পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার
রয়েল সুইডিশ একাডেমি অব সায়েন্স, প্রতি বছর পদার্থবিজ্ঞানের মাধ্যমে মানবতার স্বার্থে অসামান্য অবদান রাখা বিজ্ঞানীদের পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার-এ ভূষিত করে থাকে। ১৯০১ সালে আলফ্রেড নোবেল কর্তৃক চালু করা পাঁচটি শাখায় নোবেল পুরস্কারের মধ্যে এটি অন্যতম, অন্য চারটি শাখা হলো- রসায়নে নোবেল পুরস্কার, সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার, শান্তিতে নোবেল পুরস্কার এবং চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার।
পদার্থ বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার | |
---|---|
বিবরণ | পদার্থবিজ্ঞানের মাধ্যমে মানবতার স্বার্থে অসামান্য অবদান রাখা |
তারিখ | ১০ ডিসেম্বর ১৯০১ |
অবস্থান | স্টকহোম, সুইডেন |
দেশ | সুইডেন |
পুরস্কারদাতা | রয়েল সুইডিশ একাডেমি অব সায়েন্স |
পুরস্কার | ৯ মিলিয়ন সুইডিশ ক্রোনা (২০১৭)[১] |
প্রথম পুরস্কৃত | ১৯০১ |
বর্তমানে আধৃত | আলাঁ আস্পে, জন ক্লাউজার, আন্টন সাইলিঙার (২০২২) |
সর্বাধিক পুরস্কার | জন বারডিন (২) |
ওয়েবসাইট | nobelprize.org |
রঞ্জন রশ্মি বা এক্স-রে আবিষ্কারের মাধ্যমে অসামান্য অবদান রাখার স্বীকৃতিস্বরূপ পদার্থবিজ্ঞানে প্রথম নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন পদার্থবিজ্ঞানী উইলিয়াম রন্টজেন। নোবেল ফাউন্ডেশন এই পুরস্কারটি দিয়ে থাকে, যা পদার্থবিজ্ঞানের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার হিসেবে গণ্য করা হয়। প্রতি বছর ১০ ডিসেম্বর, নোবেলের মৃত্যুবার্ষিকীতে স্টকহোমে একটি বার্ষিক অনুষ্ঠান আয়োজনের মধ্য দিয়ে এই পুরস্কার প্রদান করা হয়ে থাকে। ২০১৮ সাল পর্যন্ত, মোট ২০৯ জন বিজ্ঞানী এই পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। [২]
পটভূমি
আলফ্রেড নোবেল তার শেষ ইচ্ছাপত্রে উল্লেখ করেন, তার সম্পত্তি কাজে লাগিয়ে একগুচ্ছ পুরস্কার প্রবর্তন করা হবে এবং পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, শান্তি, চিকিৎসাবিজ্ঞান বা মেডিসিন এবং সাহিত্য- এই পাঁচটি ক্ষেত্রে "মানবতার বৃহত্তম স্বার্থে" যারা অবদান রাখবেন,তাদের এই পুরস্কারে ভূষিত করা হবে।[৩] যদিও নোবেল তার জীবদ্দশায় বেশ কয়েকটি ইচ্ছাপত্র লেখেন, তার শেষ ইচ্ছাপত্রটি তার মৃত্যুর এক বছর পূর্বে লেখা হয় এবং ১৮৯৫ সালের ২৭ নভেম্বর প্যারিসের সুইডিশ-নরওয়েজিয়ান ক্লাবে উইলটি স্বাক্ষরিত হয়। [৪][৫] নোবেল তার মোট সম্পত্তির ৯৪ শতাংশ, ৩১ মিলিয়ন সুইডিশ ক্রোনার ( ২০১৬ সালের মূল্যমানে ১৯৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ১৭৬ মিলিয়ন ইউরো) পাঁচটি নোবেল পুরস্কার প্রবর্তন ও প্রদানের জন্য উইল করে যান।[৬] তবে উইলটিকে ঘিরে যে সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছিল, সেজন্য বেশ কিছুদিন অপেক্ষা করতে হয়। অবশেষে ১৮৯৭ সালের ২৬ এপ্রিল, স্টরটিং (নরওয়ের পার্লামেন্ট) উইলটি অনুমোদন করে।[৭][৮] উইলের নির্বাহক রগনার সোলমান ও রুডলফ লিলিজেকুয়েস্ট মিলে নোবেলের ধনসম্পদ রক্ষণাবেক্ষণ ও নোবেল পুরস্কার আয়োজনের জন্য নোবেল ফাউন্ডেশন গঠন করেন।
নোবেলের শেষ ইচ্ছাপত্র অনুমোদনের কয়েকদিনের মধ্যেই শান্তিতে নোবেল পুরস্কার প্রদানের জন্য নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটির সদস্যদের দায়িত্ব দেওয়া হয়। পুরস্কার প্রদানের জন্য প্রতিষ্ঠানগুলো যে সূচি অনুসরণ করেঃ ক্যারোলিন্সকা ইন্সটিটিউট ৭ জুন, সুইডিশ একাডেমি ৯ জুন এবং রয়েল একাডেমি অব সায়েন্সেস ১১ জুন।[৯][১০] এছাড়া নোবেল পুরস্কার কীভাবে প্রদান করা উচিত, সে ব্যাপারে নির্দেশিকা তৈরির ব্যাপারেও নোবেল ফাউন্ডেশন ঐকমত্যে পৌঁছায়। ১৯০০ সালে, নোবেল ফাউন্ডেশনের প্রণীত নতুন বিধান সম্রাট দ্বিতীয় অস্কারের মাধ্যমে প্রচার করা হয়। নোবেলের শেষ ইচ্ছানুযায়ী, রয়েল সুইডিশ একাডেমি অব সায়েন্সেসকে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার প্রদানের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
মনোনয়ন ও নির্বাচন
সর্বোচ্চ তিনজন বিজয়ী ও দুইটি ভিন্নধর্মী কাজকে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত করা হয়।[১১][১২] অন্যান্য নোবেল পুরস্কারের তুলনায় পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার প্রদানের জন্য মনোনয়ন ও নির্বাচন বেশ দীর্ঘ ও কঠোর প্রক্রিয়ায় করা হয়ে থাকে। মূলত এ কারণেই দীর্ঘদিন ধরে পদার্থবিজ্ঞানের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার হিসেবে এর গুরুত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে। [১৩]
দ্য রয়েল সুইডিশ একাডেমি অব সায়েন্সেস কর্তৃক নির্বাচিত পাঁচজন সদস্যের একটি বিশেষ নোবেল কমিটি পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল বিজয়ীদের নির্বাচিত করে থাকে। সেপ্টেম্বরে এর প্রথম ধাপ শুরু হয়। নির্বাচিত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর, পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়নে নোবেল বিজয়ী এরকম প্রায় ৩০০০ মানুষের কাছে প্রার্থী মনোনয়নের জন্য গোপনীয় ফর্ম প্রেরণ করা হয়। পরের বছর ৩১ জানুয়ারির মধ্যে পূরণ করা নমিনেশন ফর্মগুলো নোবেল কমিটির কাছে পৌঁছায়। বিশেষজ্ঞরা যাচাই-বাছাই ও আলাপ আলোচনা করে ১৫ জনের মতো প্রার্থীকে নির্বাচিত করেন। কমিটি একটি চূড়ান্ত প্রতিবেদন তৈরির মাধ্যমে এই সুপারিশকৃত নামগুলো একাডেমির কাছে পেশ করে। একাডেমির পদার্থবিজ্ঞান শাখায় এ নিয়ে আরও আলাপ আলোচনা শেষে সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল বিজয়ীকে চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত করা হয়।[১৪]
প্রার্থীদের নাম কখনোই প্রকাশ্যে ঘোষণা করা হয় না, তাদের যে নোবেল পুরস্কারের জন্য বিবেচনা করা হয়েছে, সেটাও কখনো তাদের জানানো হয় না। মনোনয়নের সব দলিলপত্র পঞ্চাশ বছরের জন্য সিলগালা করে রাখা হয়। [১৫] যদিও কাউকে মরণোত্তর মনোনয়ন দেয়ার বিধান নেই, পুরস্কার প্রদান কমিটির সিদ্ধান্ত গ্রহণ (সাধারণত অক্টোবরে) ও পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানের (ডিসেম্বর) মাঝে কেউ যদি মৃত্যুবরণ করেন, তবুও তিনি পুরস্কৃত হতে পারেন। ১৯৭৪ সালের পূর্বে, মনোনয়ন পাওয়ার পর যদি কোনো প্রার্থী মৃত্যুবরণ করতেন, তিনি মরণোত্তর পুরস্কারের জন্য বিবেচিত হতে পারতেন। [১৬]
পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার জন্য কৃতিত্বপূর্ণ আবিষ্কারকে "সময়ের পরীক্ষায়"-ও উত্তীর্ণ হতে হয়। এর ফলে আবিষ্কার ও পুরস্কারপ্রাপ্তির মধ্যে ২০ বছর বা তার চেয়েও অনেক বেশি ব্যবধান থাকতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, সুব্রহ্মণ্যন চন্দ্রশেখর নক্ষত্রমণ্ডলের গঠন ও বিবর্তন নিয়ে তার ত্রিশের দশকে করা গবেষণার জন্য দীর্ঘ প্রায় পঞ্চাশ বছর পর, ১৯৮৩ সালে যুগ্মভাবে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। এই পদ্ধতিগত জটিলতার কারণে অনেক বিজ্ঞানীই তাদের জীবদ্দশায় কাজের স্বীকৃতি পান না। বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার কখনোই নোবেল পুরস্কারের জন্য বিবেচিত হয়নি, কারণ আবিষ্কারের প্রভাব সমাদৃত হওয়ার আগেই আবিষ্কারক মৃত্যুবরণ করেছেন। [১৭][১৮]
পুরস্কার
পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী একটি স্বর্ণপদক, কৃতিত্বের মানপত্র ও সনদ এবং নগদ অর্থ লাভ করেন। [১৯]
পদক
নোবেল পুরস্কারের পদকগুলো নোবেল ফাউন্ডেশনের নিবন্ধিত ট্রেডমার্ক। ১৯০২ সাল থেকে মিন্টভারকেট নামের একটি সুইডিশ কোম্পানি[২০] ও মিন্ট অব নরওয়ে পদকগুলো তৈরি করে থাকে। প্রতিটি পদকের উপরিভাগের বামপার্শ্বে আলফ্রেড নোবেলের ছবি আছে। পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, চিকিৎসাবিজ্ঞান এবং সাহিত্যের নোবেল পুরস্কারের পদকের উপরিভাগে একইভাবে আলফ্রেড নোবেলের ছবি এবং তার জন্মমৃত্যু সাল (১৮৩৩-১৮৯৬) খোদাই করা থাকে। শান্তি ও অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কারের পদকেও নোবেলের প্রতিকৃতি রয়েছে, তবে তা একটু ভিন্ন নকশায় খোদাই করা হয়।[২১][২২] পদকের বিপরীত পাশের নকশা পুরস্কার প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানভেদে বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। তবে রসায়ন ও পদার্থবিজ্ঞানের নোবেল পদকে প্রকৃতিকে দেবীরূপে দেখা যায়, যার অবগুণ্ঠন ধরে থাকেন এক বৈজ্ঞানিক প্রতিভা। ১৯০২ সালে এরিক লিন্ডবার্গ রসায়ন, পদার্থবিজ্ঞানের পাশাপাশি চিকিৎসাবিজ্ঞান ও সাহিত্যের জন্য নোবেল পদকের নকশা করেন।[২৩]
সনদ
নোবেল পুরস্কার বিজয়ীরা সরাসরি সুইডেনের সম্রাটের হাত থেকে সনদ গ্রহণ করেন। পুরস্কার প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো প্রত্যেক নোবেল বিজয়ীর জন্য স্বতন্ত্রভাবে সনদগুলো ডিজাইন করে থাকে। প্রতিটি সনদে একটি ছবি, বিজয়ীর নাম এবং কী অবদানের জন্য তিনি নোবেল পেলেন, সে বিষয়ে একটি বিবৃতি লেখা থাকে। [২৪][২৪]
পুরস্কারের অর্থ
পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে নোবেল বিজয়ীকে কী পরিমাণ অর্থ প্রদান করা হবে, তা উল্লেখ করে একটি দলিল দেওয়া হয়। নোবেল ফাউন্ডেশনের থাকা তহবিলের উপর ভিত্তি করে একেক বছর পুরস্কারের অর্থমূল্য বিভিন্ন হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ২০০৯ সালে পুরস্কারস্বরূপ সর্বমোট ১০ মিলিয়ন সুইডিশ ক্রোনার (১.৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার) প্রদান করা হয়।[২৫] কিন্তু ২০১২ সালে প্রদেয় অর্থের পরিমাণ ছিল ৮ মিলিয়ন সুইডিশ ক্রোনার বা ১.১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।[২৬] যদি একই ক্যাটাগরিতে দুইজন বিজয়ী হয়ে থাকেন, তাহলে পুরস্কারের অর্থ দুজনের মাঝে সমানভাগে ভাগ করে দেওয়া হয়। কিন্তু তিনজন যদি যৌথভাগে বিজয়ী হন, তাহলে পুরস্কার প্রদান কমিটি পুরস্কারের অর্থ তিনজনের মাঝে সমানভাগে ভাগ করে দিতে পারেন, অথবা একজন বিজয়ীকে অর্ধেক অর্থ দিয়ে বাকি দুজনকে এক চতুর্থাংশ করে অর্থ পুরস্কার দিতে পারেন। [২৭][২৮][২৯][৩০]
অনুষ্ঠান
নির্বাচকের দায়িত্ব পালন করা কমিটি ও প্রতিষ্ঠান সাধারণত অক্টোবরের দিকে নোবেল বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করেন। এরপর ১০ ডিসেম্বর, নোবেলের মৃত্যু বার্ষিকীর দিন স্টকহোম কনসার্ট হলে একটি অনুষ্ঠান আয়োজনের মধ্য দিয়ে বিজয়ীদের আনুষ্ঠানিকভাবে পুরস্কার প্রদান করা হয়। অনুষ্ঠানের দিন নোবেল বিজয়ী একটি সনদ, একটি পদক ও পুরস্কারের অর্থমূল্য লেখাএকটি দলিল পেয়ে থাকেন। [৩১]
আরও দেখুন
তথ্যসূত্ৰ
উদ্ধৃতিসমূহ
উৎস
- Friedman, Robert Marc (2001). The Politics of Excellence: Behind the Nobel Prize in Science. New York & Stuttgart: VHPS (Times Books). আইএসবিএন ০-৭১৬৭-৩১০৩-৭, আইএসবিএন ৯৭৮-০-৭১৬৭-৩১০৩-০.
- Hillebrand, Claus D. (June 2002). "Nobel Century: A Biographical Analysis of Physics Laureates". Interdisciplinary Science Reviews 27.2: 87-93.
- Schmidhuber, Jürgen (2010). Evolution of National Nobel Prize Shares in the 20th Century at arXiv:1009.2634v1 with graphics: National Physics Nobel Prize shares 1901–2009 by citizenship at the time of the award and by country of birth.
- Lemmel, Birgitta. "The Nobel Prize Medals and the Medal for the Prize in Economics" ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ১৫ আগস্ট ২০১৮ তারিখে. nobelprize.org. Copyright © The Nobel Foundation 2006. (An article on the history of the design of the medals.)
বহিঃসংযোগ
- "All Nobel Laureates in Physics" – Index webpage on the official site of the Nobel Foundation.
- "The Nobel Prize Award Ceremonies" – Official hyperlinked webpage of the Nobel Foundation.
- "The Nobel Prize in Physics" – Official webpage of the Nobel Foundation.
- "The Nobel Prize Medal for Physics" ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ১৬ জুলাই ২০১৭ তারিখে – Official webpage of the Nobel Foundation.