রোমান সংখ্যা
রোমান সংখ্যা হচ্ছে প্রাচীন রোম হতে উদ্ভূত একধরনের সংখ্যা পদ্ধতি এবং মধ্যযুগ পর্যন্ত সারা ইউরোপ জুড়ে সংখ্যা লেখার জন্য সাধারণত এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হতো। এখানে সংখ্যাগুলিকে লাতিন বর্ণমালার বিভিন্ন বর্ণের সমন্বয়ে উপস্থাপন করা হয় এবং প্রতি সমন্বয়ের একটি নির্দিষ্ট পূর্ণমান রয়েছে। আধুনিক রোমান সংখ্যা পদ্ধতি নিম্নলিখিত সাতটি চিহ্ন ব্যবহার করে:
I | V | X | L | C | D | M |
১ | ৫ | ১০ | ৫০ | ১০০ | ৫০০ | ১০০০ |
রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পরেও রোমান সংখ্যার ব্যবহার অব্যাহত থেকে। চতুর্দশ শতাব্দী থেকে শুরু করে ইউরোপ রোমান সংখ্যার জায়গায় আরবি সংখ্যা প্রচলিত হতে লেগেছিল। অবশ্য ইউরোপে আরবি সংখ্যার প্রচলন ধীরগতিতে হয়েছিল এবং এখনও কিছু জায়গায় রোমান সংখ্যা ব্যবহার করা হয়।
ঘড়ির মুখ বা ডায়ালে অনেকসময় রোমান সংখ্যা দেখতে পাওয়া যায়। উদাহরণস্বরপ, লন্ডনের বিগ বেনের মুখে ১ থেকে ১২ পর্যন্ত ঘণ্টাগুলোকে নিম্নলিখিত ভাবে লেখা থাকে:
এখানে IV ও IX সংখ্যাকে যথাক্রমে "পাঁচ হতে এক কম" (৪) ও "দশ হতে এক কম" (৯) আকারে পড়া যায়। অবশ্য রোমান সংখ্যা ব্যবহৃত অনেক ঘড়িতে ৪ বোঝানোর জন্য IV-এর জায়গায় IIII ব্যবহার করা হয়।[১]
এছাড়া ভবন ও স্থাপনায় সাল বোঝানোর জন্য এবং চলচ্চিত্র ও টিভি প্রোগ্রামের শিরোনামে কপিরাইট তারিখ বোঝানোর জন্য রোমান সংখ্যা ব্যবহার করা হয়। MCM সংখ্যার অর্থ "এক হাজার, এবং অপর হাজার হতে একশো কম" এবং এটি ১৯০০ সংখ্যাকে বোঝাচ্ছে। সুতরাং, MCMXII বলতে ১৯১২ বোঝাচ্ছে। বর্তমান একবিংশ শতাব্দীর বছরের জন্য ব্যবহৃত MM বলতে ২০০০ বোঝাচ্ছে এবং আজকের বছর MMXXIV (২০২৪)।
বিবরণ
রোমান সংখ্যা পদ্ধতিতে দশের প্রত্যেক ঘাতের জন্য পৃথক প্রতীক ব্যবহার করা হয় এবং এখানে শূন্যের জন্য কোনো পৃথক প্রতীক নেই। অন্যদিকে আরবি ও বাংলা সংখ্যা পদ্ধতিতে ডানদিকে শূন্য যোগ করে দশের বিভিন্ন ঘাতকে প্রকাশ করা হয়।
সাধারণ রূপ
নিম্নলিখিত সারণিতে রোমান সংখ্যার সাধারণ রূপ দেখানো হয়েছে:[২]
সহস্র | শতক | দশক | একক | |
---|---|---|---|---|
১ | M | C | X | I |
২ | MM | CC | XX | II |
৩ | MMM | CCC | XXX | III |
৪ | CD | XL | IV | |
৫ | D | L | V | |
৬ | DC | LX | VI | |
৭ | DCC | LXX | VII | |
৮ | DCCC | LXXX | VIII | |
৯ | CM | XC | IX |
রোমান পদ্ধতিতে ৪ (IV) ও ৯ (IX) সংখ্যাকে বিয়োগ আকারে লেখা হয়,[৩] যেখানে ছোট সংখ্যার (I) মাধ্যমে বড় সংখ্যাকে (V বা X) বিয়োগ করা হয়। এর মাধ্যমে IIII ও VIIII-এর মতো আরও কদাকার উপস্থাপনা এড়িয়ে যাওয়া যায়। ৪ ও ৯ ছাড়া ৪০ (XL), ৯০ (XC), ৪০০ (CD) ও ৯০০ (CM) সংখাকেও রোমান পদ্ধতিতে বিয়োগ আকারে লেখা হয়।[৪]
দুই বা ততোধিক দশমিক অঙ্কবিশিষ্ট সংখ্যার ক্ষেত্রে প্রত্যেক অঙ্কের জন্য অনুরূপ রোমান সংখ্যা ব্যবহার করা হয়, যেমন:
- ৩৯ = XXX + IX = XXXIX
- ২৪৬ = CC + XL + VI = CCXLVI
- ৭৮৯ = DCC + LXXX + IX = DCCLXXXIX
- ২,৪২১ = MM + CD + XX + I = MMCDXXI
শূন্য দিয়ে উপস্থাপিত স্থান উহ্য করা হয়, যা লাতিন (ও বাংলা) সংখ্যার নামের অনুরূপ:
এভাবে উপস্থাপিত সবচেয়ে বড় সংখ্যা হচ্ছে ৩,৯৯৯ (MMMCMXCIX) এবং রোমান সংখ্যার বর্তমান প্রচলিত ব্যবহারের পক্ষে এটি যথেষ্ট, যেমন:
- ১৭৭৬ = M + DCC + LXX + VI = MDCCLXXVI (স্ট্যাচু অব লিবার্টির বইয়ে লেখা সাল)
- ১৯১৮ = M + CM + X + VIII = MCMXVIII (প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অন্তিম বছর)
- ১৯৪৭ = M + CM + XL + VII = MCMXLVII (ভারতের স্বাধীনতার বছর)
- ১৯৭১ = M + CM + LXX + I = MCMXLXXI (বাংলাদেশের স্বাধীনতার বছর)
- ২০২৪ = MMXXIV (আজকের বছর)
পাশ্চাত্যে আরবি সংখ্যা প্রচলিত হওয়ার আগে রোমান সংখ্যার প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় ব্যবহারকারীরা আরও বড় সংখ্যা লেখার জন্য বিভিন্ন উপায় অবলম্বন করেছেন, যার মধ্যে অ্যাপোস্ট্রোফাস (apostrophus) ও ভিনকিউলাম (vinculum) পদ্ধতি উল্লেখযোগ্য।
অন্যান্য রূপ
উপরে বর্ণিত সাধারণ রূপ ছাড়াও অন্যান্য রূপে রোমান সংখ্যা লেখা হয়েছে।
অন্যান্য যোগ আকার
যদিও রোমান আমল থেকে রোমান পদ্ধতিতে ৪ , ৪০ ও ৪০০ সংখ্যাকে বিয়োগ আকারে লেখা (IV, XL ও CD) প্রচলিত হয়ে এসেছে, এদের অনেকসময় যোগ আকারেও লেখা (IIII, XXXX ও CCCC) হয়,[৭] যার মধ্যে ২৪ (XXIIII),[৮] ৭৪ (LXXIIII),[৯] ও ৪৯০ (CCCCLXXXX)-এর মতো যৌগিক সংখ্যা উল্লেখযোগ্য।[১০] রোমান পদ্ধতিতে ৯, ৯০ ও ৯০০ (VIIII,[৭] LXXXX,[১১] ও DCCCC[১২]) সংখ্যাকেও কদাচিৎ যোগ আকারে লেখা হয়।
একই নথি বা খোদাইয়ে যোগ ও বিয়োগ উভয় আকারে রোমান সংখ্যা লেখা হয়। যেমন: রোমের কলোসিয়ামের সংখ্যা দ্বারা চিহ্নিত দরজায় IV-এর জায়গায় সবসময় IIII ব্যবহার করা হয়, কিন্তু ৪০ সংখ্যাকে বিয়োগ আকারে (XL) লেখা হয়; সুতরাং ৪৪ নং দরজাকে XLIIII দ্বারা চিহ্নিত করা হয়।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]
রোমান সংখ্যা ব্যবহৃত আধুনিক ঘড়িতে এখনও চারটা বোঝানোর জন্য অনেকসময় IIII ব্যবহার করা হয়, কিন্তু নয়টা বোঝানোর জন্য IX ব্যবহার করা হয়। এই প্রথা বহুকাল আগের ঘড়ি থেকে প্রচলিত হয়ে এসেছে, যেমন চতুর্দশ শতাব্দীর শেষের ওয়েলস ক্যাথিড্রালের ঘড়ি।[১৩][১৪][১৫] তবে এই প্রথা সর্বজনীন নয়; যেমন লন্ডনের বিগ বেন ঘড়িতে চারটা বোঝানোর জন্য বিয়োগ আকারে IV লেখা হয়।[১৪][ক]
বিংশ শতাব্দীর শুরুতে তৈরি হওয়া অনেক স্থাপত্যের খোদাইয়ে রোমান পদ্ধতিতে ১৯০০ সংখ্যাকে বিভিন্ন আকারে লেখা হয়, যদিও সাধারণভাবে একে MCM আকারে লেখা হয়। যেমন লন্ডনের অ্যাডমিরালটি আর্চে ১৯১০ সংখ্যাকে MDCCCCX আকারে লেখা হয়, আবার যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট লুই আর্ট মিউজিয়ামের উত্তর ফটকে ১৯০৩ সংখ্যাকে MDCDIII আকারে লেখা হয়।[১৭]
বিশেষ করে সমাধিপ্রস্তর ও সমাধি-সম্পর্কিত অন্যান্য খোদাইয়ে ৫ ও ৫০ সংখ্যাকে অনেকসময় যথাক্রমে V ও L না লিখে IIIII ও XXXXX লেখা হয় এবং বেশ কিছু জায়গায় VI বা LX লেখার পরিবর্তে IIIIII বা XXXXXX লেখা হয়েছে।[১৮][১৯]
শূন্য
স্থানিক সংখ্যা পদ্ধতি না হওয়ার জন্য রোমান সংখ্যায় ফাঁকা দশমিক ঘর বোঝানোর জন্য কোনো শূন্য ব্যবহার করা হয় না। এছাড়া রোমান আমলে ব্যবহৃত রোমান সংখ্যা পদ্ধতিতে ০ বোঝানোর জন্য জন্য কোনো প্রতীক নেই। শূন্য বোঝানোর জন্য লাতিন nulla শব্দটি ব্যবহার করা হতো, যা এক নঞর্থক শব্দ, অবশ্য মধ্যযুগে এর প্রাচীনতম ব্যবহার পাওয়া যায়। যেমন ডাইওনিসিয়াস এগজিগিউয়াস ৫২৫ খ্রিস্টাব্দের এক পাণ্ডুলিপিতে রোমান সংখ্যার পাশাপাশি nulla শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন।[২০][২১] ৭২৫ সালে বেদে বা তাঁর এক অনুগামী শূন্য বোঝানোর জন্য N ব্যবহার করেছিলেন, যা লাতিন nulla বা nihil শব্দের আদ্যক্ষর।[২২]
বড় সংখ্যা
রোমান পদ্ধতিতে বড় সংখ্যা লেখার দুইরকম উপায় আছে, অ্যাপোস্ট্রোফাস (apostrophus) ও ভিনকিউলাম (vinculum)।
ভিনকিউলাম
ভিনকিউলাম (vinculum) পদ্ধতিতে প্রচলিত রোমান চিহ্নের উপর সরলরেখা যোগ করার মাধ্যমে তাকে ১,০০০ দিয়ে গুণ করা হয়। সুতরাং:[২৩]
- IV = ৪,০০০
- XXV = ২৫,০০০
রোমান প্রজাতন্ত্রের শেষের পর্ব থেকে ভিনকিউলাম পদ্ধতি প্রচলিত হয়েছিল[২৪] এবং এটি রোমান বিশ্ব জুড়ে অ্যাপোস্ট্রোফিক ↀ চিহ্নের এক অন্যতম বিকল্প ছিল (মধ্যযুগের আগে ১,০০০ বোঝানোর জন্য M ব্যবহার করা হতো না)।[২৫][২৬] মধ্যযুগেও বড় সংখ্যা বোঝানোর জন্য ভিনকিউলাম ব্যবহার করা হতো, যদিও এটি তখন "টিটিউলাস" (titulus) নামে বেশি পরিচিত।[২৭] এছাড়া ধ্রুপদী ও মধ্যযুগীয় লাতিন রচনার আধুনিক সংস্করণে ভিনকিউলাম ব্যবহার করা হয়।[২৮][২৯]
উৎপত্তি
মধ্যযুগ ও রেনেসাঁ
আধুনিক ব্যবহার
একাদশ শতাব্দীতে আরব বণিক ও গণিত গ্রন্থের মাধ্যমে আন্দালুস হয়ে ইউরোপে আরবি সংখ্যা পদ্ধতি চালু হয়েছিল। তবে চতুর্দশ ও পঞ্চদশ শতাব্দীতেও পাশ্চাত্যে রোমান সংখ্যা প্রচলিত ছিল। রোমান সংখ্যা থেকে আরবি সংখ্যায় স্থানান্তর ধীরে ধীরে সম্পন্ন হয়েছিল এবং এখনও কিছু জায়গায় রোমান সংখ্যা ব্যবহার করা হয়।
রাজশাসকের নাম
ইউরোপীয় ভাষায় রাজশাসক ও পোপের নামে ব্যবহৃত সংখ্যায় রোমান সংখ্যা ব্যবহার করা হয়, যেমন যুক্তরাজ্যের তৃতীয় চার্লস (ইংরেজি: Charles III), পোপ ষোড়শ বেনেডিক্ট (লাতিন: Benedictus XVI) ইত্যাদি। এই সংখ্যাগুলোকে সাধারণত ক্রমিক সংখ্যা হিসাবেই পাঠ করা হয়, যেমন ইংরেজি ভাষায় Charles III নামকে "চার্লস দ্য থার্ড" আকারে পাঠ করা হয়। ইউরোপীয় মধ্যযুগে এই প্রথা বিচ্ছিন্নভাবে শুরু হলেও এর আগে কোনো রাজশাসক কোনো সংখ্যার জায়গায় বিশেষণ দ্বারাই পরিচিত ছিল, যেমন উইলিয়াম দ্য কনকারার (আক্ষ. 'বিজেতা উইলিয়াম')। তবে কিছু রাজশাসক (স্পেনের চতুর্থ চার্লস, ফ্রান্সের চতুর্দশ লুই) তাঁদের মুদ্রায় IV-এর জায়গায় IIII ব্যবহার করতে পছন্দ করেছেন বলে মনে করা হয়।
গণিত
বিশেষ করে ত্রিকোণমিতি, রাশিবিজ্ঞান ও ক্যালকুলাসে কোনো লেখচিত্রে ঋণাত্মক সংখ্যা থাকলে তার প্রত্যেক পাদকে I, II, III ও IV দিয়ে চিহ্নিত করা হয়। পাদের এই নামগুলো যথাক্রমে উভয় অক্ষে ধনাত্মক সংখ্যা, X অক্ষে ঋণাত্মক সংখ্যা, উভয় অক্ষে ঋণাত্মক সংখ্যা এবং Y অক্ষে ঋণাত্মক সংখ্যাকে চিহ্নিত করছে। রোমান সংখ্যার মাধ্যমে পাদকে চিহ্নিত করার ফলে বিভ্রান্তি এড়ানো সম্ভব, কারণ লেখচিত্রে আসল তথ্য উপস্থাপন করার জন্য আরবি সংখ্যা ব্যবহার করা হয়।
জ্যোতির্বিজ্ঞান
কোনো গ্রহের ইংরেজি নামের পাশে বড় হাতের রোমান সংখ্যা যোগ করে সংশ্লিষ্ট গ্রহের উপগ্রহকে চিহ্নিত করা হয়। যেমন রোমান সংখ্যায় টাইটান উপগ্রহকে Saturn VI হিসাবে চিহ্নিত করা হয়, যেখানে Saturn হচ্ছে শনি গ্রহের ইংরেজি নাম।[৩০]
রসায়ন
পর্যায় সারণীর শ্রেণীদের চিহ্নিত করার জন্য অনেকসময় রোমান সংখ্যা ব্যবহার করা হয়, কিন্তু দাপ্তরিকভাবে এর পরিবর্তে আরবি সংখ্যা ব্যবহার করা হয়।[৩১] এছাড়া ইউপ্যাক পদ্ধতিতে অজৈব রসায়নের নামকরণে ক্যাটায়নের জারণ সংখ্যা চিহ্নিত করার জন্য রোমান সংখ্যা ব্যবহার করা হয়।
বিবিধ
- ঘড়িতে ঘণ্টা চিহ্নিত করার জন্য রোমান সংখ্যা ব্যবহার করা হয়। এক্ষেত্রে ৪ সংখ্যাকে অনেকসময় IIII লেখা হয়।
- ভবনের ফাসাদ ও ভিত্তিপ্রস্তরে খোদাই করা নির্মাণ সালে রোমান সংখ্যা ব্যবহার করা হয়।
- ভূমিকা ও সূচনায় পৃষ্ঠা সংখ্যা চিহ্নিত করার জন্য রোমান সংখ্যা ব্যবহার করা হয়। এছাড়া পরিশিষ্টেও অনেকসময় পৃষ্ঠা সংখ্যা চিহ্নিত করার জন্য রোমান সংখ্যা ব্যবহার করা হয়।
- শিক্ষাপদ্ধতিতে বিদ্যালয়ের শ্রেণিকে অনেকসময় রোমান সংখ্যা দিয়ে চিহ্নিত করা হয়। যেমন: নবম শ্রেণি বোঝানোর জন্য অনেকসময় "শ্রেণি IX" লেখা হয়।