নানচিং গণহত্যা

নানচিং গণহত্যা,[টীকা ১] যা ইতিহাসে নানচিং ধর্ষণ নামেও পরিচিত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে দ্বিতীয় চীন-জাপান যুদ্ধ চলাকালে ১৯৩৭–৩৮ সালে রাজকীয় জাপানি সেনাবাহিনী কর্তৃক সংঘটিত একটি গণহত্যা। এই গণহত্যা পরিচালনা করা হয়েছিল তৎকালীন চীনের রাজধানী নানচিং (১৯১২–৪৯) এর জনগণের উপর। ৬ সপ্তাহব্যাপী এই গণহত্যা শুরু হয় ১৯৩৭ সালের ১৩ ডিসেম্বর। এই সময়ে জাপানের রাজকীয় সেনাবাহিনী ৪০,০০০ থেকে ৩,০০,০০০ নিরীহ চীনা জনগনকে হত্যা করে[৭][৮] এবং ব্যাপক লুটপাট ও ধর্ষণ করে[৯][১০]

নানচিং গণহত্যা (নানচিং-এর ধর্ষণ)
মূল যুদ্ধ: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দ্বিতীয় চীন-জাপান যুদ্ধ

কিনহুয়া নদীর তীরে নানচিং হত্যাকাণ্ডে নিহতদের মৃতদহের কাছে দণ্ডায়মান এক জাপানি সেনা
তারিখ১৩ ডিসেম্বর ১৯৩৭ – জানুয়ারি ১৯৩৮
অবস্থান
ফলাফল৫০,০০০–৩,০০,০০০ জনের মৃত্যু (প্রাথমিক সূত্র)[১][২]
৪০,০০০–৩,০০,০০০ মৃত (বিশেষজ্ঞদের)[৩]
৩,০০,০০০ মৃত (চীনা সরকারি হিসাব অনুযায়ী)[৪][৫][৬]

মার্কো পোলো সেতু ঘটনার পর চীন–জাপান যুদ্ধ শুরু হয়ে যায় এবং ১৯৩৭ সালের ১৩ ডিসেম্বর বহু দিন অবরোধের পর প্রায় দেড় লক্ষ জাপানি সৈন্য চীনা শহর নানচিং দখল করে নেয়। এরপর প্রায় কয়েক সপ্তাহ ধরে শহরটিতে এক অবিশ্বাস্য মাত্রার গণহত্যা সংঘটিত হয়। জাপানি সৈন্যরা কখনও পরিকল্পিতভাবে, কখনও কেবল আনন্দের উদ্দেশ্যে অনির্দিষ্টভাবে শহরটির চীনা লোকদেরকে হত্যা ও ধর্ষণ করা শুরু করে। সম্ভবত ৪,০০,০০০ (চার লক্ষ) চীনাকে হত্যা করা হয়, আর সেই সাথে ধর্ষিত হন নানচিং-এর হাজার হাজার নারী।

গণহত্যার এই ঘটনা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ পাওয়ার পরও জাপানি সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব ও সম্রাট হিরোহিতোর বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেননি। যুদ্ধ শেষ হবার পর এই গণহত্যার সাথে জড়িত বেশির ভাগ সামরিক নেতার কোন বিচার বা শাস্তি হয়নি। দূর প্রাচ্য আন্তর্জাতিক সেনা অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে বেশ কয়েকজনকে এই যুদ্ধাপরাধের জন্য সাজা দেয়া হলেও মূল পরিকল্পনাকরী জাপানি যুবরাজ আসাকাকে শাস্তি দেয়া যায়নি। তাছাড়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের আত্মসমর্পণের পূর্বে এ সম্পর্কিত সকল প্রমাণাদি ধ্বংস করে ফেলা হয়। ১৯৪৬ সালে টোকিওতে গঠিত আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের ভাষ্য মতে এই গণহত্যায় ২,০০,০০০ এর অধিক চীনা জনগণকে হত্যা করা হয়[১১]। ১৯৪৭ সালে চীনে গঠিত যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের ভাষ্য মতে ৩,০০,০০০ এর অধিক মানুষকে হত্যা করা হয়।

জাপান সরকার ও সে সময়কার যে সকল সেনাসদস্য নানচিং অভিযানে অংশগ্রহণ করেছিলেন তাদের অনেকেই স্বীকার করেছেন যে সেখানে এই ধরনের বর্বর গণহত্যাসহ ধর্ষণ ও লুটপাটের মত যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত হয়েছিল[১২][১৩]

রাজকীয় জাপানি সেনাবাহিনীর অভিযান

An article on the "Contest to kill 100 people using a sword" published in the Tokyo Nichi Nichi Shimbun. The headline reads, "'Incredible Record' (in the Contest to Cut Down 100 People)—Mukai 106–105 Noda—Both 2nd Lieutenants Go Into Extra Innings".[১৪]

তৎকালীন চীনের রাজধানী নানচিং দখলের পর এই হত্যাকাণ্ড মাত্র ছয় সপ্তাহ স্থায়ী হয়েছিল। যদিও জাপানের সেনাবাহিনীর বর্বরতা এরপরও চলতে থাকে। সাংহাই থেকে নানচিং অভিযানের সময়ে জাপানি বাহিনী ইতিহাসের ভয়াবহতম নৃসংশতার নজির স্থাপন করে। সেই সময়ের এক জাপানি সাংবাদিকের বর্ণনায় পাওয়া যায় যে, দশম বাহিনীকে এই মর্মে মৌন সম্মতি দেয়া হয় যে, তারা যত দ্রুত নানচিং পৌছতে পারবে তত বেশি লুট ও নারী ধর্ষণের সুযোগ পাবে[১৫]

জাপানি বাহিনী নানচিং দখল করার পর সেখানকার সব স্থাপনায় আগুন ধরিয়ে দেয়। পথে সকল ব্যক্তিকে বেয়োনেট অথবা বিশেষ সামরিক তরবারি দিয়ে হত্যা করে।

সিন গুন্টো দিয়ে একজন চৈনিককে গলা কেটে হত্যা করার পূর্ব মূহুর্তের ছবি

ঔপন্যাসিক তাতসুজো ইশিকাওয়া তার নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত উপন্যাস Ikiteiru Heitai (জীবিত সৈনিক)-এ তখনকার জাপানি সেনাবহিনীর ১৬ তম ডিভিশনের সেনাদের বর্বরতার চিত্র তুলে ধরেছেন[১৬]। এসময় দুইজন জাপানি সামরিক কর্মকর্তার মধ্যে সংগঠিত নরহত্যার প্রতিযোগিতাটি তৎকালীন জাপানি সংবাদপত্রে ফলাও করে প্রচারিত হত। প্রতিযোগিতাটি ছিল, শুধুমাত্র একটি তরবারি দিয়ে নরহত্যার সংখ্যা ১০০ জনে উন্নীত করা[১৭]

বহু সংখ্যক চীনা বেসামরিক ব্যক্তিককে জীবন্ত কবর দেয় হয়। ছোট দুগ্ধপোষ্য শিশুদের উপরে ছুঁড়ে দিয়ে তরবারি দিয়ে বিদ্ধ করার ঘটনাও ঘটে।

ধর্ষণ

ছবিতে দেখা যাচ্ছে জন ম্যাগির কেস ৫ চলচ্চিত্রে যেমনটি চিত্রিত হয়েছে তেমনভাবে এক কিশোরীকে হত্যা করা হয়
জন ম্যাগির চলচ্চিত্রে কেস ৫: ১৯৩৭ সালের ২৩ ডিসেম্বর প্রায় ৩০ জন জাপানি সৈন্য নম্বর ফাইভ জিনলুকোউ-এর একটি বাড়ির ১১ জন চীনা সদস্যের ৯ জনকে হত্যা করে। এক নারী ও তাঁর দুই কিশোরী মেয়েকে ধর্ষণ করা হয়, এবং জাপানি সৈন্যরা তাঁর যোনিতে একটি বোতল ও একটা বেত ঢুকিয়ে দেয়। একটি ৮ বছর বয়সী মেয়েকে ছুরি মারা হয়, কিন্তু সে ও তাঁর ছোট বোন বেঁচে যায়। ছবিটিতে নিহতদের ছবি দেখা যাচ্ছে[১৮][১৯]

আন্তর্জাতিক যুদ্ধপরাধ ট্রাইব্যুনালের ভাষ্য ‍অনুযায়ী, জাপানি সৈন্যরা নানচিং-এ ২০,০০০ জন অল্পবয়সী ও বৃদ্ধা নারীকে ধর্ষণ করে[২০]। এই গণধর্ষণকাণ্ড ঘটানো হয় অত্যন্ত শৃঙ্খলার সাথে। সৈনিকরা প্রতিটি বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে নারী ও মেয়ে শিশুদেরকে ধরে এনে ধর্ষণ করে[২১]। এসকল নারীদের অনেককে ধর্ষণের পরপরই হত্যা করা হত। অনেককে বিভিন্নভাবে তাদের যৌনাঙ্গ বিকৃত করার পর হত্যা করা হত[২২]। যৌনাঙ্গে বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে অথবা পায়ুপথে বাঁশ প্রয়োগ করে হত্যা করা হত। মেয়ে শিশুদের যোনিপথ কেটে বড় করে তারপর ধর্ষণ করা হত[২৩]

জন ম্যাগির বিবরণ অনুযায়ী,

১৩ ডিসেম্বর প্রায় ৩০ জন সৈন্য নানচিং-এর দক্ষিণ-পূর্ব অংশে #৫ হসিং লু কুতে একটি চীনা বাড়িতে আসে এবং ভিতরে প্রবেশ করার সুযোগ দাবি করে। হা নামের একজন মোহাম্মেদান দরজা খোলেন। তারা তৎক্ষণাৎ একটি রিভলভার দিয়ে তাঁকে হত্যা করে। তাঁর মৃত্যুর পর মিসেস হা তাদের সামনে হাঁটু গেড়ে বসেন এবং আর কাউকে হত্যা না করার জন্য অনুরোধ করেন। মিসেস হা তাদের কাছে জানতে চান যে, কেন তারা তাঁর স্বামীকে মেরেছে। তারা তাঁকে গুলি করে। মিসেস হসিয়াকে গেস্ট হলের একটি টেবিলের নিচ থেকে টেনে-হিঁচড়ে বের করা হয় যেখানে তিনি তাঁর ১ বছরের বাচ্চাকে নিয়ে লুকিয়ে ছিলেন। তাঁকে নগ্ন করার পর এবং এক বা একাধিক সৈন্য তাঁকে ধর্ষণ করার পরে তাঁর বুকে বেয়োনেট দিয়ে আঘাত করা হয় এবং তাঁর যোনির মধ্যে একটি বোতল ঢুকিয়ে দেয়া হয়। শিশুটিকে বেয়োনেট দিয়ে হত্যা করা হয়। এরপর কিছু সৈন্য পরের কক্ষে যায়, যেখানে মিসেস হসিয়ার বয়স্ক পিতা-মাতা এবং ১৬ ও ১৪ বছর বয়সী দুই মেয়ে ছিলেন। সৈন্যরা তাদেরকে ধর্ষণ করতে উদ্যত হলে তাদের নানি তাদেরকে রক্ষা করার চেষ্টা করেন। সৈন্যরা একটি রিভলভার দিয়ে তাঁকে হত্যা করে। তাঁর স্বামী স্ত্রী দেহ আঁকড়ে ধরেন এবং তাঁকেও হত্যা করা হয়। এরপর মেয়ে দুইটিকে নগ্ন করা হয়; বড়টিকে ২–৩ জন এবং ছোটটিকে ৩ জন ধর্ষণ করে। বড় মেয়েটিকে এরপর বেয়োনেট দিয়ে আঘাত করা হয় এবং তার যোনিতে একটি বেত প্রবেশ করানো হয়। ছোট মেয়েটিকেও বেয়োনেটবিদ্ধ করা হয় কিন্তু তার মা ও বোনের সঙ্গে যে ভয়ানক আচরণ করা হয়েছে তা থেকে তাকে রেহাই দেয়া হয়। এরপর সৈন্যরা ঐ কক্ষে থাকা ৭–৮ বছর বয়সী আরেক বোনকে বেয়োনেটবিদ্ধ করে। বাড়িটির শেষ হত্যাকাণ্ডের শিকার হয় হা-এর যথাক্রমে ৪ ও ২ বছর বয়সী দুই ছেলে। বড়টিকে বেয়োনেটবিদ্ধ করা হয় এবং ছোটটির মাথা তরবারি দিয়ে কেটে ফেলা হয়[২৪]

কোনো কোনো ক্ষেত্রে জাপানি সৈন্যরা পরিবারের সদস্যদের একজনকে অপর জনের সঙ্গে যৌনসঙ্গম করতে বাধ্য করে। তারা ছেলেদেরকে মায়েদের ধর্ষণ করতে বাধ্য করে এবং বাবাদেরকে মেয়েদের ধর্ষণ করতে বাধ্য করে[২৫]

কারণ

চীনা নাগরিকদের উপর এই ভয়াবহ উৎপীড়নের কারণ পরিষ্কার নয়। ধারণা করা হয়, সাংহাই দখল করতে প্রচুর লোকবল ও সময় ব্যয় করতে হওয়ায় আত্মঅহমিকায় অন্ধ জাপানি বাহিনী প্রতিশোধস্পৃহার বশবর্তী হয়ে এমন কাণ্ড ঘটায়। তারপরও একটি যুদ্ধ সংঘটিত হবার পিছনে সাধারণত যে সকল গূঢ় কারণ থাকে তার কোনটিই নানচিং গণহত্যার পশ্চাতে ছিল না[২৬]

বিচার

এ গণহত্যার মূল পৃষ্ঠপোষক ছিলেন তৎকালীন জাপানী সম্রাট হিরোহিতো। তিনি তার চাচা যুবরাজ আসাকাকে নানচিং অভিযানের নেতা হিসাবে মনোনীত করেন। নানচিং হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনাকারী হিসাবে তাকেই দায়ী করা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আত্মসমর্পণের শর্ত অনুসারে জাপানের সম্রাট অথবা রাজপরিবারের সদস্যদের পরবর্তীতে কোন অপরাধের জন্য বিচারের সম্মুখীন করা যাবে না। এই শর্তানুসারে আসাকাকে কোন বিচারের সম্মুখীন করা যায় নি[২৭]। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ১৯৪৬-৪৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত জাপানের রাজধানী টোকিও মহানগরে জাপানকে যুদ্ধাপরাধী সাব্যস্ত করে যে বিশেষ আন্তর্জাতিক আদালতে বিচার হয়, বাঙালি বিচারপতি রাধা বিনোদ পাল ছিলেন সেই আদালতের অন্যতম বিচারপতি। তিনি তার ৮০০ পৃষ্ঠার বিচক্ষণ রায় দিয়ে জাপানকে “যুদ্ধাপরাধ”-এর অভিযোগ থেকে মুক্ত করেন। এ রায় বিশ্বনন্দিত ঐতিহাসিক রায়ের মর্যাদা লাভ করে।

আরও দেখুন

টীকা

তথ্যসূত্র

বহিঃসংযোগ

🔥 Top keywords: রাম নবমীমুজিবনগর দিবসপ্রধান পাতামুজিবনগর সরকারবিশেষ:অনুসন্ধানইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগএক্স এক্স এক্স এক্স (অ্যালবাম)বাংলাদেশবাংলা ভাষামিয়া খলিফারাজকুমার (২০২৪-এর চলচ্চিত্র)আনন্দবাজার পত্রিকাআবহাওয়ারামপহেলা বৈশাখউয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগইসরায়েলইরানরবীন্দ্রনাথ ঠাকুরমুজিবনগরইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউনরিয়াল মাদ্রিদ ফুটবল ক্লাব২০২৪ ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগক্লিওপেট্রাচর্যাপদভূমি পরিমাপশেখ মুজিবুর রহমানজনি সিন্সকাজী নজরুল ইসলামঈদুল আযহাফিলিস্তিনইউটিউবভারতবিকাশআসসালামু আলাইকুমসৌদি আরববাংলা প্রবাদ-প্রবচনের তালিকামুহাম্মাদ