মুহাম্মাদ বিন কাসিম
ইমাদুদ্দীন মুহাম্মদ বিন কাসিম আস সাকাফি (আরবি: عماد الدين محمد بن القاسم الثقفي; ৩১ ডিসেম্বর, ৬৯৫–১৮ জুলাই, ৭১৫) ছিলেন একজন উমাইয়া সেনাপতি ও মুসলিম বিজেতা।[১] তিনি ভারতীয় উপমহাদেশের অন্তর্ভুক্ত সিন্ধু নদসহ সিন্ধু এবং মুলতান জয় করে তা ইসলামি উমাইয়া খিলাফতের অন্তর্ভুক্ত করেন।[২] তার সিন্ধু বিজয়ের ফলে মুসলিমদের জন্য ভারত বিজয়ের পথ প্রশস্ত হয়। বিন কাসিম ৭১২ সালে মাত্র ১৭ বছর বয়সে তৎকালীন রাজা দাহিরকে পরাজিত করে সিন্ধু জয় করেন।[৩][৪] দাহির সিন্ধি ব্রাহ্মণ রাজবংশের শেষ শাসক ছিল এবং তারপর সিন্ধু ইসলামি খিলাফতের অংশ হয়। পরাজিত হওয়ার পর দাহিরের শিরশ্ছেদ করা হয় এবং তার মাথা বসরার গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফের কাছে পাঠানো হয়। মুসলিম বাহিনী সিন্ধুর রাজধানী আরোর দখলের সাথে সাথে মোহাম্মদ বিন কাসিম প্রথম মুসলিম বিজেতা হন, যিনি সফলভাবে ভারতীয় ভূমি দখল করেন।[৫][৬][৭][৮][৯][১০][১১][১২][১৩]
ইমামুদ্দীন মুহাম্মদ বিন কাসিম আস সাকাফি عماد الدين محمد بن القاسم الثقفي | |
---|---|
স্থানীয় নাম | عماد الدين محمد بن القاسم الثقفي |
জন্ম | ৩১ ডিসেম্বর ৬৯৫ তাইফ, আরব উপদ্বীপ |
মৃত্যু | ১৮ জুলাই ৭১৫ (২০ বছর) মসুল, ইরাক |
আনুগত্য | হাজ্জাজ বিন ইউসুফ, উমাইয়া খলিফা প্রথম আল ওয়ালিদের গভর্নর |
পদমর্যাদা | সেনাপতি |
যুদ্ধ/সংগ্রাম | সিন্ধু ও মুলতান জয় এবং তা উমাইয়া খিলাফতের অন্তর্ভুক্তিকরণ |
দাম্পত্য সঙ্গী | জয়নব বিনতে হাজ্জাজ বিন ইউসুফ |
সম্পর্ক |
|
মোহাম্মদ বিন কাসিম বনু সাকিফের অন্তর্গত ছিলেন। এটি একটি আরব উপজাতি ছিল, যা পশ্চিম আরবের তায়েফ শহরের চারপাশে বসবাস করতো। তার পিতা আল কাসিম বিন ইউসুফ তার বাল্যকালেই মারা যান। তারপর থেকে তার চাচা উমাইয়া গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ তাকে লালনপালন করেন। তিনি মোহাম্মদকে যুদ্ধবিদ্যা ও সরকার পরিচালনা শিক্ষা দেন।[৫][৪]
মুসলিমদের পারস্য বিজয়ের পর তিনি তার ছোট চাচা মুহাম্মদ বিন ইউসুফ আস সাকাফির স্থলাভিষিক্ত হয়ে ফার্সের গভর্নর হিসেবে নিযুক্ত হন। এরপর ৭০৮ থেকে ৭১১ সাল পর্যন্ত তিনি সিন্ধু বিজয়ের নেতৃত্ব দেন এবং বিজয় অর্জন হওয়ার পর তিনি সমগ্র অঞ্চলে ইসলামি শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। ৭১২ থেকে ৭১৫ সাল তার মৃত্যু হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি সিন্ধুর গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ইরাকের ওয়াসিত শহরে মৃত্যুবরণ করেন এবং ওয়াসিতেই তার সমাধি রয়েছে বলে কিছু বর্ণনায় পাওয়া যায়।[১৪][১৫] তবে কিছু সুত্রের দাবি হল, তার মৃতদেহ বেলুচিস্তানের উপকূলীয় অঞ্চলের আধা-মরুভূমি মাক্রানে সমাহিত করা হয়েছিল। এর সমর্থনে কোনো শক্তিশালী ও প্রমাণিত সূত্র পাওয়া যায়নি।[৮]
উৎস
মুসলমানদের মা ওয়ারা আন্নাহার বিজয়ের তুলনায় মধ্যযুগীয় আরবি সূত্রে মুহাম্মদ বিন কাসিম ও আরব মুসলিমদের সিন্ধু বিজয় সম্পর্কে তথ্য খুব সীমিত।[১৬] ইমাম বালাজুরি (মৃ.৮৯২) রচিত ফুতুহুল বুলদানে সিন্ধু বিজয় ও বিজেতা মুহাম্মদের ব্যক্তিত্বের বিবরণী নিয়ে কয়েকটি পৃষ্ঠা রয়েছে এবং ইমাম ইয়াকুবির (মৃ. ৮৯৮) কিতাবুল বুলদানে জীবনী সংক্রান্ত তথ্য কেবল একটি রচনার একটি অনুচ্ছেদে সীমাবদ্ধ। এসব ছাড়া ইমাম তাবারির (মৃ. ৮৩৯) এই বিষয়ে ইতিহাস সম্বলিত দুচার লাইন ও ইমাম আবুল ফারাজ ইসফাহানির কিতাবুল আগানিতে এই বিষয়ে সামান্যই উল্লেখ রয়েছে।[১৬]
সমসাময়িক গ্রন্থাবলিতে মোহাম্মদ বিন কাসিম ও সিন্ধু বিজয় সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া না গেলেও ইসলামি ইতিহাসের পরবর্তী রচনাবলিতে এই বিষয়ে ব্যাপক বর্ণনা রয়েছে। লেখক এবং ঘটনাবলীর মাঝে শত বছরের ব্যবধান থাকার কারণে তা বর্ণনায় সনদ উল্লেখ করা হয়েছে। হাদিস বা পূর্ববর্তী ঘটনা বর্ণনার ক্ষেত্রে মুসলিম মুহাদ্দিস এবং ইতিহাসবিদদের সনদের মান যাচাইকরণের বিষয়টি প্রসিদ্ধ। সিন্ধু বিজয় এবং মুহাম্মাদ সম্পর্কে বর্ণনা রয়েছে এমন রচনাবলী:
- আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া।
- আল কামিল ফিত তারিখ।
- তারিখুল খুলাফা।
- তারিখুল ইসলাম।
- আত তারিখুল ইসলামি।
- ওয়াফাইয়াতুল আ'ইয়ান ইত্যাদি।
মুহাম্মদের সিন্ধু বিজয় ও তার মৃত্যুর বিস্তারিত বিবরণ ১৩ শতকের ফার্সি রচনা চাচ নামায় পাওয়া যায়।[১৬] চাচনামার তথ্যাবলী ৮ম শতাব্দীতে সিন্ধু বিজয়ে অংশ নেওয়া আরব সৈন্যদের পরবর্তী বংশধরদের বিবরণ থেকে নেওয়া হয়েছে। যেমন কাজি (বিচারক) ও সিন্দি শহরের আলোর ও ভাকারের ইমামরা, যারা নিজেদের মুহাম্মদের গোত্র বনু সাকিফের বংশধর হিসেবে দাবি করেন।[১৬] বইটির বর্ণনাশৈলীর ঐতিহাসিক সত্যতার ব্যাপারে বেশ কয়েকজন মুসলিম ইতিহাসবিদও কিছু অভিযোগ তুলেছেন। আহমেদ আসিফের মতে, বইটির বর্তমান আরবি পাণ্ডুলিপি মোহাম্মদ বিন কাসিম আস সাকাফির ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বকে কেন্দ্র করে রচিত ; কিন্তু ১৩শ শতাব্দীর পাঠ্য ভিন্ন ছিল। ঐতিহাসিকভাবে বইটি তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ বইটি সিন্ধু অঞ্চলের মাধ্যমে ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলামের আগমনের ইতিহাস বোঝার একটি উৎস ছিল। চাচনামা একটি রোমান্টিক রচনা, যা ১৩ শতকের ইতিহাস দ্বারা প্রভাবিত এবং তা ৮ম শতকের ঐতিহাসিক পাঠ নয়।[১৭]
বইটি নিয়ে এমন পর্যালোচনা হলেও এটি সিন্ধু বিজয় ও মুহাম্মদ সম্পর্কে রচিত একটি বিখ্যাত ঐতিহাসিক গ্রন্থ। বইটি পাকিস্তানের রাষ্ট্র–অনুমোদিত ইতিহাসের পাঠ্যপুস্তকের একটি অংশ। বইটি নিয়ে মূলত প্রাচ্যের ইতিহাসবিদেরা প্রথম সমালোচনামূলক পর্যালোচনা শুরু করে এবং পরবর্তীতে তা মুসলিম ইতিহাসবিদদের প্রভাবিত করে।[১৮] প্রাচ্যবিদ ফ্রান্সেস্কো গ্যাব্রিয়েলি ধারণা করেন যে, এই রচনার তথ্যাবলী সম্ভবত ১০০০ সালের পর উদ্ভূত হয়েছে। চাচ নামাকে তিনি মোহাম্মদ সম্পর্কে তথ্যের জন্য একটি "ঐতিহাসিক রোমান্টিক রচনা" এবং 'একটি দূরতম ও সন্দেহজনক উৎস' বলে মনে করেন।[১৬]
প্রাথমিক জীবন
মুহাম্মদের জন্ম আনু. ৬৯৪ সালে।[১৯] তার জন্মস্থান প্রায় নিশ্চিতভাবে হেজাজের (পশ্চিম আরব) তায়েফ বা মক্কা অথবা মদিনা, যা সাকিফ গোত্রের ঐতিহ্যবাহী অঞ্চল হিসেবে পরিচিত।[১৬] তাদের সাধারণ ইসলাম গ্রহণের পর আনু. ৬৩০ সালে সাকিফের সদস্যরা ধীরে ধীরে খিলাফতে রাশিদায় উচ্চ সামরিক ও প্রশাসনিক পদে অধিষ্ঠিত হয়। প্রাথমিক মুসলিম বিজয়ের সময় এবং পরে বিশেষ করে ইরাকে তারা গুরুত্বপূর্ণ কমান্ড ও অর্থনৈতিক ভূমিকা পালন করে।[২০] এছাড়া গোত্রটি ভারতীয় উপমহাদেশের বিরুদ্ধে প্রথমদিকের আরবীয় সামরিক অভিযানের সাথে যুক্ত কয়েকজন কার্যকর কমান্ডার তৈরি করে। ৬৩৬ সালে বাহরাইনের সাকাফি (পূর্ব আরব) গভর্নর উসমান বিন আবুলআস ভারতীয় বন্দর দেবাল, থানে ও ভারুচের বিরুদ্ধে নৌ অভিযান প্রেরণ করেছিলেন। ৬৬১ সালে উমাইয়া খিলাফতের আবির্ভাবের সাথে সাথে গোত্রটির শক্তি বাড়তে থাকে।
মুহাম্মদ বিন কাসিম বানু আউফ শাখার আবু আকিল পরিবারের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন, যা সাকিফের দুটি প্রধান শাখার একটি।[১৯] হাজ্জাজের উত্থানের সাথে সাথে আবু আকিল পরিবার ব্যাপক প্রতিপত্তি অর্জন করতে থাকে, যিনি মোহাম্মদের পিতা কাসিম বিন হাকামের প্রথম পৈতৃক চাচাতো ভাই।[১৯] হাজ্জাজকে উমাইয়া খলিফা আব্দুল মালিক ( ৬৮৫–৭০৫) দ্বিতীয় মুসলিম গৃহযুদ্ধের সময় এবং পরে ৬৯২ সালে খিলাফত বিষয়ে উমাইয়াদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী আবদুল্লাহ বিন জুবায়ের ইবনে আওয়ামকে হত্যা করেন এবং এর দুই বছর পর তিনি ইরাক ও পূর্ব খিলাফতের ভাইসরয় নিযুক্ত হন।[১৯][১৬] পদোন্নতির পর পর হাজ্জাজ সাকিফ গোত্রের পৃষ্ঠপোষক হয়ে ওঠেন এবং ইরাক ও তার আওতাধীন অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ পদে কয়েকজন সদস্যকে নিয়োগ করেন।[১৯] মুহাম্মদের বাবাকে বসরার ডেপুটি গভর্নর নিযুক্ত করা হয়। যদিও অন্যত্র তার কর্মজীবন আলাদা ছিল না।[১৯] চাচ নামায় উদ্ধৃত মুহাম্মদ ও হাজ্জাজের মধ্যে একটি চিঠি অনুসারে মুহাম্মদ বিন কাসেমের মা হাবিবা উজমা ছিলেন।[১৯]
চাচ নামা আরো ইঙ্গিত করে যে, মুহাম্মদের সুলব নামে একজন সমবয়সী ভাই ছিল। আরবি সূত্রগুলি নির্দেশ করে যে, হাজ্জাজ নামে তার একজন ছোট ভাই ছিল, যিনি ৭৪০ সালের আলাভি বিদ্রোহের সময় একজন উমাইয়া সেনাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন।[১৯] মুহাম্মদের শৈশব ও কৈশোর সম্পর্কে আরবি সূত্র থেকে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।[১৬] তবে আধুনিক ঐতিহাসিক নবী বখশ বালুচ মনে করেন যে, মোহাম্মদ সম্ভবত আংশিকভাবে তায়েফ এবং তারপরে বসরা ও ওয়াসিতে বড় হন, যা তৎকালীন ইরাকের প্রাদেশিক রাজধানী ছিল এবং হাজ্জাজ ৭০২ সালে এটি প্রতিষ্ঠা করেন।[১৯] মোহাম্মদের সময় বসরা একটি সামরিক ও তৎকালীন ইসলামি বিশ্বের বুদ্ধিবৃত্তিক কেন্দ্র ছিল।
মুহাম্মদের কর্মজীবনের দিগন্ত প্রশস্ত হতে পারে, যখন ওয়াসিতে তিনি হাজ্জাজের পৃষ্ঠপোষকতায় শিক্ষিত ও প্রশিক্ষিত হতে থাকেন।[১৯] হাজ্জাজ তাকে খুব পছন্দ করতেন[১৯] এবং তাকে নিজের মেয়ে জয়নাবকে বিয়ে করার জন্য যথেষ্ট মর্যাদাপূর্ণ বলে মনে করতেন।[১৯] কিতাবুল আগানিতে, ১৭ বছর বয়সী মুহাম্মদকে "তার সময়ের সর্বশ্রেষ্ঠ সাকফি বলে উল্লেখ করা হয়েছে।[১৬] বেলুচের সংক্ষিপ্তসারে, 'মোহাম্মদ অনুকূল পরিবেশে একজন দক্ষ, উদ্যমী এবং সূক্ষ্ম রুচির সংস্কৃতিবান ছেলে হয়ে বেড়ে ওঠেন'।[১৯]
ফর্সের গভর্নর
মুহাম্মদের প্রথম দায়িত্ব ছিল আধুনিক ইরানের ফর্স প্রদেশে, যেখানে তাকে কুর্দিদের একটি বিচ্ছিন্ন দলকে বশীভূত করতে বলা হয়েছিল। মিশন সফলভাবে শেষ হওয়ার পর তিনি ফারসের গভর্নর হিসেবে নিযুক্ত হন। তিনি সম্ভবত নিজের চাচা মোহাম্মদ বিন ইউসুফ আস সাকাফি স্থলাভিষিক্ত হন। তিনি হাজ্জাজের ছোট ভাই ছিলেন এবং পূর্বে একজন গভর্নর ছিলেন।[৬] দায়িত্ব পাওয়ার পর শিরাজ শহরটিকে মুহাম্মদ পুনরুজ্জীবিত করেন বলে জানা যায়। তিনি শহরে একটি রাজকীয় ভিলা এবং এর কাছেই একটি সামরিক ক্যাম্প তৈরি করেনন। এছাড়া তাকে শিরাজের দক্ষিণে কাস্পিয়ান সাগরের নিকটবর্তী জুরজানের কিছু অঞ্চল অধীনস্থ করার দায়িত্বও দেওয়া হয়েছিল।[২১]
তখন ইবনে আশ'আসের বিদ্রোহের ফলে ফর্সে কিছু বিদ্রোহী হয়তো অবশিষ্ট ছিল, যা হাজ্জাজের শাসনকে প্রায় পতনের মুখে নিয়ে যায়। বিদ্রোহীদের একজন প্রবীণ সমর্থক এবং সেই সময়ের একজন উল্লেখযোগ্য শিয়া, জাবির ইবনে আবদুল্লাহ রা. এর একজন শিষ্য ও বিখ্যাত হাদীস বর্ণনাকারী[২২] আতিয়া ইবনে সা'দ আউফী হাজ্জাজের আদেশে মোহাম্মদ বিন কাসেমের হাতে গ্রেফতার হন।[২৩][২৪] গ্রেফতারের পর আতিয়া বিন সাদকে শাস্তি হিসেবে সাহাবি আলিকে গালি দিতে বলা হয়। আতিয়া আলীকে অভিশাপ দিতে অস্বীকার করেন এবং শাস্তি পান। যদিও শাস্তির বিশদ বিবরণ কোথাও উল্লেখ করা হয়নি ; তবে ইমাম ইবনে হাজার আসকালানি ও ইমাম তাবারির মতো ইতিহাসবিদগণ উল্লেখ করেন যে, তাকে ৪০০ বেত্রাঘাত করা হয় এবং লাঞ্ছনার অংশ হিসেবে জন্য তার চুল ও দাড়ি কামিয়ে দেওয়া হয়। তখন তিনি খুরাসানে পালিয়েছিলেন এবং শাসক পরিবর্তন হওয়ার পর ইরাকে ফিরে আসেন।[২৫][২৬]
সিন্ধুর পটভূমি
প্রারম্ভিক মুসলিম উপস্থিতি
খেলাফতে রাশেদার সময় প্রাথমিক মুসলিম মিশনারি দ্বারা হিন্দু অধ্যুষিত সিন্ধু ও ইসলামের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করা হয়। হাকিম ইবনে জাবালা আবাদি, যিনি ৬৪৯ সালে মাক্রান আক্রমণ করেছিলেন, তিনি ছিলেন আলী ইবনে আবু তালিবের প্রথম দিকের পক্ষপাতী।[২] আলী রা. এর খিলাফতকালে সিন্ধুর অনেক জাট ইসলামের প্রভাবে আসেন[২৭] এবং কেউ কেউ উটের যুদ্ধে অংশ নিয়ে আলীর পক্ষে যুদ্ধ করতে গিয়ে শহিদ হন।[২] হারিস ইবনে মুররাহ আবাদি এবং সাইফি ইবনে ফাসায়েল শায়বানী উভয় আলী রা. এর সেনাবাহিনীর অফিসার ছিলেন এবং ৬৫৮ খ্রিষ্টাব্দে দুজনেই মাক্রান আক্রমণ করেন।[২] দামেস্কের কাছে ৬৬০ সালে হুজর ইবনে আদি আল-কিন্দির সাথে শিরশ্ছেদ করা ৭ জন আলী সমর্থকের মধ্যে সাইফি বিন ফাসায়েল একজন ছিলেন।[২] উমাইয়াদের অধীনে (৬৬১–৭৫০ খ্রিস্টাব্দ) অনেক শিয়া প্রত্যন্ত গ্রাম্য অঞ্চলে আপেক্ষিক শান্তিতে বসবাসের জন্য সিন্ধু অঞ্চলে আশ্রয় প্রার্থনা করে এবং জিয়াদ হিন্দি ছিলেন সেই শরণার্থীদের একজন।[২৮]
সিন্ধুর প্রতি উমাইয়াদের আগ্রহ
উইঙ্কের মতে, মেড (সিন্ধুতে বসবাসকারী সিথিয়ানদের একটি উপজাতি) এবং অন্যান্যদের ওপর অভিযানের মাধ্যমে এই অঞ্চলে উমাইয়াদের আগ্রহ বৃদ্ধি পায়।[২৯] মেডরা অতীতে দজলার মুখ থেকে শ্রীলঙ্কার উপকূল পর্যন্ত তাদের বাওয়ারিজ থেকে সাসানি জাহাজসমূহে জলদস্যুতায় লিপ্ত ছিল এবং তখন পর্যন্ত তারা দেবল, কচ্ছ এবং কাথিয়াবাড়ের ঘাঁটি থেকে আরব জাহাজ শিকার করতে সক্ষম হয়েছিল।[৩০]
সেই সময়ে সিন্ধু ছিল হিন্দের বন্য সীমান্ত অঞ্চল এবং সিন্ধুর বেশিরভাগ অঞ্চলে আধ-যাযাবর উপজাতিদের বসবাস ছিল, যাদের কার্যকলাপ ও সক্রিয়তায় পশ্চিম ভারত মহাসাগরের বেশিরভাগ অঞ্চল বিরক্ত ছিল।[৩০] মুসলিম সূত্রগুলি জোর দিয়ে বলে যে, দেবল জলদস্যু এবং অন্যান্যদের দ্বারা গুরুত্বপূর্ণ ভারতীয় বাণিজ্যিক রুটগুলির সাথে সংঘটিত এমন কার্যকলাপের ফলেই আরবরা এই অঞ্চলকে বশীভূত করতে বাধ্য হয়, যাতে সমুদ্রবন্দর ও সামুদ্রিক রুটগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় এবং সিন্ধু সেই জলদস্যুদের মূলকেন্দ্র ছিল সেই সাথে তাদের স্থলপথও।[২৯] হাজ্জাজের গভর্নরশিপের সময দেবলের কিছু মেড একটি অভিযান চালিয়ে শ্রীলঙ্কা থেকে আরবে ভ্রমণকারী মুসলিম মহিলাদের অপহরণ করে। এভাবে মেডরা উমাইয়া খিলাফতের ক্রমবর্ধমান শক্তিকে ভিত্তি প্রদান করেছিল এবং এর ফলে তাদের সিন্ধু অঞ্চলের বেলুচিস্তানের মাক্রানে পা রাখতে বাধ্য হতে হয়েছিল।[৩০][৩১][৩২]
এছাড়াও এই অভিযানের কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয় যে, আরবদের থেকে পালিয়ে আসা সাসানি এবং উমাইয়াদের একত্রীকরণ থেকে পলায়নকারী আরব বিদ্রোহীদের আশ্রয় প্রদানের জন্যেও আরবরা সিন্ধু অভিযানে আগ্রহী হয়। সেই আরব বিদ্রোহীদের পরে দেবলের গভর্নর পার্তাব রায় বন্দী করে। নাহেদ নামের এক আরব মেয়ের লেখা একটি সাহায্য প্রার্থনামূলক চিঠি হাজ্জাজ বিন ইউসুফের কাছে আসে, যে মহিলা পার্তাব রায়ের কারাগার থেকে পালিয়ে এসে হাজ্জাজ বিন ইউসুফের কাছে সাহায্য চেয়েছিলেন। হাজ্জাজ দাহিরের কাছে বন্দীদের মুক্তি এবং ক্ষতিপূরণ দাবি করলে পরবর্তীতে দাহির এই বলে প্রত্যাখ্যান করে যে, তাদের উপর তার কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। অবশেষে ৭১১ সালে হাজ্জাজ সিন্ধুর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য মুহাম্মদ ইবনে কাসিমকে পাঠান।
মাওয়ালি–নতুন ধর্মান্তরিত ও অনারব মুসলিম–যারা সাধারণত হাজ্জাজের রাজনৈতিক বিরোধীদের সাথে জোটবদ্ধ ছিল এবং বলা হয়, তাদের প্রায়শই উমাইয়া খিলাফতের সীমান্তে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে বাধ্য হত; যেমন—কাবুল, সিন্ধু ও মাওয়ারান্নাহর। মাওয়ালিদের অনেকে সিন্ধু বা তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল থেকে বিদ্রোহী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করত।[২৯] রাশিদুন খলিফা উমর বিন খাত্তাবের সময় থেকে এই অঞ্চল আরব নীতির অনুকূলে ছিল না। তিনি এটি একটি আতিথেয়তাহীন ও দরিদ্র ভূমি হওয়ার খবর পেয়ে এই অঞ্চলে আরো অভিযানমূলক উদ্যোগ বন্ধ করে দিয়েছিলেন।
সিন্ধু জয়
হাজ্জাজ এই অভিযানে ক্ষেত্রে পূর্বেকার অভিযানের চেয়ে অধিক যত্ন ও পরিকল্পনা করেছিলেন।[২৯] ৭০৮ থেকে ৭১১ সাল পর্যন্ত হাজ্জাজ মুহাম্মদ বিন কাসিম আস সাকাফিকে অভিযানের কমান্ড দিয়েছিলেন এবং তখন তার বয়স ছিল মাত্র ১৫–১৭ বছর। এর সুস্পষ্ট কারণ ছিল পূর্ববর্তী দুজন উমাইয়া কমান্ডার জলদস্যু ঠেকাতে ব্যর্থতার জন্য সিন্ধুর শাসক রাজা দাহিরকে শাস্তি দিতে সফল হননি এবং সিন্ধুর উপকূলে মুসলিম জাহাজগুলি ব্যাহত করা থেকে বাঁচাতে পারেননি।[৩৩] তাই হাজ্জাজ আস্থাবান সেনাপতির দায়িত্বে সিন্ধুতে অভিযান চালানোর পরিকল্পনা করেন। হাজ্জাজ কুফা থেকে এই অভিযানের তত্ত্বাবধান করেন এবং নিয়মিত প্রতিবেদন আকারে মুহাম্মদের সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ বজায় রেখেছিলেন এবং এর উদ্দেশ্যে বসরা ও সিন্ধুর মধ্যে বিশেষ বার্তাবাহক নিযুক্ত করা হয়েছিল।[২৯]
মুহাম্মাদ বিন কাসিমের অধীনে শিরাজ থেকে রওয়ানা হওয়া সৈন্যবাহিনীতে ৬,০০০ জন সিরীয় অশ্বারোহী ও ইরাক থেকে আসা মাওয়ালিদের একটি দল ছিল।[২৯] সিন্ধুর সীমান্তে তার সাথে আরো একটি অগ্রিম বাহিনী ও ছয় হাজার উটের অশ্বারোহী বাহিনী যোগ দিয়েছিল এবং পরবর্তীতে মাক্রানের গভর্নরের কাছ থেকে শক্তি বৃদ্ধির অংশ হিসেবে সরাসরি সিন্ধু নদীর মোহনায় ৫টি মানজানিকসহ (ক্যাটাপল্টস) কিছু অস্ত্রশস্ত্র সমুদ্রপথে দেবলে স্থানান্তরিত হয়েছিল।[২৯] যে সেনাবাহিনী শেষ পর্যন্ত সিন্ধু দখল করে, পরে তারা জাট ও মেড এবং সেইসাথে অন্যান্য বেসামরিক লোকদের উচ্ছ্বসিত ভাব প্রত্যক্ষ করে, যারা সিন্ধুতে আরবদের সাফল্য স্বচক্ষে দেখেছিল।
মুহাম্মদ বিন কাসিম যখন তার বাহিনীকে নিয়ে মাক্রান মরুভূমির মধ্য দিয়ে যান, তখন তাকে ফান্নাজবুর এবং আরমান বেলা (লাসবেলা) নামক অশান্ত শহরদুটিকে পরাস্ত করতে হয়েছিল, যে দুটিই পূর্বে আরবদের দ্বারা জয় করা হয়েছিল এবং মাঝপথে তারা বিদ্রোহ করে।[২৯]
মুহম্মদ বিন কাসিমের সিন্ধু অভিযানে প্রথম আক্রমণ করা শহরটি ছিল দেবল। হাজ্জাজের নির্দেশে মুহাম্মাদ দেবলের বিরুদ্ধে তাদের ঔদ্ধত্যের জবাব দিয়েছিলেন এবং জনগণ বা পুরোহিতদের আঘাত না করে তাদের ঢাল হিসেবে ব্যবহৃত বড় মন্দিরটি গুড়িয়ে দেন।[২৯][৩৩] দেবল থেকে আরব সৈন্যরা যুদ্ধ ছাড়াই উত্তর-পূর্ব দিকে যাত্রা করে নেরুণ ও সাদুসানের (সেহওয়ান) মত মতো শহরগুলি জয় করেন।[৩৪] যুদ্ধের ইসলামি নিয়ম অনুযায়ী ক্রীতদাসসহ যুদ্ধলব্ধ সম্পদের একপঞ্চমাংশ হাজ্জাজ ও খলিফার কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল।[৩৪] এসব শহরের অভিযান আপেক্ষিক স্বাচ্ছন্দ্যভাবে সম্পন্ন হয়েছিল; তবে সিন্ধুর [ক] অপর প্রান্তে রাজা দাহিরের সেনাবাহিনী প্রস্তুত ছিল, যারা তখনো মুসলিম বাহিনীর মুখোমুখি হয়নি।[৩৪] মুহাম্মাদ তাদের মুখোমুখি হওয়ার প্রস্তুতি হিসেবে হাজ্জাজের পাঠানো অতিরিক্ত শক্তি পুনরায় সরবরাহ ও গ্রহণ করার জন্য নেরুনে ফিরে আসেন।[৩৪] সিন্ধু নদীর পূর্ব তীরে শিবির স্থাপন করে বিন কাসিম দূত পাঠান এবং নদীতে জাট ও নৌকার মালিকদের সাথে দর কষাকষি করেন।[৩৪] বেট দ্বীপের রাজা মোকাহ বাসায়ার সাহায্য পেয়ে বিন কাসিম নদী পার হয়ে যান। সেখানে তার সাথে ভাট্টার ঠাকুর ও পশ্চিমী জাটদের সেনারা যোগ দিয়েছিলেন।[৩৪]
আররুরে (রোহরি) মুহাম্মাদ সম্মুখযুদ্ধে রাজা দাহিরের বাহিনী ও পূর্ব-জাটদের মুখোমুখি হয়েছিলেন।[২৯] যুদ্ধে দাহির মারা যান এবং তার সেনাবাহিনী পরাজিত হয়ে পলায়ন করলে মুহম্মদ সিন্ধুর নিয়ন্ত্রণ নেন।[৩৪] যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে কেবল লড়াইরত শত্রু সৈন্যদের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয় এবং কারিগর, বণিক ও কৃষকদের সাধারণ ক্ষমা করা হয়। মৃত দাহির ও তার সভাসদরা, রাজকুমারী এবং যুদ্ধলব্ধ সাধারণ সম্পদের পঞ্চমাংশ হাজ্জাজের কাছে পাঠানো হয়েছিল।[৩৪] এরপর শীঘ্রই অন্যান্য প্রদেশের রাজধানী, ব্রাহ্মনাবাদ, আরোর এবং মুলতান মধ্যবর্তী অন্যান্য শহরের সাথে জয় করা হয়। এসব বিজয়ে সামান্য মুসলিম হতাহতের ঘটনা ঘটে।[৩৪] মুলতান ছিল হিন্দু ধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান।[৩৩] সাধারণত কয়েক সপ্তাহ বা মাস অবরোধের পর মুসলিম সৈন্যরা বড় বড় ব্যবসায়ীদের হস্তক্ষেপের মাধ্যমে একটি শহর দখল করতেন এবং তাদের সাথে পরবর্তীতে বিভিন্ন চুক্তি নিষ্পত্তি করতেন।[৩৪] নিয়ম মাফিক যুদ্ধের পর সমস্ত যোদ্ধাদের মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়েছিল এবং তাদের স্ত্রী ও সন্তানদের যথেষ্ট সংখ্যক দাস করা হয়েছিল এবং যুদ্ধলব্ধ স্বাভাবিক সম্পদের পঞ্চমাংশ ও ক্রীতদাসদের হাজ্জাজের কাছে পাঠানো হয়েছিল।[৩৪] সাধারণ জনগণের জন্যে নিরাপত্তা কর ও সম্মানী স্থির তাদের বাণিজ্য ও কুষি চালিয়ে যেতে উৎসাহিত করা হয়েছিল।[৩৪]
আধুনিক পাকিস্তানের অন্তর্গত সিন্ধু জয় করা যদিও ব্যয়বহুল ছিল এবং এতে কিছু সৈন্য হারাতে হয়েছিল, উমাইয়া খিলাফতের জন্য এটি একটি বড় লাভ ছিল। এর ফলে ইসলাম ভারতীয় উপমহাদেশে প্রবেশ করে এবং গোটা অঞ্চলে ছড়িয়ে যায়। এরপর মুসলমানরা ভারতের অভ্যন্তরে আক্রমণ করার চেষ্টা করে। কিন্তু তারা গুহিলা রাজবংশের উত্তর ভারতীয় রাজা বাপ্পা রাওয়াল, গুর্জরা-প্রতিহার রাজবংশের নাগভট্ট ও ৮ম শতাব্দীর প্রথম দিকে চালুক্য রাজবংশের দক্ষিণ ভারতীয় সম্রাট দ্বিতীয় বিক্রমাদিত্যের মুখোমুখি হয় এবং পিছু হটে। ৭১৫ খ্রিষ্টাব্দে মুহাম্মাদ বিন কাসিমকে ভারতের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে ইরাকে ডেকে পাঠানো হয়। কিছু বিশ্লেষক মনে করেন যে, মোহাম্মদ বিন কাসিম যদি আরবে ফিরে না যেতেন তাহলে পুরো ভারত জয় করা তার কাছে সময়ের ব্যাপার ছিল মাত্র। মুহাম্মাদের পর অনেকে অভিযান চালান; কিন্ত কেউই সফল হতে পারেনি। কাথিয়াবাড়ের অভিযানে ব্যর্থ হওয়ার পর আরব ইতিসবিদরা স্বীকার করেছেন যে, আব্বাসীয় খলিফা আল-মাহদি ভারতের কোনো অংশ জয় করার প্রকল্প ছেড়ে দিয়েছিলেন।"
সামরিক ও রাজনৈতিক কৌশল
হাজ্জাজ কর্তৃক মুহাম্মাদকে পাঠানো একটি চিঠিতে সামরিক কৌশলের রূপরেখা দেওয়া হয়েছিল:[৩৫]
আমার হুকুম দেওয়া হল,আহলে হার্বের (যোদ্ধাদের) সবাইকে হত্যা করো; তাদের ছেলে-মেয়েদের জিম্মি করে আটক করে বন্দি করো। যারা আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে না...তাদের আমান (শান্তি ও নিরাপত্তা) দান করো এবং তাদের সম্মান ও সম্পদের জিম্মি (সংরক্ষণকারী ব্যক্তি) হিসাবে নিজেকে স্থির করো।..
আরবদের প্রথম লক্ষ্য ছিল অর্থনৈতিক অবকাঠামো সংরক্ষণের চেষ্টা করার সাথে সাথে স্বল্পকায় হতাহতের মাধ্যমে সিন্ধু বিজয়কে সহজতর করা।[৩৬] এই কারণে শহরগুলিকে দুটি বিকল্প দেওয়া হয়েছিল : হয়তো বা শান্তিপূর্ণভাবে মুসলিমদের কাছে নতি স্বীকার করা বা বল প্রয়োগের মাধ্যমে তাদের প্রতিহত করা।[৩৭] শহর দখলের কাজটি সাধারণত শত্রুদের মধ্য থেকে একটি পক্ষের সাথে একটি চুক্তির মাধ্যমে সম্পন্ন করা হতো এবং তাদের বিশেষ সুযোগ-সুবিধা ও বস্তুগত পুরস্কার দিয়ে চুক্তি করা হত।[২৯] এই ধরনের চুক্তি দুই ধরনের ছিল: "সুলহ " বা "আহদে ওয়াসিক" (চুক্তি) ও "আমান (আত্মসমর্পণ/শান্তি)"।[২৯] অস্ত্রের জোরে দখল করা শহর ও দুর্গগুলির মধ্যে বিন কাসিম নিজের সামরিক কৌশলের অংশ হিসাবে আহলে-হারব ( লড়াইকারী পুরুষ) শত্রুদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছিলেন। তাদের মধ্যে জীবিত সৈন্যদের ক্রীতদাস করা হয়েছিল।[২৯]
যেখানে প্রতিরোধ ছিল শক্তিশালী, দীর্ঘায়িত ও নিবিড়, সেখানে প্রায়শই মুসলিম বাহিনীতে ব্যাপক হতাহতের ঘটনা ঘটত, সেখানে মুহাম্মদ বিন কাসিমের প্রতিক্রিয়া ছিল একটু কঠিন ও নাটকীয়। রাওয়ারে ৬,০০০ জন, ব্রাহ্মনাবাদে ৬,০০০ থেকে ২৬,০০০, ইস্কাল্টানে ৪,০০০ এবং মুলতানে ৬,০০০ মৃত্যু ঘটান।[৩৭] এর বিপরীতে সুলহের মাধ্যমে দখলকৃত এলাকা, যেমন: আরমাবিল, নিরুন ও আরোরে প্রতিক্রিয়া ছিল খুবই হালকা এবং সেখানে মাত্র কিছু হতাহতের ঘটনা ঘটে।[৩৭] সুলহকে ( পরামর্শ) মুহাম্মদ বিন কাসিমের বিজয়ের পছন্দনীয় পদ্ধতি বলে মনে হয়েছিল। ইমাম বালাজুরি এবং চাচ নামা দ্বারা নথিভুক্ত ৬০% এরও বেশি শহর এবং গ্রাম্য উপজাতীয় অঞ্চল ব্যবহারযোগ্য ছিল।[৩৭] এক পর্যায়ে হাজ্জাজ অতি নম্র হওয়ার জন্য মুহাম্মাদকে তিরস্কার করেছিলেন।[৩৭] ইতিমধ্যে সাধারণ লোকদের সবাইকে ক্ষমা করে দেওয়া হয়েছিল এবং তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যেতে উত্সাহিত করা হয়েছিল।[২৯] হাজ্জাজ আদেশ দিয়েছিলেন যে, এই বিকল্পটি দেবলের কোনো বাসিন্দাকে দেওয়া হবে না; তবুও মুহাম্মদ বিন কাসিম দেবলের কিছু নির্দিষ্ট গোষ্ঠী এবং ব্যক্তিকে এটি প্রদান করেছিলেন।[৩৭]
মুসলিম সাফল্যের কারণ
মুহাম্মদ বিন কাসিমের সাফল্যের জন্য আংশিকভাবে রাজা দাহিরকে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী সংখ্যাগরিষ্ঠের উপর নিপীড়নমূলক শাসন এবং একজন অজনপ্রিয় হিন্দু রাজা হিসেবে দায়ী করা হয়েছে, যারা আরোরের চাচ এবং তার আত্মীয় রাই রাজবংশকে দখলদার হিসেবে দেখেছিলেন।[৩১] বৌদ্ধদের সহায়তা প্রদান এবং জাট ও মেড সম্প্রদায় থেকে দাহিরের অশ্বারোহী বাহিনীতে মূল্যবান পদাতিক সেনা হিসাবে কাজ করা বিদ্রোহী সৈন্যদেরও দায়ী করা হয়, যারা দাহিরের পক্ষে ত্যাগ করেছিল।[৩৮] যদিও ব্রাহ্মণ, বৌদ্ধ, গ্রীক এবং আরব সাক্ষ্য পাওয়া যায় যে, দুটি ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে ৭ম শতাব্দী পর্যন্ত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল।[৩৯]
এর সাথে আরো ছিল:
- মুসলিম বাহিনীর উচ্চতর সামরিক সরঞ্জাম; যেমন: সিজ ইঞ্জিন ও মঙ্গোল বও ( এক প্রকার ধনুক বা পেতে রাখা ফাঁস)।[৩১][৪০]
- সৈন্যদের মাঝে শৃঙ্খলা ও দৃঢ় নেতৃত্ব।[৩১]
- মনোবল বৃদ্ধিকারী হিসেবে জিহাদের ধারণা।[৩১]
- ধর্ম; মুসলিম সাফল্যের ভবিষ্যদ্বাণীতে ব্যাপক বিশ্বাস।[৩১][৩৯]
- স্থানীয়দের অস্ত্র গ্রহণ না করা অথবা গ্রহণ না করতে প্ররোচিত করা হয়েছিল। কারণ মোট জনসংখ্যার অধিকাংশই ছিল বৌদ্ধ এবং তারা তাদের হিন্দু শাসকদের প্রতি অসন্তুষ্ট ছিল।[৩৯]
- লোহানা জাটদের অপেক্ষাকৃত দূর্বল পরিশ্রম।[৩৯]
- দাহিরের প্রধান ও অভিজাতদের দলত্যাগ করা।[৩৯]
সিন্ধু প্রশাসন
সিন্ধু বিজয়ের পর মুহাম্মাদ বিন কাসিমের কাজ ছিল একটি স্থিতিশীল রাষ্ট্র হিসেবে এতে একটি প্রশাসনিক কাঠামো স্থাপন করা, যা একটি নতুন বিজিত বিদেশী ভূমিকে অন্তর্ভুক্ত করবে, যেখানে পূর্বে অমুসলিমদের বসবাস ছিল।[৩৬] তাই মুহাম্মাদ একটি সমঝোতামূলক নীতি গ্রহণ করেছিলেন এবং স্থানীয়দের তাদের ধর্মীয় কর্মকাণ্ডে হস্তক্ষেপ না করার বিনিময়ে মুসলিম শাসন মেনে নেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলেন।[৩৬] যতদিন স্থানীয়রা নিজেদের নিরাপত্তা কর এবং শাসককে শ্রদ্ধা প্রদান অব্যাহত রাখবে ততদিন এর বিনিময়ে ইসলামি রাষ্ট্র অমুসলিমদের যেকোন বিদেশী আক্রমণ ও শত্রুর হাত থেকে সুরক্ষা প্রদান করবে।[৩১] তিনি এ অঞ্চলের মুসলিম জনগণের জন্য ইসলামি শরিয়া আইন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন; তবে হিন্দু ও অন্য ধর্মাবলম্বীদের তাদের গ্রাম শাসন করার এবং তাদের নিজস্ব আইন অনুসারে তাদের মধ্যকার বিরোধ নিষ্পত্তি করার অনুমতি দেয়া হয়েছিল।[৩১] গ্রামপ্রধান (রঈস) ও সর্দারসহ (দিহকান) ঐতিহ্যবাহী শ্রেণিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানগুলি বজায় রাখা হয়।আমিল নামক একজন মুসলিম অফিসারকে বংশগত ভিত্তিতে প্রতিটি শহর পরিচালনার জন্য অশ্বারোহী সৈন্যদলের সাথে মোতায়েন করা হয়েছিল।[৩৬]
সম্পদে ইসলামি আইন মতে কর এবং খারাজ বসানো হয়েছিল এবং অমুসলিমদের জিম্মি (সংরক্ষিত ব্যক্তি) হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছিল। জিম্মি অর্থের মাঝে তাদের সম্পদ, সম্মান ও উপসালয়ের সংরক্ষণ করাও অন্তর্ভুক্ত ছিল।[২৯] স্থানীয় অমুসলিমদের সেনাবাহিনীর চাকরি ও জাকাত নামি মুসলিমদের উপর আরোপিত ধর্মীয়ভাবে বাধ্যতামূলক করব্যবস্থার অর্থ প্রদান থেকে মাফ করা হয়েছিল[৩৬] এবং এর বদলায় তাদের ওপর আরোপিত করব্যবস্থা ছিল জিজিয়া। জিজিয়া একটি প্রগতিশীল কর, যা উচ্চশ্রেণীর অমুসলিমদের থেকে উচ্চহারে এবং নিম্নশ্রেণীর থেকে নামমাত্রে নিরাপত্তার বিনিময়ে সরকারীভাবে গ্রহণ করা হয়। এর কারণ হল, অমুসলিম নাগরিকদের থেকে রাষ্ট্রের আর্থিক খাতের জন্য জাকাত গ্রহণ করা হয় না। এছাড়াও সরকারি রাজস্বের তিন শতাংশ ব্রাহ্মণদের জন্য বরাদ্দ ছিল।[৩১]
প্রশাসনে পূর্ববর্তী শাসকদের অন্তর্ভুক্তি করণ
তার শাসনামলে হিন্দু ও বৌদ্ধদের বিশ্বস্ত উপদেষ্টা ও গভর্নর হিসেবে প্রশাসনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল।[৩১] এমনকি একজন হিন্দু কাকসা একদা তার প্রশাসনের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন।[৪১] এছাড়াও দাহিরের প্রধানমন্ত্রী এবং বিভিন্ন প্রধানদেরও প্রশাসনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল।[৪২]
জাটদের মুখোমুখি
উল্লেখযোগ্য মধ্যযুগীয় মুসলিম ইতিহাসগ্রন্থ যেমন : চাচ নামা, জয়নুল-আখবার ও তারিখে বাইহাকি জাট ও মুহাম্মদ বিন কাসিমের বাহিনীর মধ্যে যুদ্ধের কথা লিপিবদ্ধ করেছে।[৪৩]
ধর্ম
লেন-পুল লিখেছেন যে, "একটি নিয়ম হিসাবে মুসলিম সরকার একযোগে সহনশীল এবং অর্থনৈতিক ছিল"।[৪৪][৪৫] ইসলাম গ্রহণে অস্বীকৃতি জানানো অমুসলিম নাগরিকদের জিজিয়া কর প্রদান একটি অর্থনৈতিক প্রেরণা হিসেবে কাজ করে। হিন্দু ও বৌদ্ধধর্মালম্বীদের জিম্মি হিসাবে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়েছিল[৪৬] এবং তাদের থেকে মুসলিমদের প্রদত্ত জাকাতের পরিবর্তে জিজিয়া আদায় করা হয়েছিল।[৪৭][৪৮][৪৬] অমুসলিমদের থেকে যাকাত আদায়ের পরিবর্তে তাদের জিজিয়া গ্রহণ অল্প সংখ্যক লোককে ইসলামে ধর্মান্তরিত না হয়ে স্বধর্মে বহাল থাকার অধিকার দেওয়া হয়েছিল।[৩৬] মুহাম্মদ বিন কাসিম কৃষিপণ্যের ১০% বাধ্যতামূলক বাৎসরিক জিজিয়া কর নির্ধারণ করেছিলেন।[৪৯][৫০][৫১][৫২]
দক্ষিণ ও দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার ইসলামের ইতিহাসবিদ মানান আহমেদ আসিফের মতে আল বিরুনির বর্ণনায় "মুহাম্মদ বিন কাসিম সিন্ধুতে সর্বপ্রথম একটি নিষিদ্ধ (গো-হত্যা) উঠিয়ে নেওয়া এবং প্রকাশ্যে মূর্তি নোংরা করার ( নৈবেদ্য হিসাবে গরুর মাংস দেওয়া ) মাধ্যমে মুশরিকদের উপর ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব নিশ্চিত করেন এবং এটি মন্দিরকে উপাসনার স্থান হিসাবে চালিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেওয়ার আগে ঘটে।[৫৩] পরবর্তীতে এমন কোনো ঘটনার বর্ণনা ইতিহাসে পাওয়া যায়নি। ধর্মনিরপেক্ষ ( সকলের ধর্মীয় কাজে স্বাধীনতা প্রদান অর্থে ) গভর্নরদের তত্ত্বাবধানের জন্য ''সদরুল ইসলাম আল ফায়াল" নামক একটি ধর্মীয় অফিস তৈরি করা হয়েছিল।[৩৬] দেশীয় বংশানুক্রমিক অভিজাতরা রানা উপাধিতে পুনরায় নিযুক্ত হন। ইয়োহানান ফ্রিডম্যানের মতে, মুহাম্মদ বিন কাসিম ঘোষণা করেছিলেন যে, ব্রাহ্মনাবাদের ব্রাহ্মণরা ভালো মানুষ।[৪৯]
মুসলিমদের বিজিত সিন্ধুতে ইসলামে ধর্মান্তরিতকরণ সামাজিক গতিশীলতার কারণে মন্থর গতিতে চলেছিল এবং ইসলামের প্রসার ধীরগতিতে হয়েছিল; এমনকি কয়েক শতাব্দী লেগেছিল।[৩৬] তখন ইসলামে কোনো গণধর্মান্তর ঘটেনি এবং কিছু মন্দির ধ্বংস থেকে রক্ষা পায়; যেমন: মুলতানের সূর্য মন্দির।[৫৪] সিন্ধু অঞ্চল ও মুলতানের আরব বসতি স্থাপনকারী নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে স্থানীয়রা ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়েছে শুধুমাত্র ধীরে ধীরে, বড় আকারে নয়।[৫৫] সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসংখ্যা হিন্দুই থেকে যায়, যাদেরকে রাষ্ট্র কর্তৃক আরোপিত জিজিয়া কর দিতে হয়েছিল।[৫৫] লোকমুখে প্রচলিত আছে যে, বিন কাসিম আলী ইবনে আবি তালিব রা. এর কন্যা সাইয়্যদা রুকাইয়া বিনতে আলীর সাথে দেখা করেছিলেন।[৫৬] ধারণা করা হয়, তিনি লাহোরে (পাকিস্তান) এসেছিলেন এবং সেখানেই রুকাইয়া রা. এর সাথে তার সাক্ষাৎ হয়। লাহোরে বিবি পাক দামান (উর্দু: بی بی پاکدامن) নামে একটি মাজার রয়েছে, যা স্থানীয়রা রুকাইয়া বিনতে আলীর মাজার বলে বিশ্বাস করে।[৫৭]
মৃত্যু
হাজ্জাজ ৭১৪ সালে মারা যান এবং তার এক বছর পরে খলিফা প্রথম আল ওয়ালিদ। আল ওয়ালিদের পর তার ভাই সুলায়মান খিলাফতের স্থলাভিষিক্ত হন। হাজ্জাজ আল ওয়ালিদের একান্ত বিশ্বস্ত ছিলেন এবং খিলাফতের বিষয়ে তার ছেলের পক্ষে প্রচারণা চালান এবং এর ফলে তিনি সুলাইমানের বিরাগভাজন হন।পরবর্তীতে সুলাইমান হাজ্জাজের ঘনিষ্ঠ জেনারেল ও কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়া শুরু করেন। সে হিসাবে হাজ্জাজের সফল সেনাপতি মাওয়ারান্নাহর (মধ্য এশিয়া) বিজয়ী কুতায়বা বিন মুসলিম এবং সিন্ধু বিজয়ী মুহাম্মাদের প্রতি দৃষ্টিপাত করেন। তিনি বিশিষ্ট জেনারেল আল মুহাল্লাবের পুত্র ইয়াজিদকে ইরাকের গর্ভনর নিয়োগ করেন এবং তিনি ইয়াজিদ ইবনে আবি কাবশাকে মুহাম্মাদ বিন কাসিমের স্থলাভিষিক্ত করে সিন্ধুর বদলি গর্ভনর নিযুক্ত করেন, যিনি পূর্বে ফারস, কিরমান, মাক্রান ও সিন্ধুর গভর্নর হিসাবে হাজ্জাজের হাতে নির্যাতন ও বন্দীত্বে শিকার হয়েছিলেন। ইয়াজিদ নিয়োগ পেয়েই অবিলম্বে বিন কাসিমকে শিকলে বেঁধে ইরাক পাঠিয়ে দেন।[২৯] উল্লেখ্য যে, মুহাম্মাদের বিদ্রোহ করে সিন্ধু অঞ্চলে স্বতন্ত্র রাজ্য প্রতিষ্ঠার সমূহ সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু তিনি খেলাফতের কেন্দ্র থেকে পৃথক হয়ে স্বতন্ত্র রাজ্য প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী ছিলেন না।
মুহাম্মদ বিন কাসিম ৭১৫ সালের ১৮ জুলাই ইরাকের মসুলে মারা যান। কিছু সূত্র বলেছে যে, বিন কাসিমের মৃতদেহ বেলুচিস্তানের মাক্রানে হিঙ্গল জাতীয় উদ্যানে স্থানান্তর করা হয়েছিল, যা এখন পাকিস্তানের অংশ।
মুহাম্মদ বিন কাসিমের ভাগ্যের বিবরণ সম্পর্কে দুটি ভিন্ন বর্ণনা রয়েছে:
- বালাজুরীর বর্ণনা মতে, ইরাকের নতুন গভর্নরের সাথে পারিবারিক কলহের কারণে মুহাম্মদকে হত্যা করা হয়েছিল। সুলায়মান মুহাম্মাদের প্রতি বিদ্বেষী ছিলেন। কারণ স্পষ্ট যে, তিনি হাজ্জাজের আদেশ অনুসরণ করেছিলেন, যাতে তিনি তার দ্বারা বিজিত অঞ্চলে সুলায়মানের উত্তরাধিকার অধিকার বাতিল ঘোষণা করেছিলেন। ৭১৪ সালে মুহম্মদ হাজ্জাজের মৃত্যুর খবর পেয়ে আরোরে ফিরে আসেন। এর কিছু দিন পর মুহাম্মাদকে নতুন খলিফার আদেশে সিন্ধুর বদলি গভর্নর ইয়াজিদ ইবনে আবি কাবশা কর্তৃক গ্রেফতার করা হয়, যিনি ইরাকের নতুন সামরিক গভর্নর ইয়াজিদ বিন মুহাল্লাবের অধীনস্থ ছিলেন এবং নতুন আর্থিক গভর্নর মাওলা সালিহের অধীনে কাজ করতেন। পূর্বে সালিহের ভাইকে হাজ্জাজের প্রশাসন মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল। তাই তিনি মুহাম্মদ এবং তার আত্মীয়দেরকে প্রতিশোধস্বরূপ নির্যাতন করে হত্যা করেছিলেন। বালাজুরি দ্বারা মুহাম্মাদের মৃত্যুর বিবরণ চাচ নামার তুলনায় সংক্ষিপ্ত।[৩১][২৯]
- চাচ নামা একটি গল্প বর্ণনা করে, যেখানে মুহাম্মদের মৃত্যুর জন্য দাহির, সূর্য দেবী এবং পরিমল দেবীর কন্যাদের দায়ী করা হয়, যারা সিন্ধু বিজয়ের সময় বন্দী হয়েছিলেন এবং বন্দী করার পর মাসহ তাদের ক্রীতদাসী করা হয়েছিল।[৫৮] বিবরণটি উল্লেখ করে যে, তারা তখন খলিফার কাছে প্রতারণা করে তাকে বিশ্বাস করায় যে, মুহাম্মদ তাদের এখানে পাঠানোর আগে তাদের ইজ্জত লঙ্ঘন করেছিলেন এবং এই অভিযোগের ভিত্তিতে মুহাম্মদকে একটি মরা গরুর চামড়ায় মুড়িয়ে সেলাই করা হয়েছিল[৫৯] এবং সেই অবস্থায় তাকে সিরিয়ায় পাঠানো হয়েছিল। ফলে শ্বাসরোধ হয়ে পথেই তাঁর মৃত্যু হয়েছিল।[৬০] এই আখ্যানটি তাদের পিতার মৃত্যুর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য তাদের এই কাজকে দায়ী করে। পরবর্তীতে তাদের ধোঁকাবাজি আবিষ্কার করার পর খলিফা অনুশোচনায় ভুগেছিলেন এবং তাদেরকে একটি প্রাচীরের মধ্যে জীবন্ত কবর দেওয়ার নির্দেশ দেন।[৩৯][৬১][৬২] তবে এই বিবরণের সত্যতা নিয়ে অনেক অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে।
মুহাম্মাদ পরবর্তী সিন্ধু
মুহাম্মদ বিন কাসিমের প্রস্থানের পরে পরবর্তী নিযুক্ত আরব গভর্নর আগমনের কিছু দিন পরই মারা যান। এর ফলে দাহিরের পলায়নকারী পুত্র সিন্ধুতে আসেন এবং ব্রাহ্মনাবাদ পুনরুদ্ধার করেন। ৭২০ সালে দ্বিতীয় অভিযানে ব্রাহ্মনাবাদ পুনরুদ্ধার হয় এবং ইসলাম ধর্ম গ্রহণের বিনিময়ে তাকে ক্ষমা ও প্রশাসনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তবে শীঘ্রই তিনি প্রত্যাবর্তন করেন এবং উমাইয়ারা উত্তরাধিকার সংকটে জড়িয়ে পড়লে সিন্ধুতে তাদের বিচ্ছেদ ঘটে।
পরবর্তীতে জুনায়েদ বিন আব্দুর রহমান আল–মুরি জয়সিয়াকে হত্যা করে এবং তার উত্তরসূরিরা এটিকে ধরে রাখতে লড়াই করার আগে অঞ্চলটি পুনরুদ্ধার করে। ৮৭০ সালে আব্বাসীয় আমলে স্থানীয় আমিররা খলিফার প্রতি সমস্ত আনুগত্য বন্ধ করে দেয় এবং ১০ শতকের মধ্যে এই অঞ্চলটি দুইটি দুর্বল রাজ্যে বিভক্ত হয়ে যায়; নিম্ন সিন্ধুতে মনসুরা ও উচ্চসিন্ধুতে মুলতান। রাজ্য দুইটি শীঘ্রই ইসমাইলীদের হাতে পরাস্ত হয়ে যায়, যারা এই অঞ্চলে একটি স্বাধীন ফাতেমি রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিল।[৩১][৬৩] এর উত্তরসূরি রাষ্ট্রগুলি খুব বেশি অর্জন করতে পারেনি এবং তা আকারে সঙ্কুচিত হতে থাকে। মাহমুদ গজনভির আগমনের আগ পর্যন্ত উত্তর ও পূর্বের ( বর্তমান পাকিস্তানের দক্ষিণ অংশ ) হিন্দু রাজারা প্রায় তিন শতাব্দী ধরে আরব বিজয় ঠেকিয়ে রেখেছিল।[৬৪]
গুণাবলী ও বিচার
মুহাম্মদ বিন কাসিম ছোটবেলা থেকেই সাহসিকতা ও নম্রতার সংমিশ্রণ দেখিয়েছিলেন। যে কারণে হাজ্জাজ বিন ইউসুফ তাকে সিন্ধু সীমান্তবর্তী অঞ্চলের দায়িত্বে নিযুক্ত করেছিল, যখন তার বয়স ছিল মাত্র ১৭ বছর ছিল। মুহাম্মাদ উত্তম চিন্তাভাবনা ও দক্ষ পরিচালনায় অভ্যস্ত ছিলেন। তিনি ন্যায়বিচার ও সহনশীলতায় শত্রু বন্ধু সকলের সাক্ষ্য হয়েছিলেন।[৮]
মুহাম্মাদ বিন কাসিম জীবনে হাজ্জাজ বিন ইউসুফের সেই উক্তিগুলির স্বার্থক প্রয়োগ ঘটান, যা তিনি তাকে দায়িত্বের প্রাক্কালে বলেছিলেন: “যদি তুমি কোনো দেশ নিয়ন্ত্রণে রাখতে চাও, তবে তার প্রতি দয়ালু হও। যারা তোমার সাথে ভালো ব্যবহার করেছে, তাদের সাথে আচরণ করার ক্ষেত্রে উদার হও এবং নিজের শত্রুকে বোঝার চেষ্টা করো। যে তোমার বিরোধিতা করে তার সাথেও সম্ভব হলে করুণাময় হও এবং আমি তোমাকে সবচেয়ে ভালো জিনিসে সুপারিশ করি যে, জনগণ তোমার সাহস জানে এবং তুমি যুদ্ধের ময়দানে তা প্রমাণ করো।[৫]
মুহাম্মদ অত্যন্ত নম্রতার বৈশিষ্ট্যযুক্ত ছিলেন। তাই তার সেনাবাহিনীতে যারা বয়স্ক বা তার পিতার চেয়ে বয়সে বড় ছিলেন, তিনি তাদের ব্যাপারে নিজেকে অহংকার ও দাম্ভিকতার দিকে ঝুঁকাতেন না। তিনি তাদের থেকে বিচ্ছিন্নও ছিলেন না। তাদের পরামর্শ ব্যতীত আদেশ করতেন না। তিনি যেখানেই গিয়েছেন প্রতিটি স্থানেই তিনি মসজিদ নির্মাণ এবং জনকল্যাণমূলক কাজ করেছেন এবং ইসলামি সংস্কৃতির প্রচার ও প্রসারের জন্য কাজ করেছেন।[৬][৫]
ঐতিহাসিক লেনপুল বলেন, মোহাম্মাদ বিন কাসিম ছিলেন উদার এবং সহনশীল বিজেতা শাসক। তার রাজ্যের অমুসলিমদের প্রতি তিনি অতিশয় সদয় আচরণ করতেন। তার উদারতার জন্যই পরবর্তীতে হিন্দু সম্প্রদায় তার মূর্তি বানিয়ে পূজা করেছিল।[৬৫][৬৬][৬৭]
বিতর্ক
সিন্ধু জয় এবং পরবর্তীতে স্থানীয়দের ধর্মান্তরিত হওয়া নিয়ে বিতর্ক রয়েছে এবং এটি সাধারণত মুহাম্মদ বিন কাসিমের সামরিক কর্মকাণ্ডের আলোকে দুটি বিরোধী দৃষ্টিকোণে উচ্চারিত হয়:[৩৫]
স্ট্যানলি লেন-পুলের বর্ণনা ( হাস্কেল হাউস পাবলিশার্স লিমিটেড কর্তৃক ১৯৭০ সালে প্রকাশিত হয় ) অনুসারে তাঁর বিজয় ছিল "উদারপন্থী" এবং তিনি প্রথাগত কর আরোপ করেছিলেন; ভাল আচরণের জন্য অমুসলিম স্থানীয়দের জিম্মি করেছিলেন এবং জনগণের জীবন ও জমি রক্ষা করেছিলেন। এমনকি তিনি হিন্দু ও বৌদ্ধ উপাসনালয়গুলিকেও অপবিত্র রেখেছিলেন ( পূর্বের অবস্থায় রেখেছিলেন) এবং তিনি ঘোষণা করেছিলেন যে, খ্রিস্টানদের গীর্জা, ইহুদিদের উপাসনালয় এবং অগ্নিপূজকদের জবাইখানাও অপবিত্র অর্থাৎ পূর্বের অবস্থায়ই থাকবে।[৬৮] একই বর্ণনায় এটি উল্লেখ করা হয়েছে যে, "তবে মাঝেমধ্যে হিন্দু ভক্তদের অপবিত্রতা ঘটেছে... কিন্তু এই ধরনের বিক্ষোভ সম্ভবত সরকারী বিবেকের কাছে বিরল ছিল...", কারণ মন্দির ধ্বংস ও বেসামরিক গণহত্যা এখনো ঘটে।[৬৯]
- জবরদস্তিমূলক ধর্মান্তরও ঘটেছিল প্রাথমিক ইতিহাসবিদ, যেমন: এলিয়ট, কসেন, মজুমদার ও বৈদ্যরা মনে করেন। তাদের অবস্থান হলো যে, সিন্ধুর ধর্মান্তর প্রয়োজন ছিল। আরো বলা হয় যে, মুহাম্মাদ বিন কাসিমের সংখ্যাগত কমতি আপাত ধর্মীয় সহনশীলতার যেকোনো দৃষ্টান্তের ব্যাখ্যা করতে সক্ষম। তবে মন্দির ধ্বংস করাকে ধর্মীয়ভাবে অনুপ্রাণিত অসহিষ্ণুতার প্রতিফলন হিসাবে দেখা হয়।[৭০] মুসলিম ইতিহাসবিদদের মতে, সিন্ধুতে জোরপূর্বক কোনো ধর্মান্তর ঘটেনি এবং কাউকে জোরপূর্বক অথবা ভীতি প্রদর্শন করে ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করা হয়নি। ইসলামে হয়তো স্বেচ্ছায় ধর্মান্তর হতে হয় অথবা জিজিয়া প্রদান করে জিম্মি হিসেবে থাকতে হয়। অনেকে ইসলামি রাষ্ট্রীয় সুবিধা ভোগ করার জন্য কেবল পার্থিক স্বার্থ বিবেচনায় মুসলমান হতে পারে।[৬][৫]
- স্বেচ্ছায় ধর্মান্তরিত হওয়ার পক্ষে থমাস ডব্লিউ, হাবিব এবং কুরেশির মতো আধুনিক মুসলিম ঐতিহাসিকদরা মতামত দিয়েছেন। তারা বিশ্বাস করেন যে, সিন্ধু বিজয় মূলত শান্তিপূর্ণ ছিল এবং ধর্মান্তরও সম্পূর্ণরূপে তেমন ছিল। আরববাহিনী উদার ও সহনশীল নীতি প্রণয়ন করেছিলেন।[৩৭] এই ঐতিহাসিকগণ " মুসলমানদের প্রশংসনীয় আচরণ" উল্লেখ করেছেন এবং তাদের কর্মকে একটি উচ্চতর সভ্যতার সংমিশ্রণ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।[৩৫]
ইসলাম, হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের বিভিন্ন বিতর্কিত ধারণাও এই বিতর্কে প্রতিফলিত হয়।[৩৭] অনেক ধর্মীয় বির্তকে প্রভাবিত হয়ে মুহাম্মাদ বিন কাসেমের সিন্ধু বিজয়কে বিতর্কিত করার প্রয়াস করেছেন বলে অনেক গবেষক অভিযোগ করেন। ইউটি ঠাকুর মুহাম্মদ বিন কাসিমের শাসনের সময়কে সিন্ধুর ইতিহাসের সবচেয়ে অন্ধকার সময বলে অভিহিত করেছেন। যে ইতিহাসের রেকর্ডে জোরপূর্বক ব্যাপক ধর্মান্তরকরণ, মন্দির ধ্বংস, হত্যা ও গণহত্যার কথা বলা হয়েছে; সিন্ধুর জনগণ তাদের হিন্দু/বৌদ্ধ ধর্মীয় প্রবণতার কারণে সহজাত শান্তিবাদী ছিল, তাদের "বর্বর অভ্যন্তরীণ" অবস্থার সাথে মানিয়ে নিতে হয়েছিল।[৭১] তবে ঠাকুর এসব ইতিহাসের কোন ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত দলিল উল্লেখ করেননি।
ম্যাকলিন বলেন, একদিকে আরব মুসলমানদের ধর্মীয় অনুপ্রেরণা তাদের সিন্ধু জয় করতে এবং স্থানীয়দের ধর্মান্তরিত করতে সাহায্য করেছে ; অন্যদিকে তাদের ধর্মান্তরিতকরণের সাথে তাদের ধর্মীয় কর্তব্যের অংশ হিসাবে অমুসলিমদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং সহনশীল হিসাবে দেখা গিয়েছে। যা ইসলামের জীবনীশক্তি সাম্য ও নৈতিকতার কারণে সহজতর হয়েছে।[৩৭] হিংসাত্মক বা রক্তপাতহীনভাবে দখলকৃত শহরগুলির উদাহরণ, যা আরবীয় সিন্ধুর পরবর্তী ইতিহাসের তথ্য ও বিবরণে (যা সন্দেহজনক) পাওয়া যায়। যেমন : দেবলে শহরে ব্রাহ্মণদের জোরপূর্বক খৎনা করা বা মোহাম্মাদ ইবনে কাসিমের গরু জবাই নিষিদ্ধ করার ক্ষেত্রে হিন্দুূদের অনুভূতিকে বিবেচনা করা। গরু জবাই একটি নির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি বা অন্যের জন্য উদাহরণ হিসাবে ব্যবহৃত হয়।[৩৭]
কিছু ইতিহাসবিদ মধ্যমপন্থা অবলম্বন করে বলেছেন যে হিন্দু এবং বৌদ্ধদের সাথে শান্তি স্থাপনের রাজনৈতিক সুবিধার জন্য মোহাম্মাদ মাঝামাঝি অবস্থানে ছিলেন। সদ্য বিজিত ভূমি পরিচালনার জন্য তার আদেশের অংশ হিসাবে অমুসলিমদের তার অধীনে কাজ করার জন্য আহ্বান জানাতে হয়েছে। এটা খুবই যুক্তিযুক্ত যে তিনি একটি মধ্যমপন্থা অবলম্বন করতে পারেন। তিনি স্থানীয়দের (সিন্ধিদের) জিম্মির মর্যাদা প্রদান করেন এবং তাদের তার প্রশাসনে অংশগ্রহণের অনুমতি দিয়েছিলেন, কিন্তু তাদের সাথে "অনাগরিক" হিসাবে আচরণ করেছিলেন (অর্থাৎ তারা খিলাফতের অন্তর্ভুক্ত ছিল না)।[৩৬]
যদিও মুহাম্মদ বিন কাসিমের যুদ্ধ স্পষ্টতই মাঝে মাঝে নৃশংস ছিল ; তবে তিনি হিন্দু ধর্ম সম্পর্কে বলেছিলেন যে, 'মূর্তিভরা মন্দিরগুলি খ্রিস্টানদের গীর্জা, ইহুদিদের সিনাগগ ও জরাথুস্ট্রীয়দের মন্দিরের মতো ( ما البوذية و الهنود إلا كنائس النصاري و اليهود و بيوت نيران المجوس )।[৩৩] তার এই উক্তিকে হিন্দু এবং বৌদ্ধদের জিম্মি শ্রেণীতে অন্তর্ভুক্তির ন্যায্যতা প্রদানকারী প্রাচীনতম বিবৃতি বলে মনে করা হয়, যার ফলে অনেক আধুনিক মুসলমান মুহাম্মাদ বিন কাসিমকে ধর্মীয় সহনশীলতার আদর্শ প্রতীক হিসেবে দেখেন।[৩৩]
সিন্ধু বিজয়ে মুসলিম দৃষ্টিভঙ্গি
মুহাম্মাদ বিন কাসিম কর্তৃক জোরপূর্বক ধর্মান্তীকরণ এবং স্থানীয়দের ওপর অতিরঞ্জন সম্পর্কে যে সকল অভিযোগ বা বর্ণনা পাওয়া যায় সেগুলি মূলত পশ্চিমা গবেষক ও ভারতীয় ঐতিহাসিকদের লেখায় পাওয়া যায়, যারা সকলেই ১৮ শতাব্দী বা এর পরবর্তী যুগের গবেষক এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রমাণবিহীন এসব অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছে।[৭২][৩৫][৩০]
মুহাম্মদ বিন কাসিমের সমকালীন মুসলিম ঐতিহাসিক বা পরবর্তীতে যে সকল মুসলিম ঐতিহাসিক সূত্রসহ মুহাম্মাদ বিন কাসিম এবং সিন্ধু বিজয় সম্পর্কে বর্ণনা করেছেন তাদের কেউই এ সকল অভিযোগ বা বর্ণনার প্রতি ইশারাও করেননি। কিন্তু অধিকাংশই মুহাম্মদ বিন কাসিম কর্তৃক ফার্সের গভর্নর থাকাকালীন বিদ্রোহী কুর্দিদের ওপর সশস্ত্র হামলা করার বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। তাই অনেক গবেষক ধারণা করেন যে, সিন্ধু অভিযানে এমন কিছু ঘটলে ঐতিহাসিকগণ অবশ্যই তা উল্লেখ করতেন।[৭৩][৭৪]
যে সকল ঐতিহাসিক বা লেখক মুহাম্মদ বিন কাসিম এবং সিন্ধু বিজয় সম্পর্কে লিখেছেন:
- ইমাম তাবারি ( تاريخ طبري )।
- ইবনে আসির (الكامل في التاريخ )।
- ইবনে খালদুন ( العبر و ديوان المبتدأ و الخبر )।
- ইবনে খাল্লিকান ( وفيات الأعيان )।
- ইবনে দাহলান ( الفتوحات الاسلامية )।
- ইবনে আসাকির ( التاريخ الكبير )।
- ইবনে কুতায়বা ( المعارف )।
- ইবনে কাসির ( البداية و النهاية في التاريخ )।
- আবুল ফিদা ( المختصر من أخبار البشر )।
- ইমাম বালাজুরি ( فتوح البلدان )।
- আল ইয়াকুবি ( البلدان و تاريخ اليعقوبي )।
স্মারক
মুহাম্মদ বিন কাসিমের উপস্থিতি ও শাসন ছিল খুবই সংক্ষিপ্ত। উমাইয়াদের সাহায্যে তার বিজয় সিন্ধুকে মুসলিম বিশ্বের কক্ষপথে নিয়ে আসে।[৭৫] তিনি সিন্ধু বিজয়ের পর শরিয়া আইনের হানাফি ব্যাখ্যা (যদিও তখন পর্যন্ত হানাফি মাজহাব নামে কোন ধর্মীয় ব্যাখ্যা সৃষ্টি হয়নি। মূলত পরবর্তীতে হানাফি ফকিহগণ এই অভিমত অনুযায়ী ফতোয়া দিয়েছেন ) মতে আইন প্রণয়ন করেন। এই মত হিন্দু, বৌদ্ধ ও জৈনদের জিম্মি ও 'আহলে কিতাবের' সমস্তরে গণ্য করে এবং যতক্ষণ তারা "জিজিয়া" নামে পরিচিত নিরাপত্তা কর প্রদান অব্যাহত রাখে ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের ধর্মীয় স্বাধীনতার অনুমতি দেয়। এই পদ্ধতি পরবর্তী শতাব্দীতে ভারতের মুসলিম শাসকদের শাসনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণিত হয়েছে।[৩১] উপকূলীয় বাণিজ্য ও সিন্ধুতে একটি নতুন মুসলিম কেন্দ্র সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান এবং মুসলিম প্রভাব বিস্তারের জন্য সুফি ধর্মপ্রচারকদের আগমনের জন্য উৎসাহী করে তোলে।[৭৬] দেবল বন্দর থেকে–যা ১২ শতক পর্যন্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ বন্দর ছিল–পারস্য উপসাগর ও মধ্যপ্রাচ্যের সাথে বাণিজ্যিক যোগাযোগ তীব্রতর হয়ে ওঠে; কারণ সিন্ধু তখন ভারত মহাসাগরে বাণিজ্য ও স্থলপথের মূলকেন্দ্র হয়ে ওঠে।[৭৫]
পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ দাবি করেছিলেন যে, পাকিস্তান আন্দোলন তখনই শুরু হয়, যখন প্রথম মুসলিম ভারতে ইসলাম প্রবেশদ্বার সিন্ধুর মাটিতে পা রাখেন।[৭৭] পাকিস্তানি পাঠ্যক্রম অনুসারে মুহাম্মদ বিন কাসিমকে প্রায় প্রথম পাকিস্তানি হিসাবে উল্লেখ করা হয়।[৭৮] তার সম্মানে পাকিস্তানে ইয়াওম-ই বাব উল-ইসলাম দিবস পালন করা হয়।[৭৯][৭৮] পোর্ট কাসিম–যা পাকিস্তানের দ্বিতীয় প্রধান বন্দর–মুহাম্মদ বিন কাসিমের সম্মানে নামকরণ করা হয়েছে।[৮০] বাগ ইবনে কাসিম,যা করাচির (সিন্ধু, পাকিস্তান)[৮১] বৃহত্তম উদ্যান এটিরও মুহাম্মদ বিন কাসিমের সম্মানে তার নামে নামকরণ করা হয়েছে। মুলতানের ইবনে কাসিম বাগ স্টেডিয়াম মুহাম্মদ বিন কাসিমের নামে নামকরণ করা হয়েছে। পাকিস্তানের নেভাল স্টেশন পিএনএস কাসিম বা কাসিম, যা পাকিস্তানের নৌবাহিনীর উভচর স্পেশাল অপারেশন ফোর্সের প্রধান অপারেশন ঘাঁটি এটিও মুহাম্মদ বিন কাসিমের নামে নামকরণ[৮২] করা হয়েছে। করাচির বিন কাসিম টাউনের নামকরণ করা হয়েছে মুহাম্মদ বিন কাসিমের নামে।[৮৩]
মাজার (সমাধি)
মুহাম্মাদ বিন কাসিমের মাজার[৮৪](সমাধি) ইরাকের ওয়াসিত জেলার আননুমানিয়াহ শহরে অবস্থিত।[১৪] ইরাকি ঐতিহাসিক মুস্তফা জাওয়াদ উল্লেখ করেন যে, ড. হুসাইন আলী মাহফুজ এবং ড. আব্দুল আজিজের উপস্থিতিতে উচ্চগবেষকদের আসরে ইরাকি মাজারের বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনার সময় দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে তিনি বলেছিলেন যে, এটা আশ্চর্যজনক যে, আমরা ইরাকিরা আমাদের পতাকাকে অন্যদের কাছে সমর্পণ করেছি। বেশিরভাগ সূত্র নিশ্চিত করে যে, মুহাম্মদ বিন কাসিম আস সাকাফির সমাধি ইরাকের ওয়াসিতের আন-নুমানিয়াহতে অবস্থিত, যা জনসাধারণের মধ্যে মুহাম্মদ বিন কাসিম আল-আলাউয়ের সমাধি হিসাবে পরিচিত। এটি সাফবীয়দের ইরাক বিজয়ের সময় এই মাজারের সম্মান রক্ষার্থে আলাভি (আলীপন্থী) মাজার বলে প্রচার করা হয়। এমনটি না হলে সফবীয় সৈন্যরা এটি গুড়িয়ে দিত এবং তখন থেকে এটি মুহাম্মাদ বিন কাসিম আল আলাভীর মাজার হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।[৮৫]
আরও দেখুন
তথ্যসূত্র
গ্রন্থপঞ্জি
- محمد بن القاسم فاتح السند : عدد من الكتاب؛ الصفحات: 23؛ تاريخ النشر : 7/6/2018, pdf
- بطل السند: عدد من الكتاب ؛ الصفحات: 127؛ تاريخ النشر : 27/11/2006 Pdf
- মুহাম্মাদ বিন কাসিম: মেজর জেনারেল আকবর খান; অনু.: আবু সাঈদ মুহাম্মদ ওমর আলী ; ইসলামিক ফাউন্ডেশন ( ১৯৮৬)
- মুহাম্মাদ বিন কাসিম: জীবন ও সংগ্রাম– মাওলানা মোহাম্মদ ইসহাক ভাট্টি; মাকতাবাতুল হেরা (২০২০)
- Baloch, Nabi Bakhsh (অক্টোবর ১৯৫৩)। "Muhammad ibn al-Qasim: A Study of His Family Background and Personality"। Islamic Culture: 242–271।
- Gabrieli, Francesco (সেপ্টেম্বর–ডিসেম্বর ১৯৬৫)। "Muḥammad ibn Qāsim ath-Thaqafī and the Arab Conquest of Sind"। East and West। 15 (3): 281–295। জেস্টোর 29754928।
- Friedmann, Y. (১৯৯৩)। "Muḥammad b. al-Ḳāsim"। Bosworth, C. E.; van Donzel, E.; Heinrichs, W. P. & Pellat, Ch.। The Encyclopaedia of Islam, New Edition, Volume VII: Mif–Naz। Leiden: E. J. Brill। পৃষ্ঠা 405–406। আইএসবিএন 90-04-09419-9।
- Gier, Nicholas F. (২০১৪), "From Mongols to Mughals : Hindu–Muslim relations in medieval India", The Origins of Religious Violence: An Asian Perspective, Lexington Books, আইএসবিএন 978-0-7391-9223-8
- Nicholas F. Gier, From Mongols to Mughals: Religious violence in India 9th-18th centuries, Presented at the Pacific Northwest Regional Meeting American Academy of Religion, Gonzaga University, May 2006.
- Lane-Poole, Stanley Medieval India under Mohammedan Rule, 712-1764, G.P. Putnam's Sons. New York, 1970
- Lecker, M. (২০০০)। "Thakīf"। Bearman, P. J.; Bianquis, Th.; Bosworth, C. E.; van Donzel, E. & Heinrichs, W. P.। The Encyclopaedia of Islam, New Edition, Volume X: T–U। Leiden: E. J. Brill। পৃষ্ঠা 432। আইএসবিএন 90-04-11211-1।
- Schimmel, Annemarie, Islam in the Indian Subcontinent, Brill Academic Publishers, Jan 1, 1980, আইএসবিএন ৯০-০৪-০৬১১৭-৭
- Appleby, R Scott & Martin E Marty, Fundamentalisms Comprehended, University of Chicago Press, May 1, 2004, আইএসবিএন ০-২২৬-৫০৮৮৮-৯
- Wink, André (১৯৯৬) [first published 1990], Al-Hind: The Making of the Indo-Islamic World, Vol 1: Early Medieval India and the Expansion of Islam (Third সংস্করণ), Brill, আইএসবিএন 0391041738
- Wink, André (২০০২) [first published 1990], Al-Hind: The Making of the Indo-Islamic World, Vol 1: Early Medieval India and the Expansion of Islam, Brill, আইএসবিএন 9780391041738
- Keay, John, India: A History, Grove Press, May 1, 2001, আইএসবিএন ০-৮০২১-৩৭৯৭-০
- MacLean, Derryl N. (১৯৮৯), Religion and Society in Arab Sind, BRILL, আইএসবিএন 90-04-08551-3
বহিঃসংযোগ
- Alexander Berzin, "Part I: The Umayyad Caliphate (661 - 750 CE), The First Muslim Incursion into the Indian Subcontinent", The Historical Interaction between the Buddhist and Islamic Cultures before the Mongol Empire
- The Chach-Nama. English translation by Mirza Kalichbeg Fredunbeg. Delhi Reprint, 1979.