হাইড্রোকার্বন

হাইড্রোজেন ও কার্বন দ্বারা গঠিত জৈব যৌগ

শুধু হাইড্রোজেন ও কার্বন দ্বারা গঠিত জৈব যৌগকে হাইড্রোকার্বন বলে।[১] হাইড্রোকার্বন বিভিন্ন ধরনের হতে পারে, যেমন সম্পৃক্ত হাইড্রোকার্বন অ্যালকেন, অসম্পৃক্ত হাইড্রোকার্বন অ্যালকিন ও অ্যালকাইন, ও অ্যারোম্যাটিক হাইড্রোকার্বন।

সরলতম হাইড্রোকার্বন মিথেন

শ্রেণিবিভাগ

২-মিথাইলহেপ্টাডেকেন, একটি অ্যালকেন যা হলোমেলিনা অরান্টিয়াকা প্রজাতির টাইগার মথের যৌন ফেরোমোন[২]

ইউপ্যাক-এর জৈব যৌগ নামকরণ পদ্ধতি অনুসারে হাইড্রোকার্বনগুলিকে নিম্নলিখিত শ্রেণিতে ভাগ করা যায়ঃ১.মুক্ত শিকল হাইড্রোকার্বনঃ

  1. সম্পৃক্ত মুক্ত শিকল হাইড্রোকার্বনঃ এই ধরনের হাইড্রোকার্বনের (অ্যালকেন) সাধারণ সূত্র CnH2n+2[৩] এই যৌগে কার্বন ও হাইড্রোজেন শুধু একবন্ধন দ্বারা যুক্ত এবং একটিমাত্র শৃঙ্খলে বা শাখাযুক্ত শৃঙ্খলে সজ্জিত। পেট্রোলিয়াম জাতীয় জৈব জ্বালানির মুখ্য উপাদান সম্পৃক্ত হাইড্রোকার্বন। কার্বন শৃঙ্খল ও শাখার দৈর্ঘ্যের উপর ভিত্তি করে সম্পৃক্ত হাইড্রোকার্বনে আইসোমেরিজম ও কাইরালিটি দেখা যেতে পারে।
  2. অসম্পৃক্ত মুক্ত শিকল হাইড্রোকার্বনঃ এই শ্রেণিতে কার্বন-কার্বন ও কার্বন-হাইড্রোজেন একবন্ধনের পাশাপাশি কার্বন-কার্বন দ্বিবন্ধন ও ত্রিবন্ধন বিদ্যমান। একটি দ্বিবন্ধন যুক্ত হাইড্রোকার্বনের সাধারণ সূত্র CnH2n (অ্যালকিন) ও একটি ত্রিবন্ধন যুক্ত হাইড্রোকার্বনের সাধারণ সূত্র CnH2n-2 (অ্যালকাইন)।
  3. বলয়াকার (সাইক্লিক) হাইড্রোকার্বনঃ এই ধরনের যৌগে এক বা একাধিক কার্বন বলয় উপস্থিত। একটি বলয় বিশিষ্ট সম্পৃক্ত বলয়াকার হাইড্রোকার্বনের সাধারণ সংকেত CnH2n

বলয়াকার হাইড্রোকার্বন দুই ধরনের। ১.সম্পৃক্তঃ সাইক্লোপ্রোপেন,সাইক্লোবিউটেন ২. অসম্পৃক্তঃসাইক্লোপ্রোপিন,সাইক্লোবিউটিন।

  1. অ্যারোম্যাটিক হাইড্রোকার্বনঃ এই শ্রেণির হাইড্রোকার্বনে এক বা একাধিক অ্যারোম্যাটিক বলয় (অ্যারোম্যাটিক রিং) থাকে। অ্যারোম্যাটিক হাইড্রোকার্বনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হল বেনজিন

ভৌত ও রাসায়নিক ধর্ম

হাইড্রোকার্বন ঘরের তাপমাত্রায় কঠিন (প্যারাফিন মোম, ন্যাপথ্যালিন), তরল (বেনজিন) ও গ্যাসীয় (মিথেন, ইথেন) তিনরকম অবস্থাতেই থাকতে পারে। হাইড্রোকার্বনের গলনাঙ্ক ও স্ফুটনাঙ্ক তার আণবিক ভর, দ্বিমেরু ভ্রামক ও কঠিন অবস্থায় প্যাকিং-এর উপর নির্ভর করে।

কার্বনের যোজ্যতা চার হওয়ার কারণে লম্বা কার্বন-কার্বন শৃঙ্খল গঠন হতে পারে, এবং কার্বনের এই "ক্যাটিনেশন" ধর্মের জন্য হাইড্রোকার্বনের অসংখ্য গঠনবৈচিত্র্য সম্ভব।

কার্বন ও হাইড্রোজেনের তড়িৎ ঋণাত্মকতার পার্থক্য মাত্র ~0.35, তাই হাইড্রোকার্বন সাধারণত নন-পোলার হয়। এই কারণেই বেশিরভাগ হাইড্রোকার্বন হাইড্রোফোবিক ও নন-পোলার জৈব দ্রাবকে (যেমন কার্বন টেট্রাক্লোরাইড, ইথার) দ্রাব্য এবং জলের মতন অজৈব দ্রাবকে অদ্রাব্য।

সম্পৃক্ত হাইড্রোকার্বনে (অ্যালকেন) সমস্ত বন্ধনই অনমনীয় সিগমা (σ) বন্ধন হওয়ার কারণে অ্যালকেন সাধারণ অবস্থায় নিষ্ক্রিয় হয়।[৪] উচ্চ তাপমাত্রায় অ্যালকেন অক্সিজেন দ্বারা জারিত হয়ে কার্বন ডাইঅক্সাইড ও জল তৈরি করে। সূর্যালোকের উপস্থিতিতে অ্যালকেন হ্যালোজেনের সঙ্গে বিক্রিয়া করে হ্যালোঅ্যালকেন গঠন করে।

অ্যালকিন ও অ্যালকাইনে দুর্বল পাই (π) বন্ধন থাকে, যা নিউক্লিয়ফিল বা ইলেক্ট্রোফিলের সাথে সংযোজন বিক্রিয়া করতে পারে।[৫]

অ্যারোম্যাটিক হাইড্রোকার্বনের অ্যারোম্যাটিক ধর্মের জন্য π বন্ধন থাকা সত্ত্বেও তা অত্যন্ত নিষ্ক্রিয় হয়, যা কেবলমাত্র অনুঘটকের উপস্থিতিতে সংযোজন ও প্রতিস্থাপন বিক্রিয়া করতে পারে।[৬]

উৎস

পৃথিবীতে হাইড্রোকার্বনের প্রধান উৎস পেট্রোলিয়ামপ্রাকৃতিক গ্যাস। পাললিক শিলার স্তরে জমে থাকা জৈব পদার্থ প্রচণ্ড তাপ ও চাপে রূপান্তরিত হয়ে তৈলাক্ত বালি, ওয়েল শেল নামের পাথর ও সামুদ্রিক মিথেন হাইড্রেটের স্তরে পেট্রোলিয়াম ও প্রাকৃতিক গ্যাস তৈরি করে।[৭]

পৃথিবীর বাইরে বাকি সৌরজগতেও হাইড্রোকার্বনের অবাধ উপস্থিতি। শনির বৃহত্তম উপগ্রহ টাইটানে মিথেনইথেনের হ্রদ খুঁজে পেয়েছে নাসার ক্যাসিনি-হাইগেন্স মিশন।[৮] সৌরজগতের বাইরে বিভিন্ন নেবুলায় পলিসাইক্লিক অ্যারোম্যাটিক হাইড্রোকার্বন (PAH) পাওয়া গেছে।[৯]

অগভীর জলাভূমিতে,[১০] উষ্ণ প্রস্রবণে[১১] এবং গভীর সমুদ্রে হাইড্রো-থারমাল জ্বালামুখের আশেপাশে[১২] অনেকসময় মিথানোজেনিক ব্যাক্টেরিয়া পাওয়া যায়, যারা বায়ুমণ্ডলীয় কার্বন ডাইঅক্সাইড বিজারণ করে মিথেন উৎপন্ন করে।

কিছু সরল হাইড্রোকার্বন

কার্বন পরমাণুর সংখ্যাঅ্যালকেন (একবন্ধন)অ্যালকিন (দ্বিবন্ধন)অ্যালকাইন (ত্রিবন্ধন)সাইক্লোঅ্যালকেনঅ্যালকাডাইন
মিথেন----
ইথেনইথিন (ইথিলিন)ইথাইন (অ্যাসিটিলিন)
প্রোপেনপ্রোপিন (প্রোপিলিন)প্রোপাইন (মিথাইল অ্যাসিটিলিন)সাইক্লোপ্রোপেনপ্রোপাডাইন (অ্যালিন)
বিউটেনবিউটিনবিউটাইনসাইক্লোবিউটেন১,৩-বিউটাডাইন
পেন্টেনপেন্টিনপেন্টাইনসাইক্লোপেন্টেনপেন্টাডাইন (পাইপেরিলিন)
হেক্সেনহেক্সিনহেক্সাইনসাইক্লোহেক্সেনহেক্সাডাইন
হেপ্টেনহেপ্টিনহেপ্টাইনসাইক্লোহেপ্টেনহেপ্টাডাইন
অক্টেনঅক্টিনঅক্টাইনসাইক্লোঅক্টেনঅক্টাডাইন
ননেনননিনননাইনসাইক্লোননেনননাডাইন
১০ডেকেনডেকিনডেকাইনসাইক্লোডেকেনডেকাডাইন

ব্যবহার

তৈল শোধনাগারে খনিজ তেল শোধন করে জ্বালানির জন্য বিভিন্ন হাইড্রোকার্বন পরিস্রুত করা হয়

হাইড্রোকার্বন বর্তমানে মানবসভ্যতার প্রধান শক্তি উৎস।[১৩] জ্বালানি হিসাবে দহনের ফলে হাইড্রোকার্বন থেকে যে বিপুল শক্তি নির্গত হয় তার সর্বাধিক ব্যবহার তড়িৎশক্তি ও তাপশক্তি উৎপাদনে। দহনের ফলে উৎপন্ন তাপ দিয়ে জল বাষ্পীভূত করে সেই বাষ্প চালনা করে ইঞ্জিন চালানো যায় ও টারবাইন ঘুরিয়ে তড়িৎ উৎপাদন করা যায়।

একটি এলপিজি গ্যাস বার্নার। এলপিজি খনিজ তেল থেকে শোধন করা হয়।

হাইড্রোকার্বনের শক্তি-উৎস হিসাবে ব্যবহারের মূলে আছে এর দহন বিক্রিয়া। হাইড্রোকার্বন অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়া করে জল ও কার্বন ডাইঅক্সাইড উৎপন্ন করে। এর সাথে নির্গত হয় প্রচুর শক্তি, কারণ দহন একটি তাপমোচী প্রক্রিয়া। সরলতম অ্যালকেন মিথেনের বিক্রিয়া হলঃ

CH4 + 2 O2 → 2 H2O + CO2 + শক্তি (-৮৮৯ KJ/mol)

অপর্যাপ্ত অক্সিজেনের উপস্থিতিতে কার্বন মনক্সাইড তৈরি হয়।

2 CH4 + 3 O2 → 2CO + 4H2O + শক্তি

যেকোনো অ্যালকেনের দহনের সাধারণ বিক্রিয়াঃ

CnH2n+2 + (3n+1)/2 O2 → (n+1) H2O + n CO2 + শক্তি

মিথেন ও ইথেন ঘরের তাপমাত্রায় গ্যাসীয় এবং চাপ-প্রয়োগে তরলীভূত করা অসুবিধাজনক। প্রোপেন ও বিউটেন চাপ-প্রয়োগে সহজেই তরলে পরিণত হয়, এবং রান্নার জ্বালানি এলপিজি থেকে শুরু করে সিগারেট লাইটার পর্যন্ত সর্বত্র এদের ব্যবহার। পেন্টেন ও হেক্সেন সাধারণ তাপমাত্রায় তরল। গবেষণাগারে ও কলকারখানায় পেন্টেন ও হেক্সেন উচ্চ আণবিক ভরবিশিষ্ট মোম ও তেলজাতীয় পদার্থের জন্য নন-পোলার গন্ধহীন দ্রাবক হিসাবে ব্যবহৃত হয়।

অ্যালকেন ও অ্যালকাইন এবং তাদের নানারকম যৌগ থেকে তৈরি হয় বিভিন্ন পলিমার যেমন পলিথিন, পলিপ্রোপিলিন এবং পলিস্টাইরিন।

৬ থেকে ১০ কার্বনবিশিষ্ট হাইড্রোকার্বন হল গ্যাসোলিন, ন্যাপথা ও জেট-জ্বালানির প্রধান উপাদান। কার্বনসংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হাইড্রোকার্বনের গলণাঙ্ক, স্ফূটনাঙ্ক, সান্দ্রতা এবং মসৃণকরন সূচক (লুব্রিকেটিভ ইন্ডেক্স) বাড়তে থাকে। রং শিল্প, পিচ তৈরি, ক্রিয়োজোট জাতীয় কাষ্ঠ সংরক্ষক প্রভৃতি বিবিধ শিল্পে এইসব হাইড্রোকার্বনের ব্যবহার আছে।[১৪]

যেহেতু ক্লোরোফ্লুরোকার্বন ওজোন স্তরের ক্ষতি করে, তাই বর্তমানে ক্লোরোফ্লুরোকার্বনের বদলে এরোসল স্প্রে-র প্রপেল্যান্ট হিসাবে উদ্বায়ী হাইড্রোকার্বন ব্যবহৃত হচ্ছে।[১৫]

তথ্যসূত্র

🔥 Top keywords: রাম নবমীমুজিবনগর দিবসপ্রধান পাতামুজিবনগর সরকারবিশেষ:অনুসন্ধানইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগএক্স এক্স এক্স এক্স (অ্যালবাম)বাংলাদেশবাংলা ভাষামিয়া খলিফারাজকুমার (২০২৪-এর চলচ্চিত্র)আনন্দবাজার পত্রিকাআবহাওয়ারামপহেলা বৈশাখউয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগইসরায়েলইরানরবীন্দ্রনাথ ঠাকুরমুজিবনগরইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউনরিয়াল মাদ্রিদ ফুটবল ক্লাব২০২৪ ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগক্লিওপেট্রাচর্যাপদভূমি পরিমাপশেখ মুজিবুর রহমানজনি সিন্সকাজী নজরুল ইসলামঈদুল আযহাফিলিস্তিনইউটিউবভারতবিকাশআসসালামু আলাইকুমসৌদি আরববাংলা প্রবাদ-প্রবচনের তালিকামুহাম্মাদ