মারি ক্যুরি

নোবেল পুরস্কার প্রাপ্ত প্রথম মহিলা বিজ্ঞানী

মারি ক্যুরি[১] (ফরাসি: Marie Curie) (৭ নভেম্বর ১৮৬৭ – ৪ জুলাই ১৯৩৪) প্রথম মহিলা বিজ্ঞানী যিনি নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। এই পোলীয় ও ফরাসি বিজ্ঞানী ১৯০৩ সালে তেজস্ক্রিয়তার উপর গবেষণার জন্য তার স্বামী পিয়ের ক্যুরি এবং তেজস্ক্রিয়তার আবিষ্কারক অঁরি বেকেরেলের সাথে যৌথভাবে নোবেল পুরস্কার পান। তিনি ছিলেন প্রথম মহিলা বিজ্ঞানী যিনি বিজ্ঞানের দুইটি ভিন্ন শাখায় দুইবার নোবেল পুরস্কার জেতেন। তিনি প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়েরও প্রথম মহিলা অধ্যাপক ছিলেন এবং তিনিই ছিলেন প্রথম মহিলা যার অসামান্য মেধার কারণে ১৯৯৫ সালে প্যান্থিয়নে সমাহিত করা হয়।[২]

ম্যারি স্ক্লদভ্‌স্কা ক্যুরি
মারিয়া স্ক্লদভ্‌স্কা ক্যুরি
জন্মনভেম্বর ৭ ১৮৬৭
ওয়ার্‌শ, কংগ্রেস পোল্যান্ড, রুশ সাম্রাজ্য
মৃত্যু৪ জুলাই ১৯৩৪(1934-07-04) (বয়স ৬৬)
পাসি, ওত সাভোয়া, ফ্রান্স
জাতীয়তাপোলীয়, ফরাসি
মাতৃশিক্ষায়তনসর্বন এবং ইএসপিসিআই
পরিচিতির কারণতেজস্ক্রিয়তা
পুরস্কার পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার (১৯০৩)
রসায়নে নোবেল পুরস্কার (১৯১১)
বৈজ্ঞানিক কর্মজীবন
কর্মক্ষেত্রপদার্থবিজ্ঞান এবং রসায়ন
প্রতিষ্ঠানসমূহসর্বন
ডক্টরাল উপদেষ্টাঅঁরি বেকরেল
ডক্টরেট শিক্ষার্থীঅঁদ্রে-লুই দ্যবিয়ের্ন
Marguerite Catherine Perey
স্বাক্ষর
টীকা
বিজ্ঞানেরই ভিন্ন দুটি ক্ষেত্র নোবেল পুরস্কার প্রাপ্ত একমাত্র ব্যক্তি

মারি ক্যুরি ১৮৬৭ সালের ৭ই নভেম্বর পোল্যান্ডের ওয়ারশতে জন্মগ্রহণ করেন, যেটি তখন রাশিয়ান সাম্রাজ্যের অংশ ছিলো। মারি কুরি ওয়ারশর গোপন ভাসমান বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেছিলেন এবং ওয়ার্সাতেই তার ব্যবহারিক বৈজ্ঞানিক প্রশিক্ষণ শুরু করেছিলেন। ১৮৯১ সালে ২৪ বছর বয়সে সে তার বড় বোন ব্রোনিস্লাভাকে অনুসরণ করে প্যারিসে পড়তে যান। সেখানেই সে তার পরবর্তি বৈজ্ঞানিক কাজ পরিচালিত করেছিলেন। ১৯০৩ সালে মারি কুরি তার স্বামী পিয়েরে কুরি এবং পদার্থবিদ হেনরি বেকেরেলের সাথে পদার্থ বিদ্যায় নোবেল পুরস্কার জেতেন। তিনি এককভাবে ১৯১১ সালে রসায়নেও নোবেল পুরস্কার জেতেন।

পদার্থবিজ্ঞানে তিনি নোবেল পান তেজষ্ক্রিয়তা নিয়ে কাজ করার জন্য। আর রসায়নে নোবেল পান পিচব্লেন্ড থেকে রেডিয়াম পৃথক করার জন্য।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় হাসপাতালগুলোতে এক্স-রের সরঞ্জামের ঘাটতি ছিল। যুদ্ধাহত রোগিদের এক্স রে সঠিকভাবে করানোর অর্থ যোগাতে তিনি তহবিল সংগ্রহে নামেন। এসময় অসুস্থ শরীর নিয়ে তিনি ২২০ টি রেডিওলোজি স্টেশন গড়ে তোলেন। এর মধ্যে ২০০ টি ছিল বিভিন্ন জায়গায় স্থায়ী ছিল, এবং ২০ টি ছিল ভ্রাম্যমাণ। এগুলো তিনি বিভিন্ন ধনী মহিলাদের কাছ থেকে গাড়ি ধার নিয়ে তৈরী করেছিলেন। তিনি নিজেও বিভিন্ন স্টেশনে এক্সেরে করতে সাহায্য করতেন এবং যুদ্ধের সময় তার গড়া এই রঞ্জনবিদ্যা ইনস্টিটিউটগুলোয় প্রায় ১০ লাখ যুদ্ধাহতের এক্স রে করা হয়েছিল।

পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারসতে নিজের গড়া রেডিয়াম ইনস্টিটিউটসহ তিনি অন্য একটি রেডিয়াম ইনস্টিটিউটে কাজ করতেন। রেডিয়াম বিষয় নিয়ে রেডিয়াম ইনস্টিটিউটে গবেষণা করে তিনি তার মেয়ে ইরিন, মেয়ের স্বামী ফ্রেডরিক জুলিয়েটের সাথে যৌথভাবে নোবেল পান।

ফ্রান্সের একজন নাগরিক হিসেবে থাকা অবস্থায়ও মারি স্ক্লদভস্কা ক্যুরি (তিনি তার দুটো উপাধিই লিখতেন )[৩][৪] তিনি কখনোই তার পোলিশ পরিচয় ভুলে যাননি। তিনি তার কন্যাদের পোলিশ ভাষা শিখিয়েছিলেন এবং তাদের পোল্যান্ডে নিয়েও গিয়েছিলেন।[৫] তিনি নিজে প্রথম যে মৌলটি আবিষ্কার করেন, তার জন্মভূমির নামানুসারে ঐ মৌলের নাম দেন পোলনিয়াম[ক] গবেষণার সময় নিজের জামার পকেটে রেডিয়াম পূর্ণ টেস্টটিউব রাখা এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় নিজের তৈরি ভ্রাম্যমাণ এক্স রশ্মি ইউনিটে কাজ করার মাধ্যমে তেজস্ক্রিয়তার সম্পর্কে আসায় অ্যাপ্লাস্টিক অ্যানেমিয়া হওয়ায় মারি ক্যুরি ১৯৩৪ সালে ফ্রান্সের (হাউতে-সাভইয়ের) সাঞ্চেল্লেমজের একটি স্বাস্থ্যনিবাসে মৃত্যুবরণ করেন।[৬]

জীবনী

প্রাথমিক জীবন

ওয়ার্সর ইউলিকা ফ্রেতা -এর "নতুন শহরে"  মারি ক্যুরির জন্মস্থান – বর্তমানে এটি মারিয়া স্ক্লদভস্কা-ক্যুরি জাদুঘর

রাশিয়া বিভাগের সময় পোল্যান্ডের ওয়ার্সতে ১৮৬৭ সালের ৭ নভেম্বর মারি ক্যুরি জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন বিখ্যাত শিক্ষক বরিন্সলা, নী বগুস্কা ও ভ্লাদিস্লাও স্ক্লদভস্কির পাঁচ সন্তানের মধ্যে সর্ব-কনিষ্ঠ। [৭] ক্যুরির জ্যেষ্ঠ ভাই বোনদের নাম জোফিয়া (জন্ম ১৮৬২), জোজেফ (জন্ম ১৮৬৩), বরিন্সলা (জন্ম ১৮৬৫) এবং হেলেনা (জন্ম ১৮৬৬)[৮]

ভ্লাদিস্লাও স্কলদভস্কি এবং তার মেয়েরা(বাম থেকে) মারিয়া, ব্রনিস্লাও, হেলেনা, ১৮৯০

১৮৬৩ থেকে ১৮৬৫ এর মধ্যে ঐতিহাসিক জানুয়ারি আপ্সপ্রিং-এর সময় পোল্যান্ডের স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দেয়ার কারণে মারি ক্যুরির পৈতৃক এবং নানা বাড়ির সম্পত্তি ধ্বংস হয়ে যায়।[৯] এই কারণে মারি ক্যুরি এবং তার ভাইবোনদের খুব অল্প বয়সেই জীবন সংগ্রাম দেখতে হয়।

ক্যুরির দাদা যযেফ স্ক্লদভস্কি ছিলেন লুবলিনের একজন বিখ্যাত শিক্ষক। তিনি যুবক বলেস্লাও স্ক্লদভস্কিকে লেখাপড়া শিখিয়েছিলেন,[১০] যিনি পরবর্তীতে পোলিশ সাহিত্যের নেতৃত্বদানকারী হিসেবে আবির্ভূত হন।[১১] মারিয়া ক্যুরির পিতা ভ্লাদিস্লাও স্ক্লদভস্কি পদার্থবিজ্ঞান এবং রসায়ন পড়াতেন যা পরবর্তীতে মারিয়ার লেখাপড়ার বিষয় হয়ে দাড়ায়। তিনি ওয়ার্সর দুইটি বালকদের জিমনেশিয়ামের পরিচালকও ছিলেন।[৮] যুদ্ধের সময় রাশিয়ার সরকার পোল্যান্ডের বিদ্যালয়গুলোতে গবেষণার যন্ত্রপাতির ব্যবহার নিষিদ্ধ করে। ভ্লাদিস্লাও বেশিরভাগ যন্ত্রপাতি বাড়িতে নিয়ে আসেন এবং নিজের সন্তানদের লেখাপড়ায় সেগুলো ব্যবহার করেন। [৮]পোলিশ চেতনা লালনের কারণে ত কালীন রাশিয়ান প্রশাসন ক্যুরির পিতাকে পূর্বের চাকরি থেকে অব্যাহতি দিয়ে নিম্নশ্রেণীর একটি কম বেতনের চাকরি দেয় এবং তারা অর্থ বিনিয়োগে ক্ষতির শিকার হন। তখন নিজেদের আয় ঠিক রাখার জন্য তারা তাদের বাড়িকে যাত্রানিবাস হিসেবে ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেয়।.[৮] মারি ক্যুরির মা ওয়ার্স বোর্ডিং স্কুল ফর গার্লস নামে একটি বিখ্যাত স্কুল চালাতেন। ক্যুরির জন্মের পর তিনি কর্মজীবন ত্যাগ করেন। যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হয়ে ১৮৭৮ সালে ক্যুরির মা মারা যান। তার তিন বছর আগে ক্যুরির জ্যেষ্ঠ বোন জোফিয়া এক বাসিন্দার কাছ থেকে জ্বরবিকার রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। মারিয়ার বাবা ছিলেন একজন নাস্তিক আর তার মা ছিলেন একজন নিবেদিত ক্যাথলিক। মা ও বোনের মৃত্যু মারি ক্যুরিকে ক্যাথলিক থেকে অজ্ঞেয়বাদীতে পরিণত করে। [৮][১২][১৩] ১০ বছর বয়সে মারিয়া ভর্তি হয়েছিলেন যে.সিকরস্কা পরিচালিত বোর্ডিং স্কুলে। পরে তিনি বালিকাদের জিমনেশিয়ামে ভর্তি হন এবং সেখান থেকেই ১৮৮৩ সালের ১২ জুন স্বর্ণপদক সহ স্নাতক লাভ করেন।[৭] পরের বছর তিনি তার পিতার নিকটাত্মীয়ের সাথে গ্রামে এবং তারও পরবর্তী বছর তার পিতার সাথে ওয়ার্সতে বসবাস করেন এবং কিছু সময় গৃহ শিক্ষিকার দায়িত্ব পালন করেন।[৭]মেয়ে শিক্ষার্থী হওয়ার কারণে মারি ক্যুরি কোন নিয়মিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে পারেননি। তাই তিনি এবং তার বোন বরিন্সলাও ক্ল্যান্ডেসটাইন ভ্রাম্যমাণ বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন, এটি উচ্চশিক্ষা প্রদানে নিবেদিত একটি পোলিশ দেশপ্রেমিক প্রতিষ্ঠান ছিল যা মেয়ে শিক্ষার্থীকেও ভর্তি করত। [৮][৭]

একটি ওয়ার্স গবেষণাগারে ১৮৯০-৯১ সালে মারিয়া স্ক্লদভস্কা তার প্রথম বৈজ্ঞানিক গবেষণা করেন।

মারিয়া তার বোন বরিন্সলাও এর সাথে একটি চুক্তি করেন যে তিনি প্যারিসে উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য বোনকে আর্থিক সুবিধা দিবেন, বিনিময়ে ২ বছর পর মারিয়া একই সুবিধা পাবেন। [১৪][৭] এরই প্রেক্ষিতে মারিয়া গভারনেসের চাকরি নেন: প্রথমে ওয়ার্সার একজন গৃহ শিক্ষিকা হিসেবে; এবং পরবর্তীতে দুই বছরের জন্য সযচজুকির একজন গভারনেস হিসেবে, জোরাভস্কিস উপাধির একটি সম্পদশালী পরিবারে, যারা তার পিতার আত্মীয় ছিল। [৭][১৪] ঐ পরিবারের সাথে থাকতে থাকতে তিনি তাদের পুত্র কাজিমিয়েরজ জোরাভস্কির প্রেমে পরেন, যিনি পরবর্তীতে একজন বিখ্যাত গণিতবিদ হয়েছিলেন। [১৪] তার অভিভাবক একজন দরিদ্র আত্মীয়কে বিয়ে করার কথায় সমর্থন দেন নি এবং তিনি তাদের বিরোধিতা করতে পারেননি।<refname="Marie Curie – Polish Girlhood (1867–1891)1"/> জোরাভস্কির সাথে মারিয়ার বিচ্ছেদ দুইজনকেই আহত করে। এরপর জোরাভস্কি ডক্টরেট অর্জন করে গণিতবিদ হিসেবে রেক্টরএবং কারকও বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মজীবন শুরু করেন। [৯] এমনকি বৃদ্ধ বয়সে ওয়ার্স পলিটেকনিকে গণিতের প্রভাষক থাকা অবস্থায়ও তিনি মারিয়ার ভাস্কর্যের সামনে বসে ধ্যানমগ্ন থাকতেন যা মারিয়া ক্যুরি কর্তৃক ১৯৩২ সালে প্রতিষ্ঠিত রেডিয়াম ইন্সটিটিউটের সামনে ১৯৩৫ সালে নির্মাণ করা হয়।[৯][১৫]

১৮৯০ এর শুরুতে, বরিনস্লাও –যিনি কিছু মাস আগে পোলিশ পদার্থবিদ এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব কাজিমিয়েরজ দলাস্কিকেবিয়ে করেন— তারা মারিয়াকে তাদের সাথে থাকার আমন্ত্রণ জানান। [৭] মারিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বেতনের টাকার অভাবে এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন, প্রয়োজনীয় টাকা সংগ্রহ করতে তার দেড় বছরেরও বেশি সময় লেগেছিল।[৭] তিনি বাবার কাছ থেকে সাহায্য পান যিনি কিনা আবার আরও আকর্ষণীয় পদে চাকরি পেয়েছিলেন।[১৪] এই সময় তিনি বই পড়া ও পত্র আদান-প্রদানের মাধ্যমে স্বশিক্ষা চালিয়ে যান।[১৪] ১৮৮৯ এর শুরুতে তিনি ওয়ার্সয় তার পিতার কাছে চলে আসেন।[৭] তিনি একজন গভারনেস হিসেবে কাজ শুরু করেন এবং ১৮৯১ সাল পর্যন্ত সেখানে থাকেন।[১৪] তিনি ভ্রাম্যমাণ বিশ্ববিদ্যালয়ে টিউটর,লেখাপড়া করেন এবং ১৮৯০-৯১-এওয়ার্সর পুরনো শহরের কাছে ক্রাকভস্কিএ প্রযেদ্মিএসচে ৬৬-এর শিল্প ও কৃষি জাদুঘরের একটি রসায়ন গবেষণাগারে ব্যবহারিক রসায়ন গবেষণা শুরু করেন। [৮][৭][১৪] এই গবেষণাগারের পরিচালক ছিলেন তার আত্মীয় জোজেফ বগুস্কি, যিনি আবার একসময় সাংক্‌ত পিতেরবুর্গে রাশিয়ান রসায়নবিদ দিমিত্রি মেন্ডেলিভেরসহকারী ছিলেন।[১৪][৭][১৬]

প্যারিসে নতুন অভিজ্ঞতা

১৮৯১ এর শেষভাগে মারিয়া পোল্যান্ড থেকে ফ্রান্সের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমান।[১৭] প্যারিসে, ১৮৯১ সালে প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন এবং গণিতে অধ্যয়ন করতে থাকেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছেই ল্যাটিন কোয়ার্টারে একটি গ্যারেট ভাড়া করে বসবাসের পূর্বে অল্প কয়েকদিনের জন্য মারিয়া (অথবা মারি, পরবর্তীতে এই নামে ফ্রান্সে সুপরিচিত হয়েছিলেন) বোন ও দুলাভাইয়ের বাসায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। [১৮][১৯] তার স্বল্প আয়ে, শীতকালে ঠাণ্ডায় ভুগে এবং প্রায় ক্ষুধায় জ্ঞান হারিয়ে তার জীবন চলত। [১৯]মারি দিনে পড়তেন, সন্ধ্যায় পড়াতেন এবং খুব সামান্যই আয় করতেন। ১৯৮৩ সালে তাকে পদার্থে ডিগ্রী প্রদান করা হয় এবং তিনি অধ্যাপক গ্যাব্রিয়েল লিপম্যানের শিল্পভিত্তিক গবেষণাগারে কাজ শুরু করেন। [৭] ইতিমধ্যে, ১৮৯৪ সালে আরেকটি ডিগ্রী লাভের মাধ্যমে ফেলোশিপ পেয়ে তিনি প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া চালিয়ে যান। [৭][১৯][খ]মারি প্যারিসে দ্য সোসাইটি ফর দ্য এনকারেজমেন্ট অফ ন্যাশনাল ইন্ডাস্ট্রি এর সহায়তায় বিভিন্ন পদার্থের চৌম্বক ধর্ম পরীক্ষার মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক গবেষণা শুরু করেন। এই সময় পিয়েরে ক্যুরি তার জীবনে আসেন। প্রকৃতির বিজ্ঞানের উপর তাঁদের আগ্রহই তাঁদের এক জায়গায় নিয়ে আসে। [২০] পিয়েরে École supérieure de physique et de chimie industrielles de la ville de Paris (ESPCI)- এর স্কুল অফ ফিজিক্‌স অ্যান্ড কেমিস্ট্রির পরামর্শক ছিলেন।[৭] তাঁদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন একজন পোলিশ পদার্থবিদ, অধ্যাপক জোজেফ কোভালস্কি-ভিএরাসজ, যিনি জানতেন যে মারি একটি বড় গবেষণাগার খুঁজছেন যার ব্যবস্থা পিয়েরে করতে পারবেন।[১৯][৭] পিয়েরের কাছে কোন বড় গবেষণাগার ছিল না, কিন্তু তিনি মারিকে কাজ শুরু করার মত জায়গা দিতে পেরেছিলেন। [১৯]বিজ্ঞান সম্পর্কে উভয়ের আগ্রহ তাঁদের কাছে নিয়ে আসে এবং তারা পরস্পর সম্পর্কে ধারণা উন্নত করতে থাকেন। [১৯][৭] ঘটনাক্রমে পিয়েরে বিয়ের প্রস্তাব দেন কিন্তু প্রথমে মারি তা গ্রহণ করেননি কারণ তিনি নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার পরিকল্পনা করছিলেন। [৭] পিয়েরে তার সাথে পোল্যান্ডে বসবাসেও রাজি হয়ে যান। [৭] ইতিমধ্যে, ১৮৯৪ সালে গ্রীষ্মের ছুটিতে মারি ওয়ার্স ফিরে এসে তার পরিবারের সাথে দেখা করেন। [১৯] তিনি তখনও এই ধারণাই পোষণ করছিলেন যে তিনি পোল্যান্ডে কাজ করতে পারবেন, কিন্তু কারকও বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে গ্রহণ করেনি কারণ তিনি একজন নারী ছিলেন[৯] পিয়েরের একটি চিঠি তাঁকে প্যারিস ফিরে এসে পিএইচডি করতে রাজী করে ফেলে।[১৯] মারির প্রবল অনুরোধে পিয়েরে চুম্বকত্বের উপর তার গবেষণা লিপিবদ্ধ করেন এবং ১৮৯৫ সালের মার্চ মাসে ডক্টরেট অর্জন করেন; তিনি স্কুলের প্রভাষক পদেও উন্নীত হন। [১৯] ঠাট্টাচ্ছলে একটি কথা প্রচলিত ছিল যে মারি, "পিয়েরের সবচেয়ে বড় আবিষ্কার"[৯] ১৮৯৫ সালের ২৬ জুলাই সেকাউক্স (সেইনে)-এ তারা বিয়ে করেন;[২১] কেউই ধর্মীয় আচার ততটা পালন করেননি;[৭][১৯] মারি বিয়ের পোশাকের জায়গায় গাড় নীল পোশাক পড়েছিলেন যা পরবর্তীতে বহু বছরের জন্য তার গবেষণাগার পোশাক ছিল। [১৯] তারা দুধরনের অবসর উপভোগ করেছিলেন: দীর্ঘ বাইসাইকেল যাত্রা ও বিদেশ ভ্রমণ , যা তাঁদের আরও কাছে নিয়ে আসে [৯] পিয়েরের মধ্যে মারি খুঁজে পেয়েছিলেন নতুন ভালবাসা , জীবনসঙ্গী এবং একজন বৈজ্ঞানিক সহকর্মী যার উপর নির্ভর করা যায়। [৯]

নতুন মৌল

গবেষণাগারে পিয়েরে এবং মারি ক্যুরি

১৮৯৫ সালে উইলহেলম রন্টগেন্ট এক্স-রে আবিষ্কার করেন। তবে এগুলো কি কারণে তৈরি হয় তা তখনো অজানা ছিল। [২২] ১৮৯৬ সালে হেনরি বেকেরেল আবিষ্কার করেন যে ইউরেনিয়াম লবণ একধরনের রশ্মি নিঃসরণ করে যাদের কোন কিছু ভেদ করার ক্ষমতা এক্স-রশ্মির সমতুল্য। [২২] তিনি দেখান যে এই রশ্মিগুলো ফস্ফোরেসেন্সের মত নয়, বাইরের কোন শক্তির সাহায্য ছাড়াই স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে এরা নির্গত হয়। [৭]এই দুইটি আবিষ্কার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মারি ক্যুরি ইউরেনিয়াম রশ্মির উপর গবেষণা শুরু করেন। উদ্ধৃতি ত্রুটি: <ref> ট্যাগে অবৈধ প্যারামিটারতিনি নমুনা পরীক্ষার জন্য একটি নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। ঘটনার ১৫ বছর আগে তার স্বামী ও দেবর একটি উন্নত ইলেকট্রোমিটার তৈরি করেন যা বৈদ্যুতিক চার্জ পরিমাপ করতে পারত। [২২] সেই যন্ত্র ব্যবহার করে মারি আবিষ্কার করেন যে ইউরেনিয়াম রশ্মি একটি নমুনার আশেপাশের বাতাসে তড়ি চালনা করে। [২২] এই পদ্ধতি ব্যবহার করে তিনি প্রথম যে বিষয় বুঝতে পারেন তা হচ্ছেঃ ইউরেনিয়াম যৌগ সমূহের কার্যকলাপ শুধুমাত্র এতে উপস্থিত ইউরেনিয়ামের পরিমাণের উপর নির্ভর করে। [২২] তিনি হাইপোথিসিস দেন যে তেজস্ক্রিয় বিকিরণ একাধিক কণার সংঘর্ষের কারণ নয় বরং একটি পরমাণু নিজেই এর কারণ।[২২] প্রাচীন ধারণা অনুযায়ী অণু অদৃশ্য; এই ধারণা ভুল প্রমাণে তার হাইপোথিসিস গুরুত্বপূর্ণ ছিল। [২২][২৩]১৮৯৭ সালে তার মেয়ে আইরিন জন্ম নেয়। [১৭] আয় বাড়ানোর জন্য ক্যুরি একোল নরমাল সুপেরিয়রেশিক্ষকতা শুরু করেন। [১৭] ক্যুরিদের কোন নিজস্ব গবেষণাগার ছিল না; তাঁদের বেশিরভাগ গবেষণা সম্পন্ন করেছিলেন স্কুল অফ ফিজিক্স অ্যান্ড কেমিস্ট্রির এক জায়গায়। [১৭] সেটি মেডিক্যাল স্কুলের ব্যবচ্ছেদ রুম ছিল, পর্যাপ্ত আলো-বাতাস ছিল না এবং পানিরোধক ও ছিল না।[২৪] তেজস্ক্রিয়তার সংস্পর্শে থাকার ক্ষতিকর পরিণাম সম্পর্কে তখন অজ্ঞাত থাকায় তারা কোন নিরাপত্তা নিশ্চিত করেননি। স্কুল গবেষণার জন্য তাঁকে কোন অর্থ সহায়তা না দিলেও তিনি বিভিন্ন ধাতব সংক্রান্ত ও খনন সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠান ও সরকারি এবং বেসরকারি সংস্থার সাহায্য পেয়েছিলেন। [২৪][১৭][২৫]ক্যুরিদের গবেষণার বিষয়বস্তু ছিল দুইটি ইউরেনিয়াম খনিজ,পিচব্লেন্ডে এবং টরবারনাইট (যা চ্যালকোলাইট নামেও পরিচিত ছিল) [২৪] তার ইলেকট্রোমিটার দেখায় যে পিচব্লেন্ডে ইউরেনিয়ামের চারগুন এবং চ্যালকোলাইট দ্বিগুণ সক্রিয় ছিল। তিনি এই সিদ্ধান্তে আসেন যে ইউরেনিয়ামের পরিমাণের ভিত্তিতে সক্রিয়তা পরিমাপ সংক্রান্ত তার প্রথম ধারণা সঠিক হলে ঐ দুইটি খনিজ অল্প পরিমাণে এমন একটি বস্তু ধারণ করে যার সক্রিয়তা ইউরেনিয়ামের চেয়ে বেশি [২৪][২৬] তিনি তখন আরও কতগুলো মৌলের সন্ধান শুরু করেন যারা তেজস্ক্রিয়তা দেয় এবং ১৮৯৮ সালে আবিষ্কার করেন যে থোরিয়ামে এই ধর্ম আছে। [২২]পিয়েরে, মারির কাজে এতই আগ্রহী হয়ে ওঠেন যে ১৮৯৮ এর মাঝামাঝি সময়ে তিনি কেলাসের উপর গবেষণা ছেড়ে মারির গবেষণায় সাহায্য শুরু করেন। [১৭][২৪]

[গবেষণার] বুদ্ধি [writes Reid] তার নিজের ছিল; কেউ তাঁকে এটা করতে সাহায্য করেনি, এবং যদিও তিনি এই বিষয়ে তার স্বামীর মতামত চেয়েছিলেন, তিনি স্পষ্টভাবে নিজের মালিকানাই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পরবর্তীতে তিনি তার আত্মজীবনীতে তার স্বামীর বিষয়ে উল্লেখ করেছিলেন এবং দুইবার পরিষ্কার করেছিলেন যে এই বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। [এটা থেকে] বোঝা যায় যে নিজের কর্মজীবনের শুরুতেই [তিনি] বুঝতে পেরেছিলেন যে ... অসংখ্য বিজ্ঞানীর পক্ষে এটা বিশ্বাস করা কষ্টসাধ্য হবে যে একজন মহিলা সত্যি সত্যিই সেই কাজগুলো করতে সক্ষম যাতে তিনি নিয়োজিত ছিলেন। [২৭]

পিয়েরে, আইরিন, মারি ক্যুরি

মারি খুব দ্রুত তার গবেষণা প্রকাশ করে তার গুরুত্ব পরতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। যদি না বেকেরেল, তার আবিষ্কারকে উদ্ভাবনের পরের দিনই প্রকাশ না করে দুই বছর পর প্রকাশ করতেন অ্যাকাডেমি ডেস সাইন্সেস-এ তবে তেজস্ক্রিয়তা আবিষ্কারের কৃতিত্ব ও একটি নোবেল পুরস্কার চলে যেত সিলভেনাস থমসনের কাছে। ক্যুরিও একই দ্রুততায় আবিষ্কার প্রকাশ করেন। তার গবেষণা পত্রে তার কাজের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিয়ে ১৮৯৮ সালের ১২ এপ্রিল তার সাবেক অধ্যাপক গ্যাবরিয়েল লিপম্যানের সাহায্যে ‘’অ্যাকাডেমিতে’’ প্রকাশ করেন। [২৮] তারপরও, থমসন যেমন বেকেরেলের কাছে হেরে গিয়েছিলেন, তেমনি প্রতিযোগিতার দৌড়ে ক্যুরিও উল্লেখ করতে ভুলে গিয়েছিলেন যে থোরিয়ামও তেজস্ক্রিয় রশ্মি নির্গমন করে। দুই মাস আগে গারহার্ড কার্ল স্মিথ,বার্লিনে নিজের গবেষণা প্রকাশ করেছিলেন[২৯]সেই সময়ে পদার্থবিজ্ঞান জগতের কেউই খেয়াল করেননি যে ক্যুরি পিচব্লেন্ড এবং চ্যালকোলাইটের সক্রিয়তা যে ইউরেনিয়াম থেকে কত বেশি তা উল্লেখ করেছেনঃ "বিষয়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ, এবং এই বিশ্বাসের জন্ম দেয় যে এই খনিজগুলো সম্ভবত এমন একটি মৌল ধারণ করে যা ইউরেনিয়াম থেকে বেশি সক্রিয়" মারি পরবর্তীতে তার অনুভূতি সম্পর্কে মনে মনে ভাবতেন "এই হাইপোথিসিসকে যত দ্রুত সম্ভব যাচাই করার একটি প্রবল আকাঙ্ক্ষা( a passionate desire to verify this hypothesis as rapidly as possible.)" [২৯] ১৮৯৮ সালের ১৪ এপ্রিল ক্যুরিরা খুব আশাব্যঞ্জক ভাবে পিচব্লেন্ডের ১০০ গ্রামের একটি নমুনা পেয়েছিলেন এবং পেসল ও মর্টার দিয়ে একে চূর্ণ করেছিলেন। সেই সময়ে তারা ধারনাও করতে পারেননি তারা যা খুঁজছেন তা এত অল্প পরিমাণে রয়েছে যে তাঁদের পরবর্তীকালে এটার জন্য টনের পর টন খনিজ বিশ্লেষণ করতে হবে। [২৯]১৮৯৮ সালের জুলাই মাসে ক্যুরি এবং তার স্বামী যৌথভাবে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করে একটি মৌলের অস্তিত্ব ঘোষণা করেন যার নাম দেয়া হয় "পোলনিয়াম", ক্যুরির জন্মস্থান পোল্যান্ডের প্রতি সম্মান দেখিয়ে এই নাম দিয়েছিলেন, যা পরবর্তীতে আরও বিশ বছর তিনটি সাম্রাজ্যে বিভক্ত ছিল[৭] ঐ বছরেরই ২৬ ডিসেম্বরে ক্যুরিরা দ্বিতীয় একটি মৌলের অস্তিত্ব ঘোষণা করেন, তারা এর নাম দিয়েছিলেন "রেডিয়াম", এই শব্দের উপত্তি ল্যাটিন শব্দ ‘’রে’’ থেকে। [৩০][১৭][২৪] তাঁদের গবেষণা চালাতে চালাতেই তারা ‘’তেজস্ক্রিয়তা’’ শব্দটি প্রতিষ্ঠিত করেন। [৭]তাঁদের আবিষ্কারকে সন্দেহের ঊর্ধ্বে ওঠানোর জন্য তারা পোলনিয়াম এবং রেডিয়াম বিশুদ্ধ আকারে পাওয়ার চেষ্টা করেন। [২৪] পিচব্লেন্ড হচ্ছে একটি জটিল খনিজ; এর গঠন উপাদানগুলো রাসায়নিকভাবে বিশ্লেষণ করা খুবই কঠিন। পোলনিয়ামের আবিষ্কার এর চেয়ে সহজ ছিল; রাসায়নিক দিক থেকে এটি বিসমাথেরমত, এবং এটিই ছিল একমাত্র বিসমাথ সদৃশ ধাতু যা খনিতে পাওয়া যায়। [২৪] রেডিয়াম পাওয়া একটু বেশি কঠিন, রাসায়নিকভাবে এর সাথে বেরিয়ামের মিল রয়েছে এবং পিচব্লেন্ডে দুইটি উপাদানই রয়েছে। ১৮৯৮ সালের মধ্যে ক্যুরিরা রেডিয়ামের অস্তিত্ব পেয়েছিলেন, তবে বেরিয়াম মুক্ত অর্থা বিশুদ্ধ ও ব্যাপক পরিমাণে রেডিয়াম পেতে তখনো অনেক দেরি ছিল।[৩১] ক্যুরিরা রেডিয়াম লবণ বিশ্লেষণ করার মত দুঃসাধ্য কাজ শুরু করেন ব্যবকলনীয় কেলাসন প্রক্রিয়ায়। ১৯০২ সালে ১ টন পিচব্লেন্ড থেকে ১ গ্রামের ১০ ভাগের ১ ভাগ রেডিয়াম ক্লোরাইড পাওয়া গিয়েছিল। ১৯১০ সালে মারি ক্যুরি বিশুদ্ধ রেডিয়াম ধাতু লাভে সক্ষম হন। [২৪][৩২] তিনি কখনো বিশুদ্ধ পোলনিয়াম পাননি, যার অর্ধায়ু মাত্র ১৩৮ দিন অর্থা বিশুদ্ধ পোলনিয়াম পাওয়ার ১৩৮ দিন পর এর ভর মোট ভরের অর্ধেক হয়ে যায় এবং এই প্রক্রিয়া চলমান থাকে। [২৪]১৮৯৮ সাল থেকে ১৯০২ সালের মধ্যে ক্যুরিদ্বয় (পিয়েরে এবং মারি) একসাথে কিংবা এককভাবে ৩২টি বৈজ্ঞানিক পত্র প্রকাশ করেন যাদের একটি উল্লেখ ছিল যে রেডিয়ামের প্রভাবে রোগাক্রান্ত, টিউমার সৃষ্টিকারী কোষ সুস্থ কোষের চেয়ে তাড়াতাড়ি ধ্বংস হয়। [৩৩]১৯০০ সালে ক্যুরি একোল নরমাল সুপেরিয়র এর প্রথম ফ্যাকাল্টি সদস্য হন এবং তার স্বামী প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাকাল্টিতে যোগ দেন। [৩৪][৩৫] ১৯০২ সালে বাবা মারা যাওয়ার কারণে মারি পোল্যান্ড যান। [১৭]

পিয়েরে এবং মারি ক্যুরি,১৯০৩

১৯০৩ সালে গ্যাব্রিয়েল লিপম্যানের তত্ত্বাবধানে প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রী লাভ করেন। [১৭][৩৬] ঐ মাসেই ক্যুরি দম্পতি লন্ডনের রয়্যাল ইন্সটিটিউটে তেজস্ক্রিয়তার উপর ভাষণ দেয়ার জন্য আমন্ত্রণ পান।শুধুমাত্র নারী হওয়ার কারণে মারি ভাষণ দেয়ার অনুমতি পাননি। শুধু পিয়েরে বক্তব্য রাখেন। [৩৪] [৩৭] ক্যুরি দম্পতি তাঁদের আবিষ্কারের পেটেন্টকরে রাখেননি এবং এর ব্যবসায় বেড়ে চলা আয়ের খুব সামান্যই তারা পেয়েছিলেন।[৩৪][২৪]

নোবেল পুরস্কার

১৯০৩ সালে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির সময়কার ছবি

১৯০৩ সালের ডিসেম্বর মাসে রয়্যাল সুইডিশ অ্যাকাডেমি অফ সাইন্স হেনরি বেকেরেল কর্তৃক উদ্ভাবিত বিকিরণের উপর সমন্বিত গবেষণার স্বীকৃতি স্বরূপ পিয়েরে ক্যুরি, মারি ক্যুরি এবং হেনরি বেকেরেলকে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার প্রদান করে। [১৭] প্রথমে কমিটি শুধুমাত্র পিয়েরে এবং বেকেরেলকে স্বীকৃতি দিতে চেয়েছিল, কিন্তু কমিটির একজন সদস্য এবং নারী বিজ্ঞানীদের সমর্থক সুইডিশ গণিতবিদ ম্যাগ্নাস গোয়েস্তা মিত্তাগ-লেফফ্লের , পিয়েরেকে এই বিষয় সম্পর্কে অবহিত করেন এবং পিয়েরের অভিযোগের প্রেক্ষিতে মনোনয়নে মারির নাম যুক্ত করা হয়। [৩৮] মারি ক্যুরি ছিলেন নোবেল পুরস্কার প্রাপ্ত প্রথম মহিলা। [১৭]ক্যুরি এবং তার স্বামী পুরস্কার গ্রহণের জন্য স্টকহোম যেতে অস্বীকার করেন; তারা গবেষণায় অনেক বেশি ব্যস্ত ছিলেন সেই সময় এবং পিয়েরে, যিনি আবার লোক সমাগম পছন্দ করতেন না, সেই সময় অসুস্থ ছিলেন এবং অসুস্থতা বেড়েই চলেছিল।[৩৮][৩৭] যেহেতু নোবেল বিজয়ীদের একটি বক্তৃতা দিতেই হয়, তাই অবশেষে ১৯০৫ সালে তারা পুরস্কার গ্রহণের জন্য যাত্রা করেন। [৩৮] পুরস্কার হিসেবে প্রাপ্ত টাকা দিয়ে ক্যুরি দম্পতি নিজেদের প্রথম গবেষণাগার সহকারী রাখতে সক্ষম হন। [৩৮] নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তি এবং জেনেভা বিশ্ববিদ্যালয়থেকে পিয়েরে সেখানে যোগ দেয়ার প্রস্তাব করায় প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয় পিয়েরেকে প্রফেসরশীপ এবং পদার্থ অনুষদের চেয়ার প্রদান করে, যদিও তখনো ক্যুরি দম্পতিকে একটি যথার্থ গবেষণাগার দেয়া হয়নি। [১৭][৩৫][৩৪] পিয়েরের অভিযোগের পর প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয় একটি নতুন গবেষণাগার তৈরিতে রাজি হয়। কিন্তু এটি ১৯০৬ এর আগে তৈরি হওয়া সম্ভব ছিল না।[৩৮]১৯০৪ সালের ডিসেম্বর মাসে ক্যুরি দম্পতির দ্বিতীয় মেয়ে ইভের জন্ম হয়।[৩৮] তিনি পরে একজন পোলিশ গভারনেস নিয়োজিত করেন তার মেয়েদের পোলিশ ভাষা শেখানোর জন্য এবং তাদের পোল্যান্ডে ভ্রমণে নেয়ার জন্য। [৫]১৯০৬ সালের ১৯ এপ্রিল একটি সড়ক দুর্ঘটনায় পিয়ের নিহত হন। ভারী বৃষ্টির মধ্যে রু দাউফিন সড়ক দিয়ে হাঁটার সময় তিনি একটি ঘোড়ার গাড়ির নিচে চাপা পড়েন এবং মাথার অস্থি ভেঙ্গে জ্যায়।[১৭][৩৯] স্বামীর মৃত্যুতে ক্যুরি প্রচণ্ড আঘাত পান।[৪০] ১৯০৬ সালের ১৩ মে প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয় সিদ্ধান্ত নেয় যে তারা পিয়েরের জন্য যে চেয়ার সৃষ্টি করেছিলেন তা থাকবে এবং তারা মারিকে ঐ চেয়ার প্রস্তাব করেন। [৪০] পিয়েরেকে সম্মান দেখিয়ে একটি বিশ্বমানের গবেষণাগার তৈরির আশায় এই প্রস্তাব গ্রহণ করেন।[৪১][৪০] তিনি ছিলেন প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মহিলা অধ্যাপক।[১৭]প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি নতুন ল্যাবরেটরির সন্ধান তখনো জারি ছিল। পরবর্তী বছর গুলোতে ক্যুরি রেডিয়াম ইন্সটিটিউট পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন। (ইন্সটিটুট দে রেডিয়াম, এখন ক্যুরি ইন্সটিটিউট, ইন্সটিটুট ক্যুরি), একটি তেজস্ক্রিয়তা সংক্রান্ত গবেষণাগার যা তার জন্য তৈরি করেছিল পাস্তুর ইন্সটিটিউট এবং প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়[৪১] পাস্তুর ইন্সটিটিউটের পরিচালক পিয়েরে পল এমিল রক্স খুবই হতাশ ছিলেন প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর, যেহেতু তারা যথার্থ গবেষণাগারের ব্যবস্থা করেনি এবং তিনি ক্যুরিকে প্রস্তাব দেন যেন তিনি পাস্তুর ইন্সটিটিউটে চলে আসে। ১৯০৯ সালে তার উদ্যোগেই রেডিয়াম ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠিত হয়।[১৭][৪২] এসব ঘটনার পর এবং ক্যুরি বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করার হুমকি দেয়ার পরই প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয় নমনীয় হয়।[৪২]

প্রথমবারের মত সল্ভে কনফারেন্সে (১৯১১), ক্যুরি (বসা অবস্থায়, ডানদিক থেকে দ্বিতীয়) কথা বলছেন হেনরি পইঙ্কারের সাথে; দাঁড়ানো অবস্থায়, ডানদিক থেকে চতুর্থ ব্যক্তি রাদারফোর্ড; ডানদিক থেকে দ্বিতীয় হচ্ছেন, আইনস্টাইন; একদম ডানদিকে, পল ল্যাঙ্গেভিন

১৯১০ সালে ক্যুরি বিশুদ্ধ রেডিয়াম পৃথক করতে সক্ষম হন; তিনি তেজস্ক্রিয় বিকিরণ পরিমাপের একটি আন্তর্জাতিক এককও প্রতিষ্ঠা করেন যার নাম পরবর্তীতে মারি ও পিয়েরেকে সম্মান দেখিয়ে “curie” রাখা হয়।[৪১] তবে, ১৯১১ সালে ফ্রেঞ্চ অ্যাকাডেমি অফ সাইন্স এক[১৭] অথবা দুই ভোটের জন্য[৪৩] তাঁকে সদস্য হিসেবে নির্বাচিত করেননি। তার পরিবর্তে নির্বাচিত হন এডওয়ার্ড ব্র্যানলি, একজন আবিস্কারক যিনি গুগ্লিয়েমো মার্কোনীকে বেতার টেলিগ্রাফের উন্নয়নে সাহায্য করেন।[৪৪] এই ঘটনার অনেক বছর পরে মারির অধীনে ডক্টরেটকারী ছাত্রী মারগুরাইট পেরেই ঐ অ্যাকাডেমির একজন সদস্য নির্বাচিত হন। ফ্রান্সের একজন মহিলা বৈজ্ঞানিক হিসেবে সুনাম অর্জনের পরও ফ্রান্সের জনগণ তাঁকে ভিনদেশী ষড়যন্ত্রকারী মনে করত- একই ধরনের ধারণা পোষণের কারণে ড্রেইফাস কাণ্ড ঘটেছিল- এবং এই ধারণার কারণেই মিথ্যা অনুমান করা হয়েছিল যে ক্যুরি একজন ইহুদী[১৭][৪৩] ফ্রেঞ্চ অ্যাকাডেমি অফ সাইন্সের নির্বাচনের সময় ডানপন্থী গণমাধ্যম তাঁকে বিদেশী এবং নাস্তিক বলে কটাক্ষ করেছিল।[৪৩] পরবর্তী সময়ে তার মেয়ে জনগণের দুমুখো নীতির সমালোচনা করেছিলেন কারণ যখন মারি কোন ফরাসি সম্মাননার জন্য মনোনীত হতেন তখন গণমাধ্যম তাঁকে অযোগ্য বিদেশী হিসেবে উপস্থাপন করত আর যখন কোন আন্তর্জাতিক সম্মাননা যেমন নোবেল পুরস্কার পেতেন তখন তাঁকে ফ্রান্সের গর্ব হিসেবে উপস্থাপন করত।[১৭]১৯১১ সালে প্রকাশিত হয় যে ১৯১০-১১ সালে একবছর সময় ধরে মারি ক্যুরির সাথে পদার্থবিদ পল ল্যাঙ্গেভিনের সম্পর্ক ছিল।[৪৩][৪৫] এটি ব্যপকভাবে গণমাধ্যমে প্রচারিত হয় এবং তার বিরোধীরা এর সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করে।[৪৬] এই ঘটনা যখন জানাজানি হয়ে যায় তখন ক্যুরি বেলজিয়ামে একটি সম্মেলনে অংশ নিয়েছিলেন। দেশে ফেরার পর তিনি তার বাসার সামনে ব্যাপক সংখ্যক উত্তেজিত জনতার ভিড় দেখতে পান এবং তার মেয়ের বাসায় আশ্রয় নিতে বাধ্য হন।[৪৩]

১৯১১ নোবেল পুরস্কার ডিপ্লোমা

তার বৈজ্ঞানিক কর্মকাণ্ডের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি একটি নতুন উচ্চতায় চলে গিয়েছিল এবং যাবতীয় বিরোধিতা প্রত্যাখ্যান করে ১৯১১ সালে রসায়নে নোবেল পুরস্কার দেয়ার মাধ্যমে রয়্যাল সুইডিশ অ্যাকাডেমি অফ সাইন্স তাঁকে দ্বিতীয়বারের মত সম্মানিত করে।[৯] "রেডিয়াম ও পোলনিয়াম আবিষ্কার, রেডিয়াম পৃথকীকরণ এবং এইরকম অসাধারণ উপাদানের প্রকৃতি ও এদের যৌগের উপর গবেষণার মাধ্যমে রসায়নশাস্ত্রের উন্নয়ন ঘটানোর স্বীকৃতিস্বরূপ" তাঁকে এই সম্মাননা দেয়া হয়।[৪৭] তিনি দুইটি নোবেল পুরস্কার অর্জনকারী প্রথম নারী এবং শুধুমাত্র তিনি ও লিনাস পলিং একাধিক ক্ষেত্রে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। ঔপন্যাসিক হেনরিক সিএঙ্কিভিজের নেতৃত্বে একটি পোলিশ প্রতিনিধি দল তাঁকে পোল্যান্ডে ফিরে এসে নিজ দেশে গবেষণা কার্যক্রম চালাতে অনুরোধ করে।[৯] ক্যুরির দ্বিতীয়ও নোবেল পুরস্কার অর্জন তাঁকে ফরাসি সরকারকে রেডিয়াম ইন্সটিটিউট তৈরিতে সহযোগিতা করতে রাজি করাতে সক্ষম করে তোলে; যেখানে রসায়ন, পদার্থ ও মেডিসিনের উপর গবেষণা হত।[৪২] ১৯১১ সালে নোবেল পুরস্কার অর্জনের কিছু সময় পরেই হতাশা এবং বৃক্কে অসুস্থতা জনিত কারণে তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।[৪৭] ১৯১২ সালের অধিকাংশ সময়ই তিনি জনসম্মুখে আসা থেকে বিরত ছিলেন তবে তার বান্ধবী ও সহকর্মী পদার্থবিদ হারথা আয়রটনের সাথে কিছু সময় ইংল্যান্ডে অতিবাহিত করেছেন।[৪৭] ১৪ মাস বিরতির পর অবশেষে ডিসেম্বর মাসে তিনি গবেষণাগারে ফিরে আসেন।[৪৭]১৯১২ সালে ওয়ার্স সাইন্টিফিক সোসাইটি তাঁকে ওয়ার্সতে একটি নতুন গবেষণাগারের পরিচালকের পদে আসীন হওয়ার প্রস্তাব দেয়। কিন্তু রেডিয়াম ইন্সটিটিউটের উন্নয়ন যা শেষ হতে ১৯১৪ সালের আগস্ট পর্যন্ত সময় লেগেছিল এবং রু পিয়েরে-ক্যুরি নামে একটি নতুন সড়ক তৈরির পরিকল্পনায় ব্যস্ত থাকায় তিনি ঐ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন।[৪২][৪৭] তিনি ১৯১৩ সালে পোল্যান্ড ভ্রমণে আসেন এবং ওয়ার্স তাঁকে স্বাগতম জানায় কিন্তু রাশিয়ান কর্তৃপক্ষ তার ভ্রমণকে অবহেলার চোখে দেখে।[৪২] একটি যুদ্ধ আসন্ন ছিল বিধায় অধিকাংশ গবেষককে ফরাসি সৈন্যে অন্তর্ভুক্ত করায় রেডিয়াম ইন্সটিটিউটের উন্নয়নে ব্যাঘাত ঘটে। ১৯১৯ সালে এর কার্যক্রম পুরোদমে চালু হয়।[৪২][৪৭][৪৮]

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ

একটি ভ্রাম্যমাণ এক্স-রে যানে ক্যুরি

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ক্যুরি বুঝতে পারেন যে যুদ্ধক্ষেত্রে সার্জনদের সাহায্য করার জন্য যুদ্ধস্থলের কাছাকাছি ফিল্ড রেডিওলজিকাল সেন্টার স্থাপন করা প্রয়োজন।[৪৮] রেডিওলজি, অঙ্গসংস্থানবিদ্যা এবং স্বয়ংক্রিয় বলবিদ্যার উপর দ্রুত অধ্যয়নের পর তিনি এক্স-রে যন্ত্র, যানবাহন, সহায়ক জেনারেটর যোগাড় করেন এবং ভ্রাম্যমাণ রেডিওগ্রাফি ইউনিটের উন্নয়ন করেন যেগুলো পরবর্তীতে পেটিটস ক্যুরিস ("ছোট ক্যুরিগুলো") নামে জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।[৪৮] তিনি রেড ক্রস রেডিওলজি সার্ভিসের পরিচালক পদে আসীন হন এবং ফ্রান্সের প্রথম সামরিক রেডিওলজি সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেন যা ১৯১৪ সালের শেষভাগ থেকে কাজ শুরু করে।[৪৮] প্রথমে একজন সামরিক চিকিৎসক এবং তার ১৭ বছর বয়সী মেয়ে আইরিনের সহায়তায় যুদ্ধের প্রথম বছরে ক্যুরি ২০ টি ভ্রাম্যমাণ রেডিওলজিকাল যা এবং মাঠ হাসপাতালগুলোতে ২০০ রেডিওলজিকাল ইউনিট স্থাপনের কাজ পরিচালনা করেন।[৪২][৪৮] পরবর্তীতে, তিনি অন্যান্য মহিলাদের এই কাজে সহায়তা করার সক্ষমতা লাভের প্রশিক্ষণ দেন।[৪৯]

১৯১৫ সালে ক্যুরি ছিদ্রযুক্ত সূচ তৈরি করেছিলেন যাতে ‘রেডিয়াম নিঃসৃত পদার্থ’ ছিল, যা পরবর্তীতে রেডন হিসেবে শনাক্ত হয়। রেডিয়াম থেকে প্রাপ্ত এই বর্ণহীন তেজস্ক্রিয় গ্যাস আক্রান্ত মানব টিস্যু জীবাণুমুক্ত করতে ব্যবহার হত।[৪৯] ক্যুরি তার নিজের কাজের জন্য পাওয়া এক-গ্রাম রেডিয়াম থেকে এই পদার্থের ব্যবস্থা করতেন।[৪৯] ধারণা করা হয় যে দশ লক্ষেরও বেশি যুদ্ধাহত সৈনিকদের চিকিৎসা করা হয়েছিল তার এক্স-রে ইউনিটে।[১৩][৪২] এই কাজে ব্যস্ত থাকায় এসময় তিনি অল্পসময়ই নিজের বৈজ্ঞানিক গবেষণায় ব্যয় করতে পেরেছিলেন।[৪২] ফ্রান্সের যুদ্ধে তার মানবতাবাদী ভূমিকা সত্ত্বেও তিনি ফ্রান্সের সরকারের কাছ থেকে কোন আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পাননি।[৪৮]

এছাড়াও যুদ্ধ শুরুর সাথে সাথে তিনি তার নোবেল পুরস্কার দান করতে প্রস্তুত হয়ে যান কিন্তু ফ্রান্সের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সেগুলো গ্রহণে অপারগতা প্রকাশ করে। [৪৯] তবে নোবেল পুরস্কার থেকে প্রাপ্ত টাকা দিয়ে তিনি ওয়ার বন্ডস কিনেছিলেন।[৪৯] এছাড়া তিনি পোলিশদের স্বার্থরক্ষায় নিয়োজিতো পোলনিয়া ইন ফ্রান্সের একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন।[৫০] যুদ্ধের পর “যুদ্ধে তেজস্ক্রিয়তা(Radiology in War)” (১৯১৯) নামক গ্রন্থে তিনি যুদ্ধকালীন সময়ে তার অভিজ্ঞতার সারমর্ম তুলে ধরেন।[৪৯]

যুদ্ধপরবর্তী সময়

১৯২০ সালে রেডিয়াম আবিষ্কারের ২৫ বছরপূর্তি উপলক্ষে ফরাসি সরকার মারি ক্যুরির জন্য একটি বৃত্তি ঘোষণা করেন; এর পূর্ববর্তী প্রাপক ছিলেন লুই পাস্তুর (১৮২২-৯৫)।[৪২] ১৯২১ সালে রেডিয়ামের উপর গবেষণার জন্য অর্থ সংগ্রহের জন্য যুক্তরাষ্ট্র গমন করেন এবং উষ্ণ অভ্যর্থনা লাভ করেন। মিসেস উইলিয়াম ব্রাউন মেলনি, মারি ক্যুরির সাক্ষাৎকার নেয়ার পর মারি ক্যুরি রেডিয়াম ফান্ড প্রতিষ্ঠা করেন এবং প্রচারণা চালিয়ে রেডিয়াম কেনার জন্য অর্থ সংগ্রহ করেন।[৪২][৫১] ১৯২১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি ওয়ারেন জি. হার্ডিং মারি ক্যুরিকে হোয়াইট হাউজ অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রের সংসদে যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক সংগ্রহকৃত ১ গ্রাম রেডিয়াম উপহার দেন।[৫২][৫৩] এই সাক্ষাতের পূর্বে বিদেশে তার বেড়ে চলা খ্যাতি সম্পর্কে অবগত হয়ে এবং জনসম্মুখে প্রকাশের জন্য তার কোন রাষ্ট্রীয় উপাধি নেই দেখে বিব্রত হয়ে ফরাসি সরকার তাঁকে লিজিয়ন অব অনার প্রদান করতে চায় কিন্তু তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন।[৫৩][৫৪] ১৯২২ সালে তিনি ফ্রেঞ্চ একাডেমী অফ মেডিসিন-এর একজন ফেলো নির্বাচিত হন।[৪২] তিনি অন্যান্য দেশেও ভ্রমণ করেন, বেলজিয়াম, ব্রাজিল, স্পেন এবং চেকোস্লোভাকিয়া গমন করে তিনি জনসম্মুখে বৈজ্ঞানিক বিষয় আলোচনা (লেকচার) করেন।[৫৫]

নোবেল বিজয়ী ক্যুরির নেতৃত্বে পরিচালিত এই ইন্সটিটিউটটি আরও চারজন নোবেল বিজয়ীর উদ্ভব ঘটায়, যাঁদের মধ্যে ছিলেন তার মেয়ে আইরিন ক্যুরি এবং মেয়ের জামাই ফ্রেডরিক ক্যুরি[৫৬] পরবর্তীকালে এটি প্রধান চারটি তেজস্ক্রিয় গবেষণাগারের একটি হিসেবে গণ্য হয়। বাকি তিনটি হচ্ছে ক্যাভেন্ডিস গবেষণাগার, ( দায়িত্বে আর্নেস্ট রাদারফোর্ড); ইন্সটিটিউট ফর রেডিয়াম রিসার্চ,ভিয়েনা, (দায়িত্বে স্টিফান মেয়ার); ম্যাক্স প্লাঙ্ক ইন্সটিটিউট ফর কেমিস্ট্রি, (দায়িত্বে অটো হ্যান এবং লিজে মাইটনার)[৫৬][৫৭]

১৯২২ সালের আগস্ট মাসে মারি ক্যুরি সদ্য প্রতিষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল কমিশন ফর ইন্টেলেকচুয়াল কোঅপারেশনের (লীগ অব ন্যাশন্সের প্রতিষ্ঠান) সদস্য হন।[৫৮] ১৯২৩ সালে তিনি পিয়েরের জীবনীর উপর “পিয়েরে ক্যুরি” শিরোনামে একটি গ্রন্থ লিখেন।[৫৯] ১৯২৫ সালে ক্যুরি ইন্সটিটিউট, ওয়ার্স এর ভিত্তি স্থাপন উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পোল্যান্ড যান।[৪২] তার দ্বিতীয়বারের মত আমেরিকা সফরে তিনি এই ইন্সটিটিউটের যন্ত্রপাতি সংগ্রহে সক্ষম হন। এটি ১৯৩২ সালে চালু হয় এবং তার বোন ব্রোনিস্লাও এর পরিচালক হন। [৪২][৫৩] এধরনের কর্মকাণ্ড তার গবেষণাকার্যে বিঘ্ন ঘটালেও তার গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির ব্যবস্থা করে।[৫৩] ১৯৩০ সালে তিনি আন্তর্জাতিক পারমাণবিক ওজন কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সেখানে কর্মরত ছিলেন।[৬০]

মৃত্যু

রেডিয়াম ইন্সটিটিউটের দিকে মুখ করে থাকা ১৯৩৫ সালে নির্মিত ভাস্কর্য, ওয়ার্স

ক্যুরি ১৯৩৪ সালে শেষবারের মত পোল্যান্ড যান।[৯][৬১] এর অল্প কয়েক মাস পরে, ১৯৩৪ সালের ৪ জুলাই তারিখে হাউতে-সাভই এর প্যাজ্জি এর সাঞ্চেল্লেমজ স্যানাটরিয়ামে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি অবর্ধক রক্তশূন্যতায় আক্রান্ত হয়েছিলেন; ধারণা করা হয় দীর্ঘদিন দীর্ঘক্ষণ তেজস্ক্রিয়তার সংস্পর্শে থাকায় তিনি এই রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন।[৪২][৬২] আয়নায়ন তেজস্ক্রিয়তার ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে তার আমলে জানা যায়নি। পরবর্তী সময়ে নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নতির মাধ্যমে এই সংক্রান্ত কাজ পরিচালিত হচ্ছে।[৬১] তিনি তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ বিশিষ্ট পরীক্ষা নল (টেস্টটিউব) তার কাপড়ের পকেটে বহন করতেন,[৬৩] এবং ওগুলো তার ডেস্কের ড্রয়ারে সংরক্ষণ করতেন, অনুজ্জ্বল আলোর উপর নির্ভর করে যা অন্ধকারে বস্তুগুলো থেকে নির্গত হয়।[৬৪] যুদ্ধের সময়ে মাঠ হাসপাতালে তেজস্ক্রিয়তাবিদ হিসেবে কর্মরত অবস্থায় ক্যুরি উন্মুক্ত যন্ত্র থেকে আগত এক্স-রশ্মির সংস্পর্শেও এসেছিলেন। [৪৯] যদিও তিনি দশকের পর দশক তেজস্ক্রিয়তার সংস্পর্শে এসে বেশকিছু অন্তহীন রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন ( যার মধ্যে ছিল ক্যাটারাক্ট জনিত কারণে প্রায় অন্ধ হওয়া) এবং এক পর্যায়ে মৃত্যুও বরণ করেছিলেন, তিনি কখনো তেজস্ক্রিয়তার সংস্পর্শে আসার স্বাস্থ্য ঝুঁকি বুঝতে পারেন নি।[৬৫]

তাঁকে সেকাউক্সের সমাধিস্থলে তার জামাই পিয়েরের পাশে সমাহিত করা হয়।[৪২] ৬০ বছর পর, ১৯৯৫ সালে তাঁদের অবদানকে সম্মান জানানোর অংশ হিসেবে উভয়ের দেহাবশেষ প্যান্থিওনে স্থানান্তর করা হয়। তিনি হয়ে যান প্রথম- এবং এখন পর্যন্ত একমাত্র নারী যিনি নিজ যোগ্যতার ভিত্তিতে প্যান্থিওনে সমাহিত হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেন।[৫৮]

তেজস্ক্রিয় দূষণের মাত্রার জন্য তার যতগুলো গবেষণা পত্র ১৮৯০ সাল থেকে ছিল সেগুলো নাড়াচাড়া করা অত্যন্ত বিপজ্জনক মনে করা হয়।[৬৬] এমনকি তার রান্নার বইও উচ্চ মাত্রায় তেজস্ক্রিয়।[৬৬] তার গবেষণা পত্রগুলো সীসা-ঘেরা বাক্সে রাখা হয়েছে, এবং যারা সেগুলো পর্যবেক্ষণ করতে যাবেন তাঁদের অবশ্যই নিরাপদ কাপড় পরিধান করতে হবে।[৬৬]

জীবনের সর্বশেষ বছরে তিনি একটি বই লিখার কাজ করেছিলেন, তেজস্ক্রিয়তা, যা ১৯৩৫ সালে তার মৃত্যুর পরপরই প্রকাশ করা হয়।[৬১]

প্রভাব

প্রতিকৃতি, মারি ক্যুরি-স্ক্লদভস্কা বিশ্ববিদ্যালয়, লুবলিন, পোল্যান্ড

বিংশ এবং একবিংশ শতাব্দীর অবয়ব নির্মাণে ক্যুরির কাজগুলো সামাজিক ক্ষেত্রে দৃশ্যমান প্রভাব ফেলেছে।[৬৭] কর্নেল ইউনিভার্সিটি এর প্রভাষক এল. পিয়ার্স উইলিয়ামস এর মতে :

ক্যুরির গবেষণা কর্মের প্রভাব ছিল যুগান্তকারী। রেডিয়ামের তেজস্ক্রিয়তা এতটাই স্পষ্ট ছিল যে তা অবহেলা করা সম্ভব হয়নি। এটি শক্তির সংরক্ষনশীলতা নীতির বিরুদ্ধে যাচ্ছিল বলে বিজ্ঞানীদের মনে হতে থাকে যার ফলে তারা পদার্থবিজ্ঞানের মৌলিক ভিত্তি পুনরায় পর্যালোচনা করতে বাধ্য হন। রেডিয়ামের তেজস্ক্রিয়তা আবিষ্কারের ফলে গবেষণা ক্ষেত্রে রাদারফোর্ড-এর মত বিজ্ঞানীরা পরমাণুর গঠন শনাক্ত করতে তেজস্ক্রিয় রশ্মির উৎস খুঁজে পান। রাদারফোর্ডের আলফা কণা বিচ্ছুরণ পরীক্ষার ফলস্বরূপ প্রথমবারের মত পরমাণু নিউক্লিউয়াসের ধারণা পাওয়া যায়। মেডিসিনে দেখা যায় যে রেডিয়ামের তেজস্ক্রিয়তার মাধ্যমে ক্যান্সারকে আক্রমণ করার উপায় আছে।[৩২]

ক্যুরির কাজ শুধু পদার্থ ও রসায়নের মত বিষয়কেই প্রভাবিত করেনি, সামাজিক প্রভাব ও ছিল। তার বৈজ্ঞানিক কর্মকাণ্ডের সফলতা প্রাপ্তির জন্য তাঁকে এমন সমস্ত বাঁধার মোকাবেলা করতে হয়েছে যার কারণ ছিল তিনি একজন নারী ছিলেন। তার জীবন ও কর্মকাণ্ডের এই অংশটি উঠে এসেছে ফ্রাঙ্কোনাইজ গিরৌড-এর Marie Curie: A Life-এ যেখানে মারি ক্যুরির নারীবাদী চরিত্রে জোর দেয়া হয়েছে।[৯]

তিনি তার সততা ও সুশৃঙ্খল জীবনাচরণের জন্য বিখ্যাত ছিলেন। [১৭][৬৭] ১৮৯৩ সালে তিনি একটি ছোট বৃত্তি পান যা তিনি ১৮৯৭ সালে নিজ যোগ্যতায় অর্থ উপার্জনের সাথে সাথে ফিরিয়ে দেন। [৭][২৫] তার প্রথম নোবেল পুরস্কারের সাথে প্রাপ্ত অর্থের অনেকটাই তিনি তার বন্ধু-বান্ধব, পরিবার, শিক্ষার্থী এবং গবেষণা সহকারীদের দেন।[৯] ক্যুরি রেডিয়াম পৃথক করার পদ্ধতিটি পেটেন্ট না করার একটি চমৎকার সিদ্ধান্ত নেন যাতে বৈজ্ঞানিক মহলগুলো বাধাহীনভাবে গবেষণা চালাতে পারে।[৬৮] তিনি আরও চেয়েছিলেন যে অর্থ সহায়তা ও পুরস্কার তাঁকে না দিয়ে তিনি যে সমস্ত বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠানে যুক্ত ছিলেন সেগুলোকে দেয়া হোক। [৬৭] তিনি এবং তার স্বামী প্রায়শই পুরস্কার ও পদক নিতে অনীহা প্রকাশ করতেন।[১৭] বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন এসবের ভিত্তিতে তার সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন যে তিনিই সম্ভবত একমাত্র ব্যক্তি যাকে খ্যাতি দ্বারা দুর্নীতিপরায়ণ করা যাবে না।[৯]

পদক, সম্মাননা ও শ্রদ্ধা

প্যান্থিওন, প্যারিসে পিয়েরে এবং মারি ক্যুরির সমাধি

স্মরণকালের সবচেয়ে জনপ্রিয় নারী বৈজ্ঞানিক হিসেবে মারি ক্যুরি বৈজ্ঞানিক জগতের একজন আদর্শ এবং সারা বিশ্বে তিনি সম্মানিত হয়েছেন, এমনকি জনসংস্কৃতি থেকেও।[৬৯] নিউ সায়েন্টিস্ট কর্তৃক ২০০৯ সালে পরিচালিত একটি ভোটে ক্যুরি “বিজ্ঞানে সর্বাধিক উজ্জীবিতকারী নারী" নির্বাচিত হন। ক্যুরি মোট ভোটের ২৫.১ শতাংশ লাভ করেন যা দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা রোজালিন্ড ফ্রাঙ্কলিনের প্রাপ্ত ভোটের (১৪.২ শতাংশ) প্রায় দ্বিগুণ[৭০][৭১]

পোল্যান্ড এবং ফ্রান্স ২০১১ সালকে মারি ক্যুরির বর্ষ ঘোষণা করেন এবং জাতিসংঘ একে রসায়নের আন্তর্জাতিক বর্ষ ঘোষণা করেন। [৭২] স্যান ডিয়েগোর মিউজিয়াম অফ কনটেম্পোরারি আর্টের জ্যাকব গ্যালারী ‘’মাদাম ক্যুরি’’ পালন করতে বর্ণিল সাজে সেজেছিল। [৭৩] ৭ নভেম্বর তার জন্মদিনে গুগল একটি বিশেষ Google Doodle দিয়ে তার জন্মদিন উদ্‌যাপন করে।[৭৪] ১০ ডিসেম্বরে সুইডেনের রাজকন্যা মেডেলিনের উপস্থিতিতে নিউইয়র্ক একাডেমী অফ সাইন্স মারি ক্যুরির দ্বিতীয় নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির শততম বার্ষিকী উদ্‌যাপন করেন।[৭৫]

মারি ক্যুরি নোবেল বিজয়ী প্রথম নারী, দুইটি নোবেল বিজয়ী প্রথম ব্যক্তি, দুইটি ক্ষেত্রে নোবেল জয়ী একমাত্র নারী এবং একমাত্র ব্যক্তি যিনি বিজ্ঞানের ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ে নোবেল পেয়েছেন [৭৬] তিনি যেসমস্ত পুরস্কার পেয়েছেন:

সোভিয়েত ডাকটিকিট (১৯৮৭)
  • ফ্রাঙ্কলিন মেডেল, আমেরিকান ফিলোসফিকাল সোসাইটি (১৯২১)[৮০]

১৯৯৫ সালে নিজ যোগ্যতার ভিত্তিতে প্রথম নারী হিসেবে তিনি প্যান্থিওন, প্যারিসে সমাধি লাভ করেন।[৫৮] ক্যুরি (প্রতীক Ci) নামক তেজস্ক্রিয়তার একক তার এবং পিয়েরের সম্মানে রাখা হয়েছে (যদিও নামকরণ প্রদানকারী কমিশন কখনও পরিষ্কার করেনি যে এই নামকরণ পিয়েরে কিংবা মারি কিংবা দুইজনের সম্মানে করা হয়েছে কিনা)।[৮১] ৯৬ পারমাণবিক সংখ্যা বিশিষ্ট মৌলের নামকরণ করা হয়েছিল কুরিয়াম[৮২] ক্যুরিদের নামে তিনটি তেজস্ক্রিয় খনিজ ও নামকরণ করা হয়েছে: কুরাইট, স্ক্লদভস্কাইট এবং কুপ্রোস্ক্লদভস্কাইট।[৮৩] তিনি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেশকিছু অনারারি ডিগ্রী লাভ করেছেন।[৫৩] ইউরোপীয় ইউনিয়নের মারি ক্যুরি একশনস প্রবাসে কাজ করতে আগ্রহী তরুণ বিজ্ঞানীদের ফেলোশিপ প্রোগ্রাম।[৮৪] তিনি পজনান বিশ্ববিদ্যালয় (১৯২২), কারকর জাগিয়েল্লোনিয়ান বিশ্ববিদ্যালয় (১৯২৪) এবং ওয়ার্স পলিটেকনিক (১৯২৬) থেকে অনারারি ডক্টরেট লাভ করেন।[৭২] তার অসাধারণ অবদানের জন্য তিনি ১৯২১ সালে আইওটা সিগমা পাই জাতীয় অনারারি সদস্যে ভূষিত হন।[৮৫]

বিশ্বের বিভিন্ন স্থান তার নামে নামকরণ করা হয়েছে। [৮৩] ২০০৭ সালে দুই ক্যুরির সম্মানে প্যারিসে একটি মেট্রোর নাম পরিবর্তন করে তাদের নামে রাখা হয়েছিল।[৮৩] পোলিশ নিউক্লিয়ার রিসার্চ রিএক্টর মারিয়া তার নামে রাখা হয়েছে।[৮৬] ৭০০০ ক্যুরি গ্রহাণুটি তার নামে নামকরণ করা হয়েছে।[৮৩] একটি কেএলএম ম্যাকডোনেল ডগলাস এমডি-১১ এর নাম (নিবন্ধন পিএইচ-কেসিসি) তার নামে রাখা হয়েছে।[৮৭]

২০১১ সালে দ্বিতীয় নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির শতবর্ষ পূর্তিতে মারি ক্যুরির জন্মস্থানে দেয়ালচিত্র।

বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান তার নামে রাখা হয়েছে, যার শুরু দুইটি ইন্সটিটিউট দিয়ে– ওয়ার্সর মারিয়া স্ক্লদভস্কা-ক্যুরি ইন্সটিটিউট অফ অঙ্কলজি এবং প্যারিসের ইন্সটিটুট ক্যুরি। তিনি ফ্রান্সের অন্যতম বিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয় পিয়েরে অ্যান্ড মারি ক্যুরি ইউনিভার্সিটি (প্যারিস ৬) এবং ১৯৪৪ সালে লুবলিনে প্রতিষ্ঠিত মারি ক্যুরি-স্ক্লদভস্কা ইউনিভার্সিটিকে সহযোগিতা দিয়েছিলেন। ১৯৪৮ সালে ব্রিটেনে অসুস্থতার শেষ সীমার রোগীদের জন্য মারি ক্যুরি ক্যান্সার কেয়ার আয়োজন করা হয়। মারি ক্যুরিকে উৎসর্গ করে ২টি জাদুঘর আছে। ১৯৬৭ সালে ওয়ার্সর "নিউ টাউনে" উলিকা ফ্রেটা (ফ্রেটা সড়ক) অর্থাৎ মারি ক্যুরির জন্মস্থানে মারিয়া স্ক্লদভস্কা-ক্যুরি মিউজিয়াম প্রতিষ্ঠা করা হয়।[৯] প্যারিসে তার গবেষণাগারটি মিউজি ক্যুরি হিসেবে সংরক্ষিত যা ১৯৯২ সালে উন্মুক্ত করা হয়।[৮৮]

তার প্রতিকৃতি হিসেবে অনেক চিত্রকর্ম তৈরি করা হয়েছে। ১৯৩৫ সালে পোলিশ প্রেসিডেন্ট ইগান্সি মজচিকের স্ত্রী মিচালিনা মজচিকা ওয়ার্সর রেডিয়াম ইন্সটিটিউটের সামনে মারি ক্যুরির একটি প্রতিকৃতি বা মূর্তি উন্মুক্ত করেন।[৯] ১৯৪৪ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে নাৎসি জার্মানিদের বিরুদ্ধে ওয়ার্স জাগরণ ঘটে এবং গোলাগুলিতে প্রতিকৃতিটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যুদ্ধের পর প্রতিকৃতি ও এর পাদস্তম্ভে গুলির চিহ্ন রেখে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।[৯] ১৯৫৫ সালে জোযেফ মাজুর কাচ দিয়ে মারি ক্যুরির প্রতিকৃতি মারিয়া স্ক্লদভস্কা-ক্যুরি মেডালিয়ন নির্মাণ করেন যা ইউনিভার্সিটি অফ বুফালোর পোলিশ রুমের বিশেষ আকর্ষণ।[৮৯]

তাকে উৎসর্গ করে বেশকিছু জীবনী লেখা হয়। ১৯৩৮ সালে তার মেয়ে ইভ ক্যুরি মাদাম ক্যুরি প্রকাশ করেন।[৭২] ১৯৮৭ সালে ফ্রাঙ্কইজ গিরৌড লিখেন মারি ক্যুরি: আ লাইফ[৭২] ২০০৫ সালে বারবারা গোল্ডস্মিথ লিখেন অবসেসিভ জিনিয়াস: দ্য ইনার ওয়ার্ল্ড অফ মারি ক্যুরি [৭২] ২০১১ সালে লরেন রেডনিজ প্রকাশ করেন রেডিওএকটিভ: মারি এবং পিয়েরে ক্যুরি, এ টেল অফ লাভ অ্যান্ড ফলআউট[৯০]

১৯৪৩ সালে গ্রির গারসন এবং ওয়াল্টার পিজন অস্কারের জন্য মনোনীত আমেরিকান চলচ্চিত্র মাদাম ক্যুরি (চলচ্চিত্র)-তে অভিনয় করেন।[৫৯] সাম্প্রতিককালে ১৯৯৭ সালে পিয়েরে ও মারি ক্যুরির উপর একটি ফরাসি চলচ্চিত্র উন্মুক্ত করা হয় যার নাম লেস পামেস ডি এম. সুতজ। এটি একই নামে একটি লিখিত একটি নাট্যগ্রন্থের উপর রচিত। এখানে ইসাবেলে হাপার্ট মারি ক্যুরির ভূমিকা পালন করেন।[৯১]

লরেন্স আরনোভিচের ‘’ফলস এজাম্পসন্স’’ নাটকে মারি ক্যুরির ভূমিকা দেখা যায়, যেখানে অন্য তিন মহিলা বিজ্ঞানীর ভূত তার জীবনের ঘটনাবলী পর্যবেক্ষণ করে।[৯২] সুসান মারি ফ্রন্তচজাক তার এক-নারীর নাটক মানিয়া: দ্য লিভিং হিস্টোরি অফ মারি ক্যুরি-এ মারি ক্যুরিকে উপস্থাপন করেন যা ২০১৪ সাল নাগাদ যুক্তরাষ্ট্রের ৩০টি রাজ্য ও নয়টি দেশে প্রদর্শন করা হয়।[৯৩]

বিশ্বজুড়ে বিল, ডাকটিকিট এবং মুদ্রায় ক্যুরির ছবি দেখা গেছে। [৮৩] পোল্যান্ডে ১৯৮০ পরবর্তী সময়ের ব্যাংকনোট জিটটিতে মারি ক্যুরির ছবি দেখা গিয়েছিল[৯৪] এমনকি ইউরো প্রচলনের পূর্বে ফ্রান্সের সর্বশেষ ৫০০-ফ্রাংক নোটে ক্যুরির ছবি ছিল। [৯৫] দারুণ বিষয় হল মালি, টোগো প্রজাতন্ত্র, জাম্বিয়া, এবং গিনি প্রজাতন্ত্রে ডাকটিকিটে পল স্ক্রোডার পরিচালিত ২০০১ সালের ছবিতে সুসান মারি ফ্রন্তচজাকের মারি ক্যুরির ভুমিকায় অভিনয়ের দৃশ্য দেখা যায়।[৯৩]

২০১১ সালে মারি ক্যুরির দ্বিতীয় নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির শতবর্ষ পূর্তিতে ওয়ার্সতে তার জন্মস্থানের সদর দরজায় একটি রূপক (বা প্রতীকী) দেয়ালচিত্র দেখা যায়। এতে দেখা যায় শিশু মারিয়া স্ক্লদভস্কা ক্যুরি একটি টেস্টটিউব ধরে ছিলেন যা থেকে দুইটি পদার্থ নির্গত হচ্ছিল যেগুলো তার প্রাপ্তবয়স্কে আবিষ্কারের কথা: পোলোনিয়াম এবং রেডিয়াম

এছাড়া ২০১১ সালে ভিস্তুলা নদীর উপর নতুন একটি ওয়ার্স ব্রিজের নাম তার নামে রাখা হয়।

পাদটীকা

ক. ^ ১৮ শতকে পোল্যান্ড তিনটি ভাগে ভাগ হয়েছিল রাশিয়া, প্রুশিয়া এবং অস্ট্রিয়ার মধ্যে এবং মারি ক্যুরি আশাবাদী ছিলেন যে মৌলটি নিজ দেশের নামে নামকরণ করলে সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে পোল্যান্ডের স্বাধীনতার অভাব বিশ্ববাসীর নজরে আসবে। পোলনিয়াম সম্ভবত প্রথম মৌল যার নাম একটি রাজনৈতিক প্রশ্ন দৃষ্টিগোচরের উদ্দেশ্য নিয়ে রাখা হয়েছিল।[৯৬]

খ. ^ তিনি কোন বিষয়ে দ্বিতীয় ডিগ্রী নিয়েছিলেন সেবিষয়ে দ্বিমত আছে। ১৯৩৮ সালে টাদেউয এস্ট্রেইকার তার পোলস্কি স্লোভনিক বায়োগ্রাফিজনি ভুক্তিতে লিখেন যে যদিও অনেক উৎস বলে যে তিনি দ্বিতীয় ডিগ্রী গণিতে নিয়েছিলেন, কিন্তু তা ভুল, তিনি রসায়নে দ্বিতীয় ডিগ্রী নিয়েছিলেন।[৭]

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

ননফিকশন

ফিকশন

বহিঃসংযোগ

🔥 Top keywords: রাম নবমীমুজিবনগর দিবসপ্রধান পাতামুজিবনগর সরকারবিশেষ:অনুসন্ধানইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগএক্স এক্স এক্স এক্স (অ্যালবাম)বাংলাদেশবাংলা ভাষামিয়া খলিফারাজকুমার (২০২৪-এর চলচ্চিত্র)আনন্দবাজার পত্রিকাআবহাওয়ারামপহেলা বৈশাখউয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগইসরায়েলইরানরবীন্দ্রনাথ ঠাকুরমুজিবনগরইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউনরিয়াল মাদ্রিদ ফুটবল ক্লাব২০২৪ ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগক্লিওপেট্রাচর্যাপদভূমি পরিমাপশেখ মুজিবুর রহমানজনি সিন্সকাজী নজরুল ইসলামঈদুল আযহাফিলিস্তিনইউটিউবভারতবিকাশআসসালামু আলাইকুমসৌদি আরববাংলা প্রবাদ-প্রবচনের তালিকামুহাম্মাদ