রাজনীতিতে পদার্পণের পূর্বে রাজীব ছিলেন ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনসের এক পেশাদার বিমানচালক। কেমব্রিজে থাকাকালীন ইতালীয় বংশোদ্ভুত সোনিয়া মাইনোর সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয় এবং পরে ১৯৬৮ সালে তাঁরা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়। মা দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও, ১৯৮০ সালে কনিষ্ঠ ভ্রাতা সঞ্জয় গান্ধীর মৃত্যুর আগে পর্যন্ত রাজীব রাজনীতি থেকে দূরেই ছিলেন। ১৯৮৪ সালে অপারেশন ব্লু স্টারের প্রতিক্রিয়ায় আততায়ীর হাতে ইন্দিরা গান্ধী নিহত হলে জাতীয় কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ রাজীবকেই দেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত করে।
১৯৮৪ সালে তার নেতৃত্বে কংগ্রেস সংসদের ৫৪২টি আসনের ৪১১টিতে জয়লাভ করে। এই জয় ছিল ভারতীয় সংসদে কংগ্রেসের সর্বকালের রেকর্ড। রাজীব গান্ধী লাইসেন্স প্রথা, শুল্ক ব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক কার্যকলাপের জন্য অনুমতি প্রদানের নিয়মনীতি ঢেলে সাজান; টেলিযোগাযোগ ও শিক্ষা ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ তথা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রসারের ক্ষেত্রে উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতিসাধন প্রভৃতি নানা কাজ শুরু করেন।
১৯৯১ সাল পর্যন্ত রাজীব গান্ধী ছিলেন ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি। এই বছরই একটি নির্বাচনী জনসভায় জনৈক এলটিটিই জঙ্গির আক্রমণে নিহত হন তিনি। ১৯৯৮ সালে তাঁর স্ত্রী সোনিয়া গান্ধী কংগ্রেস সভানেত্রী নির্বাচিত হন এবং ২০০৪ সালে তাঁর নেতৃত্বে কংগ্রেস লোকসভায় জয়লাভ করে। তাঁর পুত্র রাহুল গান্ধী সংসদ তথা সর্বভারতীয় কংগ্রেস কমিটির সাধারণ সম্পাদক[১]।
মৃত্যুর পর রাজীব গান্ধীকে ভারতের সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মাননা [ভারতরত্ন/ভারতরত্নে] ভূষিত করা হয়। উল্লেখ্য, তার মা ইন্দিরা গান্ধীও ভারতরত্ন সম্মানে ভূষিত হয়েছিলেন। রাজীব গান্ধী ভিইউ২আরজি নাম ব্যবহারকারী একজন অপেশাদার রেডিও সঞ্চালক ছিলেন।
প্রারম্ভিক জীবন
রাজীব গান্ধী ভারতের একটি বিশিষ্ট রাজনীতিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা ও স্বাধীনোত্তর ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী, জওহরলাল নেহরুর পৌত্র ছিলেন।
যদিও তারা একই পদবি ব্যবহার করতেন তবু মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে রাজীব গান্ধীর কোনো পারিবারিক সম্পর্ক ছিলন। রাজিবের পিতা, ফিরোজ ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস পার্টির একজন নবীন সদস্য ছিলেন এবং এলাহাবাদে পার্টির কাজের সুবাদে ইন্দিরা এবং তার মা কমলা নেহরুর সঙ্গে তার বন্ধুত্ব হয়। পরবর্তী কালে ইংলান্ডে থাকাকালীন ইন্দিরা এবং ফিরোজ পরস্পরের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং ফিরোজের পার্সি (জরস্ত্রিয়ান)[২][৩] ধর্মাবলম্বী হবার কারণে প্রাথমিক ভাবে জওহরলাল নেহরুর তরফ থেকে আপত্তি থাকা স্বত্তেও ১৯৪২ সালের মার্চে তারা বিবাহ করেন।
১৯৪৪ সালে যখন তার পিতা, মাতা উভয়েই প্রায়ই ইংরেজের কারারুদ্ধ হচ্ছিলেন তখন তার জন্ম হয়। ১৯৪৭ সালের অগাস্টে জওহরলাল নেহরু যখন স্বাধীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী হন এবং তাদের পরিবার এলাহাবাদে পাকাপাকি ভাবে বসবাস শুরু করে তখন ফিরোজ লখনউতেজওহরলাল নেহ্রুর প্রতিষ্ঠিত দ্য নাশনাল হেরাল্ড সংবাদপত্রের সম্পাদক নিযুক্ত হন। যাইহোক, ১৯৪৯ সালে যখন তাদের বিবাহ ব্যর্থতায় পরিনত হচ্ছিলো, তখন ইন্দিরা তাদের দুই পুত্রকে নিয়ে, জওহরলালের কার্যকারী সহকারীনী রূপে কাজ করার এবং তাদের বিশাল বাসভবনের দেখা-শোনার প্রয়োজনের ভান করে দিল্লিতেবসবাস করার জন্য চলে আসেন।সেই সময় ফিরোজ লখনউতে একাই বসবাস করতে থাকেন। এতদ্স্বত্তেও ইন্দিরা ফিরোজ কে ১৯৫১ সালে রায় বেরিলি থেকে তার ভারতের প্রথম সংসদ নির্বাচনের প্রচার অভিযানে সাহায্য করেছিলেন।
সংসদ সদস্য নির্বাচিত হবার পর ফিরোজ গান্ধিও দিল্লিতে বসবাসের জন্য চলে আসেন কিন্তু ইন্দিরা তার পিতার সঙ্গেই বসবাস করতে থাকেন এবং এতেই তাদের চূড়ান্ত বিচ্ছেদ হয়।[৪] সম্পর্ক আরো তিক্ত হয় যখন ফিরোজ হরিদাস মুন্ধ্রা কেলেঙ্কারির ব্যাপারে কংগ্রেস নেতৃত্বের প্রতি দুর্নিতীপরাযনতার অভিযোগ তোলেন। জওহরলালের ব্যাপারটির গোপনে সমাধানের প্রস্তাব স্বত্তেও ফিরোজ বিষয়টি সোজাসুজি সংসদে উত্থাপনের জন্য চাপ সৃষ্টি করেনে:
এই কলঙ্কময় ঘটনা এবং বিচারপতি এম সি ছাগলা দ্বারা তার অনুসন্ধান জওহরলালের একজন মুখ্য সহযোগী, টি টি কৃষ্ণমাচারীকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করে, যা ফিরোজ কে জওহরলালের থেকে আরো দুরে সরিয়ে দেয়। ১৯৫৮ সালে ফিরোজ গান্ধী হৃদরোগে আক্রান্ত হবার পরে কাশ্মিরে ছুটি কাটানোর অবসরে এক সংক্ষিপ্ত পারিবারিক মিলন হয়েছিল। যাইহোক, ১৯৬০ সালে দ্বিতীয় বার হৃদরোগে আক্রান্ত হবার পরে শীঘ্রই ফিরোজের মৃত্যু হয়।
শিক্ষা
তার পিতার মৃত্যু কালের মধ্যেই গান্ধী, প্রাথমিক ভাবে ওয়েলহাম বয়'স স্কুল, একটি ছেলেদের বেসরকারী আবাসিক বিদ্যালয় ও পরে দ্য দুন স্কুলে চলে যান। 'এ লেভেল', এই স্তরের পড়া-শোনার জন্য ১৯৯১ সালে তাকে লন্ডনে পাঠানো হয়। ১৯৬২ সালে তিনি কেমব্রিজের ট্রিনিটি কলেজে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সুযোগ পান। ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত রাজীব কেমব্রিজে ছিলেন এবং কোনো ডিগ্রী ছাড়াই বিশ্ববিদ্যালয় পরিত্যাগ করেন কারণ তিনি 'ট্রাইপস' (কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সান্মানিক স্নাতক ডিগ্রী) পরীক্ষায় অবতীর্ণ হননি। ১৯৬৬ সালে তিনি লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজে ভর্তি হবার সুযোগ পান। এক বছর পরেই আবার তিনি কোনো ডিগ্রী ছাড়াই ইম্পেরিয়াল কলেজ পরিত্যাগ করেন।
১৯৬৫ সালে কেমব্রিজের ভার্সিটি রেস্তোরায় সোনিয়া মাইনের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। সোনিয়া লেন্নোক্স স্কুল অফ ল্যাঙ্গুয়েজেসে (যেটি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে কোনো ভাবেই সম্পর্ক যুক্ত নয়) ইংরাজি নিয়ে পড়া-শোনা করছিলেন এবং ভার্সিটি রেস্তোরায় একজন সহকারিনী হিসেবে কর্মরত ছিলেন। মাইন-র পরিবার এই মিলনে রাজি ছিলনা কিন্তু মাইন গান্ধীর সঙ্গে ভারত বর্ষে চলে আসেন এবং ১৯৬৮ সালে তাদের বিবাহ হয়।
১৯৬৭ সালে যখন তার মা প্রধানমন্ত্রী তখন তিনি ইন্ডিয়ান এয়ার্লাইন্সে একজন পেশাদার বিমানচালক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। তিনি কখনই রাজনীতিতে আগ্রহ প্রকাশ করেননি এবং নিয়মিত ভাবে দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী নিবাসে তার মায়ের সঙ্গেও বসবাস করতেন না। ১৯৭০ সালে তার স্ত্রী তাদের প্রথম সন্তান রাহুল গান্ধীর এবং ১৯৭২ সালে তাদের দ্বিতীয় সন্তান প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর জন্ম দেন। গান্ধী রাজনীতিতে নিরুত্সাহী হলেও, তার কনিষ্ঠ ভ্রাতা সঞ্জয় তাদের মায়ের একজন নিকট পরামর্শদাতা হয়ে উঠেছিলেন।
রাজনীতিতে প্রবেশ
১৯৮০ সালে তার কনিষ্ঠ ভ্রাতার মৃত্যুর পর তার মা এবং ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস পার্টির রাজনীতিকদের দ্বারা তাকে রাজনীতিতে প্রবেশ করার জন্য রাজি করানোর চেষ্টা করা হয়। তিনি এবং তার স্ত্রী উভয়েই এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন এবং প্রকাশ্যেই জানান যে তিনি তার ভাইয়ের আসন থেকে প্রতিদ্বন্দিতা করবেন না। তা সত্বেও, ঘটনাচক্রে তিনি তার সংসদ-সদস্য প্রার্থীত্ব ও ঘোষণা করেন। তার রাজনীতিতে প্রবেশ, বহু সংবাদপত্রে, জনসাধারণ ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি দ্বারা সমালোচিত হয়েছিল। তিনি আমেথি লোকসভা কেন্দ্র থেকে প্রথম নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দিতা করেন। এই উপ-নির্বাচনে তিনি তার প্রতিদ্বন্দী লোকদল নেতা শরদ যাদব কে ২০০,০০০ এর ও বেশি ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করেন।
১৯৮১ সালের ফেব্রুয়ারিতে তার ভাইয়ের উত্তর প্রদেশ রাজ্যের আমেথি লোক সভা (সংসদীয়) কেন্দ্র থেকে নির্বাচিত হয়ে গান্ধী তার মায়ের একজন গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক উপদেষ্টা হয়ে ওঠেন। ব্যাপক ভাবে এই ধারনাই করা হয়ছিলো যে ইন্দিরা গান্ধী, রাজীব কে প্রধানমন্ত্রী পদের যোগ্য করেই গড়ে তুলছেন এবং শীঘ্রই তিনি 'যুবো কংগ্রেস' - কংগ্রেস পার্টির যুবো শাখার সভাপতি মনোনীত হন।
প্রধানমন্ত্রী
৩১শে অক্টোবর ১৯৮৪, যেদিন ইন্দিরা গান্ধী তার দেহরক্ষীদের দ্বারাই নিহত হন সেদিন গান্ধী পশ্চিম বঙ্গে ছিলেন। তার মায়ের দুই শিখ দেহরক্ষী দ্বারা হত্যা-কান্ডের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই উচ্চ পর্যায়ের কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ এমনকি রাষ্ট্রপতি জৈল সিং ও তাকে প্রধানমন্ত্রী হবার জন্য চাপ দিতে থাকেন। দেশের রাজধানী দিল্লিতে শিখ-বিরোধী দাঙ্গার পরিপ্রেক্ষিতে রাজীব গান্ধীর, "যখন একটি বিশালাকৃতি বৃক্ষের পতন হয় তখন তার তলায় ভূমিকম্প সৃষ্টি হয়"[৬] এই মন্তব্যটির জন্য ব্যাপক ভাবে সমালোচিত হতে হয়েছিল। বহু কংগ্রেস রাজনীতিককে এই দাঙ্গা পরিকল্পনার/পরিচালনার জন্য দায়ী করা হয়েছিল[৭]। যেহেতু তৎকালীন লোক সভা তার পাঁচ বছর কার্যকাল সম্পূর্ণ করেছিলো সেহেতু রাজীব কার্যভার গ্রহণের অব্যবহতি পরেই রাষ্ট্রপতি জৈল সিংকে লোক সভা ভেঙ্গে দিয়ে নির্বাচন করতে অনুরোধ জানান। রাজীব গান্ধী আনুষ্ঠানিক ভাবে কংগ্রেস পার্টির সভাপতি ও মনোনীত হলেন।
ভারত বর্ষের সংসদের ইতিহাসে সর্বকালীন সর্ববৃহদ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে কংগ্রেস পার্টি এক অভূতপূর্ব বিজয় লাভ করে[৮] সরকারের ওপর গান্ধীর একাধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। তারুণ্য, নিষ্কলুষ (মি. ক্লিন) ভাবমূর্তি ও 'দুর্নীতিপরায়ণ রাজনীতিক' এই প্রেক্ষাপট-বিহীনতা তার সহায়ক হয়েছিল। রাজীব তাই কংগ্রেসের অনুকূলে ভারতের জনসাধারণের আশা ও উদ্দীপনাকে পুনরুজ্জীবিত করতে পেরেছিলেন।
গান্ধী তার মায়ের, সমাজবাদী, পথের বিশিষ্ট ভাবে ভিন্ন পথে নেতৃত্ব প্রদান আরম্ভ করেছিলেন। তিনি, ভারতের সমাজতান্ত্রিক নীতি ও সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে বন্ধুত্যপুর্ণ সম্পর্কের কারণে দীর্ঘ সংকটাদীর্ণ ভারত-মার্কিন দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উন্নতি এবং অর্থনৈতিক ও বৈজ্ঞানিক সহযোগিতার প্রসার সাধন করেন[৯]। তিনি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যা এবং সমগোত্রীয় শিল্পে সরকারী সহায়তা বৃদ্ধি, বৈদেশিক আমদানির পরিমাণ হ্রাস, প্রযুক্তি-নির্ভর শিল্প, বিশেষত কম্পিউটার, এয়ারলাইনস, সামরিক ও টেলিযোগাযোগ প্রভৃতি ক্ষেত্রে কর ও শুল্ক হ্রাস কম্পিউটার করেন.তিনি, ব্যবসায়ীদের মূলধন সংগ্রহ, ব্যক্তি বিশেষের ভোগ্য পণ্য ক্রয় এবং আমদানির ওপর আমলাতান্ত্রিক বিধি-নিষেধ সৃষ্টিকারী লাইসেন্স রাজ এর হ্রাসের জন্য কিছ গুরুত্বপূর্ণ পন্থার প্রচলন করেছিলেন। সারা ভারত ব্যাপী উচ্চ শিক্ষা প্রসারের উদ্দেশ্যে তিনি ১৯৮৬ সালে জাতীয় শিক্ষা নীতি ঘোষণা করেছিলেন। তিনি ১৯৮৬ সালে জওহর নবোদয় বিদ্যালয় সিস্টেম-এই নামে কেন্দ্রীয় সরকারের অধীন একটি প্রতিষ্ঠানের সূচনা করেন যার প্রধান লক্ষ ছিল ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শ্রেনী পর্যন্ত অবৈতনিক-গৃহশিক্ষা সুযোগ প্রদানের মাধ্যমে সমাজের গ্রামীণ ক্ষেত্রে মানুষের উন্নয়ন। তারই প্রচেষ্টায় ১৯৮৬ সালে MTNL -এর সৃষ্টি হয় এবং পাবলিক কল অফিস যা PCO এই নামেই খ্যাত গ্রামীণ এলাকাগুলিতে টেলিফোনের বিস্তার ঘটাতে সহায়তা করেছে।
তার অনুমোদনেই জঙ্গি কার্যকলাপের রাশ টানতে পঞ্জাবে এক বিস্তীর্ণ পুলিশী ও সামরিক অভিযান চালানো হয়। পাঞ্জাব রাজ্যে এক সামরিক আইন জারির মতো অবস্থা চলছিলো যার ফলে অসামরিক মুক্ত জীবনযাপন, ব্যবসা-বাণিজ্য ও পর্যটন শিল্প বিশেষ ভাবে বিঘ্নিত হচ্ছিলো[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]। সেই সময় এখানে পুলিশ অধিকর্তা ও জঙ্গি উভয়ের দ্বারাই মানবাধিকার লঙ্ঘনের বহু অভিযোগ দায়ের হয়েছিল। এরকম অভিযোগ ও করা হয় যে, যখন পঞ্জাবের পরিস্থিতি আয়ত্তের মধ্যে তখন ভারত সরকার শ্রীলঙ্কা সরকারের সঙ্গে যুদ্ধরত LTTE বিদ্রোহীদের অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিয়ে সহায়তা করেছে। ১৯৮৭ সালের২৯শে জুলাইকলম্বোতে রাজীব গান্ধী ও শ্রীলঙ্কা রাষ্ট্রপতি জে আর জয়ার্ধনের মধ্যে ইন্দো-শ্রীলঙ্কা পীস একর্ড স্বাক্ষরিত হয়। তার পর দিনই, ৩০শে জুলাই১৯৮৭ সালে রাজীব গান্ধী যখন গার্ড অফ অনার নিচ্ছিলেন তখন ভিজয়ামুনিগে রোহন দি সিলভা নামে একজন নবীন সিহ্নলী নৌ-সেনা সদস্য রাইফেলের কুদো দিয়ে তার মাথায় আঘাত করে। আঘাতটি রাজীব গান্ধীর মাথার পিছনে করার উদ্দেশ্যে করা হয়ে থাকলেও তা তার কাঁধে লাগে। "রাজীব একটু লাফিয়ে উঠেছিলেন এবং তাঁর সামান্য ভারসাম্য হারিয়ে ছিল" এই বলে লজ্জিত শ্রীলঙ্কা রাষ্ট্রপতি, জুনিয়াস রিচার্ড জয়েবার্দেনে প্রথমিক ভাবে এই অদ্ভুত ঘটনাটিকে পাস কাটাতে চয়েছিলেন, রাজীব গান্ধী নতুন দিল্লিতে ফেরার পথে জে এন দীক্ষিত কে বলেছিলে "নিশ্চিত রূপে আমার আঘাত লেগেছিলো"। নৌ-সেনা সদস্য রোহন সেই সময় ভারতের সাম্রাজ্যবাদিতার বিরুদ্ধে সিন্ঘলীদের কাছে জাতীয়তাবাদের এক প্রতিভূ হয়ে উঠেছিলো। শ্রীলঙ্কা সরকার ও LTTE বিদ্রোহীদের মধ্যে মধ্যস্থতাকারীর প্রচেষ্টাটি যখন প্রত্যাঘাত করে তখন রাজীব গান্ধীর সরকারও এই কাজের জন্য বড়ো একটি ধাক্কা খায়[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]।
ভারত ও মার্কিন কংগ্রেসের যুগ্ম-সভায় তার বক্তৃতা সকলকে বিমুগ্ধ করেছিল, যখন তিনি বলেন, "ভারত বর্ষ একটি প্রবীন দেশ কিন্তু নবীন জাতি এবং সর্বস্থানের নবীনদের মতই আমরাও অধৈর্য্য। আমি নিজেও নবীন এবং আমার নিজেরও স্বপ্ন আছে। আমি, সম্মুখ সারির সম্মুখে প্রতিষ্ঠিত, মানুষের সেবায় নিযুক্ত, মহান দেশগুলির মধ্যে এক স্বাধীন, শক্তিশালি, স্বনির্ভর ভারত বর্ষের স্বপ্ন দেখি"[১০]।
গান্ধীর অর্থমন্ত্রী, বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংহ সরকারী ক্ষেত্রে ও দুর্নীতিপরায়ণ রাজনীতিকদের সন্দেহজনক বিবরণ উন্মোচিত করে দেওয়ায় কংগ্রেস নেতারা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন৷ প্রতিরক্ষা মন্ত্রকে স্থানানতরিত হবার পর সিংহ যা প্রকাশ করেন তা 'বোফর্স কেলেংকারী' নামে, অত্তাভিও কুয়াত্রচি, গান্ধী পরিবারে ঘনিষ্ট একজন ইতালীয় ব্যাবসায়ীয়ের মাধ্যমে সুইডেনের বোফর্স কোম্পানির এক লক্ষ-কোটি মার্কিন ডলার ঘুষের বিনিময় ভারতের কাছ থেকে বরাত পাওয়ার, এক কুখ্যাত ঘটনা। এই ঘটনা প্রকাশ্যে আনার জন্য, সিংহ কে মন্ত্রিত্য থেকে বরখাস্ত করা হয় এবং পরে কংগ্রেস থেকেও বহিস্কার করা হয়। পরে দ্য হিন্দু সংবাদ পত্রের নর্সিম্হান রাম ও চিত্রা সুব্রামানিয়াম যখন এই ব্যাপারে অনুসন্ধান জারি রাখেন তখন রাজীব গান্ধী নিজেও ব্যক্তিগত ভাবে এতে জড়িয়ে পড়েছিলেন৷ এই ঘটনা তার 'দুর্নীতি মুক্ত রাজনীতিক'-এর ভাবমূর্তি কে ছিন্ন-ভিন্ন করে দিয়ে ছিল। কিন্তু পরে ২০০৪ সালে তার মৃত্যুর পর তার নির্দোশিতা প্রমাণিত হয়[১১]।
সরকারী দুর্নীতি প্রকাশ্যে আনার জন্য সিংহ-এর জনসাধারণের[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] কাছে জনপ্রিয়তা খুব বৃদ্ধি পায় এবং বিরোধী দলগুলি তার অধীনে জনতা দল নামে একটি জোট তৈরি করে। ১৯৮৯ সালের নির্বাচনে কংগ্রেস একটি বিরাট ধাক্কা খায়। ভারতীয় কমিউনিস্টদের এবং ভারতীয় জনতা পার্টির সমর্থনে সিংহ এবং তার জনতা দল সরকার গঠন করে। গান্ধী কংগ্রেস সভাপতি থাকলেন এবং বিরোধী দলনেতা মনোনীত হলেন। অনেকে একথা বিশ্বাস করেন যে রাজীব এবং কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ ১৯৯০ এর অক্টোবর মাসে জনতা দলের উচ্চ পদাধিকারী নেতা চন্দ্র শেখরকে, জোটের অন্তর্নিহিত, যথেষ্ট, বিশেষত 'সংরক্ষণ'-এর বিষয় মতানৈক্যের কারণে ভি. পি. সিংহের সরকারের পতনের কারণ হবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন। চন্দ্র শেখর কে রাজিবের কংগ্রেস, সরকারের বাইরে থেকে সমর্থন জানানোয় তিনি প্রধানমন্ত্রী মনোনীত হন। যাইহোক, তারা ১৯৯১ তে তাদের সমর্থন ফিরিয়ে নেয় এবং পুনরায় নির্বাচন ঘোষিত হয়।
দুর্নীতি প্রতিরোধ
বিবিধ দুর্নীতিতে দুষ্ট প্রশাসনে স্বচ্ছতা আনতে ভারতের সাধারণ নির্বাচন, ১৯৮৯-র পূর্বে ১৯৮৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন, ১৯৮৮ পার্লামেন্টে পাস্ হয় যা দেশের আইননীতিতে প্রথমবারের মতো দুর্নীতি দমন আইন।
শ্রীলঙ্কা নীতি
সেই সময়ের শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী রণশিন্ঘে প্রেমদাসা ইন্দো-শ্রীলঙ্কা পিস একর্ড-এর বিরুদ্ধে থাকা স্বত্তেও রাষ্ট্রপতি জুনিয়াস রিচার্ড জয়েবার্দেনের চাপে তা স্বীকার করেন। তিন মাসের মধ্যে ইন্ডিয়ান পিস কীপিং ফোর্স (IPKF) বিদায় নেবে, এই প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতে ১৯৮৯ সালের জানুয়ারীতে প্রেমাদাসা রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন[১২]। ১৯৮৯ এর নির্বাচনে, শ্রীলঙ্কা ফ্রিডম পার্টি এবং ইউনাইটেড নাশনাল পার্টি উভয়েই চেয়েছিল IPKF বিদায় নিক এবং তারা ৯৫ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। ভারতীয় বাহিনী যেহেতু তামিল বিচ্ছিনতাবাদীদের সঙ্গেই লড়াই করছিল, সেহেতু ভারতের এই পুলিশী ভূমিকা ভারতে বিশেষত তামিল নাডু্তে অসন্তোষের কারণ হয়েছিল। গান্ধী IPKF কে ফিরিয়ে নিতে অসম্মত হন এই বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে যে, গৃহ যুদ্ধ বন্ধ করার একমাত্র রাস্তা হলো প্রেমাদাসা এবং জঙ্গি বাহিনী LTTE কে রাজনৈতিক চাপের দ্বারা এই একর্ড-কে স্বীকার করানো। ১৯৮৯ সালে সিংহ প্রধানমন্ত্রী হন এবং বাহিনী ফিরিয়ে আনা সম্পূর্ণ করেন। IPKF কার্যকলাপে ২,৪০০-এরও বেশি ভারতীয় সৈন্যের মৃত্যু এবং ২০০০ কোটি টাকা খরচ হয়।
শাহ বানো মামলা
১৯৮৫ সালেভারতের সুপ্রিম কোর্টমুসলিম বিবাহ বিচ্ছিন্ন শাহ বানোর পক্ষে রায় দিয়ে বলেন যে তার স্বামীকে তাকে খোরপোষ দিতে হবে। ভারতের মুসলিম মৌলবাদীরা একে মুসলিম পারসনাল ল-এ অনভিপ্রেত হস্তক্ষেপ এবং তারা এর প্রতিবাদ করেন। গান্ধী তাদের দাবী কে স্বীকার করে নেন[১৩]। ১৯৮৬ সালে সংসদে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রাপ্ত কংগ্রেস(ই) পার্টি সেই সময় একটি আইন প্রণয়নের দ্বারা শাহ বানো মামলায় সুপ্রিম কোর্টের রায় কে নস্যাত করে দেয়।
বিশ্বাসঘাতকতামূলক গুপ্ত হত্যা
১৯৯১ সালের২১শে মে রাজীব গান্ধী তামিল নাডুর, মাদ্রাজ থেকে ৩০ মাইল দুরে শ্রীপেরুম্বুদুরে যখন শ্রীপেরুম্বুদুর লোক সভা কেন্দ্রের কংগ্রেস প্রার্থীর হয়ে প্রচার-অভিযান সভায় তখন গুপ্ত ঘাতক দ্বারা তাকে হত্যা করা হয়[১৪]। এই গুপ্ত হত্যাকান্ডটি সংঘটিত করেছিলো লিবারেশন টাইগার্স অফ তামিল ইলম (LTTE) আত্মঘাতী মানববোমা থেনমঝি রাজারত্নম, একে গায়েত্রী এবং ধানু বলেও জানা যায়।
রাত দশটা দশ মিনিটে একটি জনসভায় ধানু তার কাছে যায় এবং প্রধানমন্ত্রী কে অভিনন্দন জানায়। সে তারপর নিচু হয়ে তাকে প্রনাম করার অছিলায় তার পোশাকের ভেতরে বাঁধা একটি কোমোর-বন্ধনীর সঙ্গে রাখা ৭০০ গ্রাম ওজনের বোমাটির (RDX) বিস্ফোরণ ঘটায়[১৫]। পূর্বতন প্রধানমন্ত্রী এবং আরও অনেক মানুষ সেই বিস্ফোরণে প্রাণ হারান। এই হত্যাকান্ডটি একজন স্থানীয় চিত্রগ্রাহকের ক্যামেরায় ধরা হয়ে থাকে যেটি পরে ঘটনাস্থল থেকে পাওয়া যায়। চিত্রগ্রাহকও ওই বিস্ফোরণে প্রাণ হারায় কিন্তু ক্যামেরা টি অক্ষত ছিল। সেই ঘটনাস্থলে রাজীব গান্ধী স্মৃতি স্তম্ভ গড়ে তলা হয়েছে এবং এই ছোট শিল্প নগরীটি একটি গুরুত্বপূর্ণ দর্শনীয় স্থান হয়ে উঠেছে।
সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি থমাসের সিদ্ধান্তে এই বিষয়টি স্পষ্ট হয় যে এই হত্যাকান্ডটি রাজীব গান্ধীর শ্রীলঙ্কায় প্রেরিত ইন্ডিয়ান পিস কিপিং ফোর্স (IPKF) দ্বারা শ্রীলঙ্কার তামিলদের ওপর অত্যাচারের জন্য LTTE প্রধান প্রভাকরণের রাজীব গান্ধীর ওপর শত্রুতার কারণ বসত। এখানে এটি মনে রাখা দরকার যে রাজীব গান্ধী প্রশাসন পিপলস লিবারেশন ওর্গনাইজেশোন অফ তামিল ইলমের (PLOTE) মতো অন্য একটি জঙ্গি তামিল গোষ্ঠীর সঙ্গেও শত্রুতা সৃষ্টি করেছিল। বিচারের সিদ্ধান্তে, অনশন ধর্মঘটে থিলীপনের মৃত্যু ও ১৯৮৭ সালের অক্টোবরে একটি জাহাজে ১২ জন LTTE জঙ্গির আত্মহত্যা কথাও উল্লেখ করা হয়েছে।
জৈন কমিশনের বিবরণে আরও বহু লোক ও সংস্থার কথা বলা হয়েছে যাদের রাজীব গান্ধী হত্যা কান্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছে। এই সন্দেহভাজনদের মধ্যে যাজক চন্দ্রস্বামীকেও এই হত্যাকান্ডে জড়িত থাকার এবং অর্থ সংস্থানে সহায়ক ছিলেন বলে মনে করা হয়[১৬][১৭][১৮]। জৈন কমিশনের অন্তর্বর্তী বিবরণে যখন এই হত্যাকান্ডে করুনানিধিরও জড়িত থাকার সন্দেহ প্রকাশ করা হয় তখন এমন এক চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয় যার ফলে কংগ্রেস আই. কে. গুজ্রালের সরকারের ওপর থেকে সমর্থন ফিরিয়ে নেয় এবং ১৯৯৮ সালে নতুন করে নির্বাচন হয়।
LTTE মুখপাত্র, আন্তন বালাসিন্ঘাম ভারতীয় দুরদর্শন চ্যানেল NDTV কে জানান যে এই হত্যাকান্ডটি "একটি বিরাট দু:খ জনক ঘটনা, একটি সুবৃহদ ঐতিহাসিক দু:খ জনক ঘটনা, যার জন্য তাঁরা গভীর ভাবে অনুতপ্ত"[১৯][২০]। তার অন্তেষ্ঠী স্থানটিতে বীর ভূমি নামে একটি স্মারক স্তম্ভ গঠিত হয়ছে। হায়দ্রাবাদে নির্মিত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটি রাজীব গান্ধীর নামে নামাঙ্কিত করা হয়েছে এবং সেটির উদ্বোধন করেন UPA এর সভাপতি সোনিয়া গান্ধী।
শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপ নীতি
১৯৮৮ সালে রাজীব গান্ধী পিপলস লিবারেশন অর্গ্যানাইজেশন অফ তামিল ইলম (পিএলওটিই) এর মতো জঙ্গি তামিল গোষ্ঠীগুলির বিরোধিতা করে মালদ্বীপের সামরিক অভ্যুত্থান ব্যর্থ করে দেন। ১৯৮৭ সালেশ্রীলঙ্কার শান্তি প্রচেষ্টায় হস্তক্ষেপ করেন এবং পরে সেদেশে ভারতীয় শান্তিরক্ষী বাহিনী প্রেরণ করেন। এই বাহিনীর সঙ্গে লিবারেশন টাইগার্স অফ তামিল ইলম (এলটিটিই) জঙ্গিগোষ্ঠীর সম্মুখ সমরের জন্য তাকেই দায়ী করা হয়। ১৯৮৭ সালের মাঝামাঝি বোফর্স কেলেঙ্কারি তার সৎ ও দুর্নীতিমুক্ত ভাবমূর্তিটি নস্যাৎ করে দেয়। ফলে ১৯৮৯ সালের নির্বাচনে ভরাডুবি ঘটে তার দল কংগ্রেসের।
কংগ্রেস সভাপতি • ওয়ার্কিং প্রেসিডেন্ট • কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি • কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিটি • অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস কমিটি • প্রদেশ কংগ্রেস কমিটি
ইতিহাস
ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের রাজ্যভিত্তিক নির্বাচনের ইতিহাস • নেহরু-গান্ধী পরিবার • কংগ্রেস রেডিও • ১০ জনপথ • ভারতের জাতীয় জরুরি অবস্থা • বোফোর্স কেলেংকারি • আইএনএ ডিফেন্স কমিটি • ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস (সংগঠন) • কংগ্রেস ভেঙে সৃষ্ট দল