মিশরের প্রথম রাজবংশ
মিশরের প্রথম রাজবংশের ফারাওদের অধীনেই মিশর প্রথম একটি ঐক্যবদ্ধ রাজ্য হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। শুরুর দিকে এর প্রশাসনিক কেন্দ্র ছিল থিনিস।[১] দ্বিতীয় রাজবংশের সাথে একত্রে প্রথম রাজবংশের শাসনকালকে মিশরের আদি রাজত্ব হিসেবে সাধারণভাবে গণ্য করা হয়ে থাকে।
তৃতীয় নাকাদা সংস্কৃতির অবসান ও প্রথম রাজবংশের উত্থান প্রায় একই সময়ের ঘটনা। মোটামুটি ৩০৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ২৮৯০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত এই রাজবংশের বিস্তার (যদিও নির্ণয় পদ্ধতির পার্থক্য অনুসারে এই সময়কাল নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে কিছুটা হলেও মতবিরোধ আছে)।
ঐক্যবদ্ধ রাজ্য হিসেবে মিশরের পত্তন ছাড়াও এই রাজবংশের অন্যতম কৃতিত্ব হল প্রশাসনিক কাঠামো নির্মাণ ও এমন কিছু প্রশাসনিক ও রাজকীয় রীতিনীতির প্রচলন, যা পরবর্তীকালেও মিশরে অনুসৃত হয়। তবে প্রাক্তন স্বাধীন অঞ্চলগুলির প্রশাসনিক ব্যবস্থা অনেকাংশেই অপরিবর্তিত রেখেই এই আমলে বিভিন্ন প্রদেশ বা নোমের পত্তন ঘটানো হয়। তৃতীয় রাজবংশের সূচনাপর্বে উচ্চ মিশরে এরকম ১৬টি ও নিম্ন মিশরে ১০টি নোমের খোঁজ পাওয়া গেছে।
নৃপতিবর্গ
প্রথম রাজবংশের ফারাওদের ক্রমতালিকা সম্বন্ধে আজ ঐতিহাসিকরা অনেকটাই নিশ্চিত। এই রাজবংশের প্রথম ফারাও ছিলেন মেনেস অথবা নারমের, শেষ শাসক ছিলেন কা। এই বংশের আটজন নৃপতির কথা জানতে পারা যায়। এঁদের সকলেই আবিডোসে সমাধিস্থ হন। এই রাজবংশের প্রায় শেষ পর্যন্ত ঐতিহ্যানুসারে রাজার মৃত্যুর পর তাঁর নিকটাত্মীয় ও বিশ্বস্ত কর্মচারীদেরও রাজার সাথেই সমাধিস্থ করা হত। রাজার কবরের পাশেই ছোট ছোট বর্গাকার কবরে রাজার সমাধিস্থলেই তাদেরও স্থান হত।[২][৩]
নৃপতিদের তালিকা
নাম | মন্তব্য | রাজত্বকাল[৪] (± ১০০ বৎসর) |
---|---|---|
নারমের | অন্য নাম মেনেস, প্রাচীন মিশরের প্রথম ফারাও এবং প্রথম রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে গণ্য হন | ৩০৫০ - ৩০০৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দ |
হোর-আহা | এঁকেও অনেকসময় মেনেস নামে শণাক্ত করা হয়ে থাকে; চিকিৎসাবিদ্যার চর্চা করতেন; লিবিয়া ও নুবিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধাভিযান পরিচালনা করেছিলেন | ৩০০৭ - ২৯৭৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দ |
নেইৎহোটেপ | সম্ভবত ফারাও আহা'র স্ত্রী; ছেলে দিয়ের'এর অভিভাবক হিসেবে রাজত্ব করেন | |
দিয়ের | লিবিয়ার সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করেন, সেখাত, কানান ও সিনাই'এর অংশবিশেষ জয় করেন; মিশরের পুনরৈক্যসাধন করেন। | ২৯৭৫ - ২৯২৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দ |
দিয়েত | মিশরের বাইরে অভিযান চালান; এঁর রাজত্বকালে একটি বড় দুর্ভিক্ষে রাজ্যের প্রভূত ক্ষতি সাধিত হয়। | ২৯২৭ - ২৯১৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দ |
মেরিতনেইৎ | অভিভাবক সম্রাজ্ঞী, ফারাও ডেন'এর মা। | |
ডেন | সিনাই'এ যুদ্ধাভিযান পরিচালনা করেন; তাঁর আমলে মিশরে একটি জনগণনা পরিচালিত হয়। | ২৯১৪ - ২৮৬৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দ |
আদিইব | ক্ষমতাদখলকারী বলে মনে করা হয়; তাঁর আমলে রাজনৈতিক অস্থিরতা লক্ষ করা যায়। | ২৮৬৭ - ২৮৬১ খ্রিস্টপূর্বাব্দ |
সেমেরখেৎ | ইনিও সম্ভবত ক্ষমতা জবরদখলকারী ছিলেন; তাঁর আমল অনেকগুলি বিদ্রোহের সাক্ষী | ২৮৬১ - ২৮৫৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দ |
কা | সাক্কারাতে এঁর সমাধিতেই মিশরে প্রথম সমাধি মন্দির পাওয়া গেছে। | .২৮৫৩ - ২৮২৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দ |
রাজকীয় ক্ষমতায় নারীদের গুরুত্ব
এই রাজবংশের আমলে মেয়েদেরও যে যথেষ্ট গুরুত্ব ছিল, তার প্রমাণ রাণী মেরিৎনেইত; ফারাও ডেনের আমলে তাঁর যে কতটা গুরুত্ব ছিল তা আন্দাজ করা যায় তার সমাধি থেকে। সমাধিটি যথেষ্ট বড়; তার উপর তাঁর নিজস্ব ব্যক্তিগত চিহ্ন (পিনতাদেরা) এবং ধর্মীয় আচার ও রীতি পালনের জন্য নিজস্ব জায়গা; সমাধিস্থলটিও যথেষ্ট বড়, পৃথক ও রাজকীয়[৫] - এ'সব কিছুই তাঁর পৃথক রাজকীয় মর্যাদারই ইঙ্গিতবাহী।[৬] এর থেকে ঐতিহাসিকরা আন্দাজ করেন যে ফারাও ডেন'এর অল্পবয়সে একটা উল্লেখযোগ্য সময় ফারাও'এর হয়ে তিনিই হয়তো রাজকীয় কাজকর্ম দেখাশুনো করতেন।[৬] সেই কারণেই হয়তো ফারাও ডেন তাঁর মাকে সিংহাসনের যুগ্ম অধিকারীর সম্মান প্রদান করেছিলেন। অবশ্য মিশরের ইতিহাসে এ'রকম ঘটনার উদাহরণ আমরা পরেও দেখতে পাই, যেমন দ্বাদশ রাজবংশের রাণী নোফ্রুসোবেক বা অষ্টাদশ রাজবংশের রাণী হাতশেপসুত।[৭]
প্রশাসন
মিশরের প্রথম রাজবংশের শাসনকাল নানা কারণে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। এইসময় প্রশাসনিক বহু রীতির প্রথম প্রচলন ঘটে; নতুন নতুন প্রশাসনিক পদ্ধতির প্রয়োগও দেখতে পাওয়া যায়। যেমন, এইসময় থেকেই গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক অধিকর্তা ও রাজকীয় পরিবারের সদস্যদের জন্য হা-তিয়া (প্রাদেশিক গভর্নর), ইরি-পাৎ, আজ-মের, প্রভৃতি সম্মানসূচক পদবী ও পদ প্রচলিত হয়। ফারাও হোর-ডেন রাজকীয় উপাধির প্রচলন করে নিসুত-বিতি উপাধি গ্রহণ করেন; তাঁর উত্তরাধিকারী ফারাও আনেজিব এই উপাধিকেই কিছুটা পরিবর্তন করে নেবুই হিসেবে পরিচিত হন। প্রথম রাজবংশের প্রত্যেক শাসকই নিজেদের জন্য আলাদা আলাদা রাজকীয় প্রাসাদ নির্মাণ করান। সুনির্দিষ্ট বৈদেশিক নীতির রূপায়নের নজিরও আমরা এই আমলে লক্ষ করি। পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন সাম্রাজ্য, যেমন সিরিয়া, নুবিয়া বা লেভান্তের সঙ্গে সম্পর্কের নিরিখে এই সম্পর্ক নির্ধারিত হত। পশ্চিম দিকের প্রতিবেশী লিবীয়দের সাথে এইসময় মিশরের যুদ্ধবিগ্রহ ছিল একপ্রকার নৈমিত্তিক ঘটনা।
মিশরবিদরা অনেকেই সন্দেহ করেন, প্রথম রাজবংশের শেষের দিকে সিংহাসন নিয়ে দ্বন্দ্ব শুরু হয়; এর পরিণামেই আবিডোসের রাজকীয় সমাধিক্ষেত্র এইসময় লুটের শিকার হয়।[৮] এইসময় সিংহাসনে বসেন কিছু অখ্যাতনামা ফারাও, যেমন স্নেফেরকা, সেখেৎ বা হোরাস-বা; এঁদের সম্বন্ধে আমরা খুব একটা কিছু জানি না।
অর্থনীতি
- প্রথম রাজবংশকালীন মিশরে জমি ছিল ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসেবে ফারাও'এর সম্পত্তি; চাষী, গবাদি পশু, উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন যন্ত্রপাতি, খামার, প্রভৃতির সাথে এইসময় জমিও উৎপাদনের এক প্রয়োজনীয় উপাদান হিসেবেই গণ্য হত।[৯][১০] উৎপাদনের এইসব উপাদান পরিচালিত হত হয় কোনও নির্দিষ্ট প্রশাসনিক কেন্দ্র (কোনও দুর্গ, হুত) বা শহর (নিউত) থেকে। এইসব প্রশাসনিক কেন্দ্রগুলি হয় সরাসরি রাজকীয় প্রশাসনের উপরে নির্ভরশীল ছিল, নতুবা ছিল কোনও মন্দির বা রাজকীয় সমাধি কর্তৃপক্ষের অধীন। এছাড়া কিছু কিছু ক্ষেত্রে রাজকীয় প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্মচারীরাও তাদের পারিশ্রমিক হিসেবে জমি ভোগ করতে পারত।
- ব্যক্তিগত সম্পত্তির কোনও অস্তিত্ব ছিল না; দেবতাদের প্রতিনিধি হিসেবে ফারাওই ছিল সমস্ত কিছুর মালিক।[১০] কিন্তু বিভিন্ন প্রশাসনিক পদ বংশানুক্রমিক হওয়ায়, ও বিশেষ করে মৃতের সমাধি উপলক্ষে পাওয়া ভূসম্পত্তিকে কেন্দ্র করে ধীরে ধীরে কিছু বড় বড় পরিবার কোনও কোনও গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিল। সম্পত্তি হস্তান্তরের বিষয়টি সাধারণভাবে কেন্দ্রীয় প্রশাসনের দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হলেও, বসত বাড়ি প্রভৃতি যা সরাসরি সরকারি সম্পত্তি নয়, সেগুলির হস্তান্তর ব্যক্তিগত পর্যায়েও শুরু হয়েছিল।
- মোটামুটি ৩০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ নাগাদ মিশরে কৃষি অর্থনীতির পত্তন হয়। ফসলের নির্দিষ্ট অংশের ভাগের ভিত্তিতে কৃষিকার্য পরিচালিত হত। এই ভাগের পরিমাণ কৃষির সাথে যুক্ত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানগুলির নিজেদের মধ্যে বন্দোবস্ত অনুযায়ী ঠিক হত। কৃষিতে উৎপন্ন উদ্বৃত্ত ফসলের উপর নির্ভর করে বিনিময় প্রথা গড়ে উঠেছিল। পশুপালন, মাছ ধরা ও হস্তশিল্পেরও যথেষ্ট বিকাশ ঘটেছিল।[৯] বিশেষত শেষোক্ত ক্ষেত্রে কর্মচারীদের বেতন হিসেবে ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত উৎপন্ন দ্রব্যের পুনর্বণ্টনের ব্যবস্থা চালু ছিল।
- যদিও এই যুগে মিশরে আজকের অর্থে কোনও অর্থব্যবস্থা চালু হয়নি, বিনিময় ও সরকার নিয়ন্ত্রিত পুনর্বণ্টন প্রথাই ছিল যাবতীয় বাণিজ্যের মূল ভিত্তি, বিভিন্ন দ্রব্যের দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে তামা, রুপো ও সোনাকে কিছুদিনের মধ্যেই স্ট্যান্ডার্ড হিসেবে গণ্য করা শুরু হয়ে যায়।[১০]
- উর্বর নীলনদ উপত্যকায় উৎপন্ন ফসলের প্রাচুর্য, বৈচিত্র এবং তার পুনর্বণ্টন খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় সহস্রাব্দের প্রথমদিকে এমন একধরনের স্থিতিশীল অর্থনীতির বিকাশ ঘটায় যে, তীব্র অভাব ও অনাহারের পরিস্থিতি আগের তুলনায় অনেকটাই কমে আসে।
- সমস্ত ধরনের বৈদেশিক বাণিজ্যই রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হত। বিভিন্ন ধরনের কাঁচামাল (যেমন সোনা, রুপো, তামা, কাঠ, নানা ধরনের মূল্যবান পাথর) সংগ্রহের জন্য এইসময়ে সিনাই, আরবের পার্বত্য অঞ্চল, নুবিয়া প্রভৃতি অঞ্চলে সাময়িক অভিযান পরিচালনা করা হত; আরও পূর্বের দূরবর্তী অঞ্চলগুলির সাথেও এই উদ্দেশ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল। খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় সহস্রাব্দের প্রথমদিকে, বিশেষত প্রথম রাজবংশের প্রথম দিকের সমাধিগুলিতে সিরীয়-প্যালেস্তিনীয় অঞ্চলের সেরামিক বা চীনামাটির পাত্র বা ব্রোঞ্জের সরঞ্জামের যে প্রাচুর্য পরিলক্ষিত হয়, তা নিঃসন্দেহে প্রমাণ করে এই সময়ে এইসব দূরবর্তী দেশের সাথে দৃঢ় বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল। হয়তো মিশরের সোনা এইসব বাণিজ্যিক বিনিময়ের ক্ষেত্রে এক উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিল।[১১]