মালালা ইউসুফজাই

শান্তিতে নোবেল পুরষ্কার বিজয়ী

মালালা ইউসুফজাই (উর্দু: ملالہ یوسفزئی‎, প্রতিবর্ণী. মলালহ্ য়ূসফ্জ়য়‎); (পশতু: ملاله یوسفزۍ, প্রতিবর্ণী. মলাল যুসফ্জ়য / [məˈlaːlə jusəf ˈzəj];[১] জন্ম: ১২ জুলাই, ১৯৯৭)[২][৩] একজন পাকিস্তানি শিক্ষা আন্দোলনকর্মী, যিনি সবচেয়ে কম বয়সে নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভ করেন।[৪] তিনি উত্তর-পশ্চিম পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশের সোয়াত উপত্যকা অঞ্চলে শিক্ষা এবং নারী অধিকারের ওপর আন্দোলনের জন্য পরিচিত।

মালালা ইউসুফজাই
ملاله یوسفزۍ
২০১৫ খ্রিস্টাব্দে মালালা
জন্ম (1997-07-12) ১২ জুলাই ১৯৯৭ (বয়স ২৬)
জাতীয়তাপাকিস্তানি
পেশাছাত্রী, মানবতাবাদী
পরিচিতির কারণনারী শিক্ষাশিক্ষার অধিকার অন্দোলন
দাম্পত্য সঙ্গীআসার মালিক(বি. ২০২১)
পিতা-মাতা
পুরস্কার
ওয়েবসাইটwww.malala.org

২০০৯ খ্রিষ্টাব্দে মালালা বিবিসির জন্য ছদ্মনামে একটি ব্লগ লেখেন, যেখানে তিনি তালিবান শাসনের অধীনে তার জীবন ও সোয়াত উপত্যকায় মেয়েদের শিক্ষার ব্যাপারে তার মতামত ব্যক্ত করেন। পরের বছর গ্রীষ্মকালে সাংবাদিক অ্যাডান এলিক তার জীবন নিয়ে নিউ ইয়র্ক টাইমসের জন্য একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেন।[৩] এরপর মালালা সংবাদমাধ্যম ও টেলিভিশনে সাক্ষাৎকার দিতে থাকেন ও দক্ষিণ আফ্রিকার আন্দোলনকর্মী ডেসমন্ড টুটু দ্বারা আন্তর্জাতিক শিশু শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনীত হন।

২০১২ খ্রিষ্টাব্দের ৯ অক্টোবর, স্কুলের বাসে একজন বন্দুকধারী তাকে চিহ্নিত করে তিনটি গুলি করে, যার মধ্যে একটি তার কপালের বাঁ দিক দিয়ে ঢুকে চামড়ার তলা দিয়ে তার মুখমণ্ডলের মধ্যে দিয়ে কাঁধে প্রবেশ করে।[৫] পরবর্তী বেশ কয়েকদিন তিনি অচৈতন্য ছিলেন ও তার অবস্থা আশঙ্কাজনক ছিল, কিন্তু ধীরে ধীরে তার অবস্থার উন্নতি হলে পরবর্তী চিকিৎসার জন্য বার্মিংহ্যাম শহরের কুইন এলিজাবেথ হাসপাতালে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়, যেখানে তিনি ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠেন।

ডয়েশ্‌ ওয়েল ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি মাসে তাকে বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত কিশোরী বলে মনে করে।[৬] জাতিসংঘের বৈশ্বিক শিক্ষাকার্যক্রমের বিশেষ দূত গর্ডন ব্রাউন ইউসুফজাইয়ের নামে জাতিসংঘের একটি আবেদনে ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দের শেষে বিশ্বের সকল শিশুকে বিদ্যালয়মুখী করার দাবি করেন; যা পাকিস্তানের প্রথম শিক্ষার অধিকার বিলের আনুষ্ঠানিক সমর্থনের পক্ষে সহায়ক হয়।[৭] ২০১৩, ২০১৪, ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দে টাইম পত্রিকা ইউসুফজাইকে বিশ্বের ১০০জন সর্বাধিক প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বের একজন বলে গণ্য করেন। তিনি ২০১১ খ্রিষ্টাব্দে পাকিস্তানের প্রথম জাতীয় যুব শান্তি পুরস্কার এবং ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দে শাখারভ পুরস্কার লাভ করেন। ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই মাসে জাতিসংঘের সদর দপ্তরে বিশ্বব্যাপী শিক্ষার পক্ষে সওয়াল করেন ও অক্টোবর মাসে কানাডা সরকার তাকে সাম্মানিক কানাডীয় নাগরিকত্ব প্রদান করার কথা ঘোষণা করে।[৮] ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে তাকে সুইডেনের বিশ্ব শিশু পুরস্কারের জন্য মনোনীত করা হয়।[৯] ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসে হ্যালিফ্যাক্সে ইউনিভার্সিটি অব কিং'স কলেজ তাকে সাম্মানিক ডক্টরেট প্রদান করে।[১০] এই বছরের শেষের দিকে নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য কৈলাশ সত্যার্থীর সঙ্গে যুগ্মভাবে মালালার নাম ঘোষণা করা হয়। মাত্র সতেরো বছর বয়সে তিনি ছিলেন বিশ্বের সর্বকনিষ্ঠ নোবেলজয়ী ব্যক্তিত্ব।[১১][১২][১৩] ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দের একাডেমি পুরস্কারের জন্য বাছাইকৃত তথ্যচিত্র হি নেমড মি মালালা তার জীবন নিয়ে তৈরি হয়।[১৪]

প্রথম জীবন

শৈশব

মালালা ইউসুফজাই ১৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দের ১২ই জুলাই উত্তর-পশ্চিম পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশের সোয়াত জেলায় পাশতুন জনজাতির অন্তর্ভুক্ত[৩] এক সুন্নি মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।[১৫] দক্ষিণ আফগানিস্তানের বিখ্যাত মহিলা পাশতু কবি ও যোদ্ধা মালালাই-এ-ম্যায়ওয়ান্দের নামানুসারে[১৬] তার নামকরণ করা হয় মালালা, যার আক্ষরিক অর্থ "দুঃখে অভিভূত"।[১৭] ইউসুফজাই পাকিস্তানের সোয়াত উপত্যকার অধিবাসী পাশতুন জাতিগোষ্ঠী বিশেষ। মিঙ্গোরা নামক স্থানে মালালা তার পিতা জিয়াউদ্দিন, মাতা তোর পেকাই ও দুই কনিষ্ঠ ভ্রাতার সঙ্গে বসবাস করতেন।[৩]

জিয়াউদ্দিন একজন শিক্ষা-আন্দোলনকর্মী ও কবি যিনি খুশহাল পাবলিক স্কুল নামক বেশ কয়েকটি বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা[১৮] এবং ইংরেজি, উর্দু ও পাশতু ভাষাতে দক্ষ মালালা তার নিকট হতেই শিক্ষালাভ করেন।[১৯][২০] একটি সাক্ষাৎকারে তিনি জানান যে তার চিকিৎসক হওয়ার ইচ্ছে থাকলেও তার পিতা তাকে রাজনৈতিক জীবন বেছে নিতে উৎসাহিত করেন।[৩] রাতে সকলে ঘুমিয়ে পড়ার পর জিয়াউদ্দিন মেয়ের সঙ্গে রাজনৈতিক বিষয়ে আলোচনা করতেন।[২১]

মালালা ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে থেকে শিক্ষার অধিকার নিয়ে সরব হতে শুরু করেন, যখন তার পিতা তাকে পেশাওয়ার প্রেস ক্লাবে একটি বক্তব্য রাখতে নিয়ে যান, যা বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম ও টেলিভেশন চ্যানেলে উপস্থাপিত হয়।[২২] ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দে মালালা ইনস্টিটিউট ফর ওয়ার অ্যান্ড পিস রিপোর্টিং প্রতিষ্ঠানের মুক্তচিন্তা পাকিস্তান যুব প্রকল্পে একজন শিক্ষানবিশ ও পরে একজন প্রশিক্ষক হিসেবে কিছুকাল কাজ করেন, যা সাংবাদিকতা, তর্ক-বিতর্ক ও আলোচনার মাধ্যম তরুণ সমাজের মধ্যে বিভিন্ন সামাজিক বিষয়ের ওপর গঠনমূলক আলোচনা করতে উৎসাহিত করত।[২৩]

শিক্ষা

মালালা অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শন, রাজনীতি এবং অর্থনীতিতে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন [২৪]

ব্যক্তিগত জীবন

২০২১ সালের ১০ নভেম্বর মালালা ইউসুফজাই তার সঙ্গী আসার মালিককে ইসলামিক রীতিতে বিয়ে করেছেন। ব্রিটেনের বার্মিংহামে এই বিয়ের অনুষ্ঠিত হয়। জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু করা মালালার স্বামী আসার পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের (পিসিবি) হাই পারফরমেন্স বিভাগের জেনারেল ম্যানেজার।[২৫]

বিবিসি ব্লগার

গতকাল সেনা হেলিকপ্টার আর তালিবানদের নিয়ে একটি ভয়ানক স্বপ্ন দেখি। সোয়াটে সেনা অভিযান শুরু হওয়ার পর থেকে এই ধরনের স্বপ্ন আমি দেখেই চলেছি। আমার মা আমার জন্য সকালের খাবার বানিয়ে দিলেন আর আমি স্কুল চলে গেলাম। আমার স্কুল যেতে ভয় করছিল কারণ তালিবানরা মেয়েদের স্কুলে যেতে নিষেধ করে ফতোয়া দিয়েছিল।[ক]

মালালা ইউসুফজাই, ৩ জানুয়ারি ২০০৯ বিবিসি ব্লগ

২০০৮ খ্রিষ্টাব্দের শেষের দিকে বিবিসি উর্দু ওয়েবসাইটের তরফ থেকে আমের আহমেদ খান ও তার সহকর্মীরা সোয়াত অঞ্চলে তালিবানদের ক্রমবর্ধমান প্রভাব সম্বন্ধে জানার জন্য সেখানকার স্থানীয় কোন মেয়েকে তার জীবন সম্বন্ধে ব্লগ লেখার অনুরোধ করার সিদ্ধান্ত নেন। সেই সময় তেহরীক-ই-নফাজ-ই-শরিয়ত-ই-মোহম্মদি নামক স্থানীয় তালিবান সংগঠনের নেতা মৌলানা ফজলুল্লাহর নেতৃত্বে তালিবানরা সোয়াত উপত্যকায় প্রভাব বিস্তার শুরু করে টেলিভিশন, সঙ্গীত, মেয়েদের শিক্ষা[২৬] ও মহিলাদের কেনাকাটার[২৭] ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। পুলিশদের মস্তকচ্যূত দেহ শহরে প্রকাশ্যে ঝোলানো থাকত।[২৬] পেশাওয়ার শহরে আব্দুল হাই ককর নামক তাদের স্থানীয় সংবাদদাতার সঙ্গে স্থানীয় শিক্ষক জিয়াউদ্দিন ইউসুফজাইয়ের যোগাযোগ ছিল, কিন্তু তারা এই কাজের জন্য কোনো ছাত্রীকে খুঁজে পাননি, কারণ পরিবারের নিকট এই কাজ ছিল যথেষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ। অবশেষে জিয়াউদ্দিন তার নিজের মেয়ে সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী ১১ বছরের মালালাকেই এই কাজের জন্য বেছে নেওয়ার পরামর্শ দিলে,[২৮][২৯] বিবিসি সম্পাদকরা সর্বসম্মতিক্রমে সমর্থন করেন।[২৬]

মালালার নিরাপত্তার জন্য বিবিসির সম্পাদকরা তাকে ব্লগে ছদ্মনাম ব্যবহার করতে বললে,[২৬] মালালা পাশতুন রূপকথার একটি চরিত্রের নাম অনুসারে[৩০][৩১] গুল মকাই ছদ্মনামে লেখেন।[৩২] ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দের ৩ জানুয়ারি বিবিসি উর্দু ব্লগে মালালার লেখা প্রথম প্রকাশিত হয়। হাতে লেখা এই সমস্ত রচনা তিনি একজন সাংবাদিককে দিতেন, যিনি সেগুলিকে স্ক্যান করে বিবিসিকে ই-মেইল করে দিতেন।[২৬] এই রচনাগুলিতে প্রথম সোয়াত যুদ্ধের সময় সামরিক অভিযানের কারণে বিদ্যালয়গুলিতে ছাত্রীদের সংখ্যা কমে যাওয়া ও বিদ্যালয়গুলি বন্ধ হয়ে যাওয়ার ব্যাপারে তার চিন্তা-ভাবনা লিখিত হয়। ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ জানুয়ারির পরে কোনো ছাত্রী বিদ্যালয়ে যেতে পারবে না এই মর্মে তালিবানরা ফতোয়া জারি করে মেয়েদের জন্য নির্দিষ্ট শতাধিক স্কুল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে নষ্ট করে দেয়।[২৬] ১৫ তারিখ ব্লগের লেখাটির কিয়দংশ নিয়ে একটি স্থানীয় সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়।[১৭]

নিষেধাজ্ঞা জারি হওয়ার পর তালিবানরা আরো বহু বিদ্যালয় ধ্বংস করে দেয়।[৩৩] এই সময় মালালা তার বার্ষিক পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।[৩৩] ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে মেয়েদের বিদ্যালয়গুলি বন্ধ ছিল। ছেলেদের বিদ্যালয়গুলিও এই ঘটনার প্রতিবাদে ৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তাদের বিদ্যালয় বন্ধ করে দেয়।[৩৩] ৯ তারিখের পরে তালিবানরা মেয়েদের প্রাথমিক সহ-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে দেয়, কিন্তু শুধুমাত্র মেয়েদের জন্য বিদ্যালয়গুলি বন্ধ থাকে।[৩৩] ১৫ ফেব্রুয়ারি, সরকারের সঙ্গে তালিবানদের শান্তি চুক্তি হয় ও ১৮ তারিখ মালালা ক্যাপিটাল টক নামে একটি জাতীয় সম্প্রচার অনুষ্ঠানে তালিবানদের বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখেন।[৩৪] তিন দিন পরে মৌলানা ফজলুল্লাহ নারিশিক্ষার ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে দেন এবং ১৭ মার্চ পরীক্ষা শেষ না-হওয়া পর্যন্ত মেয়েদের বোরখা পরে বিদ্যালয়ে যাওয়ার অনুমতি দেন।[৩৩] ১২ মার্চ মালালা বিবিসির জন্য শেষ বারের মতো ব্লগ লেখেন।[৩৫]

প্রথমদিকের আন্দোলন

মে মাসে পাকিস্তান সেনাবাহিনী দ্বিতীয় সোয়াত যুদ্ধ চলাকালীন মিঙ্গোরা প্রবেশ করে; এই সময় শহর খালি করে দেওয়া হয়, যার ফলে ইউসুফজাই পরিবার গৃহচ্যুত ও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। জিয়াউদ্দিন পেশাওয়ার চলে যান ও মালালা তার আত্মীয়দের নিকট গ্রামে চলে যান। এই সময় একটি সাংবাদিক সম্মেলনে উগ্রপন্থীদের সমালোচনা করার জন্য জিয়াউদ্দিনকে একজন তালিবান রেডিও মারফত প্রাণনাশের হুমকি দেন।[৩] পিতার আদর্শে অনুপ্রাণিত মালালা এই সময় চিকিৎসক না-হয়ে একজন রাজনীতিবিদ হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।[৩] জুলাই মাসে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী তালিবানদের শহর থেকে হঠিয়ে দিতে সক্ষম হলে প্রধানমন্ত্রী সোয়াত উপত্যকায় ফিরে যাওয়া নিরাপদ বলে ঘোষণা করেন ও ২৪ জুলাই ইউসুফজাই পরিবার আবার একত্রিত হন। এই সময় তারা তৃণমূল পর্যায়ের আন্দোলনকর্মীদের সঙ্গে মার্কিন রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামার আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের বিশেষ মুখপাত্র রিচার্ড হলব্রুকের সঙ্গে সাক্ষাত করেন, যেখানে মালালা তাকে এই পরিস্থিতিতে সাহায্য করার অনুরোধ করেন।[৩]

বিবিসির জন্য লেখা শেষ হওয়ার পর নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকার সাংবাদিক অ্যাডাম এলিক একটি তথ্যচিত্র বানানোর উদ্দেশ্যে মালালা ও তার পিতার সঙ্গে যোগাযোগ করেন।[২৯] এই তথ্যচিত্র বানানো হয়ে গেলে মালালা জাতীয় পাশতু সংবাদমাধ্যম এভিটি খাইবার ও উর্দু সংবাদমাধ্যম ডেইল আজ এবং কানাডার টরন্টো স্টারে সাক্ষাতকার দেন।[২৯] ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ অগাস্ট তিনি ক্যাপিটাল টক অনুষ্ঠানে দ্বিতীয়বার অংশ নেন।[৩৬] এই বছর ডিসেম্বর মাসে বিবিসি ব্লগের লেখিকার আসল পরিচয় হিসেবে তার নাম জানা যায়।[৩৭][৩৮] এই সময় তিনি নারীশিক্ষার জন্য সর্বসমক্ষে টেলিভিশন অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে শুরু করে দেন।

২০১১ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবর মাসে দক্ষিণ আফ্রিকার আন্দোলনকর্মী ডেসমন্ড টুটু আন্তর্জাতিক শিশু শান্তি পুরস্কারের জন্য মালালার নাম মনোনীত করেন। তিনি প্রথম পাকিস্তানি হিসেবে এই পুরস্কারের জন্য মনোনীত হলেও[৩৯] দক্ষিণ আফ্রিকার মিশেল মাইক্রফট এই পুরস্কার লাভ করেন। [৪০] দুই মাস পর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানি তাকে প্রথম জাতীয় যুব শান্তি পুরস্কার প্রদান করেন।[২৬][৩৯] মালালা কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত না-হলেও শিক্ষা প্রসারের উদ্দেশ্যে তার দ্বারা কোনো রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করার ব্যাপারে এই সময় গিলানি আশা প্রকাশ করেন।[৪১] মালালার অনুরোধে গিলানি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সোয়াত ডিগ্রি কলেজ ফর উইমেন প্রতিষ্ঠানে একটি তথ্যপ্রযুক্তি কার্যক্রম চালু করার নির্দেশ দেন। একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় মালালার নামে নামাঙ্কিত করা হয়।[৪২] ২০১২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মালালা এডুকেশ ফাউন্ডেশন তৈরি করে দরিদ্র মেয়েদের বিদ্যালয়মুখি করার প্রচেষ্টা শুরু করেন।[৪৩]

হত্যা প্রচেষ্টা

মালালা ধীরে ধীরে বিখ্যাত হতে শুরু হলে তার বিপদ বাড়তে শুরু করে। সংবাদপত্রে প্রকাশ করে, বাড়িতে ও ফেসবুকে[২৬] মৃত্যুর হুমকি দেওয়া শুরু হয়।[৪৪] ২০১২ খ্রিষ্টাব্দের গ্রীষ্মকালে তালিবান নেতারা তাকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেন।[৪৪] ২০১২ খ্রিষ্টাব্দের ৯ অক্টোবর, মালালা পরীক্ষা দিয়ে বাসে বাড়ি ফেরার সময়, একজন তালিবান বন্দুকধারী সেই বাসে উঠে পড়েন। এই বন্দুকধারী বাসে উঠে মালালা কে তা জানতে চেয়ে বাসের সকল যাত্রীকে মেরে ফেলার হুমকি দেন[২০] এবং অবশেষে মালালাকে চিহ্নিত করে তিনটি গুলি ছোড়ে, যার মধ্যে একটি তার কপালের বাঁ দিক দিয়ে ঢুকে মুখুমণ্ডল ও গলা দিয়ে কাঁধে পৌঁছয়।[৪৫] এই ঘটনায় কায়নাত রিয়াজ ও শাজিয়া রমজান নামক আরো দুই মেয়ে আহত হন।[৪৬]

চিকিৎসা

মালালাকে পেশাওয়ার শহরের একটি সামরিক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়, যেখানে চিকিৎসকরা তার ওপর অস্ত্রোপচার করেন।[৪৭] পাঁচ ঘণ্টার অস্ত্রোপচারের পর চিকিৎসকরা তার কাঁধ থেকে গুলিটিকে বের করে আনতে সক্ষম হন। গুলির প্রভাবে মস্তিষ্কের কিছুটা অংশ ফুলে উঠেছিল বলে পরদিন পুনরায় ডিকম্প্রেসিভ ক্রেনিয়েক্টমি নামক অস্ত্রোপচার করে তারা মালালার খুলির কিছুটা অংশ অপসারণ করতে বাধ্য হন।[৪৮] ১১ অক্টোবর, পাকিস্তানি ও ব্রিটিশ চিকিৎসকের একটি দল তাকে রাওয়ালপিণ্ডি শহরের আর্মড ফোর্সেস ইনস্টিটিউট অব কার্ডিওলজি প্রতিষ্ঠানে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।[৪৮] গৃহমন্ত্রী রেহমান মালিক আশ্বাস দেন যে মালালাকে সরকারি খরচে চিকিৎসক দলের তত্ত্বাবধানে জার্মানিতে উন্নত চিকিৎসার জন্য পাঠানো হবে।[৪৯][৫০] ১৩ অক্টোবর মালালার ঘুমের ওষুধের মাত্রা কমানো হয় এবং এই দিন তিনি তার হাত পা নাড়াতে সক্ষম হন।[৫১]

সারা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মালালার চিকিৎসার জন্য প্রস্তাব আসতে থাকে।[৫২] ১৫ অক্টোবর, চিকিৎসক ও পরিবারের সম্মতিতে তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য সম্পূর্ণ সরকারি খরচে[৫৩] যুক্তরাজ্যের বার্মিংহ্যাম শহরের কুইন এলিজাবেথ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।[৫৪]

২০১২ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ অক্টোবর চিকিৎসায় সাড়া দিয়ে মালালা চেতনা ফিরে পান[৫৫] এবং পরবর্তী কয়েকদিন সংক্রমণের সঙ্গে লড়াই চললেও[৫৬] তার অবস্থা ধীরে ধীরে স্থিতিশীল হয়ে ওঠে এবং ৮ নভেম্বর তিনি বিছানায় উঠে বসতে সক্ষম হন।[৫৭] ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দের ৩ জানুয়ারি তাকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয় এবং ওয়েস্ট মিডল্যান্ডস অঞ্চলে তার পরিবারের সাময়িক বাসস্থানে তার পরবর্তী চিকিৎসা চলে।[৫৮][৫৯] ২ ফেব্রুয়ারি, তার খুলির অংশ পুনর্গঠনের জন্য এবং ককলিয়ার ইমপ্লান্ট বসিয়ে শ্রবণশক্তি ফিরিয়ে আনার জন্য অস্ত্রোপচার করা হয়।[৬০][৬১]

প্রতিক্রিয়া

তেহরিক-ই-তালিবান নামক সংগঠনের মুখপাত্র এহসানুল্লাহ এহসান এই ঘটনার দায় স্বীকার করতে গিয়ে বলেন যে বিধর্মী ও অশ্লীলতার প্রতীক মালালা যদি এই ঘটনা থেকে বেঁচে ওঠেন, তবে তারা আবার তাকে আক্রমণ করবেন।[৬২] এই আক্রমণের পেছনে তালিবানরা যুক্তি দেন যে, তারা জিয়াউদ্দিনকে নিজ কন্যাকে তাদের বিরুদ্ধে কথা না-বলার জন্য বারবার সাবধান করলেও তিনি তা শোনেননি এবং সেই কারণে এই আক্রমণ করতে তারা বাধ্য হন।[৪৬] তারা আরো যুক্তি দেন যে কুরআনে উল্লিখিত রয়েছে যে, ইসলামের বিরুদ্ধে যারা মতপ্রকাশ করবেন তাদের হত্যা করা উচিত এবং তাদের মতে শরিয়ত অনুসারে শিশুদেরকেও একই কারণে হত্যা করার বিধান দেওয়া রয়েছে।[৬৩]

২০১২ খ্রিষ্টাব্দের ১২ অক্টোবর পাকিস্তানের ৫০জন মুসলিম মৌলবী মালালাকে আক্রমণকারী বন্দুকধারীদের বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি করেন। সুন্নি ইত্তেহাদ কাউন্সিলের ইসলামি পণ্ডিতরা সর্বসমক্ষে পাকিস্তানি তালিবানদের আক্রমণের পেছনে যুক্তিপ্রদর্শনকে ধিক্কার জানান।[৬৪] যদিও সমগ্র পাকিস্তান জুড়ে এই আক্রমণের নিন্দা করা হয়,[৬৫] তবুও কয়েকটি পাকিস্তানি উগ্র রাজনৈতিক দল ষড়যন্ত্র তত্ত্ব প্রচার করতে শুরু করে। তারা বলতে শুরু করেন যে, মালালার ওপর এই আক্রমণ মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি দ্বারা পরিচালিত হয়, যাতে আমেরিকা পাকিস্তানের ওপর ড্রোন আক্রমণ বজায় রাখার ছুতো পায়।[৬৬] তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তান ও অন্যান্য তালিবানপন্থী সংগঠন মালালাকে মার্কিন গুপ্তচর রূপে প্রচার করে।[৬৭][৬৮][৬৯][৭০]

এই হত্যা প্রচেষ্টা সারা বিশ্বের সংবাদমাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং জনসাধারণের মধ্যে মালালার জন্য সহমর্মিতা ও তালিবানদের বিরুদ্ধে ক্রোধের সঞ্চার ঘটে। আক্রমণের পরের দিন পাকিস্তানের বিভিন্ন শহরে প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয় এবং কুড়ি লক্ষাধিক মানুষ পাকিস্তানে শিক্ষার অধিকারের পক্ষে স্বাক্ষর করেন, যার ফলে পাকিস্তানের প্রথম শিক্ষার অধিকার বিল আইন হিসেবে স্বীকৃত হয়।[৭][৭১][৭২] পাকিস্তানি আধিকারিকরা আক্রমণকারীদের তথ্য পেতে ও চিহ্নিত করতে এক কোটি টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেন। জিয়াউদ্দিন এই নিরাপত্তাহীনতা ও সংকটের মধ্যেও দেশ ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে অস্বীকৃত হন।[৫০]

পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি আসিফ আলি জারদারি এই আক্রমণকে সভ্য মানুষের ওপর আক্রমণ বলে বর্ণনা করেন।[৭৩] জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি-মুন এই ঘটনাকে একটি জঘন্য ও কাপুরুষোচিত পদক্ষেপ বলে বর্ণনা করেন।[৭৪] মার্কিন রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামা এই ঘটনাকে ঘৃণ্য ও দুঃখজনক বলে উল্লেখ করেন[৭৫] ও রাষ্ট্রসচিব হিলারি ক্লিন্টন বলেন যে ইউসুফজাই সাহসিকতার সঙ্গে মেয়েদের অধিকারের জন্য লড়াই করায় তালিবানরা তার ক্ষমতায় আশঙ্কিত হয়ে তাকে আক্রমণ করেন।[৭৬] ব্রিটিশ বিদেশসচিব উইলিয়াম হেগ এই ঘটনাকে বর্বরোচিত বলে উল্লেখ করেন যা পাকিস্তান ও সমগ্র বিশ্বকে স্তম্ভিত করেছে।[৭৭]

আক্রমণের দিন লস অ্যাঞ্জেলেস শহরে একটি সঙ্গীতানুষ্ঠানে মার্কিন গায়িকা ম্যাডোনা হিউম্যান নেচার নামক তার গানটি মালালাকে উৎসর্গ করেন।[৭৮] এবং নিজের পিঠে মালালার চিত্র সংবলিত একটি ট্যাটু অঙ্কন করেন।[৭৯] মার্কিন অভিনেত্রী অ্যাঞ্জেলিনা জোলি এই ঘটনা সম্বন্ধে একটি নিবন্ধ লেখেন[৮০] মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন ফার্স্ট লেডি লরা বুশ দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকায় একটি নিবন্ধে মালালাকে অ্যানা ফ্র্যাংকের সঙ্গে তুলনা করেন।[৮১] ভারতীয় পরিচালক আমজাদ খান মালালার ওপর একটি জীবনীমূলক চলচ্চিত্র তৈরি করার কথা ঘোষণা করেন।[৮২]

জাতিসংঘের প্রস্তাব

২০১২ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ অক্টোবর, জাতিসংঘের বৈশ্বিক শিক্ষার বিশেষ দূত তথা প্রাক্তন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউন হাসপাতালে মালালার সঙ্গে দেখা করেন[৮৩] এবং আমি মালালা স্লোগান ব্যবহার করে শিশু শিক্ষার ওপর একটি প্রস্তাব রাখেন। এই প্রস্তাবের দাবি ছিল যাতে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত বিশ্বের ৬ কোটি ১০ লক্ষ শিশুকে ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দের শেষে বিদ্যালয়মুখি হয়।[৮৪] এই প্রস্তাবে পাকিস্তান সরকারের কাছে সকল শিশুকে শিক্ষার সুযোগ করে দেওয়ার ও বিশ্বের সকল দেশে মেয়েদের প্রতি বৈষম্যকে অপরাধ বলে ঘোষণা করার আবেদন করা হয়।[৮৪]

বিচার

মালালার ওপর আক্রমণের পরের দিন পাকিস্তানের গৃহমন্ত্রী রেহমান মালিক ঘোষণা করেন যে আক্রমণকারী চিহ্নিত হয়েছে।[৮৫] পুলিশ বন্দুকধারী হিসেবে রসায়নের স্নাতক স্তরের ছার আত্তাউল্লাহ খানের নাম করেন।[৮৬] তারা এই আক্রমণের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে ছয়জনকে গ্রেপ্তার করেন কিন্তু প্রমাণাভাবে তারা ছাড়া পেয়ে যায়।[৮৭]

২০১৪ খ্রিষ্টাব্দের ১২ জানুয়ারি, ইন্টার-সার্ভিসেস পাবলিক রিলেশনস ডিরেক্টর মেজর জেনারেল আসিম বাজোয়া ইসলামাবাদ শহরে সাংবাদিকদের বলেন যে, ইস্রারুর রহমান নামক একজন উগ্রপন্থীকে প্রথমে চিহ্নিত করে তার কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে মালালার ওপর আক্রমণের সঙ্গে যুক্ত উগ্রপন্থীদের সেনা, পুলিশ ও গুপ্তচর সংস্থার যৌথ অভিযানে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।[৮৮][৮৯] ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিল মাসে, সন্ত্রাসবাদ-বিরোধী বিভাগের বিচারপতি মোহম্মদ আমিন কুন্দি এই দশজনকে আজীবন কারাবাসের নির্দেশ দেন।[৯০] কিন্তু কয়েক সপ্তাহের মধ্যে এই দশজনের মধ্যে আটজনকে গোপনে ছেড়ে দেওয়া হয়।[৯১][৯২][৯৩]

জাতিসংঘে বক্তৃতা

সন্ত্রাসবাদীরা ভেবেছিল তারা আমার লক্ষ্য পরিবর্তন করে দেবে আর আমার আকাঙ্ক্ষাকে বন্ধ করে দেবে, কিন্তু আমার জীবনে কিছুই পাল্টায়নি এটুকু ছাড়া: দুর্বলতা, ভয় আর নিরাশা মরে গেছে। শক্তি, ক্ষমতা আর সাহসের জন্ম হয়েছে ... আমি কারোর বিরুদ্ধে নই, বা আমি এখানে তালিবান বা অন্য কোন সন্ত্রাসবাদী দলের বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত আক্রোশ সম্বন্ধে বলতে আসিনি। আমি এখানে প্রতিটি শিশুর শিক্ষার অধিকারের পক্ষে বলতে এসেছি। আমি তালিবান এবং সকল সন্ত্রাসবাদী ও উগ্রপন্থীদের ছেলে মেয়েদের জন্য শিক্ষা চাই। ... আসুন আমরা অশিক্ষা, দারিদ্র্য ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে একটি মহান সংগ্রাম শুরু করি, আমরা আমাদের বই আর আমাদের কলম তুলে নিই, ওগুলোই সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র। একটি শিশু, একজন শিক্ষক, একটি বই আর একটি কলম দুনিয়া বদলে দিতে পারে। শিক্ষাই একমাত্র সমাধান।[খ]

২০১৩ খ্রিস্টাব্দের ১২ জুলাই জাতিসংঘের ভাষণে মালালার বক্তব্যের কিয়দংশ

গর্ডন ব্রাউনের হস্তক্ষেপে ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দের ১২ জুলাই মাসে মালালা সারা বিশ্বের পাঁচশ জন শিক্ষা আন্দোলনকর্মীর সামনে[৯৫] জাতিসংঘে ভাষণ দেন ও বিশ্বের সকলের জন্য শিক্ষার জন্য আবেদন করেন।[৮৩] তার ওপর আক্রমণের পরে এই ছিল তার প্রথম বক্তৃতা।[৯৪] জাতিসংঘের বৈশ্বিক শিক্ষার অংশ হিসেবে যুবসমাজ দ্বারা লিখিত শিক্ষার অধিকার সংক্রান্ত একটি সংকল্পপত্রও তিনি পাঠ করে শোনান। এই ঘটনাকে স্মরণ করতে জাতিসংঘ এই দিনকে মালালা দিবস বলে ঘোষণা করে।[৯৬][গ] জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি-মুন এই মঞ্চে মালালাকে একজন বীরাঙ্গনা বলে বর্ণনা করেন।[৯৬]

আন্তর্জাতিক কর্মকাণ্ড

বারাক ওবামা, মিশেল ওবামা, ও তাঁদের কন্যা মালিয়ার সঙ্গে ওভাল অফিসে মালালা, ১১ অক্টোবর ২০১৩
স্ট্রাসবুর্গে বিশেষ সফরে ইউসুফজাই, নভেম্বর ২০১৩

২০১৩ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই মাসে মালালা বাকিংহ্যাম প্রাসাদে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের সঙ্গে সাক্ষাত করেন।[৯৮] সেপ্টেম্বরে তিনি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দেন[৯৮], অক্টোবর মাসে তিনি রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামার সঙ্গে সাক্ষাত করেন।[৯৯] ও ডিসেম্বর মাসে তিনি অক্সফোর্ড ইউনিয়নে বক্তৃতা দেন।[১০০] ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই মাসে তিনি লন্ডন শহরে অনুষ্ঠিত গার্ল সামিটে মেয়েদের অধিকার নিয়ে বক্তব্য রাখেন।[১০১][১০২] ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ওয়ার্ল্ড'স চিল্ড্রেন'স প্রাইজ ফর দ্য রাইটস অব দ্য চাইল্ড পুরস্কার লাভ করার পর প্যালেস্তাইনীয় উদ্বাস্তুদের জন্য কর্মরত ইউনাইটেড নেশনস রিলিফ অ্যান্ড ওয়ার্কস এজেন্সি প্রতিষ্ঠানকে গাজাতে ৬৫টি বিদ্যালয় তৈরি করার জন্য $ ৫০,০০০ দান করেন।[১০৩]

শিক্ষাপ্রসারের উদ্দেশ্যে মালালা ফান্ড নামে একটি দাতব্য তহবিল খোলা হয়। গর্ডন ব্রাউনের অনুরোধে ম্যাককিনসে অ্যান্ড কোম্পানির উপদেষ্টা ও ইউসুফজাই পরিবারের সদস্য শিজা শাহিদ এই তহবিলের প্রধান দায়িত্ব নেন। গুগলের সহকারী অধিকর্তা মেগান স্মিথ এই তহবিল বোর্ডের সদস্য।[১০৪] অ্যাঞ্জেলিনা জোলি নারীশিক্ষার জন্য মালালা ফান্ডে $ ২০০,০০০ প্রদান করেন।[১০৫][১০৬] ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দের ১২ জুলাই নিজের অষ্টাদশ জন্মদিনে এই তহবিলের সাহায্যে মালালা সিরিয়ার ১৪ থেকে ১৮ বছর বয়সী উদ্বাস্তু মহিলাদের জন্য লেবাননের বেকা উপত্যকায় একটি বিদ্যালয় ও কর্মশালা স্থাপন করেন। তিনি বিশ্বের নেতৃবৃন্দকে গুলির বদলে বইয়ের ওপর জোর দিতে আবেদন করেন।[১০৭][১০৮]

নোবেল শান্তি পুরস্কার

বহিঃস্থ ভিডিও
মালালার নোবেল বক্তৃতা

২০১৪ খ্রিষ্টাব্দের ১০ অক্টোবর, শিশুদের প্রতি অবিচারের বিরুদ্ধে ও শিক্ষার অধিকারের লড়াইয়ের জন্য মালালা ইউসুফজাই ও ভারতীয় সমাজকর্মী কৈলাশ সত্যার্থীকে নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রদান করা হয়।[১০৯] মাত্র ১৭ বছরে মালালা এই পুরস্কারলাভের সময় বিশ্বের সর্বকনিষ্ঠ নোবেলজয়ীর সম্মান লাভ করেন।[১২][১৩][১১০] ১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্দে পদার্থবিজ্ঞানী আব্দুস সালামের পর তিনি দ্বিতীয় পাকিস্তানি নাগরিক যিনি এই পুরস্কার লাভ করেন।[১১১] তার নোবেল জয় সম্বন্ধে বিভিন্ন মহলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যায়।[১১২][১১৩][১১৪][১১৪]

২০১৪ ইগুয়ালা গণ অপহরণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে মেক্সিকোর একজন নাগরিক এই পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে বাধা দিলেও নিরাপত্তারক্ষীরা তাকে দ্রুত সরিয়ে নিয়ে যান। মালালা পরে এই ব্যক্তির প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করেন।[১১৫]

রচনা

সহ-লেখিকার ভূমিকায় ব্রিটিশ সাংবাদিক ক্রিস্টিনা ল্যাম্বকে রেখে মালালার স্মৃতিকথা আই অ্যাম মালালা: দ্য স্টোরি অব দ্য গার্ল হু স্টুড আপ ফর এডুকেশন অ্যান্ড ওয়াজ শট বাই দ্য তালিবান (ইংরেজি: I Am Malala: The Story of the Girl Who Stood Up for Education and was Shot by the Taliban) ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবর মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে লিটল, ব্রাউন অ্যান্ড কোপানি ও ইংল্যান্ডে ওয়েদেনফিল্ড অ্যান্ড নিকলসন দ্বারা প্রকাশিত হয়।[১১৬] দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকার সমালোচক ফতিমা ভুট্টো একে একটি সাহসী বই বলে মত দেন এবং মালালার নিন্দুকদেরকে এই বই পড়ার পরামর্শ দেন, যদিও তিনি ক্রিস্টিনা ল্যাম্বের জড়তাপূর্ণ ও সবাজান্তা ভাবকেও কঠোর সমালোচনা করেন।[১১৭] মেরি আরানা নামক দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকার একজন সমালোচক অ্যানা ফ্র্যাংকের ডায়েরির সঙ্গে এই বইয়ের তুলনা করেন।[১১৮] এন্টারটেইনমেন্ট উইকলি মন্তব্য করে যে সহ-লেখিকার কল্যাণে মালালার সাহসী শব্দ এই বইয়ে অনেকটাই খাট হয়ে গিয়েছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও তার বার্তা নিখাদ রয়েছে।[১১৯]

ইসলাম অবমাননার দায়ে অভিযুক্ত করে সারা পাকিস্তান বেসরকারি বিদ্যালয় ফেডারেশন তাদের এক লক্ষ বাহান্ন হাজার বিদ্যালয়ে এই বইটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।[১২০] পাকিস্তানের সম্পাদক আনসার আব্বাসি মন্তব্য করেন যে, এই বই মালালার সমালোচকদের মতকেই পোক্ত করে যে, তিনি পাকিস্তান ও ইসলামবিরোধী একজন পশ্চিমী দালাল।[১২১]

২০১৪ খ্রিষ্টাব্দে আই অ্যাম মালালা: হাউ ওয়ান গার্ল স্টুড আপ ফর এডুকেশন অ্যান্ড চেঞ্জড দ্য ওয়ার্ল্ড (ইংরেজি: I Am Malala: How One Girl Stood Up for Education and Changed the World) নামে এই বইয়ের একটি শিশু সংস্করণ প্রকাশিত হয়।[১২২] এই বইয়ের অডিও বা শ্রবণযোগ্য সংস্করণটি ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দের সেরা শিশুদের অ্যালবামের জন্য গ্র্যামি পুরস্কার জিতে নেয়।[১২৩][১২৪]

পুরস্কার ও সম্মাননা

শাখারভ পুরস্কার প্রদান মঞ্চে মালালা, ইউরোপীয় সংসদ, নভেম্বর ২০১৩

মালালা ইউসুফজাই নিম্নলিখিত জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেন:

  • ২০১১: আন্তর্জাতিক শিশু শান্তি পুরস্কার (মনোনীত)[৩৯]
  • ২০১১: জাতীয় যুব শান্তি পুরস্কার[২৬]
  • জানুয়ারি, ২০১২: নৈতিক সাহসিকতার জন্য অ্যানা ফ্র্যাংক পুরস্কার[১২৫][১২৬]
  • অক্টোবর, ২০১২:সিতারা-এ-শুজাত[১২৭]
  • নভেম্বর, ২০১২: ফরেন পলিসি সাময়িকীর সেরা ১০০ বৈশ্বিক চিন্তাবিদ[১২৮]
  • নভেম্বর, ২০১২: মাদার টেরিজা পুরস্কার[১২৯][ঘ][১৩১]
  • ডিসেম্বর, ২০১২: টাইম বর্ষসেরা ব্যক্তিত্ব বাছাই[১৩২]
  • ডিসেম্বর, ২০১২: শান্তি ও মানবতাবাদী কর্মকাণ্ডের জন্য রোম পুরস্কার[১৩৩][১৩৪]
  • জানুয়ারি, ২০১৩: সাইমন দে বোভেয়ার পুরস্কার[১৩৫]
  • মার্চ, ২০১৩: মেম্মিঙ্গার ফ্রেই হেইটস্প্রেইস ১৫২৫[১৩৬][১৩৭])
  • মার্চ, ২০১৩: ডাউটি স্ট্রীট অ্যাডভোকেসি অ্যাওয়ার্ড অব ইন্ডেক্স অন সেন্সরশিপ[১৩৮]
  • মার্চ, ২০১৩: ফ্রেড ও অ্যানা জার্ভিস পুরস্কার[১৩৯]
  • এপ্রিল, ২০১৩: ভাইটাল ভয়েসেস গ্লোবাল লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ডস[১৪০]
  • এপ্রিল, ২০১৩: টাইম সাময়িকী বিশ্বের ১০০ জন সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বের একজন[১৪১]
  • মে, ২০১৩: প্রেমি ইন্তারন্যাসিওনাল কাতালুনিয়া অ্যাওয়ার্ড[১৪২]
  • জুন, ২০১৩: ওপেক আন্তর্জাতিক উন্নয়ন তহবিলের বার্ষিক উন্নয়ন পুরস্কার[১৪৩]
  • জুন, ২০১৩: দ্য অবজার্ভার এথিক্যাল অ্যাওয়ার্ডসের পক্ষ থেকে ২০১৩ সালের সেরা আন্তর্জাতিক প্রচারক[১৪৪]
  • অগাস্ট, ২০১৩: টিপেরারি আন্তর্জাতিক শান্তি পুরস্কার[১৪৫]
  • অগাস্ট, ২০১৩: আন্তর্জাতিক শিশু শান্তি পুরস্কার[১৪৬]
  • সেপ্টেম্বর, ২০১৩: অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের পক্ষ থেকে অ্যাম্বাসাডর অব কনসায়েন্স অ্যাওয়ার্ড[১৪৭]
  • সেপ্টেম্বর, ২০১৩: ক্লিন্টন গ্লোবাল সিটিজেন অ্যাওয়ার্ডস[১৪৮]
  • সেপ্টেম্বর, ২০১৩: হার্ভার্ড ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে পিটার গোমস হিউম্যানিটারিয়ান অ্যাওয়ার্ড[১৪৯]
  • ২০১৩: অ্যানা পোলিতকোবস্কায়া পুরস্কার
  • ২০১৩: ওকলাহোমা সিটি ন্যাশনাল মেমোরিয়ালের পক্ষ থেকে রিফ্লেকশন অব হোপ অ্যাওয়ার্ড[১৫০]
  • ২০১৩: শাখারভ পুরস্কার
  • ২০১৩: এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে সাম্মানিক কলাবিদ্যায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রী[১৫১]
  • অক্টোবর, ২০১৩: প্রাইড অব ব্রিটেন টিনেজার অব কারেজ অ্যাওয়ার্ড[১৫২]
  • নভেম্বর, ২০১৩: গ্ল্যামার ম্যাগাজিন বছরের সেরা নারী[১৫৩]
  • নভেম্বর, ২০১৩: জিজি২ হ্যামার পুরস্কার[১৫৪]
  • নভেম্বর, ২০১৩: ইন্টারন্যাশনাল প্রাইজ ফর ইক্যুয়ালিটি অ্যান্ড নন-ডিসক্রিমিনেশন[১৫৫]
  • ফেব্রুয়ারি, ২০১৪: শিশু অধিকারের জন্য বিশ্ব শিশু পুরস্কার[১৫৬]
  • মার্চ ২০১৪: আয়ার্ল্যান্ডের এক্সিকিউটিভ ইউনিয়নের সাম্মানিক আজীবন সদস্যপদ[১৫৭]
  • ২০১৪: স্কোল গ্লোবাল ট্রেজার অ্যাওয়ার্ড[১৫৮]
  • ২০১৪: সাম্মানিক ডক্টরেট, ইউনিভার্সিটি অব কিং'স কলেজ, হ্যালিফ্যাক্স, কানাডা[১০]
  • যুগ্মভাবে ভারতের কৈলাশ সত্যার্থীর সঙ্গে ২০১৪: নোবেল শান্তি পুরস্কার[১৩]
  • ২০১৪: ফিলাডেলফিয়া লিবার্টি মেডেল[১৫৯]
  • ২০১৪: টাইম ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দের সবচেয়ে প্রভাবশালী ২৫ জন কিশোরবয়স্কদের একজন[১৬০]
  • ২০১৪: সাম্মানিক কানাডীয় নাগরিকত্ব
  • ২০১৫: তার সম্মানে একটি গ্রহাণুর নামকরণ ৩১৬২০১ মালালা করা হয়। [১৬১]

জনপ্রিয় মাধ্যমে

২০১৫ খ্রিষ্টাব্দের ২ অক্টোবর মার্কিন চলচ্চিত্র নির্মাতা ডেভিস গুগেনহাইমের পরিচালনায় হি নেমড মি মালালা নামক একটি তথ্যচিত্র মুক্তিলাভ করে।[১৬২][১৬৩][১৬৪] ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেল ২৯ ফেব্রুয়ারি এই চলচ্চিত্র সম্প্রচার করে।[১৬৫]

বোজ্যাক হর্সম্যান নামক একটি টেলিভিশন ধারাবাহিকের স্টিল ব্রোকেন নামক একটি পর্বে, সেই পাকিস্তানি মেয়ে যে নোবেল পুরস্কার জিতেই চলেছে, এইরকম একটি উক্তিতে মালালার কথা উল্লেখ করা হয়।[১৬৬]

পাদটীকা

তথ্যসূত্র

বহিঃসংযোগ

🔥 Top keywords: রাম নবমীমুজিবনগর দিবসপ্রধান পাতামুজিবনগর সরকারবিশেষ:অনুসন্ধানইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগএক্স এক্স এক্স এক্স (অ্যালবাম)বাংলাদেশবাংলা ভাষামিয়া খলিফারাজকুমার (২০২৪-এর চলচ্চিত্র)আনন্দবাজার পত্রিকাআবহাওয়ারামপহেলা বৈশাখউয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগইসরায়েলইরানরবীন্দ্রনাথ ঠাকুরমুজিবনগরইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউনরিয়াল মাদ্রিদ ফুটবল ক্লাব২০২৪ ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগক্লিওপেট্রাচর্যাপদভূমি পরিমাপশেখ মুজিবুর রহমানজনি সিন্সকাজী নজরুল ইসলামঈদুল আযহাফিলিস্তিনইউটিউবভারতবিকাশআসসালামু আলাইকুমসৌদি আরববাংলা প্রবাদ-প্রবচনের তালিকামুহাম্মাদ