টিকাদান
টিকাদান বলতে কোনও রোগের বিরুদ্ধে অনাক্রম্যতা (প্রতিরোধ ক্ষমতা) অর্জনে দেহের অনাক্রম্যতন্ত্রকে (রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে) সাহায্য করার জন্য দেহে টিকা প্রয়োগ করাকে বোঝায়। টিকাতে দুর্বল, জীবন্ত বা মৃত অবস্থায় বিদ্যমান অণুজীব বা ভাইরাস, কিংবা ঐ অণুজীব থেকে প্রাপ্ত প্রোটিন বা বিষাক্ত পদার্থ থাকে। টিকাগুলি দেহের অভিযোজিত অনাক্রম্যতাকে উদ্দীপ্ত করে কোনও সংক্রামক রোগ থেকে অসুস্থতা প্রতিরোধে সাহায্য করে। যখন কোনও জনসমষ্টির একটি পর্যাপ্ত পরিমাণ বৃহৎ অংশকে টিকাদান করা হয়, তখন যূথ অনাক্রম্যতা অর্জিত হয়। যূথ অনাক্রম্যতা দুর্বল-অনাক্রম্যতাবিশিষ্ট ও টিকাগ্রহণে অক্ষম ব্যক্তিদেরকে সুরক্ষা প্রদান করে, কেননা একটি দুর্বল জীবাণুও তাদের ক্ষতিসাধন করতে পারে।[১] টিকাদানের কার্যকারিতার উপর ব্যাপক গবেষণা ও যাচাই করা হয়েছে।[২][৩][৪] বর্তমানে টিকাদান সংক্রামক রোগ প্রতিরোধের জন্য সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি হিসেবে স্বীকৃত।[৫][৬][৭][৮] টিকাদানের কারণে ব্যাপক অনাক্রম্যতার সুবাদে বসন্ত রোগকে বিশ্বব্যাপী নির্মূল করা সম্ভব হয়েহে এবং বিশ্বের সিংহভাগ এলাকা থেকে পোলিও ও ধনুষ্টংকারসহ আরও কিছু রোগ উচ্ছেদ করা গেছে। তবে অপেক্ষাকৃত নিম্নহারে টিকাদানের ফলে কিছু কিছু উচ্ছেদকৃত রোগের আবার প্রাদুর্ভাব দেখা দিচ্ছে, যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হামের প্রাদুর্ভাব। এগুলির জন্য আংশিকভাবে টিকাগ্রহণে দ্বিধাকে দায়ী করা হয়েছে।[৯] বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে টিকাদান প্রতি বছর ৩৫ থেকে ৫০ লক্ষ অকাল মৃত্যু প্রতিরোধ করে।[১০]
টিকাদান | |
---|---|
রোগের বীজ তথা জীবাণু রোপণের মাধ্যমে প্রথম যে রোগটিকে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করা হয়েছিল, তা ছিল সম্ভবত গুটিবসন্ত। ১৬শ শতকে চীনে প্রথম গুটিবসন্ত জীবাণুরোপণ হয়েছিল বলে নথিপত্রে উল্লেখ পাওয়া যায়।[১১] It was also the first disease for which a vaccine was produced.[১২][১৩] যদিও কমপক্ষে ছয়জন ব্যক্তি একই মূলনীতি বহু আগেই ব্যবহার করেছিলেন, তা সত্ত্বেও ইংরেজ চিকিৎসক এডওয়ার্ড জেনারকে ১৭৯৬ সালে গুটিবসন্তের টিকার উদ্ভাবকের স্বীকৃতি দেওয়া হয়। তিনিই প্রথম সাক্ষ্যপ্রমাণ প্রকাশ করে দেখান যে ঐ টিকাটি কার্যকর এবং তিনি সেটির উৎপাদনের বিষয়ে পরামর্শ প্রদান করেন।[১৪] ফরাসি বিজ্ঞানী লুই পাস্তর অণুজীববিজ্ঞানে গবেষণাকর্মের মাধ্যমে এই ধারণাটির আরও বিকাশ সাধন করেন। গুটিবসন্ত একটি ছোঁয়াচে ও অত্যন্ত মরণঘাতী রোগ ছিল, যার ফলে সংক্রমিত প্রাপ্তবয়স্কদের ২০-৬০% এবং শিশুদের ৮০% মৃত্যুবরণ করত।[১৫] ১৯৭৯ সালে নির্মূল হওয়ার আগে গুটিবসন্ত ২০শ শতাব্দীতে প্রায় ৩০ থেকে ৫০ কোটি ব্যক্তির মৃত্যুর কারণ ছিল।[১৬][১৭][১৮]
টিকাদান ও রোগের বীজরোপণের মধ্যে পার্থক্য আছে। বীজরোপণে জীবন্ত শক্তিশালী জীবাণু ব্যবহার করা হয়। টিকাদানের প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে বৈজ্ঞানিক, নৈতিক, রাজনৈতিক, চিকিৎসাগত নিরাপত্তা ও ধর্মীয় ভিত্তিতে কিছু অনীহা প্রদর্শিত হলেও কোনও প্রধান ধর্মে টিকাদানের বিরোধতা করা হয় না। এমনকি জীবন বাঁচানোর সামর্থ্য রাখে বলে কেউ কেউ টিকাদানকে অত্যাবশ্যক বলে মনে করেন।[১৯] মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জাতীয় টিকাজনিত আঘাতের ক্ষতিপূরণ কর্মসূচির আওতায় মানুষ দাবিকৃত আঘাতের জন্য ক্ষতিপূরণ পেতে পারে। প্রথম দিককার সাফল্যের কারণে টিকাদান ব্যাপকভাবে গৃহীত হয় এবং গণটিকাদান অভিযানগুলি বহুসংখ্যক ভৌগোলিক অঞ্চলে বহুসংখ্যক রোগের প্রাদুর্ভাব ব্যাপকভবে হ্রাস করেছে। মার্কিন রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র সিডিসি টিকাদানকে ২০শ শতাব্দীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জনস্বাস্থ্য খাতে দশটি মহাসাফল্যের একটি হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে।[২০]
কার্যকারিতা
সংক্রামক রোগ থেকে রক্ষা করার জন্য টিকা হল কৃত্রিমভাবে প্রতিরোধ ক্ষমতা সক্রিয়করণ এর একটি উপায়। এই সক্রিয়করণটি ঘটে প্রতিরোধ ব্যবস্থায় একটি ইমিউনোজেন দিয়ে প্রাইমিংয়ের মাধ্যমে। সংক্রামকের সাথে অনাক্রম্য প্রতিক্রিয়া উদ্দীপনাটি টিকাদান নামে পরিচিত। টিকাকরণে ইমিউনোজেনসমূহ পরিচালনা করার বিভিন্ন উপায় অন্তর্ভুক্ত করা রয়েছে।[২১]
ভবিষ্যৎ সুরক্ষা বাড়ানোর জন্য কোনও রোগীর কোনও রোগের সংক্রমণের আগে বেশিরভাগ টিকা দেওয়া হয়। তবে রোগীর ইতিমধ্যে ঐ রোগ সংক্রামিত হওয়ার পরে কিছু কিছু টিকা দেওয়া হয়। গুটি বসন্ত রোগের সংস্পর্শে আসার পরে প্রদত্ত টিকা রোগ থেকে কিছুটা সুরক্ষা দেয় বা রোগের তীব্রতা হ্রাস করতে পারে বলে জানা গেছে। [২২] প্রথম রেবিস বা জলাতঙ্ক রোগের টিকা লুই পাস্তুর একটি শিশুকে দিয়ে ছিলেন। একটি রেবিড কুকুরের কামড় দেওয়ার পরে তিনি শিশুটিকে এই টিকা দিয়েছিল। ১৪ দিনের বেশি সময় ধরে রেবিজ ইমিউন গ্লোবিউলিন এবং ক্ষতের যত্ন সহ একাধিকবার পরিচালিত হওয়ার পর রেবিজ টিকাটি মানুষের মধ্যে রেবিজ প্রতিরোধে কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়েছে। [২৩] অন্যান্য উদাহরণের মধ্যে রয়েছে পরীক্ষামূলক এইডস, ক্যান্সার [২৪] এবং আলৎসহাইমারের রোগ এর টিকা।[২৫] এই ধরনের টিকাদানে আরও দ্রুত এবং প্রাকৃতিক সংক্রমণের চেয়ে অনেক কম ক্ষতি সহ অনাক্রম্য প্রতিক্রিয়াটি ঘটে থাকে। [২৬]
বেশিরভাগ টিকা ইনজেকশনের মাধ্যমে দেওয়া হয় কারণ সেগুলি অন্ত্র এর মাধ্যমে নির্ভরযোগ্যভাবে শোষিত হয় না। অন্ত্রের অনাক্রম্যতা বৃদ্ধির জন্য লাইভ অ্যাটেনিউটেড পোলিও, রোটাভাইরাস, কিছু টাইফয়েড এবং কিছু কলেরা ভ্যাকসিন মৌখিকভাবে দেওয়া হয়। টিকার দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব থাকে এবং সাধারণত এটি বিকাশ হতে বেশ কয়েক সপ্তাহ সময় নেয়। [২৭]
যখন কোনও ব্যক্তির প্রতিরোধ ব্যবস্থা প্রথম টিকা দেওয়ার পরে অ্যান্টিবডি উৎপাদন করতে পারে না তখন প্রাথমিক টিকার ব্যর্থতার ঘটনা ঘটে। যখন বেশ কয়েকটি সিরিজ দেওয়া হয় এবং প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করতে ব্যর্থ হয় তখন টিকা ব্যর্থ হতে পারে। "টিকা ব্যর্থতা বা ভ্যাকসিন ব্যর্থতা" শব্দটি দিয়ে ঐ টিকা ত্রুটিযুক্ত - তা বোঝায় না। বেশিরভাগ টিকার ব্যর্থতা কেবল প্রতি ব্যক্তির স্বতন্ত্র ইমিউন প্রতিক্রিয়ার পরিবর্তনের কারণে ঘটতে পারে।[২৮]
আরও দেখুন
- টিকা নীতি
- টিকা পরীক্ষা
- গর্ভাবস্থায় টিকাদান
- বিশ্ব টিকাদান সপ্তাহ