হাইড্রোজেনেশেন
হাইড্রোজেনেশেন হলো আণবিক হাইড্রোজেন এবং অপর একটি যৌগের মধ্যে সংঘটিত রাসায়নিক বিক্রিয়া, যা সম্পাদনের জন্য নিকেল, প্যালাডিয়াম ও প্লাটিনামের মত অনুঘটকের উপস্থিতি প্রয়োজন হয়। জৈব যৌগের পরিমাণ হ্রাস বা সম্পৃক্তকরণে এই প্রক্রিয়ার প্রয়োগ ঘটানো হয়। হাইড্রোজেনেশেন প্রক্রিয়ায় একটি অণুতে হাইড্রোজেন পরমাণু যোগ করা হয়; অনেক ক্ষেত্রেই এই অণু অ্যালকিনের অণু হয়ে থাকে। স্বাভাবিক পরিবেশে বিক্রিয়াটি সংঘটনের জন্য অনুঘটক অবশ্যপ্রয়োজন। শুধু অতি উচ্চ তাপমাত্রায় অনুঘটকবিহীন হাইড্রোজেনেশেন বিক্রিয়া সংঘটিত হয়। হাইড্রোকার্বনে দ্বিবন্ধন ও ত্রিবন্ধন হ্রাসে এ প্রক্রিয়ার উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে।[১]
ব্যবহার
অনুঘটন হাইড্রোজেনেশেন প্রক্রিয়ার শিল্পক্ষেত্রে বহুবিধ ব্যবহার রয়েছে। শিল্পক্ষেত্রে হাইড্রোজেনেশেন প্রক্রিয়া অসমজাতীয় অনুঘটকের উপর নির্ভর করে।
সবজিজাত তেল প্রক্রিয়াকরণের জন্য হাইড্রোজেনেশেন ব্যাপক হারে ব্যবহার করা হয়। [২] পলিআনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি এসিড বা বহু-অসম্পৃক্ত ফ্যাটি এসিড ব্যবহার করে সবজিজাত তেল আহরণ করা হয়। এ ধরনের এসিডে প্রচুর দ্বিবন্ধন থাকে, যা আহরণ প্রক্রিয়ায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। হাইড্রোজেনেশনের ফলে এরূপ দ্বিবন্ধন অপসৃত হয়।
পেট্রোরসায়ন শিল্পে অ্যালকিন ও অ্যারোমেটিক হাইড্রোকার্বনকে সম্পৃক্ত অ্যালকেন (প্যারাফিন) ও চাক্রিক অ্যালকেনে রূপান্তর করতে হাইড্রোজেনেশেন প্রক্রিয়া ব্যবহার করা হয়।
ইতিহাস
ডোবেরেইনারের বাতিতে প্লাটিনাম অনুঘটকের উপস্থিতিতে অক্সিজেনের সাথে হাইড্রোজেন সংযোজন "হাইড্রোজেনেশনের প্রথম ঘটনা" বিবেচিত হয়। ১৮২৩ সালের দিকে ডোবেরেইনারের বাতির বাণিজ্যিক ব্যবহার শুরু হয়। ফ্রেঞ্চ রসায়নবিদ পল সাবাতিয়ে হাইড্রোজেনেশেন প্রক্রিয়ার জনক পরিগণিত হন। সাবানশিল্পে কাজ করা মার্কিন রসায়নবিদ জেমস বয়েসের কাজের উপর ভিত্তি করে ১৮৯৭ সালে সাবাতিয়ে আবিষ্কার করেন, নিকেল অনুঘটকের উপস্থিতিতে হাইড্রোজেন সংযোজন বিক্রিয়া করলে গ্যাসীয় হাইড্রোকার্বন উৎপন্ন হয়। এটি সাবাতিয়ে প্রক্রিয়া নামেও পরিচিত। এজন্য সাবাতিয়ে ১৯১২ সালে যৌথভাবে রসায়নে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। ভিলহেল্ম নরমান তরল তেলের হাইড্রোজেনেশেন প্রক্রিয়া আবিষ্কারের জন্য ১৯০২ সালে জার্মানি ও ১৯০৩ সালে ব্রিটেনে পেটেন্ট লাভ করেন। ১৯০৫ সালে সর্বপ্রথম বর্ণিত হেবার বস প্রক্রিয়ায় নাইট্রোজেনের হাইড্রোজেনেশেন প্রক্রিয়ার বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেওয়া আছে। ১৯২২ সালে ফিশার ট্রোপ প্রক্রিয়ায় কয়লা হতে আহরিত কার্বন মনোক্সাইডের হাইড্রোজেনেশেন বিক্রিয়ায় তরল জ্বালানিতে রূপায়িত করা হয়।
১৯২২ সালে ভোরহিস ও অ্যাডামস এক বায়ুমণ্ডলীয় চাপের অধিক চাপে হাইড্রোজেনেশেন বিক্রিয়া ঘটানোর পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। [৩] ১৯২৬ সালে ভোরহিস ও অ্যাডামসের গবেষণার উপর ভিত্তি করে বর্ধিত চাপ ও তাপে হাইড্রোজেনেশন বিক্রিয়া ঘটানোর উপাদান "পার শ্যাকার" -এর বাণিজ্যিক ব্যবহার শুরু হয়। এখনো এটি বহুল প্রচলিত। ১৯২৪ সালে মুররে রেইনি নিকেলের মিহিচূর্ণ সংস্করণ উদ্ভাবন করেন, যেটি নাইট্রাইলের অ্যামিনে রূপান্তর এবং মার্জারিন উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়।
সমজাতীয় অনুঘটন হাইড্রোজেনেশেন
১৯৩০ এর দশকে ক্যালভিন আবিষ্কার করেন, কপার(II)যৌগ হাইড্রোজেনকে জারিত করে। ১৯৬০ সালে অবস্থান্তর ধাতব যৌগ ব্যবহার করে সমজাতীয় অনুঘটক উৎপাদন শুরু হয়। "উইলকিনসনের অনুঘটক" এর অন্যতম উদাহরণ। অতঃপর আবিষ্কৃত হয়, রোডিয়াম ও ইরিডিয়াম অ্যালকিন ও কার্বনিলের হাইড্রোজেনেশেন ঘটাতে পারে।[৪] ১৯৭০ সালে এল ডিওপিএ সংশ্লেষণের সময় অপ্রতিসম হাইড্রোজেনেশনের বিষয়টি বিজ্ঞানীদের কাছে ধরা পড়ে। ১৯৯০ এর দশকে নোয়োরি অপ্রতিসম হাইড্রোজেনেশেন প্রক্রিয়া আবিষ্কৃত হয়।[৫] ১৯৩০ ও ১৯৪০ এর দশকে শুরু হওয়া "অক্সো প্রক্রিয়া" এবং জিগলার-নাটা পলিমারকরণের উপর করা কাজ এতে তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব ফেলে।