দীপাবলি
দীপাবলি[২] (সংস্কৃত: दीपावलिः দীপাৱলিঃ) হল হিন্দুদের একটি প্রধান ধর্মীয় উৎসব।[৩] এটি হিন্দু পঞ্জিকায় কার্তিক মাসে অনুষ্ঠিত হয়, যা গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জির অক্টোবর বা নভেম্বর মাসে পড়ে। অন্যান্য ভারতীয় অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরাও এটি উদযাপন করে থাকে। এটি আধ্যাত্মিক "অন্ধকারের ওপর আলোর বিজয়, মন্দের ওপর ভালোর, এবং অজ্ঞতার ওপর জ্ঞানের প্রতীক"। এই দিন সব হিন্দুর বাড়িতে নানা ধরনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। তবে জৈন-শিখ ধর্মালম্বীরাও এই সময়ে একই ধরনের উৎসব পালন করে থাকেন। দীপাবলি ভারত,[৪] নেপাল, মরিশাস, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার, গায়ানা, সুরিনাম, ত্রিনিদাদ ও টোবাগো, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও ফিজিতে একটি সরকারি ছুটির দিন। বাংলাদেশেও এই দিনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ছুটি দেওয়া হয়।
দীপাবলি | |
---|---|
অন্য নাম | দেওয়ালি, আলোর উৎসব, দীপোৎসব, দীপান্বিতা, আলোকোৎসব |
পালনকারী | হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ ও জৈন ; ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার, মরিশাস, গায়ানা, ত্রিনিদাদ ও টোবাগো, সুরিনাম, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও ফিজি (জাতীয় ছুটি) |
ধরন | ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক |
উদযাপন | দিয়া আলোকসজ্জা, পূজা (উপাসনা এবং প্রার্থনা), হবন (অগ্নি নিবেদন), ব্রত (উপবাস), দান, মেলা, ঘর পরিষ্কার করা এবং সাজসজ্জা, আতশবাজি, উপহার এবং ভোজে অংশ নেওয়া। |
শুরু | ১২ বা ১৩ই কার্তিক (ধনতেরাস/ধনত্রয়োদশী) |
সমাপ্তি | ১৭ই কার্তিক ভাইফোঁটা |
তারিখ | নভেম্বর ২০২৩ [১]
|
সংঘটন | বার্ষিক |
হিন্দু উৎসবের তারিখ হিন্দু পঞ্জিকা চন্দ্র-নক্ষত্র কিন্তু বেশিরভাগ উৎসবের তারিখ পঞ্জিকার চন্দ্র অংশ ব্যবহার করে নির্দিষ্ট করা হয়। একটি চন্দ্র দিন তিনটি পঞ্জিকার উপাদান দ্বারা স্বতন্ত্রভাবে চিহ্নিত করা হয়: মাস (চন্দ্র মাস), পক্ষ (চান্দ্র পাক্ষিক) এবং তিথি (চন্দ্র দিন)। অধিকন্তু, মাস নির্দিষ্ট করার সময় দুটি ঐতিহ্যের মধ্যে একটি প্রযোজ্য। যথা: আমন্ত / পূর্নিমান্ত। যদি এবং কেবল যদি একটি উৎসব চাঁদের ক্ষীয়মাণ পর্যায়ে পড়ে, এই দুটি ঐতিহ্য একই চন্দ্র দিবসকে দুটি ভিন্ন (কিন্তু ধারাবাহিক) মাসে পড়ে বলে চিহ্নিত করা হয়। একটি চন্দ্রবর্ষ একটি সৌরবর্ষের তুলনায় প্রায় এগারো দিন ছোট। ফলস্বরূপ, বেশিরভাগ হিন্দু উৎসব গ্রেগরিয়ান পঞ্জিকায় ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন দিনে হয়। | |
ধর্মীয় তাৎপর্য
"দীপাবলি" নামটির অর্থ "প্রদীপের সমষ্টি"।[৫] এই দিন হিন্দুরা ঘরে ঘরে ছোটো মাটির প্রদীপ জ্বালেন। দীপাবলির অনুষ্ঠানে সারি-সারি প্রদীপের আলোতে স্বর্গের দেবতাকে গৃহে বরণ করে নেওয়া হয়। এই প্রদীপ জ্বালানো অমঙ্গল বিতাড়নের প্রতীক।[৬] উত্তর ভারতে দীপাবলির সময় নতুন পোশাক পড়া, পরিবার ও বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে মিষ্টি বিতরণের প্রথাও আছে।
দীপাবলির মাধ্যমে উপনিষদের আজ্ঞায় এই কথাটা খুবই সদৃঢ় ভাবে চরিতার্থ হয়ে ওঠে,
অসতো মা সত্ গময়।
তমসো মা জ্যোতির্গময়।
মৃত্যোর্মা অমৃতং গময়।
ওঁ শান্তিঃ ওঁ শান্তিঃ ওঁ শান্তিঃ॥
অর্থাৎ, অসৎ হতে সত্যে নিয়ে যাও,
অন্ধকার হতে জ্যোতিতে নিয়ে যাও,
মৃত্যু হতে অমরত্বে নিয়ে যাও।
সর্বত্র যেন ছড়িয়ে পড়ুক শান্তির বার্তা।
গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় ঘটনা
উত্তর ভারতীয় হিন্দুদের মতে দীপাবলির দিনেই শ্রীরামচন্দ্র চৌদ্দ বছরের নির্বাসনের পর অযোধ্যা ফেরেন। নিজের পরমপ্রিয় রাজাকে ফিরে পেয়ে অযোধ্যাবাসীরা ঘিয়ের প্রদীপ জ্বেলে সাজিয়ে তোলেন তাদের রাজধানীটাকে।
জৈন মতে, ৫২৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মহাবীর দীপাবলির দিনেই মোক্ষ বা নির্বাণ লাভ করেছিলেন।[৭][৮]
১৬১৯ খ্রিষ্টাব্দে শিখদের ষষ্ঠ গুরু হরগোবিন্দ ও ৫২ জন রাজপুত্র দীপাবলির দিন মুক্তি পেয়েছিলেন বলে শিখরাও এই উৎসব পালন করেন।[৯]
আর্য সমাজ এই দিনে স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতীর মৃত্যুদিন পালন করে। তারা এই দিনটি "শারদীয়া নব-শস্যেষ্টি" হিসেবেও পালন করেন। এছাড়া, নেপাল-ভারত-বাংলাদেশের সকল সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যেই এই উৎসব নিয়ে উদ্দীপনা লক্ষ্য করা যায়।
আয়োজনের সময়
আশ্বিন মাসের কৃষ্ণা ত্রয়োদশীর দিন ধনতেরাস অথবা ধনত্রয়োদশী অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে দীপাবলি উৎসবের সূচনা হয়। কার্তিক মাসের শুক্লা দ্বিতীয়া তিথিতে ভাইফোঁটা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এই উৎসব শেষ হয়। নবরাত্রি উৎসব অথবা বাঙালিদের দুর্গোৎসব শেষ হওয়ার ১৮ দিন পর দীপাবলি শুরু হয়। গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসারে, মধ্য-অক্টোবর থেকে মধ্য-নভেম্বরের মধ্যে দীপাবলি অনুষ্ঠিত হয়।
ধনত্রয়োদশী
ধনত্রয়োদশী বা ধনতেরাসের দিন অনেক ভারতীয় ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের অর্থবর্ষের সূচনা হয়; লোকজন নতুন বর্তন, বাসন, গয়না প্রভৃতিও কিনে থাকেন এই দিনে। তবে বেশির ভাগ বাঙালি ব্যবসায়ীদের অর্থবর্ষের সূচনা হয় পহেলা বৈশাখে।
ভূত চতুর্দশী
দ্বিতীয় দিনটিকে বলে ভূত চতুর্দশী। এই দিনে বাঙালিরা বাড়ির চোদ্দোটা এঁদো কোণায় চোদ্দোটা প্রদীপ জ্বালিয়ে কালো মুছিয়ে আলোকিত করে তোলেন বাড়িটাকে। কথায় আছে যে এমনটা করলে ভূতপ্রেত পরিবার আর স্বজনদের ঘাড়ের কাছে নড়তে পারে না; এমনটাও লোককথায় শোনা যায় যে, এই প্রদীপসজ্জার মাধ্যমে পরিবারের পিতৃপুরুষদের অনুষ্ঠানে পদার্পণ করার জন্য নিমন্ত্রণ পাঠানো হয়, যাতে তারা মায়ের বাৎসরিক আগমনে উপস্থিত হয়ে সবাইকে শুভাশিস দিয়ে নিজেরা মায়ের আশীর্বাদে মোক্ষ লাভ করবেন।
অমাবস্যায় উৎসব
তৃতীয় দিন কার্তিক অমাবস্যায় যেখানে উত্তর ভারতে লক্ষ্মীর পূজা চলছে, পশ্চিমবঙ্গে দারুণ জাঁকজমকে ঘটা করে পালন করা হয় কালীপূজা। অবশ্য সেদিন আদি পশ্চিমবঙ্গ বাসিন্দারা, ঘটিরা, বাড়িতে লক্ষ্মীর পূজাও করে থাকেন। তবে আদি বাংলাদেশি হিন্দুদের, বাঙালদের, এই নিয়ম নেই; তা অনেকে বাড়িতেও কালীপূজা করেন, যদিও এই পূজার বারোয়ারি ভাবে পালন হওয়ার প্রচলন বেশি। কখনো কখনো কালীপুজোর দিন আর দীপাবলির দিন পৃথকও হতে পারে; দেওয়ালির তারিখটা একদিন পরে কিংবা আগেও পড়া সম্ভব।
লক্ষ্মীপূজার আয়োজন
এই দিনটিতে পূর্ব ভারত বাদে সম্পূর্ণ ভারতবর্ষে লক্ষ্মী-গণেশের পূজোর নিয়ম আছে। বাড়িঘর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে সারা রাত প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখলে ঘরে লক্ষ্মী আসেন বলে উত্তর ভারতীয় হিন্দুরা বিশ্বাস করেন।
কালীপূজার আয়োজন
বঙ্গ, আসাম, ওড়িশা ও মিথিলাতে এই দিনটি কালীপূজা হিসেবে উদ্যাপন করা হয়। ভারতীয় সমাজের দৃঢ় বিশ্বাস 'দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন' বা 'ন্যায়ের কাছে অন্যায়ের পরাজয়' এই নীতিতে। বঙ্গের দীপান্বিতা কালীপূজা বিশেষ জনপ্রিয়। এই উৎসব সাড়ম্বরে আলোকসজ্জা সহকারে পালিত হয়। তবে এই পূজা প্রাচীন নয়। ১৭৭৭ খ্রিষ্টাব্দে কাশীনাথ রচিত শ্যামাসপর্যাবিধিগ্রন্থে এই পূজার সর্বপ্রথম উল্লেখ পাওয়া যায়। কথিত আছে, নদিয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় অষ্টাদশ শতকে তার সকল প্রজাকে শাস্তির ভীতিপ্রদর্শন করে কালীপূজা করতে বাধ্য করেন। সেই থেকে নদিয়ায় কালীপূজা বিশেষ জনপ্রিয়তা লাভ করে। কৃষ্ণচন্দ্রের পৌত্র ঈশানচন্দ্রও বহু অর্থব্যয় করে কালীপূজার আয়োজন করতেন। অমঙ্গল বিতাড়নের জন্য আতসবাজি পোড়ানো হয়।[১০][১১][১২]
প্রতিপদ
চতুর্থ দিন কার্তিক শুক্লা প্রতিপদ।
গোবর্ধন পূজা
এই দিন বৈষ্ণবেরা গোবর্ধন পূজা করেন।
ভাইফোঁটা
পঞ্চম দিন যমদ্বিতীয়া বা ভ্রাতৃদ্বিতীয়া বা ভাইফোঁটা। কথিত আছে, এই দিন মৃত্যুর দেবতা যম তার বোন যমুনার কাছ থেকে ফোঁটা নিয়েছিলেন। অন্য মতে, নরকাসুর নামে এক দৈত্যকে বধ করার পর যখন কৃষ্ণ তার বোন সুভদ্রার কাছে আসেন, তখন সুভদ্রা তার কপালে ফোঁটা দিয়ে তাকে মিষ্টি খেতে দেন। সেই থেকে ভাইফোঁটা উৎসবের প্রচলন হয়। এই দিন বোনেরা তাদের ভাইদের জন্যে উপোস করে তাদের বাড়িতে নিমন্ত্রণ করে। তারপর তাদের ভাইদের কপালে চন্দনের ফোঁটা পরিয়ে দিয়ে ছড়া কেটে বলে-
এইভাবে বোনেরা ভাইয়ের দীর্ঘজীবন কামনা করে। তারপর ভাইকে মিষ্টি খাওয়ায়। ভাইও বোনকে উপহার দেয় এবং কল্যাণ কামনা করে।
আরও দেখুন
তথ্যসূত্র
বহিঃসংযোগ
- উইকিউক্তিতে দীপাবলি সম্পর্কিত উক্তি পড়ুন।
- The Ancient Origins of Diwali, India’s Biggest Holiday, Becky Little (2017)
- দীপাবলি