আল জাজিরা
আল জাজিরা (আরবি: الجزيرة al-ǧazīrah আইপিএ: [æl dʒæˈziːrɐ]), এছাড়াও আলজাজিরা হিসাবে পরিচিত এবং জেএসসি হল আল জাজিরা মিডিয়া নেটওয়ার্ক মালিকানাধীন এবং কাতারের দোহা সদর দফতর থেকে সম্প্রচারিত একটি সংবাদভিত্তিক টেলিভিশন চ্যানেল।[১] প্রাথমিকভাবে এটি আরবি ভাষায় চালু হলেও বর্তমানে স্যাটেলাইট চ্যানেলটি টিভি চ্যানেল হিসেবে আল জাজিরা থেকে একাধিক ভাষায় ইন্টারনেট এবং বিশিষ্ট টিভি চ্যানেল সহ বিশ্বের বিভিন্ন নেটওয়ার্কের সঙ্গে ক্রমবর্ধমানভাবে প্রসারিত হচ্ছে। আল জাজিরা বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রবেশ করেছে। আল জাজিরা কাতার সরকার মালিকানাধীন চ্যানেল।[১][২][৩][৪][৫][৬]
আল জাজিরা স্যাটেলাইট চ্যানেল | |
---|---|
উদ্বোধন | ১ নভেম্বর ১৯৯৬ |
মালিকানা | আল জাজিরা মিডিয়া নেটওয়ার্ক |
স্লোগান | "দ্যা ওপিনিয়ন এন্ড দ্যা আদার ওপিনিয়ন" |
দেশ | কাতার |
ভাষা | আরবি |
প্রচারের স্থান | বিশ্বব্যাপী |
প্রধান কার্যালয় | দোহা, কাতার |
ভ্রাতৃপ্রতিম চ্যানেল(সমূহ) | আল জাজিরা ইংরেজি, আল জাজিরা মুবাসসার, আল জাজিরা বলকানস, আল জাজিরা তুর্ক, আল জাজিরা ডকুমেন্টারি |
ওয়েবসাইট | Al Jazeera Arabic |
প্রাপ্তিস্থান | |
টেরেস্ট্রিয়াল | |
নিলস্যাট | ইউএইচএফ সার্ভিস |
ফ্রিভিউ এইচডি (ইউকে) | চ্যানেল ৮৪ |
কৃত্রিম উপগ্রহ | |
আরবস্যাট | 12034 H - 27500 - 3/4 |
yes (Israel) | Channel 176 |
ক্যাবল | |
Virgin Media (UK) | Channel 831 |
Mozaic TV | Channel 100 |
CableVision (Lebanon) | Unknown |
Various cable systems in various countries | Check Local listings |
স্ট্রিমিং মিডিয়া | |
আলজাজিরা.নেট | https://aljazeera.net/live |
২০১৭ সালের জুন মাসে, কাতার কূটনৈতিক সংকট চলাকালিন সময়ে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, মিশরিয় সরকার চরমপন্থিদের সমর্থনের অভিযোগে আল জাজিরার মালিকানাধীন সকল কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়ার দাবি জানায়।[৭][৮] সংবাদ মাধ্যমটির বিরুদ্ধে "কাতারি প্রোপাগান্ডা" ছড়ানোর অভিযোগে অনেক সংগঠন ও রাষ্ট্র দ্বারা সমালোচিত।[৯][১০][১১]
শব্দতত্ত্ব
আরবিতে, আল-জাজিরাহ আক্ষরিক অর্থে "দ্বীপ" বোঝায়। এখানে আরব উপদ্বীপকে বোঝান হয়েছে।[১২] যেটি شبه الجزيرة العربية সিব আল-জাজিরাহ, আল-আরাবিয়াহ, সংক্ষিপ্তভাবে الجزيرة العربية আল-জাজিরাহ আল-আরাবিয়া।
ইতিহাস
আল জাজিরা স্যাটেলাইট চ্যানেল (বর্তমানে এ.জে.এ.) ১৯৯৬ সালের ১ নভেম্বর অরবিট কমিউনিকেশন কোম্পানির যৌথ উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়।[১৩] এটি প্রতিষ্ঠার পূর্বে মধ্যপ্রাচ্যে বিবিসির আরবি ভাষার চ্যানেলটি বেশি জনপ্রিয় ছিল। কিন্তু সৌদি আরব সরকার দ্বারা এটিকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয়েছিল। তাই প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ হয়ে যায়। ফলে বিবিসিতে কর্মরত বহু কর্মী কাজ হারান। এ কর্মীদের আল জাজিরা নিজেদের প্রতিষ্ঠানে নিয়ে যায়। ফলে আল জাজিরা অনেক মজবুত একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়।[১৪]
১ নভেম্বর ১৯৯৬ সালে,আল জাজিরা প্রথম দিনের মতো সম্প্রচার শুরু করে। এটি শুরুতে দৈনিক ৬ ঘন্টা সম্প্রচার করত। ১৯৯৭ সালের শেষ নাগাদ আল জাজিরা প্রতিদিন ১২ ঘন্টা সম্প্রচার চালায়। ১৯৯৯ সালের প্রথম দিনে,আল জাজিরা ২৪ ঘন্টা সম্প্রচার শুরু করে। তখন আল জাজিরা আরব অঞ্চলে একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্কে পরিণত হয় ও এটির জনপ্রিয়তা বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে যায়। ২০০১ সালে আল জাজিরা নিজেদের একটি আরবি ভাষার ওয়েবসাইট চালু করে।[১৫]
আফগানিস্তান যুদ্ধ
২০০১ সালে নিউইয়র্কের টুইন টাওয়ারে হামলার পর যখন যুক্তরাষ্ট্র আল কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেন ও তালেবান সদস্যদের বিরুদ্ধে আফগানিস্তানে অভিযান পরিচালনা করছিল,তখন আল জাজিরা ওসামা বিন লাদেন ও তালেবান থেকে প্রাপ্ত চিত্রগুলো সম্প্রচার করছিল। তখন অনেকে আল জাজিরাকে "সন্ত্রাসীদের কন্ঠ" বলে আখ্যায়িত করেন।[১৬] তবে এ কারণে আল জাজিরা প্রচুর আরব দর্শক অর্জন করে।[১৭][১৮]
অন্যান্য আরো অনেক টিভি চ্যানেল ফুটেজগুলো আল জাজিরা থেকে অর্থের বিনিময়ে ক্রয় করতে আগ্রহী হয়। এ সময় আল জাজিরার গুরুত্ব সারাবিশ্বে বেড়ে যায় কারণ তখন আফগানিস্তানের অভ্যন্তরে আল জাজিরার একটি ব্যুরো ছিল ফলে আল জাজিরা পুরো ঘটনাটি নিকট থেকে কভার করতে সক্ষম হয়। এ সময় আল জাজিরার ফুটেজগুলোর মূল্য প্রায় আড়াই লক্ষ ডলার পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়।[১৯]
২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের একটি ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় আল জাজিরার কাবুল ব্যুরো ধ্বংস হয়ে যায়।[২০]
আফগানিস্তানে আল জাজিরার বিপুল চাহিদার পর নেটওয়ার্কটি বিশ্বের আরো অনেক সংঘাতপূর্ণ এলাকায় ব্যুরো স্থাপন করে।
২০০২ সালে সৌদি আরবের অর্থায়নে দুবাইয়ে আল আরাবিয়া নামের একটি চ্যানেল প্রতিষ্ঠা লাভ করে যা আল জাজিরার প্রতিযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচিত হয়।[২১]
২০০৫ সালে আল জাজিরা সাংবাদিক তাইসির আলোনি যিনি ৯/১১ হামলার কয়েক সপ্তাহে পর ওসামা বিন লাদেনের সাক্ষাতকারের দ্বায়িত্ব পান,তিনি স্পেনে গ্রেফতার হন[২২]। আলোনিকে আল কায়েদার সাথে ঘনিষ্ঠতার অভিযোগে দোষি সাব্যস্ত করা হয় ও ৭ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।[২৩]
২০০৩-এ,যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ইরাকে আক্রমণের পর আল জাজিরার ফুটেজের কদর সারাবিশ্বের সংবাদ মাধ্যমগুলোতে আরো বেড়ে যায়। সে বছরের ১ এপ্রিল,মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিমান আল জাজিরার বাগদাদ ব্যুরোতে আক্রমণ চালায় এবং এ আক্রমণে আল জাজিরার সাংবাদিক তারেক আইয়ুব নিহত হন[২৪]। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এ হামলাকে ভুল বলে অভিহিত করে। এরপর আল জাজিরা ইরাকে নিজেদের ব্যুরোর একটি মানচিত্র যুক্তরাষ্ট্রের কাছে সরবরাহ করে যাতে সেটি আক্রমণ থেকে রক্ষা পায়।[২৫]
২০১০ সালে তিউনিসিয়ার একজন প্রতিবাদী তরুণ মোহামেদ বুয়াজিজি-এর মৃত্যুর পর তিউনিসিয়ায় একটি বিক্ষোভের সূত্রপাত হয়। এ বিক্ষোভ আল জাজিরা সর্বপ্রথম সম্প্রচার করে[২৬][২৭]। ক্রমেই এ বিক্ষোভ পুরো আরব অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে এবং এটিকে আরব বসন্ত বলে আখ্যায়িত করা হয়।
কাতারের কূটনৈতিক সংকট ২০১৭-১৮
২০১৭ সালে কাতারের কূটনৈতিক সঙ্কটের সময় সৌদি আরব,সংযুক্ত আরব আমিরাত,বাহরাইন এবং মিশর কর্তৃক কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠার শর্তাবলীর মধ্যে একটি ছিল আল জাজিরা মিডিয়া নেটওয়ার্ক বন্ধ করা[২৮][২৯][৩০]। সে বছর সৌদি আরব,সংযুক্ত আরব আমিরাত ও জর্ডান আল জাজিরার সম্প্রচার নিষিদ্ধ করে[৩১][৩২]। সৌদি আরবের রিয়াদে অবস্থিত আল জাজিরার ব্যুরো বন্ধ করে দেওয়া হয়।[৩৩][৩৪]
কাতার সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আল জাজিরা বন্ধ করার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন ও এ সম্পর্কে যেকোনো আলোচনা করতে অস্বীকৃতি জানান[৩৫]। সে বছর আল জাজিরার সাইটগুলো সাইবার আক্রমণের শিকার হয়[৩৬]। আল জাজিরা বন্ধের এ দাবি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম দ্বারা সমালোচিত হয়।[৩৭]
শিরিন আবু আকলেহ হত্যা
২০২২ সালের ১১ মে,পশ্চিম তীরের জেনিন ক্যাম্পে ইসরায়েলি বাহিনীর একটি অভিযান চলাকালে সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে নিহত হন আল জাজিরার নারী সাংবাদিক শিরিন আবু আকলেহ।[৩৮] আল জাজিরার দাবি, ইসরায়েলি বাহিনী "ইচ্ছাকৃতভাবে" শিরিনকে গুলি করে হত্যা করেছে।[৩৯] তবে ইসরায়েল প্রাথমিকভাবে দাবি করে যে,ফিলিস্তিনি বন্দুকধারীর গুলিতে শিরিনের প্রাণ যায়।[৪০] আন্তর্জাতিকভাবে এ হত্যার প্রতিবাদে জানানো হয়।[৪১][৪২] তার অন্তোষ্টিক্রিয়ায় ইসরায়েলি পুলিশের সাথে ফিলিস্তিনিদের সংঘর্ষ হয়।[৪৩] জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এ হত্যার তদন্ত করে ও বেশিরভাগ সংস্থা ইসরায়েলি বাহিনীকে হত্যার জন্য দায়ী করে। ইসরায়েল এ অভিযোগ প্রথমে অস্বীকার করলেও, ২০২২ সালের ৫ সেপ্টেম্বর ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ স্বীকার করে যে ইসরায়েলি বাহিনীর গুলিতে "অনিচ্ছাকৃতভাবে" নিহত হয়েছেন।[৪৪] তবে এ ঘটনার যেকোনো তদন্ত ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষেত্রে ইসরায়েল অস্বীকৃতি জানায়।[৪৫][৪৬] ৬ ডিসেম্বর,২০২২ তারিখে, সাংবাদিক শিরিন আবু আকলেহকে হত্যার দায়ে,আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে মামলা করে আল জাজিরা।[৪৭][৪৮]
সমালোচনা
আল জাজিরা মিডিয়া নেটওয়ার্ককে কাতারের রাষ্ট্রীয় মদদপুষ্ট সংবাদ মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এর পেছনে একটি কারণ হলো প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই আল জাজিরা নিয়মিতভাবে কাতার সরকারের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমর্থন পেয়ে আসছে।[৪৯] এই সংবাদ মাধ্যমটি প্রতিষ্ঠা করাই হয়েছিলো কাতারের অর্থনৈতিক শক্তিকে রাজনৈতিক শক্তিতে রুপান্তরের লক্ষ্যে। [৫০] আল জাজিরা সংবাদ মাধ্যমটির সংবাদ সম্পাদনায় কাতার সরকারের সরাসরি হস্তক্ষেপেরর অভিযোগও রয়েছে।[৫১] ২০১০ সালে উইকিলিকস দ্বারা ফাঁস হওয়া যুক্তরাষ্ট্রীয় অভ্যন্তরীণ কূটনৈতিক তারবার্তায় কাতার সরকার নিজেদের কূটনৈতিক প্রয়োজন মাফিক আল জাজিরার সংবাদ সম্পাদনায় হস্তক্ষেপ করে বলে জানিয়েছিল।[৫২][৫৩][৫৪]
স্বাধীন সাংবাদিকতায় হস্তক্ষেপের অভিযোগে লন্ডন, বৈরুত, প্যারিস, মস্কো এবং কাইরোর একাধিক সাংবাদিক আল জাজিরা থেকে পদত্যাগ করেন।[৫৫][৫৬]