চাঁদের দূরপৃষ্ঠ
চাঁদের দূরপৃষ্ঠ হলো চাঁদের সেই গোলার্ধ যা চাঁদের কক্ষপথে যুগপৎ ঘূর্ণনের ফলে নিকট পৃষ্ঠের বিপরীতে সর্বদা পৃথিবী থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকে । নিকট পৃষ্ঠের তুলনায় প্রচুর অভিঘাত খাদ , স্বল্প সমতলতা ও অন্ধকার চান্দ্র মারিয়া সাগরাদি নিয়ে দূরপৃষ্ঠকে বহুলাংশে সৌরজগতের বুধগ্রহ ও বৃহস্পতির ক্যালিস্টো উপগ্রহের ন্যায় অন্যান্য ঊষর স্থানের মতো দেখায় । এতে রয়েছে দক্ষিণ মেরু–আইটকেন অববাহিকা নামক সৌরজগতের বৃহত্তম খাদগুলির একটি । চাঁদের উভয় পৃষ্ঠই দুই সপ্তাহ সূর্যালোক ও তারপরে দুই সপ্তাহ রাত পায় , তবুও সুদূর পাশটিকে কখনও কখনও " চাঁদের অন্ধকার দিক " বলা হয় , যেখানে "অন্ধকার" ব্যবহার করা হয় সূর্যের আলো না থাকার পরিবর্তে অদৃশ্য বুঝাতে ।
চাঁদের দোলনের কারণে এর দূরপৃষ্ঠের প্রায় ১৮ শতাংশ পৃথিবী থেকে মাঝে মাঝে দৃশ্যমান হয় । অবশিষ্ট ৮২ শতাংশ ১৯৫৯ সালে সোভিয়েত লুনা ৩ মহাকাশ অনুসন্ধানে ছবি তোলার আগে অপ্রত্যক্ষিত ছিল । ১৯৬০ সালে সোভিয়েত একাডেমি অফ সায়েন্সেস দূরপৃষ্ঠের ছবির প্রথম সংকলন প্রকাশ করে । অ্যাপোলো ৮ নভোচারীরাই প্রথম মানুষ যারা ১৯৬৮ সালে চাঁদকে প্রদক্ষিণ করার সময় দূরপৃষ্ঠকে ব্যক্তিগতভাবে দেখেছিলেন । ৩ জানুয়ারী ২০১৯-এ চাং'ই ৪ মহাকাশযানের দূরপৃষ্ঠে প্রথম অবতরণ করার আগ পর্যন্ত সকল মনুষ্যবাহী এবং মনুষ্যবিহীন নরম অবতরণই চাঁদের নিকটপৃষ্ঠে হয়েছিল । [১]
জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা দূরে একটি বড় বেতার দূরবীক্ষণ যন্ত্র স্থাপন করার পরামর্শ দিয়েছেন , যাতে চাঁদ এটিকে পৃথিবী থেকে সম্ভাব্য বেতার ব্যতিচার থেকে নিজেকে রক্ষার ঢাল বানাতে পারে । [২]
সংজ্ঞা
পৃথিবী থেকে মহাকর্ষীয় বল চাঁদের ঘূর্ণনকে এমন এক অবস্থানে ধীর করে দিয়েছে যেখানে এর একটি পৃষ্ঠই সর্বদা পৃথিবীর দিকে মুখ করে থাকে—এটি এমন এক প্রপঞ্চ যাকে বলা হয় মহাকর্ষীয় আবদ্ধতা । অন্য পৃষ্ঠকে , যার বেশিরভাগটাই পৃথিবী থেকে দেখা যায় না , তাই "চাঁদের দূরপৃষ্ঠ" বলা হয় । চাঁদের দোলায়মানতার কারণে সময়ে সময়ে দূরের কিছু চন্দ্রাকলাকৃতির প্রান্ত দেখা যায় । চন্দ্রপৃষ্ঠের মোট ৫৯ শতাংশ পৃথিবী থেকে এক সময় বা অন্য সময়ে দৃশ্যমান হয় । পৃথিবী থেকে ক্ষীণ পর্যবেক্ষণ কোণ থাকায় (এগুলিকে "পূর্ণভাবে" পর্যবেক্ষণ করা যায় না) পৃথিবী থেকে মাঝে মাঝে চাঁদের দূরবর্তী অংশের উপযোগী পর্যবেক্ষণ করা কঠিন ।
পার্থক্যসমূহ
চাঁদের গোলার্ধ দু'টির সুস্পষ্ট স্বতন্ত্র চেহারা রয়েছে , নিকটপৃষ্ঠটি অনেকগুলি বৃহৎ মারিয়ায় (ল্যাটিন ভাষায় 'সমুদ্র' অর্থে , যেহেতু প্রথম দিকের জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা ভুলভাবে ভেবেছিলেন যে এই সমভূমিগুলি চান্দ্র জলের সমুদ্র) আচ্ছাদিত আর দূরপৃষ্ঠে রয়েছে অল্পকিছু মারিয়া সহ একটি বিধ্বস্ত , ঘন খাদযুক্ত চেহারা । নিকটপৃষ্ঠের ৩১.২% এর তুলনায় দূরপৃষ্ঠের মাত্র ১% মারিয়া দ্বারা আচ্ছাদিত ।[৩] এই পার্থক্যের জন্য সাধারণভাবে গৃহীত ব্যাখ্যাটি নিকট গোলার্ধে তাপ-উৎপাদনকারী উপাদানগুলির উচ্চ ঘনত্বের সাথে সম্পর্কিত , যেমনটি লুনার প্রসপেক্টর গামা-রে স্পেকট্রোমিটার থেকে প্রাপ্ত ভূ-রাসায়নিক মানচিত্র দ্বারা প্রদর্শিত হয়েছে । তবে অন্যান্য কারণও এ স্বাতন্ত্র্যকে প্রভাবিত করতে পারে , যেমন পৃষ্ঠের উচ্চতা এবং ভূত্বকের পুরুত্ব , যেখানে আগ্নেয়গিরিজাত শিলাগুলি বিস্ফোরিত হয় , অবশ্য এইগুলি ব্যাখ্যা করে না কেন দূরপৃষ্ঠের দক্ষিণ মেরু-আইটকেন অববাহিকা (যা চাঁদের সর্বনিম্ন উচ্চতা ধারণ করে এবং একটি পাতলা ভূত্বকের অধিকারী) নিকটপৃষ্ঠের Oceanus Procellarum-এর মতো আগ্নেয়গিরি হিসাবে সক্রিয় ছিল না ।
অনুসন্ধান
প্রাথমিক অনুসন্ধান
১৯৫০ দশকের শেষ অবধি চাঁদের দূরবর্তী দিক সম্পর্কে খুব কমই জানা ছিল । দোলনাদির কারণে দূরপৃষ্ঠের চন্দ্রাঙ্গের নিকট বৈশিষ্ট্যগুলি পর্যায়ক্রমে সীমিত ঝলকের জন্য দেখা যায় , তবে তা চাঁদের মোট পৃষ্ঠের মাত্র ৫৯% পর্যন্ত । [৪] এই বৈশিষ্ট্যগুলি একটি নিম্ন কোণ থেকে দেখা হয়েছিল ব'লে দরকারী পর্যবেক্ষণ বাধাগ্রস্থ করেছিল (এ কারণে একটি পর্বতশ্রেণী থেকে একটি খাদকে আলাদা করা কঠিন প্রমাণিত হয়েছিল) । দূরপৃষ্ঠের অবশিষ্ট ৮২% অজানা রয়ে গেছে এবং এর বৈশিষ্ট্যগুলি অনেক জল্পনা-কল্পনার বিষয় ।
১৯৬৮ সালের ডিসেম্বরে অ্যাপোলো ৮ মিশনের সময় দূরপৃষ্ঠটি প্রথম মানুষের চোখে সরাসরি দেখা গিয়েছিল । নভোচারী উইলিয়াম অ্যান্ডার্স এই দৃশ্য বর্ণনা করেছেন :
"দূরপৃষ্ঠকে আমার সন্তানরা কিছু সময়ের খেলেছে এমন বালুস্তুপের মতো দেখায় , নির্দিষ্ট কিছু নয় , এবড়ো-থেবড়ো মাত্র ।"