রাই (শস্য)
রাই (Secale cereale) একপ্রকার ঘাস যা খাদ্যশস্য এবং গবাদি পশুর খাবার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এটি গম এর সমগোত্রীয় এবং গম, যব ও জই এর সাথে সম্পর্কীত। রাই দানা আটা, রুটি, মদ এবং গৃহপালিত পশুর খাদ্য উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়। এটি সিদ্ধ করে অথবা পিষ্ট করে গোটা আকারেও খাওয়া যায়।
রাই | |
---|---|
রাই গাছ | |
বৈজ্ঞানিক শ্রেণীবিন্যাস | |
জগৎ: | উদ্ভিদ |
বর্গ: | Poales |
পরিবার: | Poaceae |
উপপরিবার: | Pooideae |
গোত্র: | Triticeae |
গণ: | Secale |
প্রজাতি: | S. cereale |
দ্বিপদী নাম | |
Secale cereale L. | |
প্রতিশব্দ | |
Secale fragile M.Bieb., "রাই" |
রাই একপ্রকার খাদ্যশস্য এবং বাগান এর রাই ঘাস বা গবাদিপশুর খড়ের সাথে একে মেলানো উচিত নয়।
ইতিহাস
মধ্য এবং পূর্ব তুরস্কের নিকটবর্তী এলাকায় বন্যভাবে জন্মানো শস্যগুলোর মধ্যে রাই একটি। নব্য প্রস্তর যুগে এশিয়া মাইনর অঞ্চলে আবাদ করা শস্য হিসাবে রাই এর চাষ ক্ষুদ্র পরিসরে শুরু হয়।[১] কিন্তু মধ্য ইউরোপে ব্রোঞ্জ যুগের (১৮০০-১৫০০ খ্রীষ্টপূর্ব) পূর্ব পর্যন্ত রাই আবাদের কোন প্রত্নতাত্ত্বিক ইঙ্গিত নেই।[২] সম্ভবত রাই গমেরই একটা প্রকারভেদ হিসেবে বর্তমান তুরস্ক (এশিয়া মাইনর) হতে ইউরোপে পৌছায় এবং পরবর্তী পর্যায়ে পৃথক খাদ্যশস্য হিসেবে চাষ হতে শুরু করে। রোমান সভ্যতার বিভিন্ন নির্দশনে রাই এর অস্তিত্ব লক্ষ্যনীয়,[৩] যদিও প্রাচীন রোমান দার্শনিক লিনি রাই কে অভিহিত করেন "এটি খুবই দরিদ্র খাবার এবং ক্ষুধা দূর করতেই ব্যবহার হয়"[৪] এবং "পাকস্থলির জন্য আদর্শ নয়" হিসেবে।[৫]
মধ্যযুগ হতে মধ্য এবং পূর্ব ইউরোপে ব্যাপক হারে রাই এর চাষ শুরু হয়। ফ্রেঞ্চ-জার্মান সীমান্তের পূর্বে এবং হাংগেরির উত্তরে প্রধান খাদ্য উপাদান হিসেবে রাই এর আবাদ হয়। দক্ষিণ ইউরোপে এর আবাদ নগন্য।
মানবসভ্যতার যাযাবর জীবনযাত্রার যুগে সিরিয়ার উত্তরের ইউফ্রেতিস উপত্যকার টেল আবু হুরায়রা অঞ্চলে রাই চাষের উপকথা প্রচলিত, যদিও আধুনিক কালে এই দাবী প্রশ্নবিদ্ধ।[৬] সমালোচকরা প্রমাণ হিসেবে রেডিওকার্বন ডেটিং এবং শুধুমাত্র শস্যদানা প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপনকে নির্দেশ করেন।[৭]
চাষের বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি
শীতকালে রাই এর চাষ করা হয় ভুমিক্ষপ্য রোধ করতে। শীতকালেও সামান্য রোদের উপস্থিতিতেই এটি বাড়ে। শীতকালে আগাছার বিস্তৃতি রোধেও রাই ব্যবহার হয়। শীতকালীন রাই শস্য হিসেবে বাজারজাত করা যায়,[৮] অথবা চাষের পর খেত হতে না তুলে খেতেই রেখে দেয়া হয় পচন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে উর্বরতা বৃদ্ধির জন্য।
পাতা গুবরে, মাছি, বিভিন্ন রকম পোকা রাই চাষে নেতিবাচক ভুমিকা পালন করে।[৯]
উৎপাদন এবং খাদ্যগ্রহন
রাই প্রধানত পূর্ব, মধ্য ও উত্তর ইউরোপে আবাদ হয়। রাই আবাদের বৃত্ত উত্তর জার্মানি হতে পোল্যান্ড, ইউক্রেন, বেলারুশ, লিথুনিয়া এবং লাটভিয়া সহ উত্তর রাশিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত। উত্তর আমেরিকার যুক্তরাস্ট্র এবং কানাডায়, দক্ষিণ আমেরিকার আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল এবং চিলিতে, ওশেনিয়ার অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডে, এশিয়ার তুরস্ক, কাজাখস্তান এবং চীনের উত্তরাঞ্চলে রাই এর আবাদ হয়।
রাই উৎপাদনের হার ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে। উদাহরনস্বরুপ, রাশিয়াতে ১৯৯২ সালে ১৩.৯ মেট্রিক টন রাই উৎপাদন হয়, পরবর্তীতে ২০১২ সালে ২.১ মেট্রিক টন রাই উৎপাদন হয়। একইভাবে পোল্যান্ডে ১৯৯২ সালে ৫.৯ মেট্রিক টন হতে ২০০৫ এ ২.৯ মেট্রিক টন, জার্মানিতে ৩.৩ মেট্রিক টন হতে ৩.৯ মেট্রিক টন, বেলারুশে ৩.১ মেট্রিক টন হতে ১.১ মেট্রিক টন, চীনে ১.৭ মেট্রিক টন হতে ০.৭ মেট্রিক টন উৎপাদন হয়।[১০] বেশিরভাগ উৎপাদিত রাই উৎপাদনকারী দেশেই খাদ্যের চাহিদা মেটাতে ব্যবহার হয় অথবা পাশ্ববর্তী দেশে রপ্তানী হয়। রাই এর আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা সীমিত।
রোগবালাই
রাই এরগোট ছত্রাকের দ্বারা সহজেই আক্রান্ত হয়।[১১][১২] এরগোট ছত্রাক আক্রান্ত রাই খেলে মানুষ এবং গবাদি পশুর "এরগোটিজম" নামক রোগ হতে পারে। এরগোটিজম খিচুনি, দৃষ্টি বিভ্রম, মিসক্যারেজ এমনকি মৃত্যুর মত মারাত্মক শারীরিক ও মানসিক সমস্যা সৃষ্টি করে। ঐতিহাসিকভাবে, রাই এর উপর নির্ভরশীল আর্দ্র উত্তরের দেশগুলোতে নির্দিষ্ট সময় পর পর এরগোটিজম মহামারী আকার ধারণ করতো। অনেক সময় এরগোটিজমের আগমনের জন্য সাধারণ মানুষকে ডাইনিরুপে অভিযোগ করা হতো। এই প্রথা ইউরোপে ও দক্ষিণ আমেরিকায় প্রচলিত ছিলো।[১৩]
ব্যবহার
শীর্ষ ১০ রাই রপ্তানীকারক দেশ (মেট্রিক টন এককে) | |
---|---|
জার্মানি | ৩৮৯৩০০০ |
পোল্যান্ড | ২৮৮৮১৩৭ |
রাশিয়া | ২১৩১৫১৯ |
বেলারুশ | ১০৮২৪০৫ |
গণচীন | ৬৭৮০০০ |
ইউক্রেন | ৬৭৬৮০০ |
ডেনমার্ক | ৩৮৪৪০০ |
তুরস্ক | ৩৭০০০০ |
কানাডা | ৩৩৬৬০০ |
স্পেন | ২৯৬৭০০ |
বিশ্ব মোট | ১৪ ৬১৫ ৭১৯ |
উৎস: এফএও [১০] |
রাই এর আটার রুটি ইউরোপের উত্তর ও পূর্বে বহুত প্রচলিত।[১৪][১৫] রাইএর আটা গিলাডিনে পুর্ন কিন্তু এতে গ্লুটেনিনের হার কম। এতে গ্লুটেনিনের হার গমের আটা হতেও কম। এতে উচ্চহারে আশতন্তু বিদ্যমান।[১৬]
রাই এর দানা মদ তৈরিতে ব্যবহার হয়। রাই এর অন্যান্য ব্যবহারের মধ্যে রয়েছে প্রাকৃতিক রোগনিরামক প্রস্তুতি। এছাড়াও রাই এর খড় গবাদিপশুর খাদ্য আকারে এবং হস্তশিল্প তৈরিতে ব্যবহার হয়।
আবাদ
রাই অপেক্ষাকৃত অনুর্বর জমিতেও জন্মে। যার ফলে এটি বালুপুর্ন জমির অঞ্চলসমুহের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। রাই গুল্ম প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় অন্যান্য ছোট ফসল হতে বেশি পারদর্শী। তুষার আবৃত অঞ্চলে গম আবাদ না করা গেলেও রাই আবাদ করা যায়। অধিকাংশ চাষী শীতকালে রাই রোপন করেন। বসন্তকালে রাই পাকে এবং সংগ্রহের উপযোগী হয়।[১৩]
গ্রীষ্মকালীন রাই দ্রুত বর্ধনশীল হয়। গ্রীষ্মের মাঝামাঝি এসেই এরা তাদের সর্বোচ্চ উচ্চতা ১২০ সেন্টিমিটার (৪ ফিট) এ পৌছায়। একই সময়ে শীতকালীন রাই অঙ্কুরোদগম হয়। দ্রুত বর্ধনের হার আগাছার বিস্তৃতি রোধ করে। এজন্য রাই চাষে কিটনাশক প্রয়োজন হয় না।
রাই গুল্ম গমের খেতে অনাকাঙ্খিত ফসল রুপে দেখা যায়। এদের নির্মুল না করা হলে গমের উৎপাদন এবং বাজারমুল্য হ্রাস পায়।[১৭]
পরিবেশগত প্রভাবকসমুহ
রাই এর পরিবেশ ও ভৌগোলিক সহনশীলতা পূর্বে আলোচিত হয়েছে। গবেষকরা রাই গাছে কিছু নির্দিষ্ট প্রোটিন চিনহিত করেছেন, যা একে ঠান্ডা পরিবেশেও জীবিত রাখে। এই প্রজাতির ঠান্ডা সহনশীলতার ক্ষমতার প্রকৃতি বিভিন্ন প্রাণী, যেমন মাছ বা কিটপতঙ্গের ঠান্ডা সহনশীলতার ক্ষমতার প্রকৃতি হতে ভিন্ন। নির্দিষ্টভাবে, রাই গাছের পাতা শীতকালে বিভিন্ন প্রকারের পলিপেপটিড উৎপন্ন করে যা একে ঠান্ডা সহনশীলতার ক্ষমতা প্রদান করে। এই পলিপেপটিড বিভিন্ন মাছ ও কিটপতঙ্গের উৎপন্ন পলিপেপটিড হতে ভিন্ন।[১৮] চরমভাবাপন্ন পরিবেশে জীবনধারনের ক্ষমতা ছাড়াও, রাই গাছ উর্বরতা বৃদ্ধির জন্য সুপরিচিত। যদিও সাম্প্রতিককালে রাই গাছের বায়োমাস হতে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরনের প্রমাণ মিলেছে। বিশেষভাবে রাই চাষের সময় মিথেন গ্যাস নিঃসরিত হয়। তবে মিথেনের নিঃসরনের হার রাই চাষের বিভিন্ন পর্যায়ে পরিবর্তন হয়। শস্য কাটার ঠিক পূর্ব পর্যায়ে মিথেন নিঃসরনের হার সর্বোচ্চ, এবং ফুল আসার আগে তা সর্বনিম্ন। এই তথ্যটি আনন্দের কারণ ফুল আসার পরই রাই এর পুষ্টিগুন বৃদ্ধিপায়। এই পদ্ধতিতে রাই গাছের পরিবেশের উপর নেতিবাচক প্রভাব হ্রাস করা যায়।[১৯]
বিস্তৃতি এবং ব্যবহার
রাই গাছের পরিবেশের উপর প্রভাবই শুধু নয়, এর বহুবিধ ব্যবহারের জন্যও রাই গুরুত্বপূর্ণ। পর্তুগালের উত্তরাঞ্চলের ১৪ টি পৃথক প্রজাতির রাই এর উপর গবেষণা চালিয়ে পর্যবেক্ষণ করা হয় যে, সংরক্ষণধর্মী প্রোটিনগুলো বিভিন্ন প্রকার এবং বিভিন্নরকম জীনগত প্রকরন বিদ্যমান। এই পদ্ধতিতে বিভিন্ন গুনাবলির সংমিশ্রন ঘটিয়ে সবচেয়ে উপযোগী রাই প্রজাতি উদ্ভাবন করা সম্ভব।[২০] একইভাবে রাই এর জীনগত গুনাবলী ব্যবহার করে অন্যান্য ফসলেরও সহনশীলতা বৃদ্ধি করা সম্ভব, যেমন গম। রাই এর সাথে ক্রস-পরাগায়নের ফলে গমের পরাগায়ন ক্ষমতা বহুলাংশে বৃদ্ধি পায়। রাই এর 4R ক্রোমজোম গমের আশের আকার বৃদ্ধি করে এবং পরাগরেনুর সংখ্যা বৃদ্ধি করে।[২১] এছাড়াও বিভিন্ন রাই এর প্রজাতি সংমিশ্রন ঘটিয়ে উচ্চফলনশীল হাইব্রিড রাই প্রজাতি S. cereanum উদ্ভাবন করা হয়, যা বিভিন্ন পরিবেশে উৎপাদন সম্ভব। একই সঙ্গে উচ্চফলনশীল রাই প্রজাতিতে হজমযোগ্য তন্তু ও প্রোটিন ওধিক পরিমানে রয়েছে।[২২] রাই এর উপর সংঘটিত গবেষণা ভবিষ্যত পৃথিবীর খাদ্যচাহিদা পুরনে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করবে।
শস্য সংগ্রহ প্রক্রিয়া
রাই সংগ্রহ পদ্ধতি গমের সাথে সংগতিপুর্ন। সংযুক্ত চাষ পদ্ধতিতে এটি করা হয়, রাই গাছ কর্তন, আটি বাধা এবং মাড়াই, খড় পৃথকীকরন ইত্যাদি। সংগ্রহিত শস্যদানা স্থানীয় খাদ্যগুদাম অথবা শস্যাগারে সংরক্ষণ করা হয়। যান্ত্রিক চাষাবাদ যুগের আবির্ভাবের পূর্বে রাই আবাদ বিভিন্ন কাস্তে, কোদাল ও লাঙ্গলের সাহায্যে করা হতো।[২৩][২৪] রাই সংগ্রহ করা হতো আশগুলোকে হাতে মাড়াই করে।
স্বাস্থ্যঝুঁকি
গম, যব, এবং এদের উচ্চফলনশীল প্রকারভেদের ন্যায় রাই এও গ্লুটেন আছে, যা একে গ্লুটেন সংক্রান্ত বিভিন্ন অসুখ, যেমন সেলিয়াক অসুখ, নন-সেলিয়াক গ্লুটেন স্পর্শকাতরতা এবং গম এলার্জিতে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য অনুপযোগী করে।[২৫] কিছুসংখ্যক গম এলার্জি যুক্ত ব্যক্তি অবশ্য রাই সহ্য করতে পারেন।[২৬]
এরগোটিজম একপ্রকার অসুস্থতা যা এরগোট ছত্রাক আক্রান্ত রাই খেয়ে হতে পারে। এরগোট ছত্রাক আক্রান্ত রাইয়ে LSD-25 নামক বিষাক্ত উপাদান প্রস্তুত করে। এরগোটিজম বিংশ শতাব্দীতে প্রচলিত ছিলো, আধুনিক সময়ে উন্নত খাদ্য নিরাপত্তা উদ্যোগের জন্য এরগোটিজম আর প্রচলিত নয়। তা সত্বেও খাদ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রে কঠোরতা বজায় না থাকলে এরগোটিজম পুনরায় আবির্ভুত হতে পারে।[২৭]
তথ্যসূত্র
বহিঃসংযোগ
- Schlegel, Rolf; Korzun, V. (২০১৬)। "Genes, Markers, and Linkage Data of Rye (Secale cereale L.)"। 08.16। এপ্রিল ১৩, ২০১৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ জুলাই ১২, ২০১৬।
- Schlegel, Rolf (২০১৬)। "Current List of Wheats with Rye and Alien Introgression"। Rye-Gene-Map.de। 05.16। মে ২৭, ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ জুলাই ১২, ২০১৬।
- "Growing Rye"। ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ জুলাই ১২, ২০১৬ – University of North Texas Library, Government Documents Department-এর মাধ্যমে।