প্রাকৃতিক সম্পদ

মানবজাতির কর্ম ছাড়াই বিদ্যমান সম্পদ

প্রাকৃতিক সম্পদ হলো এমন সম্পদ যা সরাসরি প্রকৃতি থেকে আহরণ করা হয় এবং সামান্য পরিবর্তনের মাধ্যমে মানব ব্যবহারোপযোগী করা হয়। এতে বাণিজ্যিক ও শিল্প ব্যবহার, নান্দনিক কদর, বৈজ্ঞানিক আগ্রহ এবং সাংস্কৃতিক কদরের মতো মূল্যবান বৈশিষ্ট্যের উৎস অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। পৃথিবীর ক্ষেত্রে এ ধরনের সম্পদের মধ্যে সূর্যের আলো, বায়ুমণ্ডল, পানি, ভূমি, সমস্ত উদ্ভিদকূলসহ সমস্ত খনিজ এবং প্রাণিজীবন অন্তর্ভুক্ত।[১][২][৩][৪]

সুন্দরবন একটি নিরবচ্ছিন্ন প্রাকৃতিক সম্পদের উদাহরণ। বন মানুষের জন্য কাঠ, খাদ্য, পানি এবং উদ্ভিদ ও প্রাণীজ উপজাতি আর পশুদের জন্য আশ্রয় প্রদান করে। জীবের মধ্যে পুষ্টিচক্র খাদ্য শৃঙ্খল গঠন করে এবং প্রজাতির জীববৈচিত্র্যকে লালন করে।
বাংলাদেশের মৌলভীবাজার জেলায় অবস্থিত মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত নিরবচ্ছিন্ন প্রাকৃতিক সম্পদের একটি উদাহরণ। জলপ্রপাতগুলো মানুষ, প্রাণী ও গাছপালা বেঁচে থাকার জন্য পানি সরবরাহ করে এবং সামুদ্রিক জীবেরও বাসস্থান দেয়। জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য টারবাইন ঘুরাতে জলের বেগ ব্যবহার করা যেতে পারে।
বঙ্গোপসাগরের তটে অবস্থিত পশ্চিমবঙ্গের দীঘা সমুদ্রসৈকত। সমুদ্র প্রাকৃতিক সম্পদের একটি উদাহরণ। সমুদ্রের ঢেউ হলো তরঙ্গ শক্তি, যা একটি নবায়নযোগ্য শক্তির উৎস তৈরি করতে ব্যবহার করা যেতে পারে। সমুদ্রের পানি লবণ উৎপাদন, বিশুদ্ধকরণ ও গভীর জলের মাছের আবাসস্থল প্রদানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। সমুদ্রে সামুদ্রিক প্রজাতির জীববৈচিত্র্য রয়েছে যেখানে পুষ্টিচক্র লক্ষণীয়।
সাইবেরিয়ার একটি মুক্তখন্দ হীরক খনি উদাচনায়া পাইপের একটি ছবি। এটি একটি অনবায়নযোগ্য প্রাকৃতিক সম্পদের উদাহরণ।

প্রাকৃতিক সম্পদ আমাদের প্রাকৃতিক ঐতিহ্যের অংশ হতে পারে বা অভরায়ণ্যে সুরক্ষিত থাকতে পারে। বিশেষ অঞ্চল (যেমন- সুন্দরবন) প্রায়ই তাদের বাস্তুতন্ত্রে জীববৈচিত্র্য ও ভূবৈচিত্র্য প্রদর্শন করে। প্রাকৃতিক সম্পদ বিভিন্ন উপায়ে শ্রেণিবদ্ধ করা যেতে পারে। প্রাকৃতিক সম্পদ হলো বস্তু ও উপাদান (এমন কিছু যা ব্যবহার করা যেতে পারে) যা পরিবেশের মধ্যে থেকে পাওয়া যায়। প্রতিটি মানবসৃষ্ট পণ্য প্রাকৃতিক সম্পদ দ্বারা গঠিত (তার মৌলিক স্তরে)।

একটি প্রাকৃতিক সম্পদ একটি পৃথক সত্তা হিসাবে বিদ্যমান থাকতে পারে, যেমন- বিশুদ্ধ পানি, বায়ু, সেইসাথে মাছের মতো যেকোনো জীবন্ত প্রাণী; অথবা এটি নিষ্কাশন শিল্প দ্বারা একটি অর্থনৈতিকভাবে উপযোগী আকারে রূপান্তরিত হতে পারে যেটিকে অবশ্যই সম্পদ প্রাপ্তির জন্য প্রক্রিয়া করতে হবে, যেমন- ধাতব আকরিক, বিরল মৃত্তিকা মৌল, পেট্রোলিয়াম, কাঠ ও অধিকাংশ শক্তি। কিছু সম্পদ হলো পুনর্নবীনীকরণযোগ্য বা নবায়নযোগ্য সম্পদ, যার অর্থ হলো সেগুলো একটি নির্দিষ্ট হারে ব্যবহার করা যেতে পারে এবং প্রাকৃতিক ক্রিয়ায় তাদের পুনরুদ্ধার হয়ে যাবে, পক্ষান্তরে অধিকাংশ নিষ্কাশন শিল্প অপুনর্নবীনীকরণযোগ্য বা অনবায়নযোগ্য সম্পদের উপর অধিক পরিমাণে নির্ভর করে যা শুধুমাত্র একবারই আহরণ করা যেতে পারে।

প্রাকৃতিক সম্পদের বণ্টন দেশসমূহের মাঝে ও অভ্যন্তরে অনেক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংঘর্ষের কেন্দ্রে হতে পারে। এটি ক্রমবর্ধমান অভাব এবং ঘাটতির সময়কালে সত্য (সম্পদ হ্রাস ও অতিরিক্ত ব্যবহার)। সম্পদ আহরণও মানবাধিকার লঙ্ঘন ও পরিবেশগত ক্ষতির একটি প্রধান উৎস। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক উন্নয়ন বিষয়সূচিসমূহ প্রায়শই আরও টেকসই সম্পদ নিষ্কাশন তৈরির উপর আলোকপাত করে, কিছু বিশেষজ্ঞ ও গবেষক অর্থনৈতিক মডেল তৈরির দিকে মনোনিবেশ করেন, যেমন- বৃত্তাকার অর্থনীতি, যা সম্পদ আহরণের উপর কম নির্ভর করে এবং পুনঃব্যবহার, পুনর্ব্যবহারযোগ্য ও নবায়নযোগ্য সম্পদের উপর বেশি নির্ভর করে। যা টেকসইভাবে পরিচালনা করা যেতে পারে।

শ্রেণিবিভাগ

প্রাকৃতিক সম্পদের শ্রেণিবিভাগের বিভিন্ন মানদণ্ড রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে উৎপত্তির উৎস, বিকাশের পর্যায়, নবায়নযোগ্যতা এবং মালিকানা।

উৎস

বিকাশের পর্যায়

  • সম্ভাব্য সম্পদ: যেসব সম্পদসমূহের অস্তিত্ব রয়েছে বলে জানা যায়, কিন্তু এখনও ব্যবহৃত হয়নি। এগুলো ভবিষ্যতে ব্যবহার করা যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, পাললিক শিলার পেট্রোলিয়াম যা টেনে বের করে ব্যবহার না করা পর্যন্ত একটি সম্ভাব্য সম্পদ হিসাবেই থেকে যায়।
  • প্রকৃত সম্পদ: যেসব সম্পদসমূহ জরিপকৃত, পরিমাপকৃত ও ব্যবহার্য এবং বর্তমানে উন্নয়নে ব্যবহৃত হয়। এগুলো সাধারণত প্রযুক্তি ও তাদের সম্ভাব্যতার স্তরের উপর নির্ভরশীল। যেমন: কাঠ প্রক্রিয়াজাতকরণ।
  • সংরক্ষিত সম্পদ: এমন প্রকৃত সম্পদের অংশ যা ভবিষ্যতে লাভজনকভাবে বিকশিত হতে পারে।
  • মজুদকৃত সম্পদ: যেসব সম্পদসমূহের জরিপ করা হয়েছে, কিন্তু প্রযুক্তির অভাবে ব্যবহার করা যাচ্ছে না। যেমন: হাইড্রোজেন যান।

নবায়নযোগ্যতা/ক্ষয়তা

  • নবায়নযোগ্য সম্পদ: এই ধরনের সম্পদ প্রাকৃতিকভাবে পুনঃপুরণ করা যেতে পারে। এই সম্পদসমূহের মধ্যে কিছু ক্রমাগত পাওয়া যায় এবং তাদের পরিমাণ মানুষের ব্যবহারের দ্বারা উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত হয় না, যেমন সূর্যালোক, বায়ু, বায়ুপ্রবাহ, পানি ইত্যাদি। যদিও অনেক নবায়নযোগ্য সম্পদের এত দ্রুত পুনরুদ্ধারের হার নেই, এই সম্পদসমূহ অতিরিক্ত ব্যবহারের দ্বারা হ্রাসের জন্য সক্ষম। মানুষের ব্যবহারিক দৃষ্টিকোণ থেকে সম্পদসমূহকে নবায়নযোগ্য হিসাবে শ্রেণিবদ্ধ করা হয় যতক্ষণ না পুনঃপূরণ/পুনরুদ্ধারের হার ব্যবহারের হারের চেয়ে বেশি হয়। তারা অনবায়নযোগ্য সম্পদের তুলনায় সহজেই পুনঃপূরণ করে।
পদ্মা নদী বাংলাদেশের স্বাদুপানি ও মৎস্য সম্পদের অন্যতম বৃহৎ উৎস। এটি নবায়নযোগ্য সম্পদের একটি উদাহরণ।
  • অনবায়নযোগ্য সম্পদ: এই ধরনের সম্পদ হয় ধীরে ধীরে গঠিত অথবা পরিবেশে প্রাকৃতিকভাবে গঠিত হয় না। খনিজসমূহ এই শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত সবচেয়ে সাধারণ সম্পদ। মানব দৃষ্টিকোণ থেকে সম্পদসমূহ অনবায়নযোগ্য হয় যখন তাদের ব্যবহারের হার পুনঃপূরণ/পুনরুদ্ধারের হারকে অতিক্রম করে; এর একটি ভালো উদাহরণ হলো জীবাশ্ম জ্বালানি, যেগুলো এই শ্রেণিতে রয়েছে কারণ তাদের গঠনের হার অত্যন্ত ধীর (সম্ভাব্য লক্ষ লক্ষ বছর), যার অর্থ তারা অনবায়নযোগ্য বলে বিবেচিত হয়। কিছু সম্পদ প্রাকৃতিকভাবে মানুষের হস্তক্ষেপ ছাড়াই পরিমাণে হ্রাস পায়, এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো তেজস্ক্রিয় উপাদান যেমন ইউরেনিয়াম, যা স্বাভাবিকভাবেই ভারী ধাতুতে পরিণত হয়। এর মধ্যে ধাতব খনিজগুলোকে পুনর্ব্যবহারের মাধ্যমে পুনরায় ব্যবহার করা যেতে পারে,[৫] তবে কয়লা ও পেট্রোলিয়াম পুনর্ব্যবহার করা যায় না।[৬] একবার তাদের সম্পূর্ণরূপে ব্যবহার করা হলে তারা পুনঃপূরণ করতে লক্ষ লক্ষ বছর সময় নেয়।

মালিকানা

  • ব্যক্তিগত সম্পদ: ব্যক্তিদের ব্যক্তি মালিকানাধীন সম্পদ। এর মধ্যে রয়েছে ফ্লাট, ঘরবাড়ি, বাগান, চারণভূমি, পুকুর ইত্যাদি।
  • সমষ্টিগত সম্পদ: সম্পদ যা একটি সম্প্রদায়ের সকল সদস্যের কাছে অধিগম্য। যেমন: কবরস্থান।
  • জাতীয় সম্পদ: মূলত সকল ব্যক্তিগত ও সাম্প্রদায়িক সম্পদ জাতীয় সম্পদের অন্তর্গত। জনকল্যাণের জন্য এগুলো অর্জন করার আইনগত ক্ষমতা জাতির রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে রাজনৈতিক সীমানার ভিতর খনিজ, বন এবং বন্যপ্রাণ এবং একচেটিয়া অর্থনৈতিক অঞ্চল (Exclusive Economic Zone)।
  • আন্তর্জাতিক সম্পদ: এ ধরনের সম্পদ আন্তর্জাতিক সংস্থা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। যেমন: আন্তর্জাতিক জলভাগ

আহরণ

সম্পদ আহরণ বা নিষ্কাশনের সাথে এমন যেকোনো কার্যকলাপ জড়িত যেখানে প্রকৃতি থেকে সম্পদ উত্তোলন করা হয়। এর ব্যপ্তি প্রাক-শিল্প সমাজের প্রথাগত ব্যবহার থেকে শুরু করে বৈশ্বিক শিল্প পর্যন্ত হতে পারে। নিষ্কাশন শিল্পসমূহ কৃষির পাশাপাশি অর্থনীতির প্রাথমিক খাতের ভিত্তি। সম্পদের আহরণের ফলে কাঁচামাল উৎপাদিত হয়, যা তারপর মূল্য সংযোজন করার জন্য প্রক্রিয়াজাত করা হয়। নিষ্কাশন শিল্পের উদাহরণ হলো শিকার, ফাঁদ, খনন, তেল ও গ্যাস তুরপুন এবং কাঠ সংগ্রহ। প্রাকৃতিক সম্পদ একটি দেশে যথেষ্ট পরিমাণ অর্থ প্রদান করতে পারে;[৭] তবে সম্পদ বৃদ্ধির কারণে হঠাৎ করে অর্থের প্রবাহ একটি দেশে সামাজিক সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে, যার মধ্যে রয়েছে মুদ্রাস্ফীতির ফলে অন্যান্য শিল্পের ক্ষতি (অর্থনীতিশাস্ত্রে বিষয়টি "ওলন্দাজ রোগ" নামে পরিচিত) ও দুর্নীতি, যার ফল হলো বৈষম্য ও অনুন্নয়ন, এটি "সম্পদের অভিশাপ" হিসাবে পরিচিত।

নিষ্কাশন শিল্পসমূহ অনেক স্বল্পোন্নত দেশে একটি বৃহৎ ক্রমবর্ধমান কার্যকলাপের প্রতিনিধিত্ব করে, কিন্তু উৎপন্ন সম্পদ দেশকে সবসময় টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধির দিকে পরিচালিত করে না। জনগণ প্রায়শই অভিযুক্ত করে যে নিষ্কাশন শিল্পের ব্যবসাসমূহ কেবলমাত্র স্বল্পমেয়াদী মূল্য সর্বাধিক বৃদ্ধি করার জন্য কাজ করে, যা ইঙ্গিত করে যে স্বল্পোন্নত দেশসমূহ শক্তিশালী কোম্পানির জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। বিকল্পভাবে অনুমান করা হয় যে প্রায়শই উপস্থাপকের ভূমিকা পালনকারী সরকারগুলো কেবলমাত্র তাৎক্ষণিক বিক্রয়লব্ধ আয় সর্বাধিক বৃদ্ধি করতে কাজ করে। গবেষকরা যুক্তি দেন যেখানে উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা ও ব্যবসা-বাণিজ্য একে অপরকে কাঁটিয়ে যায়, সেখানে সাধারণ আগ্রহের ক্ষেত্র রয়েছে। রাজস্ব ব্যবস্থাপনা ও ব্যয়ের জবাবদিহিতা, অবকাঠামো উন্নয়ন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দক্ষতা ও বেসরকারি খাতের উন্নয়ন এবং শিশুদের, বিশেষ করে প্রাপ্ত ও অপ্রাপ্তবয়স্ক নারীদের উপর প্রভাবের মাধ্যমে বেসরকারি খাত এবং উপস্থাপক সরকারগুলোর সাথে জড়িত হওয়ার এই সুযোগসমূহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর জন্য রয়েছে।[৮] একটি শক্তিশালী সুশীল সমাজ প্রাকৃতিক সম্পদের কার্যকর ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। নরওয়ে এক্ষেত্রে একটি রোল মডেল হিসাবে কাজ করতে পারে, কারণ এখানে ভালো প্রতিষ্ঠান রয়েছে এবং সুশীল সমাজের শক্তিশালী নেতাদের সাথে উন্মুক্ত ও গতিশীল জনবিতর্ক রয়েছে, যা নিষ্কাশন শিল্পে সরকারি ব্যবস্থাপনার জন্য একটি কার্যকর "চেক এন্ড ব্যালেন্স সিস্টেম" (পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণ) প্রদান করে, যেমন এক্সট্র্যাক্টিভ ইন্ডাস্ট্রিজ ট্রান্সপারেন্সি ইনিশিয়েটিভ (ইআইটিআই), তেল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ শিল্পে সুশাসনের জন্য একটি বৈশ্বিক মানদণ্ড। এর ফলে নিষ্কাশন খাতগুলোতে শাসন-সংক্রান্ত প্রধান সমস্যাগুলো সমাধান করা যায়।[৯] যাইহোক, যে দেশগুলোতে খুব শক্তিশালী ও ঐক্যবদ্ধ সমাজ নেই, অর্থাৎ সেখানে বিরোধিপক্ষ সরকারের প্রতি সন্তুষ্ট নয় যেমনটি নরওয়েতে দেখা যায়, সেখানে প্রকৃতপক্ষে একটি গৃহযুদ্ধ শুরু ও তা স্থায়িত্বের জন্য প্রাকৃতিক সম্পদ একটি ফ্যাক্টর হতে পারে।[১০]

সম্পদের অবক্ষয়

বেলজিয়ামের থর্ন্টোব্যাঙ্ক বায়ুকল খামারে বায়ুর প্রাকৃতিক সম্পদ এই ৫ মেগাওয়াট বায়ুশক্তি বায়ুকলগুলোকে চালিত করে। বায়ু একটি প্রাকৃতিক সম্পদ যেটি বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহার করা যেতে পারে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রাকৃতিক সম্পদের অবক্ষয় বা হ্রাস বিভিন্ন সরকার ও জাতিসংঘের মতো সংস্থাগুলোর প্রধান কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। বিষয়টি জাতিসংঘের এজেন্ডা ২১ এর দ্বিতীয় ধারায় স্পষ্ট হয়, যেখানে দেশগুলোর জন্য তাঁদের প্রাকৃতিক সম্পদ টিকিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের রূপরেখা প্রদান করা হয়েছে।[১১] প্রাকৃতিক সম্পদের অবক্ষয় একটি টেকসই উন্নয়ন সমস্যা হিসেবে বিবেচিত হয়।[১২] টেকসই উন্নয়ন শব্দদ্বয়ের অনেকগুলো ব্যাখ্যা রয়েছে, বিশেষ করে ব্রুন্ডল্যান্ড কমিশনের ব্যাখ্যা মতে, টেকসই উন্নয়ন হচ্ছে 'এটা নিশ্চিত করা যে ভবিষ্যত প্রজন্মের নিজস্ব চাহিদা পূরণের ক্ষমতার সাথে আপস না করে এটি বর্তমানের চাহিদা পূরণ করে কিনা';[১৩] যাইহোক, ব্যাপক অর্থে এটির অর্থ হলো বর্তমান ও ভবিষ্যতে পৃথিবী নামক গ্রহের মানুষ ও প্রজাতির চাহিদার ভারসাম্য বজায় রাখা।[১১] প্রাকৃতিক সম্পদের ক্ষেত্রে অবক্ষয় টেকসই উন্নয়নের জন্য উদ্বেগের বিষয়, কারণ এর ফলে বর্তমান পরিবেশের অবনতি হতে পারে[১৪] এবং ভবিষ্যত প্রজন্মের চাহিদাকে প্রভাবিত করারও সম্ভাবনা আছে।[১২]

"প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ একটি মৌলিক সমস্যা। যতক্ষণ না পর্যন্ত আমরা উক্ত সমস্যার সমাধান করি, অন্য সবকিছু সমাধান করলেও আমাদের যৎসামান্যই উপকার হবে।"

থিওডোর রুজভেল্ট[১৫]

প্রাকৃতিক সম্পদের অবক্ষয় সামাজিক বৈষম্যের সাথে জড়িত। যদি বিবেচনা করা হয় যে অধিকাংশ জীববৈচিত্র্য উন্নয়নশীল দেশে অবস্থিত,[১৬] তবে সম্পদের এই অবক্ষয় উক্ত দেশগুলোর জন্য বাস্তুতন্ত্র ব্যবস্থার ক্ষতির কারণ হতে পারে।[১৭] কেউ কেউ এই অবক্ষয়কে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সামাজিক অস্থিরতা ও দ্বন্দ্বের একটি প্রধান উৎস হিসেবে দৃষ্টিপাত করেন।[১৮]

বর্তমানে পৃথিবীর বেশিরভাগ জীববৈচিত্র্য ধরে রাখা রেইনফরেস্ট অঞ্চলগুলোর জন্য একটি বিশেষ উদ্বেগ রয়েছে।[১৯] নেলসনের মতে,[২০] বন উজাড় ও হ্রাস পৃথিবীর ৮.৫% বনভূমিকে প্রভাবিত করে যেখানে পৃথিবীর পৃষ্ঠের ৩০% বনভূমি ইতিমধ্যেই কেটে ফেলা হয়েছে। যদি আমরা বিবেচনা করি যে ৮০% মানুষ গাছপালা থেকে প্রাপ্ত ওষুধের উপর নির্ভর করে এবং বিশ্বের প্রেসক্রিপশনের ওষুধে উদ্ভিজ্জ উপাদান রয়েছে,[১৭] তাহলে বিশ্বের রেইনফরেস্টের ক্ষতির ফলে সম্ভাব্য জীবন রক্ষাকারী আরও ওষুধের খোঁজ পাওয়ার সম্ভাবনা হ্রাস পেতে পারে।[২১]

প্রাকৃতিক সম্পদের অবক্ষয় ঘটার কারণ 'পরিবর্তনের প্রত্যক্ষ চালক'[২০] যেমন খনন, পেট্রোলিয়াম উত্তোলন, মাছ ধরা ও বনায়ন এগুলোর পাশাপাশি 'পরিবর্তনের পরোক্ষ চালক' যেমন জনসংখ্যাবিদ্যা (যেমন জনসংখ্যা বৃদ্ধি), অর্থনীতি, সমাজ, রাজনীতি ও প্রযুক্তি।[২০] কৃষির বর্তমান পদ্ধতি প্রাকৃতিক সম্পদের অবক্ষয় ঘটায় আরেকটি কারণ। উদাহরণস্বরূপ, নাইট্রোজেনের অত্যধিক ব্যবহার[২০] ও মরুকরণের[১১] কারণে মাটিতে পুষ্টির ক্ষয় হয়, অর্থাৎ মাটির উর্বরতা হ্রাস পায়। প্রাকৃতিক সম্পদের অবক্ষয় সমাজের জন্য একটি ক্রমাগত উদ্বেগ। সুপরিচিত সংরক্ষণবাদী নেতা এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি থিওডোর রুজভেল্টের উদ্ধৃত উক্তিটির মধ্যে বিষয়টি প্রতিফলিত হয়, যিনি প্রাকৃতিক সম্পদের অনিয়ন্ত্রিত আহরণের বিরোধী ছিলেন।

সংরক্ষণ

মানব কার্যকলাপের কারণে প্রকৃতিকে আরও ক্ষয় থেকে রক্ষা করার প্রয়োজনীয়তাকে স্বীকৃতি দেবার জন্য ১৯৮১ সালে জাতিসংঘ প্রকৃতির জন্য বিশ্ব সনদ তৈরি করে। এটিতে বলা হয়েছে যে প্রকৃতিকে রক্ষা করার জন্য আন্তর্জাতিক থেকে ব্যক্তি পর্যায় পর্যন্ত সকল সামাজিক স্তরে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। এটি প্রাকৃতিক সম্পদের টেকসই ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তার রূপরেখা প্রদান করে এবং ইঙ্গিত করে যে সম্পদের সুরক্ষা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইনে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।[২২] ১৯৯০ সালে প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে অধিক দৃষ্টিপাত করার জন্য প্রকৃতি সংরক্ষণের জন্য আন্তর্জাতিক ইউনিয়ন (আইইউসিএন), প্রকৃতির জন্য বিশ্ব বিস্তৃত তহবিল (ডব্লিউডব্লিউএফ) এবং জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচি (ইউএনইপি) ‘স্থায়িত্বের বিশ্ব নৈতিকতা’ (World Ethic of Sustainability) প্রস্তুত করেছে,[২৩] যেখানে টেকসই পরিবেশের জন্য আটটি মান নির্ধারণ করা হয়েছে, যার মধ্যে প্রাকৃতিক সম্পদকে অবক্ষয় থেকে রক্ষা করার প্রয়োজনীয়তাও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এই নথিসমূহের বিকাশের পর থেকে প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষার জন্য অনেক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তন্মধ্যে রয়েছে যথাক্রমে বৈজ্ঞানিক ক্ষেত্র প্রতিষ্ঠা এবং সংরক্ষণ জীববিজ্ঞান এবং বাসস্থান সংরক্ষণের অনুশীলন।

সংরক্ষণ জীববিজ্ঞান হলো পৃথিবীর জীববৈচিত্র্যের প্রকৃতি ও অবস্থার বৈজ্ঞানিক অধ্যয়ন, যার লক্ষ্য হলো প্রজাতি, তাদের আবাসস্থল ও বাস্তুতন্ত্রকে বিলুপ্তির অত্যধিক হার থেকে রক্ষা করা।[২৪][২৫] এটি বিজ্ঞান, অর্থনীতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা অনুশীলনের একটি আন্তঃবিভাগীয় বিষয়।[২৬][২৭][২৮][২৯] সংরক্ষণ জীববিজ্ঞান শব্দটি ১৯৭৮ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার লস হোলাতে অবস্থিত ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, সান ডিয়েগোতে অনুষ্ঠিত একটি সম্মেলনের শিরোনাম হিসাবে চালু করা হয়েছিল, সম্মেলনটি আয়োজন করেন জীববিজ্ঞানী ব্রুস এ. উইলকক্স ও মাইকেল ই. সুলে।

বাসস্থান সংরক্ষণ হলো এক ধরনের ভূমি ব্যবস্থাপনা যা বনজ উদ্ভিদপ্রাণীদের আবাসস্থল সংরক্ষণ, সুরক্ষা ও পুনরুদ্ধার করতে অনুসন্ধান করে, বিশেষ করে সংরক্ষণ নির্ভর প্রজাতি এবং তাদের বিলুপ্তি, খণ্ডিতকরণ বা পরিসরে হ্রাস রোধ করে।[৩০]

ব্যবস্থাপনা

প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা হলো প্রাকৃতিক সম্পদ যেমন ভূমি, পানি, মাটি, উদ্ভিদপ্রাণী ব্যবস্থাপনার একটি ক্ষেত্র–পাশাপাশি ব্যবস্থাপনা কীভাবে বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য জীবনযাত্রার মানকে প্রভাবিত করে তার উপর একটি বিশেষ দৃষ্টিপাত। অতএব, বর্তমান প্রজন্ম ও ভবিষ্যত প্রজন্ম উভয়কে প্রাকৃতিক সম্পদ সরবরাহ করার জন্য সম্পদের বিচারিক ব্যবহার অনুসারে টেকসই উন্নয়ন অনুসৃত হয়। মৎস্যবিদ্যা, বনায়ন ও বন্যপ্রাণীবিদ্যা এসকল ক্ষেত্র প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনার বৃহৎ উপশাখার উদাহরণ।

প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবস্থাপনায় সম্পদের সীমা নির্ধারণের জন্য কার সম্পদ ব্যবহারের অধিকার আছে এবং কার নেই তা চিহ্নিত করাও অন্তর্ভুক্ত।[৩১] স্থানীয় অবস্থার উপর নির্ভর করে কখন এবং কীভাবে সম্পদ ব্যবহার করা হয় তা নিয়ন্ত্রণকারী নিয়ম অনুসারে সম্পদসমূহ ব্যবহারকারীদের দ্বারা ব্যবহৃত হতে পারে[৩২] অথবা সম্পদসমূহ সরকারি সংস্থা বা অন্যান্য কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ দ্বারাও নিয়ন্ত্রিত হতে পারে।[৩৩]

"...প্রাকৃতিক সম্পদের সফল ব্যবস্থাপনা বাক স্বাধীনতার উপর নির্ভর করে, একাধিক স্বাধীন গণমাধ্যম চ্যানেলের মাধ্যমে একটি গতিশীল ও ব্যাপক জনবিতর্ক এবং প্রাকৃতিক সম্পদের সমস্যায় নিযুক্ত একটি সক্রিয় নাগরিক সমাজ..."[৩৪] প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবস্থাপনায় ভূমিকা রাখতে পারে, এর কারণ শেয়ারকৃত সম্পদের প্রকৃতি, যারা নিয়ম দ্বারা প্রভাবিত হয় তাঁরা সম্পদ বিন্যাস বা পরিবর্তন করতে অংশগ্রহণ করতে পারে।[৩১] সরকার কর্তৃক স্বীকৃতির অধীনে ব্যবহারকারীদের নিজস্ব ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান ও পরিকল্পনা তৈরি করার অধিকার রয়েছে। সম্পদের অধিকারের মধ্যে রয়েছে ভূমি, পানি, মৎস্য ও চারণভূমি সংক্রান্ত অধিকার।[৩২] সম্পদের ব্যবহারকারী বা ব্যবহারকারীদের কাছে দায়বদ্ধ পক্ষগুলোকে সক্রিয়ভাবে নিরীক্ষণ করতে হবে ও নিয়মানুসারে সম্পদ সম্মতির (resource compliance) সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে এবং যারা নিয়ম লঙ্ঘন করে তাঁদের উপর জরিমানা আরোপ করতে হবে।[৩১] অপরাধের গুরুতরতা ও প্রেক্ষাপট অনুসারে এই বিরোধসমূহ স্থানীয় প্রতিষ্ঠান দ্বারা দ্রুত ও কম খরচে সমাধান করা হয়।[৩২] প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা নিয়ে আলোচনা করার জন্য বিশ্বব্যাপী বিজ্ঞানভিত্তিক প্ল্যাটফর্ম হলো সুইজারল্যান্ডে অবস্থিত ওয়ার্ল্ড রিসোর্সেস ফোরাম (ডব্লিউআরএফ)।

আরও দেখুন

তথ্যসূত্র

🔥 Top keywords: রাম নবমীমুজিবনগর দিবসপ্রধান পাতামুজিবনগর সরকারবিশেষ:অনুসন্ধানইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগএক্স এক্স এক্স এক্স (অ্যালবাম)বাংলাদেশবাংলা ভাষামিয়া খলিফারাজকুমার (২০২৪-এর চলচ্চিত্র)আনন্দবাজার পত্রিকাআবহাওয়ারামপহেলা বৈশাখউয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগইসরায়েলইরানরবীন্দ্রনাথ ঠাকুরমুজিবনগরইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউনরিয়াল মাদ্রিদ ফুটবল ক্লাব২০২৪ ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগক্লিওপেট্রাচর্যাপদভূমি পরিমাপশেখ মুজিবুর রহমানজনি সিন্সকাজী নজরুল ইসলামঈদুল আযহাফিলিস্তিনইউটিউবভারতবিকাশআসসালামু আলাইকুমসৌদি আরববাংলা প্রবাদ-প্রবচনের তালিকামুহাম্মাদ