিন ও হাইড্রোক্সিলাইসিন কোলাজেন সুস্থিতকরণের জন্য দরকার।কোলাজেন মানদেহের একটি প্রাথমিক গাঠনিক প্রোটিন যা রক্তবাহ, পেশি, ত্বক, অস্থি, তরুণাস্থি ও অন্যান্য যোজক কলার জন্য দরকারী। ত্রুটিপূর্ণ যোজক কলার ফলে কৈশিক জালিকা ভঙ্গুর হয় যার ফলে অস্বাভাবিক রক্তপাত, কালশিরা ও অভ্যন্তরীণ রক্তপাত হতে পারে। কোলাজেন অস্থির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হওয়ায় অস্থি গঠনও আক্রান্ত হয়। দাঁত ঢিলা হয়ে যায় ও অস্থি সহজে ভেঙে যায়। ভাঙা অস্থি জোড়া লাগলেও পুনরায় আবার ভাঙতে পারে।[৬] ত্রুটিপূর্ণ কোলাজেন ফিব্রিলোজেনেসিস ক্ষত নিরাময়ে ব্যাঘাত ঘটায়।অচিকিৎসিত স্কার্ভি মারাত্মক হতে পারে।[১৬]

প্রতিরোধ

খাদ্য ও এতে প্রতি ১০০ গ্রামে ভিটামিন সি
উপাদানভিটামিন সি
পরিমাণ
(mg)
আমলকী৬১০.০০
বিছুটি৩৩৩.০০
পেয়ারা২২৮.৩০
ব্ল্যাককারেন্ট১৮১.০০
জেসপ্রি সানগোল্ড১৬১.৩০
মরিচ১৪৪.০০
পার্সলি১৩৩.০০
সবুজ কিউয়িফল৯২.৭০
ব্রকলি৮৯.২০
ব্রাসেলস স্প্রাউট৮৫.০০
বেল মরিচ৮০.৪০
পেঁপে৬২.০০
স্ট্রবেরি৫৮.৮০
কমলা৫৩.২০
লেবু৫৩.০০
বাঁধাকপি৩৬.৬০
পালং শাক২৮.০০
শালগম২৭.৪০
আলু১৯.৭০

ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণের মাধ্যমে স্কার্ভি প্রতিরোধ করা সম্ভব। ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবারের মধ্যে অন্যতম হলো আমলকী, মিষ্টি মরিচ বা ক্যাপসিকাম, ব্ল্যাককারেন্ট, ব্রকলি, মরিচ, পেয়ারা, কিউয়িফল ও পার্সলি। এছাড়া ভিটামিন সি সমৃদ্ধ অন্যান্য ফলের মধ্যে রয়েছে লেবু, জামির, কমলা, পেঁপেস্ট্রবেরি। ভিটামিন সি সমৃদ্ধ শাকসবজির মধ্যে রয়েছে ব্রাসেলস স্প্রাউট, বাঁধাকপি, আলুপালং শাক[১৭]কিছু প্রাণীজ খাদ্য যেমন কলিজা, মাকটাক ((তিমির চামড়া), ঝিনুক, মস্তিষ্ক, সুষুম্নাকাণ্ড ইত্যাদি। যেসকল প্রাণী নিজে নিজেই ভিটামিন সি তৈরি করতে পারে তাদের সতেজ মাংস স্কার্ভি প্রতিরোধের জন্য যথেষ্ট ভিটামিন সি ধারণ করে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে শুধু মাংস, এমনকি আংশিক রান্না করা মাংসও স্কার্ভি উপশম করতে পারে ( বিশেষভাবে ফরাসি সৈনিকরা যারা সতেজ ঘোড়ার মাংস খেয়েছিল)। অপরপক্ষে, অন্যান্য ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে শুধু মাংস নির্ভরশীল খাদ্যাভ্যাস স্কার্ভি করতে পারে।[১৮]


চিকিৎসা

দৈনিক ১০ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি খেতে বলা হয়।[১৯]দুই সপ্তাহের মধ্যে অধিকাংশ ব্যক্তি ভালো হয়ে যায়।[২০]

ইতিহাস

প্রাচীন মিশরে প্রায় খ্রিস্টপূর্ব ১৫৫০ অব্দে প্রথমবারের মতো স্কার্ভির উপসর্গ লিপিবদ্ধ করা হয়।[২১] প্রাচীন গ্রিসে, চিকিৎসক হিপোক্রেটিস (৪৬০-৩৭০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) স্কার্ভির লক্ষণ বর্ণনা করেছিলেন প্লীহার স্ফীতি ও অবরুদ্ধতা হিসেবে।[২২][২৩] ৪০৬ সালে চীনা সন্ন্যাসী ফা-হিয়েন লিখেছিলেন যে, স্কার্ভি প্রতিরোধ করার জন্য চীনা জাহাজগুলোতে আদা নিয়ে যাওয়া হতো।[২৪] ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার খেলে স্কার্ভি থেকে আরোগ্য লাভ হয় এই তথ্যটি বিস্মৃত হলেও বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে পুনরায় আবিষ্কৃত হয়।[২৫]

প্রারম্ভিক আধুনিক যুগ

ত্রয়োদশ শতাব্দীতে ক্রুসেডাররা বারংবার স্কার্ভিতে আক্রান্ত হতো। লেবুজাতীয় ফল খেলে স্কার্ভি থেকে আরোগ্য লাভ করা যায়, এই তথ্য ১৪৯৭ সালে ভাস্কো দা গামার সমুদ্র অভিযানের সময়ই জানা ছিল। [২৫][২৬] এবং ১৫০৭ সালে পেদ্রো আলভারেজ ক্যাব্রাল ও তার নাবিকদল তা নিশ্চিত করেন।[২৭] পর্তুগিজরা সেন্ট হেলেনা দ্বীপে ফলের গাছ ও শাক সবজি রোপন করেছিল। এশিয়া থেকে নিজ দেশে ফিরতি সমুদ্র যাত্রায় বিরতি স্থান হিসেবে এই দ্বীপকে ব্যবহার করত। যেসব নাবিকরা স্কার্ভি ও অন্যান্য রোগে আক্রান্ত হতো তাদেরকে এই দ্বীপে রেখে যেত। সুস্থ হলে পরবর্তী জাহাজে তারা বাড়ি ফিরত।[২৮]১৫০০ সালে, ক্যাব্রালের ভারতগামী নৌবহরের একজন নাবিক লিখেছিলেন যে, মালিন্দির রাজা অভিযাত্রিক দলকে সতেজ মেষমাংস, মুরগির মাংস, পাতিহাঁস ও এর সাথে লেবু ও কমলা দিয়েছিলেন যার ফলে আমাদের কয়েকজনের স্কার্ভি ভালো হয়েছিল[২৯][৩০]দূর্ভাগ্যজনকভাবে এসকল ভ্রমণ বর্ণনা স্কার্ভিঘটিত সামুদ্রিক বিয়োগান্তক ঘটনা থামাতে পারে নি। এর কারণ প্রথমত ভ্রমণকারী ও তাদের মধ্যে যারা নিজেদের স্বাস্থ্যের জন্য দায়ী কোনো যোগাযোগ ছিল না এবং আরেকটি কারণ হলো জাহাজে ফল ও শাক-সবজি বেশি দিন রাখা যেত না।[৩১]১৫৩৬ সালে, ফরাসি ভ্রমণকারী জাক কার্তিয়ে সেন্ট লরেন্স নদী ভ্রমণের সময় তার স্কার্ভি আক্রান্ত লোকদের সারিয়ে তুলার জন্য স্থানীয় লোকজনের জ্ঞান কাজে লাগিয়েছিলেন। তিনি চা বানাতে আর্বর ভাইটি নামক চিরহরিৎ বৃক্ষের কাঁটা সিদ্ধ করেছিলেন। পরবর্তীতে দেখা গিয়েছিল তাতে প্রতি ১০০ গ্রামে ৫০ মি.গ্রা. ভিটামিন সি আছে।[৩২][৩৩]চলমান জাহাজে এরূপ চিকিৎসা সহজলভ্য ছিল না যেখানে এই রোগের প্রকোপ সবচেয়ে বেশি ছিল।১৬০১ সালের ফেব্রুয়ারিতে, ক্যাপ্টেন জেমস ল্যানকাসটার, সুমাত্রায় যাত্রাকালে তার নাবিকদলের স্কার্ভি ঠেকানোর জন্য লেবু ও কমলা নিতে উত্তরাঞ্চলীয় উপকূলে জাহাজ ভিড়ান।[৩৪]ক্যাপ্টেন ল্যানকাসটার তার অধীন চারটি জাহাজে পরীক্ষা চালান। এক জাহাজের নাবিকদল নিয়মিত লেবুর রস পেত, আর অন্য তিন জাহাজে পেত না। ফলে, অন্য তিন জাহাজের সদস্যরা স্কার্ভিতে আক্রান্ত হয়েছিল এবং অনেকে মারাও গিয়েছিল।[৩৫]আবিষ্কারের যুগে (১৫০০ থেকে ১৮০০ অব্দ পর্যন্ত) প্রায় বিশ লাখ নাবিক স্কার্ভিতে মৃত্যু বরণ করেছে বলে অনুমান করা হয়।[৩৬] জোনাথান ল্যাম্ব লিখেছিলেন: ১৪৯৯ সালে, ভাস্কো দা গামা তার ১৭০ জন নাবিকদের মধ্যে ১১৬ জনকে হারিয়েছিলেন; ১৫২০ সালে, ম্যাগেলান ২৩০ জনের মধ্যে ২০৮ জন কে হারান;...সবাই মূলত স্কার্ভিতে মারা যায়।[৩৭]১৫৭৯ সালে, স্পেনীয় খ্রিস্টান ভিক্ষু ও চিকিৎসক অগাস্টিন ফারফেন একটি বই প্রকাশ করেছিলেন যাতে তিনি স্কার্ভির জন্য কমলা ও লেবু খেতে সুপারিশ করেছিলেন। এই চিকিৎসা স্পেনীয় নৌবাহিনীতে ইতোমধ্যে জানা ছিল।[৩৮]১৫৯৩ সালে, অ্যাডমিরাল স্যার রিচার্ড হকিন্স স্কার্ভি প্রতিরোধের জন্য কমলা ও লেবুর রস খাওয়ার কথা বলেছিলেন।[৩৯]১৬১৪ সালে, ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সার্জন জেনারেল জন উডল কোম্পানির জাহাজের শিক্ষানবিশ শল্যচিকিৎসকদের জন্য দা সার্জন'স মেট নামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেন। তিনি বারংবার নাবিকদের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে বলেন যে, স্কার্ভি রোগ থেকে আরোগ্য পেতে সতেজ খাবার খেতে হবে, যদি না পাওয়া যায় তাহলে কমলা, লেবু, লাইম ও তেঁতুল খেতে হবে।[৪০] যাহোক, তিনি এর কারণ ব্যাখ্যা করতে পারেন নি। তার এই দৃঢ়োক্তি তৎকালীন প্রভাবশালী চিকিৎসকদের মতামতকে টলাতে পারে নি যারা ভাবত যে স্কার্ভি ছিল পরিপাকন্ত্রের একটি সমস্যা।এমনকি ইউরোপে শুষ্ক অঞ্চলে মধ্যযুগের শেষ পর্যন্ত স্কার্ভি দেখা যেত প্রধানত শীতের শেষ দিকে যখন সবুজ শাকসবজি ও ফল পাওয়া যেত না বললেই চলে। আমেরিকা থেকে আলু আসা শুরু হলে অবস্থার উন্নতি হওয়া শুরু হয়।১৮০০ সালের মধ্যে স্কটল্যান্ডে স্কার্ভি প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যায়, যেখানে পূর্বে ব্যাপকভাবে এই রোগটি ছড়িয়েছিল।[৪১]:১১

অষ্টাদশ শতাব্দী

জেমস লিন্ড, স্কার্ভি প্রতিরোধ ক্ষেত্রে অন্যতম পথিকৃৎ।

১৭০৭ সালে গ্লস্টারশায়ারের হ্যাসফিল্ডের একটি বাড়িতে জনাবা এবট মিচেলের একটি হস্তলিখিত বই আবিষ্কৃত হয় যেখানে স্কার্ভি থেকে পরিত্রাণের ওষুধের কথা লিখা ছিল যা ছিল কমলার রস ও সাদা ওয়াইন বা বিয়ারের সাথে মিশ্রিত বিভিন্ন উদ্ভিদের নির্যাস।[৪২]১৭৩৪ সালে লেইডেন ভিত্তিক চিকিৎসক জোহান ব্যাকস্ট্রম স্কার্ভির ওপর একটি বই প্রকাশ করেন যাতে তিনি উদ্ধৃত করেন যে, স্কার্ভি হয় কেবল সবুজ সতেজ খাদ্য খাওয়া থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকলে; যা এই রোগের একমাত্র মুখ্য কারণ , এবং আরোগ্য লাভের জন্য সবুজ সতেজ শাকসবজি ও ফল খাওয়ার অনুরোধ জানান।[৪৩][৪৪][৪৫]যাহোক, ১৭৪৭ সালের দিকে জেমস লিন্ড আনুষ্ঠানিকভাবে জানান যে খাবারের সাথে লেবুজাতীয় ফল যোগ করে স্কার্ভির চিকিৎসা করা সম্ভব। এটা ছিল মেডিসিনের ইতিহাসে প্রথম নিয়ন্ত্রিত চিকিৎসা গবেষণা প্রতিবেদন।[৪৬][৪৭]

এইচ এম এস সালিসবারি তে নৌবাহিনীর সার্জন হিসেবে লিন্ড স্কার্ভির কতিপয় সুপারিশকৃত প্রতিকার কে তুলনা করে পরীক্ষা চালান। এর মধ্যে ছিল হার্ড সাইডার, ভিট্রিওল, ভিনেগার, সামুদ্রিক পানি, কমলা, লেবু এবং পেরুর গন্ধতরু, আদা, মার নামক গন্ধরস, সরিষা বীজ ও মুলার মূলের মিশ্রণ। আ ট্রিটিজ অন দা স্কার্ভি (১৭৫৩)[২][৪৬] নামক প্রবন্ধে লিন্ড তার গবেষণার বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেন এবং এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, স্কার্ভির চিকিৎসায় কমলা ও লেবু সবচেয়ে কার্যকর।[৬][৪৬]দুঃখজনকভাবে লিন্ডের এই দীর্ঘ ও জটিল কাজ তেমন প্রভাব ফেলতে পারে নি। লিন্ড নিজেও কখনো স্কার্ভির একক প্রতিকার হিসেবে লেবুর রসের কথা প্রচার করেন নি। তিনি এই চিকিৎসা মতামত এমন সময়ে দিয়েছিলেন যখন স্কার্ভির বহুবিধ কারণ ছিল। বিশেষত কঠোর পরিশ্রম, দূষিত পানি ও স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে লবণাক্ত মাংস খাওয়া যা স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাস ও রেচনক্রিয়া ব্যাহত করত। তাই স্কার্ভির জন্য একাধিক সমাধানের প্রয়োজন ছিল।[৬][৪৮]লিন্ডের সময় লেবুর রসকে ফুটিয়ে ঘন করা হতো। দুঃখজনকভাবে এই প্রক্রিয়া ভিটামিন সি নষ্ট করে দিত, ফলে লেবুর রস দিয়ে স্কার্ভির চিকিৎসা অসফল ছিল।[৬]অষ্টাদশ শতাব্দীতে শত্রুর হাতে যত ব্রিটিশ সেনা নিহত হয়েছে, স্কার্ভিতে তার চেয়ে বেশি মারা গিয়েছে। ১৭৪০-১৭৪৪ সালে জর্জ অ্যানসনের সমুদ্রাভিযানে প্রথম দশ মাসের মধ্যে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ (২০০০ জনের মধ্যে ১৩০০ জন) নাবিক স্কার্ভিতে মারা যায়।[৬][৪৯]সাত বছরব্যাপী যুদ্ধে রয়্যাল নেভি ১,৮৪,৮৯৯ জন সৈনিকের তালিকা তৈরি করেছিল; যার মধ্যে ১,৩৩,৭০৮ জনেরই খোঁজ মিলে নি বা রোগে মারা গিয়েছে। স্কার্ভি ছিল অন্যতম প্রধান কারণ। [৫০] যদিও ঐ সময়ে নাবিকরা ও নৌবাহিনীর সার্জনগণ এই ব্যাপারে প্রত্যয়ী ছিলেন যে লেবুজাতীয় ফল স্কার্ভি সারাতে পারে, কিন্তু প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসকগণ স্কার্ভির তৎকালীন তত্ত্বের সাথে মিলে নি বলে এই বিষয়কে একদমই আমলে নেন নি।চিকিৎসা তত্ত্ব এই ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল যে, নৌবাহিনীর পথ্য ও সামুদ্রিক জীবনের কষ্টের জন্য ত্রুটিপূর্ণ পরিপাকের দ্বারা ঘটিত অভ্যন্তরীণ পচনের ফলে স্কার্ভি রোগ হয়। যদিও এই প্রাথমিক ধারণাকে পরবর্তী তাত্ত্বিকগণ বিভিন্নভাবে জোর দেন, তথাপি তারা যে প্রতিকার সুপারিশ করেছিলেন (যা নৌবাহিনী গ্রহণও করেছিল) তা ছিল কেবল পরিপাকতন্ত্রকে সক্রিয় করতে 'হিসহিসে পানীয়' পানের চেয়ে সামান্য বেশি। সে সময় নিয়মিতভাবে ভিট্রিওলের এলিক্সার পান করানো হতো যা ছিল সালফিউরিক অ্যাসিড, স্পিরিট, কিঞ্চিৎ পানি ও মসলা মিশ্রিত একটি পানীয়।১৭৬৪ সালে, সেনাবাহিনীর সার্জন জেনারেল ও পরবর্তীতে রয়েল সোসাইটির সভাপতি স্যার জন প্রিঙ্গল ও ড. ডেভিড ম্যাকব্রাইড একটি নতুন চিকিৎসা নিয়ে আসেন। তাদের ধারণা ছিল টিসুতে 'নির্দিষ্ট বায়ু' না থাকায় স্কার্ভি হয় যা মল্ট ও ঔর্ট এর মিশ্রণ পান করে প্রতিরোধ করা যাবে। এই মিশ্রণের গাঁজনের মাধ্যমে শরীরে পরিপাক উদ্দীপ্ত করবে এবং হারানো গ্যাস পুনরুদ্ধার করবে।[৫১] এই ধারণাগুলো ব্যাপকভাবে গৃহীত হয়েছিল এবং শক্তিশালী সমর্থন পেয়েছিল, যখন জেমস কুক জাহাজে করে বিশ্বভ্রমণে (১৭৬৮-১৭৭১) বেরিয়েছিলেন। তিনি যেসকল প্রতিকার নিয়ে গবেষণা করছিলেন তার মধ্যে মল্ট ও ঔর্ট ছিল তালিকার শীর্ষে। তালিকার অন্যান্য জিনিসের মধ্যে ছিল বিয়ার, সাওয়ারক্রাউট (গাঁজনকৃত কাঁচা বাধাকপি), ও লিন্ডের রব (ঘনকৃত লেবুর রস)। তবে এর মধ্যে লেবু ছিল না।[৫২]একজন ব্যক্তিও সে সময় মারা যায় নি এবং তার প্রতিবেদন মল্ট ও ঔর্টের পক্ষে যায়। যদিও এটি এখন পরিষ্কার যে, এটা ও অন্যান্য যাত্রায় তার নাবিকদের স্বাস্থ্য ভালো থাকার পিছনে কারণ ছিল, কুক কঠোর শৃঙ্খলার মাধ্যমে জাহাজের পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করতেন এবং নিয়মিতভাবে জাহাজে সতেজ খাবার ও সবুজ শাকসবজি ও ফলমূল রাখতেন।[৫৩] কুক আর যে নিয়মটি করেছিলেন তা হলো জাহাজের তামার ফুটন্ত তাওয়ার উপরিভাগ থেকে প্রাপ্ত নোনা চর্বি ভক্ষণ নিষিদ্ধকরণ। নৌবাহিনীতে এটা খুবই প্রচলিত ছিল তখন। বায়ুর সংস্পর্শে এসে তামা যে যৌগগুলো তৈরি করত তা অন্ত্র থেকে ভিটামিন শোষণ ব্যাহত করত। [৫৪]

১৭৮৯-১৭৯৪ সালে স্পেনীয় নৌবাহিনী কর্মকর্তা আলেসান্দ্রো মালাসপিনার অভিযানটি ছিল প্রথম প্রধান দীর্ঘ দূরত্বের অভিযান যেখানে কার্যত কোনো স্কার্ভি দেখা যায়নি।মালাসপিনার চিকিৎসা কর্মকর্তা, পেদ্রো গঞ্জালেজ, প্রত্যয়ী ছিলেন যে সতেজ কমলা ও লেবু স্কার্ভি প্রতিরোধের জন্য অত্যাবশ্যক। উন্মুক্ত সাগরে ৫৬ দিনব্যাপী ভ্রমণে কেবল একবার প্রাদুর্ভাব ঘটেছিল। পাঁচজন নাবিকের উপসর্গ দেখা দিয়েছিল, তন্মধ্যে একজনের অবস্থা গুরুতর ছিল। গুয়াম দ্বীপে তিন দিন অবস্থানের পর তারা পাঁচজনই সুস্থ হয়ে উঠেন। বৃহৎ স্পেনীয় সাম্রাজ্য ও অনেক মধ্যবর্তী বন্দরসমূহ সতেজ ফল সংগ্রহ সহজতর করেছিল।[৫৫]যদিও শতাব্দীর শেষ দিকে ম্যাকব্রাইডের তত্ত্বকে চ্যালেঞ্জ করা হচ্ছিলো, তথাপি ব্রিটেনের চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান এই ধারণায় নিবেদিত ছিল যে, স্কার্ভি হলো অভ্যন্তরীণ 'পচনের' একটি রোগ এবং প্রশাসকদের দ্বারা পরিচালিত দা সিক অ্যান্ড হার্ট বোর্ড এই পরামর্শ অনুসরণে বাধিত অনুভব করতো। যাহোক, জিব্রাল্টার অবরোধ ও অ্যাডমিরাল রোডনির ক্যারিবীয় অভিযানের সময় লেবুর রস ব্যবহারের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে রয়্যাল নেভিতে এর কার্যকারিতার ব্যাপারে মতামত শক্তিশালী হয়েছিল। জিলবার্ট ব্লেইন[৫৬] ও থমাস ট্রটারের[৫৭] মতো বিশেষজ্ঞদের লেখার মাধ্যমে তা আরও শক্তিশালী রূপ লাভ করে। ১৭৯৩ সালের আসন্ন যুদ্ধের জন্য স্কার্ভি নির্মূল করা খুব জরুরি হয়ে পড়ে। কিন্তু প্রথম উদ্যোগ চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান থেকে আসেনি বরং এসেছিল অ্যাডমিরালদের পক্ষ হতে। মরিশাসের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনায় আদিষ্ট হয়ে রিয়্যার অ্যাডমিরাল গার্ডনার ঔর্ট, মল্ট ও ভিট্রিওলের ইলিক্সারের ব্যাপারে অনাগ্রহী ছিলেন যা তখনও রয়্যাল নেভির জাহাজে দেওয়া হচ্ছিল, এবং তিনি দাবি জানিয়েছিলেন যেন সমুদ্রাভিযানে স্কার্ভি ঠেকাতে তাকে লেবু সরবরাহ করা হয়। সিক ও হার্ট বোর্ডের সদস্যবৃন্দ তার অনুরোধকে সমর্থন জানান এবং নৌপ্রশাসন সদর দফতর এটির অনুমোদন দেয়। যাহোক, শেষ মূহুর্তে পরিকল্পনাটি পরিবর্তন করা হয়। মরিশাসের বিরুদ্ধে অভিযানটি বাতিল হয়। ১৭৯৪ সালের ২রা মে, কমোডোর পিটার রেইনিয়ারের অধীন কেবল এইচ এম এস সাফোক ও দুটি ছোট যুদ্ধ জাহাজ (স্লুপস্) একটি বহির্গামী কনভয়ের সাথে পূর্ব দিকে যাত্রা করেছিল, কিন্তু জাহাজগুলোতে পরিপূর্ণভাবে লেবুর রস ও এর সাথে মিশানোর জন্য চিনি সরবরাহ করা হয়েছিল। অতঃপর ১৭৯৫ সালে, আশ্চর্যজনক একটি সংবাদ আসলো। চার মাস সমুদ্র যাত্রা শেষে সাফোক কোনো স্কার্ভির চিহ্ন ছাড়াই ভারতে এসে পৌঁছেছে এবং এর নাবিকদল যাত্রাকালের চেয়েও স্বাস্থ্যবান ছিল। ফলটা ছিল তাৎক্ষণিক। রণতরির অধিনায়কগণও উচ্চৈঃস্বরে লেবুর রস সরবরাহের দাবি জানালেন এবং কতৃপক্ষও পরবর্তীতে সকল যুদ্ধ জাহাজে লেবুর রস সরবরাহের অনুমতি দিয়ে দিল।[৫৮]নৌবহরের সকল জাহাজে লেবুর রস সরবরাহের যথোপযুক্ত পদ্ধতি খুঁজে পেতে এবং লেবুর রসের ব্যাপক সরবরাহ নিশ্চিত করতে কয়েক বছর লেগে গিয়েছিল, তবে ১৮০০ সালের মধ্যে, একটি পদ্ধতি দাঁড়িয়ে যায় এবং কাজ করা শুরু করে। এর ফলে নাবিকদের স্বাস্থ্যের দারুন উন্নতি চোখে পড়ে এবং এর ফলস্বরূপ নৌযুদ্ধে শত্রুর বিরুদ্ধে সুবিধা পেতে শুরু করে বিশেষ করে এখনো যারা এই পদ্ধতি গ্রহণ করেনি।

ঊনবিংশ শতাব্দী

হেনরি ওয়ালশ ম্যাহন এর জার্নালের একটা পৃষ্ঠা যেখানে তার সময়ের এইচ এম কনভিক্ট শিপ ব্যারোসা (১৮৪১/২) তে যাত্রাকালীন স্কার্ভির ফল দেখানো হয়েছে।

আলেকজান্দ্রিয়া অবরোধকালীন (১৮০১) নেপোলিয়নের সেনাবাহিনীর প্রধান সার্জন, ব্যারন ডোমিনিক-জাঁ লারে, তার স্মৃতিকথায় লিখেছিলেন যে ঘোড়ার মাংসের ভক্ষণ ফরাসিদেরকে স্কার্ভির মহামারী ঠেকাতে সাহায্য করেছিল। মাংস রান্না করা হয়েছিল কিন্তু তা আরবদেশ থেকে কেনা অল্প বয়সি ঘোড়া থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিল, এবং তাসত্ত্বেও কার্যকর ছিল। এটি ফ্রান্সে ঘোড়ার মাংস খাওয়ার ঊনবিংশ শতাব্দীর ঐতিহ্যের সূচনা করতে সাহায্য করেছিল। [৫৯]লচলিন রোজ ১৮৬৭ সালে অ্যালকোহলের সাহায্য ছাড়াই লেবুর রস সংরক্ষণের একটি পদ্ধতি প্যাটেন্ট করেছিলেন। তিনি একটি ঘনকৃত পানীয় (স্কোয়াশ) তৈরি করেছিলেন যা রোজের লাইম জুস নামে পরিচিত ছিল।১৮৬৭ সালের দা মারচ্যান্ট শিপিং অ্যাক্ট অনুযায়ী স্কার্ভি প্রতিরোধ করার জন্য রয়্যাল নেভি ও মারচ্যান্ট নেভির সকল জাহাজে নাবিকদের প্রতিদিন এক পাউন্ড লাইম রেশন হিসেবে দেওয়ার কথা বলা হয়।[৬০] পণ্যটি সর্বত্র ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে, এই কারণে লাইমি (limey) শব্দটি দ্বারা প্রথমদিকে ব্রিটিশ নাবিকদের, পরবর্তীতে সাবেক ব্রিটিশ উপনিবেশগুলোর মধ্যে (বিশেষত আমেরিকা, নিউজিল্যান্ড ও দক্ষিণ আফ্রিকা) ইংরেজ অভিবাসীদের ও শেষ দিকে আমেরিকান অপশব্দে সকল ব্রিটিশ লোকদের বুঝাতে ব্যবহৃত হতো।[৬১]Cochlearia officinalis নামক বৃক্ষ, যা "কমন স্কার্ভিগ্র‍্যাস" নামেও পরিচিত, এটি স্কার্ভি নিরাময় করতে পারে এই পর্যবেক্ষণ থেকেই এই সাধারণ নামটি চালু হয়েছিল, এবং শুকনো বাণ্ডিল বা পাতিত নির্যাস করে জাহাজে নেওয়া হতো। এটা অত্যন্ত তিক্ত স্বাদযুক্ত হওয়ায় মসলা ব্যবহার করা হতো। ঊনবিংশতিতম শতাব্দীতে লেবুজাতীয় ফল সহজলভ্য হওয়ার আগ পর্যন্ত স্কার্ভিগ্র‍্যাস পানীয় ও স্যান্ডউইচ যুক্তরাজ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল।[৬২]নেপোলিয়নিক যুদ্ধে ব্রিটেনের বিরুদ্ধে ফ্রান্সের সাথে স্পেনের মৈত্রীর ফলে ভূমধ্যসাগরীয় লেবুর সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়, তখন লেবুর পরিবর্তে ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান লাইম ব্যবহৃত হতে থাকে, কারণ তা ব্রিটেনের ক্যারিবীয় উপনিবেশ থেকে খুব সহজে পাওয়া যেত[২৫] এবং স্কার্ভি সারাতে বেশি ফলদায়ক বলে বিশ্বাস করা হতো কারণ সেগুলো বেশি অম্লীয় ছিল। ভিটামিন সি (তখনও অজানা) নয় বরং অম্লই স্কার্ভি সারাতে পারে বলে তখন বিশ্বাস করা হতো। প্রকৃতপক্ষে, পূর্বের লেবুর চেয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান লাইমে ভিটামিন সি-এর পরিমান ছিল খুবই কম, অধিকন্তু সেগুলো সতেজ অবস্থায় না খেয়ে বরং লাইম জুস হিসেবে খাওয়া হতো, যা আলো ও বাতাসের সংস্পর্শে আসতো এবং কপার নালির মধ্য দিয়ে প্রবেশ করানো হতো, এই সকল প্রক্রিয়ায় ভিটামিন সি-এর পরিমাণ বহুলাংশে কমিয়ে দিত। বাস্তবিক পক্ষে, ১৯১৮ সালে নেভি ও মার্চ্যান্ট মেরিনের লাইম জুস থেকে প্রতিনিধিত্বমূলক নমুনা ব্যবহার করে প্রাণীর ওপর পরিচালিত গবেষণায় দেখা যায় যে এর কার্যত স্কার্ভি সারানোর ক্ষমতা নেই।[২৫] স্কার্ভি যে মূলত একটি পুষ্টির ঘাটতিজনিত রোগ, সতেজ খাদ্য, বিশেষত সতেজ লেবুজাতীয় ফল অথবা সতেজ মাংস খাওয়ার মাধ্যমে ভালোভাবে চিকিৎসা করা সম্ভব, এই বিশ্বাসটি ঊনবিংশতিতম শতাব্দী ও বিংশতিতম শতাব্দীর প্রথমভাগে সর্বজনীন ছিল না, ফলে বিংশতিতম শতাব্দীতেও নাবিক ও ভ্রমণকারীগণ স্কার্ভি রোগে আক্রান্ত হতে থাকেন। উদাহরণস্বরূপ ১৮৯৭-১৮৯৯ সাল ব্যাপী চলমান বেলজিয়ান অ্যান্টার্কটিক এক্সপিডিশনে ব্যাপকভাবে স্কার্ভি দেখা দিয়েছিল যখন এর নেতা, আদ্রিয়ান দি জেরালশ, প্রথম দিকে তার লোকদেরকে পেঙ্গুইন ও সিল মাংস খেতে অনুৎসাহিত করেছিলেন।ঊনবিংশতিতম শতাব্দীতে রয়্যাল নেভির আর্কটিক অভিযানের সময় এটা ব্যাপকভাবে বিশ্বাস করা হতো যে, সতেজ খাবারের চেয়ে বরং জাহাজে ভালো স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা, নিয়মিত শরীর চর্চা ও নাবিকদের মনোবল ধরে রাখার মাধ্যমে স্কার্ভি প্রতিরোধ করা সম্ভব।নৌ অভিযানে স্কার্ভির প্রকোপ চলতেই থাকল এমনকি যখন আর্কটিক অঞ্চলে বেসামরিক তিমিশিকারি ও ভ্রমণকারীদের মধ্যে প্রায়োগিক স্কার্ভিরোধী হিসেবে সতেজ (শুঁটকিকৃত বা টিনজাত নয়) মাংস সুপরিচিত ছিল। এমনকি সতেজ মাংসের রান্না এর স্কার্ভিরোধী বৈশিষ্ট্য পুরোপুরি ধ্বংস করত না, কারণ অনেক রান্নার প্রক্রিয়া সকল মাংসকে উচ্চ তাপমাত্রায় আনতে ব্যর্থ হতো।নিম্নলিখিত বিষয়গুলোর জন্য বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছিল:[২৫]

  • যেখানে সতেজ লেবুজাতীয় ফল (বিশেষত লেমন) স্কার্ভি সারিয়ে তুলত, সেখানে লাইম জুস যেটি আলো, বাতাস ও তামার নলের সংস্পর্শে আসতো সেটি স্কার্ভি সারাতে পারতো না – এভাবে লেবুজাতীয় ফল স্কার্ভি সারাতে পারে এই ধারণাটি গুরুত্ব পায় নি;
  • সতেজ মাংসও (বিশেষত অঙ্গীয় মাংস ও কাঁচা মাংস, যা আর্কটিক অভিযানের সময় খাওয়া হয়েছিল) স্কার্ভি সারিয়েছিল, ফলে স্কার্ভি সারাতে ও প্রতিরোধ করতে সতেজ শাকসবজি অত্যাবশ্যক এই তত্ত্বটি গুরুত্ব হারায়;
  • বাষ্পচালিত জাহাজের উচ্চগতি ও ভূমিতে উন্নত পুষ্টি স্কার্ভির প্রকোপ কমিয়ে দিয়েছিল – এর ফলে সতেজ লেবুর তুলনায় তামার নলদ্বারা প্রস্তুত লাইম জুসের অকার্যকারিতা তাৎক্ষণিকভাবে প্রকাশিত হয়নি। এর ফলে সৃষ্ট বিভ্রান্তিতে রোগের নতুন জীবাণু তত্ত্বের আলোকে একটি নতুন তত্ত্ব প্রস্তাব করা হয়েছিল – যে স্কার্ভি হচ্ছে খাদ্যে টোমেইন বিষক্রিয়াজনিত একটি রোগ। টোমেইন হচ্ছে ব্যাকটেরিয়াঘটিত একটি বর্জ্য পদার্থ, বিশেষ করে দূষিত টিনজাত মাংসে।

ঊনবিংশতিতম শতাব্দীর শেষ দিকে শিশুদের স্কার্ভি রোগ দেখা দেয় কারণ শিশুদেরকে গোরুর পাস্তুরিত দুধ খাওয়ানো হচ্ছিলো, বিশেষ করে শহুরে উচ্চবিত্ত পরিবারে। পাস্তুরায়ন প্রক্রিয়ায় ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস হলেও এটা ভিটামিন-সিও নষ্ট করে দেয়। পরবর্তীতে পেঁয়াজের রস বা রান্নাকৃত আলু ব্যবহার করে এই সমস্যার সমাধান করা হয়। স্থানীয় আমেরিকান অধিবাসীরা আগন্তুকদের স্কার্ভি থেকে বাঁচতে বন্য পেঁয়াজ খাওয়ার নির্দেশনা দিত।[৬৩]

বিংশ শতাব্দী

বিংশতিতম শতাব্দীর শুরুর দিকে, যখন রবার্ট ফ্যালকন স্কট অ্যান্টার্কটিক অভিমুখে তার প্রথম অভিযান (১৯০১-১৯০৪) শুরু করেন, তখন বিদ্যমান তত্ত্বটি ছিল যে স্কার্ভি টোমেইন বিষক্রিয়ার মাধ্যমে হয়, বিশেষত টিনজাত মাংসে।[৬৪] তবে, স্কট আবিষ্কার করেছিলেন যে অ্যান্টার্কটিক সিলের সতেজ মাংস কোনো দুর্ঘটনা ঘটার আগেই স্কার্ভি সারিয়ে তুলেছিল।[৬৫]

১৯০৭ সালে, একটি প্রাণী মডেল আবিষ্কার করা হয় যা স্কার্ভিরোধী বিষয় পৃথককরণ ও শনাক্তকরণে সাহায্য করবে। নরওয়ের দুজন চিকিৎসক অ্যাক্সেল হোলস্ট ও থিওডোর ফ্রলিচ নরওয়ের মাছধরা জাহাজের নাবিকদের বেরিবেরি নিয়ে গবেষণা করছিলেন। তারা তখন বেরিবেরি গবেষণায় কবুতর ব্যবহার করতেন। তখন তারা কবুতরের চেয়ে ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণী চাচ্ছিলেন এবং গিনিপিগ কে বেছে নিলেন। তারা গিনিপিগকে তাদের পরীক্ষার পথ্য হিসেবে খাদ্যশস্য ও ময়দা খেতে দিলেন, যা পূর্বে কবুতরের বেরিবেরি করেছিল এবং আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করলেন যে বেরিবেরির পরিবর্তে গিনিপিগের শরীরে স্কার্ভির উপসর্গ দেখা দিচ্ছে। গিনিপিগ ছিল দৈবযোগে বাছাইকৃত একটি প্রাণী। ঐ সময়ের আগ পর্যন্ত, মানুষ ব্যতীত অন্য কোনো প্রাণীর দেহে স্কার্ভির উপসর্গ দেখা যায়নি এবং এটাকে কেবল মানুষের রোগ বলে বিবেচনা করা হতো। কিছু পাখি, স্তন্যপায়ী প্রাণী ও মাছ স্কার্ভিতে আক্রান্ত হয় কিন্তু কবুতরের স্কার্ভি হয় না, কারণ তারা নিজেদের দেহে অ্যাসকরবিক অ্যাসিড সংশ্লেষণ করতে পারে। হোলস্ট ও ফ্রলিচ দেখলেন যে তারা বিভিন্ন সতেজ খাবার ও নির্যাস যোগ করে গিনিপিগের স্কার্ভি সারিয়ে তুলতে পারছেন। স্কার্ভির এই প্রাণী গবেষণামূলক মডেলকে, যা এমনকি খাদ্যে ভিটামিনের অপরিহার্য ধারণার পূর্বে করা হয়েছিল, ভিটামিন সি গবেষণায় সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ হিসেবে মনে করা হয়।[৬৬]১৯১৫ সালে, গ্যালিপলি অভিযানে নিউজিল্যান্ডের সৈন্যদের খাদ্যে ভিটামিন সি-এর অভাব ছিল যার ফলে তাদের স্কার্ভি দেখা দেয়। এটি ভাবা হয় যে গ্যালিপলিতে মৈত্রী আক্রমণ ব্যর্থ হওয়ার অনেক কারণের মধ্যে স্কার্ভি একটি।[৬৭] ভিলহালমুর স্টেফ্যানসন, একজন আর্কটিক ভ্রমণকারী যিনি ইনুইট উপজাতিদের মধ্যে বসবাস করতেন, প্রমাণ করেছিলেন যে তারা যে পুরো মাংস নির্ভর খাদ্য খেতেন তাতে কোনো ভিটামিনের ঘাটতি হতো না। তিনি ১৯২৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে নিউইয়র্কের বেলভিউ হাসপাতালে একটি গবেষণায় অংশ নিয়েছিলেন, যেখানে তিনি ও আরেকজন সঙ্গী চিকিৎসকদের নিবিড় পর্যবেক্ষণে একবছর ধরে শুধু মাংস খেয়েছিলেন, তবুও তাদের স্বাস্থ্য ভালো ছিল।[৬৮]১৯২৭ সালে, হাঙ্গেরীয় প্রাণরসায়নবিদ অ্যালবার্ট জেন্ট গিয়র্গি একটি যৌগ পৃথক করেছিলেন যাকে তিনি হেক্সুরোনিক অ্যাসিড নামে অভিহিত করেন।[৬৯] জেন্ট-গিয়র্গি অ্যাড্রিনাল গ্রন্থি থেকে যে হেক্সুরোনিক অ্যাসিড পৃথক করেছিলেন তা স্কার্ভিরোধী বলে ধারণা করেছিলেন, কিন্তু অ্যানিম্যাল-ডেফিসিয়েন্সি মডেল ব্যতীত এটি তিনি প্রমাণ করতে পারেন নি। ১৯৩২ সালে, আমেরিকার পিটসবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক চার্লস গ্লেন কিং অবশেষে প্রমাণ করেন যে স্কার্ভি ও হেক্সুরোনিক অ্যাসিডের মধ্যে একটি যোগাযোগ রয়েছে।[৭০] জেন্ট গিয়র্গি কিং-এর গবেষণাগারকে কিছু হেক্সুরোনিক অ্যাসিড প্রদান করেছিলেন এবং শীঘ্রই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যে এটাই ছিল বহুপ্রতীক্ষিত স্কার্ভিরোধী বস্তু। এই কারণে হেক্সুরোনিক অ্যাসিড কে পরবর্তীতে অ্যাস্করবিক অ্যাসিড নাম দেওয়া হয়।

একবিংশ শতাব্দী

বিশ্বের অধিকাংশ অঞ্চলে স্কার্ভির হার কম।[৭১] যারা আক্রান্ত হচ্ছে তারা মূলত উন্নয়নশীল দেশের পুষ্টিহীনগৃহহীন লোকজন।[৭২]শরণার্থী শিবিরে এর প্রাদুর্ভাব লক্ষ করা গিয়েছে।[৭৩]উন্নয়নশীল দেশে যেসব লোকের ক্ষত নিরাময় ঠিকমতো হয় না তাদের মধ্যে স্কার্ভি পাওয়া গিয়েছে।[৭৪]

মানব পরীক্ষা

গবেষণামূলকভাবে নিয়ন্ত্রিত খাবার দিয়ে মানব শরীরে স্কার্ভি সৃষ্টি করানোর একটি পরীক্ষা করা হয়েছিল ব্রিটেনে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এবং ১৯৬০ সালের শেষের দিকে আইওয়া রাজ্যে স্বেচ্ছাসেবী কারাবন্দীদের ওপর।[৭৫][৭৬] এই গবেষণাগুলোতে দেখা গিয়েছে যে, খুব কম ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণের মাধ্যমে যে স্কার্ভির উপসর্গগুলো দেখা দিয়েছিল তা দৈনিক মাত্র ১০ mg ভিটামিন সি দিয়ে সারিয়ে তুলা সম্ভব। এ-সব গবেষণায় কিছু ব্যক্তিকে দৈনিক ৭০ mg ( যার ফলে রক্তে ভিটামিন সি-এর মাত্রা হতো প্রায় ০.৫৫ mg/dl, টিসু সম্পৃক্তি মাত্রা প্রায় ), এবং কিছু ব্যক্তিকে দৈনিক ১০ mg (যা রক্তে ভিটামিন সি-এর মাত্রা কম বাড়াত) ভিটামিন সি দেওয়া হতো, তবে এই দুই দলের মধ্যে কার্যকারিতায় বিশেষ কোনো পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় নি। কারাগারে বন্দী ব্যক্তিদের মধ্যে ভিটামিন সি-মুক্ত খাদ্য গ্রহণের প্রায় চার সপ্তাহের মধ্যে স্কার্ভির উপসর্গ দেখা দিয়েছিল, যেখানে ব্রিটিশ গবেষণায় সময় লেগেছিল প্রায় ছয় থেকে আট মাস। এর সম্ভাব্য কারণ ছিল, গবেষণায় অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিদের স্কার্ভি সৃষ্টিকারী খাদ্য দেওয়ার আগে ছয় সপ্তাহ ধরে দৈনিক ৭০ mg ভিটামিন সি দেওয়া হয়েছিল।[৭৫] উভয় গবেষণায় দেখা গেছে, ভিটামিন-সি বিহীন খাদ্য গ্রহণরত ব্যক্তিদের যখন স্কার্ভির উপসর্গ দেখা গিয়েছে তখন তাদের রক্তে ভিটামিন সি-এর মাত্রা এতটায় কম ছিল যে তা সঠিকভাবে পরিমাপ করা যাচ্ছিল না, এবং আইওয়া গবেষণায়, এই সময় পরিমাপকৃত (লেবেলকৃত ভিটামিন সি তরলীভবন দ্বারা) মাত্রা ছিল ৩০০ মি.গ্রা. এর চেয়েও কম এবং দৈনিক টার্নওভার মাত্র ২.৫ মি.গ্রা.।[৭৬]

অন্যান্য প্রাণীতে

অধিকাংশ প্রাণী ও উদ্ভিদ উৎসেচক-চালিত ধাপের মাধ্যমে মনোস্যাকারাইড কে রূপান্তর করে ভিটামিন সি সংশ্লেষণে সক্ষম। তবে, কিছু স্তন্যপায়ী প্রাণী ভিটামিন সি সংশ্লেষণ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে, সিমিয়ান ও টারসিয়ার এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। এরা দুটি প্রধান প্রাইমেট উপবর্গের একটি হ্যাপ্লোরাইনাই-এর অন্তর্ভুক্ত এবং এই গোষ্ঠীতে মানুষও অন্তর্ভুক্ত।[৭৭] স্ট্রেপসিরাইনিরা (নন-টারসিয়ার প্রোসিমিয়ান) নিজেদের ভিটামিন সি তৈরি করতে পারে, এবং এরা হলো লেমুর, লোরিস, পটো ও গ্যালেগো। ক্যাভাইয়াডি গোত্রের অন্ততপক্ষে দুটি প্রজাতি, ক্যাপিবারা[৭৮]গিনিপিগও অ্যাসকরবিক অ্যাসিড সংশ্লেষণ করতে পারে না। পাখি ও মাছের অনেক জানা প্রজাতি আছে যেগুলো তাদের নিজস্ব ভিটামিন সি তৈরি করে না। যে-সব প্রজাতি অ্যাসকরবেট তৈরি করে না তাদের খাবারে এটি সরবরাহ করতে হয়। এর ঘাটতি হলে মানুষের দেহে স্কার্ভি রোগ হয় এবং অন্যান্য প্রাণীদের ক্ষেত্রেও প্রায় একই রকম উপসর্গ দেখা দেয়।[৭৯][৮০][৮১]

যে-সকল প্রাণীদের স্কার্ভি হয় তাদের প্রত্যেকেরই এল-গুলোনোল্যাকটোন অক্সিডেজ (GULO) নামক উৎসেচকের অভাব থাকে, যা ভিটামিন সি সংশ্লেষণের শেষ ধাপে প্রয়োজন পড়ে। এ-সকল প্রজাতির জিনোমে GULO উৎসেচকটি সিউডোজিন হিসেবে থাকে যা প্রজাতিগুলোর বিবর্তনমূলক অতীত কে ইঙ্গিত করে।[৮২][৮৩][৮৪]

নামকরণ

বাচ্চাদের ক্ষেত্রে মাঝেমধ্যে স্কার্ভিকে বার্লোর রোগ বলা হয়, স্যার থমাস বার্লোর নামানুসারে এই নাম রাখা হয়েছিল।[৮৫] তিনি একজন ব্রিটিশ চিকিৎসক ছিলেন এবং ১৮৮৩ সালে এই রোগের বর্ণনা দেন।[৮৬] তবে, বার্লোর রোগ বলতে মাইট্রাল ভালব প্রোল্যাপস্ও (বার্লো'স সিনড্রোম) বুঝায়, যা জন ব্রেরেটন বার্লো ১৯৬৬ সালে প্রথম বর্ণনা করেন।[৮৭]

তথ্যসূত্র

আরও পঠন

  • Bown, Stephen R.। Scurvy: How a Surgeon, a Mariner, and a Gentleman Solved the Greatest Medical Mystery of the Age of Sail। ৫ জুলাই ২০০৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৭ জুন ২০২১ 
  • Carpenter, K.J. (১৯৮৬)। The History of Scurvy and Vitamin C। Cambridge। 
  • Cegłowski, Maciej (৭ মার্চ ২০১০)। "Scott and Scurvy"IdleWords.com 
  • Vale, B. & Edwards, G. (২০১১)। Physician to the Fleet: The Life and Times of Thomas Trotter 1760-1832। Boydell। 

বহিঃসংযোগ

  • "Scurvy (Scorbutus)"The Encyclopaedia Britannica; A Dictionary of Arts, Sciences, Literature and General Information। XXIV (SAINTE-CLAIRE DEVILLE to SHUTTLE) (11th সংস্করণ)। Cambridge, England and New York: At the University Press। ১৯১১। পৃষ্ঠা 517। সংগ্রহের তারিখ ২২ অক্টোবর ২০১৮ – Internet Archive-এর মাধ্যমে। 
শ্রেণীবিন্যাস
বহিঃস্থ তথ্যসংস্থান
🔥 Top keywords: রাম নবমীমুজিবনগর দিবসপ্রধান পাতামুজিবনগর সরকারবিশেষ:অনুসন্ধানইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগএক্স এক্স এক্স এক্স (অ্যালবাম)বাংলাদেশবাংলা ভাষামিয়া খলিফারাজকুমার (২০২৪-এর চলচ্চিত্র)আনন্দবাজার পত্রিকাআবহাওয়ারামপহেলা বৈশাখউয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগইসরায়েলইরানরবীন্দ্রনাথ ঠাকুরমুজিবনগরইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউনরিয়াল মাদ্রিদ ফুটবল ক্লাব২০২৪ ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগক্লিওপেট্রাচর্যাপদভূমি পরিমাপশেখ মুজিবুর রহমানজনি সিন্সকাজী নজরুল ইসলামঈদুল আযহাফিলিস্তিনইউটিউবভারতবিকাশআসসালামু আলাইকুমসৌদি আরববাংলা প্রবাদ-প্রবচনের তালিকামুহাম্মাদ