মীরাবাঈ
মীরাবাঈ (রাজস্থানি: मीराबाई) (১৪৯৮-১৫৪৬ খ্রিস্টাব্দ) ছিলেন একজন অভিজাতবংশীয় হিন্দু অতিন্দ্রীয়বাদী সংগীতশিল্পী ও সহজিয়া (অসাম্প্রদায়িক) কৃষ্ণ-ভক্ত। তিনি রাজস্থান অঞ্চলের অধিবাসী ছিলেন। মীরাবাঈ বৈষ্ণব ভক্তি আন্দোলনের সন্ত ধারার প্রধান ব্যক্তিত্বদের অন্যতম। মনে করা হয়, তিনি বারোশো থেকে তেরোশো ভজন রচনা করেছিলেন। এই গানগুলি সারা ভারতে জনপ্রিয়তা লাভ করে। ভক্তিবাদী ধারায় রচিত এই গানগুলির মাধ্যমে তিনি কৃষ্ণের প্রতি তাঁর প্রেম ব্যক্ত করেছিলেন।
মীরাবাঈ | |
---|---|
ব্যক্তিগত তথ্য | |
জন্ম | ১৪৯৮ খ্রীষ্টাব্দ,[১] |
মৃত্যু | ১৫৪৬ খ্রীষ্টাব্দ, দ্বারকা |
ধর্ম | হিন্দু |
দাম্পত্য সঙ্গী | ভোজরাজ সিং শিশোদিয়া |
মীরাবাঈয়ের গান ও তাঁর সম্প্রদায়ে তাঁর সম্পর্কে যে গল্প প্রচলিত আছে তার ভিত্তিতে তাঁর জীবনবৃত্তান্ত বর্ণনা করা হয়। এই জীবনবৃত্তান্ত অবলম্বনে একাধিক চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। তবে এই সব গল্পের ঐতিহাসিক ভিত্তি অবিতর্কিত নয়। বিশেষত, যে সব গল্পে তানসেনের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক প্রদর্শিত হয়েছে সেগুলি যথেষ্টই বিতর্কিত। আবার মীরা রবিদাস না রূপ গোস্বামীর শিষ্যা ছিলেন, তা নিয়েও বিতর্ক আছে। তার লেখা ৯৮ টি গান বলিউডের বিভিন্ন চলচ্চিত্রে ব্যবহার করা হয়েছে
জীবনী
মীরা ছিলেন একজন রাজপুত রাজকুমারী।[২] তিনি অধুনা ভারতের রাজস্থান রাজ্যের নাগৌর জেলার অন্তঃপাতী মেরতার নিকটবর্তী কুদকি (কুরকি) নামে একটি ছোট গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর পিতা ছিলেন যোধপুর শহরের প্রতিষ্ঠাতা মান্দোরের রাও যোধার (১৪১৬-১৪৮৯) পুত্র তথা রাঠোর বংশীয় যোদ্ধা রতন সিংহ রাঠোর।
বাল্যকালে মীরা এক পরিব্রাজক সন্ন্যাসীর দ্বারা আরাধিত একটি কৃষ্ণমূর্তির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিলেন। মূর্তিটি পাওয়ার জন্য তিনি কান্নাকাটি জুড়ে দিয়েছিলেন। মূর্তিটি তাঁকে দেওয়া হয়েছিল এবং সম্ভবত তিনি সারা জীবন মূর্তিটি নিজের কাছে রেখেছিলেন। তাঁর মা তাঁর এই ধর্মভাবের সমর্থক ছিলেন। কিন্তু তিনি অকালেই মারা যান।
শৈশবেই চিতোর-রাজ রানা সঙ্গার জ্যেষ্ঠ পুত্র ভোজ রাজের সাথে মীরার বিয়ের হয়। যোদ্ধা পরিবারের সদস্য হয়ে মীরা উল্লেখ করেন যে তিনি প্রকৃতই শ্রীকৃষ্ণের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন। ফলে, শ্বশুরবাড়ীর লোকজন তার ঈশ্বর ভক্তি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তৈমুর কর্তৃক হিন্দুস্তান দখলের পর ইসলামী শাসনে আবদ্ধ দিল্লীর সুলতানের রাজত্বকালে রাজপুতেরা জোরপূর্বক নিজেদেরকে স্বাধীন বলে ঘোষণা করে। কিন্তু ষোড়শ শতকে বাবর কর্তৃক সাম্রাজ্য দখল করলে এবং কিছু রাজপুত তাকে সমর্থন করলে বাকীরা নিজেদের জীবনবাজী রেখে তার সাথে যুদ্ধ করে। মীরার স্বামী ভোজ রাজ ১৫২৭ খ্রীষ্টাব্দের ঐ যুদ্ধে নিহত হয়। মীরার ২০ বছর বয়সী জীবনে মায়ের মৃত্যুর পর এটি ছিল ধারাবাহিক শোকের আরও একটি। তিনি মনে করলেন, ভালবাসা-প্রেম-আবেগ সবকিছুই ক্ষণস্থায়ী।কৃষ্ণপ্রেমে মত্ততা মীরার একান্তই ব্যক্তিগত বিষয় হলেও কখনও কখনও এই মত্ততা নিয়ে তাকে শহরের অলি-গলিতে নাঁচতে হয়েছিল। তার দেবর ও চিতোরগড়ের নতুন শাসক বিক্রমাদিত্য ছিলেন দুষ্ট-প্রকৃতির যুবক। মীরা'র খ্যাতি, সাধারণ ব্যক্তিদের সাথে তার মেলামেশা এবং নারী হিসেবে লজ্জাশীলতা না থাকায় কয়েকবারই বিক্রমাদিত্য তাকে বিষ মিশিয়ে হত্যা করতে চেয়েছিলেন। এছাড়াও, তার ননদ উদাবাঈ মীরা'র সম্বন্ধে বিভিন্ন দূর্নাম রটাতে থাকেন।[৩]এর কিছুদিন পর মীরা গুরু হিসেবে রবিদাসের নাম ঘোষণা করেন এবং বৃন্দাবনে কৃষ্ণনাম করতে করতে চলে যান। তিনি মনে করতেন যে, পূর্বজন্মে গোপী হিসেবে ললিতা নামে কৃষ্ণপ্রেমে পাগল ছিলেন। মীরা'র অভিমত যে, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের একমাত্র পরমপুরুষ হচ্ছেন প্রভু শ্রীকৃষ্ণ। তিনি সন্ন্যাসব্রত অব্যাহত রাখলেন এবং নৃত্যসহযোগে উত্তর ভারতের বিভিন্ন গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে বেড়াতে লাগলেন।[৪]মীরা'র সাথী হিসেবে বারাণশীতে কবীরের সাথে ঘনিষ্ঠতা সামাজিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করেছিল। শেষের বছরগুলোতে সন্ন্যাসীনি হয়ে গুজরাটের দ্বারকায় মীরাকে দেখা গিয়েছিল।
কবিতা
মীরা'র গানগুলো সাধারণ ধারারই পদ, শ্লোক বা চরণ যা আধ্যাত্মিক গানেরই অংশবিশেষ। পদগুলো একত্রিত হয়ে "মীরা'র পদাবলী" বা মীরা'র ভজন নাম ধারণ করে। বর্তমানে প্রচলিত অনুবাদগুলো রাজস্থানী ভাষায় এবং কৃষ্ণের জন্মভূমি বৃন্দাবনে হিন্দীতে ব্রজ ভাষায় ব্যাপক হারে উচ্চারিত হচ্ছে। পদগুলোর কিছু কিছু আবার রাজস্থানী এবং গুজরাটি - উভয় ভাষায়ই লিখিত।
যদিও মীরা নির্গুণ ব্রহ্মত্বের আধ্যাত্মিকতা এবং উত্তরের শান্ত ভক্তিতে বিশ্বাসী ছিলেন, তবুও সন্দেহ নেই যে তিনি তার হদয়, মন ও মন্দির শ্রীমদ্ভগবদগীতায় বর্ণিত শ্রীকৃষ্ণকে ঠাঁই দিয়েছিলেন। তিনি বলতেন যে প্রিয়া ও প্রভু হিসেবে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সাথে তার ব্যক্তিগত সম্পর্ক বিদ্যমান। তার কবিতাগুলোয় কৃষ্ণের পদচরণে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণের কথকতা বর্ণিত আছে। কবিতায় কৃষ্ণের প্রিয় রঙ গোধূলীতে রঙ্গীন হবার বাসনার কথাও মীরা উল্লেখ করেছেন।
ইংরেজি সংস্করণ
এলস্টোন এবং সুব্রামনিয়াম ভারতে মীরা বাঈয়ের নির্বাচিত আধ্যাত্মিক কবিতাগুলো ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করে প্রকাশ করেন। দ্য হিন্দি ক্লাসিক্যাল ট্র্যাডিশন শিরোনামে তারা সমান্তরালভাবে মীরা'র কবিতাগুলো সংগ্রহ করে অনুবাদ করেন। মীরা'র কিছু ভজন রবার্ট ব্লাই কর্তৃক মীরাবাঈ ভার্সনস্ শিরোনামে প্রকাশ করেছেন। ব্লাই জেন হির্শফিল্ডের সাথে মিরাবাঈ: একস্ট্যাটিক পয়েমস্ নামে যৌথভাবে বই প্রকাশ করেন।[৫]
মীরা বাঈ সম্পর্কে প্রামাণ্য জীবনী
মীরার প্রামাণ্য জীবনী সেভাবে পাওয়া যাও না। তবে বহূ পূর্বে আর্থার ম্যাকাউলিফ তাঁর দ্য শিখ রিলিজিয়ন গ্রন্থের ষষ্ঠ খণ্ডে মীরাবাঈয়ের সামান্য জীবন কাহিনি তুলে ধরেছেন। অবশ্য সেটিও অলৌকিক কাহিনিতে ভরপুর। অংশটি রাজা রঘুরাজ সিংহের ভগৎ মল থেকে অনূদিত। টডের আনাল্স্ অ্যান্ড অ্যান্টিকুইটিস্ অফ্ রাজস্থান গ্রন্থে কিছু পরিচয় আছে। বোম্বে থেকে ১৯৬৬ সালে প্রকাশিত হয় গোয়েট্জ্ হারমনের মীরাবাঈঃ হার লাইফ অ্যান্ড টাইমস্। সেটিও অলৌকিকতা দোষে দুষ্ট। স্বামী বুধানন্দ ইংরেজিতে মীরাবাঈয়ের একটি জীবনী লিখতে সচেষ্ট হয়েছেন।
জনপ্রিয় মাধ্যমে মীরা বাঈ
- গায়ক জন হার্বিশন ব্লাইয়ের অনুবাদকে গ্রহণ করে মিরাবাঈ সংস্ শিরোনামে প্রকাশ করেন।
- অঞ্জলী পাঞ্জাবী মীরাবাঈয়ের জীবনীকে ঘিরে এ ফিউ থিংস আই নো এবাউট হার শিরোনামে প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করেন।[৬]
- তাঁর জীবনকে ঘিরে দু'টি অতি জনপ্রিয় চলচ্চিত্র ভারতে নির্মিত হয়। ১৯৪৫ সালে এম. এস. সুবুলক্ষী তামিল ভাষায় নির্মিত মীরা চলচ্চিত্রে নাম ভূমিকায় অভিনয় করেন। হিন্দী ভাষায় গুলজারের সুরে ১৯৭৯ সালে মীরা চলচ্চিত্র মুক্তি পায়।
- এছাড়াও টেলিভিশনে ধারাবাহিকভাবে মীরা জীবনকে উপজীব্য করে ২০০৯-১০ সালে মীরা প্রদর্শিত হয়।
- ২০০৯-এর ১১ অক্টোবর মীরা বাঈয়ের জীবনকে রূপান্তর করে মীরা - দ্য লাভার শিরোনামে একটি সঙ্গীত এ্যালবাম প্রকাশিত হয়। এতে মীরার কিছু জনপ্রিয় ভজনের প্রকৃত সুর ধারণ করা হয়।[৭]
- রাজকৃষ্ণ রায় মীরাবাইয়ের জীবনীকে ঘিরে বাংলা ভাষায় ধর্মমূলক নাটক রচনা করেন।
গ্রন্থপঞ্জী
- চতুর্বেদী, আচার্য পরশুরাম, মীরাবাঈ কি পদাবলী (১৬'শ সংস্করণ)
- গোয়েটজ্, হারমন, মীরা বাঈ: হার লাইফ এণ্ড টাইমস, বোম্বে, ১৯৬৬
- মীরাবাঈ: লাইবেসনারিন ডাই ভার্স ডার ইণ্ডিস্চেন ডিকতারিন আন্ড মিস্টিকারিন। রাজস্থান থেকে জার্মান ভাষায় অনুবাদ, শুভ্র পরশার, * কেল্কহেইম, ২০০৬ (আইএসবিন ৩-৯৩৫৭২৭-০৯-৭)
- হাউলে, জন স্ট্রাটন. দ্য ভক্তি ভয়েসেস: মিরাবাঈ, সুরদাস এণ্ড কবীর ইন দিয়ার টাইমস এবং আওয়ারস, অক্সফোর্ড, ২০০৫।