আলোর দ্রুতি

শূন্য মাধ্যমে ভরহীন বস্তু ও তদসংশ্লিষ্ট অন্যান্য ক্ষেত্র তথা তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গের দ্রুতি

শূন্য মাধ্যমে আলোর যে দ্রুতি পাওয়া যায়, সেটি একটি সার্বজনীন ভৌত ধ্রুবক, যা পদার্থবিজ্ঞানের অনেক ক্ষেত্র ও শাখায় গুরুত্বপূর্ণ। একে সাধারণত c দ্বারা চিহ্নিত করা হয়। শূন্যস্থানে আলোর দ্রুতি প্রতি সেকেন্ডে ঠিক ২৯,৯৭,৯২,৪৫৮ মিটারের সমান, যা প্রায় ৩ লক্ষ কিলোমিটার প্রতি সেকেন্ড বা ১.৮৬ লক্ষ মাইল প্রতি সেকেন্ড বা ৬৭১০ লক্ষ মাইল প্রতি ঘণ্টার সমতূল্য।[Note ৩] আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্ব অনুসারে c হচ্ছে চিরায়ত পদার্থ বা শক্তির দ্রুতির ঊর্ধ্ব সীমা এবং একইভাবে স্থান দিয়ে তথ্য বহনে সক্ষম কোনো সংকেতের দ্রুতির ক্ষেত্রেও এটি একটি ঊর্ধ্ব সীমা।[৪][৫][৬]

আলোর দ্রুতি
The distance from the Sun to Earth is shown as 150 million kilometres, an approximate average. Sizes to scale.
সূর্য থেকে পৃথিবীতে সর্যের আলো পৌঁছতে গড়ে প্রায় ৮ মিনিট ১৯ সেকেন্ড সময় লাগে।
সঠিক মান
মিটার প্রতি সেকেন্ড২৯৯৭৯২৪৫৮
আনুমানিক মান
কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা০৮০০০০০০০
মাইল প্রতি সেকেন্ড৮৬০০০
মাইল প্রতি ঘণ্টা[১]৬৭১০০০০০০
জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক একক প্রতি দিন১৭৩[Note ১]
পারসেক প্রতি বছর০.৩০৭[Note ২]
বিভিন্ন দূরত্ব গমনে আলোর সংকেতের আনুমানিক সময়
দূরত্বসময়
এক ফুট১.০ ন্যানোসেকেন্ড
এক মিটার৩.৩ ন্যানোসেকেন্ড
ভূস্থির কক্ষপথ থেকে পৃথিবীতে১১৯ মিলিসেকেন্ড
পৃথিবীর নিরক্ষরেখার সমান দৈর্ঘ্য১৩৪ মিলিসেকেন্ড
চাঁদ থেকে পৃথিবীতে১.৩ সেকেন্ড
সূর্য থেকে পৃথিবীতে (১ জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক একক৮.৩ মিনিট
এক আলোকবর্ষ১.০ বছর
এক পারসেক৩.২৬ বছর
সূর্যের নিকটতম তারা থেকে (১.৩ pc)৪.২ বছর
নিকটতম ছায়াপথ থেকে পৃথিবীতে২৫ হাজার বছর
আকাশগঙ্গা ছায়াপথ জুড়ে১ লক্ষ বছর
অ্যানড্রোমিডা ছায়াপথ থেকে পৃথিবীতে২৫ লক্ষ বছর

দৃশ্যমান-আলোসহ সকল প্রকার তড়িৎচুম্বকীয় বিকিরণ আলোর দ্রুতিতে ভ্রমণ করে। দৈনন্দিনকার অনেক ঘটনায় অর্থাৎ বাস্তব অনেক প্রায়োগিক ক্ষেত্রেই, আলো এবং অন্যান্য তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গসমূহকে তাৎক্ষণিকভাবে সঞ্চালিত হতে দেখা গেলেও দীর্ঘ দূরত্ব এবং অত্যন্ত সংবেদনশীল পরিমাপের ক্ষেত্রে এদের সসীম গতির লক্ষণীয় প্রভাব বিদ্যমান। তাৎক্ষণিক মুহূর্তে ভূপৃষ্ঠ থেকে আমরা নক্ষত্রের যে আলোগুলো দেখি সেগুলো আমাদের চোখে দৃশ্যমান হওয়ার বহু বছর পূর্বে নক্ষত্র থেকে যাত্রা শুরু করেছে। এই ব্যাপারটি মানুষকে দূরবর্তী বস্তু দেখে মহাবিশ্বের ইতিহাস অধ্যয়ন করার সুযোগ করে দিয়েছে। দূরবর্তী স্পেস প্রোবের (কৃত্রিম উপগ্রহবিশেষ) সাথে যোগাযোগ করার সময়, পৃথিবী থেকে ঐ সব মহাকাশযানে এবং তদ্বিপরীতে সেগুলো থেকে পৃথিবীতে কোনো সংকেতের ভ্রমণ করতে কয়েক মিনিট থেকে কয়েক ঘণ্টা সময় পর্যন্ত লেগে যেতে পারে। কম্পিউটিংয়ে দুটি কম্পিউটার মধ্যে, কম্পিউটার স্মৃতিতে এবং একটি সিপিইউয়ে যোগাযোগের যে চূড়ান্ত সর্বনিম্ন ডিলে (বিলম্ব) ঘটে, তা নির্ধারন করে দেয় আলোর গতি। অত্যন্ত উচ্চ নির্ভুলতার সাথে বড় দূরত্বের পরিমাপের ক্ষেত্রে ভ্রমণকালের পরিমাপে আলোর দ্রুতি ব্যবহার করা হয়।

সর্বপ্রথম ১৬৭৬ সালে ওলে রোমার বৃহস্পতির আইয়ো উপগ্রহের অধ্যয়নের মাধ্যমে দেখান যে, আলো তাৎক্ষণিকভাবে ভ্রমণ করে না, বরং একটি নির্দিষ্ট সসীম দ্রুতিতে ভ্রমণ করে। ক্রমান্বয়ে পরবর্তী শতাব্দীগুলোতে আলোর দ্রুতির আরও সঠিক পরিমাপ উদঘাটিত হয়। ১৮৬৫ সালে প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রে জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল আলোকে একটি তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ হিসেবে এবং এটি তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গ হওয়ায় c দ্রুতিতে ভ্রমণ করে বলে প্রস্তাব করেন।[৭] যেকোনো জড় প্রসঙ্গ কাঠামোয় আলোর দ্রুতি c যে একটি ধ্রুবক, ১৯০৫ সালে অ্যালবার্ট আইনস্টাইন তা স্বীকার করে নেন এবং আলোর দ্রুতি যে আলোর উৎসের গতির উপর নির্ভরশীল নয় সেটাও স্বীকার করে নেন।[৮] তিনি আপেক্ষিকতার তত্ত্বের প্রতিপাদনের মাধ্যমে এই স্বীকার্যটির পরিণামসমূহ উদ্ভাবন করেন, আর এটি করতে গিয়ে দেখান যে, আলো এবং তড়িচ্চুম্বকত্বের প্রেক্ষাপটের বাইরেও c পরামিতিটির প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে।

এছাড়াও, মহাকর্ষীয় তরঙ্গের মতো ভরহীন কণা এবং ক্ষেত্র-বিচলতাগুলোও শূন্যস্থানে c দ্রুতিতে ভ্রমণ করে। এই ধরনের কণা এবং তরঙ্গসমূহ উৎসের যেকোনো দ্রুতির সাপেক্ষে কিংবা পর্যবেক্ষকের যেকোনো জড় প্রসঙ্গ কাঠামোর সাপেক্ষে c দ্রুতিতে ভ্রমণ করে। অশূন্য স্থির ভরের কণাকে c দ্রুতির কাছাকাছি হওয়ার জন্য ত্বরান্বিত করা যেতে পারে, তবে দ্রুতিকে যে প্রসঙ্গ কাঠামোতেই পরিমাপ করা হোক না কেন কখনই এটা অর্জন করা সম্ভব নয়।

আপেক্ষিকতার বিশেষ এবং সাধারণ তত্ত্বগুলোতে c স্থান এবং কালের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক স্থাপন করে এবং ভর-শক্তি সমতুল্যতারভর-শক্তি সমতুল্যতার বিখ্যাত E = mc2 সমীকরণেও এর উপস্থিতি দৃশ্যমান।[৯]

কিছু কিছু ক্ষেত্রে, বস্তু বা তরঙ্গ আলোর চেয়ে দ্রুত ভ্রমণ করতে পারে বলে মনে হতে পারে। এর উদাহরণের মধ্যে রয়েছে তরঙ্গসমূহের দশাবেগ, উচ্চ-গতিসম্পন্ন নির্দিষ্ট কিছু জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক বস্তুর উপস্থিতি এবং নির্দিষ্ট কিছু কোয়ান্টাম প্রভাবহাবল সীমানার বাইরে মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ আলোর দ্রুতিকে অতিক্রম করে বলে মনে করা হয়।

কাচ বা বায়ুর মতো স্বচ্ছ পদার্থের তৈরি মাধ্যমে আলোর সঞ্চালনের দ্রুতি c-এর চেয়ে কম; একইভাবে, তারের মধ্য দিয়ে তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গের দ্রুতিও c-এর চেয়ে ধীর গতির। c এবং কোনো পদার্থের মধ্য দিয়ে আলোর দ্রুতি v-এর অনুপাতকে ঐ পদার্থের প্রতিসরাঙ্ক n বলা হয় (n = +c/v)। উদাহরণস্বরূপ, কাচের মধ্য দিয়ে দৃশ্যমান আলোর প্রতিসরাঙ্ক সাধারণত ১.৫ এর কাছাকাছি হয়, যার অর্থ হলো কাচের মধ্য দিয়ে আলো +c/১.৫০০০০০ km/s (২৪০০০ mi/s) দ্রুতিতে ভ্রমণ করে। আবার, দৃশ্যমান আলোর জন্য পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের প্রতিসরাঙ্ক প্রায় ১.০০০২৯, ফলে বায়ুতে আলোর দ্রুতি প্রায় ২,৯৯,৭০৫ কিলোমিটার প্রতি সেকেন্ড, যা শূন্যমাধ্যমে আলোর দ্রুতির থেকে খুব সামান্য পরিমাণেই কম।

সাংখ্যিক মান, সংকেত ও একক

শূন্যস্থানে আলোর দ্রুতিকে সাধারণত ছোট হাতের c অক্ষরটি দ্বারা চিহ্নিত করা হয়, যা ইংরেজি "constant" কিংবা ল্যাটিন "celeritas" থেকে নেওয়া হয়েছে। ল্যাটিনে celeritas-এর হলো অর্থ দ্রুততা, ক্ষিপ্রতা। ১৮৫৬ সালে উইলহেম এডুয়ার্ড ওয়েবার এবং রুডলফ কোলরাউশ ভিন্ন একটি ধ্রুবকের জন্য c ব্যবহার করেছিলেন, যা পরে শূন্যস্থানের আলোর দ্রুতির √২ গুণের সমান দেখানো হয়েছিল। ইতিহাসের পর্যায়ক্রম থেকে দেখা যায়, ১৮৬৫ সালে জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েলের প্রবর্তিত V প্রতীকটি আলোর দ্রুতির জন্য বিকল্প একটি প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল। ১৮৯৪ সালে পল ড্রুড c-কে এর আধুনিক অর্থ দিয়ে পুনঃসংজ্ঞায়িত করেন। ১৯০৫ সালে অ্যালবার্ট আইনস্টাইন বিশেষ আপেক্ষিকতার উপর জার্মান ভাষাভিত্তিক তার মূল গবেষণাপত্রগুলোতে V ব্যবহার করেছিলেন, কিন্তু ১৯০৭ সালে তিনি এটাকে c-তে বদলে ফেলেন, যা ততদিনে আলোর দ্রুতির জন্য একটি আদর্শ প্রতীক হয়ে উঠেছে।[১০][১১]

কখনও কখনও পদার্থের তৈরি এমন যেকোনো মাধ্যমে (অর্থাৎ শূন্যস্থান নয় এমন মাধ্যমে) তরঙ্গের দ্রুতির জন্য c ব্যবহার করা হয় এবং শূন্যস্থানে আলোর দ্রুতির বেলায় c0 ব্যবহার করা হয়।[১২] অক্ষরের পাদদেশে লেখাযুক্ত এই সংকেতটি, যা আন্তর্জাতিক একক পদ্ধতির দাপ্তরিক নথি ও লেখালেখিগুলো অনুমোদিত হয়েছে,[১৩] তা আলোর দ্রুতির সাথে সম্পর্কযুক্ত তড়িচ্চুম্বকীয় ধ্রুবকসমূহের অনুরূপ। এসব ধ্রুবকের মধ্যে রয়েছে: চৌম্বক ভেদ্যতা বা চৌম্বক ধ্রুবকের জন্য  μ0তড়িৎভেদ্যতা বা বৈদ্যুতিক ধ্রুবকের জন্য ε0 এবং মুক্ত স্থানের প্রতিবন্ধকতার জন্য Z0। এই নিবন্ধটিতে কেবল শূন্যস্থানে আলোর দ্রুতির জন্য c ব্যবহার করা হয়েছে।

একক পদ্ধতিগুলোতে আলোর দ্রুতির ব্যবহার

১৯৮৩ সাল থেকে, এককের আন্তর্জাতিক পদ্ধতিতে ধ্রুবক c-কে ঠিক ২৯,৯৭,৯২,৪৫৮ মিটার প্রতি সেকেন্ড হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা আসছে। শূন্যস্থানে আলো এক সেকেন্ডের ২৯৯৭৯২৪৫৮ ভাগ সময়ে ঠিক যে দূরত্ব অতিক্রম করে সেই দূরত্বকে এক মিটাররূপে সংজ্ঞায়িত করতে উপর্যুক্ত সম্পর্কটি ব্যবহার করা হয়। এইভাবে, c-এর মান ব্যবহার করে, সেই সাথে সেকেন্ডের নির্ভুল পরিমাপ থেকে মিটারের জন্য একটি আদর্শ তৈরি করা যায়।[১৪] মাত্রাযুক্ত ভৌত ধ্রুবক হিসেবে c-এর সাংখ্যিক মান বিভিন্ন একক পদ্ধতির ক্ষেত্রে আলাদা হবে। উদাহরণস্বরূপ, ব্রিটিশ ইম্পেরিয়াল এককে আলোর দ্রুতি প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ১,৮৬,২৮২ মাইল[Note ৪] কিংবা প্রতি ন্যানোসেকেন্ড প্রায় ১ ফুট[Note ৫][১৫][১৬]

পদার্থবিদ্যার যেসব শাখায় (যেমন: আপেক্ষিকতায়) c প্রায়ই দেখা যায়, যেখানে c = 1, সেসব ক্ষেত্রে সচরাচর পরিমাপের প্রাকৃতিক একক পদ্ধতি কিংবা জ্যামিতিকরণকৃত একক পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়।[১৭][১৮] এক দ্বারা গুণ বা ভাগের কোনো প্রভাব না থাকায় এই এককসমূহের ব্যবহারে c স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান হয় না। আলোর "আলোক-সেকেন্ড প্রতি সেকেন্ড" এককটি এখানেও প্রাসঙ্গিক, এমনকি যদি এটি বাদও দেওয়া হয়। আলোক-সেকেন্ড হচ্ছে শূন্যস্থানে প্রতি সেকেন্ডে আলোর অতিক্রান্ত দূরত্ব (আলোকবর্ষের ধারণার অনুরূপ)।

পদার্থবিজ্ঞানে আলোর দ্রুতির মৌলিক ভূমিকা

শূন্যস্থানে আলোক তরঙ্গ যে দ্রুতি নিয়ে সঞ্চালিত হয়, তা তরঙ্গের উৎসের গতি এবং পর্যবেক্ষকের জড় প্রসঙ্গ কাঠামোর সাপেক্ষে স্বাধীন, অর্থাৎ শূন্যস্থানে আলোর দ্রুতি এই দুটি বিষয়ের কোনোটির উপর নির্ভরশীল নয়।[Note ৬] আলোর গতির এই অপরিবর্তনশীলতার স্বীকার্যটি ১৯০৫ সালে অ্যালবার্ট আইনস্টাইন কর্তৃক প্রতিপাদিত হয়,[৮] ম্যাক্সওয়েলের তড়িচ্চুম্বকত্বের তত্ত্বের দ্বারা এবং আলোকীয় ইথারের প্রমাণের অভাবের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি এটা করেন;[১৯] ইথারের অনুপস্থিতির ব্যাপারটি ইতোমধ্যেই ধারাবাহিকভাবে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হয়েছিল।[Note ৭] আলোর দ্বিমুখী দ্রুতি (যেমন: একটি উৎস থেকে আয়না পর্যন্ত গিয়ে পুনরায় ফিরে আসা) যে প্রসঙ্গ কাঠামোর উপর নির্ভর করে না, তা কেবল পরীক্ষার মাধ্যমই যাচাই করা সম্ভব। কারণ হলো: উৎস এবং শনাক্তকারী যন্ত্রের অবস্থানে থাকা ঘড়িগুলোকে কীভাবে সমলয় (সিঙ্ক্রোনাইজ) করা উচিত সেরূপ সুনির্দিষ্ট কিছু নিয়ম-নীতি ছাড়া আলোর একমুখী দ্রুতির (যেমন: উৎস থেকে দূরবর্তী শনাক্তকারী যন্ত্রে) পরিমাপ করা অসম্ভব। সে যাইহোক, ঘড়ির জন্য আইনস্টাইনের সমলয় রীতি গ্রহণ করলে, সংজ্ঞা অনুসারে আলোর একমুখী দ্রুতি এর দ্বিমুখী দ্রুতির সমান হয়ে পড়ে।[২০][২১] সকল জড় প্রসঙ্গকাঠামোয় পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রগুলো একই থাকে এই অনুমানটি মেনে নিলে আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্ব থেকে c-এর এই অপরিবর্তনশীলতার পরিণতিসমূহ উদঘাটিত হয়।[২২][২৩] এই পরিণতিগুলোর একটি এই যে, c হচ্ছে সেই দ্রুতি, শূন্যস্থানে আলোসহ সকল ভরহীন কণা এবং তরঙ্গ নিশ্চয়ই যে দ্রুতি নিয়ে ভ্রমণ করে।[২৪][Note ৮]

বেগের ফাংশনরূপে γ লরেন্টজ ফ্যাক্টর।ফ্যাক্টরটি 1 থেকে যাত্রা শুরু করে এবং যখন v আলোর দ্রুতি c-এর কাছাকাছি হয় তখন এই ফ্যাক্টরও অসীমতার কাছাকাছি পৌঁছায়।

বিশেষ আপেক্ষিকতার প্রতি-স্বজ্ঞাত (counterintuitive) এবং পরীক্ষণের মাধ্যমে যাচাইকৃত অনেক প্রভাব ও সংশ্লিষ্টতা রয়েছে।[২৬] এই প্রভাব ও সংশ্লিষ্টতাগুলোর কয়েকটি হলো: ভর ও শক্তির সমতূল্যতা (E = mcটেমপ্লেট:I sup)দৈর্ঘ্য সংকোচন (চলমান বস্তুর সংকোচন),[Note ৯] এবং সময়ের প্রসারণ (যেখানে চলমান ঘড়ি অপেক্ষাকৃত ধীরে চলে)। লরেন্টজ ফ্যাক্টর হলো সেই ভৌত রাশি যা দৈর্ঘ্যের সংকোচন এবং সময়ের প্রসারনকে উপস্থাপন করে, যেখানে γ দ্বারা সূচিত এই ফ্যাক্টরটি হচ্ছে: γ = (1 − vটেমপ্লেট:I sup/cটেমপ্লেট:I sup)−1/2, এখানে v হলো বস্তুর দ্রুতি। বস্তুর দ্রুতি c-এর তুলনায় অত্যন্ত নগন্য হলে γ ফ্যাক্টরটি 1 থেকে খুব সামান্যই বড় হয়, যা অগ্রাহ্য করা যায়। আমাদের অধিকাংশ দৈনন্দিন গতির ক্ষেত্রে এমন ঘটনাই ঘটে থাকে। এসব ক্ষেত্রে বিশেষ আপেক্ষিকতা গ্যালিলিয়ান আপেক্ষিকতার খুবই ঘনিষ্ঠ হয়। কিন্তু, আপেক্ষিক দ্রুতির বৃদ্ধিতে γ ফ্যাক্টরের মানও বৃদ্ধি পায় এবং যখন v-এর মান c-এর কাছাকাছি হয় তখন ফ্যাক্টরটি অসীমতা দিকে ধাবিত হয়। উদাহরণস্বরূপ, আপেক্ষিক দ্রুতি যখন আলোর দ্রুতির 86.6% হয় (v = 0.866 c), তখন সময়ের প্রসারনের ফ্যাক্টরটি তথা লরেন্টজ ফ্যাক্টরটি γ = 2 হয়। একইভাবে, আলোর দ্রুতির 99.5% (v = 0.995 c) এর ক্ষেত্রে সময়ের প্রসারণ ফ্যাক্টরকে γ = 10 হতে দেখা যায়।

স্থান এবং সময়কে স্থানকাল নামে পরিচিত একটি একীভূত কাঠামো হিসেবে বিবেচনা পূর্বক বিশেষ আপেক্ষিকতার ফলাফলগুলোকে সংক্ষিপ্ত করা যেতে পারে (স্থান এবং সময়ের এককগুলোর সাথে সম্পর্কযুক্ত c সহকারে)। আর এমনটা করা হলে, ভৌত তত্ত্বগুলো লরেন্টজ ইনভেরিয়েন্স নামক একটি বিশেষ প্রতিসাম্যকে মেনে চলে, যে প্রতিসাম্যটির গাণিতিক সূত্রে c পরামিতিটি বিদ্যমান থাকে।[২৯] কোয়ান্টাম তড়িৎ-গতিবিজ্ঞান, কোয়ান্টাম ক্রোমোডাইনামিক্স, কণা পদার্থবিজ্ঞানের প্রমিত মডেল এবং সাধারণ আপেক্ষিকতার মতো আধুনিক ভৌত তত্ত্বগুলোর জন্য লরেন্টজ ইনভেরিয়েন্স হচ্ছে একটি প্রায়-সর্বজনীন অনুমান। c প্যারামিটারটি পদার্থবিজ্ঞানের এমন অনেক প্রসঙ্গে উপস্থিত হয়, যেগুলোর সাথে আলোর সম্পর্ক নেই। আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানে তাই c প্যারামিটারটি সর্বব্যাপী। উদাহরণস্বরূপ, c যে মহাকর্ষ এবং মহাকর্ষীয় তরঙ্গেরও দ্রুতি সাধারণ আপেক্ষিকতা সেটার ভবিষ্যদ্বাণী করে,[৩০] এবং মহাকর্ষীয় তরঙ্গের পর্যবেক্ষণসমূহ এই ভবিষ্যদ্বাণীর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে দেখা গেছে।[৩১] অ-জড় প্রসঙ্গ কাঠামোয় (মহাকর্ষীয়ভাবে বাঁকা স্থান-কালে বা ত্বরিত প্রসঙ্গ কাঠামোয়) আলোর স্থানীয় দ্রুতি ধ্রুবক এবং তা c-এর সমান, তবে দূরত্ব এবং সময়কে কীভাবে সংজ্ঞায়িত করা হচ্ছে তার সাপেক্ষে, সসীম দৈর্ঘ্যের একটি সঞ্চারপথ বরাবর আলোর দ্রুতি c থেকে আলাদা হতে পারে।[৩২]

সাধারণত অনুমান করা হয় যে, স্থান-কাল জুড়ে c-এর মতো মৌলিক ধ্রুবকগুলোর একই মান থাকে, যার অর্থ হচ্ছে, এগুলো অবস্থানের উপর নির্ভর করে না এবং সময়ের সাথে এদের পরিবর্তন হয় না। তথাপি, সময়ের সাথে আলোর দ্রুতির পরিবর্তন ঘটতে পারে বলে অনেক তত্ত্বে বলা হয়েছে।[৩৩][৩৪] এ পর্যন্ত আলোর দ্রুতির এই ধরনের পরিবর্তনের কোনো চূড়ান্ত প্রমাণ পাওয়া যায়নি, তবে এগুলো চলমান গবেষণার বিষয়বস্তু হিসেবে রয়ে গেছে।[৩৫][৩৬]

এছাড়াও সাধারণভাবে এটাও অনুমান করা হয় যে, আলোর গতি আইসোট্রপিক। এর অর্থ এই যে, আলোকে যে দিকেই পরিমাপ করা হোক না কেন, তার একই পরিমান পাওয়া যাবে। কোনো চৌম্বক ক্ষেত্রে নিউক্লীয় শক্তি স্তর থেকে নিঃসরণরত নিউক্লিয়াসগুলোর দিগাবস্থার (ওরিয়েন্টেশন) একটি ফাংশন হিসেবে যে নিঃসরণগুলো পাওয়া যায় (দেখুন: হিউজেস-ড্রেভার পরীক্ষণ), তাদের পর্যবেক্ষণগুলোতে এবং ঘূর্ণায়মান আলোকীয় অনুনাদকের (দেখুন: অনুনাদক পরীক্ষণ) পর্যবেক্ষণগুলোতে সম্ভাব্য দ্বিমুখী অ্যানিসোট্রপির উপর কঠোর সীমাবদ্ধতা আরোপিত হয়েছে।[৩৭][৩৮]

দ্রুতির ঊর্ধ্ব সীমা

বিশেষ আপেক্ষিকতা অনুসারে, v দ্রুতিতে চলমান m স্থির ভরের একটি বস্তুর শক্তি হবে γmcটেমপ্লেট:I sup, যেখানে γ হল লরেন্টজ ফ্যাক্টর যার সংজ্ঞা উপর দেওয়া হয়েছে। দ্রুতি v শূন্য হলে লরেন্টজ ফ্যাক্টর γ একের সমান হয়, যা ভর ও শক্তির সমতূল্যতার জন্য বিখ্যাত E = mcটেমপ্লেট:I sup সূত্রের জন্ম দেয়। যখন বস্তুর দ্রুতি v-এর মান c-এর সন্নিকটবর্তী হয় তখন γ ফ্যাক্টরটি অসীমের কাছাকাছি চলে যায়, আর ভরযুক্ত একটি বস্তুকে আলোর দ্রুতিতে ত্বরিত করতে অসীম পরিমাণ শক্তির প্রয়োজন। আলোর দ্রুতি হচ্ছে ধনাত্মক স্থির ভরযুক্ত বস্তুর দ্রুতির ঊর্ধ্ব সীমা, এবং স্বতন্ত্র ফোটনগুলোর পক্ষেও আলোর বেগের চেয়ে দ্রুত ভ্রমণ করা সম্ভব নয়।[৩৯] গতির এই ঊর্ধ্ব সীমা  আপেক্ষিক শক্তি এবং ভরবেগের অনেক পরীক্ষায় পরীক্ষার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।[৪০]

A ঘটনাটি লাল প্রসঙ্গ কাঠামোয় B ঘটনার পূর্বে ঘটে। কিন্তু এই A ঘটনার ব্যাপারটি সবুজ প্রসঙ্গ কাঠামোর B ঘটনার সাথে যুগপৎভাবে এবং নীল প্রসঙ্গ কাঠামোর B ঘটনার পরে ঘটে।

আরও সাধারণভাবে বলা যায়, যেকোনো সংকেত বা শক্তির পক্ষে c এর চেয়ে দ্রুত ভ্রমণ করা অসম্ভব। দ্রুতির এই বাধ্যবাধকতার একটি যুক্তি বিশেষ আপেক্ষিকতার প্রতি-স্বজ্ঞাত (counter-intuitive) প্রভাব থেকে পাওয়া যায়। বিশেষ আপেক্ষিকতার প্রতি-স্বজ্ঞাত এই প্রভাবটি যুগপৎ-সংঘটনের আপেক্ষিকতা নামে পরিচিত। যদি দুটি ঘটনা A এবং B-এর মধ্যকার স্থানিক দূরত্ব ঘটনা দুটির মধ্যকার সময়ের ব্যবধানের c গুণের থেকে বৃহত্তর হয়, তাহলে এমন কিছু প্রসঙ্গ কাঠামো থাকবে, যেখানে একটি কাঠামোয় A ঘটনা B ঘটনার পূর্বে, অন্য কাঠামোয় B ঘটনা A ঘটনার এর পূর্বে এবং অপর কোনো কাঠামোয় উভয়ই যুগপৎভাবে ঘটবে। এর ফলে, কোনো জড় প্রসঙ্গ কাঠামোর সাপেক্ষে যদি কোনো কিছু c-এর চেয়ে দ্রুত গতিতে ভ্রমণ করে, তাহলে সেটি একই সময়ে অন্য একটি প্রসঙ্গ কাঠামোর সাপেক্ষে পিছনের দিকে ভ্রমণ করবে এবং ক্যাজুয়ালিটির লঙ্ঘন ঘটবে।[Note ১০][৪৩] এই ধরনের প্রসঙ্গ কাঠামোয়, একটি "প্রভাব"কে তার "কারণ"-এর পূর্বেই পর্যবেক্ষণ করা যেতে পারে, অর্থাৎ এই ধরনের কাঠামোয় কোনো ঘটনা ঘটার পূর্বেই তা পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব। ক্যাজুলিটির এই ধরনের লঙ্ঘনের ঘটনা নথিবদ্ধ করার ইতিহাস অদ্যাবধি পাওয়া যায়নি।[২১] আর এমনটা ঘটলে তা ট্যাকিওনিক এন্টিটেলিফোনের মতো প্যারাডক্সের সূচনা করবে।[৪৪]

দ্রষ্টব্য

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

ঐতিহাসিক তথ্যসূত্র

আধুনিক তথ্যসূত্র

  • Brillouin, L (১৯৬০)। Wave propagation and group velocity। Academic Press। 
  • Jackson, JD (১৯৭৫)। Classical Electrodynamics (2nd সংস্করণ)। John Wiley & Sons। আইএসবিএন 978-0-471-30932-1 
  • Keiser, G (২০০০)। Optical Fiber Communications (3rd সংস্করণ)। McGraw-Hill। পৃষ্ঠা 32আইএসবিএন 978-0-07-232101-2 
  • Ng, YJ (২০০৪)। "Quantum Foam and Quantum Gravity Phenomenology"। Amelino-Camelia, G; Kowalski-Glikman, J। Planck Scale Effects in Astrophysics and Cosmology। Springer। পৃষ্ঠা 321ff। আইএসবিএন 978-3-540-25263-4 
  • Helmcke, J; Riehle, F (২০০১)। "Physics behind the definition of the meter"। Quinn, TJ; Leschiutta, S; Tavella, P। Recent advances in metrology and fundamental constants। IOS Press। পৃষ্ঠা 453। আইএসবিএন 978-1-58603-167-1 
  • Duff, MJ (২০০৪)। "Comment on time-variation of fundamental constants"। arXiv:hep-th/0208093  

বহিঃসংযোগ

🔥 Top keywords: রাম নবমীমুজিবনগর দিবসপ্রধান পাতামুজিবনগর সরকারবিশেষ:অনুসন্ধানইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগএক্স এক্স এক্স এক্স (অ্যালবাম)বাংলাদেশবাংলা ভাষামিয়া খলিফারাজকুমার (২০২৪-এর চলচ্চিত্র)আনন্দবাজার পত্রিকাআবহাওয়ারামপহেলা বৈশাখউয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগইসরায়েলইরানরবীন্দ্রনাথ ঠাকুরমুজিবনগরইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউনরিয়াল মাদ্রিদ ফুটবল ক্লাব২০২৪ ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগক্লিওপেট্রাচর্যাপদভূমি পরিমাপশেখ মুজিবুর রহমানজনি সিন্সকাজী নজরুল ইসলামঈদুল আযহাফিলিস্তিনইউটিউবভারতবিকাশআসসালামু আলাইকুমসৌদি আরববাংলা প্রবাদ-প্রবচনের তালিকামুহাম্মাদ