ইন্দ্র (দেবতা)
ইন্দ্র (দেবনাগরী লিপি: इन्द्र বা इंद्र) হলেন সনাতন ধর্মের একজন বৈদিক দেবতা এবং স্বর্গের রাজা।[৪] তিনি আকাশ, বজ্রপাত, আবহাওয়া, বজ্র, ঝড়, বৃষ্টি, নদী প্রবাহ এবং যুদ্ধের সাথে জড়িত।[৫][৬][৭][৮] ইন্দ্রের পৌরাণিক কাহিনী এবং ক্ষমতা অন্যান্য ইন্দো-ইউরোপীয় দেবতা যেমন জুপিটার, পেরুন, পারকুনাস, জালমোক্সিস, তারানিস, জিউস ও থর এবং বৃহত্তর প্রোটো-ইন্দো-ইউরোপীয় পুরাণের অংশ ।[৯][১০][১১]
ইন্দ্র | |
---|---|
অন্যান্য নাম | দেবেন্দ্র, মহেন্দ্র, সুরেন্দ্র, সুরপতি, সুরেশ, দেবেশ, দেবরাজ, অমরেশ, পর্জন্য, বেন্ধন |
দেবনাগরী | इन्द्र বা इंद्र |
অন্তর্ভুক্তি | দেবতা |
আবাস | অমরাবতী, ইন্দ্রলোকের রাজধানী, স্বর্গ [১] |
মন্ত্র | ওম ইন্দ্রায় নমঃ |
অস্ত্র | বজ্র, অস্ত্র, ইন্দ্রাস্ত্র, ঐন্দ্রাস্ত্র, বাসবী শক্তি। |
প্রতীকসমূহ | বজ্র, ইন্দ্রজাল |
বাহন | ঐরাবত (সাদা হাতি), উচ্চৈঃশ্রবা (সাদা ঘোড়া) |
গ্রন্থসমূহ | বেদ, রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ |
লিঙ্গ | পুরুষ |
উৎসব | ইন্দ্রযাত্রা, রাখীবন্ধন, লোহরি, ইন্দ্রপূজা, দীপাবলি |
ব্যক্তিগত তথ্য | |
মাতাপিতা | |
সহোদর | সূর্য, বায়ু, বরুণ,যম, বামন, ভাগ্য, অর্যমা, মিত্র, সাবিত্র |
সঙ্গী | শচী (ইন্দ্রাণী) |
সন্তান | জয়ন্ত, জয়ন্তী, ষষ্ঠী, দেবসেনা এবং অর্জুন ও বালীর আধ্যাত্মিক পিতা |
গ্রিক সমকক্ষ | জিউস |
রোমান সমকক্ষ | জুপিটার |
তিনি দ্বাদশ আদিত্যের মধ্য একজন। পুরাণ অনুযায়ী মহর্ষি কশ্যপ(আদি কারণ) ও অদিতি(অনন্ত আকাশ) হচ্ছেন তাঁর পিতামাতা। বেদে ঋষিগণ তাঁকে দেবরাজ হিসেবে অভিহিত করেছেন, কারণ ইন্দ্র শক্তি দ্বারাই অন্যান্য দেবতা অর্থাৎ মহাবিশ্বের অন্যান্য শক্তি পরিচালিত হয়।[১২] ঋগ্বেদে সবচেয়ে বেশি ইন্দ্র স্তুত হয়েছেন। বৈদিক শাস্ত্রে ইন্দ্র কোনো প্রাকৃতিক দৃশ্যমান বস্তু বা মূর্তি নন, তিনি হচ্ছেন বৃষ্টিবর্ষণের কারণ, সূর্য। তিনি সেই কারণ যা বজ্রপাত, বৃষ্টি ও নদী প্রবাহিত করে।[১৩] বেদ অনুযায়ী, ইন্দ্র হচ্ছেন ঈশ্বর বা পরমব্রহ্ম এর একটি গুণবাচক নাম যিনি ঈশ্বরের বর্ষণশক্তির বিকাশস্থল।[১৪]
ব্যুৎপত্তি
"ইদি পরমৈশ্বর্য্যে" এই ধাতুর উত্তর "রন্" প্রত্যয় করে ইন্দ্র শব্দ সিদ্ধ হয়ে থাকে। "য় ইন্দতি পরমৈশ্বর্য্যবান ভবতি স ইন্দ্রঃ পরমেশ্বরঃ"। যিনি নিখিল ঐশ্বর্যশালী এজন্য সেই পরমাত্মার নাম ইন্দ্র।[৪]
ইন্দ্র শব্দটি সংস্কৃত ‘ইন্দ্’ ধাতু হতে আগত যা বর্ষণ নির্দেশাত্মক। এর সাথে “র” প্রত্যয় যোগ করে ‘ইন্দ্র’ শব্দ হয়। অতএব যিনি বৃষ্টি বর্ষণ করেন তিনিই ইন্দ্র।[১৫]
বিভিন্ন গ্রন্থে ইন্দ্র
বেদ-এ ইন্দ্র
বেদে ইন্দ্র একজন সর্বপ্রধান দেবতা। বৈদিক দেবগণের মাঝে ইন্দ্রস্তুতি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে।[১২][১৩][১৪] বেদের সর্বাধিক সংখ্যক সুক্ত রয়েছে ইন্দ্রের উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত। বৈদিক তেত্রিশ দেবতার মাঝে ইন্দ্র একজন। বেদে সূর্যের বারোটি রূপ অর্থাৎ দ্বাদশ আদিত্যকে দেবতা বলা হয়েছে। এর মাঝে ইন্দ্র হচ্ছে বৃষ্টিবর্ষণকারী সূর্য।
পুরাণে ইন্দ্র
বেদের মতো পুরাণে ইন্দ্র তেমন গুরুত্বপূর্ণ নন, যিনি স্বর্গের রাজা হন তিনিই ইন্দ্র। বিভিন্ন পুরাণে ইন্দ্রকে একজন মানবরুপী দেবতা হিসেবে চিত্রায়িত করা হয়েছে।[১৬] তার সমস্ত শরীরে একশত চোখ বিরাজমান। তিনি পঞ্চমহাভূতের সদস্য। তার রাণীর নাম শচীদেবী এবং বাহন ঐরাবত ও উচ্চৈঃশ্রবাঃ। মহাভারত অনুযায়ী ইন্দ্র অর্জুনের পিতা। পাণ্ডুপত্নী কুন্তী এক বলশালী পুত্রকামনা করে পুত্রেষ্টি মন্ত্রে ইন্দ্রকে আহ্বান করেন ও অর্জুনের জন্ম দেন।
অনেকে মনে করেন যে, পুষ্পক রথ হলো ইন্দ্রের বাহন কিন্তু পুষ্পক রথ আসলে ধনের দেবতা ধনরাজ কুবেরের সম্পদ যা পরবর্তীতে লঙ্কাপতি দশানন রাবণ কুবেরের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেন।
দেবরাজ ইন্দ্র
দেবগণের মাঝে ইন্দ্র হচ্ছেন প্রধান। তিনি ত্রিলোকের রাজা, দেব ও মনুষ্যগণের রাজা। মরুৎগণ (বায়ু) হচ্ছেন ইন্দ্রের সেনা।
ইন্দ্রের অস্ত্র
ইন্দ্রের অস্ত্র হচ্ছে বজ্র বা বিদ্যুৎ। ত্বষ্টা ইন্দ্রের জন্য দধীচি বা দধ্যঞ্চের অস্থি দ্বারা বজ্র নির্মাণ করেন। মহাভারত ও পুরাণ অনুযায়ী দধীচি মুনি জগৎ কল্যাণে নিজ দেহ দান করলে তার মস্তকের অস্থি দিয়ে বিশ্বকর্মা বজ্র নামক অস্ত্র তৈরি করেন। দধীচির মস্তক ছিল অশ্বের মস্তক। সেই ছিন্ন মস্তক ইন্দ্র লাভ করেন।
ইন্দ্রের অসুর বধ
তিনি বহু দানবকে যুদ্ধে বধ করেছেন। তিনি সোমপান পূর্বক শুষ্ণ, চুমুবি, ধুনি, শম্বব, পিপ্রু, বল, অর্বুদ, কুযব প্রভৃতি বহু অসুর বধ করেছেন। বজ্রের দ্বারা ইন্দ্রের বৃত্রবধ করার একটি গুরুত্বপূর্ণ রূপক উপাখ্যান বেদে উল্লেখ পাওয়া যায়।[১৭] যার জন্য তার আরেক নাম ‘বৃত্রহন্তা’। ইন্দ্রের বৃত্রবধে সহায়ক ছিলেন মরুৎগণ। ত্বষ্টার পুত্র হচ্ছে বৃত্র। ‘বৃ’, ‘বৃৎ’ অথবা ‘বৃধ’ ধাতু থেকে বৃত্র শব্দ নিষ্পন্ন হয়েছে। আচ্ছাদন হেতু, বর্তমান বা বিচরণ হেতু বা বর্ধন হেতু বৃত্র শব্দের বৃত্রত্ব। মেঘ অন্তরীক্ষ আচ্ছাদন করে, অন্তরীক্ষে বর্তমান থাকে, অন্তরীক্ষে বিচরণ করে, বর্ধিত করে। আকাশ বা সূর্য আচ্ছাদনকারী মেঘই বৃত্র। বৃত্রের অপর নাম অহি বা সর্প। [১৮] অহি ষোলো পাকে ইন্দ্রকে আবৃত করেছিল। বৃষ্টিপাতে বাদাসৃষ্টিকারী কুণ্ডলীকৃত সর্পাকার মেঘ দেখে ঋষিগণ অহি বা সর্প কল্পনা করেছিলেন যা সূর্যকে আবেষ্ঠিত করেছিল। ইন্দ্র বৃত্রকে হত্যা করেন। বৃত্রবধের ফলে বৃষ্টিধারা পতিত হয়ে সমুদ্রাভিমুখী হয়। মূলত এটি হচ্ছে প্রকৃতির একটি ঘটনাকে যেখানে সূর্য, বৃষ্টি বিঘ্নকারীকে মেঘকে বজ্রের দ্বারা বধ করে বৃষ্টি বর্ষণ করানোর বর্ণনা হয়েছে। যার ফলে রুদ্ধগতি নদীসমূহ বেগের সাথে সমুদ্রে প্রবাহিত হয়।[১৯] ডঃ দাসের মতে, বৃত্র অন্ধকারের দানব, এবং সূর্যের এক মূর্তি ইন্দ্র অন্ধকারের দানবকে হত্যা করে আলোক আনয়ন করেন।[২০]
আবার কোনো কোনো পণ্ডিত ইন্দ্রের বৃত্রবধকে ঐতিহাসিক ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। ইন্দ্রের বৃত্রবধকে আর্য-অনার্য সংঘর্ষ বলে মনে করেন। ইন্দ্র ছিলেন শ্বেতকায় আর্যজাতির একজন মানবীয় নেতা, যিনি ভারতবর্ষের আদিম অনার্য অধিবাসীদের সাথে যুদ্ধ করে ভারতে আর্যজাতির প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। এই সংঘর্ষকে বেদে ইন্দ্র-বৃত্র বিরোধ নামে সংরক্ষণ করা হয়েছে। কেউ কেউ আবার আর্যজাতি ও সেমিটিক জাতির সংঘর্ষের সন্ধান পেয়েছেন বৃত্রাসুর ও ইন্দ্র সংগ্রামে। ম্যাক্স মুলারের মতে বেদের বৃত্রবধ কাহিনী গ্রিক মহাকবি হোমারের ট্রয় যুদ্ধের কাহিনীর মূল। তার মতে বেদের সময় ট্রয়যুদ্ধের Helen, বেদের পাণিগণ(Ponis) ট্রয়ের প্যারিস (Paris) নাম গ্রহণ করেছে। আচার্য যোগেশ চন্দ্র লিখেছেন, “ঋগ্বেদের বৃত্র গ্রিক পুরাণের হাইড্রা। হারকিউলিস হাইড্রা বধ করেছিলেন।” রামনাথ সরস্বতীর প্রাচীন গ্রিক দেবতা ‘জিউসের সাথে ইন্দ্রের তুলনা করেছেন। ইন্দ্রের ন্যায় জিউসের অস্ত্রও ছিল বজ্র। অনেকের মতে এসব ব্যাখ্যা নিতান্তই কল্পনা।
আবেস্তায় ইন্দ্র
পার্সিক ধর্মগ্রন্থ আবেস্তায় ইন্দ্রোপাসনা দেখা যায়। ইন্দ্রকে ‘বেরেথরঘ্ন’ =সং বৃত্রঘ্ন বা বৃত্রহন্তা বলা হয়েছে। তবে সেখানে ইন্দ্রের প্রতি দ্বেষভাবের প্রকাশও হয়েছে। ইন্দ্রকে সেখানে দেবতার পরিবর্তে দানব হিসেবে দেখা হয়।
আরও পড়ুন
- হিন্দুদের দেবদেবী উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ ১ম খন্ড) - ডঃ হংসনারায়ণ ভট্টাচার্য
আরও দেখুন
তথ্যসূত্র
বহিঃসংযোগ
- Lee, Phil। "Indra and Skanda deities in Korean Buddhism"। Chicago Divinity School। Chicago, IL: University of Chicago।
- "Indra, Lord of Storms and King of the Gods' Realm"। Philadelphia, PA: Philadelphia Museum of Art।
- "Indra wood idol – 13th century, Kamakura period"। Nara, Japan।